দুর্নীতির দুর্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রেজোয়ান সিদ্দিকী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৭ জুলাই ১৯৭৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে ১৫ জুলাই বিজ্ঞান অনুষদের একজন সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। আলোচনাকালে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আইনস্টাইন পদকপ্রাপ্তির নেপথ্য কাহিনী’ (৬ জুলাই সংখ্যা) শীর্ষক রিপোর্টটি করে ‘বিচিত্রা’ বিরাট দায়িত্ব পালন করেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকের বাংলাজ্ঞান সম্পর্কে প্রামাণ্য রিপোর্টটি প্রকাশ করা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে। কারণ তাতে নাকি শিক্ষক সমাজের সম্মান ভুলুন্ঠিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লেদাক্ত পরিবেশ ক্লেদাক্ত সমাজেরই প্রতিফলন। সুতরাং এ অপরিহার্য। কেউ কেউ বলেছেন, আপনারা মন্ত্রণালয় কর্পোরেশন চোখে দেখেন না। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত মাতামতি করেন কেন? অর্থাৎ কর্পোরেশন- মন্ত্রণালয়ের দোষত্রুটি দুর্নীতি সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরা যাবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি নারীর আয়েবের মতো পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় যেহেতু নির্বাহ হয় আমাদের ক্ষুধাদীণ মানুষেরই পয়সায়। সুতরাং এ সম্পর্কে জানবার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে। একথা বলেছেন, বিশ্বিবিদ্যালয়েরই আর একজন শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অব্যবস্থা,অরাজকতা প্রশাসনিক উন্মাসিকতা প্রভৃতি অপকর্মের মূলে রয়েছে এই দ্বিমুখী নীতি। সেটি আপনার স্বার্থের অনুকূল, তা খুব ভাল, আর যেটি তা নয়, তা খুবই খারাপ। তাই আইনস্টাইন পদকের নেপথ্য কাহিনী ছাপা হলে দোষ নেই কিন্তু শিক্ষকের অজ্ঞতা ছাপা হলে দোষ হয়। তা ঢেকে রাখতে হবে।
এই ঢেকে রাখার ফলেই আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব রকমের দুর্নীতির এক মহাসূতিকাগারে পরিণত হয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক দূর্নীতি,স্বজনপ্রীতি, হঠাকারিতা ঔদ্ধত্য জন্ম নিয়েছে। মূলোৎপাটন না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরং তার গোড়ায় পানি ঢেলে ঢেলে সযত্নে লালন করেছেন। তার ফলে জন্ম নিয়েছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, জন্ম নিয়েছে নতুন পাপ। সমাজের রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে গেছে ক্যান্সারের মতো হাজারো রোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাপের ইতিহাস দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা প্রায় অসম্ভব। এ সম্পর্কে ১৯৭৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, তার রিপোর্ট তৎকালীন চ্যান্সেলরের কাছে পেশ করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৩ আগস্ট। সে রিপোর্ট সাধারণ কাছে প্রকাশ করা হয়নি। সেটি ছিল সিক্রেট, গোপনীয়৷ সে রিপোর্ট কেন এই দীর্ঘ দিন পরেও প্রকাশ করা হল না, তা অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। ঐ রিপোর্টটির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলেও জানা যায়নি। বরং দুর্নীতির দায়ে কাউকে কাউকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ পুনরুদ্দমে শুরু করেছেন দুর্নীতি, বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন আপন আপন ক্ষেত্রে। পাপ আরও জমছে। নতুন নতুন সমস্যা প্রসারিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সামান্য ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বিষধর সাপগুলো ফোঁস ফোঁস করতে করতে উঠে এসেছে। এই অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে যার সঙ্গেই কথা বলতে গিয়েছি তিনিই বলেছেনঃ বলতে মানা। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেছেন ভাইস-চ্যান্সেলর নিষেধ করেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে, রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেছেনঃ ভিসিকে জিজ্ঞেস করে নিই।
আমাদের অনুসন্ধান অসম্পূর্ণা মাত্র দু একটি ঘটনার। যদি ব্যাপক অনুসন্ধান চালান হয়, তা হলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজক অবস্থা অনেক বেশি ব্যাপক। এই অবস্থা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে সযত্নে লালিত হয়ে হয়ে এটি এখন দুর্নীতির এক লীলাক্ষেত্রে পরিণত। তার কয়েকটি উদাহরণ আমরা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে চাই।
চাকরি, পদোন্নতি ইত্যাদি
১৯৭৬ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশন শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে একগাদা অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। সে সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নিয়োগের আগে এ্যাকাডেমিক কমিটিতে তা পাস করিয়ে নিতে হয়। পরে সিন্ডিকেট পদটি অনুমোদন করে। তারপর রেজিস্ট্রার ঐ পদের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর প্রাপ্ত সকল দরখাস্তের মধ্য থেকে দরখাস্তকারীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তারপর সিলেকশন কমিটির অনুমোদন হয়। পরেই একজন শিক্ষক নিযুক্ত হতে পারেন। কিন্তু এই নিয়মের পাশাপাশি আছে এডহক ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের রেওয়াজ। এই রেওয়াজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের স্বজনপ্রীতির প্রধান উপায় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। তার প্রমাণ আছে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে। কিন্তু সে সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়াই হয়নি বরং নতুন নতুন ক্ষেত্রে একই ধরনের অনিয়মের সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে চারজন পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। পদার্থ বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, ইসলামের ইতিহাস; সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বাংলা প্রভৃতি (প্রায় সব) বিভাগে ঘটেছে এ ধরনের ঘটনা। এই অনিয়ম লেকচারার পদ থেকে শুরু করে প্রফেসর পদ পর্যন্ত চলছে।
এ ক্ষেত্রে পদন্নতির বিষয়টি আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিভাগে কোনো উচ্চপদ সাধারণত অবিজ্ঞাপিত অবস্থায় শূন্য থাকে না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগ থেকে যোগ্য ব্যক্তির জন্য পদ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়। কিংবা ভাইস-চ্যান্সেলর নিজেই তেমন প্রস্তাব দিতে পারেন। কিন্তু তা প্রথমে বোর্ড অফ এডভান্স স্টাডিজ-এ পাস করিয়ে নিয়ে এ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে তা আবার পাস করিয়ে নেয়া হয়। এবং সব শেষে সিন্ডিকেটেও তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। তারপর এর জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। তখন বিভাগীয় যোগ্য শিক্ষককে অপর দরখাস্তকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, উপাচার্য অহরহ এই নিয়ম লঙ্ঘন করছেন।
এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছরে প্রায় ৩০ টি ক্ষেত্রে এরকম নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। এতে আরও প্রায় ৪০ জন শিক্ষক নিজেদের যোগ্য বলে মনে করে পদোন্নতির জন্য অনুরূপ দরখাস্ত করেন। তাদের ব্যাপারে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিভিন্ন বিভাগে উচ্চতর পদের জন্য যোগ্য যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাদের আবেদনপত্র দাখিলের জন্য একটা সার্কুলার দেয়া হোক। কিন্তু সিন্ডিকেটের কোনো কোনো সদস্য ও ভুক্তভোগী শিক্ষকদের বারবার তাগিদ সত্ত্বেও উপাচার্য আজ পর্যন্ত ওই সার্কুলার জারি করেন নি। আর যে ৪০ জন এই খবর জানার পর দরখাস্ত করেছেন, তাদের আবেদনপত্র চাপা পড়ে আছে।
কোনো পদের জন্য বিজ্ঞাপন প্রদান নিয়েও রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, কর্তৃপক্ষ তাদের মর্জিমাফিক কোনো কোনো সময় পদের বিজ্ঞাপন দানের দু এক মাসের মধ্যেই সিলেকশন কমিটির বৈঠক ডাকেন। আবার কোনো কোনো সময় দু’তিন বছরও ডাকেন না। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলা বিভাগের একজন প্রফেসর নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কিন্তু তাতে একজনকে প্রফেসর করে আরও দুজনকে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রফেসর করা হয়। সিলেকশন কমিটি তিন জনকে পদোন্নতির সুপারিশ করলেও শেষে ডঃ কাজী দীন মুহাম্মদ ও ডঃ রফিকুল ইসলামের পদোন্নতি মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু উপযুক্ততা থাকা সত্বেও পদোন্নতি থেকে বাদ পড়ে যান ডঃ ওয়াকিল আহমদ।
একই ঘটনা ঘটেছে ইতিহাস বিভাগে। গত বছর ঐ বিভাগে দুটি প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। ঐ পদে যারা আবেদন করেছিলেন তাদের দরখাস্ত বিবেচনার জন্য বিশেষজ্ঞ ছিলেন দেশে-বিদেশে। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারেই সিলেকশন কমিটির শিক্ষক নিয়োগের কথা। জানা যায়, ঐ বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ আবু ইমাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ সালাহউদ্দীন আহমদের প্রফেসর হবার কথা। কিন্তু কোনো বিশেষজ্ঞই যার নাম করেন নি সিলেকশন কমিটি সেই ওদুদুর রহমানকে প্রফেসরের স্থায়ী পদে নিয়োগ করে। জনাব রহমান শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে তিনি কাস্টমস ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি করেন। তার কোন ডক্টরেট ডিগ্রি বা কোনো পাবলিকেশন নেই। তবে দুইটি থার্ড ক্লাস রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়েত কেউ কেউ তো কৌতুক করে বলেছেন যে, পাবলিকেশন তো দূরের কথা তিনি নিজের নামও নাকি পুরোপুরি সই করেন না, ইনিশিয়াল দেন। জুনিয়র শিক্ষকরা বলছেন, থার্ড ক্লাস না পেলে প্রফেসর হবার নাকি কোনো উপায় নেই। অপর একটি পদে নিয়োজিত হয়েছেন ডঃ সালাহউদ্দীনন আহমদ তারপর ঐ বিভাগের এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মোমিন চৌধুরীকে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রফেসর করা হয়।
একই ঘটনা ঘটেছে আইন বিভাগে। সেখানে একজন প্রফেসর নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিলে চারজন আবেদন করেন। তাদের তিন জনের ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে এবং একজন তখনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। কিন্তু তাদের উপেক্ষা করে সিলেকশন কমিটি কে এ এ কামরুদ্দীনকে প্রফেসর পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। কে এ এ কামরুদ্দীনের কোন ফার্স্ট ক্লাস নেই। দুটো থার্ড ক্লাস ও দুটো সেকেন্ড ক্লাস রয়েছে। তবে সিন্ডিকেট সিলেকশন কমিটির ঐ অযৌক্তিক সুপারিশ অনুমোদন না করে, তা আবার সিলেকশন কমিটির কাছেই ফেরত পাঠায়।
