You dont have javascript enabled! Please enable it! 1961 | আইয়ুব খানের আমলে বাংলাদেশের কৃষক | বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯৭৮ ঈদ সংখ্যা - সংগ্রামের নোটবুক

আইয়ুব খানের আমলে বাংলাদেশের কৃষক | বদরুদ্দীন উমর

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯৭৮ ঈদ সংখ্যা

[“আইয়ুব খানের আমলে বাঙলাদেশের কৃষক”-এর রচনাকাল ১৯৭১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর। ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমি আলোচনার উদ্দেশ্যেই এই কাজটি শুরু করি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর এ কাজে আর অগ্রসর হতে পারিনি। ইচ্ছে ছিলো কৃষি অর্থনীতি, ছোট শিল্প এবং অপেক্ষাকৃত বৃহৎ শিল্প ইত্যাদি মিলে সামগ্রিকভাবে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা। সেদিক থেকে বর্তমানে প্রকাশিত রচনাটি খুবই অসম্পূর্ণ। ভিন্ন পরিস্থিতিতে লিখিত এই রচনাটি প্রয়োজনবোধে সামান্য পরিবর্তন করে এখন প্রকাশ করা হলেও এ সম্পর্কে পরে আরও বিস্তৃত আলোচনা করার দরকার হবে। –বদরুদ্দীন উমর]

১. জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী অবস্থা

১৯৫০ সালের জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইনের বলে ভূস্বামীদের থেকে কিছু পরিমাণ জমি নিয়ে পূর্ব বাঙলা সরকার স্বল্পসংখ্যক গরীব কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে। কিন্তু এই বন্টনের মাধ্যমে প্রত্যেকে এত অল্প পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি পায় যে, তার ওপর নির্ভর করে পরিবারের পূর্ণ ভরণপোষণ কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। উপযুক্ত কৃষি ঋণের অভাবও এর সাথে যুক্ত হয়। কাজেই নোতুন আইনে যারা জমি লাভ করলো তারাও আংশিকভাবে বর্গাজমির ওপর থাকলো নির্ভরশীল। এর ফলে নোতুন জমি লাভ সত্ত্বেও বর্গাপ্রথার আওতা থেকে তারাও বাদ পড়লো না।

জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে সরকার ও খাজনাদানকারী কৃষকদের মধ্যবর্তী সমস্ত স্বত্ব বিলুপ্ত হলেও খাজনার সামগ্রিক ভার কিন্তু কৃষকদের উপর কিছুমাত্র কমলো না। নোতুন ব্যবস্থায় জমিদারের পরিবর্তে খাজনার মালিক হলো রাষ্ট্র। জমিদারী প্রথায় মধ্যস্বত্বভোগী এবং জমিদারের নায়েব-গোমস্তারা কৃষকদের উপর যে নির্যাতন চালাতো সে নির্যাতনেরও কোন লাঘব নোতুন ব্যবস্থায় হলো না। কারণ সরকারী আমলা এবং কর্মচারীরা রাষ্ট্রের পক্ষে কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়কালে তাদের পূর্ববর্তীদের মতোই নানা প্রকার অতিরিক্ত আদায় শুরু করলো। গ্রামাঞ্চলে শুরু হলো ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপক রাজত্ব। সার্কেল অফিসার ও তহশীলদাররাই থাকলো এই নির্যাতনকারীদের পুরোভাগে।

এক হিসেবে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্বের থেকে পরবর্তী পর্যায়ে কৃষকদের অবস্থার কিছুটা অবনতিই ঘটলো। পূর্বে জমিদারের খাজনা বাকী পড়লে জমিদার অথবা তার নায়েব গোমস্তাদের কাছে সুপারিশ করে কৃষকরা অনেক সময় খাজনা দেওয়ার তারিখ পিছিয়ে নিতেন, স্থানীয় পরিচিত লোক হিসেবে তাদের থেকে অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য কিছু কিছু সুবিধেও লাভ করতেন। ১৯৫০ এর দিকে প্রজাদের উপর জমিদারের নিয়ন্ত্রণ পূর্ব বাঙলার প্রায় সর্বত্রই পূর্বের মতো কঠোর না হয়ে অনেকখানি শিথিল হয়ে এসেছিলো। শ্রেণী হিসেবে জমিদারদের ক্ষয়িষ্ণুতা এবং জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের একের পর এক আন্দোলনই ছিলো এই পরিবর্তনের মূল কারণ।

রাষ্ট্র জমিদার হওয়ায় খাজনা আদায়কারীরা হলেন অস্থানীয় সরকারী কর্মচারী। এই কর্মচারীদের সাথে স্থানীয় কৃষকদের কোন পূর্ব-পরিচয়ের যোগসূত্র না থাকায় তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক পূর্বের তুলনায় হয়ে দাঁড়ায় অনেক যান্ত্রিক। কাজেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ঘুষ, বডি ওয়ারেন্ট, সম্পত্তি ক্রোক ইত্যাদির মাধ্যমে তারা বকেয়া খাজনার দায়গ্রস্থ কৃষকদের ওপর যে নির্যাতন শুরু করে তার সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট শোষণের কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। উপরন্তু জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ঠিক পূর্ববর্তী পর্যায়ে জমিদারী নির্যাতনের শৈথিল্যের তুলনায় এই নির্যাতনের মাত্রা এবং ব্যাপকতা বহুগুণে বৃদ্ধি লাভ করে।

জমিদারী শোষণের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো মহাজনী শোষণ। জমিদারী প্রথার অবসান কিন্তু পূর্ব বাঙলায় মহাজনী শোষণের অবসান ঘটাতে অথবা তার মাত্রা ও বিস্তৃতিকে খর্ব করতে সমর্থ হলো না। বর্গাশোষণ, ঘুষ, বডি ওয়ারেন্ট, সম্পত্তি ক্রোক ইত্যাদির চাপে পড়ে উত্তরোত্তরভাবে কৃষকরা মহাজনী শোষণের শিকারে পরিণত হলো। তাদের সামান্য জমিজমা ঋণের দায়ে মহাজনদের কাছে হস্তান্তর করে তারা স্ফীত করতে থাকলো ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা। মাঝারি কৃষক হলো গরীব কৃষক, গরীব কৃষক হলো ভূমিহীন কৃষক এবং ভূমিহীন কৃষক দরিদ্র থেকে হলো আরও দরিদ্র। বন্যা, মহামারী, খাদ্যাভাব ও ঋণ—বাঙলার কৃষক জীবনের এই চার অলঙ্কারের বোঝা পরবর্তী পর্যায়ে হয়ে দাঁড়ালো আরও অনেক গুরুতর।

এই গুরুতর অবস্থার একটা মোটামুটি চিত্র ১৯৬১ সালের আদমশুমারি থেকেই পাওয়া যায়। পূর্ব বাঙলার সামগ্রিক অর্থনীতির পেশাগত কাঠামো এবং কৃষিকার্যরত শ্রমিকদের অনুপাত ও সংখ্যা, বিভিন্ন শ্রেণীর হাতে জমির পরিমাণ, গ্রামাঞ্চলে জমির ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন শ্রেণীর আয়ের পরিমাণ, কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা, চাষের গরু-লাঙ্গল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসের স্বল্পতা এবং সর্বোপরি কৃষি উৎপাদনের পশ্চাদপদতা এই কয়টি  বিষয়ের তথ্যাদি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত উল্লেখই পূর্ব বাঙলায় কৃষক জীবনের আর্থিক অবস্থা চিত্রনের জন্যে যথেষ্ট।

(ক) কৃষি উৎপাদন ও শিল্পোৎপাদন এবং কৃষি শ্রমিক ও শিল্প শ্রমিকের পারস্পরিক অনুপাত যে কোন দেশের অর্থনীতির পশ্চাদপদতা পরিমাপের পক্ষে খুব সহায়ক। কারণ দেশ শিল্পক্ষেত্রে যত বেশী অগ্রগতি সাধন করে ততই কৃষি উৎপাদনের অনুপাতে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং তার সাথে সাথে শিল্প শ্রমিকদের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধিও ঘটে। এই শিল্পবিকাশই আবার অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে সামন্তবাদের অবশেষসমূহকে আরও ক্ষয়িষ্ণু করে এবং তার অবসান ঘটায়।

প্রথমেই উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনা করলে আমরা দেখবো যে, তৎকালীন পূর্ব বাঙলা ছিলো এদিক দিয়ে এশিয়ার যে কোন দেশের থেকে অনেক বেশী পশ্চাদপদ। ১৯৬৩ সালের একটি হিসেবে মতো১ কয়েকটি দেশের সাথে পূর্ব বাঙলার তুলনা করলেই এটা দেখা যাবে।

দেশ বৎসর কৃষি উৎপাদনের অনুপাত
বার্মা ১৯৬৩ ৪২.৪
ক্যাম্বোডিয়া ১৯৫৯ ৪১.৪
সিংহল ১৯৬১ ৪৬.২
গণচীন ১৯৫৬ ৪৮.১
ভারত ১৯৬১ ৪৬.৬
ইরান ১৯৬২ ২৬.৯
থাইল্যান্ড ১৯৬২ ৩৬.১
জাপান ১৯৬২ ১৪.২
পূর্ব পাকিস্তান ১৯৬২-৬৩ ৬১.০
পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৬২-৬৩ ৪৫.০

উপরের এই চিত্র থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ব বাঙলায় কৃষি উৎপাদন দেশের মোট উৎপাদনের ৬১.০% ভাগ। চীন যেখানে বিপ্লবের মাত্র সাত বৎসর পর তার শিল্পোৎপাদনকে ৫১.৯% পর্যায়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে সেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ষোল বৎসর পরেও আমাদের শিল্পোৎপাদনের অনুপাত ৩৯%। এদিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের অবস্থা মোটামুটি এক এবং পূর্ব বাঙলার থেকে অনেক স্বতন্ত্র। জাপান এশিয়ার মধ্যে সব থেকে শিল্পোন্নত দেশ, সেজন্যে জাপানে কৃষি উৎপাদনের অনুপাত ১৪.২% অর্থাৎ শিল্পোৎপাদনের অনুপাত ৮৫.৮%।

আমাদের দেশের কৃষি শ্রমিক ও শিল্প শ্রমিকদের সংখ্যানুপাত হিসেব করলে এই একই সত্যোর দেখা মিলবে। ১৯৫১ সালের আদমশুমারির হিসেবে পূর্ব বাঙলায় কৃষি কার্যরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ৮৩.১৫%। কিন্তু ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সে সংখ্যা হলো ৮৫.২৬%। ১৯৫১ এবং ১৯৬১ সালের এই হিসেব২ অনুযায়ী পূর্ব বাঙলার সামগ্রিক অর্থনীতিতে পেশাগত কাঠামোর বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু এই দশ বৎসরে কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা পূর্বের থেকে আরও ২.১১% বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। এদিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা অবশ্য অনেকখানি স্বতন্ত্র। সেখানে ১৯৫১-৬১ সালে কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা ৬৫% থেকে ৫৯.৩১% এ নেমে এসেছে অর্থাৎ সেই অনুপাতে শিল্প শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।৩

(খ) ১৯৫০ সালের প্রায় দশ বৎসর পর ভূমি মালিকানার একটা চিত্র নীচের অঙ্কগুলি থেকে পাওয়া যাবে।৪

 (গ) ১৯৬১ সালের হিসেব৫ থেকে দেখা যায় যে, পূর্ব বাঙলার ৮১.২% সংখ্যক গ্রাম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ জমিতে চাষ আবাদ করে নিজেদের খাদ্য সংস্থান পর্যন্ত এদের দ্বারা সম্ভব হয় না। খাদ্য পরিস্থিতিই যখন এই রকম তখন এই শ্রেণীর কৃষকদের অন্যান্য ব্যয়ের অবস্থা সহজেই অনুমান করা চলে। বিভিন্ন অর্থকরী ফসল থেকে যে অতিরিক্ত আয় হয় প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই নগণ্য।

যে সমস্ত কৃষক নিজেদের জমিতে চাষ আবাদ করে তাদের একর প্রতি আয়ের একটা হিসেব প্রথমেই নেওয়া দরকার। এই হিসেব৬ মতো এক একর জমিতে ধান উৎপাদন করতে ব্যয় হয় ২০৯ টাকা অর্থাৎ মণপ্রতি ১৪.৩ টাকা। এই খরচের মধ্যে অবশ্য কৃষকের নিজের মজুরিও ধরা হয়েছে। নিজের জমির উপর ব্যয়কৃত শ্রম-শক্তির মূল্য বাদ দিয়ে এই হিসেব করলে একর প্রতি খরচা হয় ১০৯ টাকা অর্থাৎ প্রতি মণে ৭.৩ টাকা।

খামারের আকার (একর হিসেবে) খামারের সংখ্যা শতাংশ পুরো আবাদী এলাকা (একর হিসেবে) শতাংশ
০.৫ এর নীচে ৮,০২,৬৩০ ১৩ ১,৩৮,৩৮২
০.৫ থেকে ১.০ এর নীচে ৬,৮৯,৮৪০ ১১ ৪,০১,৬৮০
১.০ থেকে ২.৫ এর নীচে ১৬,৭৭,৪১০ ২৭ ২৪,৬৮,৫৯০ ১৩
২.৫ থেকে ৫.০ এর নীচে ১৬,১৫,০২০ ২৬ ৫১,৫১,১৭৫ ২৭
৫.০ থেকে ৭.৫ এর নীচে ৬,৯৮,৪৫০ ১২ ৩৭,৮০,২৪৫ ২০
৭.৫ থেকে ১২.৫ এর নীচে ৪,৪২,৩৬০ ৩৭,১৭,০৩৪ ১৯
১২.৫ থেকে ২৫.০ এর নীচে ১,৮৭,৭৯০ ২৬,৮৮,৯২২ ১৪
২৫.০ থেকে ৪০.০ এর নীচে ২১,৩৭০       .৩৪ ৫,৩৮,৬১৮
৪০.০ এবং উর্ধ্বে ৪,৬১০        .০৮ ২,৫৩,৪৬৩

উপরের অঙ্কগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ০.৫% থেকে ২.৫% একর জমির মালিকদের সংখ্যা হচ্ছে ৫১% এবং এদের হাতে আবাদ হয় মোট  জমির ১৬%। এরা হলো গরীব কৃষক। নিজেদের জমির উপর নির্ভর করে এদের জীবিকা নির্বাহ হয় না, কাজেই এরা হয় অন্যের জমি বর্গা নেয়, অথবা অন্যের খামারে ক্ষেতমজুরের কাজ করে, অথবা অন্য কোন অর্থকরী কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। এদের উপরই ঋণের বোঝা সব থেকে বেশী। ঋণের দায়েই এরা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভূমিহীন কৃষকে।

২.৫ থেকে ৭.৫ একর জমির মালিকদের সংখ্যা ৩৮% এবং এদের হাতে আবাদ হয় ৪৭% জমি। কিছুসংখ্যক গরীব কৃষক এর অন্তর্ভূক্ত হলেও মোটামুটিভাবে এরা হলো মধ্য কৃষক। এরা সাধারণতঃ অন্য কারো জমিতে নিজেরা কাজ করে না এবং অন্যদেরকেও নিজেদের জমিতে কাজে লাগায় না। এদের জীবিকা সংস্থান নিজেদের জমি থেকে মোটামুটিভাবে হলেও বন্যা এবং অন্যান্য কারণে এরাও অনেকাংশে ঋণগ্রস্ত। এদের হাত থেকেও ঋণের দায়ে জমি হস্তান্তরিত হয়।

৭.৫ থেকে ২৫.০ একর জমির মালিকদের সংখ্যা ১০% এবং এদের হাতে আবাদ হয় ৩৩% জমি। এরা প্রধানতঃ হলো ধনী কৃষক, তবে এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ছোট জোতদারও আছে। এদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল হলেও চাষের ক্রমবর্ধমান খরচা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পাটের মূল্য হ্রাস ইত্যাদি কারণে এদের মধ্যেও অনেকে ঋণগ্রস্ত। এই শ্রেণীর ধনী কৃষক ও জোতদাররা নিজেদের জমির একাংশ সাধারণতঃ বর্গাচাষের জন্যে বিলি করে।

২৫.০ একর থেকে বেশী জমির মালিকদের সংখ্যা ৪২%, এদের  হাতে আবাদযোগ্য জমি আছে ৪%। এই শ্রেণীর লোকেরা হলো জোতদার শ্রেণীভুক্ত। এরা নিজেরা কৃষকদের মতো স্বহস্তে চাষ আবাদ করে না। বর্গাচাষের মাধ্যমে অথবা জমির কিছু অংশে কৃষি শ্রমিক নিযুক্ত করে এরা নিজেদের জমি আবাদ করে।

এই সমস্ত হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ধনী কৃষক ও জোতদার অর্থাৎ যারা বর্গাশোষণ করে তাদের ১০.৪২% এর হাতে জমি আছে মোট আবাদী জমির ৩৭%। এবং ৮৯% গরীব এবং মধ্য কৃষকের হাতে জমি আছে ৬৩% ভাগ।

১৯৬১ সালে এই হলো জমিদারশূন্য পূর্ব বাঙলায় ভূমি মালিকানার চিত্র।

এক্ষেত্রে একর প্রতি গড়পড়তা উৎপাদন ধরা হয়েছে ১৫.২৩ মণ। ১৯৬৪-৬৫ সালের বাজারদর হিসেবে মণপ্রতি ধানের দর ১২.৬০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি একরে গড়পড়তা আয় ১৯২ টাকা। কৃষকের নিজের শ্রম বাদ দিয়ে হিসেব করলে একরপ্রতি আসল আয় দাঁড়ায় ৮৩ টাকা। কিন্তু এই শ্রমকে ধরে আয় নির্ণয় করলে একরপ্রতি ১৭ টাকা এবং মণপ্রতি ১.৭০ টাকা ক্ষতি দেখা যায়। পাট চাষের ক্ষেত্রেও৭ এই ক্ষতির পরিমাণ ৪ টাকা।

দেশের অর্থনীতিতে সামন্তবাদের অবশেষসমূহের ও সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব নির্ণয়ে এই হিসেবটির তাৎপর্য খুব উল্লেখযোগ্য নিজের শ্রম হিসেব করে একরপ্রতি ১৭ টাকা ক্ষতি এবং শ্রমের হিসেব বাদ দিয়ে ৮৩ টাকা আয়ের অর্থ নিজের জমিতে চাষ করার থেকে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরিতে কাজ করা অনেক বেশী লাভজনক। এই পরিস্থিতিতে নিজের জমি পরিত্যাগ করে কৃষকের পক্ষে গ্রামাঞ্চলে অথবা শহরে সরাসরি নিজের শ্রমশক্তি বিক্রয় করাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকের পক্ষে তা সাধারণতঃ সম্ভব হয় না, কারণ গ্রামাঞ্চলে এবং শহরে কাজের তেমন সংস্থান নেই। কাজেই ক্ষতি স্বীকার করেও তাকে নিজের জমিতেই বাঁধা থাকতে হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঋণের দায়ে পরিণত হতে হয় ভূমিহীন কৃষকে। বর্গাচাষীদের অবস্থা এদিক দিয়ে আরও গুরুতর।

১৯৬১ সালে পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে আয় বিতরণের নিম্নলিখিত চিত্র৮ পাওয়া যায়।*

ক্রমিক সংখ্যা আয় গ্রুপ সংখ্যা পরিবার সংখ্যা

সমগ্র পরিবারের শতাংশ

আয় সমগ্র আয়

সমগ্র আয়ের শতাংশ

২৫ টাকার নীচে ২১ ১.৬ ৪৮৩ ০.১
২৫-৪৯ টাকা ১৮৩ ৯.২ ৮,৮৬৭ ২.৯
৫০-৭৪ টাকা ৩১০ ১৫.৬ ১৮,৬০০ ৬.১
৭৫-৯৯ টাকা ২৯৫ ১৪.৯ ২৪,৪৮৫ ৮.১
১০০-১২৪ টাকা ২৬৯ ১৩.৬ ২৮,৭৮৩ ৯.৩
১২৫-১৪৯ টাকা ২১৬ ১০.৯ ২৮,০৮০ ৯.২
১৫০-১৯৯ টাকা ২৭৭ ১৪.০ ৪৭,০৯০ ১৫.৫
২০০-২৪৯ টাকা ১১৮ ৫.৯ ২৬,০৭৮ ৮.৬
২৫০-২৯৯ টাকা ৯২ ৪.৬ ২৪,৯৩২ ৮.২
১০ ৩০০-৩৯৯ টাকা ৯৬ ৪.৮ ৩১,২০০ ১০.৩
১১ ৪০০-৫০০ টাকা ৪৩ ২.১ ১৯,১৭৮ ৬.৩
১২ ৫০০ টাকার উর্ধ্বে ৫৭ ২.৮ ৪৪,৫১৭ ১৪.৭

* আয় বলতে এখানে মাসিক আয় ধরা হয়েছে।

উপরের অঙ্কগুলি থেকে দেখা যায় যে, গ্রামাঞ্চলে ২৬.৪% পরিবারের মাসিক আয় ৭৫ টাকার কম। প্রতি পরিবারে গড়ে চারজন ধরলেও যে আয় দাঁড়ায় তাতে ন্যূনতম খাদ্য সংস্থানও হয় না। এই গ্রুপের মধ্যে ১.৬% পরিবারের মাসিক আয় ২৫ টাকারও নীচে। কাজেই সমগ্র পরিবার সংখ্যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশেরও বেশী পরিবার অভুক্ত এবং অর্ধভুক্ত অবস্থায় দিন কাটায়। ৭৫ টাকার উর্ধে যাদের মাসিক আয় তাদের অবস্থাও রীতিমত শোচনীয়।

উপরের হিসেব মতো পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে ৮৭.৭% পরিবারের গড়পড়তা মাথাপিছু মাসিক আয় ২৮ টাকারও কম। এবং উচ্চতম পর্যায়ের ৪.৯% ধনী পরিবারের আয় সমগ্র আয়ের ২১% ভাগ।

(ঘ) চাষের গরু, লাঙ্গল ইত্যাদির অভাব ভূমিহীন ও গরীব কৃষক, এমন কি অনেক মধ্য কৃষকেরও অবস্থাকে অধিকতর ঘোরতর করে তোলে। ১৯৬০ সালের হিসেবে৯ দেখা যায় যে, ৩৭% খামারের গরু অথবা তার নীচে যে সমস্ত খামারের জমি তাদের মাত্র ১০% এবং এক একর ও তার নীচের খামারগুলির ২৮% এর গরু আছে। আর একটি রিপোর্ট১০ থেকে দেখা যায় যে, ৬৮% গ্রামেই কৃষিকার্যের জন্যে প্রয়োজনীয় গবাদি পশুর অভাব আছে। এই অভাব পূরণের জন্যে কৃষকদেরকে অনেক অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং অন্যদের কাছে পশু ধার করার ফলে তাদের ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়।

গবাদি পশুর অভাবের মতো লাঙ্গলের অভাবও খুব উল্লেখযোগ্য১১ মোট খামারের এক-তৃতীয়াংশেরই কোন লাঙ্গল নেই। এক একরের নীচে যে সমস্ত খামারের জমি তাদের সংখ্যা মোট খামারের ২৪% হলেও এই খামারসমূহের মধ্যে মাত্র ১৬.৭% এর লাঙ্গল আছে। ৫ একরের উর্ধে যে সমস্ত খামারের জমি একমাত্র তাদেরই ১০০% এর লাঙ্গল আছে। এই ধরনের খামারের সংখ্যা কিন্তু মাত্র ২৩%। অর্থাৎ ৭৭% খামারই কোন না কোন সময়ে লাঙ্গলের অভাবে কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদেরকে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন কৃষক অথবা জোতদারদের খামার থেকে গবাদিপশুর মতো লাঙ্গলও ধার করতে হয়।

এতো অধিক সংখ্যক কৃষকের যেখানে গবাদি পশু ও লাঙ্গলের মতো কৃষিকার্যে অপরিহার্য প্রয়োজনীয় জিনিসের এতো অভাব সেখানে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা মূলধন নিয়োগের প্রশ্ন নিতান্তই অবাস্তব। পূর্ব বাঙলার কৃষকদের বিপুল অধিকাংশ জমি, গবাদি পশু, লাঙ্গল এবং ঋণের জন্য জোতদার-মহাজনদের ওপরই প্রধানতঃ নির্ভরশীল এবং এই নির্ভরশীলতাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রবলতম অন্তরায়।

(ঙ) পূর্ব বাঙলায় কৃষি উৎপাদন যে কতখানি বিপর্যস্ত সেটা প্রথমেই খাদ্য পরিস্থিতির ‍দিকে তাকালে বোঝা যাবে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত উৎপাদনের হিসেব নিলে দেখা যায় যে, এই সময়ে আউশ, আমন এবং বোরো ধানের একরপ্রতি গড়পড়তা উৎপাদন ৭৯৪ পাউন্ড থেকে ৮৪১ পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে১২ কিন্তু দশ বৎসরে একরপ্রতি এই বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় মোটেই যথেষ্ট নয়।

কাজেই এই সময়ে মাথাপিছু ধানের উৎপাদন সমগ্র দেশে ১৯৪৭ এর তুলনায় ১৯৫৮ সালে মোটেই বাড়েনি, বরং কমেছে। ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৫৭-৫৮ সালের জনসংখ্যা হিসেবে১৩ দেখা যায় যে, ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব বাঙলার জনসংখ্যা ছিলো ৫১৪৬০,০০০ অর্থাৎ এই আট বৎসরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিলো ১৯% ভাগেরও বেশী। কিন্তু সেই তুলনায় একরপ্রতি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি উপরোক্ত হিসেব মতো ৫.৬% ভাগ। এ তো গেলো একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির কথা। একথা বাদ দিয়ে যদি আমরা দেশে খাদ্য আমদানীর একটা হিসেব১৪ নেই তাহলেই খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির একটা সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যাবে। (টন হিসেবে)

বৎসর চাল গম ময়দা ও গম থেকে উৎপন্ন খাদ্য মোট
১৯৪৭ ২০,২৪৩ ৯,১২২ ২৯,৩৬৫
১৯৫৬ ৫,৩৩,২৫৬ ৪৯,৫৯৯ ১,৮৩১ ৫,৮৪,৬৮৬
১৯৫৮ ৪,৬৫,৮৬৪ ১,২৭,৯৪৩ ৭,৬০০ ৬,০১,৪০৭
১৯৬৩ ৫,৬৫,০০৯ ৯,১৮,৭৮০ ৬,০০০ ১৪,৯৯,৭৮৯

উপরের এই অঙ্কগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাঙলায় খাদ্য খাটতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫৬ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ হঠাৎ পাঁচ লক্ষ টনে ওঠে। এর পরবর্তী পর্যায়ে ঘাটতি কমাতো দূরের কথা একটানাভাবে বেড়েই চলে এবং ১৯৬৩ সালে এসে পূর্ব বাঙলার খাদ্য ঘাটতি এক নোতুন পর্যায়ে ওঠে।

খাদ্য ঘাটতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষতঃ ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির একটা হিসেব আমরা পেয়েছি। কৃষি উৎপাদনের অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদনের এই হার কিন্তু অন্য রকম। ১৯৪৭-৪৮ সালে একরপ্রতি পাট উৎপন্ন হতো ১,৩২৯ পাউন্ড। উৎপাদনের হার ১৯৫৬-৫৭ সালে সব থেকে উঁচুতে উঠে দাঁড়ায় ১,৭৯৪ পাউন্ডে। কিন্তু  ১৯৫৭-৫৮ সালে পাটের একরপ্রতি উৎপাদন দেখা যায় ১,৫৮৬ পাউন্ড। এরপর থেকে পাটের উৎপাদন ক্রমশঃ নীচের দিকে নামে১৫। ইক্ষুর ক্ষেত্রে ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে (একরপ্রতি ১৫ টন)।১৬, তামাক ১৯৪৭-৪৮ সাল একরপ্রতি উৎপন্ন হতো ৭৬১ পাউন্ড, ১৯৫৭-৫৮ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৭২৬ পাউন্ড।১৭, একমাত্র চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেই এর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।১৮, ১৯৪৭-৪৮ সালে ৭০,০০০ একর জমিতে চা উৎপন্ন হতো ২৮,১৮১,০০০ পাউন্ড অর্থাৎ একরপ্রতি ৪০১ পাউন্ড। ১৯৫৭-৫৮ সালে সেই পরিমাণ ছিলো ৭৫,৯০০ একর জমিতে ৪৪,৪৯৮,০০০ পাউন্ড অর্থাৎ একরপ্রতি ৫৮৯ পাউন্ড। দশ বৎসরে এক্ষেত্রে একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে ৪৬% এর মতো। ধান এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসলের তুলনায় এই হার বৃদ্ধির কারণ চা বাগানের উৎপাদন সংগঠনের সাথে সাধারণ কৃষি খামারের উৎপাদন সংগঠনের পার্থক্য। চা বাগানের উৎপাদন পদ্ধতি পুরোপুরি ধনতান্ত্রিক, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তা নয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত উন্নততর উৎপাদন সংগঠন সত্ত্বেও অন্যান্য দেশ, বিশেষতঃ ভারত, সিংহল, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন প্রভৃতি দেশের তুলনায় পূর্ব বাঙলার চা উৎপাদন বৃদ্ধির হার অনেক কম।

(চ) কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষকের বিপর্যস্ত অবস্থার অনিবার্য পরিণতি দাঁড়ায় কৃষকের উত্তরোত্তর ঋণগ্রস্ততায়। জমি, গরু, লাঙ্গল, বীজ, সার, সেচের পানি ইত্যাদির নিদারণ অভাব এবং উৎপাদন ব্যবস্থার পশ্চাদপদত্বের ফলে কৃষকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি না ঘটে দিন দিন তার অবনতিই ঘটে। এই অবনতি ও দুর্দশার হাত থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তারা ঋণ নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই ঋণের বোঝা তাদের আর কমে না। এর ভারেই তারা শেষ পর্যন্ত জমি হারায় এবং ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যাকে স্ফীত করে।

বস্তুতঃপক্ষে গ্রামাঞ্চলে খুব বিত্তশালী কিছুসংখ্যক বড়ো জোতদার ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণীর বিপুলসংখ্যক পরিবারেই ঋণের প্রয়োজন হয়। এই ঋণ বিভিন্ন সরকারী সূত্র থেকে কিছুটা পাওয়া গেলেও পুরো ঋণ চাহিদার তুলনায় সেটা নিতান্তই সামান্য। তাছাড়া এই ঋণ যারা পায় তাদের প্রত্যেকেই তাদের জমি বা অন্যান্য সম্পত্তির পরিমাণ দেখেই ঋণ দেওয়া হয়। এজন্যেই ভূমিহীন কৃষক ও বর্গাদারেরা এই সরকারী ঋণদানকারী সংস্থাগুলির আওতার মধ্যে পড়ে না।

১৯৬০ সালের কৃষি সেন্সারের হিসেবে১৯ দেখা যায় যে, ৩০ লক্ষ ২০ হাজার কৃষকের ঋণের প্রয়োজন হলেও ৮ লক্ষ ১০ হাজার অর্থাৎ ২৬.৮% সরকারী সূত্রে ঋণ লাভ করেছে। কিন্তু এর থেকে আবার পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় না। কারণ ২৬.৮% অংশ ঋণ লাভ করলেও এই ঋণের পরিমাণ এত অল্প যে তা সমগ্র প্রয়োজনের মাত্র ১.৭% ভাগ।২০

আর একটি হিসেব২১ মতে দেখা যায় যে, ‘বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের’ থেকে ঋণের পরিমাণ ৬৭.৩% এবং ‘ভূস্বামী’ ও ‘খামার মালিকদের’ থেকে প্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ১২% ভাগ। মহাজনদের কোন উল্লেখ এই হিসেবে নেই। যাই হোক, সরকারী ঋণের এই অবস্থা থেকে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় পর্যন্ত যে ভিত্তিতে ঋণ লেন-দেন হতো সে ভিত্তি গ্রামাঞ্চলে বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি। ঋণের ক্ষেত্রে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই যে, ১৯৬০ সালের কৃষি সেন্সাস অনুযায়ী পূর্ব বাঙলায় ছোটো-বড় কৃষি খামারের মোট সংখ্যা হলো ৬১ লক্ষ ৩৯ হাজার এবং এদের মধ্যে ৩০ লক্ষ ২০ হাজার অর্থাৎ প্রায় ৫০% ঋণগ্রস্ত।২২, ঋণের এই চাপ যে গরীব ও মধ্য কৃষকের ক্ষেত্রে তুলনায় অনেক বেশী ছিলো সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্গাপ্রথা ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইনের’ আওতাভুক্ত ছিলো না, এর ফলে বর্গাদারদেরকে জমির মালিকদেরকে উৎপন্ন ফসলের অন্ততঃ অর্ধেক ভাগ খাজনা হিসেবে দিতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এই খাজনার পরিমাণ অর্ধেকের থেকেও বেশী। গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্গাদানযোগ্য জমির ওপরও চাপ বেশী পড়েছে। সেই সুযোগে জোতদাররা অনেক ক্ষেত্রে উল্টো তেভাগা চালু করেছে। এই উল্টো তেভাগার অর্থ উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক জোতদার। খুলনা, ফরিদপুর এবং উত্তর বাঙলার কোন কোন এলাকার বেসরকারী রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, এই ধরনের উল্টো তেভাগার শোষণে নির্যাতিত কৃষকরা প্রকৃতপক্ষে মানবেতর জীবনই যাপন করছে।

জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার কৃষকসমাজ ও কৃষি ব্যবস্থার যে চিত্র আমরা পাচ্ছি তার থেকেই এখানে ফসলে খাজনা ও সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের শোষণের পরিমাণ ও অর্থনীতির চরিত্র নির্ণয় সহজেই করা যেতে পারে। কিন্তু এই চিত্র আইয়ুব খানের ভূমিনীতি প্রচলিত হওয়ার পূর্ববর্তী পর্যায়ের। আইয়ুবের শাসন আমলে এই অবস্থার আরও দ্রুত অবনতি ঘটে এবং তার ফলে কৃষকদের জীবনচিত্র উল্লিখিত অবস্থান থেকে হয়ে উঠে আরও ভয়াবহ।

২. আইয়ুবের ভূমিনীতি এবং তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য

যে কোন দেশে ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ ও ভূমি সংস্কারের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতেও দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবর্তনের ধারা সেই সমস্ত দেশে সামন্ত অর্থনীতিকে ভেঙ্গেচুরে নোতুন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী করে নিয়েছিলো। কিন্তু সাধারণভাবে এটা সত্য হলেও প্রত্যেক দেশেই এই পরিবর্তন একই পথ ধরে অগ্রসর হয়নি, তাদের প্রত্যেকেরই এদিক দিয়ে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলো।

ধনতন্ত্রের বিকাশের অর্থ নোতুন নোতুন পণ্য সৃষ্টি। কিন্তু শুধু পণ্য সৃষ্টির মাধ্যমেই ধনতন্ত্রের বিকাশ হয়ও না এবং তা সম্ভবও নয়। কারণ পণ্য সৃষ্টির পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজন উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি প্রথম বৎসরে ১ লক্ষ সূতী শাড়ী তৈরী করে বৎসরের শেষে দেখে যে আশি হাজারের বেশী শাড়ী তার বিক্রি হয়নি তাহলে তারা পরবর্তী বৎসরে আর এক লক্ষ শাড়ী তৈরী করবে না। এর কারণ এক লক্ষ শাড়ী বিক্রির বাজার দেশে নেই। এর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, শিল্পজাত পণ্যের জন্য বাজারের প্রয়োজন এবং শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন বাজারের বিস্তৃতি অর্থাৎ অধিকতর সংখ্যক ক্রেতার মধ্যে উৎপন্ন জিনিসের চাহিদা সৃষ্টি।

কিন্তু চাহিদা সৃষ্টি হয় কিভাবে : এটা সম্ভব লোকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জীবন ধারণ, ভোগ ও উৎপাদনের জন্য মানুষের অনেক কিছু প্রয়োজন হয়, মানুষ সেগুলি কিনতেও চায়। কিন্তু প্রয়োজন থাকলে এবং কেনার ইচ্ছে হলেই মানুষ যে কোন জিনিস কিনতে পারে না। সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয় একমাত্র তখনই যখন প্রয়োজন ও ইচ্ছের সাথে অর্থ-সামর্থ্যও থাকে। এই অর্থ-সামর্থ্য না থাকলে কোন জিনিসের যত প্রয়োজনই হোক এবং তা সংগ্রহের যত ইচ্ছেই থাক সে প্রয়োজন এবং ইচ্ছে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে না। কাজেই বাজারের বিস্তৃতির অর্থ এই ধরনের চাহিদার বিস্তৃতি। এবং এই ধরনের চাহিদার বিস্তৃতির অর্থ সমাজে বসবাসকারী জনগণের কর্মসংস্থান এবং আয়-বৃদ্ধি। আয় বৃদ্ধির সাথে এজন্যেই ধনতন্ত্রের বিকাশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

অনুন্নত দেশে শিল্প বিকাশ যে পর্যায়ে শুরু হয় সে পর্যায়ে দেশের

* বর্গা প্রথায় দেয় ফসলে খাজনার মধ্যে সামন্ত শোষণের অবশেষ থাকলেও বর্তমানে প্রচলিত বর্গা প্রথাকে পুরোপুরি সামন্ত শোষণ বলা চলে না। কারণ এক্ষেত্রে বীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ, দিনমজুরির ভিত্তিতে কৃষি শ্রমিক নিয়োগ, সেচের পানি ইত্যাদির জন্য পুঁজি নিয়োগের প্রয়োজন। এবং এই পুঁজি কোন ক্ষেত্রে বর্গাদারকে পুরো নিয়োগ করতে হয়, কোন ক্ষেত্রে জমির মালিককে পুরো নিয়োগ করতে হয় অথবা কোন ক্ষেত্রে সেই পুঁজি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়োজিত হয়। বিভিন্ন এলাকার বিশেষ অবস্থার উপরই নির্ভর করে কে কতখানি পুঁজি এইভাবে নিয়োগ করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুঁজি বিনিয়োগের একটা ব্যাপার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই থাকে এবং সেজন্য উৎপন্ন ফসলে পুঁজিরও একটা অংশ থাকে। জমির মালিক পুঁজি নিয়োগ করলে সে ফসলের ভাগও সেই অনুযায়ী বেশী নির্ধারণ করে। এই অতিরিক্ত অংশটি হয় পুঁজির মুনাফা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইভাবে নিয়োজিত পুঁজি জমির মালিক ও বর্গাদারদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।

অধিকাংশ মানুষই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে এবং কৃষি কার্যই হয় তাদের আর্থিক জীবনের ভিত্তি। শতকরা আশি-নব্বুই ভাগ মানুষ এইভাবে কৃষিকার্যের ওপর নির্ভরশীল থেকে গ্রামে বসবাস করার ফলে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা ও বাজার সম্প্রসারণের প্রশ্ন তাদেরকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরর্থক। এজন্যে শিল্প সম্প্রসারণ ও বিকাশের খাতিরেই প্রয়োজন শতকরা এই আশি-নব্বুই ভাগ মানুষের সামাজিক এবং উৎপাদন সম্পর্ক এবং সেই সাথে আর্থিক জীবন কিছুটা পরিবর্তন করা, শিল্প বিকাশের ধারার সাথে সমন্বয় রেখে ধীরে ধীরে তাদের আর্থিক অবস্থারও সংস্কার করা।*

এই সংস্কার প্রচেষ্টার সাথেই ভূমি সংস্কারের প্রশ্ন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই সংস্কারের প্রয়োজনেই সরকারের মাধ্যমে শিল্প পুঁজি স্বার্থ ভূমি সংস্কারের উদ্যোগী হয়। পাকিস্তানেও এই ব্যতিক্রম হয়নি এবং এই প্রয়োজনের তাগিদেই আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা দখল করার পর সেই মাসেই নিয়োগ করেছিলেন ভূমি সংস্কার কমিশন।

এক দশকেরও অধিক কাল ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের বিকাশ ঘটলেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সেখানে কোন ভূমি সংস্কার হয়নি। এর কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ত শক্তির প্রভাব। আইয়ুব খানের পূর্ববর্তী সে সমস্ত রাজনৈতিক শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন তাদেরকে ভূস্বামী শ্রেণীর ওপর অনেকখানি বেশী নির্ভর করতে হতো, তারা নিজেরাও অধিকাংশই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বড়ো বড়ো সামন্ত পরিবারের সন্তান। কাজেই যতদিন তাঁদের হাতে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিলো ততদিন পশ্চিম পাকিস্তানে কোন ভূমি সংস্কারই সম্ভব হয়নি। আইয়ুব খানের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান সেদিক দিয়ে অনেক স্বতন্ত্র ছিলো। ভূস্বামী শ্রেণীর সাথে তাঁর সামরিক শাসনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকলেও তাদের উপর তিনি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে বৃহৎ শিল্প, বৃহৎ ব্যবসা ও সামগ্রিকভাবে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথেই আইয়ুবের যোগ ছিলো অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী। এই শ্রেণীর স্বার্থেই আইয়ুব খান শাসন ক্ষমতা দখল করেই ভূমি সংস্কার কমিশন নিয়োগ করেন।

আইয়ুব পশ্চিম পাকিস্তান ভূমি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে যে ভূমিনীতি ঘোষণা করেন তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যেক পরিবারের উর্ধতম জমির পরিমাণ নির্দিষ্ট হয় ৫০০ একর। ভূমি সংস্কারের দিক দিয়ে জমির এই উর্ধতম পরিমাণ খুব বেশী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেটা ছিলো একটা অগ্রসর পদক্ষেপ। কারণ সেখানে বড়ো জমিদার জায়গীরদারদের এক একজনের জমির পরিমাণ ছিলো দশ, বিশ, এমন কি তিরিশ-চল্লিশ হাজার একর পর্যন্ত। পূর্ব বাঙলায় ভূমি সংস্কারের জন্যে কোন পৃথক কমিশন গঠন না করলেও আইয়ুব এখানে জমির উর্ধতম পরিমাণ নির্দিষ্ট করেন ১২৫ একর অর্থাৎ ৩৭৫ বিঘা।

পূর্ব বাঙলার ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ অনুযায়ী ইতিপূর্বে ১৯৫০ সালে প্রত্যেক পরিবারের উর্ধতম পরিমাণ অর্থাৎ সিলিং নির্ধারিত হয় ১০০ বিঘা অথবা মাথাপিছু ১০ বিঘা। এদিক দিয়ে বিচার করলে পূর্ব বাঙলায় আইয়ুবের ভূমি নীতিকে সংস্কার আখ্যা তো দেয়া চলেই না, উপরন্তু তা ছিলো সংস্কারের বিপরীত।

পশ্চিম পাকিস্তান ৫০০ একরকে জমি মালিকানায় সিলিং নির্দিষ্ট করলেও ভূস্বামীদের অতিরিক্ত জমি সরকার বিনামূল্যে দখল না করে তার জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে। যে কোন বুর্জোয়া ভূমি সংস্কারেই অতিরিক্ত জমির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকে। কাজেই সেদিক দিয়ে এখানে কোন ব্যতিক্রম হয়নি।

দুটি মূল কারণে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। প্রথমতঃ সম্পত্তির প্রতি বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্মাণ। সামন্ত ব্যবস্থার মতো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এজন্যে কোন প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে তারা অক্ষম। পূর্ব বাঙলার ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলের’ বিতর্ককালেও ক্ষতিপূরণের সমর্থনে অর্থমন্ত্রী যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী নেওয়ার অর্থ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। আইন অনুযায়ী সরকার কোন ব্যক্তিকেই জমিদারী, শিল্প, বাণিজ্য অথবা অন্য কোন স্বার্থ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ব্যতীত বঞ্চিত করতে পারেন না।

ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দ্বিতীয় কারণ, ভূমি সংস্কারকে শিল্প উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা। একদিকে যেমন এই সংস্কারের দ্বারা গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী কৃষকদের আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তেমনি অন্যদিকে ভূস্বামীরা ক্ষতিপূরণের অর্থ শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারেন। এর ফলে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে পুঁজির অভাব অনেকখানি দূর হয়। ইউরোপের ধনতন্ত্রের বিকাশের যুগে সামন্ত ভূস্বামীরা শিল্প ক্ষেত্রে পুঁজি নিয়োগ করে ভূমি থেকে অর্জিত আয় ছাড়াও এই নোতুন এবং অতিরিক্ত আয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। ভূস্বামীদের এই আয়কেই মার্কস ‘যন্ত্রশিল্পেরূপ গাছের সোনার ফল’ বলে আখ্যায়িত করেন।

আইয়ুবের ভূমিনীতি কিন্তু পূর্ব বাঙলায় শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে তেমন সহায়ক হলো না। প্রথমতঃ এখানে উর্ধতম পরিমাণ ১০০ বিঘা থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ বিঘা করাতে ক্ষতিপূরণের কোন প্রশ্ন উঠলো না। ক্ষতিপূরণের অর্থ যেখানে নেই সেখানে ভূমি সংস্কারের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে পুঁজি নিয়োগের প্রশ্নও অবান্তর। উপরন্তু এখানে ফল দাঁড়ালো উল্টো। কারণ ১৯৫০ সালে জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্দিষ্ট করে জমির প্রতি ঝোঁক কমিয়ে শিল্পে অর্থ নিয়োগের যে ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিলো তার চাকাকে এই নোতুন ভূমিনীতি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলো।

এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর থেকে নানা দুঃখ-দুর্দশা এবং আর্থিক বিপর্যয়ের ফলে কৃষকরা জোতদার মহাজন শ্রেণীর কাছে ঋণের দায়ে যেভাবে জমি হস্তান্তর করছিলো আইয়ুব ভূমিনীতি তাকেই আইনগত সমর্থন দিয়ে সেই উল্টোমুখী ধারা রোধ অথবা খর্ব করার পরিবর্তে তাকে জারী রাখা এবং প্রবল করারই ব্যবস্থা করে জোতদার মহাজনদের মধ্যে অনেক কৃষকদের জমি সরাসরি নিজেদের মালিকানাধীনে আনতে না পেরে সেগুলি বন্ধকী জমি হিসেবে নিজেদের দখলে রাখতো। আইয়ুবের ‘সংস্কার’ জমির ওপর তাদের দখলী স্বত্বকে মালিকানা স্বত্বে পরিণত করার পথ পরিষ্কার করলো।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। অধিক পরিমাণ জমি ব্যক্তি মালিকানার অধীনে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ব্যবস্থা পূর্ব বাংলায় প্রবর্তিত

* অপর একটি কারণেও চাহিদা বৃদ্ধি এবং তার সাথে বাজারের বিস্তৃতি ঘটে। সে কারণটি হলো, জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কৃষকদের কৃষি শ্রমিকে পরিণত হওয়া। জমির মালিক থাকার সময়, এমন কি বর্গা চাষেও নিযুক্ত থাকার সময়েও কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজন নিজেদের উৎপন্ন ফসলের দ্বারা পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে মেটাতে সক্ষম হন। এর ফলে বাজারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কম থাকে। কিন্তু জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কৃষি শ্রমিকে পরিণত হওয়ার ফলে তারা নিজেদের উৎপন্ন ফসলের দ্বারা নিজেদের চাহিদা মেটাতে আর সক্ষম হন না। এজন্য তাঁদেরকে বাজারের ওপরেই নির্ভরশীল হতে হয়। অর্থাৎ কৃষি শ্রমিক হিসেবে তাদেরকে খাদ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসই বাজার থেকে কিনে নিজেদের চাহিদা মেটাতে হয়। কাজেই জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কৃষি শ্রমিকে পরিণত  হওয়াতে কৃষকদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটলেও বাজার থেকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস তাদেরকে বাধ্যতাবশতঃ কিনতে হওয়ার জন্যে তার দ্বারা সাময়িকভাবে বাজারের সম্প্রসারণ ঘটে। এবং বাজারের এই সম্প্রসারণের অর্থই হলো কৃষি ক্ষেত্রে ধনবাদী উৎপাদন সম্পর্ক, মুদ্রা অর্থনীতি ও ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কমবেশী সম্প্রসারণ।

“সুতরাং রাজনীতির কার্যক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দমনের সকল ব্যবস্থায় এরা যোগ দেয়। আর সাধারণ জীবনযাত্রায় বড় বড় বুলি সত্ত্বেও যন্ত্রশিল্পরূপ গাছের সোনার ফল কুড়িয়ে নিতে এদের আপত্তি নেই। পশম, বীট, চিনি অথবা অল্প মদের ব্যবসার জন্য সত্য, প্রেম, মর্যাদা বেচতে এদের দ্বিধা হয় না ” [কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। কমিউনিস্ট পার্র্টির ইশতেহার। প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। পৃঃ৫৯]

এর ফলে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পায় এবং এইভাবে গ্রামাঞ্চলে বাজারের কিছুটা বিস্তৃতি ঘটে। ফলে আইয়ুবের সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র বেআইনী জমি দখলকে বাধা না দিয়ে তাকে পরোক্ষভাবে উৎসাহ দেওয়ার নীতিই গ্রহণ করলো। এই উৎসাহের জোরে পূর্ব বাঙলার সর্বত্র তো বটেই, তবে বিশেষভাবে ফরিদপুর ও দক্ষিণ বাঙলার চর অঞ্চলে জোতদাররা ঘুষ ও নানান দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার বিঘা জমি নিজেদের আয়ত্তগত করলো। কাজেই ১৯৫০ সালের জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের যা কিছু সামান্য সুফল কৃষকরা পেয়েছিলেন সেটাও অবশেষে সম্পূর্ণ নাকচ হয়ে গেলো। অল্প জমির মালিক কৃষকদের আয় করতে শুরু করলো এবং সেই অনুযায়ী তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে এই সংস্কারের ফলে তা উত্তরোত্তর হ্রাস পেতে থাকলো। এইভাবে একদিকে প্রাপ্ত কৃষি উদ্বৃত্ত জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিয়োজিত হওয়া এবং অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বাজারের প্রয়োজনীয় বিস্তৃতি না ঘটার পরিণতিতে পূর্ব বাঙলার শিল্প সম্প্রসারণ যে অনেকখানি বাধাপ্রাপ্ত হলো সে কথা বলাই বাহুল্য।

এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা গেলো তার থেকে আইয়ুবের ভূমিনীতির অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলি মোটামুটি হলো এই :

(ক) পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণ করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃষকদের মধ্যে উৎপন্ন ফসলে অধিকতর অংশ দেওয়া। এর অর্থ কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও শিল্প পণ্যের দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ।

(খ) পশ্চিম পাকিস্তানে ভূস্বামীদেরকে ক্ষতিপূরণ দানের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে অর্থ নিয়োগ করতে উৎসাহ দান।

(গ) পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ের উৎস হিসেবে জমির প্রতি ঝোঁক কমিয়ে শিল্প মালিকানার দিকে ঝোঁক বাড়ানো।

(ঘ) পূর্ব বাঙলায় কৃষকদের জমি হস্তান্তর সহজতর করা ও তাদের আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে (বিশেষতঃ উৎখাত হওয়া কৃষকদের মজুর হিসেবে নিয়োগের সুযোগ অভাবে) তাকে সঙ্কুচিত করা।

(ঙ) পূর্ব বাঙলার ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে জমি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ধারা অব্যাহত রেখে জমির প্রতি ঝোঁক বাড়ানো ও তার মাধ্যমে বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের এক বিরাট অংশকে শিল্পক্ষেত্র থেকে জমি ক্রয়ের দিকে চালনা করা। এইভাবে পূর্ব বাঙলায় পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানী বড়ো পুঁজির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা।

(চ) পূর্ব বাঙলায় সামন্ত প্রথার অবশেষসমূহকে সামরিক শাসনের প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রণ করা।

উপরোক্ত অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, তাদের প্রত্যেকটিই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প পুঁজি স্বার্থে নিয়োজিত। পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্তশক্তিকে অনেকাংশে খর্ব করে সেখানে শিল্প সম্প্রসারণ এবং পূর্ব বাঙলার আধা সামন্তবাদী পশ্চাদপদ অর্থনীতিকে একই গতিতে খর্ব না করে এখানকার শিল্প সম্প্রসারণে যথাসাধ্য বাধা দিয়ে পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পের বিক্রয় ক্ষেত্র বা বাজার হিসেবে টিকিয়ে রাখাই আইয়ুব-প্রবর্তিত ভূমিনীতির মূল অর্থনৈতিক লক্ষ্য।

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আইয়ুব অন্যান্য যে সমস্ত নীতি অনুসরণ করেন তার মধ্যে সর্বপ্রধান হলো রাষ্ট্রকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মতো একটা খাজনা আদায়কারী যন্ত্রে পরিণত করা। এই যন্ত্র এবং তার অধীনস্থ কর্মচারীবৃন্দ কৃষকদের ওপর কর বৃদ্ধি করে এবং ঘুষ, দুর্নীতি ও নানান নির্যাতনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেতাত্মাকেই বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাঙলার কৃষকদের ওপর লেলিয়ে দেয়।

সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ফলে পূর্ব বাঙলায় আইয়ুব খান এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কোন সামাজিক মূল ছিল না। এই সামাজিক মূলহীনতা যে কোন শাসনের পক্ষেই রীতিমতো বিপজ্জনক। কাজেই এই বিপদ অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠার জন্য আইয়ুব খানের প্রয়োজন হয় পূর্ব বাঙলায় এক শ্রেণীর সমর্থক ও সহযোগী সৃষ্টি করা। কিন্তু স্বার্থের ঐক্য ব্যতীত কোন সক্রিয় সহযোগিতা কখনো সম্ভব নয়। এজন্যে আইয়ুব এদেশে এমন এক শ্রেণীকে বাছাই করেন যারা তাঁদের স্বার্থের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী এবং যাদের স্বার্থের সাথে তাদের কোন শ্রেণীগত সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই। এই শ্রেণীকেই অবলম্বন সম্পর্ক স্থাপন করে পূর্ব বাঙলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের শ্রেণীচরিত্র অনেক ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা নির্বাচিত হলো তারা অনেকখানি সামন্ত প্রভাবের আওতাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক পরিবর্তনের দিক দিয়ে বিচার করলে তারা ‘সামন্ত প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা’ এক নোতুন শ্রেণীর লোক—এই শ্রেণী হলো গ্রাম্য বুর্জোয়া। পশ্চিম পাকিস্তানে এই গ্রাম্য বুর্জোয়াদের মাধ্যমেই সামন্তশক্তি শিথিল হচ্ছে।

পূর্ব বাঙলায় এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের শ্রেণীচরিত্র এদিক দিয়ে কিছুটা স্বতন্ত্র। এখানে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা নির্বাচিত হলো তারা প্রধানতঃ নিজেরাই জোতদার মহাজন—সামন্ত অবশেষের প্রতিনিধি। এরা যে শুধু আইয়ুবকে রাজনৈতিক সমর্থনই দান করলো তাই নয়। গ্রামাঞ্চলে পশ্চাদপদ অর্থনীতিকে প্রয়োজন মতো টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এরাই হলো সরকারের মূল খুঁটি।

এই মৌলিক গণতন্ত্রীদেরকে শক্তিশালী করার জন্য আইয়ুব সরকার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সারা পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে ব্যয় করে। দুর্নীতির মাধ্যমে এই অর্থের এক বিপুল অংশ পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মৌলিক গণতন্ত্রীদের হাতেই যায়। কিন্তু শ্রেণীচরিত্রের পার্থক্যের জন্যে তারা একইভাবে এই মূলধনকে কাজে লাগায় না। পশ্চিম পাকিস্তানে এই মূলধন ব্যয়িত হয় মোটামুটি ছোটখাট শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে। পূর্ব বাঙলায় সেই একই মূলধন নিয়োজিত হয় মহাজনী কারবার এবং জমি খরিদের ক্ষেত্রে।

এদিক দিয়ে বিচার করলেও দেখা যাবে যে, মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থায় অবলম্বিত দুর্নীতির ফলাফলও পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে এক হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে তা সামন্তবাদকে খর্ব করার পথ খুলে দিয়েছে এবং পূর্ব বাঙলায় তা আধা-সামন্তবাদী পশ্চাদপদ অর্থনীতিকে প্রয়োজন মতো টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

৩. মৌলিক গণতন্ত্র

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করার পরিবর্তে পশ্চাদমুখী ও প্রতিক্রিয়াশীল জোতদার-মহাজন শ্রেণীকে কেন্দ্রীয় সরকারের  দৃঢ়তম রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করাই যে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য সেটা মৌলিক গণতন্ত্র এবং ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

প্রথমেই মৌলিক গণতন্ত্রের কাঠামো সম্পর্কে বলা দরকার। ইউনিয়ন কাউন্সিলই মৌলিক গণতন্ত্রের নিম্নতম প্রশাসনিক ইউনিট এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। এই কাউন্সিলের নির্বাচন সাবালকের প্রত্যক্ষ ভোটে হলেও মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ জেলা শাসকের অনুমতিক্রমে মহকুমা শাসকের দ্বারা মনোনীত। মনোনয়নের এই ব্যবস্থা অবশ্য ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাবালকের প্রত্যক্ষ ভোটের পরিবর্তে পরোক্ষভাবে কাউন্সিলের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন।

নোতুন ব্যবস্থায় ইউনিয়ন কাউন্সিলকে স্থানীয়ভাবে কর ধার্যের ব্যাপকতর ক্ষমতা দেওয়া হবে। চৌকিদারী আদায় ব্যতীত জমি, বাড়ী, ব্যবসা, যানবাহন ইত্যাদির উপর কর আদায়ের ক্ষমতা প্রাপ্ত হওয়ায় এবং সরকারী সাহায্য বৃদ্ধির ফলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের আয় দাঁড়ায় গড়পড়তা বাৎসরিক ১৩,০০০ টাকা। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ইউনিয়ন বোর্ডগুলির বাৎসরিক আয় ছিলো মাত্র ১৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা।

ইউনিয়ন কাউন্সিলের ঠিক উপরের ধাপ হলো থানা কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্য হলো থানার অধীনস্থ ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলির চেয়ারম্যানবৃন্দ, এক-চতুর্থাংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত এবং অন্য চতুর্থাংশ হলো থানা কৃষি ও সমবায় অফিসার, রাজস্ব সংক্রান্ত সার্কেল ইন্সপেক্টর, স্কুল পরিদর্শক প্রভৃতি থানা পর্যায়ের থানা কাউন্সিলগুলির চেয়ারম্যান হিসেবে সার্কেল অফিসারকেই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এই থানা কাউন্সিলের উপরে জেলা কাউন্সিল। এখানে অর্ধেক সদস্য হলো সরকারী কর্মচারীবৃন্দ, এক-চতুর্থাংশ জেলার ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের থেকে মনোনীত এবং বাকী এক-চতুর্থাংশ মনোনীত জেলার ‘হোমরাচোমরা’ ব্যক্তিদের থেকে। জেলা কাউন্সিলের এই অবস্থা থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে যে, তা ১৮৮৫ সালের ব্যবস্থার থেকে সর্বাংশে পশ্চাদপদ। পূর্ব ব্যবস্থায় জেলা বোর্ডে যেখানে সরকারী মনোনয়ন ছিলো এক-চতুর্থাংশ সেখানে জেলা কাউন্সিলের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই হলেন মনোনীত। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোন স্থান এতে নেই।

এর থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইউনিয়ন কাউন্সিল ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিত্বের কোন ব্যবস্থা মৌলিক গণতন্ত্রের মধ্যে নেই।

মৌলিক গণতন্ত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো জাতীয় রাজনীতির সাথে তার যোগসূত্র। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে সাবালকের ভোটের ব্যবস্থা ১৯৬২ সালের সংবিধানে ছিলো না। সারা দেশে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্রীরাই ছিলো এই নির্বাচনে ভোটদানের মালিক। সাবালকের প্রত্যক্ষ ভোটের পরিবর্তে সরকারী অনুগ্রহপুষ্ট মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটের উপর প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনকে দাঁড় করানোর রাজনৈতিক সুবিধা সহজেই বোধগম্য। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই নির্বাচনের একটা আবরণ রেখে আইয়ুব সরকার পূর্ব বাঙলার সামন্ত শক্তির সাথে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থগত যোগসূত্রকে অনেকাংশে নিরাপদ এবং দৃঢ়তর করে।

পেশাগত এবং আয়গত দিক দিয়ে কারা ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলিতে নির্বাচিত হয়েছিলো সেটা নিম্নলিখিত কতকগুলি তথ্য থেকে জানা যাবে। এ তথ্যগুলি বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার সার্ভে রেকর্ড থেকে সংগৃহীত।

পেশাগত বিভাগ—১ (সমগ্র সংখ্যার শতাংশ)

বৎসর ভূমি-মালিক ব্যবসাদার ও ঠিকাদার উকিল, শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি অন্যান্য
১৯৫৯ ৮২,৪৬ ১৫,৬০ ০.৬৫ (শুধুমাত্র উকিল) ১.২৯
১৯৬৪ ৭৭,৭৮ ১৬,৯৬ ২.৭৮ (উকিল, শিক্ষক, ডাক্তার) ২.৪৮

উপরের টেবিলটি থেকে স্পষ্টই দেখা যায় যে, ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে ভূমি মালিকদের সংখ্যাই মোটামুটিভাবে সমগ্র সংখ্যার চতুর্থাংশ-পঞ্চমাংশ। এর কারণ অধিকাংশ সদস্যই গ্রামাঞ্চলের এবং এদের আয়ের মূল উৎস জমি। এই হিসেবে অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৯-এর থেকে ১৯৬৪ সালে ভূমি-মালিকদের শতাংশ কমে এসেছে। এই হিসেব সামগ্রিকভাবে বিচার না করে যদি গ্রাম ও শহরাঞ্চলের ভিত্তিতে বের করা যায় তাহলে অবশ্য চিত্রটা সামান্য অন্যরকম দাঁড়ায়। এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ সালের মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচনের আর একটি হিসেব নীচে দেওয়া গেলো।

পেশাগত বিভাগ—২ (১৯৬৪) (সমগ্র অংশের শতাংশ)

অঞ্চল ভূমি-মালিক ব্যবসাদার ও ঠিকাদার উকিল, শিক্ষক, ডাক্তার অন্যান্য মোট
গ্রামাঞ্চল ৮০.৮৯ ১৪.৪০ ২.৫২ ২.১৯ ১০০
৮.৯৮ ৭৩.৬১ ৮.১০ ৯.৩১ ১০০

পেশাগত বিভাগের এই দ্বিতীয় টেবিলটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৯ সালের মতো ১৯৬৪ সালেও গ্রামাঞ্চলের মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে ভূমি মালিকদের সংখ্যা ৮০% এরও বেশী। সামগ্রিক চিত্র ১৯৬৪ সালে সামান্য পরিবর্তনের কারণ শহরাঞ্চলে ভূমি মালিকদের পরিবর্তে ব্যবসাদার ও ঠিকাদারদের সংখ্য বৃদ্ধি।

মৌলিক গণতন্ত্রীদের শ্রেণীচরিত্র বোঝার সুবিধের জন্য তাদেরকে আবার আয়গত দিক দিয়ে বিভক্ত করে নীচের টেবিলটিতে দেখানো গেলো।

আয়গত বিভাগ—৩ (১৯৬৪) (সমগ্র অংশের শতাংশ)

অঞ্চল বাৎসরিক ১০০০ টাকার নীচে আয় বাৎসরিক ১০০০ টাকার উপরে এবং ৩০০০ টাকার নীচে আয় বাৎসরিক ২০০০ টাকার উপর এবং ৩০০০ টাকার নীচে আয় বাৎসরিক ৩০০০ টাকার উপর এবং ৪০০০ টাকার নীচে আয় বাৎসরিক ৪০০০ টাকা এবং তদূর্ধ্ব আয় মোট
গ্রামাঞ্চল ১০.৫৩ ২১.৬৬ ২১.৫৭ ১৬.৭২ ২৯.৫২ ১০০
শহরাঞ্চল ১.৯৪ ৯.৬০ ১৪.১২ ১৬.২৫ ৫৮.০৯ ১০০

পেশাগত দিক থেকে বিভক্ত করে আমরা দেখছি যে, গ্রামাঞ্চলে ৮০% এর উপর মৌলিক গণতন্ত্রীরা ভূমি মালিক। আয়গত বিভাগের উপরের টেবিলটি থেকেও আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ভূমি মালিকেরা কোন শ্রেণীভুক্ত। দুই হাজার থেকে চার হাজার ও তদূর্ধ্ব বাৎসরিক আয়সম্পন্ন মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংখ্যা হলো ৬৭.৮%।

কিন্তু এর মধ্যে বাৎসরিক ৪০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব আয়সম্পন্ন হলো ২৯.৫২% অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ। এই ৬৭.৮১% মৌলিক গণতন্ত্রীরা অধিকাংশই জোতদার শ্রেণীভুক্ত। এদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ধনী কৃষকও আছে। বিপুল সংখ্যাধিক্যের জন্যে প্রত্যেক ইউনিয়ন কাউন্সিলেই যে জোতদার-মহাজনরা নিরঙ্কুশ প্রাধান্য লাভ করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

উপরের সার্ভে রেকর্ডগুলির সাথে পরবর্তী পর্যায়ের আর একটি সার্ভের৪ তুলনামূলক বিচার করলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে ধারণা আরও স্পষ্ট হবে।

পূর্ব বাঙলার জমি মালিকানার স্তর বিভাগ ও জমি

মালিকানার ভিত্তিতে মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংখ্যা (১৯৬০-৬৫)৫

খামারের আয়তন সারা পূর্ব বাঙলা (১৯৬১) মৌলিক গণতন্ত্রীদের শতকরা সংখ্যা

(৩৯২ জনের উপর ভিত্তি করে)

