You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাসদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন
শাহ্জাহান সিরাজ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৭ জুলাই ১৯৭৯

সমাজতান্ত্রিক দলের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শাহ্জাহান সিরাজ। ছাত্র জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন ৭০-৭১ সালে তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ‘৭২ সালে যে ক’জন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাঁদের একজন তিনি। এখন তিনি দলের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও জাতীয় সংসদের একজন উচ্চকণ্ঠ সদস্য। শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে দেশের ও তার দলের বিভিন্ন বিষয়ে বিচিত্রা একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ।

প্রশ্নঃ সম্প্রতি সমাপ্ত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রথম বারের মত যোগদান করে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে আপনার কি অভিজ্ঞতা হয়েছে? উত্তরঃ নতুন একজন সদস্য হিসেবে সম্প্রতি সমাপ্ত বাজেট অধিবেশনকে যেভাবে আশা করেছিলাম সেভাবে হয় নি। কারণ এই অধিবেশনেও দেখা গেল বিগত অধিবেশনের মত ও অন্যান্য অধিবেশনে যে ধরনের আলোচনা হয় সে রকমই হয়েছে। ঠিক জাতীয় বাজেটের উপর যে ধরনের আলোচনা বা সমালোচনা হওয়া উচিত ছিল আসলে সেরকম কিছু হয়নি। বেশির ভাগ সময়ই খুটিনাটি বিষয় নিয়েই অধিকাংশ সময় ব্যয় করা হয়েছে এবং জাতীয় বাজেট আলোচনায় যে গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন আমার মনে হয় না তা’ হয়েছে।

প্রশ্নঃ বিগত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আপনি অংশগ্রহণ না করলেও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এর সংস্পর্শে ছিলেন। সেদিক দিয়ে দুটো সংসদের মধ্যে আপনি কোন পার্থক্য দেখছেন কি?
উত্তরঃ পার্থক্য তো অবশ্যই রয়েছে। সেটা ছিলো পার্লামেন্টারী ফর্ম অফ গভর্মেন্ট এবং এখন হলো প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্ম অফ গভর্ণমেন্ট। সে পার্লামেন্টে যদিও বিরোধী দলের সংখ্যা ছিলো খুবই কম তবু সেখানে আমার মনে হয় সে সময় যে বক্তব্যগুলো রাখতে দেয়া হত এবং বক্তব্যগুলো আসত তাতে জাতীয় প্রশ্নগুলো সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারা যেত।

প্রশ্নঃ মুজিব আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত জাসদের রাজনৈতিক কার্যকলাপকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করছেন?
উত্তরঃ কিভাবে মূল্যায়ন করবো? এখানে কোন ভাবের প্রশ্ন আসে না
যা বাস্তব তাই। আমাদের এখনো কোন সঠিকভাবে তাত্ত্বিক মূল্যায়ন করা হয়নি।

প্রশ্নঃ তবুও একটি দল যারা সাত বছরের অধিক সময় কার্যকাল চলছে তার তো মূল্যায়ন রয়েছে?
উত্তরঃ জাসদ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে নীতির ভিত্তিতে জনগণ স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো তা’ বাস্তবায়িত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি বলে জাসদ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে। এ সংগ্রামে জাসদ ছিলো আছে এবং থাকবে। এ সংগ্রাম চালাতে গিয়ে দেখা যায় হাজার হাজার কর্মী প্রাণ দিয়েছে। কর্নেল তাহেরের মত একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। এবং আজো আমাদের দলের সভাপতি মেজর জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ, স, ম আবদুর রব, অন্যতম নেতা সিরাজুল আলম খান, আসানুল হক ইনু, খন্দকার বাতেন ও মেজর জিয়াউদ্দিনসহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী সংগ্রাম করতে গিয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন।

প্রশ্নঃ আপনারা কি কোনো সাফল্যই লাভ করেন নি?
উত্তরঃ সফলতা অবশ্যই আছে। এত অত্যাচার নির্যাতনের পরেও আমরা আন্দোলনের যে ধারা সে ধারাটি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। এবং আমরা আশা করি, আমরা যে বক্তব্য দিয়েছি তা’ দেশের জনগণের এবং কৃষক শ্রমিক মেহনতির মানুষের মুক্তির জন্য। এ বক্তব্য ছাড়া তাদের মুক্তি নেই। জনগণ একটু দেরিতে হলেও তা’ বুঝতে পারবে এবং সর্বশেষে এটাই বাস্তবায়িত হবে।

প্রশ্নঃ জাসদের মত একটি পেটি বুর্জোয়া, বুর্জোয়া পার্টির পক্ষে কিভাবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব?
উওরঃ জাসদ কোন পেটি বুর্জোয়া বা বুর্জোয়া সংগঠন নয়। জাসদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন।

প্রশ্নঃ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার ক্ষেত্রে আপনারা কোন কোন রাজনৈতিক দলকে এই মুহূর্তে মিত্র মনে করছেন? এ ব্যাপারে আপনারা কতটুকু এগিয়েছেন?
উত্তরঃ আমরা ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ডাক দিয়েছি। আমাদের আলোচনা হয়েছে আতাউর রহমান সাহেবের সঙ্গে, রাশেদ খান মেনন, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, নির্মল সেন— আশা করা যাচ্ছে আরো অনেকের সঙ্গে আলোচনা হবে।

প্রশ্নঃ আলোচনা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে?
উওরঃ আমাদে এ কয়জনের মধ্যে মোটামুটি কর্মসূচীর ব্যাপারে বোঝাপড়া হয়েছে।