এমনিভাবে মনোবিজ্ঞান বিভাগেও ঘটে অনিয়ম। সেখানে একজন লেকচারার পদে নিয়োগের জন্য যারা দরখাস্ত করেন তাদের মধ্যে ছিলেন সরকারী কলেজে তিন বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন শিক্ষক, যার অনার্স এবং এম এ পর্যায়ে ফার্স্ট ক্লাস ছিল। কিন্তু সিলেকশন কমিটি একটি পরীক্ষায়ও ফার্স্ট ক্লাস পাননি, এমন একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করে। সিন্ডিকেটে এ বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার জন্য সিলেকশন কমিটির কাছে ফেরত পাঠায়।
শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি বি করিমও সম্প্রতি অপর একটি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিভাগেই এধরনের ঘটনা রয়েছে। কিন্তু এইসব অনিয়ম নিরসনের জন্য কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায় নি। বরং প্রতিনিয়তই এধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।
শিক্ষক নিয়োগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ইতিহাস দীর্ঘ। স্বজনপ্রীতি, বঞ্চনা, খামখেয়ালি ; যথেচ্ছাচার ও নিয়মাবহির্ভূত সকল ব্যবস্থা গ্রহণই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশন এ ধরনের এক ডজন নজির হাজির করেছিল। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ফলে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ একটি পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে চারজন নিয়োগ, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা এখনও সমানে চলছে। তার সঙ্গে চলছে মারাত্নক রকম স্বজনপ্রীতি।
তদন্ত কমিশন রিপোর্টে উল্লেখিত হয়নি এমনি বহু ঘটনার মাত্র একটির উল্লেখ করা যেতে পারে।
জানা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের এম এ ফাইনাল পরীক্ষার দু’টি পত্রের খাতা নিজে দেখেন এবং এক্সটার্নাল পরীক্ষকের কাছে না পাঠিয়ে কেবল তাঁর নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে দেন। পরীক্ষার এক্সটার্নালগণ ঢাকায়ই ছিলেন। কিন্তু ডঃ আবদুল আজিজ তাদের কাউকে খাতা দেননি বলে জানা গেছে। পরীক্ষার ফল বের করার আগে পর্যন্ত তিনি ঐ নম্বরপত্র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দেননি। ঐ পরীক্ষার দু’পত্র এক্সটার্নাল পরীক্ষককে দেখানো হয়নি, তাতে একজন ছাত্রকে তিনি একটি পত্রে ৭২% নম্বর দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ২৬ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের বিষয়ে শতকরা ৭২ নম্বর পাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। অবশ্য ঐ ছাত্র অন্য পত্রে (যা এক্সটার্নাল পরীক্ষক দেখেছেন) শতকরা ৫৮ ভাগ মাত্র নম্বর পান। পরীক্ষার ফল প্রকাশের এই অনিয়ম ঐ বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ করা পর্যন্ত চলে।
ডঃ আজিজের সুপারিশ অনুসারে এম এ-তে ভর্তি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম ও দ্বিতীয় দু’জন ছাত্রকে এডহক ভিত্তিতে ঐ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এক্সটার্নাল পরীক্ষককে না দেখিয়ে যে ছাত্রকে ৭২% নম্বর দেয়া হয়েছিল, তিনি এম এ ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। কিন্তু কোনো শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম হচ্ছে তা বিভাগীয় প্লানিং কমিটিতে পাস করে নিতে হয়।
যে দু’জন ছাত্রকে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় তারা কেউই বিএ অনার্স ক্লাসে প্রথম কোন শ্রেণী পাননি। এমএ ফাইনাল পরীক্ষায় যিনি চতুর্থ হয়েছিলেন (মোহাম্মদ আবদুল হালিম) তিনি এসএসসি পরীক্ষায় সকল বিভাগে প্রথম, এইচএসসি পরীক্ষায় নবম, বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় এবং এম এ ফাইনাল পরীক্ষায় চতুর্থ হন। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে বিভাগীয় চেয়ারম্যান শিক্ষক নিয়োগের সময় তার আবেদন বিবেচনা পর্যন্ত করেননি।
পরে আবদুল হালিম এ ব্যপারে তৎকালীন অস্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর ও বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী অধ্যাপক শামস-উল-হকের কাছে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এডহক ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম অবহিত করে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের আবেদন জানান। অস্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর তার দাবির ব্যাপারে একমত হন এবং বিষয়টি বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডঃ আবদুল আজিজের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠান। কিন্তু ডঃ আজিজ এটি বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানান, যদিও সে সময় বিভাগে একটি শূন্যপদ ছিল। আবদুল হালিম পরে অবশ্য ঐ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
এরপর ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ডঃ আবদুল আজিজ যখন আইনানুসারে বিভাগীয় চেয়ারম্যানশীপ ছেড়ে দেন। তার আগে আগে প্ল্যানিং কমিটির বৈঠক ডাকেন এবং ঐ বৈঠকে আবদুল হালিমকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং তার আমলে সেটাই ছিল প্ল্যানিং কমিটির ঐ একমাত্র বৈঠক। চাকরিচ্যুত্তির জন্য আবদুল হালিমকে কোন কারণ দেখান হয়নি। স্রেফ বলা হয় যে, তার এডহক ভিত্তিতে চাকরির মেয়াদ আর বাড়ানো সম্ভব হবে না। অথচ এর মাত্র দু মাস আগেই তিনি বিভাগের এডহক ভিত্তিতে নিয়োজিত দু’জন শিক্ষকের চাকরির মেয়াদ সম্প্রসারণ করেন।
আবদুল হালিম এ ব্যাপারে আবার ভাইস চ্যান্সেলরকে অবহিত করেন। পরে ভাইস-চ্যান্সেলরের নির্দেশে তাকে পুনর্বহাল করা হয়। এরপর চেয়ারম্যান নূরুল মোমেনের সময় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে তাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়। ১৯৭৭ সালের আগস্টে আবদুল হালিম ‘স্টাডি লিভ’- এ কানাডা যাওয়ার আগে ১০-৩-৭৭ তারিখে, ২১-৪-৭৭ তারিখে এবং ১৮-৮-৭৭ তারিখে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে তিনটি আবেদন করেন এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
জানা গেছে, ডঃ আজিজ-এর বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের এমএ ফাইনাল পরীক্ষার (১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত) ফল বেআইনীভাবে প্রকাশের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি যথারীতি সিন্ডিকেটে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু সিন্ডিকেটের একজন সদস্য অভিযোগ করেন যে ভাইস চ্যান্সেলর বারবার গড়িমসি করে এই বিষয়টি আলোচ্য সূচী থেকে কৌশলে সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে রিপোর্ট দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। তার ওপর কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
আবার গত এম এ ফাইনাল পরীক্ষায় ডঃ আবদুল আজিজ কোর্স শিক্ষক হিসেবে তৎকালীন চেয়ারম্যানের কাছে পিরিয়ডিক্যাল টেস্টের নম্বর প্রভৃতি জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে এম এ পরীক্ষার ফল প্রকাশে ৪/৫ মাস দেরি হয়। পরীক্ষার নম্বর জামা না দেয়ার জন্য বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর ডঃ আবদুল আজিজের নম্বর বাদ দিয়ে এ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুসারে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।
বিষয়টি তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ঐ দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান। ফলে জুন মাসের দু’তারিখে আহ্বায়ক হিসেবে অপর একজনকে নিয়োগ করা হয়। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে এসব চিঠিপত্র পাঠাতে অহেতুক দেরি করা হয়। তারপর ১৬ জুন থেকে বলতে গেলে ঐ তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তদন্ত এখনও চলছে।
১৯৭৩ সালের এমএ ফাইনাল পরীক্ষায় (৭৫ সালে অনুষ্ঠিত) ব্যাপারে তার দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট সিন্ডিকেট আলোচনা হয়নি। ভাইস চ্যান্সেলর ফজলুল হালিম চৌধুরী নাকি বলেছেন যে, দুটো রিপোর্ট একত্রে হাতে এলে আলোচনা হবে।
ইতিমধ্যে ১লা জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডঃ আবদুল আজিজকেই আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন। ‘৭৩-এর অর্ডিন্যান্সের সংশোধনী বলে। উল্লেখ্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ঐ সংশোধনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে ডঃ আজিজই একনাত্র ব্যক্তি যিনি সমিতির সদস্য নন।।
তদন্ত পরিস্থিতি
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তগুলোর প্রায় সব কিছুরই পরিস্থিতি এমনি ঢিলেঢালা শম্বুক গতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশন তাদের রিপোর্টে বিভিন্ন
দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছিলেন। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরও নম্বর বাড়িয়ে প্রিয় ছাত্রদের পাস করান বা ডিভিসন দেয়া সম্পর্কে প্রমাণ উপস্থিত করেছিল তদন্ত কমিশন।
১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর বর্তমানে প্রফেসর ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ফেলকরা ৩২ জন ছাত্রকে সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিএসসি পাস পরীক্ষার একজন, বিকম পাস পরীক্ষার একজন, বিএ পাস পরীক্ষার ২৬ জন, প্রিলিমিনারী এমএ (‘৭২) পরীক্ষার দু’জন এবং এমএ ফাইনাল পরীক্ষার দু’জন প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে ৫ নম্বর গ্রেস দেয়া হয়। মতিন চৌধুরী প্রদত্ত বেআইনী নম্বর ছিল তার অতিরিক্ত। তেমনি ভাবে তিনি আইন পরীক্ষার ২৯ জন প্রার্থীকে ও বেআইনীভাবে নম্বর বাড়িয়ে পাস করান।
তদন্ত কমিশন রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে, দু’জন ছাত্র ছাত্রী শিরিন আখতার (রোল ১৬২৬৪) ও নূরুল ইসলাম সিকদার (রোল ৪৩৮৪) পরীক্ষার ফল বের হয়ে যাওয়ার পর তাদের বাংলা বিষয়ের নম্বর পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন জানায়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মিসেস নীলিমা ইব্রাহিমের কাছে তা পাঠান। মিস নীলিমা ইব্রাহিম তাদের নম্বর পরীক্ষা করার বদলে শিরিন আখতারের নম্বর ৩৩ থেকে বাড়িয়ে ৪০ এবং নূরুল ইসলামকে ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৮ করে দেন। যা মারাত্মক রকমের দুর্নীতি। বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স অনুসারে কোনো বিশেষ খাতা পুনর্বিবেচনার নিয়ম নেই। প্রয়োজন বোধে নম্বরের যোগ ঠিক আছে কিনা, বা কোনো উত্তরে নম্বর দেয়া হয়েছে কিনা তাই পরীক্ষা করা যায়। একই কাজ করেন অর্থনীতি বিভাগের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ কে টি হোসেন। যাহোক পরীক্ষা নম্বরের নিয়ন্ত্রক ডঃ নীলিমা ইব্রাহীমের কাছে চিঠি লিখে পাঠান যে, মিসেস ইব্রাহিমের খাতা পুনঃপরীক্ষা করার ক্ষমতা নেই। এবং ছাত্রদের লিখে পাঠান যে, তাদের খাতায় নম্বর বসানো নিয়ে কোনো গোলমাল নেই। পরে দেখা যায় যে, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যে চিঠিতে মিসেস নীলিমা ইব্রাহিমকে ঐ কথা লিখে পাঠান তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মতিন চৌধুরী খাতা পুনঃপরীক্ষাও এবং নম্বর বৃদ্ধি অনুমোদন করে নোট দেন। তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নোট উপেক্ষা করে এটা করেন। যা করবার তার কোনো অধিকার নেই। এটি ছিল একটি মারাত্মক অনিয়ম। তাছাড়া খাতা পুনঃ পরীক্ষা করাবার প্রয়োজন হলে তা কোনো একটি খাতা পুনঃপরীক্ষা করার নিয়ম নেই। সকল খাতাই পরীক্ষা করানোর নিয়ম।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কারও বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নি। ফলে নতুন নতুন ক্ষেত্রে নম্বর বৃদ্ধির নজির সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাস বিভাগের পাস ও সাবসিডিয়ারী পরীক্ষার পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ কে এম মোহসীন কয়েকজন পরীক্ষার্থীর নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্ক্রুটি নাইজারগণের হাতে দুটো কেস ধরে পড়ে। প্রায় আট-ন মাস আগে তার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু সে তদন্তের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত সিন্ডিকেট দাখিল করা হয় নি। কেস ধরা পড়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। নম্বর বৃদ্ধি সম্পর্কে লোক প্রশাসন বিভাগের মিসেস মাহতাব ও সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
