You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06 | বাকের তোমাকে ভুলি নাই - মাহফুজুর রহমান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩ জানুয়ারি ১৯৯৭ - সংগ্রামের নোটবুক

বাকের তোমাকে ভুলি নাই – মাহফুজুর রহমান

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩ জানুয়ারি ১৯৯৭

আজ ২৫ বছর পর স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে আবার সেই ’৭১—এর ডায়েরিটা বের করলাম। সযত্নে সংরক্ষিত সেই ছোট চিঠিটা ডায়েরির পাতার ফাঁকে দেখতে পেলাম। সাথে আটকানো স্বাধীন বাংলাদেশের কোন একটি দৈনিকে প্রকাশিত শহীদ বাকেরের চির বিদায়ের খবরের কাগজের কাটিং।
দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট। আমি এবং সামসুজ্জামান ফরহাদ (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসীর ১ম বর্ষের ছাত্র) ঢাকা শহর থেকে প্রভাকরদি, আড়াই হাজার থানা, রামচন্দ্রপুর হয়ে বেলা ৪টার দিকে বিখ্যাত সেই চারগাছ বাজারে গিয়ে উপস্থিত হই। চারগাছ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন এবং নির্গমনের একটি ঐতিহাসিক দুর্গম পথ। এই পথটি মোটামুটিভাবে যুদ্ধের ৯ মাসই মুক্তিযোদ্ধারা চলাচলের জন্য মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আমি আর ফরহাদ একটি ছিপ নৌকা যোগে চারগাছ বাজার—এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের দিক থেকে আসা একটি মুক্তিযোদ্ধা ভর্তি নৌকার দিকে দৃষ্টি পড়ল। সেই নৌকা থেকে বাকের আমার নাম ধরে ডাকতেই আমি আমার নৌকা থামাতে বললাম। উল্লেখ্য, আমি আর মোহাম্মদ আবুবকর (ডাক নাম বাকের) তদানীন্তন কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) এর বি.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। নৌকা দুটি পাশাপাশি আসতেই বাকের আমার নৌকায় চলে এলো। আমাদের মন্তব্য এবং আমার অপারেশন এরিয়ার সম্ভাব্য ক্ষেত্র সম্পর্কে জানার পর বিশেষ সুবিধার জন্য সেক্টর—২ এর গেরিলাদের দায়িত্বে নিয়োজিত বাদল ভাইকে বাকের একটি চিঠি লিখে দেয়। বাকেরের ইংরেজীতে লেখা সেই চিঠিখানা (যা কাগজের অভাবে আমার পকেট ডায়েরির পাতায় নৌকায় বসেই লেখা হয়েছিল) ২৫ বছর ডায়েরিতেই ছিল। এই চিঠির মাধ্যমে বাদল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং সেই মোতাবেক বাদল ভাই আমাদের দু’জনকে ২ নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারে বিশেষ ট্রেনিং—এর ব্যবস্থা করেছেন। পরবর্তীতে আমরা দু’জন পালাটানা ক্যাম্প—এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে পূর্ণাঙ্গ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে আবার ২ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসি।
২ নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারে (মেলাঘর) ফিরেই বাদল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং বাকেরের চিঠির বক্তব্য মোতাবেক আমি ঢাকা এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করি। এই সময়ই প্রথম জানতে পেলাম বাকেরের পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়ার কথা। মনটা একেবারে ভেঙ্গে যায়। বাদল ভাই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাকের—এর প্ল্যাটুন সেই বিখ্যাত ক্র্যাক প্ল্যাটুন—এর কমান্ডার মায়া ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের ২ জনকেই পরিচয় করিয়ে দেন। বাকেরের নিজস্ব গেরিলা দল ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুন’—এর কথা শুনতেই আমি আর ফরহাদ সঙ্গে সঙ্গেই ক্র্যাক প্ল্যাটুনে যোগদান করি এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অপারেশন—এর জন্য অবস্থান নেই।
১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হলো। বিজয়ের আনন্দে দেশ উদ্বেল হলো কিন্তু বন্ধু বাকেরকে আর পেলাম না। সেই আনন্দ শেষে কিছুদিনের মধ্যেই আবার কলেজে ফিরে গেলাম কিন্তু বন্ধু বাকের আর কোনদিন কলেজে ফিরে এলো না। কিছুদিন পর একটি সংবাদপত্রে বাকেরের ধরা পড়ার ঘটনাটি ছাপ হয় যার অংশটিই আমার ডায়েরিতে ২৫ বছর যাবৎ সযত্নে রেখেছি।
০০০০০০