You dont have javascript enabled! Please enable it!

নীল বিদ্রোহ

প্রমোদ রঞ্জন সেনগুপ্ত

নীল চাষের প্রথম থেকেই বাংলার নীলচাষীরা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ করেছিল তার কিছু উল্লেখ ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। ১৮৪৮ সালে একজন ইংরেজ লেখক  ক্যালকাটা রিভিউ  পত্রিকায় ত্রিশ বৎসর পূর্বের নীলকর  শীর্ষক প্রবন্ধে সেই সংঘর্ষের এইরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন।  অসংখ্য ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা আমরা জানি। মাত্র দু একটি নয়, এমন শত শত মুখোমুখি সংঘর্ষের উদাহরণ আমরা দিতে পরি যে যেখানে দুইজন, তিনজন, এমনিক ছয় জন নিহত হইয়াছে এবং সেই অনুপাতে আরও অনেক আহত হইয়াছে ; অসংখ্য খন্ডযুদ্ধ পশ্চিমা  ‘বজ্র’  ভাষাভ ষী ভাড়াটিয়া সৈন্যরা এমন দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছে যে তাহা যে কোন যুদ্ধে কোম্পানীর সৈন্যদের পক্ষে গৌরবজনক হইত ; বহু ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব কৃষক লাঠিয়ালদের দ্বারা অক্লান্ত হইয়া তাহার তেজস্ব ঘোড়ার পিঠে চাপিয়া অতিদক্ষতার সহিত পলায়ন করিয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা সশস্ত্র আক্রমণের দ্বারা নীলকুঠিগলিকে ধুলিসাৎ করিয়া দিয়াছে , অনেক স্থানে একপক্ষ বাজার লুট করিয়াছে, তার পরক্ষণেই অপর পক্ষ আসিয়া তাহার প্রতিশোধ লইয়াছে। নীলকররা গ্রামে গিয়েই একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করত। তারা এটা জমিদারদের কাছে শিখেছিল। প্রত্যেক জমিদারদেরই একটা লাঠিয়ালবাহিনী থাকতো। প্রাচীন সামন্তকাল থেকে ভারতে এই প্রথা চলে আসছিল। অসংখ্য লোকের নিকট লাঠিয়াল হওয়াটা একটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ; আবার অনেক গুন্ডা-বদমায়েশরাও তাতে যোগ দিত। নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনীতে এই সব গুন্ডা-বদমায়েশদের সব সময়ই স্থান হতো এবং তারা দলে দলে এসে তাতে যোগ দিত। একজন নীলকর  কলোনাইজেশন  কমিটিতে তার পক্ষে বলেছিল যে, স্থানীয় জমিদারের সঙ্গে তার একটা ঝগড়া হয়েছিল ; এই কথাটা প্রচার হতে এক মূর্হূত দেরী হলো না ; ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই ধরনের ৪০০ লাঠিয়াল তার কাছে কর্ম-প্রার্থী হলো । (১০৯ ক)

নীলকরদের বিরদ্ধে আমরা একজন শক্তিশালী নেতার পরিচয় পাই—তাঁর নাম সর্দার বিশ্বনাথ। ঐতিহাসিক প্রকাশ রায় বলেছেন, যাহারা একক শক্তিতে বিদেশী নীলকর দস্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে বিশ্বনাথ সদার প্রথমত ও শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী। (১৩০ খ) হারাধন দত্তও ঠিকই বলেছেন যে “বিশ্বনাথ সদর বাংলাদেশে নীল-আন্দোলনের অন্যতম পূরোধা ও প্রথম পথিকৃৎ, বিশ্বনাথ এককভাবে সেকালের সেই দূর্ধষ অপ্রতিহত নীলকরদের বিরদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরন করে নীল আন্দোলনের প্রথম শহীদ হন। ডাকাত হিসাবেই আমরা বিশ্বনাথের গল্প শুনে এসেছি—কিন্তু ঊনবিংশ শতকের প্রথম তিনি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব দশকে তিনি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। (১০৯. গ)।

কেডি ও লেডিয়ার্ড নামক দুইজন নীলকরদের কুঠি বিশ্বনাথ কিভাবে আক্রমণ করেছিলেন তার বর্ণনা নদীয়া জেলা গেজেটিয়ারে আছে। (১০৯ ঘ) ১৮২৯ সালে ময়মনসিংহ জেলায় জামালপুরের কয়েকটা গ্রামে ৫০০ লাঠিয়াল নিয়ে নীলকররা অাক্ৰমণ করে। নীলকরদের ডাকে পুলিশ এসে গ্রামের মোড়লদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষকরা পুলিশের এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। পুলিশের আগমন সংবাদ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোষণা করার জন্য বৃক্ষ চূড়ায় উঠে ঘন্টা বজিয়ে দিত কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক হাজার কৃষক এসে পুলিশকে ঘেরাও করে ফেলত। একবার এইভাবে কৃষকরা পুলিশদলকে বন্দী করে রেখে দেয়। ম্যাজিস্ট্রেট সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বন্দী পুলিশদের উদ্ধার করেন। ময়মনসিংহ-এ নীল চাষীর এই সংগ্রাম অনেকদিন চলেছিল। (১০৯ ঙ) টাঙ্গাইলের উত্তাল যমুনা নদীর তীরবর্তী চারাবাড়ী-বাঘিল অঞ্চলে জনৈক ভবানী মিত্রের নেতৃত্বে হিন্দু মুসলমান কৃষক লাঠিয়াল বাহিনী নীলকরদের নৌকায় দড়ি দিয়ে বেধে যমুনার অপর তীরে সিরাজগঞ্জে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল, নীলকুঠি জালিয়ে দিয়েছিল। (১০৯ চ) তিতুমীরের নেতৃত্বে বারাসতের কৃষক বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট ঘটনা। এই বিদ্রোহ একাধারে বৃটিশ সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সরকার নীলকর উভয় সম্প্রদায়ের জমিদার মহাজন সকলের নির্যাতন শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এই অঞ্চলের জমিদার কৃষকদের রায় তাঁর জামদরীর মধ্যে ওয়াহাবী মতাবলম্বী প্রত্যেকের দাড়ির উপর আড়াই টাকা খাজনা ধার্য করলেন। স্বভাবতই কৃষকরা যখন এই  “দাড়ির খাজনা” দিতে অস্বীকার করল তখন জমিদার শত শত লাঠিয়াল নিয়ে তিতুমীরের গ্রাম আক্রমন করল, বার বার আক্রমন করেও “দাড়ির খাজনা” আদায় করা গেল না। পুলিশ সব সময়ই জমিদারকে সাহায্য করলো। ইতিমধ্যে নীল চাষের ব্যাপারে কৃষকদের সঙ্গে নীলকরদের সংঘর্ষ লেগেই ছিল। তাই নীলকররা জামদারদের সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষকদের উপর আমন চালাতে লাগল। গোবর ডাঙ্গার জামিদার কালী মুখোপাধ্যায় হাতীতে চড়ে তিতুমীরকে যখন আক্রমন করলেন তখন মোল্লা হাটি কুঠির ম্যানেজার ডেভিস তার সঙ্গে আরো একটা শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে কালিপ্রসন্নের সঙ্গে যোগ দিল। গোবর-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়ও তার লাঠিয়াল নিয়ে কালিপ্রসন্নের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তিতুমীরের প্রচন্ড-পাল্টা আমনে প্রথমেই ডেভিসের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, ডেভিস নিজে সর্বপ্রথম পলায়ন করেছিল। উভয় পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়। দেবনাথ তিতুমীরের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। বিচারে তাঁর মৃত্যুদন্ড হয়েছিল।

জমিদার ও নীলকররা বারবার তিতুকে আক্রমন করেও কখন তাঁকে পরাস্ত করতে পারলোনা, তখন তারা সরকারের নিকট সাহায্য প্রার্থী হলো। সরকার তিতুকে ধ্বংস করার জন্য যশোহরের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠালেন ১৮৩০ এর ১৫ই নবেম্বরে। সরকারের পক্ষে বন্দুকধারী সৈন্য বাহিনী আর তিতুমীরের শুধু তীর, বর্শ, তলোয়ার, ইট পাটকেল, আর কাঁচা বেল আধুনিক অস্ত্র যোগাড় করা গরীব গ্রাম বাসীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিতুমীরের প্রচণ্ড আক্রমনের ফলে সরকারী সৈনারা পিছু, হটল এবং আলেকজান্ডার কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেন। দারোগা রাম রাম চক্রবর্তী (জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের আত্মীয়) তিতুর হাতে বন্দী হলেন। বিচারে অত্যাচারী দারোগার প্রাণদণ্ড হলো, এই জয়ের পর তিতুমীর নীলকরদের কতকগুলি কুঠি আক্রমন করলেন। নীলকরদের প্রচুর লাঠিয়াল থাকা সত্বেও তারা অত্নরক্ষা  করতে না পেরে কলকাতায় পালিয়ে গেল।  ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের সকল সভ্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিতু নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ বলে ঘোষণা করলেন। এই স্বাধীনতা ঘোষণার ফল কি হবে তা তিতু ভালোভাবেই জানতেন। তিনি তৈরি হলেন। নারিকেল বেড়িয়তে বাঁশের কেল্লা প্রস্তুত হলো।  বড়লাট বেন্টিঙ্ক আলেকজান্ডারের পরাজয়ের পর নদীয়ার কালেকটরকে হুকুম দিলেন তিতুকে অাবার আক্রমন করার জন্য। এক সুসজ্জিত বিরাট সরকরী বাহিনী, জমিদার বাহিনী ও নীলকর বাহিনী মিলিতভাবে তিতুকে আক্রমন করার জন্য অগ্রসর হলো। তিতুও তাঁর বাহিনী নিয়ে বাঘারিয়া নামক স্থানে এসে সেখানকার পরিত্যাক্ত নীলকুঠি দখল করে শত্রুর অপেক্ষা করতে লাগলেন। বিহারী লাল সরকার, যিনি ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিলেন না, এই লড়াই সম্বন্ধে লিখেছেনঃ মাসুমের (তিতুর সেনাপতি) সৈন্যগণ অন্তরালে অবস্থান করায় গুলি বর্ষণে তাহাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হইল না। কিন্তু কালেকটরের ক্ষতি হইয়াছিল অত্যাধিক। ইহা দেখিয়া কালেকটর যুদ্ধ করিবার হকুম দেন। তাঁহাদিগকে পালাইতে দেখিয়া মাসুমের সৈন্যরা চারিদিকে হইতে ভীষণ বেগে তাহাদিগকে আক্রমন করে। এই আক্রমনে সাহেবের বহু লোক নিহত হয় এবং একটি হস্তী ও কয়েকটি বন্দুক মাসুমের হস্তগত হয়। কালেকটর ও জজ সাহেব দ্রুত পলায়ন করিয়া বজর য় করিয়া জলপথে পালায়ন করেন। তাহাদের পালাইতে দেখিয়া জমিদারগণও যেদিকে পারিলেন পলায়ন করিলেন।