তারা ট্যাবলেট করতে গিয়ে নম্বরে গোলমাল করে ফেলেন। তাতে নাকি প্রথম শ্রেণী পাওয়া একজন ছাত্র দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নাকি তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করেছিল। রিপোর্টে নাকি তাদের দোষ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় নি।
তেমনিভাবে নীতিবিগর্হিত কার্যকলাপের জন্য স্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগের ডঃ মুস্তফার বিরুদ্ধে গঠন করা হয়েছিল তদন্ত কমিটি, আজ পর্যন্ত সে কমিটি কাজ শেষ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে ডঃ গোলাম মোস্তফা অবশ্য বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। তিনি অপসারিত হয়েছেন কিনা জানা যায়নি৷ তবে তার স্থলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়বদ্ধ একজন শিক্ষককে আনা হয়।
এবং তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দান করে। এমনি আর একটি ঘটনা। ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তরুণ অধ্যাপক মোহাম্মদ জাকারিয়া খান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ল’ পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষায় নকল করার দায়ে তার পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। তবে তিনি এখনও শিক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এই তদন্ত কতদিন চলবে? যদি তার দোষ প্রমাণিত হয়, তবে কি তার সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রমাণিত দোষীদেরও শাস্তি হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত দ্রুত শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও তা কার্যকর করা হয়েছে। ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন তরুণ বিবাহিতা লেকচারার আলতাফ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একজন ছাত্রীকে বিয়ে করেন। এই দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগে অবিলম্বে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অভিযোগঃ নীতিবিগর্হিত কার্যকলাপ। অপর কেসটি হচ্ছেঃ অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার নুরুল (অস্পষ্ট) বিদেশে থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী জনৈকা ছাত্রীকে এখান থেকে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে পাঠিয়ে দেন। সেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি চাকরিচ্যুত হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজনঃ এরা দুজনেই লেকচারার।
শাস্তি, মওকুফ, সুবিধা প্রভৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করা, এক শ্রেণীর শিক্ষকের ক্লাস না নেয়া, দোষীদের শাস্তি না হওয়া, এখন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়মিত ঘটনা। কখনও কখন এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক, যেকথা আগেও উল্লেখিত হয়েছে। কখনও করে এক শ্রেণীর কর্মচারী। এই প্রক্রিয়া ১৯৭২ সাল থেকে চালু হয়েছে। আজ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে কলঙ্কিত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা বাইরে পাচার করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এলডি এ্যাসিস্ট্যান্ট (তখন) গিয়াসউদ্দীন আহমদ অভিযুক্ত হন। পরীক্ষা সমূহের নিয়ন্ত্রক ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছ থেকে তাকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেন ‘৭২ সালের ৩১ জুলাই। ১২ আগস্ট ভাইস চ্যান্সেলর বিষয়টি তদন্তের জন্য আইন বিভাগের কে এ এ কামরুদ্দীনকে চেয়ারম্যান করে আর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিনি অক্টোবর মাসে রিপোর্ট দেন যে, অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং তাকে চাকরি থেকে অপসারিত করা হোক।
১০ অক্টোবর তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বিষয়টি আইন গত দিক পরীক্ষার জন্য এ্যাডভোকেট সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের কাছে পাঠান। ৩০ অক্টোবর এ্যাডভোকেট তার রিপোর্টে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট তথ্য ভিত্তিক। সুতরাং তাকে অপসারণে আইনগত কোনো বাধা নেই। এই অবস্থায় তখনকার তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী সমিতির সভাপতি (বর্তমান স্টাফ ওয়েলফেয়ার অফিসার) একটি নিজস্ব তদন্ত কমিটি করে গিয়াসউদ্দীনকে নির্দোষ বলে একটি রিপোর্ট তৈরি করে ভিসির কাছে পেশ করেন। ভাইস চ্যান্সেলর বিষয়টি আবার এ্যাডভোকেটের কাছে পাঠান। এ্যাডভোকেট তার আগের মতই পুনর্ব্যাক্ত করেন।
পরে ১৯৭৩ সালের ১২ মার্চ ভাইস চ্যান্সেলর তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার আদেশ দেন। কিন্তু ১২ এপ্রিল ডঃ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব হস্তান্তর করার দিন তার ঐ আদেশ পরিবর্তন করে গিয়াসউদ্দীনকে কন্ট্রোলারের অফিস থেকে রেজিস্ট্রারের অফিসে বদলি করে দেন।
২৬ এপ্রিল নয়া ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মতিন চৌধুরী এক নির্দেশে বলেন যে, ‘ গিয়াসউদ্দীনের বরখাস্ত আদেশ বহাল থাকবে’।
কিন্তু ২ মে (‘৭৩) তিনি আবার তার আদেশ বদলে নতুন আদেশ দেন। তাতে তিনি লেখেন যে ‘গিয়াসউদ্দীন আহমদের বরখাস্তের আদেশ পুনর্বিবেচনা করে তাকে অবিলম্বে রেজিস্ট্রারের অফিসে বদলি করা হল’। পরে ১৯৭৪ সালের ১৬ই এপ্রিল তাকে প্রমোশন দিয়ে ইউডি এ্যাসিস্ট্যান্ট করা হয়। এভাবেই এক একটি ঘটনা ঘটে। খানিকটা নড়াচড়া হয় তারপর আবার পাথরের মত স্থবির হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা পাচারের শাস্তি প্রমোশন। তেমনিভাবে ৭৪ সালে অনুষ্ঠিত বিএ পাস ও সাবসিডিয়ারী পরীক্ষায় নকল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী পরিষদ সিন্ডিকেট দু’জন ছাত্রকে তিন বছর করে এবং ১ জন ছাত্রীকে পাঁচ বছরের জন্য এক্সপেল করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল সিন্ডিকেট ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বহিস্কৃত ও তাদের একজনের আইনজীবী অভিভাবকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মতিন চৌধুরী অত্যন্ত বেআইনীভাবে ২৪ জুন (‘৭৫), ৪ জুলাই (৭৫) ও ৫ জুলাই (৭৫) তাদের শাস্তি হ্রাস করে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করার আদেশ দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে ভাইস-চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত রদবদল করতে পারেন না।
সাম্প্রতিককালে লোকপ্রশাসন বিভাগের দু’জন শিক্ষক নজমুন্নেসা মাহতাব ও সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা ট্যাবুলেশনের কারচুপি করে একজন ছাত্রের একটি বিষয়ে ৫৮ এর স্থলে ৩৪ বসিয়ে দেন। ফলে ঐ ছাত্রটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। পরে ঐ প্রার্থীর আবেদন বিবেচনা করে সিন্ডিকেট দেখতে পায় যে, সে ৩৪ নয়, ৫৮ পেয়েছে। তারপর ঐ ছাত্রকে সিন্ডিকেট প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে। মিসেস মাহতাবের ও সাইদুর রহমানের ট্যাবুলেশনে এই কারচুপি তদন্ত করার জন্য সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করার পর মিসেস নজমুন্নেসা মাহতাবকে ‘স্টাডি লিভ’ দিয়ে বিদেশে যাবার সুযোগ দেয়া হয় এবং সাইদুর রহমানও নাকি ইরানে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। উল্লেখ্য নজমুন্নেসা মাহতাব রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্নীয়া। ফলে ঐ ঘটনার তদন্ত এখন হিমাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালক আহমদ উল্লাহ’র বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে ঐ বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকগণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে তাকে সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সমাজকল্যাণ বিভাগে যানও না, এবং কোনো ক্লাসও নেন না, অথচ নিয়মিত বেতন পেয়ে যাচ্ছেন।
এমনি অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে ‘অতিরিক্ত এডিশনাল রেজিস্ট্রার’ নিয়োগ নিয়েও। ভাইস চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক এস বি হোসেনকে তার স্ব দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তাকে ‘এডিশনাল রেজিস্ট্রার’ নিয়োগ করেছেন। জানা গেছে এর জন্য তিনি অতিরিক্ত কোনো ভাতা বা বেতন গ্রহণ করেন না। ঐ জায়গায় একজন অনারারী এডিশনাল রেজিস্ট্রারের কি প্রয়োজন তাও অবশ্য জানা যায়নি। যদি এডিশনাল রেজিস্ট্রারের কোনো প্রয়োজন থাকে তবে তা বিজ্ঞাপন দিয়ে কেন নিয়োগ করা হচ্ছে না— এ প্রশ্ন সবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রেজিস্ট্রার নূরউদ্দীন আহমদের এ বছরই অবসর নেবার কথা ছিল। কিন্তু জানা গেছে, সিন্ডিকেট তাকে ঐ চাকরিতে দু’বছরের জন্য পুনঃ নিয়োগের সুপারিশ করে। তাই তিনি আরও দু বছর ঐ চাকরিতে থাকবেন। অনেকেরই ধারণা, নূরউদ্দীন আহমদের পর এসবি হোসেনকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের জন্য তাকে অবৈতনিকভাবে এডিশনাল রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে পরবর্তীকালে তাকে অভিজ্ঞতা দেখিয়ে এবং এত দিন বিনা বেতনে সেবার কথা বলে নিয়োগ করা সহজতর হয়।
প্রশাসনিক অব্যবস্থাও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মারাত্নক সঙ্কট। কোর্স সিস্টেম অনুষ্ঠিত অর্থনীতি বিভাগের গত অনার্স পরীক্ষার সকল ছাত্রের সকল কোর্স নম্বর পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষকগণ যথারীতি ক্লাস নেননি এবং ছাত্ররা পরীক্ষা দেয়নি। পরে প্রাপ্ত অসম্পূর্ণ নম্বরের ভিত্তিতেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালিয় কর্তৃপক্ষ কাউকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিতেও সাহস করেনি বলে জানা যায়।
জানা গেছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের ক্লাস না নেয়ার অভিযোগ ছিল অনেক দিনের। শেষে পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটে যে, ভাইস চ্যন্সেলর ঐ বিভাগের শিক্ষকদের ডেকে নিয়মিত ক্লাস নেবার অনুরোধ জানান। কিন্তু কোনো নোটিশ দিতে পারেন নি।
