সংবাদ
২৯শে জানুয়ারি ১৯৬৯
ষড়যন্ত্র মামলা : বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিবর রহমানের বক্তব্য :
এই মামলা কায়েমী স্বার্থের শোষণ অব্যাহত রাখার একটি ষড়যন্ত্র
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্যের ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান গতকাল (মঙ্গলবার) বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করিয়া প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেন, যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চলিয়া আসিতেছে, এই মামলা উহারই চরম অধ্যায়। ইহা কায়েমী স্বার্থবাদী শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য বর্তমান শাসকচক্রের একটি ষড়যন্ত্রও বটে। “পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হইতে আলাদা করার জন্য আমি কখনও কিছু করি নাই। এবং আমি কখনও সশস্ত্র বাহিনী, নৌবাহিনী অথবা বিমান বাহিনীর কোন বা অন্য কাহারও সহিত পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হই নাই। আমি নির্দোষ এবং সম্পূর্ণ নিরপরাধ এবং কথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”
আওয়ামী লীগ প্রধান তাঁহার জবানবন্দীতে বলেনঃ শুধুমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালানোর জন্য, আমার এবং আমার পার্টিকে হেয় প্রতিপন্ন ও অসম্মান করার জন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবী অর্থাৎ ৬-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে দাবাইয়া রাখার জন্য এবং সকল ক্ষেত্রে বিশেষতঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং চাকুরীর ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠার পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষা করার জন্যই এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে আমাকে মিথ্যাভাবে জড়িত করা হইয়াছে।
তিনি বলেনঃ এই আদালতে আসার পূর্বে আমি কখনও লেঃ কামাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, লেঃ মোজাম্মেল হোসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হোসেন, এল/এস সুলতানউদ্দীন আহমেদ, কামাল উদ্দীন আহমেদ, ষ্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ এবং সশস্ত্র, নৌ ও বিমান বাহিনীর অন্যান্য লোককে দেখি নাই। মন্ত্রী থাকাকালে আমার অফিসিয়াল কাজের মাধ্যমে মেসার্স আহমেদ ফজলুল রহমান, রুহুল কুদ্দুস ও কে, এম, শামসুর রহমান—এই তিনজন সি,এস,পি অফিসারকে আমি জানিতে পারি। ঐ সময় তাঁহারা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে কাজ করিতেছিলেন। তবে, আমি তাঁহাদের সহিত রাজনীতি বা কোন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কখনও কোন কথা বলি নাই।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন : আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কখনও বিশ্বাস করি না। আমি দেশের উভয় অংশের প্রতি ন্যায়বিচার চাহিয়াছিলাম এবং ৬-দফা কর্মসূচীতে উহা সন্নিবেশিত রহিয়াছে। দেশের জন্য আমি যা ভাল মনে করি সর্বদাই তা নিয়মতান্ত্রিক সীমারেখার মধ্যে প্রকাশ্যে প্রকাশ করি। তৎসত্ত্বেও শাসকচক্র ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক আমাকে নির্যাতিত হইতে হয়। এই শাসকচক্র ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল আমার এবং আমার পার্টির উপর নির্যাতন চালাইয়া পাকিস্তানী জনগণকে, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের উপর তাঁহাদের শোষণ স্থায়ী করিতে চায়।
মহামান্য আদালতের সম্মুখে আওয়ামী লীগ প্রধান আরও বলেন যে, এই মামলায় প্রতিশোধ মূলকভাবে তাঁহাকে জড়িত করা হইয়াছে। তিনি বলেন ঃ ১৯৬৮ সনের ৬ই জানুয়ারী পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অভিযুক্ত হিসাবে ২৮ জনের নামের যে তালিকা প্রকাশিত হয়, উহাতে আমার নাম ছিল না। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হইয়াছিল যে, সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিই স্বীকারোক্তি করিয়াছেন, তদন্ত প্রায় শেষ এবং মামলাটি অবিলম্বে বিচারে উঠিবে।
তিনি আরও বলেন: একটি মন্ত্রী দফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে একজন মন্ত্রী হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা হইতে আমি বলিব যে, সংশ্লিষ্ট দলিল ব্যক্তিগত ভাবে যাচাই ও তথ্য সম্পর্কে সন্তুষ্টির পর সংশ্লিষ্ট দফতরের সেক্রেটারী কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত কোন প্রেস বিজ্ঞপ্তি ইস্যু হইতে পারে না। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে প্রেস বিজ্ঞপ্তি ইস্যুর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন।
‘আমি তাসখন্দ ঘোষণা সমর্থন করি’
শেখ মুজিবর রহমান তাঁহার বক্তব্যের আর এক অংশে বলেন : আমি তাসখন্দ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানাইয়াছিলাম, কারণ আমার পার্টি ও আমি নিজে বিশ্বাস করি যে, সকল আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হওয়া উচিত। কারণ, আমরা প্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করি।
জবানবন্দীর প্রথম অংশে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে তাঁহার ভূমিকার, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পার্লামেন্টে তাঁহার সদস্য ও পরে মন্ত্রী হওয়ার কথা, এ সময় গণচীন সফরকারী পাক-প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দান, নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদল গঠনের জন্য কয়েক বৎসর কারাবরণ, সামরিক শাসনের পর গ্রেফতার ও পরে মুক্তি লাভ, ১৯৬২ সনে পুনরায় গ্রেফতার, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন, মিস ফাতেমা জিন্নার সপক্ষে বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা, ১৯৬৫ সনে ভারতীয় হামলার নিন্দা ও প্রতিরোধের আহবান, যুদ্ধকালে গভর্ণর হাউসে সর্বদলীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ঢাকা সফরকালে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও তাঁহার নিকট পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও দেশরক্ষার স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবী জ্ঞাপন, তাসখন্দ ঘোষণা সমর্থন, সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে যোগদান ও ৬-দফা কর্মসূচী পেশ, আওয়ামী লীগ কর্তৃক ৬-দফা গ্রহণ ও জনমত সৃষ্টি, ১৯৬৬ সনের এপ্রিলে যশোরে গ্রেফতার ও পরে জামিনে মুক্তি লাভ ও পুনরায় গ্রেফতার, সিলেটে প্রেরণ ও পরে জামিনে মুক্তিলাভ এবং জেলগেটে পুনরায় গ্রেফতার ও ময়মনসিংহে প্রেরণ ও পরে জামিনে মুক্তি লাভের পর ঢাকা আগমন, ৮ই মে দিবাগত রাত্রে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৩২ ধারায় গ্রেফতার ও তৎপরবর্তীকালে বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী গ্রেফতার, ৭ই জুনের হরতাল, কারাগারে বিভিন্ন মামলার শুনানী, কেন্দ্ৰীয় কারাগার হইতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর ও মানসিক নির্যাতনের শিকার এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অধিবেশন শুরুর পূর্বে কৌসুলি জনাব আবদুল সালাম খানের সহিত তাঁহার সাক্ষাতের কথা বিবৃত করেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