১৮৩১ সালে ১৪ই নবেম্বর আরো জাঁকজমকের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনী তিতুর বাঁশের কেল্লা আমন করল। তারা দুইটি কামান নিয়ে এসেছিল। তা দিয়ে তারা অবিরাম গোলা বর্ষণ করতে লাগলো। একটি গোলার আঘাতে তিতুর দক্ষিণ উরু, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণ পর তিতুমীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কামানের গোলার বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লারও বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। ৮০০ বন্দীকে আলিপুরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তাদের বিচার হলো। বিচারে গোলাম মাসুমের প্রাণদন্ড হলো। অনেকের দ্বীপান্তর হলো, এবং অনেকের কারাদণ্ড হলো। বাঁশের কেল্লার সামনে গোলাম মাসুমের ফাঁসী হয়েছিল। (সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের কৃষক বিদ্রোহ……পৃঃ ২৬৯-২৮২ দ্রষ্টব্য।) দুর্বল সংগঠন লইয়া প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় উন্নত অাগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রুর সহিত সংগ্রামে বিদ্রোহীরা তাহাদের ঘোষিত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ ও ধ্বংস হইয়া গেলেও ভবিষ্যৎ কালের বৈপ্লবিক স্বাধীনতা-সংগ্রামের ভিত্তি রচনার দিক হইতে এই বিদ্রোহ সাথকতামন্ডিত হইয়াছে। কামানের মুখে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা শুষ্ক পত্রের মতো উড়িয়া গেলেও ইহা বংশ পরম্পরায় বাঙ্গালী জনসাধারণের চিত্তভূমিতে ভবিষ্যৎ স্বধীনতা সংগ্রামের যে অজেয় দুর্গ রচনা করিয়া রাখিয়াছে, ইংরেজ শাসকগণ সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াও কোনদিন তাহার ভিত্তি টলাইতে পারে নাই। (ঐ, পৃঃ ২৮১)। তিতুমীরের বিদ্রোহের পর নীল কৃষকদের সঙ্গে নীল কাদের আরো অনেক খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৮৪৩ সালের ময়মনসিং-এর কাগমারীর ঘটনা। গোলকনাথের নেতৃত্বে কৃষকরা নীলকর কিংকে আক্রমন করে। দুই পক্ষে অনেকক্ষণ লড়াইয়ের পর তারা কিংকে বন্দী করে নিয়ে যায় ও অনেকদিন ধরে সেই অবস্থায় কিংকে বন্দী করে রাখে। গোলকনাথকে গ্রেফতার করবার জন্যে পরওয়ানা বার হয় কিন্তু তাহার কোনো খোজ  পাওয়া যায় নাই। (সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতে কৃষক বিদ্রোহ….. পৃঃ ২৫৩।)

খুলনার দুর্ধর্ষ নীলকর রেণীর বিরুদ্ধে তালুকদার শিবনাথ ঘোষের ১৮৪০ থেকে ১৮৪৩ পর্যন্ত গৌরবোজ্বল সংগ্রামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিবনাথ সর্বস্ব পণ করে নীলকরের বিরুদ্ধে তিন চার বার বন্দুক ধরে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। সহস্রাধিক কৃষক-লাঠিয়াল শিবনাথের পাশে এসে  দাঁড়িয়েছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা অসাধারণ সৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন চন্দ্রকান্ত দত্ত, রামচন্দ্র মিত্র, ভৈরবচন্দ্র মিএ, লাঠিয়াল সদর সাদেক মোল্লা, গয়রাতুল্লা, গৌর ধোপা ফকির মামদ, আফাজুদ্দিন, সানমামুদ জোলা ইত্যাদি। একবার শিবনাথ রেনীর ৩৬টি নীল ও চিনি বোঝাই নৌকা কলকাতার পথে কাঁচিকাটা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। এই সব অঞ্চলে গ্রাম্য কবিতায় শোনা যায় :  ‘চন্দ্র দত্ত রণে মত্ত, শিব সেনাপরি’ ,  গুলিগোলা সাদেক মোলা, রেণীর দপ্ত করে চুর, বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা, ধন্য বাংলা বাঙ্গালী বাহাদুর,  দেখিয়া শিবের ভংগী, পলাইল দীনেই সিঙ্গি  (রেণীর কুঠির দেওয়ান দীন– নাথ সিংহ)। (সুপ্রকাশ রায়ঃ ঐ, পৃঃ ২৫৯-৩৬০)

১৮৫৭-৫৯ সালের মহাবিদ্রোহের সময় বাংলাদেশে নীলকর, জমিদার ও সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের অসন্তােষ এত ঘনিহত হয়ে উঠেছিল যে সেই সময় বাংলার কৃষকও যদি সময় মত নিতৃত্ব পেত তাহলে বাংলাদেশে যে ব্যাপক বিদ্রোহবার সম্ভাবনা ছিল সে সম্মধ্যে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে। সে সময় বাংলায়ও যদি , বিদ্রোহ ঘটত তাহলে ভারতের ইতিহাস যে অন্যরুপ ধারণ করতো। তাতে সন্দেহ নেই। বাংলার কৃষকরা, বিশেষ করে নীল চাষীরা বিদ্রোহী ভবাপন্ন হলেও জমিদার নীলকরদের সাহায্যে তাদের দাবিয়ে রাখতে পেরেছিল। এই সময় সরকার অনেক নীলকরকে অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেটের পদে নিয়োগ করেছিল ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া তখনকার অধিকংশ বাংগালী শিক্ষিতরা ভারতীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক, কারণ কৃষকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে ভারতীয় জমিদার ও ইংরেজ নীলকর উভয়ই তাদের শ্রেণী-স্বার্থের বিরুদ্ধে যোগসুত্র বাধা, কয়েকটা ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে তাদের মধ্যে যত তীর সংঘর্ষই হোক না কেন জমিদারী স্বার্থের এই ঐক্যবদ্ধকে ১৮৫৯ সালের খাজনা আইন (রেন্ট এ্যাক্ট ১০ অফ ১৮৫৯) আরও দৃঢ় করে দিল। 

ভারতীয় মহাবিদ্রোহ থেকে ইংরেজ সম্রাজ্যবাদীরা যে শিক্ষাটা গ্রহণ করেছিল তা হলো এই যে, ভারতের মুমুর্ষ সামন্তশ্রেণীকে তাদের প্রধান মিত্ররুপে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। শুধু, অযোধ্যাতেই নয়, প্রত্যেকটি প্রদেশে আইন পাশ করে জমিদার মহাজনদের ক্ষমতাশালী করে তুলল। ১৮৫৯ এর দশম আইন বাংলার জন্যে সেই রকম একটি আইন। এই আইনে কৃষক কিছুই পেলনা-শুধু বলা হলো যে কৃষক তার চাষের জমির জন্যে পাট্রার অধিকার, প্রজাসত্বের অধিকারী, এতে আরো বলা হলো প্রজাসত্তের মতোই মাত্র বলা হলো, কাজে পরিণত করা হলো না যে, জমিদাররা প্রজাদের উপর কোন প্রকারের দমন পীড়ন চালাতে পারবে না। কৃষকদের উপর এই দমন পীড়নে অধিকার ছিল জমিদারদের একটা প্রধান অস্ত্র। কৃষককে কাছারীতে ডেকে এনে, তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে, নানা প্রকারের নির্যাতন করে ও সর্বশেষে মোকদ্দমার ভয় দেখিয়ে জমিদার তার নিকট থেকে সব কিছু আদায় করে নিত। ১৮৫৯ এর দশম আইনের শেষোক্ত ধারাগুলির   বিরদ্ধে নীলকররা ও জমিদাররা ভীষণ চে’চা মেচি শুরু করে দিল। ফরলং লারমুররা বলতে লাগলো এটা একটা অত্যন্ত অন্যায় আইন। এটা জমিদার হিসাবে নীলকরদের অধিকারঅত্যন্ত অন্যায় একেবারে গোড়ায় আঘাত করেছে, এটা জমিদারদের সমান্ত তান্ত্রিক   অধিকারগুলি ধ্বংস করে দেবে। (রিস, এ্যান্স নছ : ৬ ২৯৪০) ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের এই সমস্ত ভূমি সংকার আইন যে মোটেই কার্যকরী হয়না, সব মধ্যেই আটকা পড়ে থাকে তা সপষ্ট ভাষায় বলেছিলেন (১৮৫৯ সালে) মূর্শিদাবাদের ম্যাজিস্টেট ককবার্ণঃ যে সব নীলকর জমিদারী অধিকার পেয়েছে তারা কোনো প্রজারক্ষা আইনের কথা শুনলে যা বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়-হেসে উড়িয়ে দেয়, কেননা জমিদারদের উপর এইসব অাইন কখনই প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। এই সহজ কারণের জন্য যে যতক্ষণ পর্যন্ত রায়তদের এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই নীলকরের মুঠোর মধ্যে তারা কেউই এই সব আইনের সাহায্য নিতে সাহস করবে না। (সিলেকশন ফ্রম বেংগল গভর্নমেন্ট রেকর্ডস, ইনডিগো কালটিভেশন, পাট ১,)। ১৮৫৯-১৮৬০ সাল ভারত একটা গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচিছল। এই কালটা ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন থেকে বৃটিশ মন্ত্রীসভার শাসনে উত্তোরণ আর অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতে তখন ঘটছিল একটা মূল্য বিপ্লব । এ দুটোই হলো মহাবিদ্রোহের পরাজয়ের ফল। সেই সময় কি পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি ও মজুরী বৃদ্ধি টাকা আনা পয়সা হিসেবে হয়েছিল তা নিম্নের তথ্যগলি থেকে বোঝা যাবেঃ (১০৯জ) যশোহর । বর্ধমান কঞ্চনগর বারাসাত ১৮৫৫ ১৭৬০ ১৮৫৫ ১৮৬০ ১৮৫৫ ১৮৬০ ১৮৫৫ ১৮৬০ দৈনিক মজুরীর হার ০-২-০ ০-৩-৬ ০-১-৬ ০-২-৬ ০-১-৩ ০-২-৬ ০-২-৬ ০-৪০ ধান প্রতি মণ ০-১- ৬ ১-৪৬ ০-১০- ০ ১ -৪-০ ০-১০- ০১ -৭-৬ ০-১২-০১-১০-০ সরিষা প্রতি মণ। ৯-৪০ ১২-০-০ ৬-৮-০১০-৪-০ ৭-১২-০ ৯-১ গরুর গাড়ী প্রতিটি ৩-৮-০ ৭-৮-০ ৭-৮- ০ ১৫-০ ১৫-০-০ ২০-০-০ ৬-১০০ ৮-৪-০১-০-০ ১২-০-০ ৩০-০-০ ৪০-০-০ ১-০- ০১-৮- ০১-১০ লাঙ্গল প্রতিটি। °°০ ১-৮- ০১-১০- ১১-১২- ০১-৮- ০১-১২-০ ১-০-০ ১৬-০ এক জোড়া চাষের বলদ। ২০-০-০ ৩২-০-০ ১০-০-০১৬-0-0 ২৮-১২-০ ৩৩-১২-0 ১৬-০-০ ২৫-০-০ ৪০-০-০ ৬০-০-০ ৩৫ ০-০ ২৪-০-০ ৪০-০-০

