You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
২৯শে জানুয়ারি ১৯৬৯
আমাকে মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে : শেখ মুজিবের জবানবন্দী :
পূর্ব্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী দাবাইয়া রাখার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলা

ঢাকা, ২৮শে জানুয়ারী। -আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামী জনাব শেখ মুজিবর রহমান অদ্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের নিকট ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে পূৰ্ব্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ অস্বীকার করিয়াছেন।
ফরিয়াদী পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্তির পর জনাব মুজিবর রহমান জবানবন্দীতে তাহার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। জনাব শেখ মুজিবর রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের বৈঠকে যোগ দান করিয়াছেন এবং তাহাদের অর্থ সাহায্য করিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ আনা হইয়াছে। জনাব মুজিবর রহমানের জবানবন্দীর পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :
শেখ মুজিবর রহমান তাঁহার বিবৃতিতে বলেন, “স্কুল শিক্ষা গ্রহণের সময় হইতেই আমি পাকিস্তান অর্জ্জনের জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। আমি প্রাক আজাদী যুগের ভারতীয় ও বঙ্গীয় মোছলেম লীগ প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ছিলাম এবং লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়াও আমি পাকিস্তান দাবী হাসেলের জন্য কাজ করিয়া গিয়াছি।
আজাদী লাভের পর মোছলেম লীগ পাকিস্তানের জনসাধারণের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব এইচ, এস, সোহরাওয়াদ্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি আওয়ামী লীগ পূৰ্ব্বেও নিয়মতান্ত্রিকতার পথ অনুসারী একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিগণিত ছিল এবং এখনও উহা সেইরূপই রহিয়াছে।
১৯৫৪ সালে আমি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্ব্বাচিত হই এবং পরে আমি জাতীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্ব্বাচিত হইয়াছিলাম। আমি দুইবার পূর্ব্ব পাকিস্তান সরকারের উজির হইয়াছিলাম। উহাছাড়াও আমি গণচীনরিপাবলিকে প্রেরিত পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করিয়াছিলাম। জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদল গঠনের জন্য ইতিপূর্ব্বেই এই সময়ের মধ্যে আমাকে কয়েক বৎসর কারাভোগ করিতে হইয়াছে।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে শুরু করেন। তাঁহারা ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তারিখে পূর্ব্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স অনুসারে আমাকে গ্রেফতার করেন এবং প্রায় দেড় বৎসরকাল আমাকে বিনা বিচারে আটক রাখেন। আমি এইভাবে আটক থাকার সময় তাঁহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা রুজু করেন কিন্তু সকল অভিযোগ হইতে আমি সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর অথবা ১৯৬০ সালের জানুয়ারী নাগাদ আমি উক্ত আটক অবস্থা হইতে মুক্তিলাভ করি।
আমার উপর এই মর্ম্মে বিধিনিষেধ জারী করা হয় যে, ঢাকা ত্যাগ করিতে হইলে আমাকে লিখিতভাবে আমি কোন কোন স্থানে যাইতে চাই তাহার বিবরণ স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরও লিখিতভাবে সে বিষয় স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা সব সময় ছায়ার মত আমার পিছনে থাকিয়াছি।
অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারী করার প্রাক্কালে আমার নেতা মরহুম এইচ, এস সোহরওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। সেই সময় আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স অনুসারে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং প্রায় ছয়মাস কাল আমাকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়।
জনাব সোহরওয়ার্দীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের উভয় অংশেই অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসাবে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের অন্যতম অঙ্গদল হিসাবে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্ব্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার সিদ্ধান্ত করি। সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষ হইতে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে জনাব আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নাকে মনোনয়ন দান করা হয়। আমরা তখন নির্ব্বাচনী অভিযান শুরু করি। আমার বক্তৃতাসমূহ সম্পর্কে কয়েকটি মামলা রুজু করিয়া পুনরায় আমার বিরোধিতা ও আমাকে হয়রানী করিতে শুরু করেন।
১৯৬৫ সালে ভারতের সহিত যুদ্ধ চলিতে থাকার সময় যে সকল রাজনৈতিক নেতা ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম এবং সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পুরাপুরিভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানাইয়া আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও উহার সকল ইউনিটের নিকট সার্কুলার প্রেরণ করে।
