You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিই দাম বাড়াচ্ছে

গত মে মাসে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নকল শিবাজী চ্যবন সাহেব বলেছিলেন যে, উনিশশ একাত্তর-বাহাত্তর সালের বাজেটে মােট দুশাে কুড়ি কোটি টাকা ঘাটতি হবে। স্বভাবতই এই ঘাটতি খরচ সংকুলানের জন্যে সরকারকে ঐ পরিমাণ কাগজী নােট বাজারে ছাড়তে হবে। কারণ বাজেটে নির্ধারিত খরচ কুলােবার অন্য কোনাে উপায় নেই।
মূলধনী খাতে বাজেটে বিদেশি সাহায্য বা ঋণের পরিমাণ আটশাে কোটি টাকার মতাে পাওয়া যাবে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু ডলার সঙ্কট ও তার ফলে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও বাণিজ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার ফলে বিদেশি সাহায্যের সম্ভাবনা সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে সমস্ত বিদেশি সাহায্যের প্রােগ্রাম বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত করায় আমাদের মতাে যেসব দেশ পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্যে বিদেশের মুখাপেক্ষী তাদের সমস্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে পড়ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই শ্রেণীস্বার্থমূলক নির্বোধ আর্থিক নীতির ফলে সারা দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির নিয়ন্তা সরকার ও শিল্পমালিকদের মনেও ভীতি ও আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী শ্রীসুব্রাহ্মনিয়ম লােকসভায় বলেছেন যে, দেশের উৎপন্ন পণ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন পরিকল্পনার মােট প্রস্তাবিত ব্যয়ের পনেরাে শতাংশ ছাটাই মানে মােট প্রস্তাবিত ব্যয় আনুমানিক চব্বিশ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটির পরিকল্পনা ছাঁটাই করতে হবে। চতুর্থ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রস্তাব করার কালে দেশের কোটিপতি শিল্পমালিকরা পরিকল্পনা ব্যয় কমিয়ে চলার নীতি গ্রহণের জন্যে চাপ দিচ্ছিলেন। তখন কেন্দ্রীয় সরকার তাতে সম্মত না হলেও, অর্থনৈতিক চাপ এবং অকেজো আর্থিক নীতি গ্রহণ করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যাতে পরিণামে একচেটিয়া মালিক। কোটিপতিদের মনােবাঞ্ছাই পূর্ণ হয়।
আজ তাই হয়েছে। ভারত সরকার বলতে চান যে, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের চাপ বাড়তে থাকার ফলেই অর্থনীতি এমন বিপাকে পড়েছে। কথাটা কি ঠিক?
বাংলাদেশের ঘটনার সূত্রপাত পঁচিশে মার্চ, বাজেট এসেছে মে মাসে। নব্বই লক্ষ শরণার্থীর শিবিরে রয়েছেন তারা মূলত সরকারের উপর নির্ভরশীল। এই প্রায় এককোটি নিরাশ্রয় মানুষের জন্য ভারত সরকারের আনুমানিক বাৎসরিক ব্যয় পিচশ পঁচিশ কোটি টাকা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। এর মধ্যে এইড ইন্ডিয়া ক্লাব একশ তেত্রিশ কোটি টাকা দিতে অঙ্গীকার করেছেন। এ টাকা বিদেশি মুদ্রায় পাওয়া যাবে। আরাে প্রায় একশ কোটি টাকা সােভিয়েত, চেকোশ্লাভিয়া, পােলান্ড প্রভৃতি ইউরােপীয় দেশ থেকে পাবার আশা রয়েছে। সুতরাং মূলত আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে অনুমিত ব্যয়ের অর্ধেকের মতাে পাওয়ার কথা। আর শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের বাৎসরিক ব্যয় আগে ধরা হয়েছিল সাড়ে চারশাে কোটি টাকা। সুতরাং ভারত সরকারের নিজস্ব খরচ হতে পারে দুশাে থেকে আড়াইশাে কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক সাহায্য বৃদ্ধি পাবে এ রকম সম্ভাবনাও যথেষ্ট। আর দি সরকারি মুখপত্রের আশাফলবতী হয় এবং বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান মার্চ মাসের আগেই হয়ে যায় তাহলে শরণার্থীদের প্রায় সবাই বাংলাদেশে নিরাপদে ফিরে যাবেন বলে ধরা যায়।
তাছাড়া আমাদের দেশে স্বাভাবিক লােক সংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমে গেছে। যদি বর্তমানে আড়াই শতাংশ বৃদ্ধির বদলে পাঁচ বছর আগেও যে সাড়ে তিন শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল তা বজায় থাকত, তাহলে এ বছর ভারতবর্ষে মােট জনসংখ্যা আরাে দু’কোটি বেশি হতাে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আসার ফলে বড় জোর আমাদের পরিবার পরিকল্পনার বাবদ ব্যয়ের অর্ধেক ফলপ্রসূ হয়নি বলে ধরা যেতে পারে।