১৮৫৫ সাল থেকে ১৮৬০ এর মধ্যে প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রের দাম দেড়গুণ দুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আফিং চাষীরা আন্দোলন করে তার দাম বাড়িয়ে নিয়েছিল। অন্যান্য কৃষকরাও তাদের দ্রব্যের জন্য বেশি দাম পাচিছল। কিন্তু নীল চাষীদের বেলায় নীল চাষের জন্য কোনো পরিবর্তনই ঘটল না, তারা তাদের নীল গাছের জন্য ১৮৫৫ সালে যে দাম পেত ১৮৬০ সালে তার থেকে এক পয়সাও বেশি পাচিছল না। তাছাড়া নদীয়া জেলার ভিতর দিয়ে পূর্ব বাংলা রেলপথ এই সময় নির্মিত হতে থাকার ফলে মজুরীর দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু নীলকররা এসব কিছুই গ্রাহ্য করছিল না। (১০৯ঝ ) স্বভাবতঃই এইসব নানা কারণে নীল চাষীরা একটা বিস্ফোরণের অবস্থায় এসে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে প্রচারিত হলো বারাসাতে ইডেনের পরোয়ানা।  ১৮৫৯-৬১ সালের নীল বিদ্রোহের প্রসঙ্গে প্রধান বিষয়টি হলো এই যে সে-সময় কৃষকদের মধ্যে একটা নব চেতনা এসে গিয়ে ছিল, তারা নিজেদের আর অসহায় মনে করছিল না, তারা নিজেদের উপর বিশ্বাস করতে শিখেছিল। ১৮৩১ এর তিতুমীরের লড়াই, ১৮৫৫-৫৬ এর সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি ১৮৫৭-৫৮র সদ্য অনুষ্ঠিত মহাবিদ্রোহের শিক্ষাগলির তাৎপর্য তাদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা জাগিয়ে তুলছিল। ১৮৫১ থেকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ও ব্যাপকভাবে নীলচাষীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়। এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে উপরিউক্ত ইংরেজী পত্রিকা লিখেছিলঃ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া আছে, এটাই নিয়ম। নীলকরদের অত্যাচারের মাত্রার উপরেই নির্ভর করবে রায়তদের প্রতিরোধের রূপ। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। যে মহকুমা থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফকে অসম্মান জনকভাবে বদলি করা হয়েছিল, নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রথম শুরু হয় সেখান থেকেই নীলচাষ না করবার জন্য কৃষকদের এই দঢ়-সংকল্প যেমনই আকস্মিক তেমনই অপ্রত্যাশিত। {১১০] ১৮৫৯ সালের প্রথমদিকে যখন স্যার পিটার গ্র্যান্ট বাংলার ছোটলাট নিযুক্ত হলেন, তখন থেকেই এই নীলের প্রশ্নটা একেবারে অপরিহার্যভাবে গভর্ণমেন্টের উপর চাপ দিতে লাগল। [১১১] পূর্বেই বলা হয়েছে যে মহাবিদ্রোহ দমন করার পর যখন ভারতবর্ষ শাসন করার ভার ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার নিয়ে নিল, তখন তারা ভারত-সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে পাকাপোক্ত করে গড়ে তুলতে সিদ্ধান্ত করল। কাজেই তাদের প্রথম কাজ হলো স্বৈরাচারী ও উদ্ধত নীলকরদের কিছুটা সংযত করা, কেননা নীলকররা তখন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আর একটা রাষ্ট্রের মতো (এ ষ্টেট উইথইন এ ষ্টেট) আচরণ করছিল। তাছাড়া, মহাবিত্তোহ ঠিক দমন হতে না-হতেই, নীলচাষীরা যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তাতে এই পন্থা অবলম্বন না করেই বা তাদের কি উপায় ছিল ? 

চরঘাটের (বারাসত) নীলকর যখন দেখল যে চাষীরা নীল না বুনতে বদ্ধপরিকর তখন সে তাদের জমিতে জোর করে নীলচাষ করবে বলে ঠিক করল। চাষীরা ম্যাজিস্টেট এসলী ইডেনের নিকট পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করল। ইডেন শান্তি রক্ষার জন্য সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন এবং ১৮৫৯ সালের দশম অাইনের বলে মার্চ মাসে এক পরোয়ানা জারি করে সকলকে জানিয়ে দিলেন যে নিজের জমিতে নীলচাষ করা কৃষকদের ইচছাধীন ; জোরজুলুমের দ্বারা নীলচাষ বেআইনী। ইডেনের পরোয়ানার ব্যাপারে সরকারের মধ্যে দুটো পরস্পর বিরোধী মত দেখা গেল—ছোটলাট গ্র্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেল প্রমুখ ইডেনকে সমর্থন করলেন, অন্য ধারে নদীয়ার কমিশনার গ্রেটি নীলকরদের পক্ষ নিলেন।

১৮৫৯, ১লা মে তারিখে বাংলার প্রথম ছোটলাট হ্যালিডের স্থানে গ্র্যান্ট নিযুক্ত হয়ে এলেন। হ্যালিডে ছিলেন নীলকরদের স্বর্গরাজ্য-তারা প্রজাদের উপর যথেচছাচার করত এবং অবাধে শোষণ ও নির্যাতন চালিয়ে যেত। হ্যালিডের সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইন শৃঙখলা বজায় রাখার চেষ্টা বিশেষ করত না, নীল অঞ্চলে নীলকররা তাদের নিজেদের একটা স্বৈরাচারী রাজত্ব প্রায় কায়েম করে ফেলেছিল।

গ্র্যান্ট বাংলার ছোটলাট নিযুক্ত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান্টাস এ্যাসোসিয়েসনের একটা শক্তিশালী প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করল যে, বর্তমান সরকার নীলচাষের বিরোধী বলে কৃষকদের মধ্যে যে ধারণাটা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই, সরকারকে ঘোষণা করতে হবে যে তারা নীল চাষের বিরোধী নয়, এবং যে সব রায়ত নীলচাষের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাদের তা পালন করতেই হবে এবং এমন একটা আইন পাশ করতে হবে যার দ্বারা যারা নীল চাষের চুক্তিভঙ্গ করবে সংক্ষিপ্ত বিচারে (সুমারি ট্রাইল) তাদের শান্তি দেবার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিতে হবে।  সাধারণত যে চুক্তিতে স্বাক্ষর কৃষককে বাধ্য করা হতো তা ছিলঃ

১। নীলকরের কর্মচারীকে কৃষকের জমি মাপতে দিতে হবে (এই মাপ অনুসারে দেড় বিঘার জমিটা একবিঘা হয়ে যেত);

২। যে জমি নীলের জন্য মাপা হলো তাতে কৃষক নীল বুনতে বাধ্য থাকবে; ৩। নীলকরের নিকট থেকে চাষীকে নীলের বীজ কিনতে হবে;

৪। নিড়ান দিতে কৃষক বাধ্য ;

৫। কৃষককে ফসল কাটতে হবে;

৬। নিজের খরচে গরুর গাড়ী করে কৃষককে নীল গাছগুলি নীলকরের ফ্যাক্টরিতে পৌছে দিতে হবে। (ইনডিগো কম, রিপোর্ট, এপিক্স টেন)।

নীলকরদের স্মারকলিপির দ্বারা বড়লাট ক্যানিং খুব প্রভাবিত হলেন এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে খুব তাড়াতাড়ি করে একটা কড়া আইন পাশ করে দিলেন—১৮৬০ সালের ১১ আইন—এ্যাক্ট ১১ অফ ১৮৬০-যে আইন কৃষকদের নীল চুক্তি পালন করতে বাধ্য করবে এবং নীল চাষ সম্বন্ধে একটা তদন্ত কমিশন বসাবে। এই আইন ৪ঠা এপ্রিল থেকে ৩রা অক্টোবর, ১৮৬০ পর্যন্ত ৬ মাস বলবৎ থাকবে। এই আইন অনুযায়ী যদি কোনো কৃষক নীল চাষের জন্য দাদন নিয়ে চুক্তি বন্ধ হয়ে থাকে ও তদ অনুসারে নীল চাষ না করে তাহলে শুধুমাএ নীলকরের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে ম্যাজিটে তাকে ৩ মাসের জন্য জেল দিতে পারবেন এবং যদি কোনো ব্যক্তি কৃষককে নীল চাষ না করতে প্ররোচনা দেয় তাহলে তারও কারাদন্ড ও জরিমানা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপীল করা চলবে না। 

এই রকম একতরফা কঠোর আইনের উদাহরণ কোনো সভ্যদেশে কমই দেখা যায়। ইংলণ্ডের ভারত সচিব সার চার্লস উড এই ১১ আইনের তীব্র সমালোচনা করলেন। তিনি বড় লাট ক্যানিংকে লিখলেন যে তিনি এই আইনের জন্য খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছেন করণ চুক্তিভাগের জন্য দেওয়ানী মামলার (সিন্ডিল কেসেস) ব্যাপারে ম্যাজিস্টেটকে ফৌজদারী এক্তিয়ার (ক্রিমিনাল জরিসডিকশন) দেওয়া হয়েছে; তিনি আরও বললেন যে যেহেতু নীল হচেছ প্রকৃতপক্ষে বলপূর্বক চাষ (ফে রসড লেবার), আমরা কোনো কড়া আইন পাশ করে তাকে কার্যকরী করতে পারি না (উড টু ক্যানিং মে ৩, ১৮৬০)। খোলাখুলিভাবে উড ভারত সরকারকে জানালেন দেওয়ানী চুক্তি (সিভিল কনষ্ট্র কট) ফৌজদারী মামলার (ক্রিমিনাল এসেকিউশান) কারণ হতে পারে না। পচিশ বছর পূর্বে লর্ড মেকলে যখন ভারত সরকারের প্রথম আইন প্রণেতার পদে নিযুক্ত ছিলেন তখন লিখেছিলেন ঃ নীল চুক্তিগুলো নীতিগতভাবে অত্যন্ত আপত্তিকর….একদিকে নীলচুক্তির ফলে এবং অন্যদিকে নীলকরদের বেআইনী ও হিংসাত্মক কার্যের ফলে কৃষক প্রায় ভূমিদাসে পরিণত হইয়াছে। (মাইনিউট বই লর্ড ম্যাকিউলী, ১৭ই অক্টোবর, ১৮৩৫)। কিন্তু নীল কৃষক আজ ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বদ্ধপরিকর। পক্ষান্তরে নীলকররাও ১৮৬০ সালের বেআইনী ১১ আইন, পুলিশ, আদালতের সাহায্যে ভূমিদাস প্রথা ও বলপূর্বক কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শুরু হয়ে গেল বাংলার সমস্ত নীল এলাকার নীলকর, পুলিশ ও আদালতের তাণ্ডব। শত শত গ্রাম আক্রান্ত হলো, সহস্র সহস্র কৃষকদের গ্রেফতার, কারাদণ্ড ও জরিমানা হলো, অসংখ্য কৃষকের মাথা ফাটল, অনেক গ্রাম জ্বলে গেল, অনেক কৃষকের ঘর বাড়ি ভস্মিভূত হয়ে গেল, সহস্র সহসক সর্বস্বান্ত হয়ে গেল, অসংখ্য কৃষককে অপহরণ করে তাদের উপর চরম পাশবিক অত্যাচার করা হলো, ৫০ জনের অধিক কৃষককে ধারাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। সম্পূর্ণরপে নীলকরদের মুখের কথার উপর নির্ভর করে, সাক্ষ্য প্রমাণ উপেক্ষা করে ম্যাজিস্ট্রেটরা নীলকরদের পক্ষে রায় দিতে লাগল। আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগও কৃষকদের দেয়া হলো না। একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ৭৯টি মাললা ৪ দিনের মধ্যে সমস্ত তদন্ত শেষ করে সব কজন কৃষককে শাস্তি দিয়ে মামলাগুলো শেষ করে দিল।  গ্র্যান্ট তাঁর মিনিটে আরও বললেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট মামলার পরিচালনার সময় নীলকরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বসেন এবং আদালত নীলকরের আমলা ও মোক্তারদের দ্বারা ভর্তি হয়ে যায়। রায়তদের চুক্তি অমান্য করতে উত্তেজিত করছিলেন বলে এই মিথ্যা মামলায় রায়তদের মোক্তার তেতুরাম চক্রবর্তীকে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে এই মামলা শেষ হয়েছিল। (Minute of the Gov. G. P. Grant Aug 17, Indigo Papers, Vol. 3.)