০.৫ একরের নীচে ১৩.০
০.৫ থেকে ১.০ একরের নীচে ১১.০
১.০ থেকে ২.৫ একরের নীচে ২৭.০ ২.২৯
২.৫ থেকে ৫.০ একরের নীচে ২৬.০ ১৩.২৬
৫.০ থেকে ৭.৫ একরের নীচে ১২.০ ২১.১৭
৭.৫ থেকে ১২.৫ একরের নীচে ৭.০ ২০.৪১
১২.৫ থেকে ২৫.০ একরের নীচে ৩.০ ২৩.৪৭
২৫.০ থেকে ৪০.০ একরের নীচে ১২.৫
৪০.০ একর ও তদূর্ধ্বে ৬.৮৮

এই টেবিলটির অঙ্কগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এক একরের কম জমির মালিকদের সংখ্যা ২৪% হলেও ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলিতে তাদের কোনই স্থান নেই। কিন্তু ৭.৫ ও তদূর্ধ্ব পরিমাণ জমির মালিকদের সংখ্যা ১১% এর কম হলেও মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে তাদের সংখ্যা ৬৩.২৬%।

এই একই সার্ভের আর একটি হিসেব মতো আয়গত দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, জমির পরিমাণের থেকে আয়ের পরিমাণের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও প্রকট।

আয়গত ভিত্তিতে মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংখ্যা৬ (১৯৬০-৬৫)

আয়গত মর্যাদা বাৎসরিক ১০০০ টাকার কম বাৎসরিক ১০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব বাৎসরিক ২০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব বাৎসরিক ৩০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব বাৎসরিক ৪০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব
কিন্তু ৪০০০ টাকার নীচে কিন্তু ৩০০০ টাকার নীচে
১৯৫৮-৫৯

১৯৬৪-৬৫

৩.৬৮

১.৮৩

১৫.৬৮

১২.৯২

২৬.৫২

২৪.২৫

১৯.৫৪

২২.৪১

৩৫.৩

৪৪.০

এই টেবিলটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৮-৫৯ সালে বাৎসরিক ২০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব আয়সম্পন্ন মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংখ্যা ৮১.৩৬% কিন্তু ১৯৬৪-৬৫ সালে তাদের সংখ্যা ৯০.৬৬% এর মধ্যে ৪০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব আয়সম্পন্নদের সংখ্যা ১৯৫৮-৫৯ এবং ৩৫.৩% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪%।

জমি মালিকানা এবং আয়গত ভিত্তিতে মৌলিক গণতন্ত্রীদের সম্পর্কে উপরের দুটি টেবিলের তথ্য থেকে একটি জিনিস বিশেষভাবে চোখে পড়ে। সেটি হলো এই যে, ভূমি মালিকানা থেকে বাৎসরিক আয়ের ভিত্তিতে বিচার করলে উচ্চ শ্রেণীর সংখ্যাধিক্য তুলনায় অনেক বেশী দাঁড়ায়। এর কারণ খুব স্পষ্ট। জমির ভিত্তিতে দেখলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের শুধু জোতদারী চরিত্র বোঝা যায়। কিন্তু মোট আয়ের ভিত্তিতে দেখলে জোতদার-মহাজনকে চোখে পড়ে। অপেক্ষাকৃত ছোট জোতদারদের জমির আয়ের সাথে মহাজনী কারবারের আয় যুক্ত হওয়াতেই আয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর আপেক্ষিক সংখ্যাগুরুত্ব। ২৫ একর এবং তদূর্ধ্ব জমির মালিক (১৯.৩৮) এবং বাৎসরিক ৪০০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব আয়সম্পন্ন ব্যক্তির (৪৪%) তুলনা করলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।

মৌলিক গণতন্ত্রীদের সম্পর্কে যে পাঁচটি টেবিলের তথ্য এখানে উল্লেখ করা গেলো তাদের সূত্র ভিন্ন হলেও প্রত্যেকটির মধ্যে একটি সত্যিই চোখে পড়ে। সেটি হলো মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে জোতদার-মহাজন শ্রেণীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

কিন্তু এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। অন্য আরো অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, বড়ো জোতদার-মহাজনরা তো বটেই, এমনকি অপেক্ষাকৃত অল্পবিত্তসম্পন্ন মৌলিক গণতন্ত্রীরা পর্যন্ত স্থানীয় ‘স্বায়ত্তশাসনের’ সুযোগ নিয়ে নিজেদের আয়কে বৃদ্ধি করে অনেক উচ্চতর পর্যায়ের নিয়ে গেছে। অন্য কতকগুলি বিষয়ের সাথে এই প্রক্রিয়াকে ভালোভাবে বোঝার জন্যে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দরকার।

৪. ওয়ার্কস প্রোগ্রাম*

ওয়ার্কস প্রোগ্রামের উপর আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার তা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই প্রোগ্রামের সম্পর্ক১। কারণ প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এই পরিকল্পনার প্রবর্তক।

১৯৬১ সালে জন কেনেডি প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘শান্তির জন্যে খাদ্য’ প্রোগ্রাম গ্রহণ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো মোটামুটি দুটি। প্রথমতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল খাদ্য উদ্বৃত্তকে পি,এল, ৪৮০ প্রোগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর খাদ্য ঘাটতি দেশগুলিতে চালান দেওয়া। দ্বিতীয়তঃ খাদ্যশস্য সরবরাহের সুযোগ নিয়ে অনুন্নত দেশগুলিতে মার্কিন প্রভাব ও প্রভুত্বকে জোরদার করা। পৃথিবীর অন্যতম খাদ্য ঘাটতি এলাকা হিসাবে পাকিস্তান সহজেই এই কর্মসূচীর আওতাভুক্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের সাথে এ বিষয়ে যে চুক্তি করে তার ফলে সাব্যস্ত হয় যে, পি,এল, ৪৮০-এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৬২ কোটি ১০ লক্ষ ডলার মূল্যের উদ্বৃত্ত গম, মাখন, গুঁড়ো দুধ, তেল, চর্বি ইত্যাদি সরবরাহ করবে। পাকিস্তান এইসব খাদ্যসামগ্রীর মূল্য টাকায় পরিশোধ করবে এবং তা পাকিস্তানে মার্কিন সরকারের ‘কাউন্টার পার্ট ফান্ডে’ জমা থাকবে। এই ফান্ডের একটা অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাহায্যপ্রাপ্ত’ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় ব্যয় হবে এবং বাকী অংশ ব্যয় হবে পাকিস্তানে তাদের দূতাবাসের বিভিন্ন কাজকর্মে।

এই সাহায্য প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর কারণ সেখানে ‘ইন্ডাস রিপ্লেসমেন্ট ওয়ার্কস’-এ যে টাকা ব্যয় হচ্ছিলো তার ফলস্বরূপ মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার জন্যেই সেখানে ক্রয়যোগ্য পণ্য সরবরাহের প্রয়োজন ছিলো। পি, এল, ৪৮০-এর খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের সেই ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু এর ফলে আর এক সমস্যা দেখা দেয়। একে ইন্ডাস রিপ্লেসমেন্টের পরিকল্পনা বহির্ভূত ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় তার উপর আবার এই নোতুন সরবরাহ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে আরও প্রকট করে তোলার সম্ভাবনার ফলে পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের সাথে সংযুক্ত হার্ভার্ড উপদেষ্টা গ্রুপ** দ্বিতীয় পরিকল্পনার বাইরে পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলের জন্যে একটা সরকারী ওয়ার্কস প্রোগ্রামের প্রস্তাব করে।

* ওয়ার্কস প্রোগ্রামের উপর সব থেকে উল্লেখযোগ্য বই হলো রহমান সোবহান-এর ‘Basic Democracies Works Programme And Rural Development in East Pakistan‘ওয়ার্কস প্রোগ্রামের উপর অধিকাংশ তথ্যই এই বই থেকে নেয়া। Pakistan Academy for Rural Development, Comilla (PARD)-এর প্রকাশিত বহু তথ্যও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের Socio Economic Survey Board-এর পক্ষ থেকে ডক্টর মোশাররফ হোসেনও বিভিন্ন এলাকা সার্ভের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট তৈরী করেন।

** হার্ভার্ড উপদেষ্টা গ্রুপের চরিত্র সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ডক্টর আবু মাহমুদ একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন : ‘শাসক চক্র এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের স্বার্থের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য আছে। নিম্নলিখিত ঘটনাবলীর জন্যেই তিনি একথা বলেছেন : হার্ভার্ডে একটি সেমিনারে যোগদানকালে তিনি একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের যুক্তি শুনে মর্মাহত হয়েছিলেন। সে খুব জোরের সাথে যুক্তি দিচ্ছিলো (সে আবার ছিলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ছাত্র) যে, অনুন্নত দেশগুলি ইস্পাত কারখানা, যন্ত্রপাতি কারখানা ইত্যাদি তৈরী না করে তাদের উচিত কাঁচামাল তৈরীর ক্ষেত্রে তাদের যে আপেক্ষিক সুবিধা আছে সেটাই কাজে লাগানো। হার্ভার্ডে পিএইচ, ডি লাভের পূর্বেই তাকে প্ল্যানিং কমিশনের উপদেষ্টা হিসাবে পাকিস্তানে পাঠানো হয়।’

Essays on Political Economy : A.N.M. Mahmood. 1970. P.30.

এর ফলে সিদ্ধান্ত হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার পার্ট ফান্ড থেকে এই প্রোগ্রামের টাকা দেওয়া হবে এবং সেই টাকার যাতে পূর্ব বাঙলায় মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি না করে তার জন্য পৃথকভাবে পূর্ব বাঙলার জন্যে পি, এল, ৪৮০ খাতে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হবে। এই হলো পূর্ব বাঙলায় ওয়ার্কস প্রোগ্রামের সূচনা।*

এরপর উপরোক্ত মার্কিন পরামর্শদাতারা কুমিল্লার ‘পাকিস্তান একাডেমী ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ এবং তার ডাইরেক্টর আখতার হামিদ খানের মাধ্যমে কুমিল্লা এলাকায় এই প্রোগ্রাম অনুযায়ী প্রথম কাজ শুরু করে। বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই প্রোগ্রামের কিছুটা সাফল্য হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে একাডেমী থেকে প্রস্তাব করা হয় যে, শুধু তাঁদের এলাকায় এই প্রোগ্রামকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে আরও পঞ্চাশটি থানায় বিস্তার করা হোক। নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তাঁরা বলেন যে, উপযুক্ত অভিজ্ঞ, শিক্ষিত এবং সৎ কর্মচারী ব্যতীত এই কর্মসূচী সফল করা সম্ভব নয়। তাই দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রথম দিকে পঞ্চাশটির বেশী থানায় তাকে কার্যকর করার চেষ্টা সম্পূর্ণ অনুচিত।

এরপরই ১৯৬২-৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সারা প্রদেশব্যাপী ১০ কোটি টাকার এক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম চালু করে। অর্থাৎ কুমিল্লা একাডেমীর পরামর্শ মতো ৫৪টি (৫০ কুমিল্লার ৪টি) থানার মধ্যে এই প্রোগ্রামকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ছড়িয়ে দেয়া হয় পূর্ব বাঙলার ৪১১টি থানায় এবং ৪০৫৩টি ইউনিয়নে।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রোগ্রাম চালু হওয়ার পর বৎসর তার সাফল্য ও কার্যকারিতা সম্পর্কে একাডেমীর তেমন কোন বিরূপ সমালোচনা না করে তাকে সমর্থনই করে এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে আরও বর্ধিত আকারে ২০ কোটি টাকার প্রোগ্রাম পুনঃ প্রবর্তিত হয়।** শুধু তাই নয়, এর পরবর্তী পর্যায়ে তা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামাঞ্চলের জন্যে একটা স্থায়ী কর্মসূচী।

পরিকল্পনা কমিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট মার্কিন উপদেষ্টা গ্রুপ ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্রথম পর্যায়ে আখতার হামিদ খানের তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা একাডেমীতে একটি প্রজেক্ট শুরু করে। এই প্রজেক্টের সাফল্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী পর্যায়ে ওয়ার্কস প্রোগ্রামকে সারা পূর্ব বাঙলায় ব্যাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উক্ত প্রজেক্ট মোটামুটিভাবে পানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। একাডেমী এ সম্পর্কে রিপোর্টে বলে যে, বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা এবং গ্রাম্য বেকারদেরকে কাজ দেওয়ার জন্যে পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা খুব কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।২  সড়ক নির্মাণ কর্মসূচীর স্থান এই প্রজেক্টে ছিলো খুবই নগণ্য।৩

কিন্তু ওয়ার্কস প্রোগ্রামের এই প্রাথমিক সাফল্য পানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে হলেও পরবর্তী পর্যায়ে যখন সারা পূর্ব বাঙলা ব্যাপী এই প্রোগ্রাম চালু করা হয় (১৯৬২-৬৩) যখন তার মধ্যে পানি নিয়ন্ত্রণ প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়ে সমস্ত গুরুত্ব গিয়ে পড়ে সড়ক নির্মাণের উপর।

উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলে বেকারদের কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্যে পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা, বন্যা ও শুষ্কতার ফলে এদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তার হাত থেকে রক্ষার জন্যে পানি নিয়ন্ত্রণের উপর কুমিল্লা একাডেমীও প্রাথমিক পর্যায়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এই সমস্ত বিবেচনা এবং পরামর্শ সত্ত্বেও ১৯৬২-৬৩ সালের ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্যে পানি নিয়ন্ত্রণের স্থান থাকে খুবই নগণ্য। পরবর্তী পর্যায়ে তা হয়ে দাঁড়ায় আরও বেশী অনুল্লেখ্যযোগ্য।

* ‘নগদ অর্থের সরবরাহ এবং তার সাথে খাপ খাইয়ে পণ্য আমদানী এই উভয়ের জন্যেই পি, এল, ৪৮০-এর সাথে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা থাকায় এই প্রোগ্রাম পাক-মার্কিন সম্পর্কের তাপমাত্রার প্রতি দারুণভাবে স্পর্শকাতর।’ Basic Democracies Works Programme and Rural Development in East Pakistan : Rehman Sobhan. P.116.

* ‘নিজেদের পাইলট প্রজেক্টের উপর রিপোর্টে একাডেমী যে ভয় প্রকাশ করেছিলো কতকগুলি শক্তির অদ্ভূত রাসায়নিক সংমিশ্রণের ফলে তা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলো।—১৯৬২-৬৩ সালে (ওয়ার্কস প্রোগ্রাম সম্পর্কে—লেখক) নিজেদের মূল্যায়ন রিপোর্টে একাডেমী তাদের নিজেদের সযত্ন নিয়ন্ত্রিত পাইলট প্রজেক্টের থেকে এক্ষেত্রে অনেক কম বিষয়েই সমালোচনা করলো।’ Rehman, P-110 (এরপর থেকে অন্য কিছু উল্লেখ না থাকলে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের উপর রহমান সোবহানের বইটি শুধু Rehman নামেই উল্লিখিত হবে।)

পানি নিয়ন্ত্রণের প্রতি এই উপেক্ষা আরও বেশী করে চোখে পড়ে যখন ১৯৬৩-৬৪ সালে এবং ১৯৬৪-৬৫ সালে এক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের তুলনা করা হয়।৪  ১৯৬৪-৬৫ সালে খাল খননের খরচ পূর্ববতী বৎসরের তুলনায় কয়েকগুণ কমে আসে। ১৯৬৩-৬৪ সালে যেখানে ১ মাইল খাল খননের জন্যে খরচা হতো ১ মাইল কাঁচা সড়ক নির্মাণের থেকে ৩৩০৬ টাকা বেশী, সেখানে ১৯৬৪-৬৫ সালে সেই খরচা দাঁড়ায় মাইলপ্রতি সড়ক নির্মাণের থেকে ৪৯০ টাকা কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৬৪-৬৫ সালের বাজেটে খাল খননের জন্য নির্ধারিত হয় সমগ্র খরচের ৩.৫১% ভাগ।

বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন ইত্যাদি খাতে ১৯৬৩-৬৪ সালে ব্যয় হয় ৬.৭৫% ভাগ এবং সড়ক নির্মাণের জন্যে ব্যয় হয় ৭১.৬% ভাগ।৫  মূল উদ্দেশ্য থেকে অগ্রাধিকার ও গুরুত্বের দিক দিয়ে এই ব্যয় নির্ধারণ নীতি যে কতখানি বিচ্যুত সেটা নীচে উদ্ধৃত কুমিল্লা একাডেমীর প্রাথমিক প্রস্তাব থেকেই বোঝা যাবে :

‘বহুকাল ধরে উপেক্ষিত গ্রামাঞ্চলে সড়ক, সেতু, কালভার্ট, স্কুলগৃহ, পুষ্করিণী ইত্যাদি অনেক ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু উপযুক্তভাবে তৈরী বাঁধ, রেগুলেটর ও স্লুইস গেট সম্বলিত জালের মতো ছড়ানো পানি নিষ্কাশন খালসহ পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অগ্রাধিকার দাবী খুব সুস্পষ্ট।’৬

চীনের কমিউনগুলিতে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে এবং সেখানে উৎপাদনের হার বহুগুন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ এই সাফল্যজনক পানি নিয়ন্ত্রণ। বস্তুতপক্ষে পানি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনই কমিউন ব্যবস্থার উদ্ভবের একটা বড়ো কারণ। এক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, গ্রামের মতো ছোট এলাকা নিয়ে কোন পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই সম্ভব হয় না। তার জন্যে প্রয়োজন হয় আরও বড় এলাকা এবং ঘনিষ্ঠতর গণসংযোগ ও কারিগরি সাহায্য।*

পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা বন্যা নিয়ন্ত্রণ অথবা উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন কাজে এলো না। অথচ চীনের কমিউনগুলির মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ করে বৃহৎ বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বাইরে বহু এলাকাকে আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত করা হয়েছে এবং সেই সাথে  উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য।**

উত্তর ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতাও এদিক দিয়ে খুব উল্লেখযোগ্য। ***

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গ্রামাঞ্চলে সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন প্রধানতঃ উৎপন্ন দ্রব্য বাজারজাতকরণের জন্যে। সড়ক নির্মাণের প্রশ্ন উৎপাদনের প্রশ্নের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওয়ার্কস প্রোগ্রামে সড়ক নির্মাণের উপর যে সর্বময় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সেটা কতখানি ফলপ্রসূ তার বিচার এজন্যেই এই দুই প্রশ্নের উপর নির্ভরশীল।

০০০০০০০০০

* ‘এদের (কৃষি সমবায়গুলির সমন্বয়ে গঠিত বৃহৎ ইউনিট—লেখক) মধ্যে সবগুলিও না হলেও অধিকাংশই সৃষ্টি হয়েছিলো পূর্ববর্তী শীতের সেচকার্য তৎপরতার সময় উদ্ভূত প্রয়োজনের তাগিদে। এইভাবে হুনানে তানশুই নদীর তীরবর্তী এলাকায় আটচল্লিশটি ছোট সমবায় আশিটি ছোট ছোট পানি নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্ট তৈরী করেছিলো। কিন্তু ক্ষুদ্র আকার, নিম্নমান এবং ভালো এলাকা (যেগুলি হয়তো অন্যদের সমবায়ের অন্তর্ভূক্ত) নির্বাচনে অক্ষমতার ফলে এদের মধ্যে অনেকগুলিই গ্রীষ্মকালীন বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছোট ছোট খামারগুলি একত্রিত হওয়ার পর তারা সক্ষম হলো পরিকল্পনা তৈরী করতে তেরটি বৃহত্তর পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের, যেগুলি দূর করলো বন্যা ও খরার উপদ্রব।’

—The Rise of the Chinese peoples Commune and six years after, by, Anna Lousic strong, p. 15. New world press, 1964.

**‘প্রথম যৌথ উদ্যোগ হিসেবে চীনের কৃষকরা পানি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তাকেই গভীরভাবে অনুভব করে।– এ সমস্যার উদ্ভব বড়ো রকমের বন্যা থেকে হয়নি, হয়েছে পাহাড়ী খাদ বিধৌতকারী লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট প্রবাহসমূহ থেকে। স্থানীয় কৃষকরা যদি এগুলি ধরে রাখতে পারে তাহলে স্থানীয়ভাবে সংরক্ষিত জমি ও পানি দ্বারা তাদের নিজেদের খামারগুলি সঙ্গে সঙ্গে লাভবান হবে এবং সেই সাথে এর দ্বারা বড়ো রকমের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজও বাস্তবতঃ সাহায্য পাবে।

১৯৫৭-৫৮ সালে শীতকালীন নাগদ শুধু বিশেষজ্ঞরাই নয়, কৃষকরা পর্যন্ত এটা ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করেছিলো।—-১৯৫৭-৫৮ সালের শীতকালে চীনের বহু এলাকায় এমন বিরাট তৎপরতা শুরু হলো যা পৃথিবীর ইতিহাসে ইতিপূর্বে সম্পন্ন সেচকার্যকে খাটো করে দিলো।’

—The Rise of the Chinese peoples Commune and six years after, by, Anna Lousic strong, p. 11-12, New world press, 1964.

***‘নোতুন উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপনের যৌক্তিকতা থাকে একমাত্র তখনই যখন তার ফলস্বরূপ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এই কার্যসম্পাদিকা শক্তিকে পুরোদস্তুর ব্যবহারের জন্যে নোতুন শ্রমিক সংগঠনকে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব ও কারিগরি বিষয়ের ওপর সরাসরি কাজ করতে হয়। ভিয়েতনামে এই বিষয়টি হলো পানি সংরক্ষণ।

যাই হোক, কোন রকম গুরুত্বপূর্ণ গঠনকার্যের জন্যে এককভাবে কোন ক্ষুদ্র কৃষকের প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি ছিলো না এবং নিজের ক্ষুদ্র জমিখন্ডের ওপর দিয়ে খাল অথবা বাঁধ চলে যাক সেটাও কেউ চাইতো না। একমাত্র যৌথ খামারই পানি সংরক্ষণকে প্রয়োজনীয় ধাক্কা দিয়ে তার ফলস্বরূপ প্রতি বৎসর অধিকতর ফসল এবং উৎপাদনের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলো।

পানি সংরক্ষণ কাজের উন্নতির সাথে সমবায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। একমাত্র পানি সংরক্ষণের সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতেই যেমন সমবায়গুলিকে সুসংহত করা যেতে পারে তেমনি অন্যদিকে আবার সমবায় খামার ব্যতীত পানি সংরক্ষণের কোন উন্নতিও সম্ভব নয়।

যে সমস্ত এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ পানি সংরক্ষণ কার্য সম্পন্ন হয়েছে, যেমন হঙ ইয়েন প্রদেশে, সেখানে সমবায়ের খুব দ্রুত অগ্রগতি এবং কৃষি উন্নয়নের ভালো হার পরিলক্ষিত হয়েছে।’

—Vietnamese studies, No. 13, Agricultural problems Vol.2 Democratic Republic of Vietnam. 1967, P, 82-83.

০০০০০০০

ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে যে সড়কগুলি নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলি প্রায় সবই কাঁচা সড়ক। এগুলির উপর দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে রিক্সা যাতায়াত পর্যন্ত সম্ভব নয়।৭  কাজেই এই সমস্ত সড়কগুলির উপর দিয়ে বিক্রয়যোগ্য জিনিস অর্থাৎ পাট, ধান, বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য শস্য মাথায় করেই বহন করতে হয়। এজন্যে জিনিসপত্র বাজারজাতকরণের দিক দিয়ে এইসব সড়ক মোটেই সহায়ক হয়নি।

তাছাড়া সাধারণ কৃষকদের (যাদের বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত খুব অল্প) বাজার হলো গ্রাম্য হাট। সাধারণতঃ দু’-তিন মাইলের মধ্যেই কোন না কোন হাট পাওয়া যায় এবং এই ধরনের গ্রাম্য বিক্রেতাদের বাজারের পরিধি এই হাটগুলির অবস্থান দ্বারাই বিশেষভাবে সীমিত। বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত বলতে যা উৎপন্ন করে তা প্রধানতঃ ঘরে খাওয়ার জন্যে। এদের বিক্রি করার মতো উদ্বৃত্ত না থাকলেও মাঝে মাঝে অবশ্য এদেরকে খাদ্য তালিকার বাইরের প্রয়োজন মেটানো এবং পুরাতন ঋণ শোধের জন্যে বৎসরের খাবারের একাংশ বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হয়। এই বিক্রয়ের পরিমাণ এতো অল্প এবং তার তাগিদ এতো মারাত্মক যে বিক্রয়যোগ্য উৎপন্ন দ্রব্য বাজারজাতকরণের জন্যে কোন কৃষক সড়কের অপেক্ষা রাখে না। মাঠের উপর দিয়েই অনায়াসে তারা দু’তিন মাইল পথ অতিক্রম করে হাটে উপস্থিত হয়। কাজেই গ্রামের ক্ষুদে উৎপাদকদের উৎপন্ন দ্রব্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের এই কাঁচা সড়ক কোন কাজেই আসে না। বস্তুতপক্ষে ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে যতদিন পর্যন্ত না উন্নত পদ্ধতিতে চাষ আবাদ ও বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ ঘটছে ততদিন পর্যন্ত বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত গ্রামাঞ্চল থেকে বাজারজাতকরণের গুরুত্ব নিতান্তই নগণ্য। এ বিষয়ে একটু পরে আরও বিস্তৃত আলোচনা করা হবে।

গ্রামের উদ্বৃত্ত যেমন বাইরের বাজারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তেমনি শহরাঞ্চলের শিল্পজাত দ্রব্যও গ্রামে বাজারজাত করার প্রয়োজন হয়। সেদিক দিয়ে প্রশ্নটি বিচার করলে দেখা যাবে যে, গ্রাম্য দোকানগুলিতে এই ধরনের শিল্পদ্রব্যের বিক্রয়ের বাজার গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার দ্বারা বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। নিতান্ত প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য জিনিসের বাইরে কোন জিনিস কেনার ক্ষমতা সাধারণ কৃষকদের নেই। উৎপাদনের স্বল্পতার দ্বারাই তাদের আয় ও  ক্রয়ক্ষমতা সর্বতোভাবে নির্দিষ্ট। কৃষি উৎপাদনের বিপর্যস্ত এবং অনুন্নত অবস্থা এভাবেই আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে শিল্পজাত দ্রব্যের বাজারকে সঙ্কুচিত রেখেছে।

উৎপাদন পদ্ধতির অনুন্নত অবস্থা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির হার নগণ্য হওয়ার ফলে কৃষকদের বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত বাজারজাতকরণ অথবা শিল্পজাত দ্রব্য কৃষকদের কাছে বাজারজাতকরণ কোনদিক দিয়েই ইউনিয়ন কাউন্সিল ও থানা কাউন্সিলগুলি দ্বারা নির্মিত এই কাঁচা সড়কগুলির কোন উপযোগিতা অথবা কার্যকারিতা নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে ঘোড়ার আগে গাড়ী জোড়ার এতো চমৎকার উদাহরণ বাস্তব ক্ষেত্রে খুব কমই দেখা যায়।

জেলা কাউন্সিলের অধীনস্থ সড়ক নির্মাণ কর্মসূচীর পর্যালোচনা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার দিক থেকে নালা, খাল-বাঁধ ও উপকূলবর্তী এলাকার কমিউনিটি সেন্টারের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও ওপরের টেবিলটি থেকে দেখা যাচ্ছে এইসব খাতে ব্যয় কত কম হয়েছে। প্রয়োজন ও ব্যয়ের দিক থেকে অগ্রাধিকারের এই আকাশ-পাতাল তারতম্যের কোন অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা নেই।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক মার্কিন উপদেষ্টা এবং মৌলিক গণতন্ত্র বিভাগের সরকারী ভাষ্যে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের দৌলতে পূর্ব বাঙলার অর্থনৈতিক উন্নতির অনেক হিসেবে পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে এখানে উদাহরণস্বরূপ দু’একটি উল্লেখ করা হলো। করলে অর্থের  অপচয় এবং  সত্যিকার উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব—এ দুই-ই আরও সুস্পষ্ট হবে। জেলা কাউন্সিলগুলি নিজেদের বাজেটের ৯৮.৩৮% ভাগ সড়ক নির্মাণের জন্যে খরচ করেছে। এর মধ্যে ৭৯.৬% ভাগ ব্যয় পাকা সড়কের উপর।৮  এই সড়কগুলি নির্মাণের পরিকল্পনা জেলা কাউন্সিলের অধীন এবং তার সাথে সামগ্রিক প্রাদেশিক সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনার কোন যোগাযোগ নেই। এজন্যেই জেলা কাউন্সিলের এই পাকা সড়কগুলি ‘পরিকল্পনার’ মধ্যে কোন সত্যিকার পরিকল্পনা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি প্রদেশের, এমনকি জেলার সামগ্রিক যোগাযোগের দিক থেকে খুব বেশী ব্যবহারযোগ্য নয়। কাজেই এই খাতে যে ব্যয় জেলা কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে হয়েছে তা সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি।

আর একটি জিনিসও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সারা পূর্ব বাঙলায় পুরাতন জেলা বোর্ডগুলির দ্বারা নির্মিত সড়কের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩০,০০০ মাইল।৯  এই সড়কগুলি মেরামতের অভাবে ব্যবহারের প্রায়ে অযোগ্য হয়ে দাঁড়ালেও সেগুলি মেরামতের দিকে জেলা কাউন্সিলগুলি বিশেষ কোন দৃষ্টি দেয়নি। অথচ অপেক্ষাকৃত অল্প ব্যয়ে এই সড়কগুলিকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলাও দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরাতন সড়কগুলি মেরামত করার পরিবর্তে নোতুন নোতুন সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনার ওপরই জেলা কাউন্সিলগুলির ঝোঁক বেশী। ব্যাপকতর প্রাদেশিক পরিকল্পনার সাথে এই পরিকল্পনার কোন উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ না থাকায় উন্নয়নের কাজে আসার থেকে এই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ মোটামুটিভাবে অপব্যয়ই হচ্ছে।১০  ১৯৬৩-৬৫ সালে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অধীনে যে কাজ হয়েছে তার একটা হিসেব১১ নীচে দেওয়া গেল :

কাজের খাত সংখ্যা মাইল টাকায় খরচা শতাংশ
১। কাঁচা সড়ক ১৯৬৩-৬৪

১৭,৯৭১

১৯৬৪-৬৫

১৮,১৫৫

১৯৬৩-৬৪

২৭,৫৫৩

১৯৬৪-৬৫

২৮,৪১০,৫৫

১৯৬৩-৬৪

৫,৫১,৭৭

১৬৩

১৯৬৪-৬৫

৪,২৯,১১,

৭৯১,২৪

১৯৬৩-৬৪

২৮,৬১

১৯৬৪-৬৫

২৭,৬৩

২। পাকা সড়ক ৯৯০ ১,২০৫ ৪,৯২৮ ১,০৮০,৪৪ ৪,৯২,৭২,

০২৬

৩,৫৭,৬৪,

১৯৭,৭১

২৫,৫৫ ২৩,০৩
৩। সেতু ও কালভার্ট ৭,৪২৮ ১১,৯০৪ ১,০৩,৭৯৮

(বর্গফুট)

৩,০০,৪১৫

(বর্গফুট)

৩,৪৫,৬৫

২১৯

৩,৯৭,০৫,

৮৭১,৩৮

১৮,০১ ২৫,৫৭
৪। নালা ও খাল ১,৪৪৬ ১,৪৪৩ ১,২৪৮ ৫,৩৫৬,৪৮ ৬৬,৩৪,৬৪২ ৫৪,৬৪,

১৭২,৮৯

৩,৫৪ ৩,৫১
৫। বাঁধ ৯৯০ ১,২৮৪ ১,৮৪২ ৩,৬৫৪,০৫ ৬৩,৯০,১৫৯ ৫৫,০৩,২০৮

১০

৩,৪১ ৩,৫৪
৬। ইউনিয়ন কমিউনিটি সেন্টার

৭। উপকূলবর্তী কমিউনিটি সেন্টার

২,৩০৭

 

৭৯

১,৭৪২ ১,৮৭,৫১,

১৬০

৮৭,১৭,১৬০

৯৭,৮৩,৬৫৫

৬৫৫,৮৬

৯,৭২

৪,৬২

৬,৩০
৮। থানা ট্রেনিং ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ২৪৪ ২৩০ —- ১,৩৩,১৮,