কিন্তু গােটা অর্থনীতি ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে, চতুর্থ পরিকল্পনা ব্যয় সাড়ে তিন হাজার কোটি। ছাটাই করার কারণ হিসেবে বাংলাদেশের শরণার্থী আগমনকে ধরা যায় না। বাংলাদেশের সমস্ত শরণার্থী যদি অচিরে দেশে ফিরে যান, তবুও ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মুখ থেকে রক্ষা পাবে না।
ভারতের অর্থনীতি এভাবে ভেঙে পড়ার, পরিকল্পনামূলক ব্যয় এভাবে ছাঁটাই করার কোনাে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক নিয়ম উপস্থিত ছিল না, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্ত আর্থিক, সামাজিক নীতিগুলােই এবং পরােক্ষভাবে সারা পুঁজিবাদী দুনিয়ার মুদ্রা ও বাণিজ্য সঙ্কটের ভাগিদার বলেই ভারতের অর্থনীতি আজ আধােগামী, শিল্পোৎপাদনের হার দেড় শতাংশ মাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে পনেরাে শতাংশ, বেকারের সংখ্যা প্রতিমাসে এক লক্ষের অংকে দাড়িয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহতা ক্রমাগত বাড়ছে, লােকের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে কল্পনাতীতভাবে।
অথচ গত পাঁচ বছরে খরা ও বন্যা সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন চতুর্থ পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অভ্যন্তরে পঁচাত্তর লক্ষ টন খাদ্যশস্যের মজুদ ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে এবং সারা বছরে শরণার্থীদের মােট প্রয়ােজন হবে মাত্র দশ লক্ষ সত্তর হাজার টনের। অর্থাৎ খাদ্যশস্য বাবদ শরণার্থীদের চাপ নিতান্তই অকিঞ্চিকর।
দেশে সঞ্চয়ের হার ও পরিমাণ উভয়েই বেড়েছে। উনিশশাে ছেষট্টি-সাতষট্টি সালে মােট সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল একশ সতেরাে কোটি টাকা, উনিশশ উনসত্তর সালে তা দাঁড়িয়েছে একশাে আটাত্তর কোটি টাকা। অর্থাৎ শিল্পোৎপাদন হ্রাস, বিপুলভাবে কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং পণ্যমূল্যের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটা সত্ত্বেও কৃষি পণ্যোৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে গ্রামীণ বড় বড় উৎপাদক জোতদার ও ব্যবসায়ীদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে এক কোটি টাকার বেশি যাদের সম্পদ রয়েছে এমন বড় বড় কোম্পানিগুলাের মুনাফা ও রিজার্ভ ফান্ডের মােট পরিমাণ বেশ বেড়েছে। তবু কেন দেশে শিল্পকারখানা বাড়ছে না? তবু কেন নতুন নতুন চাকরির সংস্থান বাড়ছে না।
এর অন্যতম প্রধান কারণ দেশের মানুষের আয় কমে গেছে, তারা আর প্রয়ােজনীয় জিনিস পত্র কিনতে পারছেন না। ফলে শিল্পপতিদের হাতে যথেষ্ট রিজার্ভ ফান্ড ও ব্যাঙ্কে যথেষ্ট সঞ্চয় জমা পড়া সত্ত্বেও অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারছে না অন্য দিকে গ্রামীণ বড় বড় উৎপাদক, জোতদাররা কৃষি উৎপাদন মূল্যের বৃহদাংশ আত্মসাৎ করে বাজারে নিজেদের পণ্য ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে।
ফলে কৃষিজাত পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। আখ, তুলা, তৈলবীজ, আলু, আনাজপাতি, জাল, মাছ, মাংস, ডিম প্রভৃতি এখন সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে।
এই মূল্য বৃদ্ধি ও জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা পড়ে যাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলাে কেন্দ্রীয় সরকার ক্তৃক বেপরােয়া কাগজী নােটের পরিমাণ বাড়িয়ে চলা। মে মাসে অর্থমন্ত্রী বললেন যে, দুশ কুড়ি কোটি টাকার মতাে ঘাটতি ব্যয় হবে সারা বছরে আর বারােই নভেম্বর তারিখে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবে দেখা গেল যে, ইতিমধ্যেই চার-পাঁচ মাস বাকি। এছাড়া রাজ্যের সরকারগুলাে একাত্তর-বাহাত্তর সালে ঘাটতি ব্যয় করবে দুশাে চার কোটি টাকা এবং ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে এই রাজ্য সরকারগুলাের মােট ওভার ড্রাফটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুশাে চুয়ান্ন কোটি টাকা (পাঁচই নভেম্বর তারিখে)। এই ঘাটতি ব্যয়ের অধিকাংশই উৎপাদনমূলক নয়, অর্থাৎ এর ভােগ্য পণ্যোৎপাদন বাড়েনি।

সূত্র: দর্পণ
০৩.১২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!