উক্ত যুদ্ধের সময় পূর্ব্ব পাকিস্তানের গবর্ণরের ভবনে যে সর্ব্ব দলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উহার পক্ষ হইতে আমি এই অংশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সহিত একটি যুক্ত বিবৃতি ইস্যু করি। উক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করা হয় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করিয়া যাওয়ার জন্য এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূৰ্ব্ব পাকিস্তান সফরে আগমন করিলে আমন্ত্রিত হইয়া আমি স্বয়ং এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। উক্ত সাক্ষাৎকারের সময়ে আমি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনদান এবং যুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তোলার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধের সময়ে পূর্ব্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ হইতে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।
আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমার পার্টি ও আমি অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী বিধায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা হওয়া উচিৎ বলিয়া মনে করি।
১৯৬৬ সালের গোড়ারদিকে লাহোরে একটি সর্ব্বদলীয় জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের উপায় হিসাবে ছয়দফা কৰ্ম্মসূচী পেশ করি। ছয়দফা কর্মসূচীতে পূর্ব্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়কেই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের কথা বলা হইয়াছে।
অতঃপর আমার পার্টি পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয়দফা কৰ্ম্মসূচী গ্রহণ করে এবং যাহাতে দেশের উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্যমূলক অবস্থা দুর করা যাইতে পারে তাহার জন্য উহার (অর্থাৎ ছয় দফার) অনুকূলে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে আমরা জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হই।
ইহাতে সরকারী যন্ত্র এবং প্রেসিডেন্টসহ সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ আমার প্রতি ‘অস্ত্রের ভাষায়’ ও ‘গৃহযুদ্ধের’ হুমকি প্রদান করেন এবং আমার বিরুদ্ধে ডজন খানেকেরও বেশী মামলা রুজু করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করেন। তাঁহারা প্রথমে ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে যশোরে আমাকে গ্রেফতার করেন। এ সময়ে আমি খুলনায় জনসভা অনুষ্ঠানের পর যশোর হইয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিতে ছিলাম।
আপত্তিকর বলিয়া কথিত বক্তৃতাদানের অভিযোগে ঢাকা হইতে প্রেরিত গ্রেফতারী পরোয়ানা বলে তথায় আমাকে আটক ও গ্রেফতার করা হয়।
আমাকে ঢাকায় মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজীর করা হয়। আমি ঢাকার সদর মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হই, কিন্তু তিনি আমার জামীন মন্জুর করিতে অস্বীকার করেন। তবে মাননীয় দায়রা জজ আমার জামীন মন্জুর করিলে ঐদিনই আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি সন্ধ্যা ৭টার সময় স্বগৃহে আগমন করি। ঐদিনই রাত ৮টার সময় সিলেটে তথাকথিত আপত্তিকর বক্তৃতা দানের ব্যাপারে সিলেট হইতে প্রেরিত একটা গ্রেফতারী পরোয়ানা সহ পুনরায় পুলিশ আমার গৃহে উপস্থিত হয়। আমাকে তখন গ্রেফতার করা হয়। এবং ঐদিনই রাত্রিতে পুলিশ পাহারাধীনে আমাকে সিলেটে লইয়া যাওয়া হয়। পরদিন সকালে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি আমাকে জেলে পাঠান। পরদিন সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামীন মঞ্জুর করেন। মুক্তিদানের পর পুলিশ, মোমেনশাহীর এক জনসভার আপত্তিকর বলিয়া কথিত একটি বক্তৃতাদানের দায়ে মোমেনশাহী হইতে প্রেরিত একটি গ্রেফতারী পরোয়ানা বলে সিলেটে আমাকে গ্রেফতার করে। আমাকে মোমেনশাহীর মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজীর করা হয়। অনুরূপভাবে তিনি আমার জামীন মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করেন এবং আমাকে মোমেনশাহী জেলে প্রেরণ করেন। ধারাবাহিকভাবে এই সকল গ্রেফতার, হয়রানি ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন মোমেনশাহীর দায়রা জজ আমার জামীন মন্জুর করেন এবং জেল হইতে মুক্তিলাভ করিয়া আমি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবতঃ ৮ই মে তারিখে আমি নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতাদান করি এবং রাত্রিতে আমি আমার ঢাকার বাসায় প্রত্যাবর্ত্তন করি। ঐদিন রাত্রি একটার সময় পুলিশ পাকিস্তান রক্ষাবিধি অনুসারে আমাকে গ্রেফতার করে। উহার পরই পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাজুদ্দীন আহমেদ, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মুজিবর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী এম, এ, আজিজ, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ট্রেজারার নুরুল ইসলাম চৌধুরী, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের লেবার সেক্রেটারী জহুর আহমেদ চৌধুরী সহ অন্যান্য বহুসংখ্যক পার্টি নেতাকে যুগপৎ গ্রেফতার করা হয়। কয়েকদিন পরে এম, এন, এ ও পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অর্গানাইজিং সেক্রেটারী মেসার্স মিজানুর রহমান পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পাবলিসিটি