০০০

১,৪৪,৫৪

৯৮৩,১৭

৬,৫২ ৯,৩০
৯। অন্যান্য ১১৭ ১৭,৪২,০৯২ ১,১২
মোট ৩১,৪৫৫ ৩৬,০৮০ ১,০৩,৭৯৮

৩৫,৫৫১/

বর্গফুট

৩৮৫০১,৮৮/

৩,৩৩০,৪১৫

বর্গফুট

১৯,২৮,২৫,

৫৩১

১৫,৫৩,২৯১

৯৭২,৬৫

১০০,০০ ১০০,০০

মার্কিন উপদেষ্টা দলের প্রধান ডক্টর রিচার্ড গিলবার্টের মতে, ‘যদি ৫% এর মতো অল্প আউশ ধানও বন্যার কবল থেকে রক্ষা পায় তার অর্থ হবে ৪ কোটি (৪০ মিলিয়ন) টাকার অতিরিক্ত উৎপাদন ও কৃষকদের আয়। যদি ৫% আমন ধান রক্ষা পায় তাহলে তার ফলে অতিরিক্ত আয় হবে ১০ কোটি টাকা।১২  রিচার্ড গিলবার্ট প্রদত্ত অর্থনৈতিক ফায়দার এই হিসেব সম্পর্কে রহমান সোবহানের মন্তব্য হলো, ‘যে পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কাল্পনিক হিসেবে জগতে আছে সে পর্যন্ত মিঃ গিলবার্টের অঙ্কের মধ্যে তেমন কোন ভুল পাওয়া যাবে না।—৫% ভাগ আউশ ও আমন ধান রক্ষার অর্থ ৩,৬২,৪৭২ একর আউশ ধান এবং ৬,৪৪,১২৯ একর আমন ধান রক্ষা। ১৯৬২-৬৩ সালের প্রোগ্রামের স্ফীত হিসেব মতো দাবী করা হয়েছে যে তাতে ৩৬০ মাইল পুরাতন বাঁধ মেরামত করা হয়েছে, ১৩০০ মাইল নোতুন খাল খনন করা হয়েছে এবং ৩৬০ মাইল পুনর্খোদিত হয়েছে। এই অতি নগণ্য প্রচেষ্টা কিভাবে দশ লক্ষ একর আবাদি দ্রব্যের এলাকাকে প্রয়োজনমতো রক্ষা করতে সক্ষম তার হদিস একমাত্র মিঃ গিলবার্টের কল্পনার মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে।’১৩

উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পর্কে ১৯৬৩-৬৪ সালের রিপোর্টে মৌলিক গণতন্ত্র বিভাগের বক্তব্য হলো ‘চলতি বৎসরের বিপুল ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের নির্দিষ্ট অবদান আছে।’১৪  ‘যাদের সাথে গ্রামীণ অর্থনীতির পরিচয় আছে তাঁদের মত হলো এই যে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অধীনে সড়ক, বাঁধ, নালা, খাল নির্মাণ নিশ্চিতভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহা্য্য করেছে।’১৫ 

সরকারী হিসেবে উৎপাদন বৃদ্ধির যে দাবী করা হয়েছে তার থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৬২-৬৩ সালে ধান উৎপন্ন হয়েছিলো। ৮৭.৩ লক্ষ টন এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে উৎপন্ন হয়েছিলো ১০৪.৫৬ লক্ষ টন। অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধির হার হার ২০%। বৃদ্ধির হার হিসেবে এটা যে খুবই উল্লেখযোগ্য তা অনস্বীকার্য। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ওয়ার্ক প্রোগ্রামের সাথে এই বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই।

১৯৬৩-৬৪ সালে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই ১৯৬৩-৬৪ সালের ফসল কাটা সম্পূর্ণ হয়েছিলো। কাজেই সেই প্রোগ্রামে যে সমস্ত নালা, খাল ইত্যাদি খনন করা হয়েছিলো সেগুলি ১৯৬৩-৬৪ সালের উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোন উপকারে আসেনি। এ বৎসরের কাজের উপকারিতার হিসেব বস্তুতপক্ষে পরের বৎসরে পাওয়া যেতে পারে এবং ১৯৬৪-৬৫ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে ধানের উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ১০৩.৩৭ লক্ষ টনে। অর্থাৎ ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ১৯৬৩-৬৪ সালের ‘নির্মাণকার্যের পরবর্তী বৎসর ধান উৎপাদন কমেছে ১.১%। পাট উৎপাদনের কমতির হার আবার ৯.৩%।

উৎপাদনের এই উঠা-নামার আসল কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা। ১৯৬২-৬৩ সালে বন্যার ফলে সে বৎসর কৃষি উৎপাদনের খুব বেশী ক্ষতি হয়। এজন্যে পরবর্তী বৎসরে উৎপাদন বৃদ্ধি দেখা যায় ২০% ভাগ। ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব যদি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর থাকতো তাহলে আমরা একরপ্রতি উৎপাদনের হিসেবের মধ্যেই তার দেখা পেতাম। এ সম্পর্কে বিস্তারিত সাধারণ আলোচনা আরও পরবর্তী পর্যায়ের জন্য স্থগিত রাখলেও কৃষকদের বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। এই তথ্যগুলি পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকার চারটি থানা থেকে সংগৃহীত। এই চারটি থানা হচ্ছে কুমিল্লা জেলার কোতওয়ালী থানা, ঢাকা জেলার শিবালয়, দিনাজপুর জেলা বোদা এবং যশোরের নড়াইল থানা।

শস্য বাজারজাতকরণের পরিমাণ হিসেবে এই টেবিলে কৃষকদেরকে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৬৩-৬৪ সালে বাজারজাত ধানকে সামগ্রিক উৎপাদনের শতাংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।১৬

১৯৬৩-৬৪ থানার নাম শূন্য ১-১০ ১১-২০ ২১-৩০ ৩১-৪০ ৪১-৫০ ৫১-৬০ ৬১-৭০ ৭১-৮০ ৮১-৯০ ৯১-১০০ মোট
কুমিল্লা

শিবালয়

নড়াইল

বোদা

৫৮.৬

৮৫.৭২

৬৩.৩

৫৯.৩

৮.৭

৬.৪

১২.৩

৫.১

১৩.৯

৬.০

৬.৪

১৪.৩

১২.১

০.৮

৭.০

৬.৫

২.৯

০.৮

৪.৭

৯.০

২.১

০.৪

২.৩

৩.২

০.৭

০.৪

২.৩

১.৩

০.৭

১.২

১.৩

০.৫

১০০

১০০

১০০

১০০

১৯৬২-৬৩ কুমিল্লা

শিবালয়

নড়াইল

বোদা

৭৫.৬

৫৮.১

৬৮.০

৬২.০

৪.৬

১২.০

৯.৪

৩.২

৮.২

২২.২

৮.২

১৪.৫

৬.৫

৪.০

৪.০

৫.২

২.২

১.৭

৪.৬

৮.০

২.২

০.৮

১.৮

৩.২

১.২

৩.০

১.৩

০.৮৭

০.৫

১.৩

০.৫

১.৩

১০০

১০০

১০০

১০০

১৯৫৭-৫৮ কুমিল্লা

শিবালয়

নড়াইল

বোদা

৪৭.৮

৮৭.৬

৬১.৬

৬২.৭

৯.৪

১.৬

৬.৪

৩.২

১৭.৩

৩.৬

৮.৭

১৪.৮

১০.১

২.০

৯.৮

৪.৫

৫.৮

৩.২

৩.০

৬.৫

৬.৫

২.০

৫.৩

৩.৯

৩.০

১.৯

১.১

১.৯

১.৫

১.১

০.৬

১.৫

১০০

১০০

১০০

১০০

 ওপরের এই অঙ্কগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৭-৫৮ সাল মোটামুটিভাবে মাটি কাটার ক্ষেত্রেই হয়েছে।

১৯৫৭-৫৮ থেকে ১৯৬৩-৬৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন জেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ থানায় উৎপাদনের সব থেকে বড় চরিত্র হচ্ছে তার অনিশ্চয়তা। এই ছয় সাত বৎসরে এইসব এলাকায় উৎপন্ন ফসলের ওঠা-নামার ওপর ভিত্তি করে অনিশ্চয়তা ছাড়াও আরও একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। সেটি হচ্ছে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণযোগ্য উদ্বৃত্তের ওপর ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কোন লক্ষণীয় প্রভাবের অভাব। পূর্ব বাঙলার সমস্ত এলাকার মধ্যে কুমিল্লাই এই প্রোগ্রামের সর্বপ্রধান ক্ষেত্র। সেখানেও ১৯৫৭-৫৮ অর্থাৎ প্রোগ্রামপূর্ব এবং ১৯৬৩-৬৪ সাল অর্থাৎ প্রোগ্রামের পরবর্তী পর্যায়ের তুলনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। কারণ এ পর্যায়ে সেখানে উৎপাদন কমেছে ১০% এর ওপর।

এছাড়া অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে টেবিলটির মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই এলাকাগুলিতে বাণিজ্যিক কৃষির অনুপস্থিতি। যান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের মতো কোন খামারই এই থানাগুলির কোথাও নেই। তা যদি থাকতো তাহলে ৯১-১০০% ভাগ ফসল অন্ততঃ খুব অল্পসংখ্যক খামারের পক্ষেও বাজারজাত করা সম্ভব হতো। কিন্তু এদিক থেকে ৯১-১০০ শতাংশের ঘর একেবারে শূন্য। বস্তুতঃপক্ষে ৭০% ভাগের ওপর ফসল বাজারজাতকরণের উদাহরণও নিতান্তই নগণ্য। এর সাথে শূন্য নির্দেশক প্রথম সারির দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে, বিপুল অধিকাংশ কৃষকের উদ্বৃত্ত বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।

উদ্বৃত্ত উৎপন্ন ফসলের যখন এই অবস্থা তখন সেই ফসল বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অধীনে কাঁচা সড়ক তৈরীর জন্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাৎপর্যহীন সে বিষয়ে তর্কের অবকাশ কোথায়?

এতো গেলো উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্বৃত্ত উৎপন্ন বাজারজাতকরণের প্রশ্ন। এবার কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ফলাফল বিবেচনা করা যেতে পারে। মার্কিন উপদেষ্টা গিলবার্টের মতে,‘সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ক্রয় ক্ষমতা সৃষ্টির একটা প্রভাব দেখা গেছে এবং হিসেব করে নিরাপদে বলা চলে যে, এর দ্বারা পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত দশ লক্ষ মানুষের এক মাস করে কর্মসংস্থান হয়েছে।’১৭  এই বক্তব্যকে রহমান সোবহান ‘উদ্ভূট’ বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ এই ‘প্রভাবের’ হিসেব কেউ করেনি এবং তার কোন প্রমাণও কারো হাতে নেই।১৮

কর্মসংস্থানের প্রশ্ন বিবেচনা করতে গিয়ে প্রথমেই যা লক্ষ্য করা দরকার তা হচ্ছে কাঁচা-পাকা সড়ক তৈরীর ক্ষেত্রে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অর্থ ব্যয়। কাজেই গ্রামীণ পূর্ব বাঙলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে তা এই সড়ক তৈরী অর্থাৎ মোটামুটিভাবে মাটি কাটার ক্ষেত্রেই হয়েছে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির দিক থেকে দেখতে গেলে কত লোকের কর্মসংস্থান হলো সেই সংখ্যা বিচারের থেকে তাদের কর্মের চরিত্র বিচারই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিচারের মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, কর্মরত শ্রমিকদের শ্রমশক্তি সামাজিক শ্রম বিভাগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে বিস্তার করছে কিনা।*  গৃহভৃত্য, ঠিকা শ্রমিক, বাণিজ্যিক কৃষি খামার শ্রমিক ইত্যাদি হিসেবে বিক্রিত শ্রমশক্তির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য এক নয়। মাটি কাটার কাজে যে সমস্ত গ্রাম্য শ্রমিকরা নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করেছে তাদের শ্রম গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করার কাজে যে মোটেই সহায়ক হয়নি সেটা আমরা কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণের প্রসঙ্গে দেখেছি। কাজেই লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অর্থনীতি ক্ষেত্রে যে প্রভাব সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে তার কোন সত্যিকার ভিত্তি নেই।

এই ভিত্তির অভাবের ফলেই ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কর্মসংস্থানের সাথে দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় সাহায্যার্থে ‘টেস্ট রিলিফ’ ঘটিত কর্মসংস্থানেরই অধিকতর মিল। এই রিলিফের যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির থেকে সাময়িকভাবে দুর্গত ও বিপদগ্রস্ত লোকদেরকে সাহায্য করাই আসল উদ্দেশ্য, তেমনি ওয়ার্কস প্রোগ্রামের মাটি কাটার কর্মসূচী এবং তার ফলে উদ্ভূত কর্মসংস্থানের আসল উদ্দেশ্যও অর্থনৈতিক নয়, অন্য কিছু। এই ‘ক্রয়ক্ষমতার’ সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি তাল না রাখার ফলে তার পরিণতিতে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। এবং বাস্তবতঃ হয়েছেও তাই। মার্কিন কাউন্টারপার্ট ফান্ডের অর্থ এবং পি, এল, ৪৮০-এর মাধ্যমে আমদানীকৃত জিনিসপত্রের বিষাক্ত বৃত্ত এই মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে পারেনি। কাজেই এর ফলে শুধু মার্কিনের কাছে আমাদের ঋণ বেড়েছে, তাদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এজন্যেই মার্কিন প্রতিনিধি গিলবার্ট সাহেব সাময়িক কর্মসংস্থানের জয়গান গেয়ে এদেশে সত্যিকার অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে যাতে স্থায়ী কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও বিস্তার না হয় তার ব্যবস্থাকেই জারি রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। এজন্যেই পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা, যা সর্বতোভাবে পূর্ব বাঙলায় উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সহায়ক হতো, তাকে বাদ দিয়ে সড়ক তৈরীর ওপর তাদের ভারসাম্যহীন গুরুত্ব।

কোটি কোটি টাকা ব্যয় সত্ত্বেও ওয়ার্কস প্রোগ্রামের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতির কোন বিকাশ এবং কৃষকদের আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতিই প্রকৃতপক্ষে হয়নি। ইতিপূর্বে অতি সংক্ষেপে আমরা কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের প্রশ্ন বিবেচনা করেছি। এবার কৃষকদের সাধারণ আর্থিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক।

আয় হিসেবে কৃষকদের বিভাগ ১৯

থানার নাম ১০১-২০০ ২০১-৩০০ ৩০১-৪০০ ৪০১-৫০০ ৫০১-৬০০ ৬০১-৮০০ ৮০১-১০০০ ১০০১-১২০০ ১২০১-১৫০০ ১৫০১-২৫০০ ২৫০০ এবং তদূর্ধ্ব মোট
১৯৬৩-৬৪ কুমিল্লা

বোদা

শিবালয়

নড়াইল

২.১

৮.৪

১৬.০

১৮.১

১.৪

১০.৩

১৭.৫

২৯.৬

৩.৭

১১.৭

১২.৪

২৫.৩

৬.৫

৯.৭

৯.৬

১.৮

৫.৮

৩.২

৯.৬

১.৮

১৬.৭

৯.৭

১৪.২

১০.৮

১৬.১

৯.০

৫.১

৫.৪

৯.৬

৩.৯

১.৮

১৯.৬

৯.০

৫.৮

১.৮

১৩.২

৬.৪

৩.৯

১.৮

৫.২

২২.৬

২.০

১.৮

১০০

১০০

১০০

১০০

১৯৬২-৬৩ কুমিল্লা

বোদা

শিবালয়

নড়াইল

২.৯

৭.৮

১১.২

১৭.৫

১.৪

১২.৬

৭.৩

২৯.৩

৫.৭

১২.৬

৮.৩

২১.২

৭.১

১০.৫

১৫.৭

১.৯

৭.৯

৫.৮

৮.৭

৫.৩

১৯.৩

১১.৪

১০.১

১২.৩

১৪.২

৯.৮

৯.১

৫.৩

১১.৪

৩.৫

১৭.১

১০.৫

১১.৭

১.৯

১০.১

১০.৫

৯.৬

২.৬

২.৯

৮.৫

৪.৮

১.৯

১০০

১০০

১০০

১০০

১৯৫৭-৫৮ কুমিল্লা

বোদা

শিবালয়

নড়াইল

২.১

৫.১

২৪.৭

২১.৭

১.৪

১১.০

২০.৬

৩৪.৮

৫.৭

৮.০

১২.৭

২.৯

৩.৭

৮.৮

১১.৫

১.৫

৬.৫

৫.১

৭.০

৩০.২

১১.১

১৩.৮

৮.৭

২.৯

৮.৩

৮.৮

২.০

১.৫

১৪.৫

২.৯

২২.১

১২.৪

৪.১

২.৯

১৮.৩

১৪.৬

৪.১

১.৫

৬.২

১২.৪

১.৭

১০০

১০০

১০০

১০০

ওপরের এই টেবিলটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বাৎসরিক ৫০০ টাকা এবং তার থেকে অল্প আয়ের কৃষকদের সংখ্যা ভয়ানক রকম বেশী এবং তাদের আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতি ১৯৬৩-৬৪ সাল পর্যন্ত হয়নি, উপরন্তু অবনতি ঘটেছে। এই আয় গ্রুপের কৃষকরা প্রকৃতপক্ষে নিঃস্ব। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, এদের পরিবারের লোকের সংখ্যা গড়পড়তা পাঁচ তা হলে এদের প্রত্যেকের মাথাপিছু মাসিক আয় যে কত অল্প তা সহজেই অনুমেয়। এই নিঃস্ব কৃষকদের সংখ্যা ১৯৫৭-৫৮ সালে কুমিল্লা, বোদা, শিবালয় ও নড়াইলে ছিলো যথাক্রমে ১২.৯%, ৩২.৯%, ৬৯.৫% ও ৬০.৯%। ১৯৬৩-৬৪ সালে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৩.৭%, ৪০.১%, ৫৫.৫% ও ৭৪.৮%। একমাত্র শিবালয়ে এদের সংখ্যা ১৪% ভাগ কমলেও অন্যান্য তিন এলাকায় সংখ্যা বেড়েছে। শিবালয়ে যে তারতম্য দেখা যায় সেটা স্থানীয় অবস্থা এবং আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার ওপরই বেশী নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো এই যে, মাটি কাটার কাজে নিযুক্ত শ্রমিকরা এই সর্বনিম্ন স্তরেরই কৃষক। ৭৫% ভাগ সড়ক নির্মাণ খাতে ব্যয় করলেও সামগ্রিকভাবে এই কৃষকদের অবস্থার কোন উন্নতি তার দ্বারা সাধিত হয়নি। অন্যপক্ষে ১৫০০ এবং তদূর্ধ্ব আয়সম্পন্ন কৃষকদের (প্রকৃতপক্ষে ধনী কৃষক ও জোতদার; এদের মধ্যে মৌলিক গণতন্ত্রীরাও আছে) সংখ্যা ১৯৫৭-৫৮ ও ১৯৬৩-৬৪ সালের মধ্যে কুমিল্লায় ৬.১% ভাগ থাকলেও বোদা, শিবালয় ও নড়াইলে বেড়েছে যথাক্রমে ২%, ০.১% এবং ২.১% ভাগ।

কাজের সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ আয় গ্রুপের আয়ের এই হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত এলাকাগুলিতে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় শ্রেণীর সংখ্যাই এই পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ শ্রেণী হিসেবে মধ্য শ্রেণীর সংখ্যাকে খর্ব করে ধনী হয়েছে আরও ধনী এবং দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর।

*‘কোন্ ধরনের কৃষকরা শ্রমশক্তি বিক্রয় করে সেটা দেখালেই হবে না, কোন্ ধরনের নিয়োগকর্তারা শ্রমশক্তি ক্রয় করে সেটাও দেখাতে হবে।’ Lenin : The Development of Capitalism in Russia, Collected Works, Progress  Publishers, Vol. 3. P. 177.

কর্মসংস্থানের অভাব এবং নিম্ন আয়ের সাথে অতিরিক্ত কর ভার যুক্ত হয়ে কিভাবে কৃষকদের জীবনকে সামগ্রিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে তার একটা হিসেব নীচের টেবিলটি থেকে পাওয়া যাবে।

করদাতাদের শতাংশ ২০ (মোট আয়ের শতাংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে)
১৯৬৩-৬৪ ১৯৬২-৬৩ ১৯৫৭-৫৮
০-২ ২-৪ ৪-৬ ৬-৮ ৮-১০ ১০উর্ধ্বে ০-২ ২-৪ ৪-৬ ৬-৮ ৮-১০ ১০উর্ধ্বে ০-২ ২-৪ ৪-৮ ৮-১০ ১০  উর্ধ্বে
কুমিল্লা

শিবালয়

বোদা

নড়াইল

২.১

৩.৯

৬.৬

৬.০

৯৪.৩

৯৩.৭

৭২.৩

৬৬.৩

১.৫

২.৪

১২.২

১২.৪

১.৫

৫.১

১৪.১

৩.২

০.৬

১.২

২.১

৪.৮

৭.৯

৭.৯

৯৫,৭

৯৩,৩

৭৩,৬

৬৮,৬

১.২

১.৯

৯.৬

১৮.৭

৫.১

৪.২

৩.২

০.৬

 

০.৬

৪.৩

৮.৩

১৩.৫

১০.০

৯৫.৭

৯০.২

৮২.০

৬৮.৪

১.২

৩.৯

২.৬

০.৩

০.৬

১৯.০

এই তথ্যগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৭-৫৮ সালের সাথে তুলনায় ১৯৬৩-৬৪ সালে চারটি থানার প্রত্যেকটিতেই শূন্য করদাতাদের সংখ্যা অনেকখানি করে কমে এসেছে। শুধুমাত্র করদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে অবশ্য একথা প্রমাণিত হয় না যে, তারা অধিকতরভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। আয় বৃদ্ধির সাথে কর বৃদ্ধি হওয়াও স্বাভাবিক এবং সেক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থা এবং সামগ্রিক জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতির দিক থেকে খারাপ নয়। কিন্তু সেটা খারাপ দাঁড়ায় তখনই, যখন এই অতিরিক্ত কর ভার বর্ধিত আয়ের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কর ধার্যকারীদের শোষণনীতির দ্বারা চালিত হয়। এক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের সড়ক তৈরী এবং অন্যান্য খাতে খাতে ব্যয় গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু গড়পড়তা আয় এই পর্যায়ে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের অনেকাংশে কমে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি শূন্য করদাতাদের সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি বিচার করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, সমস্ত অল্প আয়ের কৃষকদের ওপর পূর্বে কোন কর ছিলো না সেই সমস্ত কৃষকদের ওপর স্থানীয় পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্রীরা নোতুনভাবে কর কার্য করেছে।

দুই শতাংশ পর্যন্ত করদাতাদের সংখ্যা বোদাতে এই সময়ের মধ্যে শতকরা প্রায় দশ ভাগ কমে এলেও অন্য তিনটি থানাতে অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত। এর মধ্যে অবশ্য প্রত্যেকটি থানাতেই সব থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কর বৃদ্ধি হয়েছে ২-৪ শতাংশ করদাতাদের ক্ষেত্রে। এরা অধিকাংশই মধ্য কৃষক। ভূমি রাজস্ব এবং স্থানীয় করের চাপে এরা ক্রমাগতভাবে অনেকেই ভূমিহীন বর্গাদারে পরিণত হচ্ছে।

কৃষক জীবনের ওপর ওয়ার্কস প্রোগ্রাম এবং অন্যান্য সরকারী নীতির সামগ্রিক প্রভাবের একটা চিত্র পাওয়া যায় কৃষকদের ঋণগ্রস্ততায়। নীচের তথ্যগুলি এদিক থেকে খুব প্রাসঙ্গিক।

যারা ঋণ গ্রহণ করে ২১ (সমগ্র আয়ের শতাংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে)
১৯৬৩-৬৪ ১৯৬২-৬৩ ১৯৫৭-৫৮
১-২০ ২১-৪০ ৪১-৬০ ৬১-৮০ ৮১-১০০ ১০০ উপর শূণ্য ঋণ ১-২০ ২১-৪০ ৪১-৬০ ৬১-৮০ ৮১-১০০ ১০০ উপর শূন্যঋণ ১-২০ ২১-৪০ ৪১-৬০ ৬১-৮০ ৮১-১০০ ১০০ উপর
কুমিল্লা

শিবালয়

বোদা

নড়াইল

৩৪.৬

১৮.৮

১৮.৬

৪.৭

৫.৭

১৮.৮

১৪.১

৩.৫

১.৫

১২.২

২.৬

০.৭

৮.২

২.৬

৪.৭

১.৩

১.২

৪০.৪

৯.০

২.০

১.৮

১৭.১

৩০.৭

৫৮.৮

২.২

০.৪

২.১

০.৬

২.৯০.৪

০.৬

০.৮

০.৬

০.৬

১.৬

৩.২–

১.৫

০.৪

০.৪

০.৮

এই হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে ১৯৬৩-৬৪ সালের মধ্যে কৃষকদের ঋণের পরিমাণ কত বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র কুমিল্লা কোতওয়ালী থানায় এই ঋণের অধিকাংশ সমবায় সমিতির মাধ্যমে দেওয়া হলেও অন্যান্য তিন থানাতে এই ঋণ এসেছে স্থানীয় মহাজনদের থেকে।২২  রহমান সোবহান কৃষকদের সঞ্চয় এবং মূলধন নিয়োগ সম্পর্কে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার থেকে জানা যায় যে, এই ঋণের অধিকাংশ, বিশেষতঃ যারা নিজেদের আয়ের শতকরা ৪০ ভাগ পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই ঋণের প্রয়োজন হয়েছে দৈনন্দিন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্যে, কৃষি উন্নয়নে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নয়।২৩

ওয়ার্কস প্রোগ্রাম সম্পর্কে উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এই কর্মসূচী প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে পূর্ব বাঙলায় কৃষি ও কৃষকের অবস্থা দ্রুত অবনতির পথে এগিয়ে চলেছে। একদিকে সামাজিক শ্রম বিভাগ, কৃষক শ্রেণীর ভাঙন (defferentiation), কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহার, কর্ষণযোগ্য জমি সন্নিবদ্ধকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এবং অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন, কৃষকের আয় ও ঋণগ্রস্ততা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন উন্নতি ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ফলে সাধিত হয়নি। উপরন্তু বহু দিক থেকে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এই অবনতির পূর্ণতর চিত্র ১৯৬৩-৬৪ সালের পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত পূব বাঙলার সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার মধ্যে পাওয়া যাবে।

ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ফলাফল পর্যালোচনা করতে গিয়ে রহমান সোবহান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহকালে তাঁরা মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা এবং ওয়ার্কস প্রোগ্রামকে কেন্দ্র করে শ্রেণীসংঘাতের যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন। যাদের জমি বেশী, যারা অবস্থাপন্ন তারা এই প্রোগ্রামের প্রশংসা করেছে, তার স্বপক্ষে মন্তব্য করেছে। কিন্তু যাদের জমি অল্প, যারা অপেক্ষাকৃত গরীব তারা শ্রেণী হিসেবে মৌলিক গণতন্ত্রীদের যোগ্যতা, সততা ইত্যাদি সম্পর্কে ভয়ানক বিরূপ মন্তব্য করেছে, তাদেরকে তারা নিজেদের ওপর নির্যাতনকারী আখ্যা দিয়েছে।২৪  মৌলিক গণতন্ত্রীদের দুর্নীতির ভুরি ভুরি তথ্যমূলক উদাহারণও তিনি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।২৫ 

এই দুর্নীতি সম্পর্কে মোশাররফ হোসেনের রিপোর্টেও অনেক তথ্য আছে। গ্রামবাসী এবং মজুরদের সাথে তাঁদের সাক্ষাৎকারের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন :‘আমরা যে সমস্ত গ্রামবাসীর সাক্ষাৎ গ্রহণ করেছি তাদের অধিকাংশেরই মত হলো এই যে, এই কর্মসূচী খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রজেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ঠিকমতো কাজে লাগাচ্ছে না। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকে অবশ্য তদন্তকারীদেরকে বলেছে যে, লোকাল কাউন্সিলগুলি কিভাবে অর্থ কাজে লাগায় সে বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। যারা মনে করে টাকা তছরূপ হচ্ছে তাদের বক্তব্য হলো প্রজেক্ট কমিটিগুলো বর্তমান সড়কগুলি পুরোপুরি সংস্কারের জন্য টাকা যোগাড় করলেও তারা ছোটখাট সংস্কারের বেশী কিছু করে না। নিযুক্ত শ্রমিকদের নামে মজুরি হিসেবে যা লেখা হয় তার থেকে তাদেরকে দেওয়া হয় কম। তাছাড়া মাষ্টার রোলে অনেক মিথ্যে নামও তালিকাভুক্ত করা হয়। প্রজেক্টের হিসেবের থেকে মালমশলা অনেক কম কেনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো প্রজেক্টের জন্য কেনা মালমশলা ব্যক্তিগত কাজে লাগানো হয়।’২৬  আবার :‘প্রজেক্ট বিশেষে নিযুক্ত শ্রমিকদের নাম এবং তাদেরকে কি পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে সেটা প্রজেক্ট কমিটির রক্ষিত রেকর্ড থেকে পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় এই সমস্ত রেকর্ডের সত্যতা যাচাই করা হয়। বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, যে সমস্ত শ্রমিকেরা নিজেরা প্রজেক্টে কাজ করেছে তাদের থেকে আমরা যা জেনেছি তার সাথে মাষ্টার রোলে রেকর্ডকৃত এক একটি প্রজেক্টে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা, কাজের দিনের সংখ্যা এবং সেই শ্রমিকদেরকে প্রদত্ত টাকার পরিমাণের কোন মিল নেই।’২৭

রহমান সোবহান এবং মোশাররফ হোসেনের এইসব বক্তব্যেরই সমর্থন পাওয়া যায় অল্প শিক্ষিত কৃষক কর্মীদের অসংখ্য রিপোর্ট* থেকে। খুলনা জেলা সম্পর্কে এই ধরনের একটি রিপোর্টে মাটি কাটার ক্ষেত্রে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয় :

‘ইউনিয়ন কাউন্সিলের রাস্তায় খাটতে গেলে কন্ট্রাক্টররা ফাঁকি দেয়। কন্ট্রাক্টররাই বিডি মেম্বার। মাটির দাম ধরা যাক ১৯/২০ বা ২৫/২৬ টাকা হাজার। কিন্তু এদের দেওয়া হয় ১০/১২ টাকা। এই ধাঁ ধাঁ দুপুর রোদে চোখে আগুন ছোটে। সমানে কাজ করে চলে মজুর। হিসেব করে দেড় টাকা দাম পড়বে। সে সাড়ে পাঁচটায় বাড়ী যায়। কন্ট্রাক্টর মাটি মাপার সময় কম ফেলে, ফাঁকি দেয়। সিঁড়ি উঠিয়ে না দিলে দাম কম দেওয়া হয় (এটা আইন নয়, কিন্তু গায়ের জোরে আইন করা হয়)। দামও ‘আজ বিল পাইনি, কাল দেবো’ করে দু’সপ্তাহ ঘুরায়। দাম পড়ে জনপ্রতি চৌদ্দ আনা। তাই দিয়ে সংসার চালাতে হয়। এদিকে বর্ষা নামে, মাটি কাটা হয় না। সি-ওর কেরানীর সহযোগিতার বুক পানিতে মাটি মেপে ঠিকই মাষ্টার রোল দেওয়া হয়। মাঝ থেকে টাকা মারা পড়ে। সি-’ও ব্যক্তিটি টাকা পান কিনা জানিনে।’২৮

রাজশাহী জেলার নবদাশপুর ইউনিয়নের অপর একটি রিপোর্টে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের শোষণকান্ড সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার থেকে এই ধরনের নির্যাতনের একটা সাধারণ চিত্র পাওয়া যাবে।

‘নির্বাচিত চেয়ারম্যান গাংগোপাড়া হাটের রাইস মিল, নোতুন বাড়ী, উন্নয়ন দশকের বেহিসেবী টাকা লাভ করেছেন। গাংগোপাড়া হাট উক্ত চেয়ারম্যান নামমাত্র টাকায় ডাক দিয়ে নিয়েছে। এ হাটের ইজারা বা হাট তোলার পরিমাণ শুনলে আঁৎকে উঠতে হয়। ২০০ টাকা দামে গরু বিক্রি করলে ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা দিতে হয়। এই ইউনিয়নের পথঘাট করার জন্যে যে সকল কালভার্ট প্রস্তুত করা হয় তার জন্যে ৩০,০০০ হতে ২৫,০০০ টাকা ব্যয়ের হিসেব ধরা হয়েছে, তার প্লাষ্টার ধুয়ে ইটগুলি মুখব্যাদান করে আছে। এই টাকাগুলো চেয়ারগুলো, দারোগা প্রভৃতিদের মদ ও নারীদেহের ক্ষুধার বরাদ্দ যুগিয়েছে।’

‘চেয়ারম্যান নিরন্ন মৃতপ্রায় কৃষকদের রিলিফের কাপড়, চাউল, গম, চিনি, ভুট্টা প্রভৃতি যেভাবে আত্মসাৎ করেছে তা সত্যিই দুঃখজনক। পরবর্তী নির্বাচনে ভোটের ওয়াদা করিয়ে তারপর রিলিফের জিনিস দেওয়া হয়। আর রাতের গভীরে শতকরা ৭৫ ভাগ রিলিফের মাল পাচার হয়ে যায়। রেশনের দোকানের ডিলার সাহেব হঠাৎ ফরমান জারি করে, ‘আজ রেশন দেওয়া হবে।’ যদি নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট দিনে রেশন তোলা না হয় তবে আর দেওয়া হয় না। এবং রেশনের পরিমাণ ডিলারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। কারও যদি ১ সের চিনি বরাদ্দ থাকে তবে সে পাবে ১ পোয়া; কিন্তু কার্ডে লেখা হবে ১ সের। এইভাবে সাধারণ মানুষকে গম, আটা, চিনি প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সেই চিনি-আটা চড়া দামে হাটে প্রকাশ্যভাবে বিক্রয় হচ্ছে। এইভাবে এই এলাকায় বাদশাহী রাজত্ব চালাচ্ছে সুদখোর, মহাজন, দারোগা, পুলিশ, চেয়ারম্যান, ইজারাদারেরা।’২৯