তেমনিভাবে, এই অবস্থারই সুযোগ নিয়েছেন, ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান কবির চৌধুরী। তিনি সম্প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়ন, এ্যাঙ্গোলা ভ্রমণ করে এসেছেন। জানা গেছে, যাবার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে যাননি বা কোনো দরখাস্তও দেননি। এবং তার অবর্তমানে যিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন, তাকেও লিখিত কোনো চিঠি দেয়া হয় নি। কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধেও কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই কি নিয়ম?
দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে প্রশাসনিক অব্যবস্থা আজ এই পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে।
বিভাগ ভাঙ্গা, বিভাগ গড়া
দেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ ভেঙ্গে বিভাগ গড়ার হিড়িক পড়ে যায়। তারই ফলশ্রুতিতে কমার্সের দু’টি বিভাগকে চার টুকরো করে গঠিত হয় ফিন্যান্স, মার্কেটিং এ্যাকাউন্টিং ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভেঙ্গে বানানো হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থনীতি বিভাগ ভেঙ্গে দু টুকরো করে গঠিত হয় অর্থনীতি ও তাত্ত্বিক অর্থনীতি বিভাগ। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সামান্য এক টুকরো নিয়ে গঠিত হয় পদার্থ বিজ্ঞান আর তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ। বাইওকেমিস্ট্রির টুকরো টুকরা নিয়ে গঠিত হয় মাইক্রো বাইওলজি বিভাগ, প্রভৃতি।
ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগ নিয়েও আছে প্রশ্ন। ইসলামের ইতিহাস ও ইতিহাস বিভাগের পাঠ্যসূচী বলতে গেলে একই। ইতিহাসে জোর দেয়া হয় ইউরোপীয় অংশে, আর ইসলামের ইতিহাসে জোর দেয়া হয় মধ্যপ্রাচ্য অংশ। কিন্তু ঐ দুই বিভাগেই আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, আধুনিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারতে মুসলমান শাসন, আধুনিক ইউরোপ, বৃটিশ ইন্ডিয়াসিহ বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত পড়ানো হয়। তা হ’লে এই দুটি বিভাগ আলাদা রাখার যুক্তি কি? এই দুই বিভাগে প্রতিটি বিষয় পড়ানোর জন্য রয়েছেন আলাদা আলাদা শিক্ষক। কিন্তু একই শিক্ষক দিয়েও দু’ বিভাগেরই অভিন্ন বিষয় পড়ানো সম্ভব। তা’হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের অপচয় কমতে পারে।
তেমনিভাবে ফিন্যান্স, মার্কেটিং, এ্যাকাউন্টিং ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আট পত্রের মধ্যে চারপত্রই অভিন্ন। অথচ তা পড়ানর জন্য নিয়োগ করা হয়েছে আলাদা আলাদা শিক্ষক। কোন গৌরী সেন গুণছে টাকা?
তেমনি অভিন্ন বিষয় রয়েছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের। তার জন্যও নিয়োজিত আছেন আলাদা আলাদা শিক্ষক।
গড়ে উঠেছে অর্থনীতি বিভাগ ভেঙ্গে আর একটি বিভাগ তাত্ত্বিক অর্থনীতি, আগে এর সকল বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল অর্থনীতিতে।
তেমনি এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ভেঙ্গে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলার অন্তরালে। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগেরই একটি বিষয় ছিল তত্ত্ব।
ঐ তত্ত্বকে আলাদা করে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে গঠন করা হয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। ঐ বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল, ভাল ছেলেদের গবেষণামূলক কাজের সুবিধা করে দেয়া। যদিও এসব সুবিধা এই বিভাগটি খোলার আগেও চালু ছিল। লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের গবেষণায় আরও সুবিধা দান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো বিভাগ খোলা হয়েছে, প্রকৃতিগত দিক থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান তার মধ্যে ব্যতিক্রম। এবং এই বিভাগটি সম্ভবত পারমাণবিক। কারণ এই বিভাগে একমাত্র এমএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের পড়ার সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য বিভাগে বিকল্প বিষয়ের মত। কোনো প্রিলিমিনারাই ক্লাসও এখানে হয় না। এই বিভাগে একজন মাত্র শিক্ষক, একজন অফিস এ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন চেয়ারম্যান এবং একজনই সব।
জানা গেছে, বিভাগটি খোলার পর ১৯৭৬ সালের ৯ জন, ১৯৭৭ সালে ৪ জন, ১৯৭৮ সালে ৪ জন ছাত্র ঐ বিভাগে এমএ ফাইন্যাল ইয়ারে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছেন। চেয়ারম্যান জানিয়েছেন এদের সংখ্যা কখনও ন’জনের বেশি হয়নি। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একমাত্র শিক্ষক প্রফেসর হারুনুর রশীদ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঐ বিভাগে চেয়ারম্যান নিযুক্ত ছিলেন। ঐ বিভাগের ঐক’জন ছাত্রের ক্লাস নিতেন পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের শিক্ষকরাই। কোনো নতুন শিক্ষক সেখানে নিয়োগ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবার কথা ১ জুলাই থেকে। ঐ ১ জুলাই থেকেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একমাত্র শিক্ষক চেয়ারম্যান ডঃ হারুনুর রশীদকে বদলি করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বদলি করা হয় এবং সেদিন থেকেই তিনি ঐ বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে একমাত্র শিক্ষক বিশিষ্ট এই বিভাগটি এখন শূন্য হয়ে পড়েছে। যদিও নতুন শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই বিভাগে বদলি হয়ে দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত প্রফেসর হারুনুর রশীদ দুটি বিভাগেরই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাবেন।
গত চার বছর ধরে চালু থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আজ পর্যন্ত বিভাগটি অনুমোদন করেনি। ফলে এই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ করা যাচ্ছে না। তথাপি গত কয় বছরে ঐ বিভাগের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
আসলে এইসব বিভাগ গঠনের পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন লোককে সুবিধামিত নিয়োগের ব্যবস্থা করা। এই বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়া প্রফেসর এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ইত্যাদি হওয়া এবং করা। বলতে গেলে সে কারণেই একের পর এক বিভাগ গঠিত হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন। আমাদের দেশ দরিদ্র সেখানে যদি একটি বিভাগেই কাজ করা সম্ভব হয়, তা হলে নতুন নতুন বিভাগ না খুলে বরং যেসব বিভাগের পড়াশোনায় বিশেষ পার্থক্য নেই সেগুলো একত্রিত করা এবং পড়ানোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা উচিত৷ তা’হলে এদেশের দরিদ্র করদাতা জনগণের অর্থের অপচয় কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মনে করেন। নতুন বিভাগ খোলার আগে তার সব দিক যাচাই করে দেখা দরকার।। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে ছাত্র ভর্তির হার হ্রাস পেতে পেতে প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। এগুলো সম্পর্কেও বিবেচনা করা দরকার। এবছর আরবী বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৫টি আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৯ জন। ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ৭৫টি আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৪৪ জন। উর্দু বিভাগে বরাদ্দকৃত ১০টি আসনে ভর্তি হয়েছে ১ জন। আর ফারশী বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ১০টি আসনে কেউ ভর্তি হননি।
বাড়ি ভাড়া, বাড়ি বরাদ্দ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাট বা কোয়ার্টার না পেলে তাদের বেতনের শতকরা ৩৫ ভাগ বাড়ি ভাড়া ভাতা পান। এই বাড়ি ভাড়া ভাতা নিয়ে অনিয়মের অবসানের জন্য সিন্ডিকেট ১৯৭৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী সিদ্ধান্ত নেয় যে,
‘ স্বামী বা স্ত্রী উভয় যদি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারী/ আধাসরকারী/ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন এবং তাহাদের একজনের নামে বাসা বরাদ্দ থাকে এবং তাহারা একত্রে উক্ত বাসায় বসবাস করেন, তবে অপর জন ( স্বামী বা স্ত্রী) বাসা ভাড়া ভাতা পাইবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর কর্মচারীদের স্বামী কিংবা স্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে/ সরকারী/ আধাসরকারী অফিসে অথবা অন্য কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন কিনা এবং করিলে তাহাদের কাহারও নামে (স্বামী বা স্ত্রী) অফিসের বাসা বরাদ্দ আছে কিনা সেই মর্মে হলফনামা চাওয়া হউক। তাহাদের আরও জানাইয়া দেওয়া
হউক ভবিষ্যতে তাহাদের স্বামী অথবা স্ত্রীর চাকুরীর বাসার বিষয়ে কোন পরিবর্তন ঘটিলে সঙ্গে সঙ্গে তাহা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করিতে হইবে’
ফেব্রুয়ারী মাসে ঐ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও গত ৩০ জুন তারিখে প্রদত্ত এক প্রশ্নোত্তরে সিন্ডিকেটের সেক্রেটারী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নূরউদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর কর্মচারী কাছে এখনও পর্যন্ত সে ধরনের কোনো হলফনামা চায়নি। এই চারমাস পরেও কেনো তা চাওয়া হয়নি, সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য কিছু জানাননি। সিন্ডিকেটের প্রশ্নোত্তর থেকে জানা গেছে যে, সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধান্তের আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের আইন প্রচলিত ছিল।
অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষায়িত্রী রয়েছেন, যারা স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে সরকারী/ আধাসরকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বাড়িতে বসবাস করেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত শতকরা ৩৫ ভাগ বাড়িভাড়া নিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণের মধ্যে এর একমাত্র ব্যতিক্রম ইতিহাস বিভাগের নবনিযুক্ত প্রফেসর ডঃ সালাহউদ্দীন আহমদ। তবে যেক্ষত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন, তাদের বেলায় বাড়ি ভাড়া ভাতার আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, রসায়ন বিভাগের এস এন নবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শামসুল হুদা হারুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক স্ত্রী/স্বামীর সঙ্গে সরকারী/আধাসরকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বসবাস করেও বাড়ি ভাড়া ভাতা নিচ্ছেন। এর ফলে বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ টাকার কারচুপি হচ্ছে বলে জানা গেছে। আশ্চর্যের বিষয়, সরকারী অডিট বিভাগও এই কারচুপি ধরতে পারেন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ি/ফ্ল্যাট বন্টন নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। ফ্ল্যাট বন্টন করার নিয়ম হচ্ছে পয়েন্টের ভিত্তিতে। পয়েন্ট নির্ধারিত হয় পদ, বেতন, মেধা ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু ‘মানবিক কারণের’ অজুহাতে এই বাড়ি বন্টন নিয়েও বহুবিধ কারচুপির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভাইস চ্যান্সেলর নিজস্ব ক্ষমতায় কিছু বাড়ি বরাদ্দ করেন। এবং ঐ ‘মানবিক কারণের প্রতাপে’র ফলে নাকি পয়েন্ট ভিত্তিতে বাড়ি বন্টনের এখন প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, বাড়ি দখলেও নতুন কৌশল তৈরি হয়েছে। একজন জুনিয়র শিক্ষক প্রথমে কোনো হলে হাউস টিউটর হিসেবে যোগ দেন। হলে পর্যাপ্ত বাড়ি না থাকায় তাদের জরুরী ভিত্তিতে উপাচার্যের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু এভাবে দু’ এক বছর গেলে হাউস টিউটরশীপ ছেড়ে দেয়ার পরও তারা ঐ বাড়ি ছেড়ে দেন না। ফলে পয়েন্টের বিষয়টি চাপা পড়ে থাকে। সে কারণেই প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের হাউস টিউটর নিয়োগ করা হোক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারেও কান দেননি।
