You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06 | নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে পারিনি বৌদ্ধ বলে পরিচয় দিয়েছি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩ জানুয়ারি ১৯৯৭ - সংগ্রামের নোটবুক

নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে পারিনি বৌদ্ধ বলে পরিচয় দিয়েছি
—জিন্দু প্রভা দেবী, রামপুরা, ঢাকা।

তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই। ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরীতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’ দেখানো হয়। এতে আমার ছেলে স্বপন চৌধুরী অংশ নিয়েছে। স্বপনই আমাকে বললো, মা তুমি দেখে এসো, বয়স হয়েছে, চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তবুও গেলাম। ছোট ছেলের বউ ও নাতিকে সঙ্গে নিয়ে। ছবিটি দেখানোর পর অনেকেই বক্তব্য রাখেন। উদ্যোক্তরা বললেন, এখানে স্বপন চৌধুরী নেই। কিন্তু তার মা আছেন। তাকে আমাদের কিছু বলার অনুরোধ করছি। বয়সের ভারে আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না, দাঁড়াতেও পারি না। তবুও তারা আমাকে ধরে নিয়ে গেলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যে ভয়াবহ দিনগুলি দেখেছি, তা কি আর বর্ণনা করা যায়। আমি বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ‘মুক্তির গান’ আমাকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দিল। এ ছবি দেখে আমার কষ্ট বেড়ে গেল। যাঁরা এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করল, জীবন দিল, ইজ্জত দিল তারা আজ কোথায়? আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। কিন্তু কি বলব? এদেশে সত্যি কথা বলা বিপদ। ছেলেরা সরকারি চাকরি করে, এক ছেলে গান গায়। যদি ওদের কোন বিপদ হয়। তাই কিছু বলতে পারিনি। শুধু বলেছি, যুদ্ধের সময় এদেশে থেকে কত কষ্ট পেয়েছি, কত মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছি তা মনে করলে প্রাণ অস্থির হয়ে ওঠে। ছ’টি শিশু পুত্র আর দু’টি বড় মেয়ে নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছি। নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে পারিনি। বৌদ্ধ বলে পরিচয় দিয়েছি। নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দেখি সেই ঘরে আগুন জ্বলছে। ছোট বড় সবাই বাড়ির সব কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগাল করছে। অথচ আমাদের কিছুই বলার নেই। অন্য দেশের ছবি দেখে বুঝবে না এখানে আমরা কত কষ্টে ছিলাম। চোখের সামনে দেখেছি মায়ের সামনে মেয়েকে অত্যাচার করছে। পিতার হাত হতে পুত্র ও পুত্রবধূকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘর থেকে বের করে দিল। পাতের ভাত ফেলে ছোট ছেলে রূপমের হাত ধরে বের হয়ে এলাম। সঙ্গে শুধু একটা কাপড়, গীতা বই আর আমার বাবার একটা স্মৃতি। ঘরে পড়ে রইল সোনাদানাসহ আরো অনেক মূল্যবান সম্পদ। এসবের চিন্তা তখন করিনি। পথে পথে কোথায় ঘুরবো? কোথায় একটু আশ্রয় পাব? এই চিন্তায় মাথা ঘুরতো। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি যখন দেখেছি চোখের সামনে নিরীহ বৃদ্ধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তাদের বৌ, মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করছে। তখন মনে হল এসব দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল ছিল। প্রতিদিন মানুষের ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের তান্ডবলীলা চালিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু কারো কিছু বলার সাহস নেই। সাধ্যও নেই। যারা পেরেছে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা যারা পালাতে পারিনি হয়েছি ঘরছাড়া। খাবার জন্য পয়সা নেই, কাপড় নেই, বিছানা নেই। এক কাপড়ে দিন কাটিয়েছি। দিনের বেলা মেয়েদের লুকিয়ে রাখতাম। এক মেয়ে শিলুকে বোরখা পরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ভারতে। আমরা কখনো বৌদ্ধদের বাড়িতে, কখনো তাদের মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটিয়েছি। দুই ছেলে স্বপন আর মিলন গিয়েছিল যুদ্ধে। তখন কিভাবে যে দিন কাটিয়েছি এখন ভাবলে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই ৮৬ বছর বয়সে ছেলেদের কল্যাণে ভালই আছি। তারা আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। স্বপন, রূপম, তপন (কন্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী) সবাই শিল্পী। আজ আমাদের কত সমাদর। কত বন্ধু। এত কিছুর পরেও সেই নিদারুণ দিনগুলির কথা আজও ভুলিনি। কখনো ভুলবো না। ভোলা যায় না।