০০০০০

* সায়ীদুল হাসান ও বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’তে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দুর্নীতির ওপর বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জোতদার, মহাজন, ইজারাদার, গ্রাম্য টাউট প্রর্ভতির শোষণ ও নির্যাতনের ধারা ও চরিত্র সম্পর্কেও পত্রিকাটি অনেক তথ্যপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে।

৫. সামাজিক শ্রমবিভাগ

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ফরাসী কৃষকদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস লেখেন :

‘স্বল্প জমিসম্পন্ন কৃষকেরা গঠন করে এক বিরটা জনগোষ্ঠী যার সভ্যেরা একই অবস্থায় বসবাস করে, কিন্তু পরস্পরের সাথে বহুবিধ সম্পর্ক সূত্রে আবদ্ধ থাকে না। তাদের উৎপাদন পদ্ধতি তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন না করে তাদেরকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এই বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পায় ফ্রান্সের খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কৃষকদের দারিদ্র্যের দ্বারা। তাদের উৎপাদন ক্ষেত্র ক্ষুদ্র ভূমিখন্ডের কৃষি কার্যে স্থান নেই কোন শ্রমবিভাগের, বিজ্ঞানের কোন ব্যবহারের এবং সেজন্যে বিকাশের কোন বিভিন্নমুখিতার, বুদ্ধির কোন বৈচিত্র্যের, সামাজিক সম্পর্কের কোন প্রাচুর্যের। প্রত্যেকটি কৃষক পরিবারই প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তা নিজেই সরাসরিভাবে নিজের খাদ্যসামগ্রীর অধিকাংশ উৎপাদন করে এবং সেই হিসেবে সমাজের সাথে যোগাযোগের থেকে প্রকৃতির সাথে লেনদেনের মাধ্যমেই সংগ্রহ করে নিজের জীবন ধারণের সংস্থান। একটি ক্ষুদ্র জমিখন্ড, একজন কৃষক ও তার পরিবার, তারই সংলগ্ন আর একটি ক্ষুদ্র জমিখন্ড, অপর একজন কৃষক এবং অন্য একটি পরিবার। এই ধরনের কয়েক কুড়ি নিয়ে গঠিত একটি গ্রাম, কয়েক কুড়ি গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি ডিপার্টমেন্ট (ইউনিয়ন, থানা, জেলা ইত্যাদির মতো একটি ফরাসী প্রশাসনিক বিভাগ—লেখক)। বস্তার মধ্যে আলু যেভাবে আলুর বস্তা গঠন করে অনেকখানি সেইভাবে অনুরূপ আয়তনের সরল  যোগফলই ঐভাবে গঠন করে ফরাসী জাতির বিশাল জনসমষ্টি।’১

ফরাসী কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার যে চিত্র মার্কস এখানে এঁকেছেন কৃষিতে ধনবাদী বিকাশের পূর্ববর্তী পর্যায়ে যেকোন দেশের চিত্র, ভূমি ব্যবস্থায় অল্পবিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও, সাধারণভাবে তাই। রুশ কৃষিতে সামন্তবাদী অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেনিনও সে কথাই বলেছেন।২

যে কোন দেশে সামন্তবাদী অর্থনীতির অবক্ষয় ও পতনের সাথে কৃষিক্ষেত্রে সামাজিক শ্রেণীবিভাগের বিকাশ ঘটতে বাধ্য এবং এ বিকাশের অভাব ঘটলে তা সে দেশের সামন্তবাদী অর্থনীতিরই পরিচায়ক। কৃষি অর্থনীতি যখন খুব নিম্নতেম সামন্তবাদী পর্যায়ে থাকে তখন প্রত্যেক কৃষক পরিবারই নিজের খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রায় সমগ্র অংশ নিজেরাই উৎপাদন করে, প্রত্যেকের অর্থনৈতিক জীবন মোটামুটি একই সুতোয় গাঁথা থাকে। বিভিন্ন ঋতুতে কতকগুলি ধরাবাঁধা শস্য ও ফসলের চাষ-আবাদ, গবাদি পশু প্রতিপালন ইত্যাদি একইভাবে এবং একই নিয়মে প্রত্যেকটি কৃষক পরিবার বৎসরের পর বৎসর করে চলে, তার মধ্যে কোন বৈচিত্র্য থাকে না। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবশ্য কৃষকরা শুধু কৃষিকার্যেই রত থাকে তাই নয়, তারা কৃষিজাত দ্রব্যের সাথে সম্পর্কিত ছোটখাট শিল্পকার্যও নিজেরাই করে থাকে। অর্থাৎ যে কৃষক পরিবার ধান উৎপাদন করে তারাই আবার ঢেঁকিতে ধান কুটে চাল তৈরী করে। যে পরিবার ইক্ষু উৎপাদন করে তারাই গুড় তৈরী করে, যে পরিবার কৃষিকার্য করে তারাই গরুর দুধ থেকে ঘি, দই তৈরী করে। এসব ক্ষেত্রে কৃষক পরিবারগুলির প্রয়োজনের তালিকা ও পরিধি খুব ছোট হয় এবং এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তাদেরকে বাজারের আশ্রয় না নিয়ে নির্ভর করতে হয় নিজেদের পরিশ্রমের ওপর। এর ফলে এই অর্থনীতিতে সামাজিক লেনদেনের সম্ভাবনা নিতান্তই সঙ্কুচিত থাকে।

আমাদের দেশে মোগল আমলেও এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জারী ছিলো। তখন বর্ণাশ্রমের কাঠামোর মধ্যে গ্রামে কামার, কুমোর, ছুতোর, জেলে ইত্যাদি থাকলেও তারা প্রত্যেকেই কৃষিকার্যের সাথে অল্পবিস্তর সম্পর্কিত থাকতো। কিন্তু এই সম্পর্ক সত্ত্বেও একথা বলা চলে যে, এই পর্যায়ে গ্রাম্য অর্থনীতির মধ্যে কিছুটা শ্রমবিভাগ দেখা দিয়েছিলো। তবে এই শ্রমবিভাগ এতো নিম্ন পর্যায়ের ছিলে যে সেটা প্রত্যেক পরিবারের পারিবারিক স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে কিছুটা হ্রাস করতে সক্ষম হলেও তাদের নির্ভরশীলতাকে নিজেদের গ্রামের মধ্যেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ রেখেছিলো।

বৃটিশ আমলে, বিশেষ করে ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে, এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। সারা ভারতবর্ষময় বিদেশী পণ্যদ্রব্য হাজির করে  ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং অন্যান্য ব্যবসাদারেরা পূর্ববর্তী গ্রাম্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যে কিছুটা ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামগ্রিক অর্থনীতি ও কৃষি ব্যবস্থার ওপর তার প্রভাব ছিলো খুব সামান্য ও সীমাবদ্ধ। এর ফলে গ্রাম্য অর্থনীতির বাইরে উৎপন্ন কিছু কিছু ব্যবহার্য সামগ্রী, প্রধানতঃ বস্ত্র গ্রামে ক্রয়-বিক্রয় হলেও তার দ্বারা সাধারণ কৃষকদের ওপরে বর্ণিত স্বয়ংসম্পূর্ণতার তেমন অবসান ঘটেনি। কাজেই বৃটিশ আমলেও বিপুল অধিকাংশ কৃষক পরিবারই খাদ্যসহ নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অধিকাংশই নিজেরা উৎপাদন করতো। সেখানে সামাজিক শ্রমবিভাগ তেমন উল্লেখযোগ্য ছিলো না।

১৯৪৭ সালের পর থেকে এই পারিবারিক ও গ্রাম্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার আরও কিছুটা অবসান ঘটলেও সমগ্র অবস্থার মধ্যে কোন ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। কৃষকদের আর্থিক জীবন প্রাক-পুঁজিবাদী কৃষি অর্থনীতির খুঁটিতে তখনো পর্যন্ত অনেকখানি বাঁধা ছিলো।

সামাজিক শ্রমবিভাগের মাধ্যমে উৎপাদনের লক্ষ্য বিনিময়, প্রত্যক্ষ ভোগ নয়। কাজেই যে সমাজে যত বেশী শ্রমবিভাগ দেখা দেয় সেই সমাজে বিনিময়যোগ্য সামগ্রী অর্থাৎ পণ্য উৎপন্ন হয় তত বেশী। এই বিভাগের ফলে সমাজের প্রত্যেক পরিবারকে নিজের সমগ্র প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করতে হয় না, বিভিন্ন পরিবারের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্য তারা পরস্পরের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় করে। এইভাবে শ্রমবিভাগের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টি ও বিস্তৃত হয় আভ্যন্তরীণ বাজার-শিল্প বিকাশের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

সামাজিক শ্রমবিভাগ, আভ্যন্তরীণ বাজারের বিস্তৃতি, শিল্প বিকাশ ইত্যাদি যতই অগ্রসর হতে থাকে ততই কৃষি ও শিল্প পরস্পর থেকে অধিকতরভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। কৃষিজাত দ্রব্যের ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত শিল্প-বাণিজ্য গড়ে ওঠে সেগুলিও পৃথক পৃথকভাবে সংগঠিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে দেশীয় শিল্পও নব নব ক্ষেত্রে হয়ে উঠে স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময়।

শ্রমবিভাগ এবং উৎপাদন ক্ষেত্রের এই বিচ্ছিন্নতা যত বৃদ্ধি পায় সমাজে পারিবারিক, গ্রাম্য এবং এলাকাগত বিচ্ছিন্নতা তত বেশী কমে আসে। পরিবার, গ্রাম এবং বিভিন্ন এলাকাসমূহ পরস্পরের পাশাপাশি তখন ‘আলুর বস্তার’ মতো অবস্থান না করে একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠতর লেনদেনের ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়।

এইসব পরিবর্তনের ফলে যেমন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের তুলনায় শিল্প শ্রমিকদের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি অন্যদিকে আনুপাতিকভাবে শহরগুলির জনসংখ্যাও গ্রামের জনসংখ্যার তুলনায় বৃদ্ধি পায়, পত্তন হয় নোতুন নোতুন শহরের।

শিল্প বিকাশের এই মাপকাঠিগুলিতে পূর্ব বাঙলার বর্তমান অর্থনীতি, বিশেষতঃ কৃষি অর্থনীতির বিচার বিশ্লেষণ করলেই আমরা তার যথার্থ পরিচয় নির্ণয় করতে সক্ষম হবো।

এ বিষয়ে নীচে পূর্ণতর আলোচনা করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে শুধু দুটি বিষয়েরই বিশেষ উল্লেখ দরকার। তা হলো, কৃষিকার্যরত ও শিল্পকার্যরত  শ্রমিকের এবং গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের জনগণের আনুপাতিক সংখ্যা। কোন দেশে সামাজিক শ্রম বিভাগ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ কতখানি হয়েছে এ দুটোই হলো তার একটি মাপকাঠি।

পূর্ব বাঙলায় কৃষি ও শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা এবং গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা (শতাংশ হিসেবে) ৩

সাল কৃষি শ্রমিক শিল্প শ্রমিক গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যা শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা
১৯৫১ ৮৩.১৫ ১৬.৮৫ ৯৫.৬ ৪.৩৪
১৯৬১ ৮৫.১৬ ১৪.৭৪ ৯৪.৮ ৫.১

পূর্ব বাঙলায় সামাজিক শ্রমবিভাগের অবস্থা উপরের এই টেবিলটি থেকেই মোটামুটি বোঝা যাবে। ১৯৫১ সালে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে ছিলো ৮৩.১৫%, ১৯৬১ সালে সেখানে তা দাঁড়িয়েছে ৮৫.২৬%। অর্থাৎ অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ১৯৫১ সালে গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যা ছিলো ৯৫.৬%, ১৯৬১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯৪.৮%। এক্ষেত্রে ০.৮% জনসংখ্যা কমে এলেও দশ বৎসরে এই সামান্য পরিবর্তন তাৎপর্যহীন। কাজেই সামগ্রিকভাবে বিচার করলে ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত এদিক দিয়ে একটা পরিপূর্ণ স্থিতাবস্থাই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

৬. ভূমি খাজনা

ভূমি খাজনা প্রথা ভারতবর্ষে মোগল আমলে এবং তার পূর্ববর্তী কালেও প্রচলিত ছিলো। তখন এই খাজনা সাধারণতঃ উৎপন্ন ফসলের একাংশ হিসেবে দেওয়া হতো। বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে খাজনা প্রথার প্রবর্তন করে তাতে সাধারণভাবে টাকায় খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ফসলে খাজনা এবং টাকায় খাজনায় বাহ্যিক রূপের পার্থক্য সত্ত্বেও এই দুই ধরনের খাজনাই হলো কৃষকের উদ্বৃত্ত মূল্য। কাজেই খাজনার শোষণ, সে ফসলেই হোক অথবা টাকায়, আসলে তা উদ্বৃত্ত মূল্যেরই শোষণ। সেদিক দিয়ে এই দুইয়ের মধ্যে কোন মৌলিক প্রভেদ নেই।

ভূমি মালিকেরা কৃষকদের উদ্বৃত্ত মূল্য বরাবরই খাজনার মাধ্যমে শোষণ করে এসেছে। তবে এই শোষণের রূপ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ে এক থাকেনি। প্রথমদিকে কৃষকরা এই খাজনা দিতো নিজেদের শ্রম দান করে অর্থাৎ ভূস্বামীর জমিতে কোন পারিশ্রমিক ব্যতীত মজুর হিসেবে কাজ করে। পরে এই খাজনা সরাসরি মজুরির মাধ্যমে না দিয়ে ফসলের মাধ্যমে দেওয়ার প্রথা প্রচলিত হয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে টাকার প্রচলন বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রচলন হয় টাকায় খাজনা দেওয়ার রীতি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ভূমি খাজনা কিভাবে কৃষকদের ওপর শোষণ জারি রেখে এ দেশের শিল্প বিকাশকে বাঁধাগ্রস্ত করছে তা আমরা দেখেছি।*  ১০৫০ সালে পূর্ব বাঙলায় এই বন্দোবস্তের উচ্ছেদ হয় এবং ব্যক্তি বিশেষের পরিবর্তে রাষ্ট্র হয় এই খাজনার মালিক। এই পরিবর্তনের ফলে ভূমি খাজনার মালিকানা পরিবর্তিত হলেও ভূমি খাজনার মৌলিক চরিত্রের কোন পরিবর্তন হলো না এবং সেটা হওয়ার কথাও নয়। টাকায় প্রদত্ত এই ধরনের ভূমি খাজনা সম্পর্কে মার্কস তাই বলেছেন,‘এক্ষেত্রে খোদ উৎপাদক উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে তার মূল্য ভূস্বামীকে (যে রাষ্ট্রায়ত্ত হতে পারে অথবা ব্যক্তি বিশেষও  হতে পারে) প্রদান করে।’১ 

মার্কস এই খাজনার সাথে পুঁজিবাদী ভূমি খাজনার পার্থক্যকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন :‘এই পুঁজিবাদী খামার মালিক ভূস্বামীকে অর্থাৎ যে জমি সে ব্যবহার করে তার মালিককে, এই বিশেষ উৎপাদন ক্ষেত্রে নিজের পুঁজি নিয়োগের অধিকারের জন্য চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত সময় অন্তর, যথা বৎসরে (ঠিক যেভাবে মুদ্রা পুঁজির ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সুদ প্রদান করে), কিছু পরিমাণ টাকা প্রদান করে। কৃষি জমি, গৃহ নির্মাণের জমি, খনি, মৎস্য শিকার ক্ষেত্র অথবা বনভূমি ইত্যাদি যার জন্যেই প্রদান করা হোক এই টাকাকে ভূমি খাজনা বলে।’২  কাজেই এক্ষেত্রে ভূমি খাজনা খোদ কৃষক দেয় না, দেয় পুঁজিবাদী খামার মালিক, যে ভূস্বামীর জমিতে নিজের টাকায় নিযুক্ত কৃষি শ্রমিক এবং নিজের টাকায় ক্রীত যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক কৃষি কার্যে নিযুক্ত থাকে।

০০০০

* ‘বাণিজ্যিক কৃষি ও শিল্প বিকাশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তসমূহ বিদ্যমান ছিলো বলেই মনে হয়। কিন্তু যেটুকু বিকাশ ঘটেছিলো তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো অকালজন্মা ও অসুস্থ। কেন? আমার মনে হয় এর সব থেকেই বড়ো জবাব হচ্ছে এই যে, Pax Britannica ভূস্বামী এবং এখন মহাজনকেও গ্রামাঞ্চলে উদ্ভূত সেই অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত সহজেই পকেটস্থ করতে সহায়তা করেছিলো যে উদ্বৃত্ত জাপানে খরচা যুগিয়েছিলো শিল্পায়নের কষ্টদায়ক প্রথম পর্যায়ের।…..

ঐতিহাসিক কার্যকারণের যে জটিল শৃঙ্খল ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ পশ্চাদপদত্ব ব্যাখ্যা করে তার মধ্যে প্রধান সূত্র হিসেবে আমি উল্লেখ করবো গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত আদায়ের এই বিশেষ পদ্ধতি এবং তার পরিণতিতে এই উদ্বৃত্তকে শিল্প বিকাশের দিকে চালনা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। সাধারণভাবে প্রদত্ত অন্যান্য কতকগুলি ব্যাখ্যা যথা জাতিভেদ প্রথার বিভিন্ন ক্রিয়া, সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অচলাবস্থা, ব্যবসায়ী বৃদ্ধির ঘাটতি ইত্যাদির থেকে এ কারণগুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ।’

—Barringon Moore Jr : Socil Origins of Dictatorship and Democracy 1969. P. 354-55.

০০০

১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের ফলে পূর্ব বাঙলায় প্রাক-পুঁজিবাদী ভূমি খাজনার উচ্ছেদ হলো না। উপরন্তু সেই খাজনাকে জারি রেখে রাষ্ট্র পরিণত হলো জমিদারে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধিত হলো না এবং এই খাজনার আনুষঙ্গিক সার্টিফিকেট, বডি ওয়ারেন্ট, তহশীলদারী নির্যাতন, বকেয়া খাজনা অনাদায়ে অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক, জমি থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি কৃষি উৎপাদনের বিকাশকে রুদ্ধ এবং কৃষক জীবনকে বিপর্যস্ত করলো।

ভূমি খাজনা প্রথা কিভাবে কৃষি উৎপাদনের বিকাশকে রুদ্ধ করেছে সে আলোচনার পূর্বে কৃষক-জীবনকে তা আইয়ুবের আমলে কিভাবে বিপর্যস্ত করতো এবং খাজনা আদায়কারী সরকারী কর্মচারীরা গরীব কৃষকদের ওপর কি ধরনের নির্যাতন চালাতো তার কতকগুলি উদাহরণ উল্লেখ করা দরকার। বাস্তব চিত্র হিসেবে এগুলি যথেষ্ট মূল্যবান।

(ক) রংপুর জেলা। ‘গাইবান্ধা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মহকুমার বাদিয়াখালির কালির বাজার গ্রাম থেকে এলাকার সার্কেল অফিসার খাজনার দায়ে অতর্কিতে জনৈক গরীব চাষীর গরু নিয়ে যায়। এই খবর দাবাগ্নির মতো গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে জনমনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং কৃষক সমিতির উদ্যোগে ৬/৭ শত লোক তহশীল অফিসের সামনে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তার আগে সার্কেল অফিসারটি ঐ অফিস থেকে কেটে পড়ে।

প্রস্ঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, যখন গরীব কৃষকেরা গরুর অভাবে মাঠে হাল দিতে পারছে না, বীজের অভাবে ফসল বুনতে পারছে না, তখন জোতদারদের সহযোগিতায় এসব আমলাদের দৌরাত্ম্যের ফলে সহায়-সম্বলহীন চাষীদের দুর্ভোগের সীমা থাকছে না।’

(খ) ফরিদপুর জেলা। ‘ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জ থানার অন্তর্গত ছয়গাও এবং কনেশ্বর ইউনিয়নের তহশীল অফিস বিশেষ করে গরীব কৃষকদের উপর অত্যাচারের অন্যতম কেন্দ্র। এই তহশীল অফিস এবং তার কর্মচারীগণ নিরীহ গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। খাদ্যশস্য ও দ্রব্যমূল্যের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে অধিকাংশ কৃষকের ঘরে খাবার নেই। প্রায় সারাদিন উপোস থাকতে হয়। অনেকেই মিষ্টি আলু ও চিনা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। ফলে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বা ওষুধের কোন ব্যবস্থাই নেই।

এ পরিস্থিতিতে তহশীলদার, মহাজন ও গ্রামের টাউটেরা গরীব কৃষকের উপর জুলুম করছে। জোতদার টাউটের দল খাজনার দায়ে জমিখন্ড দখলের জন্য তহশীলদারদের সাথে মিশে ষড়যন্ত্র করছে। উপরি ছাড়া তহশীল অফিসে খাজনা নেয়া হচ্ছে না। দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বরের জটিলতা বা মারপ্যাঁচ দেখিয়ে সরল কৃষকদের খাজনার নামে হয়রানি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই চরম আর্থিক দুর্দিনে এবং ধান ও পাটের বীজ বুনানো ও নিড়ানীর এই সবচেয় জরুরী সময়ে ক্রোকী পরোওয়ানা জারী করে তাদের শেষ সম্বল থালা, ঘটি, বাটি এমনকি চাষের বলদ-লাঙ্গল নিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে গরীব কৃষকদের উপর বডি ওয়ারেন্ট করে আটক রাখছে। খাজনাখোরদের অন্যায় সার্টিফিকেট অনুসারেও কেহ কেহ বহু কষ্টে টাকা পয়সা জোগাড় করলেও উপরি না দিলে মালপত্র ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। অথবা আটক ব্যক্তি মুক্তি পাচ্ছে না। জোতদার, মহাজন, টাউট তহশীলদার ও থানার লোকজন ঘনিষ্ঠ যোগসাজশে গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের উপর এভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসছে। এই অত্যাচার ও অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে কৃষক ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। তারা একতাবদ্ধভাবে এই অন্যায় ও অবিচারের মূলোৎপাটনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে।’৪

(গ) কুষ্টিয়া জেলা। ‘নিঃস্ব ভুখা কৃষক ও গরীব জনসাধারণের খাজনা দেওয়ার কোন সংস্থান না থাকায় গত ১১ই জুন ১ নং চিতুলিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও লক্ষ্মীধরদিয়ার গ্রামের মেম্বর সাহেবের নির্দেশে দফাদার ও চৌকিদার উক্ত গ্রামে প্রবেশ করে দুর্ভিক্ষকবলিত জনগণের মধ্যে সদলবলে এক দুর্ধর্ষ ক্রোকী জেহাদ চালায়। কৃষকের ঘরে হামলা দিয়ে তারা যা পায় তাই ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। বাজু নামক জনৈক ব্যক্তির তরকারি রান্নার কড়াই, বাহার আলী খড়া, গেদা মন্ডলের কোদাল, কুদ্দুছ আলীর বালতি, বাদশা মিয়ার বাটি, রতন ফকিরের চামচ ও গ্লাস ক্রোক করা হয়। এভাবে শেষ সম্বলটুকুও প্রত্যেক কৃষকের ঘর থেকে নিয়ে চলে যায়।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জোতদার মহাজন ও বিত্তশালী লোকের মধ্যে খাজনা ও ট্যাক্স বিপুল পরিমাণে বাকী আছে, অথচ তাদের বেলায় এই আইনগত ব্যবস্থা কার্যকরী নয়।’৫

(ঘ) নোয়াখালী জেলা। ‘সম্প্রতি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থানায় তহশীলদারদের অত্যাচারে সেখানকার গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খাজনা আদায়ের নামে গরীব কৃষকের গরু, ছাগল, থালা, ঘটিবাটি পর্যন্ত ঐ দুর্নীতিবাজ তহশীলদাররা ছিনিয়ে নিচ্ছে।

অনেক সময় ঐ শয়তান তহশীলদাররা কৃষকদের নানা রকম ভয় দেখিয়ে ঘুষও আদায় করে থাকে—অনেকের কাছে সেই পুরনো জমিদার আমলের বকেয়া খাজনাও দাবী করা হয়।

কৃষি ঋণ আদয়ের নামে শোষণের এক নোতুন পন্থা ঐ ঘুষখোর তহশীলদাররা আবিষ্কার করেছে। অনাদায়ী কৃষি ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তির মাল ক্রোক করে তারই জিম্মায় রেখে আসা হয়। পরবর্তী সময়ে জিম্মাদার হিসেবে মাল হাজির করার জন্য কোন নোটিশ না দিয়েই ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪০৬ নং ধারা অনুযায়ী ক্রোকী পরোওয়ানা নিয়ে গিয়ে বাদী হয়ে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়।

আষাঢ় মাসে পূর্ব বাঙলার কৃষককূল নিদারণ সংকটের মধ্যে কাটাচ্ছে। তাড়াছা অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পোকার আক্রমণ এসব তো আছেই। পোকার আক্রমণের জন্য ঐ এলাকার ধান উৎপাদন একেবারে কমে যাচ্ছে। শতকরা ৭০/৭৫ জন কৃষকই অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। পেটে নেই ভাত, পরনে নেই কাপড়, তার ‍ওপর রয়েছে জোতদার, মহাজন, টাউট বাটপার এবং ঘুষখোর তহশীলদারদের অত্যাচার—সবকিছু মিলিয়ে কৃষকের অবস্থা এখন দুবির্ষহ হয়ে উঠেছে।’৬

খাজনার শোষণ এবং সরকারী খাজনা আদায়কারীদের নির্যাতন সম্পর্কে অন্যান্য জেলার ওপরও অনেক রিপোর্ট উদ্ধৃত করা চলে; কিন্তু আপাততঃ তার প্রয়োজন নেই। কারণ এই শোষণ, নির্যাতনের চরিত্র সর্বত্রই প্রায় এক এবং অভিন্ন।

ওপরের রিপোর্টগুলি থেকে ভালোভাবেই বোঝা যায় যে, জমিদারী আমলে জমিদার ও তাদের অধঃস্তন কর্মচারীরা কৃষকদের থেকে যে অতিরিক্ত আদায় করতো এবং সেই আদায়ের জন্য যে সমস্ত নির্যাতনের আশ্রয় নিতো তার কোন অবসান ঘটেনি। রাষ্ট্রের পাওনা খাজনার উর্ধ্বে এই অতিরিক্ত আদায় একদিকে কৃষক শ্রেণীকে অধিকতর ঋণগ্রস্ত করছে এবং অন্যদিকে স্ফীত করছে তহশীলদার, সার্কেল অফিসার, পুলিশ-চৌকিদারদের পকেটকে।

ভূমি সংস্কার ও খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট প্রথা ও সকল প্রকার উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে পূর্ব বাঙলায় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রী দল-কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে রাজস্ব মন্ত্রী মাহমুদ আলী একটি ভূমি সংস্কার সম্মেলন আহ্বান করেন। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারী এবং নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এই সম্মেলনে ৬২ জন উপস্থিত থাকেন।*  খাজনার নির্যাতন বন্ধ ও সার্টিফিকেট প্রথা রহিতকরণ সম্পর্কে সম্মেলনে নিম্নলিখিত সুপারিশ পেশ করা হয় :

‘সার্টিফিকেট প্রথা তুলিয়া দিতে হইবে এবং খাজনা ও সেস আদায় করিবার নিমিত্ত সরকারকে সম্ভাব্য সর্বো’কৃষ্ট এমন বিকল্প আইন উদ্ভাবন করিতে হইবে, যাহা দ্রুত অথচ ব্যয়সাপেক্ষ নহে এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের নিকট অপেক্ষাকৃত কম কষ্টকর ও উৎপীড়নমূল হইবে। বিকল্প ব্যবস্থাটি এমনভাবে উদ্ভাবন করিতে হইবে যাহাতে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যসমূহ সাধিত হয় : যথা, বকেয়া খাজনা ও সেসসমূহ আদায় করিবার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থার প্রয়োগ। ঐসব পাওনা আদায় কার্যের সহিত সংশ্লিষ্ট নহে এমন কোন এজেন্সিকে করিতে হইবে, আইনানুগ ব্যবস্থা যে কোন ক্ষেত্রে চালু করিবার পূর্বে আদায়কারী কর্মচারীগণ অনাদায়ী প্রজাকে কোন নির্ধারিত তারিখের মধ্যে তার বকেয়া পরিশোধ করিতে বলিয়া নোটিশযোগে ঐ বকেয়া সম্পর্কে তাহাকে সাবধান করিয়া দিবেন, এমন নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে যেন সাধারণ নোটিশ এবং আইনানুগ ব্যবস্থা সম্পর্কিত সমস্ত নোটিশ অনাদায়ী ব্যক্তির নিকট ঠিক ঠিক পৌঁছে, কেবল প্রধান শস্য তুলিবার মওসুমে যখন অনাদায়ীর পরিশোধ করিবার সামর্থ্য থাকে তখনই আইনানুগ ব্যবস্থা কার্যকরী করিতে হইবে, বিচার বিভাগের অফিসারের নিকট আপীল করিবার বিধান রাখিতে হইবে, ব্যবস্থাটি প্রজাদের নিকট ন্যূনতম ব্যয়সাপেক্ষ ও ন্যূনতম উৎপীড়নমূলক হইতে হইবে, আদালত কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থাবলম্বনের সময় কোন পুরা একটি দাগের সমন্বয়ে গঠিত জোতের যতটুকু অংশ বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য যথেষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইবে কেবলমাত্র তাহাই ক্রোক হইবে এবং এক সনের জন্য তাহা নিলামে বন্দোবস্ত দিতে হইবে, তৎপর পুনরায় উহা পূর্ববর্তী মালিকের দখলে আসিবে। নিলামে প্রাপ্ত টাকা হইতে সরকারী পাওনা পরিশোধ হইয়া যাহা উদ্বৃত্ত থাকিবে তাহা মালিককে ফেরত দিতে হইবে : এবং (II.) এক সনের বেশী বকেয়া খাজনা জমিতে দেওয়া হইবে না।’৭

এই সম্মেলনে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী পর্যায়ে খাজনা সংক্রান্ত সমস্যাবলীর চরিত্র নির্ধারণ ও সেগুলি সমাধানে একটা সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশ করা হয়। অনেকাংশে অসন্তোষজক হলেও তদানীন্তন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সুপারিশ ছিলো যথেষ্ট প্রগতিশীল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর অবস্থার কোন উন্নতি না ঘটে এবং উত্তরোত্তর তার অবনতিই ঘটে।

০০০

* এই সম্মেলনে উপস্থিত এম, পি, এ-দের কয়েকজন হলেন : সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন, বসন্ত কুমার দাস, আলহাজ্ব মোহাম্মদ দানেশ, খোন্দকার আবদুল হামিদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক আবুল কাশেম, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, সৈয়দ কামরুল আহসান, মির্জা গোলাম হাফিজ, আব্দুস সামাদ, অধ্যাপক পুলিন বিহারী দে, মোহাম্মদ তোয়াহা, দৌলতুন্নেসা খাতুন। রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন : আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (গণতন্ত্রী দল), অলী আহাদ (আওয়ামী লীগ), মোহাম্মদ ইয়াকুব মিয়া (কৃষক সমিতি, ত্রিপুরা), মোহাম্মদ সুলতান (যুবলীগ), আব্দুল হক (যশোর)।

০০০

এই অবনতির চিত্রই আমরা উপরে উল্লেখিত চারটি উদাহরণে দেখেছি। সরকারী কর্মচারী, মৌলিক গণতন্ত্রী এবং জোতদার-মহাজনদের উৎপীড়নে খাজনার শোষণ বর্তমানে জমিদারী আমলের শোষণকেও বহুমাত্রায় ছাড়িয়ে গেছে।

কিন্তু শুধু খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা রদ করার উদ্দেশ্যেই নয়, খাজনা হ্রাস করা সম্পর্কেও সম্মেলনে নিম্নলিখিত সুপারিশ করা হয় :

আপাততঃ খাজনার বর্তমান হার চলিতে পারে, তবে যে সমস্ত ক্ষেত্রে খাজনার হার বেশী রহিয়াছে সেগুলি জমিদারী দখল আইনের ২৪ ধারা মোতাবেক ন্যায্য ও যথার্থ স্তরে নামাইতে হইবে। এছাড়া যে সমস্ত এলাকায় জমিদারী দখল পুরোপুরিভাবে হইয়া গিয়াছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়ের ভিত্তিতে খাজনার হার হ্রাস করার জন্য সে সমস্ত এলাকার খাজনার উচ্চ হারও পুনবিবেচনা করিতে হইবে।’৮