সে সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে একটি সমসাময়িক ইংরেজ পরিচালিত পত্রিকা লিখেছিল ও বাংলার গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা আকস্মিক ও অত্যাচার্য পরিবর্তন এসে গিয়েছে। এক মুুহুর্তে তারা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। যে রায়তদের আমরা কীতদাসের মতো অথবা রুশদেশের ভূমিদাসের মতো চিন্তা করতে অভ্যস্ত ছিলাম, জমিদার ও নীলকরদের নির্বিরোধ যন্ত্ৰরুপে যাদের আমরা জানতাম অবশেষে তারা জেগে উঠেছে, কর্মতৎপর হয়ে উঠেছে ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে তাদের আর শিকল পরিয়ে রাখা চলবে না। বর্তমানে গ্রামের লোকরা যে-রকমের আশ্চর্য অনুভূতির দ্বারা নীল চাষকে পণ্য করছে ও যার ফলে তারা অনেক স্থানে ফেটে পড়েছে তা সবথেকে দূরদর্শী ব্যক্তিরাও কল্পনা করতে পারেননি। ১৮৫৭  সালের ঠিক পরেই এই সব ঘটনা বাংলার ভবিষ্যতের উপর যে খুব প্রভাব বিস্তার করবে তাতে সন্দেহ নেই। [১১২।

যে ৭৭ জন নীলচাষী নীল-কমিশনের নিকট সাক্ষ্য দেয় তা থেকে তারা নীলচাষ না করতে কতদূর বদ্ধপরিকর হয়েছিল তা জানা যায়। তাদের কয়েকটি মতামত এখানে দেয়া হলো : দিনু, মণ্ডল—“আমার গলা কেটে ফেললেও আমি নীল বুনবো না বরং মৃত্য স্বীকার করব, তবু নিল বুনবো না (উত্তর নং ১১৫০)। জামির মণ্ডল-অামি এমন দেশে চলে যাব যেখানকার লোক নীল কখনও চোখে দেখে না বা নীল বোনে না। (উত্তর নং ১১৫০)। হাজিমোল্লা-“বরং বাড়িঘর ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাব.. তবু নীল বুনব না। ভিক্ষা করে খাব, তবু নীল বুনব না। (উত্তর – ১৫১৬)। কবি মড়ল—“আমি কারো জন্যই নীল বুনব না, এমনকি বাপ-মার জন্যও না। পাঞ্জুমোল্লা—“আমাকে গুলী করে। মেরে ফেলন, তবু আমি নীল বুনব না। (উত্তর নং ১২৪৯)।  নদীয়া ডিভিশনের কমিশনার এ, গ্রেট বাংলা সরকারের সেক্রেটারির নিকট তাঁর সাপ্তাহিক রিপোর্টে” (১০ই—১৭ই মার্চ, ১৮৬০ ) কৃষকদের মনোভাব জানিয়ে লিখেছিলেন। এই সপ্তাহে আমি ডুমুর হুদা মহকুমা পরিদর্শন করেছি। সাধারণভাবে আমার যে ধারণা হয়েছে তা হচেছ যে রায়তর নীল না বুনতে পূর্বের চাইতে এখন টের বেশি বদ্ধপরিকর। এই আন্দোলন এখন ঢের বেশি শক্তিশালী এবং আমার মনে হয় ঢের বেশি ভালভাবে সংগঠিত।’(১১৩)। কিভাবে নীল চাষ বিরোধী আন্দোলন শুর হয়েছিল সে  সম্বন্ধে শিশির কুমার বলেছেন যে নদীয়া জয়রামপুর অঞ্চলের ১২টা গ্রমের কৃষক প্রতিনিধিরা জমায়েত হয়ে একবাক্যে ঘোষণা করলেন। আমরা কখনই আর নীল বুনবো না। এইভাবে ১৮৬০ সালের নীল বিদ্রোহ শুরু হলো এবং দেখতে দেখতে সমগ্র নীল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। শত অত্যাচার করেও কৃষকদের দ্বারা নীলচাষ করানো আর সম্ভব হলো না।

যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট ম্যালেনী বিভিন্ন গ্রাম থেকে ২০০০ কর্মীককে ডেকে তাদের নীল বুনতে রাজী হতে বললেন—অমনয় বিনয় ভয় দেখানো সবই হলো, কিন্তু কৃষকরা তাদের প্রতিজ্ঞায় অটল রইল, তখন হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে ম্যালোনী ৪৯ জনকে গ্রেফতার করে থানায় পাঠিয়ে দিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই আন্দোলনকে বলেছেন নিক্ৰিয় প্রতিরোধ আন্দোলন (বৃটিশ প্যারাম, উল্টসী…. আই, ১৯২৬)। প্রকৃত পক্ষে এ আন্দোলন নীলবোনার ব্যাপারে মাত্র একটা নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ হল না। প্রথম থেকেই এই অন্দোলন নীলকরদের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটা সক্রিয়, জঙ্গী ও সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করেছিল। বহুস্থানে কৃষকরাই অত্যাচারী নীলকরদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার আওরঙ্গবাদের ঘটনাটা বিষয়ে একটি চমৎকার উদাহরণ । আওরঙ্গবাদ নীল কুঠির মালিক এড্রজ, ম্যানেজর ম্যাকলিয়ড, তার সহকারী রইস এবং গোমস্তা-তফাজিল হোসেন। ইংরেজ নীলকরদের মতোই হোসেন ছিল লেভী, নির্দয় ও অত্যাচারী; ম্যানেজার ছিল তার হাতের মুঠোয় করে তার জন্য পূর্ণ বিবিকে জোগাড় করে দিয়ে সে তাকে খুশি করে রেখে দিয়েছিল। এই ভাবে সে কৃষকদের মাথা ভেঙ্গে অনেক জমিজমা টাকা পয়সা করে ফেলেছিল। মালিক হকুম দিল–কয়েকশত বিঘা নীলচাষ করতে হবে, নীলচাষ অনেক বাড়াতে হবে। কোমড় বেধে লেগে গেল ম্যাকিলিয়ড ও হোসেন, লাঠিয়াল লাগিয়ে জোর করে নীলচাষ করাতে। তারা হুকুম দিল-অবশিষ্ট ধানের জমিতেও নীল বুনতে হবে। কৃষকরা অস্বীকার করল। তখন কৃষক নেতাদের গ্রেফতার করার জন্য হোসেন নীলকরের লাঠিয়ালদের পাঠিয়ে দিল । কৃষকরা লাঠিয়ালদের প্রতি-আক্রমণ করে হটিয়ে দিল। তারা সেখানেই থামল না—নীলকুঠি আক্রমণ করে সেখানে যেসব কৃষকদের বন্দী রাখা হয়েছিল তাদের মুক্ত করে নিয়ে আসল। ২৩শে ফেব্রুয়ারীতে হোসেন আবার তার দলবল নিয়ে গ্রামে নীলের জমি মাপতে গেল কিন্তু কৃষকদের মতিগতি দেখে সে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে গিয়ে কুঠিতে আশ্রয় নিল। তার পিছন পিছন এসে ৩০০০ কৃষক কুঠি আক্রমণ করে হোসেনকে বেদম প্রহার দিল। কয়েকদিন পরে নীল কর হোসেনকে বরখাস্ত করে দিল। (জুডিসিয়াল প্রসিডিংস ২১-১৯, ২৪২ ২৪৮ মার্চ ১৮৬০) কৃষকদের এই বিদ্রোহ মালদহ জেলায় ছড়িয়ে পড়ল । সেখানে বাকর বাদে এই এন্ড্রজেরই একটা কুঠি ছিল। কৃষকরা আক্রমণ করে ধংস করে দিল।  পাবনা জেলা একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট যখন একটা ছোট মিলিটারী পুলিশ দল নিয়ে যে সব কৃষকরা নীলবোনায় বাধা দিতে জমায়েত হয়েছিল তাদের বাধা দিতে গিয়েছিলেন তখন তারা কৃষকলাঠিয়ালদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিলেন। (বাকল্যাণ্ড আই পি ১৮৮)

১৮৬০ সালের ১৬ই মার্চ নীলকররা গ্রান্টকে একটা স্মারকপত্র পাঠায় তাতে তারা অভিযোগ করে যে কৃষকরা দলবদ্ধভাবে বিদ্রোহীভ,বাপন্ন হয়ে উঠেছে এবং নীলকররা চাষীদের দিয়ে আর নীলচাষ করতে পারছে না। সিন্দুরী কুঠির উদাহরণ দিয়ে তারা বলে যে মফস্বলের আদালতগুলোতে কোনো রায়তের বিরদ্ধে এখন কোনো মামলা আনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, কারণ আমাদের অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য আমরা কোনো সাক্ষী যোগাড় করতে পারছি না; এমনকি আমাদের কর্মচারীরা পর্যন্ত আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে আর সাহস করে না; এবং রায়তরা বর্তমানে খুব উত্তেজিত অবস্থায় আছে, বস্তুত তারা ক্ষেপে গিয়েছে, যেকোনো প্রকার দুষ্কর্মের জন্য তারা প্রস্তুত। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি ও বীজের গোলাগুলীতে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টায় আছে। আমাদের অধিকাংশ ঝি-চাকররা আমাদের ত্যাগ করে চলে গিয়েছে, কারণ রায়তরা তাদের ভয় দেখিয়েছে যে তাদের তারা খুন করবে নয়তো তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে, এবং আমাদের আশঙ্কা হচেছ যে, যে দুএক জন আমাদের সঙ্গে এখনও আছে তারাও শীঘ্রই চলে যেতে বাধ্য হবে, কারণ পাশের বাজারে তারা খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারছে না। নীলকররা কৃষকদের দঃবিয়ে রাখার জন্য ছোটলাটকে সত্বর কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বলল, তা নইলে তাদের আর মফস্বলে ধনপ্রাণ নিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। সমস্ত জেলায় বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তারা বলল ঃ ১। মোল্লাহাটি কুঠির সহকারী ম্যানেজার ক্যাম্পবেলকে অক্রমণ করে মেরে, মৃত মনে করে মাঠের মাঝে ফেলে রাখা হয়েছিল; ২। ঐ কুঠির আর একজন সহকারী হ ইড যখন ঘোড়ায় চড়ে যাচিছল তখন তাকে কৃষকরা অাক্রমণ করে, কিন্তু ঘোড়ার দ্রতগতির জন্য সে বেচে যায়; ৩। খাজুরর কুঠি কৃষকরা লুঠ করে জ্বালিয়ে দিয়েছে; ৪। লোকনাথপুরের কুঠি অক্রান্ত হয়েছিল; ৫। চাঁদপুরে গোলদার কুঠির গোলায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল ; ৬। বামনদি কুঠির চাষীরা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করছে অন্যান্য কুঠিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত কৃষ্ণনগর জেলাটাই নীলকরদের আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে। [১১৪]