উপসংহার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি নিয়ে সম্ভবত ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ‘আস্তাবল পরিষ্কার করিতে হইবে’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার কদিন পর বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকাও প্রায় একই ধরণের একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। ১৯৬২ সালে সংবাদ থাকে ‘আস্তাবল’ বলে অভহিত করেছিল, সুদীর্ঘ ১৭ বছর পরও তার কোনো উন্নতি হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অসন্তোষের মূল কারণ সম্ভবত নিহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি আর অরাজক অবস্থার ভেতরই। না এসব ঘটনার সামাজিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কোনমতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে ছাত্র অসন্তোষ পর্যন্ত কোনটিরই সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়, দিতে পারেনি কোন সমাধানও। কর্তৃপক্ষ বরং এক শ্রেণীর শিক্ষক ছাত্রকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে, বিশেষ সুযোগ দিয়ে, বিশেষ বিবেচনা করে অন্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে উস্কানি দিয়েছেন। তার ফলে ঘটেছে নতুন নতুন হাঙ্গামা।
রোকেয়া হলে দু’জন ছাত্রীর বহিষ্কারের ঘটনা নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের উন্নাসিকিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কোনো প্রতিকার হয়নি।
এই অশুভ বৃক্ষ ‘৭২ থেকে এ পর্যন্ত বেড়ে বেড়ে আকাশ স্পর্শ করেছে, ডালপালা বিস্তার করে পরিবেশ কলুষিত করেছে, নতুন নতুন পাপ জন্ম দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেছেনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি শ্রেণী। একটি সুবিধাভোগী অপরটি সুবিধালোভী। এই দুই শ্রেণীর মূলোৎপাটন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি অসম্ভব।
ছাত্রনেতারা কি ভাবছেন
সাক্ষাৎকারঃ হাসান হাফিজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যেভাবে দুর্নীতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঠিক তার বিপরীতে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনেরও সূত্রপাত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে ছাত্র আন্দোলন বহুধা বিভক্ত এবং অতীতের তুলনায় বহুলাংশে দূর্বল হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অশান্ত পরিবেশ সম্পর্কে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ কি ভাবছেন সেটা জানা প্রয়োজন। ডাকসু নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ভেতর যারা ডাকসুর সর্বোচ্চ পদে (সহ-সভাপতি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। ১৪টি ছাত্র সংগঠনের ১৪ জন নেতার কাছে আমরা ৫ টি প্রশ্ন করেছি।
প্রশ্নগুলো হচ্ছেঃ—
১। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে অসন্তোষ বিরাজমান, আপনার মতে এর কারণ কি?
২। এ অসন্তোষ কিভাবে দূর করা যেতে পারে?
৩। আপনি কি মনে করেন ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হবে?
৪। নির্বাচনে আপনার এবং আপনার প্যানেলের জয়ী হবার সম্ভাবনা কতটুকু?
৫। বিজয়ী/ পরাজিত হলে আপনার প্রধান কাজ কি হবে?
যে সকল সংঠনকে প্রশ্ন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (মান্না), বাংলাদেশ ছাত্র লীগ (কাদের), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সংগ্রামী ছাত্র ঐক্য, জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (প্রধান), বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (হাবিব), জাতীয় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মানু), গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্র লীগ (মোস্তাফিজ)।
আ ফ ম মাহমুদুর রহমান মান্না
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (মান্না)
১। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে যে অসন্তোষ বিরাজ করছে তার কারণ বের করতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই বর্তমান সমাজ কাঠামোর দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। কারণ, শিক্ষাঙ্গন সমাজ কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একটি অপরটির প্রতিচ্ছবি। সারা দেশ জুড়ে যে গভীর সঙ্কট জাতীয় জীবনে যে সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি ও শিক্ষাঙ্গনে যে লজ্জাজনক দূরবস্থা— তাকে একত্রীভূত করে দেখা দরকার। দীর্ঘদিন দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়েছে। অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে। বিদেশী সাহায্য নির্ভর বাজেট দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে হুমকির সম্মুখীন করেছে এবং সুস্থ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজ করছে তমসাচ্ছন্ন অন্ধকার। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরাচারী দুঃশাসনের চরম রূপ প্রত্যক্ষ করছি আমরা। এক কথায় দেশ আজ সর্বগ্রাসী সংকটের সম্মুখীন। বর্তমান পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রেখে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গোটা সমাজের অধিবাসীদের মতই আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও ছাত্ররা জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না।তাই তাদের মাঝে বিরাজ করছে বিরাট হতাশা ও নৈরাশ্য।
তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার সহায়ক পরিবেশ অনুপস্থিত। সরকার বিভিন্ন অপকৌশলের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তি ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাই আমরা দেখছি একশ্রেণীর ছাত্রকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের রাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সংঘঠিত হচ্ছে বিভিন্ন অসামাজিক ও অছাত্রসুলভ কার্যকলাপ। এবং শুনতে পাচ্ছি অস্ত্রের ঝণঝণানি। তাই এ ধরনের অসুস্থ ও অসহনীয় পরিবেশে শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব নয় বলে ছাত্র সমাজের মাঝে অসন্তোষ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠিত হতে পারেনি এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিধিত্বশীল ছাত্র সংসদ না থাকায় সমস্যা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে।
২। আমি আগেই বলেছি এ অসন্তোষ কোন আলাদা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়।কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেহ গোটা সমাজের সমস্যাগুলো। তাই সমাজকাঠামোয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া ছাত্র সমাজের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ সম্পূর্ণরূপে দূর করা যেতে পারে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ছাত্রদেরকে অধিকতর সচেতন করা গেলে তখন এ অসন্তোষ দূর করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে— যা কর্মমুখী গণশিক্ষা ও নতুন সমাজ নির্মাণের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করবে।
৩। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কোন নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে পরশ্রমজীবীরাই ক্ষমতায় থাকে। তারা তাদের শ্রেণী স্বার্থকে রক্ষা করার জন্যে নির্বাচনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সমাজের অন্যান্য অংশের তুলনায় অধিকতর সচেতনত বলে ডাকসু নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ হতে পারে এবং এ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে তা নির্ভর করছে অংশগ্রহণকারী ছাত্র সংগঠনগুলোর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যাপক ছাত্রদের সচেতনতার ওপর।
৪। আমি আশা করছি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল ডাকসু ও হল সংসদসমূহ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবে। কারণ শুধুমাত্র আমাদের সংগঠনই অতীত ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল কর্মতৎপরতা ও ঐকান্তিরতার মাধ্যমে। ৬২, ৬৯, ৭১, ৭৩- এর ডাকসু এ কথারই যথার্থ প্রমাণ করে। তাই সঠিক রাজনীতি ও ছাত্র সমাজের চেতনাই আমাদের বিজয়ের গ্যারান্টি।
৫। বিজয়ী হলে আমাদের প্রধান কাজ হবে সমাজের প্রতিটি অংশের দাবি ও ছাত্র সমাজের সমস্যাবলী সমাধানের লক্ষ্যে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা। এবং দেশকে স্বৈরশাসন ও পুঁজিবাদী পীড়ন থেকে মুক্ত করে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধানকারী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তাই তাদের পুঁজির শোষণ থেকে মেহনতী মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাত্র সমাজের নৈতিক দায়িত্ব ।
নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকে। এবং আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। তাই পরাজিত হলে অতীতের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের মাধ্যমে নতুনভাবে অগ্রসর হবো।
এনামুল করিম শহীদ
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
১। আমি মনে করি নিম্নলিখিত কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
(ক) উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। বৃটিশ ঔপনিবেশিক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
(খ) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হলের অপ্রতুলতা।
(গ) লাইব্রেরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বইয়ের অভাব অথচ ডিপার্টমেন্টগুলোতে সেমিস্টার সিস্টেম চালু রয়েছে।
(ঘ) হলগুলোতে খাবারের মান অনুন্নত। ছাত্রদের মেধাশক্তি বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন করা হয় না।
(ঙ) হল সমূহে অছাত্র বহিরাগত গুন্ডাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশ।
(চ) ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রদের বিদেশী শক্তির স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এদেশের কিছু জাতীয় রাজনৈতিক দল।
(ছ) বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পবিত্রতা রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতা।