সার্টিফিকেট রহিত ও খাজনা হ্রাস সংক্রান্ত এই দুটি সুপারিশই যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার কর্মসূচীর দ্বিতীয় দফার অন্তর্ভূক্ত ছিলো। এই দ্বিতীয় দফা সম্মিলিত নির্বাচনী ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় :

‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চহারের খাজনা ন্যায়সংগতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।’৯

মন্ত্রিসভার তৎকালীন ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে এই সমস্ত সুপারিশগুলি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আইয়ুব খানের আমলে দুর্নীতি, খাজনা আদায়কারীদের নির্যাতন, খাজনার  হার সবকিছুরই অদৃষ্টপূর্ব বৃদ্ধি ঘটে। নীচে ভূমি খাজনা ও কৃষি খাতে ব্যয়ের একটা হিসেব (পরবর্তী পৃষ্ঠায়) দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ১৯৫০ এবং ১৯৭০ সালের মধ্যে খাজনা বৃদ্ধির পরিমাণ। ১৯৫০ সালে মোট ভূমি খাজনা যেখানে ছিলো ২ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা, সেখানে ১৯৭০ সালে সেই খাজনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ আট গুণেরও বেশী। খাজনা বৃদ্ধির এই ধারা অবশ্য আইয়ুবের আমলে নোতুনভাবে প্রবর্তিত হয়নি, পূর্বেই তা জারী ছিলো। সেই অনুসারে ১৯৫৭-৫৮ সালে পূর্ব বাঙলার ভূমি-খাজনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিলো ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু আইয়ুবের আমলে খাজনা বৃদ্ধির ধারা নোতুনভাবে প্রবর্তিত না হলেও এই বৃদ্ধির হার প্রথম থেকেই দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। ভূমি খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধির ব্যাপারে আইয়ুব সরকার এতো বদ্ধপরিকর ছিলো যে, ১৯৫৮-৫৯ সালেই ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা থেকে তা উঠে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৫ লক্ষ। প্রাকৃতি দুর্যোগের ফলে ১৯৫৯-৬১ এবং ১৯৬২-৬৩ সালে আদায়ের পরিমাণ কম হলেও খাজনা বৃদ্ধির এই অদৃষ্টপূর্ব ও নিদারুণ হার অন্যান্য বৎসরগুলিতে দৃঢ়ভাবে বজায় রাখা হয়।

ভূমি খাজনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যে একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে সেটাও এই হিসেব থেকে দেখা যাবে। ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির হারের তারতম্যের ফলে দুই অঞ্চলে এই হার বৃদ্ধির প্রভাবের মধ্যেও কিছু তারতম্য থেকেছে। এ প্রসঙ্গে ভূমি খাজনা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমগ্র রাজস্বের কত শতাংশ সেটা দেখলে আমরা আপেক্ষিকভাবে দুই অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনীতির একটা পরিচয়ও পেয়ে যাবো।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৫৯-৬০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভূমি খাজনা যথাক্রমে সমগ্র রাজস্বের ২৩.৪ এবং ২০.২৬ ভাগ হলেও ১৯৬৯-৭০ সালে তা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১১.৪ এবং ৪.২ ভাগ। এর অর্থ শিল্প খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত আয় বৃদ্ধি। কৃষি উন্নয়ন ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের সরকারী ব্যয়ের হিসেব মতো দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ভূমি খাজনা সমগ্র রাজস্বের অপেক্ষাকৃত অনেক বড় অংশ হলেও কৃষিখাতে ব্যয় সেই তুলনায় আপেক্ষিকভাবে অনেক কম। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভূমি খাজনা যখন সমগ্র রাজস্বের ১১.৪ শতাংশ তখন এখানে কৃষি খাতে ব্যয় হচ্ছে সমগ্র ব্যয়ের ০.৯৪ শতাংশ। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ভূমি খাজনা ঐ বৎসরই যখন সমগ্র রাজস্বের ৪.২ শতাংশ, তখন সেখানে কৃষি খাতে ব্যয় ৩.১১ শতাংশ। সরকারী নীতি অনুযায়ী পূর্ব বাঙলায় কৃষি আপেক্ষিকভাবে কতখানি উপেক্ষিত এটাই হলো তার অন্যতম প্রমাণ।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভূমি খাজনা ও কৃষি খাতে ব্যয়ের হিসেব১০                          লক্ষ টাকায়

১৯৫০-৫১ ১৯৫৪-৫৫ ১৯৫৬-৫৭ ১৯৫৭-৫৮ ১৯৫৮-৫৯ ১৯৫৯-৬০ ১৯৬০-৬১ ১৯৬১-৬২ ১৯৬২-৬৩ ১৯৬৩-৬৪ ১৯৬৪-৬৫ ১৯৬৫-৬৬ ১৯৬৬-৬৭ ১৯৬৭-৬৮ ১৯৬৮-৬৯ ১৯৬৯-৭০
ভূমি খাজনা পূর্ব ২.২৪ ৫.০২ ৫.১৫ ৬.৭৫ ১৩.০৫ ৯.৩৫ ১০.৬৭ ১৪.৫৫ ৭.৬৫ ১২.৭৬ ১২.১৫ ১৩.৪৪ ১৪.৬৯ ১৪.৯১ ১৫.০০ ১৮.৫০
পশ্চিম ৩.২৮ ৪.৪০ ১১.৭৫ ১১.৯৫ ১৭.৮৫ ১৩.৮৬ ১৩.২৪ -.১৩৪ ১৪.৪৯ ১১.৪১ ৭.৩০ ১১.৩৯ ১৫.০৮ ১৬.৩২ ৯.১৪ ৯.২১
সমগ্র রাজস্বের

শতাংশ হিসেব ভূমি খাজনা

পূর্ব ২৩.৪ ২১.৮ ২৩.৩ ১০.৩ ১২.৮ ১০.৬ ১১.৪ ১১.৩ ১০.৫ ১০.৩ ১১.৪
পশ্চিম ২০.২৬ ১৫.৬৩ (-) ১.২৪ ১০.৭৪ ৭.২৬ ৪.০১ ৬.৩৯ ৮.৩৮ ৮.৮৮ ৪.৬৩ ৪.২
কৃষি খাতে ব্যয় পূর্ব ৯০ ৯৫ ৮২ ১.০১ ১.০৮ ৯৬ ১.০৫ ১.১১ ১.১৬ ১.২২ ১.২৯ ১.৬৭ ১.৬৮ ১.৬৯ ১.৭৭ ১.৯৩
পশ্চিম ৮৩ ৯৬ ১৪৪ ৩.১৪ ৯.৯৯ ৮.০০ ৪.৫৯ ৩.৩০ ৪.১০ ৩.৪২ ৩.৬১ ৪.৮৬ ৫.৬৫ ৬.০৭ ৬.০৭ ৬.৭০
সমগ্র ব্যয়ের শতাংশ হিসেবে কৃষি খাতে ব্যয়ে পূর্ব ২.৫৫ ২.৪০ ২.২২ ১.৭২ ১.২০ ১.১৮ ১.৪৭ ১.৪০ ১.২৪ ১.০৫ ০.৯৪
পশ্চিম ১১.৪৩ ৬.৫৫ ৪.১১ ৩.৭১ ২.৩১ ২.২৫ ২.৮০ ৩.১৮ ৩.২৮ ৩.১৩ ৩.১১

পূর্ব বাঙলায় ভূমি খাজনার আর একটা দিক হলো অল্প এবং অধিক জমি মালিকদের দেয় খাজনার হারের সমতা। অর্থাৎ হারের মধ্যে উঁচু-নিচুর তারতম্য এক্ষেত্রে নেই। এর ফলে এক বিঘে জমির মালিক যে হারে খাজনা দেয় হাজার বিঘা অথবা তদূর্ধ্ব জমির মালিকও খাজনা দেয় সেই একই হারে। এর ফলে জমি যার যত বেশী খাজনার চাপ তার ওপর ততই কম। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এর তাৎপর্য হলো এই যে, খাজনার এই সমহারের ফলে সরকারের হাতে কৃষি উদ্বৃত্ত উপযুক্তভাবে জমা হয় না, তার অধিকাংশই জোতদার শ্রেণীর লোকেরা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে আত্মসাৎ করে এবং তা দেশের কৃষি ও শিল্পের বিকাশ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন কাজেই লাগে না।

এখানে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ভূমি খাজনা আদায়ের জন্যে সরকারী ব্যয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় সরকারকে জমিদারের দেয় মোট রাজস্বের নয়-দশমাংশ নির্ধারিত হলেও পরবর্তী পর্যায়ে ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের আয় মোট আদায়কৃত রাজস্বের এক অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে পরিণত হয়। অর্থাৎ ভূমি রাজস্ব আদায়ের খরচা দাঁড়ায় এই খাতে সরকারী আয়ের থেকে অনেক বেশী। বর্তমানে আমরা মোট ভূমি খাজনা এবং এই খাজনা আদায়ের জন্যে সরকারী ব্যয়ের একটা হিসেব যদি নিই তা হলে দেখবো যে, গুণগতভাবে কোম্পানী আমলের ব্যবস্থাই এখনো প্রচলিত আছে এবং আদায়কৃত মোট রাজস্বের একটা বিরাট অংশ সরকারী কর্মচারীদের বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হচ্ছে।

ভূমি খাজনা ও কৃষি আয়কর এবং তা আদায় করার ব্যয়১১

 

 

 

ভূমি খাজনা

আর্থিক বছর মোট আদায় আদায়ের খরচ মোট আদায়ের কোটি টাকায় শতাংশ হিসেবে আদায়ের খরচ
১৯৬২-৬৩ ৭.৬৬ ৩.৫৩ ৪৬.০
১৯৬৩-৬৪ ১২.৭৬ ৩.৯০ ৩০.৫
১৯৬৪-৬৫ ১২.১৫ ৯.৬৬* ৭৯.৫
১৯৬৫-৬৬ ১৩.৪৪ ৯.১৭* ৬৮.২
১৯৬৬-৬৭ ১৪.৬০ ৯.৫৮* ৬৫.২
১৯৬৭-৬৮ ১৬.০০ ৮.৫৪ ৫৩.৪
 

 

কৃষি আয়কর

১৯৬২-৬৩ ০.৬৭ ০.০৬ ৬.১
১৯৬৩-৬৪ ১.৭৭ ০.০৭ ৩.৯
১৯৬৪-৬৫ ১.৪৬ ০.০৮ ৫.৫
১৯৬৫-৬৬ ১.০৮ ০.০৮ ৫.১
১৯৬৬-৬৭ ১.৮১ ০.০৮ ৫.৬
১৯৬৭-৬৮ ১.৫৯ ০.০৯ ৫.৬

* জমিদারীর ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য খরচা

ওপরের এই টেবিলটিতে ১৯৬৪-৬৭ পর্যন্ত আদায়ের খরচার মধ্যে জমিদারীর ক্ষতি পূরণের টাকাও ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে এই তিন বৎসরের খরচা বাদ দিয়ে ১৯৬২-৬৩, ১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৭-৬৮ সালের খরচার কথা যদি বিবেচনা করি তাহলে আমরা দেখবো যে, ঐ কয় বৎসরে যথাক্রমে মোট ভূমি খাজনার ৪৬.০%, ৩০.৫% এবং ৫৩.৪% ভাগ খাজনা আদায়ের জন্যেই খরচা হয়েছে। ভূমি খাজনা আদায়ের খরচা যেখানে এতো বেশী কৃষি আয়কর আদায়ের খরচা সেখানে মোট রাজস্বের পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমলে জমিদার এবং অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগীরা যেভাবে ভূমি খাজনার এক বিরাট অংশ আত্মসাৎ করতো সেইভাবে এখন সরকারী কর্মচারীরা বেতনরূপে সেই খাজনার এক বিরাট অংশ ভোগ করছে। অর্থাৎ পূর্বেও ভূমি খাজনার মাধ্যমে প্রাপ্ত কৃষি উদ্বৃত্ত যেমন কৃষি উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত না হয়ে জমিদারদের পকেটে যেতো এখনো তাই হচ্ছে।

আমাদের দেশে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো যদি সরকার ভূমি খাজনা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে কৃষি আয়ের ভিত্তিতে কর ধার্য করতো এবং সাধারণ আয়করের মতো নীচের দিকে আয়ের একটা ধাপ বাদ দিয়ে করের হার ওপরের দিকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে যেতো। জোতদার এবং অন্যান্য ভূমি মালিকেরাও এর ফলে আয় বৃদ্ধির জন্যে জমি বর্গা দেওয়া বাদ দিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কৃষির প্রসার ঘটাতো। সেক্ষেত্রে কৃষি উন্নয়নে অর্থ নিয়োগ, সমবায় কৃষির প্রচলন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির প্রসার ইত্যাদির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষি খাতে সরকারী আয়ও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেতো। পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে কৃষি উদ্বৃত্ত আদায়ের এই হলো সাধারণ নীতি।

ভূমি খাজনার পরিপূর্ণ উচ্ছেদের কথা না বললেও মোটামুটি এই নীতি অনুসারেই ১৯৭০ সালের মে মাসে বাঙালী অর্থনীতিবিদেরা* পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের কাছে নিম্নলিখিত সুপারিশ করেন :

‘দুই একর পর্যন্ত খামারের ভূমি খাজনা রহিত করা উচিত। একে সংযুক্ত করা উচিত জমি একত্রীকরণ প্রচেষ্টার সাথে। সমবায়ের মাধ্যমে জমি একত্রীকরণের ওপরই ভূমি খাজনা মাফকে নির্ভরশীল রাখতে হবে। সম্বৎসরব্যাপী সেচ ব্যবস্থাধীন এলাকায় ৩ একর, সম্বৎসরবাদী নয় এমন সেচ ব্যবস্থাধীন এলাকায় ৫ একর এবং বরণী জমি ৯ একর পর্যন্ত ভূমি খাজনা মাফ করা উচিত।

এই মাফ সীমার উর্ধ্ব পরিমাণ ভূমির মালিকদের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ভূমি খাজনা অথবা কোন প্রকার কৃষি আয়কর প্রবর্তন করা উচিত।’১২

চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭০-৭৫) ক্ষেত্রে বাঙালী অর্থনীতিবিদদের এই সুপারিশ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অগ্রাহ্য হয়। পূর্ব বাঙলায় সামন্ত ব্যবস্থার অবশেষসমূহ ও পশ্চাদপদ অর্থনীতিকে যথাসাধ্য জিইয়ে রাখাই যেখানে ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া-সামন্ত সামরিক চক্রের অন্যতম প্রধান প্রয়োজন সেখানে কোন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমি সংস্কার যে তাদের নীতি ও কর্মসূচী বহির্ভূত হবে সে কথা বলাই বাহুল্য।

৭. বর্গাপ্রথা

বৃটিশ আমলের পূর্বে ভারতবর্ষে বর্গাপ্রথার কোন প্রচলন ছিলো না। কারণ বর্গাপ্রথা দুটি শর্তের উপর নির্ভরশীল। প্রথমতঃ জমির পরিপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানা এবং দ্বিতীয়তঃ ভূমিহীন কৃষকের অস্তিত্ব। প্রাক-ব্রিটিশ আমলের গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে এই উভয় শর্তই সাধারণভাবে অবর্তমান ছিলো।*

০০০০

* চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার অর্থনীতিবিদদের একটি পৃথক প্যানেল তৈরী করেন। প্যানেলের কাজ অগ্রসর হওয়ার সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের মধ্যে পার্থক্য এত মৌলিক হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে তাঁরা একটি সর্বসম্মত সুপারিশ পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পেশ করতে ব্যর্থ হন। কাজেই দুই অঞ্চলের অর্থনীতিবিদেরা দুটি পৃথক সুপারিশ তৈরী এবং পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যে সমস্ত বাঙালী সদস্যরা এই প্যানেলে ছিলেন তাঁরা হলেন : মাজহারুল হক, মুহম্মদ আখলাকুর রহমান, নূরুল ইসলাম, এ, কে, এম গোলাম রব্বানী, রহমান সোবহান এবং আনিসুর রহমান।১৩

০০০০

বর্তমান অর্থে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতির বিষয় আমরা ইতিপূর্বে অন্যত্র আলোচনা করেছি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং অন্যান্য ভূমি ব্যবস্থার মাধ্যমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সারা ভারতবর্ষে জমির ওপর পরিপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠা করে জমিকে পরিণত করে পণ্যে, শুরু হয় জমি হস্তান্তর। ঋণের দায়ে এই জমি হস্তান্তরই বৃটিশ আমলে ভূমিহীন কৃষক ও গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব ও সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ।**

পুঁজিবাদী বিকাশের ইতিহাসে গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের সর্বহারা শ্রেণীর গুরুত্ব সম্পর্কে মার্কস বলেছেন :

‘যে সমস্ত বিপ্লব পুঁজিবাদী শ্রেণীকে ঠেলা দিয়ে এগিয়ে নিতে পারে সেগুলিই হলো প্রাচীন সঞ্চয়ের ইতিহাসে যুগান্তকারী। কিন্তু সর্বোপরি সেই মুহূর্তগুলি, যখন বিশাল জনসমষ্টি আকস্মিক ও জবরদস্তিমূলভাবে তাদের জীবন ধারণের সংস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন ও ‘বন্ধনমুক্ত’ সর্বহারা হিসেবে শ্রমিক বাজারে নিক্ষিপ্ত হয়। এই সমগ্র প্রক্রিয়ার ভিত্তি হলো কৃষি উৎপাদক, কৃষককে জমি থেকে উচ্ছেদ। বিভিন্ন দেশে এই উচ্ছেদের ইতিহাস ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে এবং কালক্রমে নানা রদবদল ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়।’১

বৃটিশ আমলে ভারতবর্ষে এবং বিশেষতঃ বাংলাদেশে, ভূমিহীন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের উদ্ভব ও সংখ্যাবৃদ্ধি যে প্রক্রিয়া অনুসারে ঘটেছিলো তাতে শিল্প শ্রমিক হিসেবে তাদের নিযুক্তির বিশেষ কোন সুযোগ এদেশে হয়নি।***  এর ফলে এই ভূমিহীন শ্রমিকেরা আমাদের দেশে শিল্পোন্নয়নকে তেমনভাবে ‘ঠেলা দিয়ে এগিয়ে নিতে’ পারেনি। কাজেই ঐ পর্যায়ে তার বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রাম্য সমাজের কাঠামো কিছুটা পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

বাংলাদেশে জমি হস্তান্তর মোটামুটিভাবে শুরু হয় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি। তারপর থেকে এই হস্তান্তর দ্রুতহারে বৃদ্ধি লাভ করে। ১৯৩১ সালের সেন্সাস উত্তরকালে এর একটা চিত্র ক্লাইভ কমিশনের কাছে প্রদত্ত কৃষক সভার স্মারকলিপিতে পাওয়া যায় :

‘সেন্সাসে (অর্থাৎ ১৯৩১ সালের সেন্সারে—লেখক) অনুসৃত কৃত্রিম সংজ্ঞাটি (অর্থাৎ কৃষকদেরকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করার সংজ্ঞা—লেখক) খুবই দুঃখজনক, কারণ কৃষকরা কি পরিমাণে জমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে এর ফলে সেটা ঠিক বোঝা যায় না।

০০০০

* ‘আপাতদৃষ্টিতে বৃটিশ প্রভাবের ফলে গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রধান পরিবর্তন হলো, গ্রামীণ সর্বহারার আয়তন বৃদ্ধি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই স্তরের অন্তর্ভূক্ত হলো প্রধানতঃ কৃষি শ্রমিক, হয় ভূমিহীন অথবা এমন এক ক্ষুদ্র ভূমিখন্ডের মালিক যা তাকে ভূস্বামীর কাছে বেঁধে রাখার পক্ষে যথেষ্ট।’

—Barrington Moore Jr. : Social origins of Dictatorship and Democracy, 1969, P. 368.

** দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

*** রেজিষ্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে দখলী জমি হস্তান্তরের সংখ্যা ১৮৮৪ সালের ৪৩,০০০ থেকে ১৯১৩ সালে উঠে দাঁড়ায় ১৫ লক্ষে (এবং তারপর থেকে নিঃসন্দেহে উত্তরোত্তরভাবে আরো বেড়ে চলেছে)। এর অর্থ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক শ্রেণীর চাষীরা বিক্রিত হয়ে জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে এবং ভূমিহীন সর্বহারার দলকেই নিশ্চিতভাবে স্ফীত করেছে। এই শ্রমিকেরা অবশ্য কলকারখানা এবং বাংলাদেশের বাগানগুলিতে যায় না, যেগুলি প্রধানতঃ উত্তর প্রদেশীয় শ্রমিকদের দ্বারাই ভর্তি থাকে। তারা হয় অধঃস্তনরায়ত অথবা ভাড়াটে কৃষি মজুর ও ভাগচাষী হিসেবে কাজ করে। প্রথম শ্রেণীভূক্তরা মহাজনদের হাতে চলে যাওয়া তাদের নিজেদের জমির ওপরই উচ্চহারে খাজনা দিয়ে চাষ আবাদ করে এবং এই কারণেই ক্রমবর্ধমানভাবে দেখা দেয় অনুপযুক্ত আবাদ ও দারিদ্র্য।’

—-Radha Kamal Mukharjee : Land problems in India P.157. Quoted in Kisan sava’s Memorandum on the permanent Settlement. P. 44.

যে বর্গাদার জমির ওপর কোন অধিকার ব্যতীত কেবলমাত্র মৌখিক ও বাৎসরিক ইজারার ভিত্তিতে জমিতে চাষ আবাদ করে তাকে জমি থেকে বিতাড়িত বলেই ধরে নিতে হবে। বাংলাদেশে কি অনুপাত জমি এখন বর্গাদারদের মাধ্যমে চাষ আবাদ করা হয় সেটা বলা অসম্ভব। কিন্তু গ্রাম বাঙলা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান আছে এ রকম যে কোন লোকের কাছে এ কথা স্পষ্ট যে, এই ধরনের তথাকথিত ‘জমি বন্দোবস্তের’ সংখ্যা অদ্ভূত দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমানে, অন্ততঃপক্ষে কোন কোন জায়গায়, এক-তৃতীয়াংশ জমি পর্যন্ত এইভাবেই আবাদ হচ্ছে।’২

বর্গা প্রথায় দুই শ্রেণীর কৃষকেরা জমি চাষ আবাদ করে। প্রথমতঃ যারা সম্পূর্ণ ভূমিহীন, দ্বিতীয়তঃ যারা অল্প জমির মালিক অর্থাৎ গরীব কৃষক। এই গরীব কৃষকদের যে সামান্য জমিজমা থাকে তাতে তাদের সারা বৎসরের খোরাকি হয় না। কাজেই বাধ্য হয়ে তাদেরকে অন্যের জমি বর্গা নিতে হয়। এইভাবে ভূমিহীন ও গরীব এই দুই শ্রেণীর কৃষকরাই ভূস্বামী অথবা জোতদারের জমিতে অল্পবিস্তর বাঁধা পড়ে। ঋণের দায়ে পরবর্তী পর্যায়ে গরীব কৃষকরা আবার উত্তরোত্তরভাবে পরিণত হয় ভূমিহীন কৃষকে।

১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ১৯৫০ সালের জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আইন এবং আইয়ুব খানের তথাকথিত ভূমি সংস্কার এই প্রক্রিয়াকে বন্ধ অথবা তার গতিকে হ্রাস করেনি। এর ফলে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়ে ১৯৬৩-৬৪ সালে পূর্ব বাঙলার ৩৭% ভাগ কৃষক পরিবার এবং ৪৫% ভাগ আবাদী জমি বর্গাচাষের আওতাভূক্ত হয়।৩

ভূস্বামীকে ফসলে খাজনা দেওয়ার প্রথা যে ভারতবর্ষে নোতুন ব্যাপার নয় তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি।*  প্রাক-বৃটিশ আমলে ফসলের মাধ্যমেই রাষ্ট্র সাধারণতঃ কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করতো। রাষ্ট্রের প্রাপ্য এই খাজনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে টাকায় দেওয়ার প্রথা প্রচলিত হয়। এর ফলে সাময়িকভাবে ফসলে খাজনা প্রথা উঠে গেলেও ঊনিশ শতকের মাঝমাঝি থেকে নোতুন রূপ পরিগ্রহ করে তা আবার বাংলাদেশে নোতুন পর্যায়ে ধীরে ধীরে প্রবর্তিত হয়। নোতুন পর্যায়ের এই ফসলে খাজনা প্রথারই অপর নাম বর্গাপ্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী যারা জমির খোদ মালিক নয় অথচ খোদ কৃষক হিসেবে সেই জমির আবাদকারী তারা ভূস্বামীদেরকে উৎপন্ন ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশ দেওয়ার শর্তে তাদের থেকে অস্থায়ীভাবে জমি ‘বন্দোব্স্ত’ নেয়। এই বন্দোবস্ত মৌখিক এবং ভূস্বামীর ইচ্ছার ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল।

শ্রম খাজনা বা বেগার খাজনার মতো ফসলে খাজনাও কৃষকের উদ্বৃত্ত মূল্য বা শ্রমশক্তি শোষণেরই একটা পদ্ধতি এবং সেদিক দিয়ে এই দুই শোষণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এ সম্পর্কে মার্কস বলেছেন,‘শ্রম খাজনার ফসলে খাজনায় রূপান্তর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভূমি খাজনার চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটায় না।’৪  কারণ প্রথমতঃ এই খাজনা প্রথা যে সমাজে প্রচলিত থাকে সে সমাজে উৎপাদন ও ভোগের বিবিধ উপাদান ও সামগ্রী কৃষকদের নিজেদের দ্বারাই মোটামুটিভাবে উৎপাদিত হয় এবং কৃষি ও গ্রামীণ গার্হস্থ্য শিল্প মোটামুটি অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিরাজ করে।৫  দ্বিতীয়তঃ খাজনার মালিক রাষ্ট্র (যেমন প্রাক-বৃটিশ আমলে) যেই হোক, ফসলে খাজনা প্রথা যে সমাজে প্রচলিত সেখানে এই খাজনার পূর্ববর্তী রূপের অর্থাৎ শ্রম খাজনার অল্প বেশী অস্তিত্ব থাকবেই।৬  পূর্ববর্তী শ্রম খাজনা বা বেগারদানকারীদের মতো একইভাবে কৃষকদের ওপর জোরজবরদস্তি করা সম্ভব না হলেও ফসলে খাজনাদানকারীরা ভূস্বামীর জমির ওপর মোটামুটিভাবে নির্ভরশীল থাকায় ভূস্বামীদের পক্ষে অধীনস্থ কৃষকদের থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেক অতিরিক্ত আদায় সম্ভব হয়। এই অতিরিক্ত আদায়ের মধ্যে পূর্ববর্তী শ্রম খাজনার জের বেগার অন্যতম। তবে এই অবস্থা সত্ত্বেও শ্রম খাজনাদানকারীদের থেকে ফসলে খাজনা দানকারীরা অনেক স্বাধীন। তাছাড়া কৃষকদের উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্য শোষণের দিক দিয়ে কোন মৌলিক পার্থক্য না থাকলেও ফসলে খাজনা যে সমাজে দেওয়া হয় সে সমাজ শ্রম খাজনার  সমাজ থেকে কিছুটা উন্নত পর্যায়ের।৭  বাংলাদেশে কৃষক সমাজের মধ্যে একের পর এক অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সাধারণভাবে বর্গা প্রথার মধ্যেও ভাঙন দেখা দেওয়ায় শ্রম খাজনার অস্তিত্ব সাধারণভাবে নেই বললেই চলে। তবে দেশের কোন কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে অথবা বিশেষ অবস্থায় ব্যতিক্রম হিসেবে এর অস্তিত্ব কোন কোন জায়গায় এখনো রয়ে গেছে।

০০০

* বদরুদ্দীন উমর—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক দ্রষ্টব্য

০০০

ফসলে খাজনা কি ধরনের সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করে সে সম্পর্কে মার্কসের নিম্নলিখিত বক্তব্য খুব উল্লেখযোগ্য :

‘ফসলে খাজনা দানের রীতি এক বিশেষ ধরনের উৎপন্ন দ্রব্য ও উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকায়, তার সাথে কৃষি ও গার্হস্থ্য শিল্প অপরিহার্যভাবে সংযুক্ত থাকায়, নিজের প্রায়-সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীতার মাধ্যমে কৃষক পরিবার বাজারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ভরণপোষণ নির্বাহ করায়, বাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের আন্দোলন ও সেই সমাজের ইতিহাস তার পরিধির বাইরে অবস্থিত থাকায়, অল্প কথায় প্রাকৃতিক অর্থনীতির চরিত্রের কারণে, এই রীতি স্থিতিশীল সামাজিক অবস্থা, যে রকমটি আমরা এশিয়াতে দেখি, তার ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে খুব উপযোগী।’৮

মাঞ্চু রাজবংশের আমলে চীনে ফসলে খাজনা অর্থাৎ বর্গাপ্রথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। প্রায় সমগ্র চীনই ছিলো এই প্রথার আওতাভুক্ত। মোগল সম্রাট এবং তাদেরও মতো চীনে মাঞ্চু সম্রাটরাও খাজনা আদায় করতেন ফসলে। বস্তুতপক্ষে এই খাজনার শস্য আদায় ও বহন করার ব্যাপারে মাঞ্চু আমলে বিস্তৃত শাসনযান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিলো। বিরাট বিরাট সরকারী জাহাজ গ্রান্ড কানালের ওপর দিয়ে এই উদ্বৃত্ত শস্য বহন করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করতো। অধিকাংশ এলাকাতেই অর্ধেক ভাগ ভূস্বামীকে দেওয়ার প্রথা প্রচলিত থাকলেও যেখানে জনসংখ্যার চাপ ও জমির চাহিদা বেশী থাকতো সেখানে ভূস্বামীরা বর্গাদারদের থেকে সুবিধা মতো বেশী আদায় করতো। এছাড়া বেগার ইত্যাদি অন্যান্য আদায়ও তার সাথে যুক্ত হতো। এই ব্যবস্থাই ছিলো মাঞ্চু স্বেচ্ছারিতার ভিত্তিপ্রস্তর।

এই ভিত্তি ১৯১১ সালে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর কুওমিনটাঙ আমলে বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি। ১৯২৫ সালের পর চীনের প্রায় সমস্ত জমিই ব্যক্তি মালিকানার অধীনস্থ হয় এবং তার প্রায় এক চতুর্থাংশে বর্গা প্রথার আওতায় পড়ে। এর মধ্যে উত্তরের গম উৎপাদনকারী এলাকায় ৮৫% ভাগ-এর ওপর এবং দক্ষিণের ধান উৎপাদনকারী এলাকায় ৪০% ভাগ জমিতে বর্গা চাষ হয়।৯  এই সময় শহরে ব্যবসাদারদের একাংশ জমিতে  স্বত্ব খরিদ করে বর্গা দিতে শুরু করে। গ্রামীণ ভূস্বামী এবং এই ধরনের ব্যবসায়ী ভূস্বামীরাই ছিলো চিয়াঙের নেতৃত্বে কুওমিনটাঙ সরকারের সামাজিক ভিত্তি। এজন্যে কুওমিনটাঙ আমলে ৩৭.৫% ভাগ শস্য ভূস্বামীদের প্রাপ্য এই মর্মে আইন প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও চিয়াঙ কাইশেক অতিরিক্ত আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতো না এবং বর্গা প্রথাকে প্রশ্রয় দিয়ে সর্বতোভাবে জিইয়ে রাখতো।১০

এশিয়াতে তো বটেই, এমন কি ইউরোপেও যে সমস্ত এলাকায় বর্গাপ্রথা প্রচলিত ছিলো সেখানে তা আপেক্ষিকভাবে সামাজিক অচলাবস্থারই সৃষ্টি করেছিলো। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উভয় দেশেই আঠারো শতকে শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি এবং প্রসার সত্ত্বেও এই কারণেই ইংল্যান্ডের থেকে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলের অবস্থা ছিলো তুলনায় অনেক স্থিতিশীল। সেখানে ৫০% থেকে ৭৫% ভাগ জমি বর্গা প্রথার অধীনস্থ ছিলো এবং ফরাসী ভূস্বামীদেরকে এই পদ্ধতিতে কৃষকদের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি শোষণ করতে রাষ্ট্রই সাহায্য করতো।১১  এই সাহায্যের ভিত্তিতেই বিপ্লবের পূর্বে সেখানে ভূস্বামী ও রাজতন্ত্রের মধ্যে রাজনৈতিক আঁতাত স্থাপিত হয়েছিলো।

রাশিয়াতে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বর্গাপ্রথার প্রচলন থাকলেও তার প্রভাব সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতির ‍ওপর তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। পরিসংখ্যানের একটি হিসেব মতো সে সময় রাশিয়ায় যে পরিমাণ জমি কৃষকরা ভূস্বামীদের থেকে নিতো তার মধ্যে ৭৬% ভাগের খাজনা দেওয়া হতো টাকায়, ৩% থেকে ৭% ভাগ দেওয়া হতো বেগার খেটে, ১৩% থেকে ১৭% ভাগ দেওয়া হতো ফসলে এবং ২% থেকে ৩% ভাগ দেওয়া হতো পাঁচমিশেলীভাবে।১২  যারা জমি বর্গা  নিতো তারা সাধারণতঃ উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভূস্বামীকে খাজনাস্বরূপ দান করতো।১৩