সেক্রেটারী এ মোমেন, পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সোসাল সেক্রেটারী ওবাইদুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শামসুল হক, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হাফিজ মোহাম্মদ মুসা, এডভোকেট ও পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মোল্লা জালালুদ্দীন আহমদ, প্রাক্তন উজির ও পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম, এন, এ আমজাদ হোসেন, এডভোকেট আমিনুদ্দীন আহমেদ, পাবনার এডভোকেট আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা সারোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী মহিউদ্দিন আহমদ, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদুল্লাহ, এডভোকেট ও অন্যতম নেতা জনাব শাহ মোয়াজ্জাম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সেক্রেটারী জনাব বজলুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব সিরাজুদ্দিন আহমদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব হারুন অর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, ঢাকা সদর নর্থ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব আবদুল হাকিম, ধানমণ্ডী আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব রশীদ মোশাররফ, সিট আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব সুলতান আহমদ, গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ কম্মী জনাব নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব এ মান্নান, পাবনার এডভোকেট জনাব হাসনাইন, মোমেনশাহীর গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব এ, রহমান সিদ্দিকী এবং অন্যান্য বহুসংখ্যক কর্মী ও ছাত্র এবং শ্রমিকনেতাকে পাকিস্তান …(অস্পষ্ট) ধারা অনুসারে গ্রেফতার করা হয় ও কারাগারে আটক রাখা হয়। তাহারা আমার দুইজন ভ্রাতুষ্পুত্র প্রাক্তন জি,এস,ই,পি,এস,এল শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ রাখিয়াছে।
উপরোক্তগুলি ছাড়াও সরকার পূর্ব্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র ইত্তেফাককে নিষিদ্ধ করিয়াছেন। উহার একমাত্র করণ এই যে, উক্ত পত্রিকা কখনও কখনও আমার পার্টির অভিমতকে সমর্থন করিত। সরকার উহার প্রেসকেও বাজেয়াফত করিয়াছেন, উহার সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক মর্য্যাদাসম্পন্ন স্বনামধন্য সাংবাদিক জনাব তোফাজ্জল হোসেন ওরফ মানিক মিয়াকে আটক করেন, তাঁহাকে দীর্ঘদিন ধরিয়া কারাগারে রাখেন এবং তাঁহার বিরুদ্ধে কয়েকটি ফৌজদারী মামলা রুজু করেন। চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাষ্টের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধি অনুসারে কারারুদ্ধ করা হয়।
আমাদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে আমার পার্টি ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন তারিখে সাধারণ ধর্ম্মঘট আহ্বান করে। সারা প্রদেশে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবাদ ধর্ম্মঘটের সময়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলী চালনায় ১১ জন নিহত হয়, প্রায় ৮০০ জন কর্ম্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং অন্যান্য অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে কতিপয় মামলা রুজু করা হয়।
পূর্ব্ব পাকিস্তানের গবর্ণর জনাব গবর্ণর জনাব মোনায়েম মোনায়েম খান কম বেশি খোলাখুলিভাবেই দলে দলে অফিসার ও অন্যান্যদের বলেন যে, যতদিন তিনি (জনাব মোনায়েম খান) বৰ্ত্তমান থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবর রহমানকে কারাগারে থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেরই জানা আছে।
আমাকে আটক রাখার পর হইতে আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের মধ্যে কতিপয় বিচারের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। এবং ঐ সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলেই আদালতের অধিবেশনের ব্যবস্থা করা হইত। উক্ত আটক ব্যবস্থায় প্রায় ২১ মাস পরে ১৯৬৮ সালের ১৭ই/১৮ই জানুয়ারী নাগাদ ১টার সময় আমাকে আটক অবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জেল গেট হইতে কতিপয় সামরিক কর্ম্মচারী আমাকে জোরপূর্ব্বক ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লইয়া আসে এবং তথায় একটি রুদ্ধকক্ষে আমাকে আটক রাখা হয়। আমাকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। নির্জ্জনকক্ষে আটক রাখা হয় এবং আমাকে কাহারও সহিত দেখা করিতে দেওয়া হয় না। আমাকে এমনকি খবরের কাগজও পড়িতে দেওয়া হয় নাই। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরিয়া আমাকে কার্য্যতঃ বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখা হইয়াছিল। এই সময়ে আমার প্রতি অমানুষিক মানসিক নির্যাতন চালান হয় এবং আমাকে যাবতীয় সুখ সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। সেই মানসিক নিৰ্য্যাতন সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভাল।
১৮ই জুন তারিখে অর্থাৎ বর্ত্তমান মামলা শুরু হওয়ার ঠিক একদিন পূর্ব্বে সৰ্ব্ব প্রথম আমি এডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং আমি তাঁহাকে অন্যতম আইনজ্ঞ হিসাবে নিযুক্ত করি।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!