(জ) ছাত্র হত্যা, নারী নির্যাতন, ছিনতাই এ সমস্ত অসামাজিক কার্যকলাপ রোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দারুণ উদাসিন্যতা যার কারণে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে জীবনের অনিশ্চয়তা৷ ত্রাস ও ভীতির মাঝে তাদের পড়াশুনো করতে
হচ্ছে। এবং
(ঝ) শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং উপাচার্যগণ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন।
২। ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যাগুলোর সমাধানের আশু নিশ্চয়তা প্রদান এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গঠনকল্পে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই মূল সমস্যার সমাধান হতে পারে।
৩। আমি ডাকসু নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করি না। কারণ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের অধিকাংশ সদস্য হলেন বাকশালী রাজনীতির ধারক ও বাহক এবং বর্তমান উপাচার্য ও সেই পথের অনুসারী। সুতরাং এই সিনেটের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার প্রশ্নই আসতে পারে না।
৪। (অস্পষ্ট) প্যানেল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলের প্যানেল। আমাদের সংগঠনের রাজনীতি বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জাতীয়তাবাদী দলের সভাপতি (অস্পষ্ট) এই রাজনীতির পক্ষে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ রায় দিয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র সমাজ আমাদের রাজনীতির পক্ষে রায় দেবেন। আমরা বিপুল ভোটে বিদেশী শক্তিগুলোর এদেশীয় এজেন্টদেরকে পরাজিত করে ডাকসুতেও জয়ী হব। (অস্পষ্ট)
৫। পরাজিত হবার আশা আমরা কখনো করিনা। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রথমেই আমাদের কাজ হবে ছাত্র-ছাত্রীদের বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ অতীতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ডাকসুতে যেয়ে ছাত্র সমস্যার সমাধান না করে ডাকসুর টাকা আত্নসাৎ করেছেন। তারা ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অরাজকতা সৃষ্টি করেছেন এবং নিরীহ ছাত্রদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। ছাত্র সমস্যা থেকে দূরে সরে গিয়ে বিদেশী অর্থে বলীয়ান রাজনৈতিক দলগুলো হাতিয়ার হিসেবে ছাত্র সমাজকে ব্যবহার করেছে। আমরা এ সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য বদ্ধপরিকর। উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করাই হবে আমাদের প্রধানতম কাজ। গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের পার্টটাইম চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন শেষ হবার পর ছাত্রদের ও ছাত্রীদের চাকরির পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান আমরা বর্তমান সরকার থেকে আদায় করতে বদ্ধপরিকর।
ওবায়দুল কাদের
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (কাদের-চুন্নু)
১। ঔপনিবেশিক আমলের উপহার বর্তমান জরাজীর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাই ছাত্র অসন্তোষের মূল কারণ।
২। বর্তমান কেরানী গড়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিউ মডেল এ রিকাস্ট করা তথা একটা গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারলে এ অসন্তোষ দূর করা সম্ভব। এ ব্যাপারে আমরা ডঃ কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের মাঝে সমাধান খুজে পাই।
৩। আমরা আশাবাদী।
৪। প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
৫। বিজয়ী হলে হাজার বছরের এ ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পদ্ধতিগত বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে স্বৈরতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন রচনায় আমাদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করব। পরাজিত হলে ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতঃ আদর্শ সংগ্রাম অব্যাহত রাখব।
কাজী আকরাম হোসেন
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
১। সন্তুষ্ট হওয়ার কারণগুলোর অনুপস্থিতিই অসন্তোষের কারণ। শিক্ষার সমস্যা, শিক্ষার পরিবেশ, অর্থনৈতিক অসঙ্গতি, সরকার ও সরকার দলের গণবিরোধী কার্যাবলী, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে অসহিঞ্চুতা ও অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ, শিক্ষা শেষে চাকরি না পাওয়ার মতো অসংখ্য সামাজিক সমস্যা ছাত্রদের অসন্তোষের মূল কারণ।
২। শিক্ষা সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, সন্ত্রাস ও হানাহানি বন্ধ করা, সুস্থ ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক ভাবে এবং সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান অসন্তোষ দূর করতে পারে।
৩। প্রশ্নটা হাইপোথিটিক্যাল। আমরা আশাবাদী যে সুষ্ঠুভাবেই নির্বাচন হবে। তবে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র রয়েছে।
৪। আমাদের সংগঠনের ভিত্তি, সাধারণ ছাত্র সমাজের ব্যাপক সমর্থন এবং সর্বোপরি সঠিক, যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান আপোষহীন বিপ্লবী নেতৃত্বের প্রতি ছাত্র সমাজের আস্থা এবং শিক্ষা জীবনের মৌলিক সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে আমাদেরকেই বিজয়ী করবে।
৫। যে কোন অবস্থাতেই আমাদের দায়িত্ব সুস্পষ্ট। প্রথমতঃ শিক্ষা সমস্যা সমাধানের আন্দোলন গড়ে তোলা, দ্বিতীয়তঃ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনসমূহের মধ্যে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা বজায় রাখা, কলুষমুক্ত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে বিতর্ক বা বিভেদ থাকতে পারে কিন্তু ছাত্র সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে কারো সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়— মুক্ত ও উদার মন নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার।
কাজী আবদুল্লাহ আল মামুন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (প্রধান)
১। ছাত্র সমাজ এদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যেকটি ছাত্র কোন না কোন পরিবারের সদস্য; সমাজের সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিক। তাই পারিবারিক অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাজিক ক্ষেত্রে তথাকথিত নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীর অবিচার অত্যাচার ও অন্যায় আচরণ এবং ব্যক্তি জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ এসব কারণে বর্তমান সমাজ কাঠামো তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। তার উপর ইদানীং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়েছে সেমিস্টার সিস্টেম। থাকার জায়গা নেই, লাইব্রেরীতে বই নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই অথচ সেমিস্টার সিস্টেমের নামে ছাত্র-ছাত্রীদের সপ্তাহের এ মাথায় একবার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হবে। আসলে কোন সুশিক্ষার লক্ষ্যে সিস্টেম চালু করা হয়নি। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হবে এ সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এদেশের নীতি বা পরিকল্পনা সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ভিন দেশের মাটি থেকে। দেশের ছাত্রশক্তি আধিপত্যবাদী শক্তির ত্রাস। ছাত্রশক্তিকে দুর্বল করে দেয়া, ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত রেখে তারা যাতে দেশ ও সমাজ সম্পর্কের কোন চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ না পায় তজ্জন্য সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এক কথায় বলা যায় যে ছাত্র সমাজের মধ্যকার বর্তমান বিক্ষোভ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রসূত নয়। বর্তমান সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থার ফলশ্রুতি।
২। ছাত্র সমস্যা সামগ্রিক সামাজিক সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই কোন বিচ্ছিন্ন উপায়ে ছাত্র সমস্যা সমাধান তথা তাদের (অস্পষ্ট) বিক্ষোভ দূর করা সম্ভব নয়। সমগ্র দেহে যেখানে ক্ষত সেখানে একটি অংশে মলম লাগিয়ে রোগ সারানো যাবেনা। সমগ্র (অস্পষ্ট) দেহে অপারেশন করতে হবে। অর্থাৎ পুরো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে হবে এবং তা একমাত্র বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায়ই সম্ভব।
৩। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাকশালী নব্য বাকশালীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ছে বৈ কমছে না নির্বাচন যতই নিকটতর হচ্ছে তাদের ত্রাস ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের (অস্পষ্ট) সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। তদুপরি নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে বাকশালী সিনেট নির্বাচিত একজন রাজনৈতিক ভি. সি কর্তৃক। তাই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
৪। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে ছাত্রলীগের (প্রধান) প্যানেলের রাজনৈতিক বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমার সংগঠনের নেতা শফিউল আলম প্রধান যেমন পরীক্ষিত তেমনি এই সংগঠনের প্রতিটি কর্মীই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর নিকট দেশ প্রেমের পরীক্ষায় পরীক্ষিত। শুধু তাই নয় এদেশের ছাত্র সমাজ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ বাকশালী, নব্য বাকশালী, রাজাকার ও ভারতের পঞ্চম বাহিনীকে প্রতিহত করতে সদা প্রস্তুত।
৫। বিরোধীপক্ষের সঙ্গে মাঝে মাঝে খেলায় অংশগ্রহণ না করলে শত্রুপক্ষের শক্তি সম্পর্কে ধারণাটা অপরিপক্ক থেকে যায়। তাই বিদেশী সমর্থনপুষ্ট শত্রুপক্ষকে তাদের বিদেশী প্রভুরা কতটা শক্তি যুগিয়েছে তা জানার জন্যেই আমরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছি। আমি বা আমাদের সংগঠনের কেউই ব্যক্তিগত ইচ্ছায় পরিচালিত হই না। সংগঠনের নির্দেশে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছি নির্বাচনের পরও সংগঠনের নির্দেশেই আমার কাজ কর্ম পরিচালিত হবে।
শামসুন নাহার ওসমানী (রুবী)
সংগ্রামী ছাত্র ঐক্য
১। ছাত্র-ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের অধিকারহীনতা, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নানারকম জাতি বিরোধী অসামাজিক কার্য-কলাপের প্রতিফলন, শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ্চাত্য প্রভাব, বাস্তব ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি প্রবর্তন না করা, ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গন— তাই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিরাজ করছে অসন্তোষ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জীবনের এ সকল সঙ্কট জাতীয় রাজনীতির সঙ্কটের বাস্তব প্রতিফলন। বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার নয়া ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক অবস্থানের কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সফল করার প্রশ্ন জনগণ ও ছাত্র সমাজের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। দেশ চায় স্বাধীনতা—