বর্গাদার এবং বেগার শ্রমিক এই ধরনের কৃষককেই লেনিন ‘বন্ধনযুক্ত’ কৃষিশ্রমিক হিসেবে ধরে নিয়ে ফসলে খাজনা দান প্রথা সম্পর্কে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন।১৪  প্রথমতঃ এই খাজনা সাধারণ নিয়ম হিসেবে সর্বক্ষেত্রেই টাকায় খাজনা থেকে অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ। দ্বিতীয়তঃ ফসলে খাজনা কৃষকদের দরিদ্রতম অংশের মধ্যেই বিস্তার লাভ করে। প্রয়োজনের নিদারুণ তাড়নায় কৃষকদের বাধ্য হয়ে এবং অন্য উপায়ের অবর্তমানে বর্গাদারে পরিণত হয়। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন কৃষকদের জমি নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সেটা তারা নেয় টাকায় খাজনার পরিবর্তে। তৃতীয়তঃ বর্গাপ্রথার মাধ্যমে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক ও পুঁজিবাদী ‘স্বাধীন’ শ্রমিক হিসেবে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের সরাসরি তুলনা করলে দেখা যায় যে, শেষোক্ত পারিশ্রমিকের পরিমাণ বেশী। রাশিয়াতে বর্গাপ্রথার মাধ্যমে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক ধনবাদী ব্যবস্থায় প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের অর্ধেকের থেকেও কম বলে লেনিন উল্লেখ করেছেন।১৫  এ প্রসঙ্গে একটা সাধারণ নিয়ম বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন :

‘আমি কেবলমাত্র এটাই বলবো যে, বিশুদ্ধ ধনবাদী ব্যবস্থায় প্রাপ্ত মজুরি সকল প্রকার দাসত্বমূলক ব্যবস্থায় এবং অন্যান্য প্রাক-ধনবাদী সম্পর্কের অধীনে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের থেকে যে বেশী সে কথা শুধু কৃষির ক্ষেত্রেই নয়, শিল্পের ক্ষেত্রেও, এবং শুধু রাশিয়াতেই নয়, অন্যান্য দেশেরও প্রমাণিত হয়েছে।’১৬

লেনিনের এই বক্তব্য আমাদের দেশেও পুরোপুরি প্রযোজ্য। ‘জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী অবস্থা’ শীর্ষক আলোচনায় ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, পূর্ব বাঙলায় গরীব কৃষকদের নিজেদের জমিতে কাজ করার থেকে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করাও আপেক্ষিকভাবে লাভজনক। গরীব কৃষকদের ক্ষেত্রে (যারা অন্ততঃ কিছু পরিমাণ জমির পুরো ফসল পায়) যখন এই অবস্থা তখন ভূমিহীন বর্গাদারদের (যাদেরকে মোট উৎপাদনের অন্ততঃ অর্ধেক খাজনা হিসেবে দিতে হয়) অবস্থা যে আরও শোচনীয় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার সাথে পূর্ব বাঙলার বর্তমান অবস্থার একটা দিকের তুলনা করলেই বোঝা যাবে আমাদের অবস্থা আরও কত বেশী শোচনীয়। রাশিয়াতে এইভাবে বেগার শ্রমের (বর্গাদারীও এর অন্তর্ভূক্ত—লেখক) হাত থেকে রক্ষা লাভের জন্য কৃষক খনিতে পালিয়ে যেতেও প্রস্তুত। অবিলম্বে টাকায় পাওনা মজুরি লাভ, অব্যক্তিগত ধরনের কাজ এবং কাজের নিয়মিত সময় দ্বারা শ্রমিক এতদূর ‘আকৃষ্ট’ হয় যে কৃষিকার্যের পরিবর্তে  ভূগর্ভস্থিত খনিকেও সে পছন্দ করে এবং সে জানে বিশুদ্ধ ধনবাদী সম্পর্ক এর থেকে কত বেশী ভালো।১৭  অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের কৃষি শ্রমিক, যারা শ্রম অথবা ফসলে খাজনা দেয়, তারা কৃষিকার্যের পরিবর্তে ধনবাদী মজুরিকেই অধিকতর লাভজনক মনে করে এবং এই ধরনের মজুরির মধ্যে নিকৃষ্টতম খনি মজুরিকেও তারা কৃষি শ্রমিকের কাজ থেকে পছন্দ করে বেশী। রাশিয়াতে ধনবাদী কলকারখানা, খনি ইত্যাদিতে মজুরির সুবিধে থাকায় দলে দলে কৃষি শ্রমিকরা সেই পথ অবলম্বনের উদ্দেশ্যে গ্রামাঞ্চল পরিত্যাগ করে চলে যায়। পালিয়ে যাওয়ার এই পথ অনেকখানি উন্মুক্ত থাকার ফলেই রাশিয়ায় শ্রম খাজনা ও ফসলের খাজনা অর্থাৎ বর্গাপ্রথার বিস্তৃতি ঊনিশ শতকের শেষ দিকে রুদ্ধ হয় এবং পরিশেষে বিশ শতকের শুরুতেই তার প্রায় উচ্ছেদ ঘটে।

পূর্ব বাঙলার অবস্থা কিন্তু এদিক দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমাদের দেশে কৃষিকার্যরত শ্রমিক (৮৫.২৬%—১৯৬১) ও গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যার (৯৪.৮%—১৯৬১) হিসেবের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এখানে শিল্প মজুরির সম্ভাবনা কত স্বল্প এবং সঙ্কুচিত। এ কারণে পূর্ব বাঙলার গরীব কৃষক বিশেষতঃ বর্গাদারেরা বর্তমান উৎপীড়নমূলক অবস্থাতেও জমির খুঁটিতে বাধ্যতামূলকভাবে বাঁধা থাকে।

এই সমস্ত ‘আধা-স্বাধীন’ শ্রমিকদেরকে এই বন্ধনে আবদ্ধ রাখার জন্যে তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ ছাড়াও অন্যরকম চাপ প্রয়োগ এবং তাদের নাগরিক অধিকার হরণ যে অপরিহার্য একথা লেনিন বলেছেন।১৮  আমাদের দেশে তো বটেই, তাছাড়া ওপরে যে দুটি দেশে ব্যাপক বর্গাপ্রথার উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেও আমরা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা লক্ষ্য করেছি তার থেকে লেনিনের বক্তব্যের সত্যতাই প্রমাণিত হয়।

বর্গাপ্রথা যে কোন দেশে আভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের পথেও একটা মস্ত বাঁধা। শুধু ভূমিহীন বর্গাদাররাই নয়, এদিক দিয়ে গরীব কৃষকদের থেকেও ধনবাদী কৃষি ও শিল্প শ্রমিকরা অনেক বেশী সহায়ক। এর কারণ বিশুদ্ধ বর্গাদাররা ভূমিহীন হলেও এবং গরীব কৃষকরা আংশিকভাবে অন্যের জমি বর্গা নিতে বাধ্য হলেও তারা নিজেদের জমিতে উৎপন্ন ফসলই ভোগ করে, তার জন্যে তাদেরকে পুরোপুরি বাজারের দ্বারস্থ হতে হয় না। তাদের মোট প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের সমগ্র অংশ অথবা অধিকাংশই এভাবে লব্ধ। অন্যদিকে ধনবাদী কৃষি ও শিল্প শ্রমিকেরা উৎপাদনের যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য অবলম্বন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রীই তাদেরকে ক্রয় করতে হয়, অর্থাৎ তার জন্যে তারা বাজারের উপর নির্ভরশীল থাকে। এই নির্ভরশীলতার অর্থনৈতিক গুরুত্ব খুব বেশী, কারণ এর মাধ্যমেই ঘটে আভ্যন্তরীণ বাজারের বিস্তৃতি এবং বাণিজ্যিক কৃষি ও শিল্পের সম্প্রসারণ। পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে গরীব ও ভূমিহীন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের তুলনামূলক পারিবারিক বাজেট সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের অবর্তমানে এ সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া সম্ভব না হলেও বর্গাদার পরিবারের সংখ্যা (মোট কৃষক পরিবারের ৩৭% ভাগ—১৯৬৩-৬৪) এবং বর্গাপ্রথার অধীনে আবাদকৃত জমির পরিমাণ (মোট জমির ৪৫%—১৯৬৩-৬৪) থেকেই অবস্থা মোটামুটিভাবে আন্দাজ করা যায়।

১৯৪৬-৪৭ সালে বর্গাপ্রথা সংস্কারের জন্য কৃষক সমিতির নেতৃত্বে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ইত্যাদি বাঙলাদেশের ঊনিশটি জেলায় ব্যাপক কৃষক-আন্দোলন হয়েছিলো। এই আন্দোলনের মূল দাবীগুলি ছিলো নিম্নরূপ : (১) উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ বর্গাদারকে দিতে হবে, (২) জমিতে বর্গাদারের দখলী স্বত্ব স্বীকার করতে হবে, (৩) শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশী অর্থাৎ মণকরা ধানে পাঁচ সেরের বেশী সুদ নেওয়া চলবে না, (৪) হরেক রকম আবওয়াবসহ সমস্ত বাজে আদায় বন্ধ করতে হবে, (৫) ফসলে খাজনা নিয়ে জোতদারকে রসিদ দিতে হবে, (৬) আবাদযোগ্য পতিত জমিকে পতিত রাখা চলবে না এবং (৭) জোরদারের পরিবর্তে বর্গাদারের খামারে ফসল তুলতে হবে।

তেভাগা আন্দোলন মোটামুটিভাবে খুব ব্যাপক এবং স্থান বিশেষে তীব্র হলেও শেষ পর্যন্ত নানা কারণে তা সফল হয়নি। কাজেই ১৯৪৭ সালের পর বর্গাপ্রথার উৎপীড়নমূলক চরিত্র পূর্বের মতোই বজায় ছিলো এবং উত্তরোত্তরভাবে অবস্থার অবনতি ঘটেছিলো। এখানে লক্ষনীয় বিষয় এই যে, বর্গাপ্রথা সংস্কারের জন্যে তেভাগা আন্দোলন সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রথার মৌলিক সংস্কার অথবা উচ্ছেদের জন্যে পূর্ব বাঙলায় কোন ব্যাপক আন্দোলন আর সংগঠিত হয়নি। বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাঙলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বর্গাপ্রথা উচ্ছেদের প্রশ্ন বরবারই ছিলো আপেক্ষিকভাবে গুরুত্বহীন, গৌণ এবং উপেক্ষিত।

এজন্যেই দেখা যায় যে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচীতে বর্গাপ্রথার কোন উল্লেখই ছিলো না এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৫৭ সালের ভূমি সংস্কার সম্মেলনে এ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট সুপারিশ করা হয়নি। সেখানে শুধুমাত্র বলা হয়েছে, বর্গাপ্রথার বিলোপ হওয়াই উচিত। সরকার ইহার সবদিক বিবেচনা করিয়া পশ্চিম বংগের তেভাগা আইনের অনুরূপ একটি আইন প্রণয়ন করিবেন।’২০  কৃষক সমিতিও বর্গাপ্রথা উচ্ছেদের দাবীকে ভিত্তি করে তেমন কোন আন্দোলন গঠন করতে সক্ষম হয়নি।

এই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন দেখা দেয় ১৯৬৮-৬৯ সালের ডিসেম্বর-মার্চ আন্দোলনের সময় এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাঙলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই সর্বপ্রথম কৃষক সমস্যা, বিশেষতঃ জোতদারী-মহাজনী শোষণের প্রশ্ন অনেকখানি গুরুত্ব সহকারে দেখা দেয়। আইয়ুব খানের এক দশকব্যাপী সামরিক শাসন গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সেই সাথে সাধারণ কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলো সেটাই ছিলো কৃষক সমস্যা এবং জোতদারী-মহাজনী শোষণ সম্পর্কিত সমস্যার এই গুরুত্বপূর্ণ আত্মপ্রকাশের মূল কারণ। সামরিক শাসেনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অবস্থার যে আরও অবনতি ঘটেছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কতকগুলি রিপোর্টের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই বাস্তব অবস্থার বর্ণনা এ প্রসঙ্গে নীচে উদ্ধৃত করা গেলো। এই রিপোর্টগুলি থেকে দেখা যাবে পূর্ব বাঙলায় বর্গাপ্রথা মহাজনী কারবারের সাথে কতখানি অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্রে গ্রথিত।*

(ক) খুলনা জেলা। ‘শোষক গোষ্ঠীর এজেন্সীগুলোর এই দেশ-জোড়া চক্রান্তের মধ্যে যদি একবার গ্রামবাংলার কোটি কোটি কৃষকের দিকে তাকা যায় তবে যে ছবিটা সকলেরই চোখে পড়বে—খুলনা জেলার অবস্থা তারই একটি খন্ড চিত্র মাত্র।

বিপুল আশা নিয়ে একদিন এই জেলার দুরন্ত মানুষ জীবন তুচ্ছ করে প্রকৃতি ও বুনো হিংস্র জানোয়ারের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে লড়াই করেছিলো। হাজার হাজার বিঘা জমি থেকে জঙ্গল সাফ করে আবাদ করতে অসংখ্য সাহসী মানব সন্তানকে সেদিন জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিলো। আজ গুটিকয়েক জোতদার-মহাজনের হস্তগত এইসব জমিতে যে কি বিপুল পরিমাণে ও কত বিচিত্র ধরনের ধান ফলতো সে কাহিনী কিংবদন্তীর মতো! এই সেদিন পর্যন্ত নিষ্ঠুর জমিদার-মহাজনী শোষণে জর্জরিত খুলনার কোন মানুষকে আপনি খুলনারই কোন মিল-কারখানায় দেখতে পাননি। শুধু পৌষ মাসে ‘দাওয়া’ কেটেই তাদের ঘরে অনেক ধান এসে যেতো। বহু বিচিত্র ও নির্মম শ্রেণীশোষণ থাকা সত্ত্বেও খুলনার কৃষক-কৃষাণীর মনে এ ব্যাপারে একটা আনন্দ ও শ্লাঘাবোধ ছিলো বৈকি!

‘সেই খুলনায় আজ শুধু ক্ষুধার্তের আর্তনাদ, নিরন্ন মানুষের কংকালের প্রদর্শনী যেন একটা। প্রায় প্রতিটি বাড়ীর ঘরের চাল ভেঙে পড়েছে, দু’একখানি মেটে পাত্র ছাড়া পানাহার করার কোন কিছু আর নেই। একখানি ছেঁড়া কাপড়-গামছা বা ‘দোচ্ছাট্টী’ পরেই অনেক গৃহবধূ লজ্জা নিবারণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তাদের মলিন বেশ, কোটরাগত চক্ষু, হাড় জিরজিরে দেহ, দেখলেই মনে হবে কোন প্রেত রাজ্যের বাসিন্দা এরা। পুরুষগুলি হাস্যকর সব পরিচ্ছদ পরে যখন হাটে-বাজারে আসে এবং আশ্চর্য হলেও যখন সত্যি সত্যি চাল-ডাল না কিনেই প্রায় শূন্য হাতে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ী ফিরে যায়, তখন পেছনে পেছনে গিয়ে যদি তার বাড়ীর অনতিদূরে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন তবে দেখবেন মানব ইতিহাসের কি লজ্জাকর নির্মম অধ্যায়ের অবতারণা। ক্ষুধিত শিশুগুলোর ডুকরে কেঁদে উঠা চীৎকারের সাথে মায়ের প্রলাপ ও বাপের চীৎকার মিলে একটা অদ্ভূত কান্ড হচ্ছে। যেকোন খবরের কাগজের ফটোগ্রাফার যদি ইচ্ছে করেন তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বায়াফ্রার নিরন্ন, নগ্ন, মৃতপ্রায় মানুষের ছবির মতো ছবি যথেষ্ট সংগ্রহ করতে পারেন।

শহরের কারখানাগুলোর সামনে শ্রমিক হতে আসা কৃষকের ভিড় (আকস্মিকভাবেই) গভীর রাতে ক্ষুধায় কাতর সন্তানকে মারপিট করার দৃশ্য, শূন্য গোয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা মৃতপ্রায় কৃষকের অশ্রুসজল চোখ দুটি এমনকি ৩০/৪০ টাকা দেনার দায়ে গলায় দড়ি দেওয়ার ঘটনা আপনার চোখে অহরহই পড়বে। মেহনতী দরিদ্র হিন্দু কৃষকেরা অনেকে দেশ ছেড়েও চলে যাচ্ছে। কাজটা তারা বুদ্ধিমানের মতো না করলেও শুধু মৃত্যুর বিকল্প হিসেবেই তা করছে। দৃশ্যের এই একটি দিক। এর সঙ্গে আরও যোগ করুন একেবারে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে থালা, বাটি, গরু-ছাগল, জমিজমা সবকিছুই—বিক্রি করার মতো হলেই হলো, দুএক পয়সার খদ্দের পেলেই আর বিলম্ব করা হচ্ছে না।

পূর্বে বলেছি মহাজন জোতদাররা গোঁফে তেল লাগিয়ে বসে আছে এবার। শস্যহানি তাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। তাদের এত জমিজমা যে তাদের সব সময় দু’চার গোলা ধান উদ্বৃত্তই থাকে। তাদের জমি থাকে সর্বত্র ছড়ানো। এ বিলে না হলে অন্যত্র হয়, ডাঙ্গায় না হলে নীচু জমিতে জন্মে এবং দু’-এক বছর না হলেও কিছুই আসে যায় না। একটা হিসেব দিচ্ছি :

একজন অতি ছোট জোতদার যার মাত্র ২০০ বিঘে জমি আছে (খুলনায় কিন্তু ১৫/২০ এমনকি ৩০ হাজার বিঘা জমির মালিকও কম নেই) তার এক বছরে ভালও পুরা ফসল হলে প্রায় ২০০০ মণ ধান হতে পারে। যদি সংসারে তার আটজন লোক থাকে তবে সমস্ত বছরে সর্বসাকুল্যে তার ১০০ মণ ধান লাগতে পারে। অর্থাৎ ১ বছরে ধান হলে তার ২০ বছর চলবে। যদি তাকে বর্গাভাগও দিতে হয় তবুও ১০ বছর চলতে পারে। স্বাভাবিকভাবে ২/৪ বছরের শস্যহানিতে তার কিছুই এসে যায় না। বরং অভাব হলে গরীব কৃষকরা তাদের জমি বিক্রি করার প্রয়োজনবোধ করে আর ঐ সকল জোতদার একেবারেই কমদামে জমিগুলো কিনে তাদের জোতদারী-মহাজনীর পরিসর বাড়িয়ে চলে।

০০০

* ‘গণশক্তি’র যে তিনটি রিপোর্ট এখানে দেওয়া হলো সেগুলি খুলনা এলাকার। অন্যান্য এলাকার রিপোর্টও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতো, কিন্তু দুটি মূল কারণে এই তিনটিকে নির্বাচন করা গেলো। প্রথমতঃ অন্যান্য রিপোর্টগুলি থেকে দেখা যায় যে, শোষণের রূপ সর্বত্রই প্রায় এক। দ্বিতীয়তঃ এই তিনটি রিপোর্ট প্রবন্ধের আকারে লেখা এবং এগুলিতে বর্ণিত অবস্থার মাধ্যমে বর্গাপ্রথা ও বর্গা শোষণের একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। এজন্যে দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও রিপোর্টগুলি থেকে অনেকখানি কমে উদ্ধৃত করা গেলো।

০০০

সুতরাং বর্তমান বছরগুলো শুধুমাত্র জোতদার মহাজনদের কাজে লাগবে। তাদের মুখের হাসি অথবা শরীরের মেদ দুটোই বেড়ে চলবে। প্রসঙ্গতঃ মনে পড়ছে খুলনার একজন জোতদার প্রায়ই তার গোত্রীয়দের মধ্যে বলতো ‘বিল উঠুক পড়ুক হেকে’। অর্থাৎ যে বছর বিল পড়বে অর্থাৎ ফসল হবে না সে বছর ওরা মহাজনীতে টাকা লাগাবে আর ফসল হলে সে বছর সুদে আসলে আদায় করবে। গরীব কৃষকদের প্রত্যেক বছরেই ফলটা একই দাড়াবে। আজকে যার ফলশ্রুতি হিসেবে ফসলি জমিগুলো সব প্রায় জোতদারদের হাতে গিয়ে পড়েছে। আজকের মহাজন বা জোতদাররা মধ্যস্বত্ব ভোগ করতে পারে না। একেবারে খোদ জমির মালিক হয়ে তার ‘ফসলের খাজনাই’ ভোগ করে। আর সেলামি, পাঁচানী, বুবনী, ধান কড়ারী, নগদ সুদে দেয় ধার প্রভৃতি বিচিত্র পন্থায় মহাজনী শোষণ চালায়।

আর এই জোতদার মহাজনদের অত্যাচার আমি নিজে দেখেছি। দেখেছি মাঘের দারুণ শীতের মধ্যে রাত্রিতে টাকার জন্য পচা পুকুরের পানিতে মানুষ বেঁধে রাখতে, খালের মধ্যে ঘাতককে প্রকাশ্যে পানির নীচে ডুবিয়ে রাখতে, লাথি মেরে বারান্দা থেকে ফেলে দিতে, গরু-বাছুর ধরে নিতে, অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে বিবাহিতা মেয়ে আটকে রাখতে বাধ্য করে তাদেরকে হুমকি দিয়ে অথবা ২/৫ টাকার বিনিময়ে ভোগ করতে, চোরাকারবারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে, পুলিশের সাহায্যে দরিদ্র লোকগুলোর উপর বর্বরের মতো হামলা করতে, সংঘবদ্ধ লাঠিয়াল বাহিনী ও ডাকাত দল পুষতে। তার বিরুদ্ধে তরুণদের কোন কোন সময়কার প্রতিবাদ একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেছে তাও দেখেছি। এইসব অত্যাচার, দস্যুতা এমনকি ফাঁকি দিয়ে পরস্ত্রীকে তালাক করিয়ে নিয়ে নিজ স্ত্রী অথবা রক্ষিতা করার নমুনা এইসব জোতদার মহাজন ও টাউটদের মধ্যে সবসময়ই চলছে। এরকম অসংখ্য লোকের নাম-ঠিকানা স্বচ্ছন্দেই বলে দেওয়া চলে। এ খবর সকলেই জানে দু’একটা বিশেষ বাড়ীতে পুলিশ সব সময়ই থাকার ও খাওয়ার সুযোগ পায়। কেন যে পুলিশগুলো এই মার্কামারা (শুনেছি থানায় নাকি এই সকল পুলিশ বান্ধবদের এক একটি লিষ্ট থাকে) মানুষগুলোর বাড়ীতে স্থান পায় এবং কোন বিশেষ উৎস্য থেকে পয়সা পেয়ে এই অকাজে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো তাদের ভাত ও অন্যান্য সকল চাহিদা জুগিয়ে থাকে—তা অনেকেরই আজ ভালভাবেই জানা। শুধু কি তাই? আজকাল আবার গ্রামে গ্রামে পাহারা দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা (আই,বি) পুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছে—পাছে এইসব নিরস্ত্র হা-ভাতে মানুষগুলো তাদের যুগসঞ্চিত শ্রেণীঘৃণা নিয়ে তাদের শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে  ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বিগত ২২ বছর ধরে ২/৩ রকম লীগ এবং ৩/৪ রকম ইসলাম দেশে রাজনীতি করছে। অধুনা মেহনতি মানুষের সচেতনতার মুখে ভাত-কাপড়ের সমাধান দেওয়ার জন্যে অনেকে একশ’ দু’শ থেকে চৌদ্দশ বছরের লাশ খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনছে। কত আপ্তবাক্যই না শুনানো হচ্ছে। এবং সকলেই মিলে গ্রামের ঐ জোতদার মহাজন টাউট যারা কখনও বা মৌলিক কখনও বা লীগ আর কখনও ইসলামিক এবং অধুনা বাঙালী সেজে ভোটবক্সে নামছেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদেরই সাথে দোস্তি করছেন। এই জোতদারদের আবার বৈচিত্র আছে—এরা উকিল-কন্ট্রাক্টর, সরকারী কর্মচারী—(বিশেষতঃ যারা কালেক্টরীতে চাকুরীরত) ডাক্তার-মোক্তার-ব্যবসায়ী কাম জোতদার মহাজন অর্থাৎ একটি তার নিজের কর্মস্থল অন্যটি জোতদারী-মহাজনী, তার শোষণের ঘাঁটি।’২১

(খ) সাতক্ষীরা (খুলনা জেলা)।‘সাতক্ষীরা মহকুমার আশাশুনি, দেবহাটা, শ্যামনগর, তালা, কালীগঞ্জ ও সাতক্ষীরা থানার ভূস্বামীগণ অর্থাৎ সামন্তপ্রভু ও মহাজনগণ সংঘবদ্ধভাবে ভূমিহীন কৃষকদের উপর তাদের ভূমি চাষের উপর কতকগুলো কঠিন শর্ত আরোপ করেছে, যার ফলে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ভূমিতে ফসল উৎপাদন করে কৃষকগণ ভূস্বামীগণের শস্যভান্ডার ভর্তি করে খালি হাতে গৃহে ফিরতে বাধ্য হয় এবং পরিবারবর্গ নিয়ে খাদ্যাভাবে রোগ শোক মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনে।

ভূস্বামীগণ নিয়ম করেছে যে, যদি কেউ তাদের জমি ভোগ করতে চায় তাবে উৎপাদিত ফসলের ৪ ভাগের এক ভাগ চাষী পাবে এবং ৩ ভাগ পাবে ভূস্বামীগণ। অথচ কয়েক বছর আগেও তারা অর্ধেক ভাগে জমি চাষ করে জীবন ধারণ করতো।

ঐ রক্তচোষা বাদুড় জোতদার-মহাজনদের দল চাষীদের ৪ ভাগের ১ ভাগ ধান দিয়েও সন্তুষ্ট নয়, তাই তাদের ঐ ১ ভাগেও ভূস্বামীগণ ভাগ বসাবার সুন্দর ফাঁদ পেতেছেন। তারা নতুন নিয়ম করেছেন যে, ভূস্বামীদের গরু নিয়ে ভাগচাষীগণকে চাষ করতে হবে, তারা নিজের গরু দিয়ে চাষ করতে পারবে না। তাই বলে ঐ গরু তারা বিনা স্বার্থে দেয় না, তাদেরকে প্রতি গরুর জন্য ভূস্বামীদেরকে ৪ মণ করে ধান দিতে হবে। এই শোষক শ্রেণী অর্থাৎ জোতদার-মহাজন শ্রেণী তাদের মধ্যে ঐক্যজোট গঠন করে এই নিয়মও করছে যে, এ সকল নিয়ম কানুন যারা মানবে না তাদেরকে জমি ভাগে দেওয়া হবে না।

এতেও তারা খুশী হতে পারেনি। তারা নিয়ম করেছে যেসব ভূমিহীন কৃষক তাদের জমি বর্গা করবে তাদেরকে জোতদার-মহাজনদের বিঘাপ্রতি দশ (১০) টাকা হারে তাদেরকে সেলামি না দিলে কৃষকরা জমি বর্গা পাবে না।

তারা আবার নিয়ম করেছে তাদের জমি যারা চাষ করবে তাদেরকে ভূস্বামীদের কাছ থেকে চাষের সময় বীজ ধান নিতে হবে, কিন্তু ফসলের মৌসুমে অর্থাৎ পৌষ মাসে তাদেরকে জোতদার-মহাজনদের দ্বিগুণ হারে ধান ওজন করে দিতে হবে।

তারা এতো করেও ক্ষান্ত হল না। তারা বর্তমান বৎসরে আর একটা নিয়ম করেছে যে, জোতদার-মহাজনদের নিয়োজিত দাওয়ালিয়া দিয়ে ধান না কাটালে তাদের জমি চাষ করতে দেওয়া হবে না। এর জন্য বিঘাপ্রতি আধ মণেরও বেশী ধান দাওয়ালিয়াদের দিতে হবে।

যে সমস্ত ভূমিহীন কৃষকগণ উপরোল্লিখিত শর্তগুলো না মানবে, ভূস্বামীগণ তাদের জমি ভাগ দেবে না। সুতরাং কৃষকগণ নিজে এবং স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের বাঁচাবার তাগিদে বাধ্য হয়ে ভূস্বামীদের এবং জোতদার-মহাজনদের সকল শর্ত মেনে নিয়ে জমি বর্গা করতে বাধ্য হয়।

এই সকল শর্তের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে জমি ভাগ করে ছিন্নমূল কৃষকেরা উদ্বৃত্ত নিয়ে বাড়ী যায় তা নীচের হিসাব থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

এই অঞ্চলের যে সব জমিতে খুব ভাল ফসল হয়, সে সকল জমিতে বিঘাপ্রতি ১৩ মণ ধান উৎপন্ন হয়। একজন কৃষক যদি কোন সামন্ত প্রভু বা জোতদার মহাজনের হাত-পা ধরে কোনমতো ১০ বিঘা ভাগে করার সুযোগ পায় তা থেকে সে ১৩০ মণ ধান খুব বেশী হলে উৎপাদন করতে পারে। এর মধ্যে হতে ৪ ভাগের ১ ভাগ কৃষকদের প্রাপ্য অর্থাৎ কৃষকের প্রাপ্য ১৩০ ৪ ৩২ মণ। জোতদার-মহাজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া দুটি গরুর জন্য তাদেরকে দিতে হবে ৪ ২ ৮ মণ ধান। তাহলে থাকল ৩-৮ ২৪ মণ। এই ২৪ মণ হতে সেলামি বাবদ ভূস্বামীদের দিতে হবে ৫ মণ ধান। অর্থাৎ থাকল ২৪-৫ ১৯ মণ ধান। এর থেকে বীজ ধান বাবদ মহাজন কেটে নেবে ধরা যাক ২ মণ, থাকল ১৯-২ ১৭ মণ। এবারে জোতদারদের নিয়োজিত দাওয়ালিয়াদের ধান কাটা বাবদ দিতে হবে ৫ মণ ধান অর্থাৎ বাকী ১৭-৫ ১২ মণ ধান। এবারে আর একটি অভিনব ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থাৎ জোতদার-মহাজনের চাষের সময় এবং রোয়ার সময় ক্ষেতমজুরদের খাওয়ানোর ফলে তারা নাকি আরও ৪ মণ ধানের অংশীদার, ফলে দাঁড়াল ১২-৪ ৮ মণ। অর্থাৎ তারা সমস্ত বছর খেটেখুটে জমিতে ফসল উৎপাদন করলো, ফসল হল, সে স্বপ্ন দেখল বাঁচার, জীবনের ক্ষীণ আশাটুকু জ্বলে উঠল তার চোখে, কিন্তু ১০ বিঘা জমি চাষ করে মাত্র আট (৮) মণ ধান মাথায় করে যখন তাকে বাড়ী আসতে হল, তখন কি তার চোখে সে বাঁচার আশা আর থাকবে? অবশ্য এই কাহিনী এখানে শেষ নয়।

চাষীদেরকে ধান কেটে ভূস্বামী বা জোতদার-মহাজনের খলেনে তুলতে হবে, মালা তুলে ঝেড়েঝুড়ে সব ধান তাদের মহাজনদের গোলায় তুলে দিয়ে আসতে হবে। এইসব কাজ শেষ করে তাদের প্রাপ্য ধান বাড়ী আনতে পারবে, অন্যথায় নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় কৃষকেরা তাদের উদ্বৃত্ত ধান বাড়ী নিতে পারে না। কেননা জোতদার-মহাজনের দল পূর্বে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দেওয়া করারী ধান অর্থাৎ দাদন দেওয়া ধানের প্রাপ্য অংশ দাবী করে। এটা আর একটু পরিস্কার করে বুঝানো দরকার। ধরুন আপনি একজন গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে ভাদ্র মাসে অভাবের দিন ২ মণ ধান ধার  করলেন, কিন্তু এই শর্তে আপনি ধান ধার তোলেন যে, পৌষ মাসে আপনাকে উক্ত মহাজনকে ৪ মণ ধান শোধ করতে হবে। এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেসব অত্যাচারিত বীর কৃষকগণ প্রতিবাদ করবেন তাদেরকে এইসব জোতদার-মহাজনের দল চুরি কেসে বা ডাকাতি কেসে ফেলে তাদের পোষ্যপুত্র পুলিশ দ্বারা জব্দ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের স্ত্রী-কন্যার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। তাদেরকে এই সমস্ত জোতদার-মহাজনের দল জোর করে অথবা কয়েকটি টাকার বিনিময়ে তাদের ইজ্জত ক্রয় করতেও পিছপা হয় না। ফলে স্ত্রী হয় ঘরছাড়া, জামাই কন্যাকে ত্যাগ করে অথবা আটকিয়ে রাখে।