এই সংবাদ পরিবেশন করে হরিশ মুখার্জী তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট-এ দুঃখ করে বলেছেন যে, নীলকররা তাদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য সংগঠিত ভাবে কাজ করছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় রায়তদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য তাদের কোনো সংগঠন নেই। সেই যুগেই হরিশ চন্দ্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। এই সময়কার ‘ঢাকা নিউজ’ লিখেছিলঃ  রুশদেশের শত শত বছরের ভূমিদাসরা তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করছে। বাংলাদেশের রায়তরা যদি তাদের জমিতে স্বাধীনভাবে চাষ করতে চায়, অথবা জন্মাবার পূর্ব থেকেই তাদের শ্রমকে বিক্রি করার পরিবর্তে নিজেদের খুশিমতো তা নিয়োগ করতে চায়, তাহলে কেন আমরা তাদের বাধা দেব।’ [১১৫]

  দ্বিতীয় বেঙ্গল পুলিশ ব্যাটলিয়নের পরিচালক হাবিলদার সেভো খান পাবনা জেলার নিশানপুর কুঠি থেকে তাঁর দেশে একটা চিঠিতে (১০ই এপ্রিল, ১৮৬০ ) লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, সকাল বেলায় আমরা প্রস্তুত হয়ে পীরারী নামক একটা গ্রামে মাচ করে গেলাম। সেখানে পৌছবামাত্রই সড়কি, তীর-ধনুক, লাঠি নিয়ে দুহাজার লোক আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। তারা ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে এল এবং একটা সড়কি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘোড়াটাকে জখম করল। আমরা শুনলাম যে এই বিদ্রোহীরা আশে পাশের ৫২টি গ্রাম থেকে এসে জমায়েত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন লোক আমাদের খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং ঐদিক থেকে কয়েকটা গুলীর আওয়াজও এসেছিল। [১১৬] এই ঘটনার শেষ কি হলো তা এই হাবিলদারের চিঠিতে জানা যায় না। এই ঘটনা থেকে আর একটা জিনিস স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে বিদ্রোহী কৃষকরা লড়াই করবার জন্য ভালোভাবেই প্রস্তুত হচ্ছিল—তার জন্য তারা কেবলমাত্র সড়কি, তীর-ধনুকের উপরই নির্ভর করেনি, বন্দুক, গোলাবারুদও সংগ্রহ করেছিল।

  এই সময়ে নীলকর সমিতির অস্থায়ী সম্পাদক ফোবর্স বাংলা সরকারের সেক্রেটারিকে লিখেছিলেন যে, আমার মতে নিম্নবঙ্গে একটা সাধারণ বিদ্রোহ এখন সুনিশ্চিত, যদি সরকার অবিলম্বে এটা দমন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করেন। বাংলা সরকারের সেক্রেটারী এই রিপোর্টের উপর মন্তব্য করেছিলেনঃ সরকারের সাহায্য ছাড়া কৃষকদের অসন্তোষ দমন করা এখন নীলকরদের ক্ষমতার একেবারে বাইরে চলে গিয়েছে। [১১৭]

   মার্চ, এপ্রিল, মে, জুনে বিদ্রোহের আগুন নদীয়া, যশোর বারাসত, পাবনা, রাজশাহী, ফরিদপুর—চারদিকে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল। এক উদ্দীপনা, এক নতুন আশা ও উৎসাহ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান কৃষকরা অগ্রসর হয়ে চলেছে। এপ্রিল মাসে বারাসতের সমগ্র কৃষকরা একবাক্যে ঘোষণা করল যে তারা আর নীল বুনবে না। জুলাই মাসে বৃটিশ জমিদার ও বণিক সমিতির সভাপতি ম্যাকিনটে ইংল্যাণ্ডে ভারত সচিব স্যার চার্লস উডকে যে চিঠি লিখেছিলে তা থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় কৃষকদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা কত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ম্যাকিনটে লিখেছিলেনঃ

   মফস্বলের অবস্থা হচ্ছে বর্তমানে (জুলাই, ১৮৬০) সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খল। কৃষকরা তাদের দেনা ও চুক্তিপত্র অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তাদের পাওনাদার ও মালিকদের দেশ থেকে একেবারে তাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে। তারা চায় এই প্রদেশ থেকে সমস্ত ইউরোপীয়দের তাড়িয়ে দিতে, তাদের যেসব সম্পত্তি তারা দখল করছে সেগুলি রাখতে ও ইউরোপীয়দের কাছে সমস্ত দেনা  নাকচ করে দিতে।'[১১৮]

   ১৮৫৯ সালে হার্সেল যখন নদীয়া জেলায় ম্যাজিস্টেট হয়ে  আসেন তখন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে নীলচাষ সম্বন্ধে কৃষকরা খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। রায়তদের মধ্যে সাধারণভাবে একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে তাদের মুক্তির আর বিলম্ব নেই তারা এমন ভাবে ব্যবহার করছিল যে তারা যেন একই সাংঘাতিক রকমের উৎপীজনের হাত থেকে রক্ষা পেতে যাচ্ছে, কিন্তু সেই মুক্তির মন্দগতিতে তারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল।……নীলচাষ সম্বন্ধে রায়তরা আগের চাইতে এখন দশগুণ বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

  নীলচাষীদের সংগ্রাম কত তাড়াতাড়ি বৈপ্লবিক আকার ধারণ করছিল তার খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায় কৃষ্ণনগরের জার্মান পাত্তী বমভাইটসের ইণ্ডিয়ান ফিল্ড-এ (৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৫) প্রকাশিত একখানা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে, বল্লভপুরের প্রজারা নীলচাষ করতে অসম্মত হলে নীলকর লাঠিয়াল লাগিয়ে তাদের গ্রাম আক্ৰমণ করবে বলে শাসিয়েছিল, কিন্তু মূহুর্তের মধ্যে গ্রামের লোকরাও লড়াইয়ের জন্য তৈরি হলো। নীলকরের পরিকল্পিত আক্রমণ কার্যে পরিণত হয়নি তার কারণ নীলকরের লাঠিয়ালরা লড়াইয়ের জন্য প্রজাদের দৃঢ়সংকল্প দেখে ভীত হয়ে পড়েছে। কৃষকরা ৬টা বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজেদের ভাগ করে নিয়েছিল। একটা কোম্পানি হয়েছিল শুধু তীরধনুক নিয়ে। প্রাচীনকালের ডেভিডের মতো ফিঙ্গাদ্বারা নিক্ষেপকারীদের নিয়ে আর একটা কোম্পানি।ইটওয়ালাদের নিয়ে আর একটা কোম্পানি, যারা আমার উঠোন থেকেও ইট-পাটকেল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। আর এক কোম্পানি হলো বেলওয়ালাদের; তাদের কাজ হলো শক্ত কাঁচা বেলগুলো নীলকরের লাঠিয়ালদের মাথা লক্ষ্য করে মারা। থালাওয়ালাদের নিয়ে আরো একটা কোম্পানি, তারা তাদের ভাত খাবার পিতলের থালাগলো অনুভমিকভাবে শত্রুকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে, তাতে শত্রু নিধন ভালো করেই হয়। আরও একটা কোম্পানি হলো রেলাওয়ালাদের নিয়ে, যারা খুব ভালো করে পোড়ানো ভাগা কিংবা আস্ত মাটির বাসনকোসন নিয়ে শত্রুকে অভ্যর্থনা জানায়। বিশেষ করে বাঙ্গালী মেয়েরা এই অস্ত্র প্রয়োজন মতো ভালোভাবেই ব্যবহার করতে জানে। এদিন নীলকরের লাঠিয়ালরা যখন দেখতে পেল যে মেয়েরা এইসব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে, তখন তাঁরা ঘাবড়ে গিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল। এসব ছাড়া আরও একটা বাহিনী গঠিত হয়েছে, যারা লাঠি চালাতে পারে তাদের নিয়ে। তারপর তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনী হল যুধিষ্ঠির কোম্পানি অথাৎ সড়কিওয়ালারা। এই কোম্পানিতে মাত্র বারো জন লোক আছে, কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার একজন সড়কিওয়ালাই ১০০ জন লাঠিকালকে হটিয়ে দিতে পারে। এরা সংখ্যায় কম হলেও এরা দুর্ধর্ষ এবং এদেরই ভয়ে নীলকরের লাঠিয়ালরা এমন ভীত হয়ে পড়েছে যে এখন পর্যন্ত তারা এগোতে সাহস করেনি। [১১৯]

  বাংলার কৃষকরা কিভাবে নীলকরদের প্রতিরোধ করল তার একটু আভাস দিয়েছেন শ্রী অনাথ নাথ বসু তাঁর মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ গ্রন্থে লাঠিয়ালগণের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য কৃষকগণ এক অপূর্ব কৌশল আবিষ্কার করিয়াছিল। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে তাহারা একটি করিয়া দুন্দুভি রাখিয়াছিল। যখন লাঠিয়ালগণ গ্রাম আক্ৰমণ করিবার উপক্ৰম করিত, কৃষকগণ তখন দুন্দুভি ধ্বনি দ্বারা পরবর্তী গ্রামের রাইয়তগণকে বিপদ সংবাদ জ্ঞাপন করিলে তাহারা আসিয়া দলবদ্ধ হইত। এইরূপ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চারি-পাঁচখানি গ্রামের লোক একত্র হইয়া নীলকর সাহেবদিগের লাঠিয়ালগণের সহিত তুমুল সংগ্রামে ব্যাপৃত হইত। [১২০]