আর সে সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত করতে অংশগ্রহণই হচ্ছে ছাত্র সমাজের দায়িত্ব। জনগণের জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে হলে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সকল প্রকার আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সামন্তবাদ ও তাদের এদেশীয় দালালদের সকল প্রকার জুলুম ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। আর এ সংগ্রামের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তিই শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টি করতে পারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। বিদেশী আধিপত্যবাদ ও তাদের দালালদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থাকার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজ করছে অসন্তোষ।
২। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ দূর করতে হলে বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল ও জয়যুক্ত করতে হবে এবং তাহলেই কেবলমাত্র গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন সম্ভব এবং দূর হতে পারে সকল প্রকার অসন্তোষ।
৩। ১৯৭৩ সালে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচনী রায়কে বানচাল করে দিয়ে তদানীন্তন শাসকদলের সমর্থক ছাত্র সংগঠন ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচনের অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশ ক্ষুণ্ন করেছে— এবারও একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখছি। অতএব নির্বাচনে অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে বলে ভরসা পাচ্ছি না।
৪। নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণ করবে আমার এবং আমার প্যানেলের জয় পরাজয়। তবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগ্রামের গতিশীল ধারা এবং বক্তব্য ছাত্র সমাজকে আকৃষ্ট করছে— এই রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ও বিজয় যত দ্রুততর হবে ততই জয়ের সম্ভাবনা নিকটতর হবে।
৫। বিজয়ী হলে আমরা আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মসূচী সফল করার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করব। পরাজিত হলে বক্তব্য কর্মসূচী প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম সংগঠিত করব।
মুহাম্মদ আবু তাহের
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির
১। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ যা চেয়েছিল তা পায়নি। প্রচলিত ঔপনিবেশিক কাঠামোর শিক্ষা আদর্শগত ও বস্তুগত উভয় মানদণ্ডেই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজের সব চাইতে সচেতন অংশ হিসেবে ছাত্রদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যার অনিবার্য পরিণতি বিশ্ববিদ্যালয় সহ গোটা শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য আর হতাশা। আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছে সাধারন ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ।
২। শিক্ষাঙ্গন সমাজ বিচ্ছিন্ন কোন অংশ নয়। যেহেতু সকল সমস্যার উৎসমূল হচ্ছে আজকের ঘুণে ধরা সমাজ সেহেতু ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং পুনর্গঠন করার মাধ্যমে এ অসন্তোষ দূর করা যেতে পারে।
৩। কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় যথাযথ ব্যবহার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ছাত্র সংগঠন— সমূহের আন্তরিক সহযোগিতাই কেবল নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট মহল এব্যাপারে সচেতন থাকবেন। তথাপি গণতান্ত্রিক পরিবেশের মাঝে যারা নিজেদের মৃত্যু ঘন্টা শুনতে পায় তারা একে বানচাল করে দিতে পারে। তাই অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদী হয়েও আমরা শংকা মুক্ত নই।
৪। ইসলামী ছাত্র শিবির ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন গতিধারার সৃষ্টি করেছে। ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবি দাওয়া আদায়ের জন্যে আমরা জন্ম লগ্ন থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যেই আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। তাই আমরা আশাকরি ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাবো।
৫। উভয় অবস্থাতেই আমরা ছাত্র সমাজের ন্যায় সঙ্গত দাবী দাওয়া আদায়, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের সংগ্রাম পরিচালনা সর্বোপরি দেশের ছাত্র সমাজকে আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের গতিকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।
জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়
জাতীয় ছাত্র আন্দোলন
১। যে হতাশাজনক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে ছাত্ররা জীবন যাপন করছে, তাদের অসন্তোষের মূল কারণ সেখানেই কেবলমাত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এটা একটা নিষ্ঠুর বাস্তব যে, আমাদের দেশ পরিপূর্ণ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ নয়। এক দিকে আমরা দেশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদ প্রভৃতি বিদেশী শক্তির বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি কর্তৃত্বাধীনে ছিল ও রয়েছে এবং তারা আমাদের সম্পদ লুন্ঠন করে নিজেরা স্ফীত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, এখনো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে সামন্ত-শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদে উৎপাদকদেকের পশ্চাদপদ সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক একটি ব্যবস্থা।
ইতিহাসের অগ্রগতির দৃষ্টি কোণ থেকে দেখলে আমাদের সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়াটি বহুদিন পূর্বেই অচলাবস্থায় উপনীত হয়েছে। আমাদের ছাত্র সমাজের অধিকাংশের জীবনই দারিদ্র্য পীড়িত। সে সামাজিক শ্রেণী গুলি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা আসছে শোষণ-নিপীড়নের ফলে ক্রমশঃই সেই শ্রেণীগুলি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বিচিত্রার জরীপেই দেখা গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় ৪০% ছাত্র পড়াশোনার খরচ চালাতে অসমর্থ হয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত না করেই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আর যারা কোনোক্রমে এই অবস্থা এড়িয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করতে সক্ষম হয় তাদের অধিকাংশের জন্যেও অপেক্ষা করে থাকে বেকারত্ব কিংবা কেরানীর জীবন। প্রকৃত পক্ষে, বর্তমান সামাজিক কাঠামোর ছাত্রদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত দুই’ই যেখানে সংকটাপন্ন যেখানে মানবিক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে অসন্তোষ ছাড়া আর কি আশা করা যেতে পারে?
২। যদি সামাজিক অগ্রগতির পথের বাধা গুলিকে অপসারিত করা যায় এবং সমাজ বিকাশের রুদ্ধ ধারাটিকে মুক্ত করে দেয়া যায় তাহলে অগ্রসর সমাজে বর্তমান সমাজের সমস্যাগুলি, ক্রমে লোপ পাবে। এই সমস্যাগুলোই ছাত্র অসন্তোষের কারণ আর সমাজের অচলতা ও পশ্চাদ পদ বিশেষ প্রকৃতিই এই সমস্যাগুলোকে জন্ম দিয়েছে। এখানে বিষয়টি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করছে। আমরা মনে করি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সামন্ত শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সমাজের স্থলে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা ও শোষণ, নিপীড়নের অবসান এবং এর সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমেই বর্তমান বিক্ষুব্ধ ছাত্র তরুণদের দক্ষ ও সৃজনশীল জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে অন্যথায় নয়।
৩। বিশেষ করে গত কয়েক বৎসর যাবত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে কি অবস্থা বিরাজমান রয়েছে তা মোটামুটি সবাই অবহিত। বিভিন্ন হল গুলিতে অছাত্র বহিরাগত ও অবৈধ সিট দখলকারী এবং সশস্ত্র ব্যক্তিরা রয়েছে। তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অপকর্ম সমগ্র জনগণের নিকট ছাত্র সমাজের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করেছে। প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গুলিই এদেরকে আশ্রয় ও মদদ দিয়ে থাকে, কেননা তারা তাদের ছাত্র ও জনগণ বিরোধী কাজে এদেরকে ব্যবহার করতে পারে। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি এরা আদৌ শ্রদ্ধাশীল নয়, বরং ব্যাপক ছাত্ররা অসংগঠিত থাকায় এবং পাশাপাশি এরা সুসংগঠিত বলে বিভিন্ন ভাবে সাধারণ ছাত্রদেরকে এরা নিপীড়নও করে থাকে। এদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও চক্রের যোগ সাজস রয়েছে।
৪। আমাদের সংগঠনের বয়স প্রায় তিন বৎসর মাত্র। এখনো ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রদের সঙ্গে আমরা দৃঢ় সংযোগ গড়ে করে তুলতে পারিনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সংগঠনের অনেকেরই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং এরা যে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে ও অবৈধ কর্ম পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ দুটি বিষয়কে বিবেচনায় রেখে আমরা আমাদের কৃতকার্যতার সম্ভাবনা মূল্যায়ন করি সেদিক থেকে আমাকে এবং আমাদের প্যানেলের বিজয় হবে এটা নিশ্চিত করা দাবী করা যায় না। যাইহোক দূরদৃষ্টি কোণ থেকে দেখলে আমরা সাধারন ছাত্রদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করছি এবং সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে রয়েছে।
৫। বিজয় অথবা পরাজয় বা অন্য যা কিছু ঘটুক না কেন আমরা আমাদের সংগঠনের কাজ একই থাকবে তা হচ্ছে প্রধানতঃ একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র সমাজকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করা এবং এই সংগ্রামকে ধাপে ধাপে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী
জাতীয় ছাত্র ইউনিয়ন
১। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে অসন্তোষ বিরাজ করছে সে অসন্তোষ কেন এবং কিসের বিরুদ্ধে? সারা দেশে যেখানে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ এক মানবেতর জীবন যাপন করছে, তাদের মধ্যে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ধনী শ্রেণীর ভোগ বিলাস অপচয় এবং শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ রয়েছে, সেখানে শিক্ষিত ও তরুণ অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার শোষণ ও অপচয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। ছাত্র সমস্যা জাতীয় সমস্যার অংশ। অভিভাবকের আয়ের স্বল্পতার জন্যে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত, শিক্ষা শেষে বেকারত্ব, শিক্ষাঙ্গনে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং অনিয়ম এবং এর সঙ্গে যুক্ত পুরাতন ও নতুন ফ্যাসিবাদী শক্তির অশুভ তৎপরতা, আবাসিক, পুস্তক, খাদ্য ও যাতায়াতের সমস্যা ; যার প্রত্যেকটির মধ্য দিয়েই জাতীয় সমস্যার প্রতিফলন ঘটছে, এগুলোই ছাত্র অসন্তোষের মূল কারণ।