প্রশ্নঃ সম্প্রতি আওয়ামী লীগের (মালেক) সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। আপনিও একই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তরঃ আমার বক্তব্য পরিষ্কার। নির্বাচনের আগে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার আন্দোলন যেটা হয়েছিলো সে আন্দোলনে আমাদের সমস্ত বিরোধী দলগুলো ( যদিও একই দৈনিক পত্রিকায় আমাদের স্টেটমেন্ট দিতে পারি নি) একই সঙ্গে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম। আমাদের আন্দোলনের শর্ত ছিলো যে জিয়াউর রহমান আমাদের ডাকবে। তবে কোন পার্টি একক ভাবে যেতে পারবে না। এধরনের একটি ‘জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট’ ছিল। সেই এগ্রিমেন্টকে ভেঙ্গে আওয়ামী লীগ সর্বপ্রথম আমাদের জিজ্ঞাসা না করেই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়। আমরা কাউকে পাশ কাটিয়ে যাই নি। সমস্ত দল পার্টি সহ আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। এবং এর পর দেখা গেল অন্যান্য পার্টি নির্বাচনে যাচ্ছে। দেশের স্বার্থে এবং বাস্তব অবস্থার কারণেই আমরা একা নয় ছয়টা পার্টি একসঙ্গে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। সুতরাং আবদুর রাজ্জাক সাহেব আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন তা’ সম্পূর্ণ অসত্য। কেউই জানে না, উনারা গেলেন। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো বাজারে গুজব রয়েছে। তার উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন এসব সত্য নয়।

প্রশ্নঃ এই মুহূর্তে কাকে আপনি প্রধান শত্রু বলে মনে করেন?
উত্তরঃ অবশ্যই জিয়াউর রহমানের সরকারকে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশে দুটি অতিকায় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তরঃ আসলে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বৃহৎ শক্তিগুলো হুমকী স্বরূপ। যদি কোন দিন আমাদের দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হয় তাহলে আমরা আমাদের দেশকে বৃহৎ শক্তির ছোবল থেকে দূরে রাখতে পারব আসলে এ জিনিসটা সার্বিকভাবে নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থার ওপর। ঘুরিয়ে বলা যায় দেশের সরকার জনগণের সঙ্গে কতটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল তার ওপর।

প্রশ্নঃ এই মুহূর্তে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব কি?
উত্তরঃ এই মুহূর্তে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া যে দেশের উন্নয়ন সম্ভব আমি তা’ বলছি না। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে দেশের সিংহভাগ কাজ করতে হবে একটা স্বাধীন দেশে তা’ কখনো ভাবা যায় না। ধীরে ধীরে বৈদেশিক সাহায্য কমাতে হবে। কিন্তু আমাদেরটা তা’ ক্রমশঃ বাড়ছে। এ লক্ষ্যণটি অত্যন্ত খারাপ। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য এটা একটা বিরাট হুমকী স্বরূপ।

প্রশ্নঃ সরকার বলছেন খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। বিরোধী দলের নেতারা বলছেন খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করছি না। এটাও কি খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করা নয়?
উত্তরঃ আমি কখনই বলিনি খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না। আমরা খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করি না। খাদ্য সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করি এবং তা’ করবই। খাদ্য সমস্যা আমাদের প্রধান সমস্যা— এ সমস্যা যতদিন থাকবে ততদিন এ নিয়ে রাজনীতি করব।

প্রশ্নঃ শোনা যায় কারাগারে আটক জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বর্তমান জাসদ নেতৃত্বের মতপার্থক্য রয়েছে। তা’ কতখানি সত্যি?
উত্তরঃ এ রকম গুজব তো শুধু এখন নয় সেই আমাদের পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই বহু দল বিভিন্নভাবে তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে জাসদের বিরুদ্ধে, জাসদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বলেছেন। আমরা মনে করে জাসদ একটি রাজনৈতিক দল এবং তা’ একটা দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এ দলে ব্যক্তিগত কোন কোন্দল নেতৃত্বের প্রশ্নও আসেও নি এবং আসবেও না। কারণ আমরা একটা আদর্শে বিশ্বাসী।
আমরা সংগ্রাম করছি। কিন্তু আমাদের দলে কোন ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় নি। বাংলাদেশের সব পার্টিই ভেঙ্গেছে। যেহেতু জাসদ এক রয়েছে তাই এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ভাঙ্গন ধরানো বা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চিন্তায়ই এসব করা হচ্ছে।

প্রশ্নঃ বিএনপি, আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাসদের কোন শ্রেণীতে পার্থক্য আছে কি?
উত্তরঃ অবশ্যই আছে। জাসদ-এদেশের মেহনতি মানুষের রাজ কায়েম করতে চায়। অন্যান্য যে সব সংগঠনগুলোর নাম বলা হয়েছে সেগুলো তা’ চায় না। আজকে যে পুঁজিপতি শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী— এই দুই শ্রেণীকে টিকিয়ে রেখে তারা শাসন করতে চায় পুঁজিপতি শ্রেণীর ধারক বাহক হিসেবে। আমরা সেটা চাই না। আমাদের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র।

প্রশ্নঃ জাসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এটি বিদেশী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ ‘৭২ সালে বলা হলো জাসদ আমেরিকার এজেন্ট, এর পর বলা হলো চীনের এজেন্ট, রাশিয়ার এবং ভারতের এজেন্ট। এখন আবার নতুন করে কি বলা হবে। একটা পার্টি যদি সব দেশের এজেন্ট হতে পারে— আসলে এ হলে তো বিরাট ব্যাপার। আসলে জাসদ কারো এজেন্ট নয়। জাসদ এদেশের জনগণের জন্য কাজ করছে এবং জনগণের একটা পার্টি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1979.pdf”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!