সাতক্ষীরায় এমন ১০/১২ জন শোষণকাণী সমাজপ্রভু রয়েছে যাদের জমির পরিমাণ ১০,০০০ (দশ হাজার) বিঘা হতে ৩৩,০০০ (তেত্রিশ হাজার) বিঘা। শোষণের এই অবস্থা সাতক্ষীরা মহকুমার দক্ষিণাঞ্চলে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই অঞ্চলের ভূস্বামীগণ কৃষকদের রক্ত আকন্ঠ পান করার জন্যই নিজেদের খেয়ালখুশীমতো নিয়ম-কানুন তৈরী করে সামন্ত শোষণের বুনিয়াদ দৃঢ় করেছে। একটা হিসাবে দেখা দেখা গেছে যে, ১৯৬৪ সালে যে সমস্ত অকৃষক মাত্র কয়েক বিঘা জমির মালিক ছিলো তারা বর্তমানে ১,০০০ হতে ৩৩,০০০ বিঘা জমির মালিক হয়ে বসেছে, এবং তারা এম,এল, এ এবং এম, পি, এ হবার সৌভাগ্যবান হয়েছে। অন্যদিকে তখন যে সমস্ত ন্যূনতম ৫০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন এবং যারা প্রকৃত কৃষক ছিলেন তারা ঐ মুষ্টিমেয় অকৃষক ভূস্বামীদের অত্যাচারে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়েছেন। তাদের ঐ সমস্ত প্রকৃত কৃষকদের জমি কুক্ষিগত করার একটা চমকপ্রদ অথচ মর্মান্তিক কাহিনী আছে।

ঐ সকল ভূস্বামীগণ স্বল্প ভূমির কৃষকদের জমি নিজেদের করায়ত্ত করার জন্য বছরের পর বছর এই বিলগুলো নোনা পানিতে ভরে রাখত, বাঁধ দিলে তা রাতের অন্ধকারে কেটে দেবার ব্যবস্থা করত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এইখানে যে, ঐ সমস্ত বিল-খালের বাঁধ বন্দীর দায়িত্ব রাখতেন তারা নিজ হাতে। এইভাবে বছরের পর বছর বিল কৃত্রিম অজন্মা তৈরী করে, ঐ সমস্ত বিলের জমির মালিকদের তীব্র দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়ে ২০ হতে ৫০ টাকা বিঘা হারে ঐ সব জমি ঐসমস্ত অকৃষক রক্তপায়ী শোষক জোতদার-মহাজনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করেছে।

এই অঞ্চলের কৃষকদের অবস্থার দিকে আজকে তাকালে দেখা যাবে যে, তারা অভাবের তাড়নায় গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকবার মিথ্যা চেষ্টা করছে। তাদের পরনের ছিন্ন কাপড় দিয়ে নিজের এবং স্ত্রী-কন্যার লজ্ঝা নিবারণের মিথ্যা প্রয়াস পাচ্ছে। তারা আজকে শহরের দিকে মিছিল করে আসছে অথবা ভারতের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে।’

(গ) পাইকগাছা থানা (খুলনা জেলা)। ‘উত্তর পাইকগাছা বলতে মূলতঃ কপিলমুনি, হরিঢালী, গদাইপুর, লতাসহ কয়েকটি ইউনিয়ন বোঝায়। আর এই সকল ইউনিয়নের ভিতর লতা হল নীচু এলাকা। এখানকার লোকের ডাঙ্গায় কোন জমিজমা নেই। তাই এরা ‘আবাদে লোক’ বলে পরিচিত। এদের একমাত্র ফসল হল ধান। আর বাকী ইউনিয়নগুলির লোকের ধান ছাড়া অন্য ফসলও আছে, যেমন পাট, রবিশস্য ইত্যাদি। আর এই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে আছে কয়েকটি বড় বড় বিল বা ‘চক’ (চক বলতে বড় বিল বোঝায়)। এই ধরনের চকের ভিতর একটা বড় চক হল কামারের আবাদ। এই আবাদের উপর ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি আবাদের উপর নির্ভরশীল লোকদের অবস্থা বর্ণনা করলে এই এলাকার তথা সমগ্র দক্ষিণ এলাকার লোকের অবস্থা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হবে না (এখানে দক্ষিণ এলাকা বলতে খুলনা জেলার দক্ষিণ অঞ্চল বোঝানো হয়েছে)। ১৫/১৬ বৎসর আগে এই এলাকা ছিলো এক প্রকার অনাবাদী। পানি সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় পর পর ৭/৮ বছর প্রায় অনাবাদী ছিলো এই এলাকা। এহেন অবস্থার ফলে গরীব কৃষক এমন কি মধ্যব্ত্তি কৃষকও অভাবের তাড়নায় দলে দলে এসে যশোর জেলায় বাসা বাঁধে প্রায় সর্বহারা অবস্থায়। এই অবস্থার সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে এই এলাকার মহাজনেরা, ধনী কৃষকেরা, জোতদারেরা, যাদের মূলতঃ অন্যপথ ছিলো। অভাবের তাড়নায় পড়ে দলে দলে লোক শরণাপন্ন হয় গৃহস্থের দুয়ারে, দাবী দু’মুঠো অন্নের। আর এরই বিনিময়ে এরা সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছে, এমন কি নিজের ষোড়শী কন্য ও স্ত্রীকেও। মহাজনেরা সেজেছিলো কুমীর, পেট তাদের ভরার দরকার, তাই গোগ্রাসে গিলেছিলো প্রায় সবই। ৫/১০ টাকায় জমি লিখে নিয়েছে প্রতিবিঘা। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শুধু খেয়েই জমি লিখে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। ১০/১৫ টাকায় প্রতিবিঘা জমি ও স্ত্রীকে মহাজনের কাছে লিখে দেওয়ার নজির এই এলাকা বহন করে।——-

এইবার গ্রামের অভ্যন্তরের দৃশ্যে কিছু আলোকপাত করা যাক। গ্রামের ২/৪ জন ছাড়া প্রায় সবাই দিনমজুর। কিছু লোকের অবশ্য জমিজমা অল্পস্বল্প আছে। এই নিঃস্ব লোকেরা উক্ত ধনীদের জমি ভাগে নেয়। ভাগে নিতে হলে অবশ্য সেলামি হিসেবে কিছু অগ্রিম দেওয়া লাগে, নইলে চলে না। তাছাড়া যদি গৃহস্থের গরু তারা নেয় তবে গরুর বাবদ কিছু ধান দিতে হয়। তাছাড়া এই এলাকার ভাগাভাগি হয় আবার ১১ আনা ৫ আনা হিসেবে। অর্থাৎ ১১ আনা গৃহস্থ ও ৫ আনা চাষীয় বা ভাগরাওয়ালা। আরও একটা উত্তম ব্যবস্থা এখানে আছে ধান কাটার আছে। ধান কাটার আগে গৃহস্থের কাছে আসে ‘দাওয়াল’রা বা যারা ধান কাটবে (ধান কাটা লোককে বলা হয় দাওয়াল)। দাওয়াল ভাগ পায় শতকরা ৮ থেকে ১০ আটি ধান, তা আবার খামারে তুলে মাড়াই করে দেওয়ার পর। এই সামান্য ভাগ পাওয়ার জন্য আবার ধান কাটার আগে বা পরে নিজেরে খেয়ে গৃহস্থকে ৫/৭টি বেগার দিতে হয়। এই সুযোগে ধানওয়ালারা যাদের ডাঙ্গায় জমি আছে তারা তাতে বিনা খরচে রবিশস্য লাগিয়ে নেয়। আর এই বেগার ও শতকরা কত ধান তারা পাবে তা ঠিক করে নেয় ধনী কৃষকরা সবাই মিলে।*

এছাড়া আষাঢ় মাসে অভাবের সময় গ্রামের মহাজনেরা টাকা ধার দেয়। সরকারী টাকা সময় মতো পাওয়া যায় না। আর গেলেও অনেক অসুবিধা আছে তাই, এরা ধর্ণা দেয় ধনীর দুয়ারে। ধনীরা টাকা দেয় শতকরা ৪ মণ ধান হিসাবে। উক্ত ধান ফসল ওঠার সময়ে দিতে হয়। ধরা যাক ৪ মণ ধানের দাম ১০০.০০ টাকা, তাহলে আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত ৫ মাসে ১০০.০০ টাকার সুদ ১০০.০০ টাকা তারা না দিতে পারলে তা চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ হবে। পরে শোধ দিতে না পারলে জমি লিখে দিতে হবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষীরা জমি লিখে দেয়, অবশ্য প্রকৃত মূল্যেও নয়। এহেন অবস্থার ভিতর দিয়ে চাষীরা ফসলের মৌসুমে প্রায় সবকিছু গৃহস্থের গোলায় তুলে দিয়ে খালি হাতে ফিরে যায়। আবার আসে ধারের পালা, জমি লিখে দেওয়ার পালা ইত্যাদি। এছাড়া সর্বহারাদের বউরাও পেটের দায়ে বিনা মাহিনায় গৃহস্থের বাড়ী কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে ইজ্জতও বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

ইদানিং আর একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে ধান কাটার সময়। বহুদিন অনাবাদী থাকায় যারা চলে গিয়েছিলো তারা আবার দেশে ফিরতে শুরু করেছে। এখন তাদের জমি অন্য হাতে চলে গিয়েছে। তাই এরা এসে ধর্ণা দেয় ধনীদের দুয়ারে, উদ্দেশ্য হলো জমিতে দখল দিতে হবে। হয়ত ১০ বিঘা জমিতে দখল দিয়ে দিতে পারলে ৫ বিঘা সেলামি হিসেবে পাবে। এই সমস্ত ধনীদের আবার লাঠিয়াল বাহিনী আছে। লাঠিয়ালরা গ্রামে সর্বহারা। সামান্য কিছু পেয়ে এরা আসে লাঠি ধরতে। পুলিশদের সাথে নাকি এদের চুক্তি থাকে। যা হোক ধান পাকলে লাঠি খেলা শুরু হয়। জমিওয়ালা কিছুই পায় না, পায় সেই গৃহস্থ আর কিছু অংশ পায় লাঠিয়ালরা। গত বছর পাইকগাছার একজন চেয়ারম্যান কয়েক হাজার মণ ধান এই প্রকারে পেয়েছিলো, অবশ্য পুলিশকে কিছু দিতে হয়েছিলো। মজার ব্যাপার এই যে, ধান রোয়ার সময় এরা বলে ‘এখন চুপ করে থাক, যে পারে রুয়ে যাক, পাকলে দেখা যাবে।’ অনেক ক্ষেত্রে আবার জমি ভাগে দেবে এই শর্তে সর্বহারারা লাঠি ধরতে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধনী কৃষক ছাড়া অন্যদের এই কাজ করতে দেখা যায় না। আর এই বড়লোকের নেতৃত্বে সামান্য লাভে লাঠিয়ালরা জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এই হলো মোটামুটিভাবে এই এলাকার ধনীদের চরিত্র। এটা শুধু এই এলাকায় নয়—সমগ্র দক্ষিণ এলাকায়। এখানে তাই এক পাশে দেখা যায় গোলা ভরা ধান, অন্য পাশে দেখা যায় ক্ষুধার্থ নরকঙ্কাল। এই এলাকায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জোতদার-মহাজন আছে, তবে সবাই এই একই ‘সিন্ডিকেন্টভুক্ত’।’২৩

০০০০

* খুলনার মতো নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং বরিশালেও অন্য এলাকা থেকে দাওয়ালরা বিপুল সংখ্যায় ধান কাটার মৌসুমে উপস্থিত হয়। নোয়াখালীর চর অঞ্চলগুলি বিশেষতঃ চর জব্বার, চর বাটা প্রর্ভতি এলাকা এবং রামগতি ও হাতিয়া; চট্টগ্রামে স্ন্দ্বীপ এবং বরিশালের বিভিন্ন চর এলাকা ও ভোলা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বিপুল সংখ্যায় এরা ঐসব অঞ্চলে মারা পড়ে।—লেখক

০০০০

মার্কস ও লেনিন উল্লিখিত ফসলে খাজনা প্রথার* সমস্ত আনুষঙ্গিকই ওপরের বিভিন্ন তথ্য এবং এই তিনটি রিপোর্টের মধ্যে কিছু পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। এই আনুষঙ্গিকগুলোর মধ্যে প্রধান হলো প্রাকৃতিক অর্থনীতির উপস্থিতি, অনুন্নত প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির অস্তিত্ব, মহাজনী শোষণের প্রতাপ, বেগার ও অন্যান্য অতিরিক্ত আদায়, জমির চাহিদা বেশী থাকায় বর্গাদারের ভাগ ইচ্ছেমতো নির্ণয়, টাকায় খাজনার থেকে এই খাজনার আপেক্ষিক ব্যয়সাপেক্ষতা, কৃষকদের দরিদ্রতম অংশের মধ্যে তার বিস্তার, বর্গাপ্রথার মাধ্যমে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের থেকে পুঁজিবাদী পারিশ্রমিকের পরিমাণ বেশী থাকা এবং এই সমগ্র শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সরকারী প্রশাসনিক যন্ত্রের চাপ।

রিপোর্টগুলিতে অল্পসংখ্যক হাতে জমি কেন্দ্রীভূত হওয়ার যে সমস্ত বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি আইয়ুবী শাসন আমলের। এই সময়েই সারা পূর্ব বাঙলায় বিশেষতঃ দক্ষিণ অঞ্চলে এবং উপকূলবর্তী এলাকায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জোতদাররা সরকারী সহায়তায় হাজার হাজার বিঘা জমি হস্তগত করে। শুধু জমি হস্তগত করেই তারা ক্ষান্ত হয় না। এই একই জোতদাররা কৃষকদের নিদারণ দৈন্য ও দারিদ্র্যের ওপর দাঁড়িয়ে মহাজনী কারবারকে পূর্ববর্তী হিন্দু মহাজনদের থেকেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়। তেভাগা আন্দোলনের চাকাকে ঘুরিয়ে তারা স্থানে স্থানে প্রবর্তন করে উল্টো তেভাগা, উল্টো চারভাগা। এই ব্যবস্থাটাই রচনা করেছিলো আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ভিত্তি প্রস্তর। এইজন্যই আইয়ুবের এক দশকব্যাপী শাসনকালে জোতদার, ইজারাদার, মহাজন ইত্যাদি শোষকদের সাথে গড়ে উঠেছিলো সামরিক শাসকচক্রের এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী আঁতাত।**

উপসংহার :

আইয়ুব খানের আমলে বাঙলাদেশের কৃষকের অবস্থা পর্যালোচনা করতে গিয়ে ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের পর থেকে এ পর্যন্ত যে সমস্ত পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে এদেশের কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক সমাজে সংঘটিত হয়েছে সেটা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছি। আইয়ুব খান তাঁর ভূমিনীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে যে সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন সেগুলিও আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছি। সে প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি, পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানী বড়ো পুঁজির স্বার্থে তিনি কিভাবে তৎকালীন পূব বাঙলার অর্থনীতিকে, বিশেষতঃ, কৃষি অর্থনীতিকে, রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব খানের এই প্রচেষ্টা যে সাময়িকভাবে বহুলাংশে সফল হয়েছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং এই সাময়িক সাফল্যের জন্যই তিনি প্রায় নিরাপদে দশ বৎসরকাল শুধু পূর্ব বাঙলা নয়, সমগ্র পাকিস্তানেই নিজের নেতৃত্বাধীন সামরিক শাসন কায়েম রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই সাফল্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। অর্থনীতি ক্ষেত্রে তাঁর নীতি ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তারই প্রতিফলন ঘটে ১৯৬৮-৬৯ সালের ব্যাপক গণ-আন্দোলনে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব না হলেও এই পরিস্থিতির কয়েকটি দিক এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে।

প্রথমেই জমি হস্তান্তরের কথা। আইয়ুবের ভূমি নীতির ফলে পূর্ব বাঙলায় কৃষকদের থেকে জমি হস্তান্তরিত হয়ে জোতদারদের এবং অন্যান্য ধরনের ভূমি মালিকদের হাতে সেই জমি কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা আমরা উল্লেখ করেছি। জোতদারী ও মহাজনী শোষণের ফলে কৃষকরা ব্যাপকভাবে জমি হারিয়ে চলেছিলেন। এইভাবে জমি হারিয়ে তাঁরা পরিণত হচ্ছিলেন বর্গাদারে। এজন্যই এই পর্যায়ে বর্গা প্রথার আওতায় মোট জমির পরিমাণ এবং বর্গাদারদের সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বৃদ্ধি ছিলো সাময়িক। এবং তা হতে বাধ্য। কারণ কৃষক কর্তৃক জমি হারানোর অর্থ কৃষি উৎপাদনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের থেকে তার বিচ্ছিন্নতা। উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এই প্রক্রিয়া শুধু জমি থেকে বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না এবং তা কোন সমাজেই থাকে না। কাজেই কৃষকদের দারিদ্র যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, তাঁদের উপর জোতদার-মহাজনদের শোষণ-নির্যাতন যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ততই তাঁরা উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। অর্থাৎ শুধু জমি বিক্রি করেই তাঁরা রেহাই পাচ্ছিলেন না, তাঁদেরকে জীবন ধারণের জন্য হালের গরু, লাঙ্গল ইত্যাদিও বিক্রি করতে হচ্ছিলো।

জমি গেলেও কৃষির অন্যান্য উপকরণ গরু লাঙ্গল ইত্যাদি থাকলে বর্গাদার হিসেবে জমি চাষ করা সম্ভব হয়। কিন্তু গরু-লাঙ্গল না থাকলে বর্গাদারীও আর সম্ভব হয় না। ঠিক এই কারণে আইয়ুব আমলের শেষ পর্যায়ে সারা পূর্ব বাঙলায় সামগ্রিকভাবে বর্গাচাষীর সংখ্যা এবং বর্গা প্রথার অধীনে সেই জমির পরিমাণ অনেক কমে আসে। যে কৃষকরা জমি হারিয়ে বর্গাদার হিসাবে জমি চাষ আবাদ করছিলেন তাঁরা পরিণত হতে থাকেন কৃষি শ্রমিকে। অর্থাৎ আইয়ুব খান তাঁর ভূমিনীতির মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া জারী করেন তার পরিণতিতে কৃষক সমাজের ভাঙন (differentiation) প্রকৃতপক্ষে আরও ত্বরান্বিত হয়। একদিকে ভূমি মালিকদের হাতে জমি এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এবং অপরদিকে স্ফীত হতে থাকে ভূমিহীন কৃষি মজুরদের সংখ্যা।

এর ফলে আইয়ুব খানের আমলেই জমি খাসে নিয়ে এসে কৃষি শ্রমিকদের দ্বারা চাষ আবাদের একটা প্রবণতা ভূমি মালিকদের মধ্যে দেখা যায়। শুধু ভূমি মালিকরাই নয়। যাদের হাতে ‍কিছু পুঁজি ছিলো তারাও ভূমি মালিকদের থেকে বেশী পরিমাণ জমি ‘বর্গা’ নিয়ে (অর্থাৎ পুঁজিবাদী লিজ) কৃষি শ্রমিকের মাধ্যমে চাষ আবাদ করতে শুরু করে। এই ধরনের অনুন্নত পুঁজিবাদী খামারের সংখ্যা তখন কম হলেও ১৯৭১ সালের পর থেকে এদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে আসছে।

১৯৬৩-৬৪ সালে মোট কৃষক পরিবারের ৩৭% ছিলো বর্গাদার পরিবার এবং মোট জমির ৪৫% ছিলো বর্গাপ্রথার অধীন। বর্তমানে মোট জমির ২০% থেকে ২৫% ভাগ হলো বর্গা প্রথার অধীন এবং সেই অনুপাতে বর্গাদার পরিবারের সংখ্যাও অনেক কম। অথচ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা এখন হলো মোট কৃষকের প্রায় ৬০%। কৃষক সমাজের মধ্যে ভাঙন এখন কোন পর্যায়ে গেছে এই হিসেব থেকেই সেটা বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়।

০০০০

* বর্গাপ্রথার মধ্যে কতকগুলি সামন্ত অবশেষের এই উপস্থিতি সত্ত্বেও একথা অবশ্য বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত বর্গাপ্রথা একটি বিশুদ্ধ সামন্তবাদী ফসলে খাজনা প্রথা নয়। বর্গাপ্রথার মধ্যে পুঁজিবাদী উপাদানের উপস্থিতিও সহজেই লক্ষণীয়। অর্থাৎ এখানে ‍পুঁজি নিয়োগেরও একটা ব্যাপার আছে। যে কৃষক জমি বর্গা নেয় সে চাষের পুরো খরচ বহন করলে তাকে ফসলের যতটুকু অংশ ভূমি মালিককে দিতে হয় অন্য ক্ষেত্রে সেটা দিতে হয় না। আবার ভূমি মালিক যদি বীজ ধান, নিড়ানী, ফসল কাটা, সার, সেচ ইত্যাদির খরচ বহন করে তাহলে সে নিজের অংশ হিসেবে আরও বেশী পেয়ে থাকে। আবার এইসব খরচ যদি কৃষক ও ভূমি মালিকের মধ্যে ভাগাভাগি হয় তাহলে ফসলের অংশ ভাগও সেই হিসেবে হয়েই থাকে। এজন্য সাধারণভাবে যে বর্গাপ্রথা তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় প্রচলিত ছিল এবং এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত আছে সেটা হলো সামন্ত অবশেষ এবং পুঁজিবাদী উপাদান উভয়েরই একটি মিশ্রণ। বর্গাপ্রথার মধ্যে উপরি উল্লিখিত এইসব পার্থক্য বাঙলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়।

** পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্যানেলভুক্ত বাঙালী অর্থনীতিবিদেরা সুপারিশ করেন :‘পূর্ব পাকিস্তানে বর্গা প্রথাকে উচ্ছেদ করতেই হবে এবং জমিতে বর্গাদারদেরকে দান করতে হবে মালিকানায়ত্ব। কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে জমি একত্রীকরণের উদ্দেশ্যে বিরাট আকারে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ প্যানেলের পশ্চিম পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা কমিশন দ্বারা এই সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হয়। কোন প্যানেলেই অবশ্য জমির উর্ধ্বতন পরিমাণ সম্পর্কে কোন ‍উল্লেখ নেই।২৪

০০০০

১৯৪৭ সালের পর পূর্ব বাঙলা থেকে অনেক হিন্দু মহাজন পরিবারের দেশত্যাগের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় সেটা মুসলমান জোতদাররাই প্রধানতঃ পূরণ করে। এরপর থেকে কিছুকাল এই জোতদার শ্রেণীই মহাজনী কারবারে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। এদের শোষণ-নির্যাতন আইয়ুবের আমলেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। কিন্তু আইয়ুব আমলের শেষদিকে এই মহাজনী ব্যবস্থার মধ্যেও পরিবর্তন শুরু হয়। এই পরিবর্তনের একটি কারণ গ্রামাঞ্চলে ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক পুঁজির আবির্ভাব। এই ব্যাংক পুঁজি ছাড়াও আর এক ধরনের লোকেরাও ধীরে ধীরে মহাজনী কারবারের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। এরা হলো চাকুরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী ইত্যাদি। অল্প পুঁজির মালিক এইসব ব্যক্তি গ্রামাঞ্চলে মহাজনী কারবারে লিপ্ত হওয়ার ফলে মহাজনী কারবার যেমন একটা ব্যাপকতা লাভ করে তেমনি তার পীড়নমূলক চরিত্রও কিছুটা লাঘব হয়। ঋণদান ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাই এর প্রধান কারণ।

১৯৭১ সালের পর থেকে ব্যাংক পুঁজি যেভাবে বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে পূর্ববর্তী কোন সময়ের সাথেই তার কোন তুলনা হয় না। বাণিজ্যিক ও কৃষি ব্যাংকসমূহের হাজার হাজার শাখার মধ্যে বিপুলসংখ্যক এখন গ্রামাঞ্চলে। এই শাখাগুলির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের কৃষকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামীণ জোতদার-মহাজনরা এই ব্যাংক ঋণ থেকে কৃষকদেরকে বঞ্চিত করার চেষ্টা, গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের এই ঋণ লাভের ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা (এইসব অসুবিধা দূর করার জন্য ব্যাংক পুঁজি এখন নিত্যনতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে) এবং ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণ নিয়ে জোতদার-মহাজন কর্তৃক কৃষকদের কাছে সেই অর্থ বেশী সুদে লগ্নী কারার চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যাংক পুঁজি এখন গ্রামীণ মহাজনী কারবারকে একটি প্রথা হিসেবে ভেঙে দিচ্ছে। মহাজনী কারবার গ্রামাঞ্চলে দ্রুতগতিতে একটি পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার আওতাভুক্ত হয়ে পড়ছে।

ক্ষুদ্র কৃষকরা জমি হারিয়ে এবং তারপর গরু-লাঙ্গল ইত্যাদি উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ হারিয়ে বিপুল সংখ্যায় কৃষি শ্রমিকে পরিণত হওয়ার ফলে বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখন স্বাভাবিকভাবেই পণ্য অর্থনীতির বিস্তার ঘটছে। পূর্বের যে কোন সময়ের থেকে এখন শতকরা অনেক বেশী সংখ্যক মানুষকে খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কিনে খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে অল্প সংখ্যকের হাতে জমি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হচ্ছে সেটাকেও বাজারজাত করার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। এর ফলে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যবসায়ী পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্যবসায়ী পুঁজির এই নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব কিন্তু কৃষি অথবা শি্ল্পের বিকাশে সহায়ক হচ্ছে না। এই পরিস্থিতির মূল কারণ বর্তমান বাঙলাদেশের অর্থনীতির উপর সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী পুঁজির নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের কৃষি ও শিল্প সংক্রান্ত নীতি ব্যবসায়ী পুঁজির স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে এবং তার ফলে পুরাতন গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো অল্পবিস্তর দ্রুতগতিতে ভেঙে পড়লেও সেই ভাঙনের উপর দাঁড়িয়ে শিল্পের ও কৃষির কোন উল্লেখযোগ্য বিকাশ হচ্ছে না এবং সমগ্র অর্থনীতিই একটা বিষাক্ত আবর্তের মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে।

এই আবর্তকে চূর্ণ করা সম্ভব যথোপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক কৃষিসহ সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। এছাড়া অন্য কোন সহজ অথবা সংস্কারমূল পথ আর নেই।

তথ্যপঞ্জী :

১.জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী অবস্থা

(১) Economic Survey of asia and Far East, 1963, Table 6, P. 187-88. Quoted from Rehman Sobhan : Basic Democracies Works Programme etc. P.2

(২) Statistical Digest of East Pakistan No.5 : 1968. P. 38 এ প্রদত্ত Table 3.1 থেকে হিসেব করা।

(৩)  Rehman Sobhan : Basic Democracise Works Programme etc. P.3

(৪) Pakistan Census of Agriculture, 1960, Vol. 1. Table 3

(৫) National Sample Survey (Third Round), 1961, Central Statiscal Office, Govt. of Pakistan. Table 5-1

(৬) Master Survey of Agriculture Series no. 5, East Pakistan Bureau of Statistics.

(৭) Pakistan Central Jute Committee, 1958-59, Rehman Sobhan : Basic Democracies P. 9-10

(৮) N.S.S. (Third Round). Rehman Sobhan : Basic Democracies etc. P. 13.

(৯) N.S.S. (Second Round). Table-39.

(১০) N.S.S. (Third Round) Table 5-1

(১১) Pakistan Census of Agriculture, Vol. 1, Table 20.

(১২) Statistical Digest of East Pakistan No. 5 : 1968. P. 56-7

(১৩) ঐ। P. 11.

(১৪) Pakistan Economic Survey 1963-64, Table 18, P. 20

(১৫) Statistical Digest of E. P. 1968. P. 60

(১৬) ঐ। P. 61

(১৭) ঐ। P. 73

(১৮) ঐ। P. 70

(১৯) Pakistan Census of Agriculture Vol. I. Tables 34-37.

(২০) National Sample Survey (Second Round) Table 72.

(২১) ঐ।

(২২) (ক) Statistical Digest of East Pakistan, 1968, P. 54

(খ) Rehman. P. 45.

২. আইয়ুবের ভূমিনীতি এবং তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য

(১) Land Reforms in West Pakistan. Part II. Decisions of the President’s Cabinet on the Report of the Land Reforms Commission for West Pakistan. P.1.

(২) The East Bengal State Acquisition and Tenancy Act. 1950. (As modified upto 30th September, 1969) Section 20. Also foot note no. 1 in P. 30

(৩) E.B. Legislative Assembly Proceedings Vol. 1, No. 4. P. 93.

(৪) উদ্ধৃত। সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। পৃষ্ঠা : ১৩৪

৩. মৌলিক গণতন্ত্র

(১) Rehman Sobhan : Basic Democracies Works Programme etc. P. 82

(২) ঐ।

(৩) ঐ। P. 85

(৪) Dr. Rashiduzzaman : Village Government in East Pakistan : A study of Union Boards and Union Counsils. Ref : R.S. Basic Democracies etc. P. 97-100

(৫) Rehman Sobhan : Basic Democracies etc. P. 98

(৬) ঐ। P. 98

৪. ওয়ার্কস প্রোগ্রাম

(১) Richard V. Gilbert, `The Works Programme in East Pakistan, paper delivered at the Conference on Labour Productivity in Geneva, December, 1963, Rehman Sobhan : Basic Democracies etc. P. 105-10

(২) A Rural Works Programme in Comilla Kotwali Thana, June 1962, report by PARD (Pakistan Academy for Rural Development), Comilla, Ch. II. Rehman. P. 108

(৩) ঐ P. 107

(৪) Rehman. P. 195

(৫) ঐ P. 157

(৬) A Manual for Rural Public Works, Ch. I, PARD. Rehman Sobhan. P. 158

(৭) Rehman.  P. 180

(৮) ঐ। P. 163

(৯) ঐ।

(১০) ঐ।

(১১) Performance Report on Rural Works Programme, 1964-65. Rehman. P. 190

(১২) Richard V. Gilbert : The Works  Programme in East Pakistan, P. 18. Rehman. P. 209

(১৩) Rehman. P. 209-10

(১৪) Works Programme for 1964-65 for East Pakistan, B.D. and L.G. Department, P. 1, para 3, Rehman Sobhan P. 210

(১৫) ঐ।

(১৬) Rehman. P. 214

(১৭) Richard Gilbert : The Works Programme in East Pakistan P. 18. Rehman P. 208

(১৮) Rehman. P. 208

(১৯) Rehman. P. 230

(২০) Rehman. P. 236 টেবিল নং ৬-১৭ থেকে গৃহীত।

(২১) Rehman. P. 232

(২২) Rehman. P. 231

(২৩) Rehman. P. 231, 234

(২৪) Rehman. P. 126

(২৫) Rehman. P. 118, 121-25, 126-27, 131-32, 137-42, Appendix No. 4

(২৬) Mosharaff P. 71-2

(২৭) Mosharaff. P. 72

(২৮) গণশক্তি। ১ম বর্ষ ২৩শ সংখ্যা। ১২ই জুলাই, ১৯৭০। পৃষ্ঠা ৫ ও ৮।

(২৯) গণশক্তি। ঐ, পৃষ্ঠা ৩।

(৩০) Rehman. P. 137-42

৫. সামাজিক শ্রম বিভাগ

(১) Karl Marx : The Eighteenth Brumaire of Luis Bonaparte. Karl Marx and Frederick Engels. Selected Works. Vol. 1. P. 478-79. Progress Publishers, Moscow, 1969.

(২) V.1. Lenin : The Development of Capitalism in Russia. Collected Works. Vol. III. P. 315. Progress Publishers, Moscow, 1964

(৩) Statistical Digest of East Pakistan, 1968-এর P. 28 এবং  32-তে প্রদত্ত Table 3.1 এবং Table 2.10 থেকে হিসেব করা।  

(৪)

৬. ভূমি খাজনা

(১) Karl Marx : Capital Vol. III. Ch. XLVII. P. 796-97, Progress Publishers, Moscow, 1966

(২) Capital III. P. 618

(৩) গণশক্তি । ১ম বর্ষ : ৭ম সংখ্যা। ২২শে মার্চ, ১৯৭০। পৃষ্ঠা : ৯

(৪) গণশক্তি। ১ম বর্ষ : ১৬শ সংখ্যা। ২৪শে মে, ১৯৭০। পৃষ্ঠা : ১৩

(৫) গণশক্তি। ১ম বর্ষ : ২২শ সংখ্যা। ৫ই জুলাই, ১৯৭০। পৃষ্ঠা : ৯

(৬) গণশক্তি। ১ম বর্ষ : ২৮শ সংখ্যা। ২৬শে জুলাই, ১৯৭০। পৃষ্ঠা : ৮

(৭) ১৯৫৭ সালের ২৭শে ও ২৮শে জানুয়ারী তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভূমি সংস্কার সম্মেলনের সুপারিশাবলী। পৃষ্ঠা : ৮ পুর্ব পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেসে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (হোম ডিপার্টমেন্ট) কর্তৃক মুদ্রিত। ১৯৫৭ সাল

(৮) ঐ। পৃষ্ঠা : ৮

(৯) একুশ দফার রূপায়ন : অধ্যাপক আবুল কাসেম। তমদ্দুন লাইব্রেরী, ১৯ আজিমপুর রোড, ঢাকা।

(১০) এই টেবিলটি Pakistan Economic Survey (1969-70)-এর Statistical (P.52-9)-এর

০০০০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978-eid.pdf” title=”1978 eid”]