   এই প্রসঙ্গে সতীশচন্দ্র মিত্র লিখেছেনঃ ‘গ্রামের সীমায় একস্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোকে অত্যাচার করিতে গ্রামে আসিলে কেহ সেই ঢাক বাজাইয়া দিত, অমনি শত শত গ্রাম্য কৃষক লাঠিসোঁটা লইয়া দৌড়াইয়া আসিত। নীলকরের লোকেরা প্রায়ই অক্ষত দেহে পালাইতে পারিত না। সম্মিলিত প্রজাশক্তি বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হওয়া সহজ ব্যাপার নহে। প্রজাদের নামে অসংখ্য মোকদ্দমা হইত, তাহারা জেলে যাইত-বিচারালয়ে তাহাদিগকে সমর্থন করিবার লোক জুটিত না। বৃটিশ ইণ্ডিয়ান সভা হইতে দুই-তিন জন মাত্র মোক্তার পাঠান হইয়াছিল, তাহারা সব মোকদ্দমার কার্য করিতে পারিতেন না। এই সময়ে শিশিরকুমার তাহার অঞ্চলে প্রজার একমাত্র বন্ধু ছিলেন; তিনি নানাভাবে উহাদিগকে সাহায্য করিতেন।….. সিপহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে নানা সাহেব ও তাঁতিয়া তোপীর নাম দেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; নীল-বিদ্রোহী কৃষকরাও তাহাদিগের নেতাদিগকে এই সব নামে অভিহিত করিত। [১২১]

  যেসব বাঙ্গালীরা দাবি করেন যে সিপাহী-বিদ্রোহ বাঙ্গালীর মনে রেখাপাত করেনি, বাঙ্গালীর মন জয় করতে পারেনি, উপরের এই উদ্ধৃতিটিই প্রমাণ করে তাঁদের উক্তি কতখানি ফাঁকা। হতে পারে যে তথাকথিত অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীর তথাকথিত গর্বান্ধ প্রগতিবাদীদের প্রশংসাভাজন হতে পারেননি, কিন্তু তাঁরা যে বাংলার প্রথম ব্যাপক মুক্তিসংগ্রামের জঙ্গী কৃষক জনসাধারণের মন ভালোভাবেই জয় করতে পেরেছিলেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

  শিশিরকুমার ঘোষের বয়স যখন ১৭/১৮ বছর তখন তিনি নীল-বিদ্রোহে একটি বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করেছিলেন এই বিদ্রোহ চলাকালে তিনি যেসব চিঠি লিখেছিলেন তা অন্যত্র আলোচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি ১৮৮০ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন [১২২], তাতেও আমরা এই বিদ্রোহ সম্বন্ধে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান পাই। তাতে তিনি বলেছিলেন যে বাংলার ৫০ লক্ষ নীলচাষী যে পরিমাণ দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিল তার উদাহরণ জগতের ইতিহাসে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। যেসব কৃষকদের জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল তারা পর্যন্ত নীল বনতে রাজী হয়নি, যদিও তাদের যথাবিধি সরকারীভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে তাদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে, তাদের ঘর-দুয়ার, যা নীলকররা ধ্বংস করে দিয়েছে, সেগুলিকে আবার তৈরি করে দেয়া হবে এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র পরিবারদের, যারা ভিখারী হয়ে তখন দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ফিরিয়ে এনে দেয়া হবে। [১২৩]

   শিশিরকুমার বলেন যে, কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৃতিত্ব হচ্ছে দুইজন ব্যক্তির কৃষ্ণনগরের নিকট চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের। বিষ্ণুচরণ একজন ছোট জোতদার ও দিগম্বর একজন ছোট মহাজন ছিলেন। তাঁরা উভয়েই কিছুকাল বিভিন্ন কুঠিতে দেওয়ানের কাজ করেছিলেন কিন্তু আতাসম্মান বজায়  রেখে কোথাও সেই কাজে বেশি দিন থাকতে পারেননি। নীলকরদের অত্যাচারের ফলে ক্রমশঃ তারা কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ালেন ও সংঘবদ্ধ করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। এই সময়টা ছিল যখন সাহেব বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য বিদ্রোহ পরিচালনা  কিন্তু নানার প্রচেষ্টা ছিল সরকারের বিরুদ্ধে, আর এই দুই বিশ্বাসের প্রচেষ্টা ছিল নীলকরদের বিরুদ্ধে। চৌগাছার বিশ্বাসদ্বয়ের কথা লিখতে গিয়ে বঙ্কিচন্দ্রের জীবনীকার লিখেছেনঃ কত ওয়াট টাইলর, হ্যামডেন, ওয়াশিংটন নিরন্তর বাংলায় জন্মগ্রহণ করিতেছেন ক্ষুদ্র বনফুলের মত মানুষ্য নয়নান্তরালে ফুটিয়া ঝাটকাঘাতে ছিন্নভিন্ন হইতেছে, আমরা তাহা দোখিয়াও দেখি না–আমরা তাহার চিত্র তুলিয়া রাখি না; কেননা আমরা ইতিহাস লিখিতে জানি না–সবে চিত্র আঁকতে শিখিতেছি।…..বাঙ্গালী মার খাইয়া অবশেষে মারিবার জন্য বুক বাঁধিয়া দাঁড়াইল। একখানি ক্ষুদ্র গ্রামের (চৌগাছার) দুইজন সামান্য প্রজা… এই দুই স্বার্থত্যাগী মহাপুরষ বাংলার নিঃস্ব সহায়শূন্য প্রজাদের এক প্রাণে বাঁধিল—সিপাহী বিদ্রোহের সদ্যনির্বাপিত আগুনের ভস্মরাশি লইয়া গ্রামে গ্রামে ছড়াইতে লাগিল। [১২৪]

 নদীয়া জেলার বাঁশবেরিয়া কুঠির ম্যানেজার উইলিয়ম হোয়াইট ১৭৫৯ সালে নীলচাষ বাড়াবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। নদীয়ার ম্যাজিসেট ছিলেন তার বন্ধু দিগম্বর ও বিষ্ণু নীল বোনার বিরুদ্ধে  কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন শুরু করলেন। প্রথমে কেবলমাত্র গোবিন্দপুরের (হসিখালি নিকট) কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হলো। ১৩ই সেপ্টেম্বর হোয়াইট ৫০০ লাঠিয়াল ও কয়েকটা হাতি নিয়ে গোবিন্দপুর আক্রমণ করল। দিগম্বরের পরিচালনায় একদল বর্শাধারী কৃষক তাদের হটিয়ে দিল। নতুন ম্যাজিস্টেট টটেনহাম তদন্ত করে দেখলেন যে হোয়াইটই দোষী, সুতরাং তিনি তাকে ৩০০ টাকা জরিমানা করলেন। (লেটার অব টটেনহাম ইন দি হিন্দু প্যাষ্টিয়এ জানুয়ারী ২১, ১৮৬০)।

   নীলকরর তখনও খুব শক্তিশালী। তাদের চাপে পড়ে সরকার টটেনহামকে অন্যত্র বদলী করে দিল। এইবার হোয়াইট ১০০০ লাঠিয়াল নিয়ে চৌগাছা ও পোড়াগাছ আক্রমণ করল। নীলকররা এরূপভাবে ব্যবহার করতে সাহস করছিল সদর থানা কৃষ্ণনগর শহরের ৮/১০ মাইলের মধ্যে। এবারকার লড়াইয়ে গ্রামবাসীরা হটে গেল; একজন কৃষক প্রাণ দিল। নীলকরের লাঠিয়ালরা গ্রাম লুট করল, তারপর আগুন লাগিয়ে জালিয়ে দিল। কয়েকদিনের মধ্যে মামলা শুরু হয়ে গেল, অনেক কৃষককে গ্রেফতার করা হলো, অনেক কৃষকের জেল হলো। বিশ্বাসদের ধরবার অনেক চেষ্টা করা হলো, তারা গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকলেন। বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর মামলার সমস্ত খরচ নিজের দিলেন। যারা জেলে গেল তাদের পরিবার প্রতিপালনের খরচও তাঁরা দিলেন। এইভাবে তাঁদের সঞ্চিত ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল। তাঁদের নিজেদের জীবনও সব সময়ই নীলকরের লাঠিয়ালদের জন্য বিপন্ন হয়ে থাকত। রাত্রিকালে যেকোনো সময়ে তারা আক্রান্ত হতে পারতেন। তাঁরাও সব সময় যেকোনো হামলায় জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতেন। স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী গ্রামকে দিবারাত্র পাহারা দিত।

 বিষ্ণুবিচরণ ও দিগম্বর দেখলেন যে একটা লড়াইয়ে অন্তত নীলকরদের হারাতে না পারলে গ্রামে আর কারও বাস করা সম্ভব হবে না। শুধু চৌগাছাই নয়, আশেপাশের গ্রাম থেকেও মেয়ে ও শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বরিশাল থেকে কয়েকজন নামকরা লাঠিয়াল নিয়ে আসা হলো। কৃষকরা দলে দলে লাঠিচালনা, সড়কি চালনা ইত্যাদি শিখতে লাগল। একজন রায়তও নীল বুনল না ;  কিছুদিনের মধ্যেই কাঠগড়া কুঠি (চৌগাছা যার অন্তর্গত ছিল) বন্ধ হয়ে গেল।

  কৃষকদের ভালো করে জব্দ করবার জন্য এবার নীলকর ১৫০০ লাঠিয়াল নিয়ে লোকনাথপুর আক্রমণ করল। এবার কৃষকরা এই আক্ৰমণের জন্য তৈরিই ছিল। বহু ক্ষণ লাঠি-যুদ্ধের পর নীলকরের লাঠিয়ালরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল। কৃষকদের এইটাই হলো প্রথম বড় জয়। এরপর তারা এইরকম আরও অনেক লড়াইয়ে জয়লাভ করেছিল। শিশিরকুমার সর্বশেষে উপরোক্ত প্রবন্ধে অনুযোগ করে লিখেছিলেন যে তখনকার সংবাদপত্ৰগুলি বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বরের সম্বন্ধে কিছু লেখেনাই তাঁদের নাম পর্যন্ত কেউ জানে না এবং এই হচ্ছে সর্বপ্রথম যে তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে লেখা হচ্ছে। উভয়েরই বংশধর এখনও বেঁচে আছেন। দিগম্বর বাবু একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্র মোটেই ভালো অবস্থায় দিন যাপন করছেন না।