২। এ অসন্তোষ দূর করা যেতে পারে সোজা কথায় একটি বৈপ্লবিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জাতীয় সমস্যার সমাধান তথা ধনী শ্রেণীর অপচয় ও ভোগবিলাস বন্ধ করে, কলকারখানা নির্মাণ ও সেচ ও সারের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে জাতীয় (অস্পষ্ট) অর্জন ও বেকারত্ব দূরকরা।
রাজনীতিকে ধনী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে শ্রমজীবী মানুষের গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
৩। আমরা মনে করি ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের এটাই কামনা। কেবলমাত্র পুরাতন ও নতুন ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর দিক থেকে নির্বাচন বানচাল করার অপচেষ্টা চলছে। অবশ্য এতে আমরা এবং অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিগুলো প্রস্তুত।
৪। নির্বাচনে আমরা এবং আমাদের প্যানেলের বিজয়ের সম্ভাবনা কতটুকু তা পরিমাপ করা কষ্টকর। তবে সাধারণ ছাত্র সমাজ প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই এর পাশাপাশি এক নতুন রাজনীতি ও নতুন পথ তাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত এবং আশা তুলে ধরতে পারবে। প্রচলিত রাজনীতি এবং নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে আমরা যে নতুন পথের এবং নেতৃত্বের প্রস্তাব করেছি এতে সাধারণ ছাত্রসমাজকে জয় করে নেওয়া এবং নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
৫। নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমাদের সর্বপ্রধান কাজ হবে আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্যে সংগ্রাম গড়ে তোলা— যার লক্ষ্য হবে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান এবং শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ কায়েম করা। পরাজিত হলেও আমাদের উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখা, যে পর্যন্ত না তা কায়েম হচ্ছে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মানু)
১। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ তথা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজমান। অসন্তোষ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার যোগ্য। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে যে অসন্তোষ বিরাজমান তা নানাবিধ এবং এর উৎসের ও বিভিন্নতা রয়েছে। ছাত্র ছাত্রীদের হলের সিট সমস্যা, ডাইনিং হল সমস্যা থেকে আরম্ভ করে তাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যা ও অসঙ্গতি এর জন্য দায়ী। তাছাড়া রয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। ছাত্র ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক উপায়ে এ সকল সমস্যা মোকাবিলার রুদ্ধ পথও অসন্তোষ বয়ে আনে আরো বেশি করে। আইনী কথার আড়ালে বেআইনী বাধা সৃষ্টি করে অচলাবস্থার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সবখানেই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
২। আপাত দৃষ্টিতে অন্যরকম মনে হলেও এ অসন্তোষের উৎস কিন্তু ছাত্র ছাত্রী আর তাদের শিক্ষায়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর উৎস মূল রয়েছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে, রাষ্ট্র যন্ত্রের ধাপে ধাপে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও রাষ্ট্র যন্ত্রের চরিত্র পাল্টালেই কেবল এ অসন্তোষ দূর করা যেতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতা তাই বলে।
৩। আমি মনে করি না, তবে আশাকরি ও মনেপ্রাণে কামনা করি ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক। আমাদের সক্রিয় প্রচেষ্টাও সেই লক্ষ্যে, কিন্তু আমাদের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খুবই সীমিত।
৪। নির্বাচনে আমার ও আমার প্যানেলে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ততটুকু রয়েছে যতটুকু আমরা আমাদের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি এবং পারব।
৫। আমি সবসময় ব্যাপক ছাত্র সমাজকে তাদের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হতে, সংগঠিত হতে এবং সংগ্রামের কাতার একত্রিত হয়ে সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে প্রচেষ্টা চালিয়েছে ভবিষ্যতেও এটাই হবে আমার কাজ।
আলী ইমাম
বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (হাবিব)
১। স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলি সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সমস্যার কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধনে কোনরূপ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে নি। যে কারণে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সমস্যা সমাধানে কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। বলতে গেলে দেশে আজও কোন ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠেনি, যার মধ্যে গোটা ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দীর্ঘদিন যাবত ছাত্র রাজনীতির নামে লুটপাট, হাইজ্যাক, গুন্ডামী, অস্ত্রের ঝনঝনানী; সন্ত্রাস সৃষ্টি ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে বাঁধাগ্রস্থ করছে এবং ছাত্র ছাত্রীরা আশা আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করছে। এই সকল গণবিরোধী কাজের ফলে স্বাভাবিক কারণেই ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মারাত্নক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
২। ছাত্র-ছাত্রীদের এই অসন্তোষ দূর করতে হলে তাদেরকে কমন প্রোগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে দৃষ্টান্তমূলক কর্মকান্ডে নজির সৃষ্টি করে তাদের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্র ছাত্রীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
৩। ডাকসু নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও অবাধ হবে তা নির্ভর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র সংগঠনগুলির গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে আমি আশা করবো ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার।
৪। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয় সাধারণতঃ তাদের জয়ী হওয়ার আকাঙ্খাটাই বেশি থাকে। আমাদের সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এদেশের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যে লালিত। এবং দেশের অন্যতম বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। আমাদের কর্মী, সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার সবদিক থেকেই আমরা আশাবাদী।
৫। ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হলে ছাত্র ছাত্রীদের সুদীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবী উৎপাদনমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা করবো, আমার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আর যদি পরাজিত হই তা হলে গঠনমূলক কাজে বিজয়ীকে সমর্থন এবং ভুল কাজে সমালোচনার হাতিয়ার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবো।
সৈয়দ তারিকুজ্জামান (দীপু)
ছাত্র ঐক্য ফোরাম
১। প্রশ্নের মাঝে এটা স্বীকৃত যে বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজমান। হলে খাবারের দুরবস্থা, সেমিনারে বইয়ের অভাব, শিক্ষার ক্রমবর্দ্ধমান ব্যয়ভার, অশুভ রাজনীতির কাছে প্রশাসনযন্ত্রের নতি স্বীকার, এ জাতীয় নানা বিধ সমস্যা নিঃসন্দেহে ছাত্র সমাজের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে এবং করছে। কিন্তু এগুলোকে ছাপিয়ে যে সমস্যাটি সর্বপ্রধান হয়ে প্রতিভাত হয়েছে, তা হলো চাকরীর অনিশ্চয়তা। এরই পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে আশাব্যঞ্জক কোন ইতিবাচক শক্তির অভাবহেতু এই অসন্তোষ আরো তীব্রতর হয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই তা থেকে হতাশা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি বিমুখতার জন্ম নিয়েছে।
২। চাকরীর নিশ্চয়তা যদি মুখ্য সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয় তবে তা সমাধানের জন্যে প্রয়োজন কর্মক্ষেত্রের ধারাবাহিক বিস্তৃতি। আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক খাত সমূহের উন্নয়ন আনার মাধ্যমেই এটা নিশ্চিত করা সম্ভব। অথচ বর্তমান সমাজ কাঠামো ( ভিন্ন অর্থে, রাষ্ট্র যন্ত্র যার মাঝে সাম্রাজ্যবাদী ও আভ্যন্তরীণ সুবিধাভোগী শ্রেণী সমূহের শোষণ ও শাসনের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে) এই উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব প্রয়োজন তাকে উৎখাত করা এবং তারস্থলে শ্রমিক কৃষক ও মেহনতী জনতার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ছাত্র পরিসরে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সেজন্য উপযুক্ত সংগঠন আবশ্যক। ব্যাপক প্রগতিশীল ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম কোন সংগঠনের অনুপস্থিতি আজকের আশু সমস্যা। এটা সমাধানের উদ্দেশ্যে আলোচনা (প্রতিনিয়ত সার সংকলন) ও সংগ্রামের সমন্বয়কারী একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া ছাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা সংগঠনভুক্ত ও সংগঠন বহির্ভূত প্রগতিমনা ছাত্র কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করবে।
৩। এ অবধি নির্বাচন কর্মকান্ড ব্যাহত সুষ্ঠুভাবে এগুচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার্থে অনেকের জন্য নির্বাচন বানচাল আশু করণীয় হয়ে দাঁড়াবার বাস্তব সম্ভাবনাও রয়েছে। এক্ষেত্রে ‘৭৩ এর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা যদিও কম, তবু অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি হবেনা তা শেষ বিশ্লেষণে নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠনের আভ্যন্তরীণ বিরোধ কোন পথ বেছে নেয়।
৪। নির্বাচনে জয় পরাজয় ব্যাপারে কোন সদুত্তর দেয়ার পূর্বে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য জানানো প্রয়োজন। আপনারা হয়ত জানেন যে, এ বছরের মার্চ মাসে ছাত্র ঐক্য ফোরাম গঠিত হয়। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরের শেষে উল্লিখিত সমাধান কল্পেই আমরা ফোরাম গঠন করি। আলোচনা ও সংগ্রামের মাধ্যমে ঐক্য প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই আমরা গত এপ্রিল মাস থেকে প্রগতিশীল বলে পরিচিত বেশ কিছু ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে নির্বাচন কেন্দ্রিক জোট গঠনে সচেষ্ট হই। কিন্তু জোট সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রকাশে অনমনীয়তার কারণে আমাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে দু একটা সংগঠনের সঙ্গে জোট না বেঁধে আমরা এককভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা মনে করি যে.
(বাকি অংশ পাওয়া যায় নাই। নীচে মূল কপি যুক্ত হল।)
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1979.07.27-bichitra.pdf” title=”1979.07.27 bichitra”]