  চৌগাছার এবং দিগম্বর ও বিষ্ণুচরণের বীরত্বপূর্ণ উদাহরণ সমস্ত নীল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল এবং সর্বত্র কৃষকদের সংগঠিত হতে উদ্দীপনা যোগল ।এই প্রসঙ্গে সতীশচন্দ্র মিত্র যা লিখে গিয়েছেন তাও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্যঃ শুধু চৌগাছার বিশ্বাসেরা নহেন, দেশ মধ্যে এমন অনেক লোকের আবির্ভাব হইয়াছিল। এই বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িক নহে; যেখানে যতকাল ধরিয়া বিদ্রোহের কারণ বর্তমান ছিল সেখানে ততকাল ধরিয়া গোলমাল চলিয়াছিল। উহার নিমিত্ত যে কত গ্রাম্য বীর ও নেতার উদয় হইয়াছিল, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাহাদের নাম নাই। কিন্তু তাহাদের মধ্যে অনেকে অবস্থানসারে যে বীরত্ব, স্বার্থত্যাগ ও মহাপ্রাণতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার কাহিনী শুনিবার ও শুনাইবার জিনিস। যাহারা তাহার চাক্ষুষ বিবরণ দিতে পারিতেন, আজ ৬৪ বছর পরে (১৩২৯ সালে লিখিত) তাঁহাদের অধিকাংশই কাল-কবলিত। এখনও গল্পগুজবে যাহা আছে, শীঘ্রই তাহা লুপ্ত হইবে।  প্রাচীন যশোহরের মানচিত্রে কত শত গ্রামের নীলকুঠির চিত্র আছে; এখনও উহার অনেক ভগ্নস্তুপ ইমারতের গায়ে বা রাস্তা খোয়ায় আত্মগোপন করে নাই। ঐ সকল কুঠির তিরোভাবের সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিকতা বিজড়িত আছে।…কিন্তু কে আজ সেই যুদ্ধক্ষেত্রের তালিকা নির্ণয় করিবে ? লড়াইত অনেক হইয়াছিল, আজ কয়জনে তাহার খবর রাখে ?…এখনও কৃষকের মুখে গ্রাম্যসরে শুনিতে পাওয়া যায়ঃ

মোল্লাহাটের লম্বা লাঠি রইল সব হুদোর আঁটি। কলকাতার বাবু ভেয়ে বজরা চেপে লড়াই

দেখব বলে।

  লড়াই হইয়াছিল, কত লোক কত স্থানে হত না আহত হইয়াছিল তাহার খবর নাই। খবর এইটুকু আছে, তাদের যন্ত্রণা ও মৃত্যু সফল হইয়াছিল, জেদ বজায় ছিল।  মোল্লাহাটির যে লম্বা লাঠির বলে নীলকরেরা বাঘের মত দেশ শাসন করিতেন, প্রজারা চাষ বন্ধ করিলে সে লাঠির আঁটি পড়িয়া রহিল, উহা ধরিবার লোক জুটিল না। নীলকরের উৎপাত বন্ধ হইয়া আসিল। [১২৫]

  ইতিহাসকার সতীশচন্দ্রের এই লেখা প্রায় ৪০ বছর পূর্বের। কিন্তু বাঙালীর প্রথম মুক্তি-সংগ্রামের গ্রাম্য বীরদের কাহিনী দূর্ভাগ্যবশত এখনও লিপিবদ্ধ হয়নি। ঘটনার একশো বছর পরে লিপিবদ্ধ না করার ফলে আজ অনেক কিছু বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও গল্পগুজবে, কিংবদন্তীতে যা আছে, তা সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ হলে ইতিহাসের পক্ষে তার মূল্য কম হবে না।

  এই সংগ্রাম পরিচলনা করবার জন্য কৃষকদের মধ্য থেকেই এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু নেতা বেরিয়ে এসেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্টেট হার্সেলকে নীল-কমিশন জিজ্ঞেস করেছিলঃ আপনি কি এমন মোড়লকে জানেন যে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি ও দৃঢ় চরিত্রের দ্বারা রায়তদের উদ্বােধিত করতে পারে ও অন্যান্য গ্রামের রায়তদের ঐক্যবদ্ধ করত পারে ? এ প্রশ্নের জবাবে কোনো ইতঃস্তত না করে হার্সেল বলেছিলেন, আমি এই ধরনের একশ লোকের নূম করতে পারি। একটা গ্রামে এমন সব নেতাদের অবির্ভাব হয়েছে যারা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেছে।[১২৬]

  বাঙ্লার নীলচাষের প্রায় প্রথম থেকেই নীলকৃষকদের সশস্ত্র বিদ্রোহের একটা ঐতিহ্য আছে। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি হচ্ছেন বিশ্বনাথ সর্দার, ‘বিশে ডাকাত’ নামে যিনি পরিচিত। তখন কোনো রাজনৈতিক দল বা আন্দোলন না থাকায় এই সব দুঃসাহসী ব্যক্তিরা অনেক সময় ডাকাত দল গড়তেন; আসলে এরা বিদ্রোহের নায়ক। বিশ্বনাথের সুবৃহৎ দলে সহস্রাধিক বলবান ব্যক্তি সশস্ত্র হইয়া প্রস্তুত থাকিত। ইহাদের প্রত্যেকের উপর বিশ্বনাথের কঠোর আদেশ ছিল, যেন কেহ কদাচ স্ত্রীলোক, শিশু ও গোজাতির উপর কোন অত্যাচার না করে। (কুমদ নাথ মল্লিক, নদীয়া কাহিনী, পৃঃ ৫৯)

  এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসায়ী কুঠিগুলি ছিল কৃষক-কারিগর শোষণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কোম্পানীর ইংরেজ কর্মচারীরা ও তাদের ভারতীয় দালালরা নামমাত্র মূল্যে তাঁতীদের কাছ থেকে প্রায় জোর করেই বস্ত্রগুলি কেড়ে নিত এবং তা ইংল্যাণ্ডে ও ইউরোপে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করত। অন্যতম প্রধান বস্ত্রকেন্দ্র শান্তিপুরের তাঁতীদের ও জনসাধারণের দূর্দশা চরমে উঠেছিল। বিশ্বনাথ এইরকম কতকগুলি কুঠি লুট করেছিলেন এবং তার ইংরেজ ও বাঙালী কর্মচারীদের শাস্তি দিয়েছিলেন।

  নদীয়াতে সেই সময় নীলচাষ বিস্তার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে নীলকরদের অত্যাচারও বেড়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে সব থেকে কুখ্যাত ছিল স্যামুয়েল ফেডি। বিশ্বনাথ ফেডির কুঠি একাধিকবার আক্রমণ করেন ও লণ্ঠন করেন, এবং একবার তাকে বন্দী করে নিয়ে যান। মিসেস ফেডি পুকুরে নেমে একটা কালো হাড়ির নিচে মাথা লুকিয়ে কোনো মতে আত্মরক্ষা করে। ইংরেজ কুঠিয়ালদের উপর এইরুপ বারংবার সুসংগঠিত সশস্ত্র আক্রমণের ফলে কোম্পানী সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। একবার একটা বড় সৈন্যদল তাকে ঘেরাও করে ফেলে তাঁকে বন্দী করে ও তাঁকে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করে।

  সদর বিশ্বনাথের কার্যকলাপের সময় ছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। চূর্ণী নদীর তীরে–হাঁসখালি, মন্নুর হাট, কৃষ্ণপুর, বাবলা বন, রাণী নগর, চন্দন নগর, চৌগাছা, খালবোলিয়া, গোবিন্দপুর ও আসাননগর ইত্যাদি গ্রামগুলি—যেখানে নীলকুঠির সুবৃহৎ অট্টালিকার ভগ্নাবশে আজও দেখা যায়—ছিল বিশ্বনাথের কার্যের কেন্দ্রস্থল। বিশ্বনাথ সম্বন্ধে হার ধন দত্ত লিখেছেনঃ “ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সেকালের গোঁড়া সমাজ নেতারা বিপদের আশঙ্কার দিন গুণতে থাকে।…গরীব দুঃখিরা কিন্তু ততটা বিচলিত হয়নি। তাঁর দুঃসাহসিক ক্রিয়া-কলাপে মহত্ব, দেশপ্রীতি, দানশীলতা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা,  শিশুর প্রতি দয়া ও দরিদ্রের প্রতি অবিমিশ্র সহানুভূতি প্রভৃতি গুণ ও চরিত্র-মহত্ব তাঁকে মনুষ্যত্বের গরিমায় মণ্ডিত করে।’ [১২৭]

 এই রকম আর একজন কৃষক নেতার নাম এস্থলে করা যেতে  পারে। কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের মেঘাই সর্দার নীলকরের বিরুদ্ধে চাষীদের ঐক্যবদ্ধ করেন।

অনেকবার নীলকরের লাঠিয়ালদের সঙ্গে মেঘাই সর্দারের দলের সংঘর্ষ হয়। একবার সুযোগ পেয়ে নীলকরের লোকেরা মেঘাইকে নৃশংসভাবে রাস্তার উপর হত্যা করে। মেঘাইর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নীলকরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন করার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। শেষ পর্যন্ত এই কৃষক-নেএীর পরিণতি হয়েছিল জানা যায়নি। এই কাহিনী আসাননগরের প্রাচীন গ্রামবাসীদের নিকট এখনও শোনা যায়। 

মালদহ জেলার ওয়াহাবী দলের রফিক মন্ডল ছিলেন নীল বিদ্রোহের বিখ্যাত নেতা। নীলকরদের বিরদ্ধে কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য ১৮৫৩ সালে তার কারাদণ্ড হয়। (হান্টার ও ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃঃ ১৮৭) মুক্তি লাভের পর পুনরায় তিনি মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সংগঠন করার কাজে অাত্ননিয়োগ করেন। একজন সমসাময়িক ইংরেজ লেখক রফিক মণ্ডলের ভূমিকা সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে নীল বিদ্রোহের সময় তিনি পূরোভাগে থাকতেন, তাঁর সমস্ত ও অর্থ তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করতেন, এবং প্রত্যেকটি সংগ্রাম শেষ পর্যত লড়তেন।…নীলকরদের সঙ্গে তিনি কখনও কোনো আপোষ করেননি। (Routledge: English Rule and Native Opinion –

নড়াইলের জমিদার রামতন রায় বহুকাল যাবৎ কি দৃঢ়তার সঙ্গে নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সে সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর নায়েব মহেশচন্দ্র চ্যাটার্জীর নাম—তিনি নিজেও একজন ছোট জমিদার—বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর সম্বন্ধে রিপোর্ট করেছিলেন যে তিনি হচেছন সব থেকে বিপজনক আন্দোলনকারী—দি মোস্ট ডেঞ্জারাস এজিটেটর, (ইন্ডিয়ান প্রসেডিংস, মার্চ ২৯, পি, ৬০ ) 1 কয়েকজন নীলকর নীল-কমিশনের নিকট অভিযোগ করে যে মহেশ চ্যাটার্জী তাদের বিরুদ্ধে কৃষক ক্ষেপিয়ে বেড়ান। নীলকর জেমস হিল বলপূর্বক তাঁর অনেক জমি দখল করে নেয়। তার পর থেকে তিনি নীলকরদের কোনোদিনই ক্ষমা করেননি। রাজশাহী ডিভিসনের কমিশনার রীড তার রিপোর্টে বলেছিলেনঃ পাবনা জেলার অধিকাংশ নলকুঠি গুলির রায়তরা কোনো নীল না বুনতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে।… ঐ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট করেছেন যে নীলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দেবার জন্য রায়তর নিজেদের মধ্যে জোর সংগঠন তোর করে ফেলেছে এবং এই কাজে নদীয়া জিলার অধিবাসী মহেশচন্দ্র চ্যাটার্জী প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। (Confidential Report of Reld, Commissioner najshahi Division State Archives, Government Bengal quoted by Goutam Chatto padhaya in his Indigo Rebellion and Remark Session of Bengal Council ainstream (Weekly). Feb. 10, 1973)

মহেশচন্দ্র দামুরহুদা অঞ্চলে তিনি কৃষকদের সঙ্গবদ্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা নীলকরদের প্রতিরোধ করেন। মোল্লাহাটিব কুখ্যাত ম্যানেজার ফরলং নীল-কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছিল যে নিশ্চিন্তপুর কুটির গণ্ডগোলের মূলে ছিলেন এই মহেশচন্দ্র। আর্চিবল্ড হিলস মহেশচন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা এ হল এই বলে যে, তিনি প্রতিরাতে কৃষকদের নিয়ে মিটিং করেন। কৃষকরা যাতে নীল না বোনে এবং নীলকরের লোকেরা যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে এবং যাতে তারা তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করে তার জন্য তাদের উত্তেজিত করতেন।

দুইজন বড় জমিদার-রানাটের শ্রীগোপাল পাল চৌধুরী ও তার ভ্রাতা  শ্যামচন্দ্র পাল চৌধুরী-নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। শ্রীগোপালের রানাঘাটের বাড়িটি ছিল নীলকরবিরোধী জমিদারদের মিলনক্ষেত্র। নীলবিদ্রোহের সময় যখন চৌগাছার বিশ্বাসদের গ্রাম নীলকরেরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল ও যখন দিগম্বর বিষ্নুচরন আত্মগোপন করে কৃষকদের সংগঠন করছিলেন সেই সময় শ্রীগোপাল তাদের পরিবারবর্গকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শ্রী গোপাল সরাসরি নীলকরদের সঙ্গে সংষর্ষ এড়িয়ে চলতেন কিন্তু শ্যামচন্দ্রের লাঠিয়ালদের সঙ্গে নীলকরদের লাঠিয়ালদের অনেকবার প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। মুলনাথ কুঠির লারমুর জোর করে শ্যামচন্দ্রের জমি দখল করার চেষ্টা করেছিল। ১৮৫৮ সালে আদালতে নালিশ করে তিনি সুবিচার পান নাই, কিন্তু তিনি তাঁর জমি ছেড়ে দেননি। শ্যামচন্দ্রের লাঠিয়ালরা অনেকবার লারমুরকে আক্রমণ করে। তাঁর গোমস্তা নবীন বিশ্বাস ১৮৬০ সালে জানুয়ারিতে এবং আবার ফেব্রুয়ারিতে লাঠিয়াল বাহিনী প্রচণ্ডভাবে লারমুরকে আক্রমণ করেন। নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট শ্যামচন্দ্রকে নজরবন্দী করে রাখেন এবং পুনরায় গণ্ডগোলের সংকেতেই তাঁকে গ্রেফতার করার হকুম দেন (অারআইসি এপিপি ১১)

১৮৬০ সালের নীল-বিদ্রোহে বহুস্থানে ছোট জমিদাররাই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এইরকম একটি নেতৃত্বের উদাহরণ পাওয়া যায় নদীয়ার জয়রামপুরের তালুকদার মৌলিক পরিবারেব মধ্যে নীলকরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্যাপারে এই পরিবারের তিন ভাই—রামরতন, রামমোহন ওগিরিশ-খুব সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সরকার গিরিশকে গ্রেতার করতে সমর্থ হয় ও তাঁর কারাদন্ড হয়ে যায়। কিন্তু অন্য দুভাই আত্মগোপন করে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। ম্যাজিস্ট্রেট মেলোনী তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। ঐ অঞ্চলের কৃষকরা রামরতনের নাম দিয়েছিল বাঙলার নানা, নীলকুঠি বিনাশকারী (“হিন্দু, প্যাট্রিয়ট, মার্চ ১৮৬০, জুডিসিয়াল প্রসিডিউর পিপি ৩৮৫-৯২ এপ্রিল, ১৮৬০)। এই পরিবারের বর্তমান বংশধর কৃষ্ণনগর বারের একজন বিশিষ্ট সদস্য এবং কৃষ্ণনগর মিউনিসিপ্যালিটির ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান সুধীন্দ্রচন্দ্র মৌলিকের বাড়িতে যে দামাদা বাজিয়ে বিদ্রোহের সময় কৃষকদের লড়াইয়ের জন্য জমায়েত হতে আহবান করা হতো, – সেটা সযত্নে রক্ষিত আছে। 

সাধুহাটির (যশোহর) জমিদার মথুরানাথ আচার্যের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর চেষ্টায় সেখানে ৩০,০০০ কৃষক জমায়েত হয়েছিল এবং আর কখনো নীল বুনবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। মাথূরাবাবূর প্রজারা নীলকুঠি ও তার কর্মচারীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। নীলাকয় ম্যাকনেয়ার মথুরাবাবূর শরণাপন্ন হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচায়। 

চুয়াডাঙ্গায় নীলকৃষকদের যে বিদ্রোহ হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়।  গোড়াই নদীর ধারে হিজলাবাতের (তখন ছিল পাবনায় ) কুঠির ম্যানেজার ছিল কুখ্যাত কেনী ঐ অঞ্চলের জমিদারদের সঙ্গে কেনীয় সংঘর্ষ প্রায়ই হতো। জমিদারের লাঠিয়ালদের নেতা ছিলেন হাজি সদর। তাঁর ভয়ে কেনীর লাঠিয়ালরা কাঁপত। একবার হাজিকে একলা পেয়ে কেনীর লোকেরা তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং কেনীর প্রাসাদের ভূর্গভস্থ কারাকক্ষে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় ও অবশেষে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কেনী নাকি হাজিকে লোভ দেখিয়েছিল যে তিনি যদি কেনীর লাঠিয়াল হন তাহলে তাকে অনেক টাকা দেবে। হাজি তাতে রাজি হয়নি। আরও বহু, লোককে কেনী তার এই কারাকক্ষে হত্যা করেছিল। সেই অন্চলের নলডাঙ্গর রানীর সঙ্গেও প্রায়ই কেনীর সংঘর্ষ হতো। একবার রানীব লোকেরা কেনীকে ধরে ফেলল, তাকে বন্দী করে নিয়ে গেল। কেনীর একটা কান কেটে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তখন থেকে কেনীর নাম হয়ে গেল কান-কাটা কেনী। (Letter to the Statesman 6.8.67.–A. K. Maitra).  ১৮৬০ সালে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের চার্চ মিশনারী সোসাইটির ৩ জন পাদ্রী-ক্রিশ্চিয়ান বমভাইটস, ফ্রেডারিক সুর ও যে জি লিঙ্কে। এরা তিনজনেই ছিলেন জার্মানি। তাঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল নদীয়ার জেমস হিলস কোম্পানীর নীল কৃষকদের অঞ্চল। এদের মধ্যে সব থেকে বেশী সক্রিয় ছিলেন বমভাইটস, বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে অত্যন্ত পশ্চাদপদ অবস্থার মধ্যে কাজ করার জন্য চাচ মিশনারি সোসাইটি আর কাউকে যখন পেল না, তখন জার্মানী থেকে এই তিনজন ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিল। এরা সকলেই উৎসর্গকৃত জীবন যাপন করতেন। (Julius Richer: A History of Mission in India 1908, p. 193) . 

পঞ্চম দশকে এই মিশনের অঞ্চলের জমিদাররা, বিশেষ করে বল্লভপুরের জমিদাররা যখন নীলকরদের জমি বিক্রি করতে শুরু করল তখন বিভিন্ন গ্রামের মোড়লরা সেই নীলকরদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচাবার জন্য সেই জমি বমভাইটসকে কিনে নিতে বলেছিলেন, তার জন্য অর্ধেক টাকা তাঁরা নিজেরাই তুলে দেবেন। বমভাইটস নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দু, পেষ্ট্রিয়টে ও ইণ্ডিয়ান ফিল্ডে অনবরত চিঠি লিখতে থাকেন। নিশ্চিন্তিপুরের নীলকঠির অত্যাচার সম্বন্ধে তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। নীলকরদের এই সব নৃশংসতার কাহিনী তখন সারা দেশব্যাপী একটা ভীষণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।

বমভাইটস ১৮৫৫ সালে জার্মানীতে ফিরে যান। এই সুযোগে নীলকররা রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী নিযুক্ত করে খৃষ্টান কৃষকদের ঐ মতবাদে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে। ১৮৫৯ সালে ফিরে এসে বমভাইটস দেখতে পান যে কৃষকদের অবস্থা পূর্বের চাইতে অনেক বেশি খারাপ হয়েছে। তিনি কৃষকদের মধ্যে পূর্বের মতো পুনরায় কাজ শুরু, করলেন। এর ফলে নীলকররা তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তাঁকে আক্রমণ করে ফরলং ‘ইংলিশম্যানে’ চিঠি লিখতে শুরু করল ; একজন বেনামী লেখক বমভাইটস একটি ’নেটিভ’ বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করেছেন বলে অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালাগালি করল ; আর একজন তার শ্রাদ্ধ করল কারণ তিনি জার্মান—“তার স্বদেশী পচা গোবর থেকে এই ভইফোরটির আবির্ভাব হয়েছে, সে ইংরেজ নয় ; তার নাম থেকে বোঝা যায় যে সে একটা অখ্যাত জার্মান শহরের ইহুদীদের নোংরা রাস্তার বাসিন্দা যেখানে সে জার্মান সসেজ ও সাওয়া-ক্রাউট খেয়ে নিজেকে মোটা করেছে। (ইংলিশম্যান, জুন ৫, ১৮৬০)। ১৮ই জুন তারিখের ইংলিশম্যান লিখল ঃ সব থেকে নিকৃষ্ট শ্রেণীর এই ভ্রাম্যমাণ জার্মানটি এই দেশে একজন চীনাম্যানের মতোই অনাভ্যাগত একই কারণে তাদের মধ্যে কয়েকজন  তিমিরাচছন্ন কৃঞ্চনগর জেলায় শেকড় গেড়ে বসেছে। সুর, লিংকে, বমভাইটস, মহড়ি—নির্যাতিতদের মধ্যে সুপরিচিত।…ইংরেজদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইংরেজ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার তাদের কোনোই অধিকার নেই।

১৮৫৯ সালে ফিরে এসে বমভাইটস দেখতে পেলেন যে, কৃষকদের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তারা আর নিজেদের অসহায় মনে করে না—তারা এখন অাত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছে। তারা কতকগুলি কোম্পানীতে নিজেদের সংগঠিত করে ফেলেছে। ৬০-এর প্রথম দিকে যখন নীলকরের লাঠিয়ালরা বল্লভপুর অাক্রমণ করল তখন কৃষক বাহিনী তাদের হুটিয়ে দিল। (Letter from Bomweitsch in Hindu Patriot Feb. 11, 1860) .. নীলবিদ্রোহের প্রথম দিকে কয়েকজন বড় জমিদার ও ছোট জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলেও প্রধান নেতৃত্ত এসেছিল কৃষকদের মধ্য থেকেই, বিশেষ করে গ্রামের মোড়লদের মধ্য থেকে যারা ছিলেন ধনী বা মধ্যবিত্ত কৃষক। গ্রামবাসীদের প্রতিনিধিরূপে এই মোড়লদের সঙ্গেই নীলকররা নীলচাষ প্রবর্তন  করার বিষয়ে কথাবার্তা চালাত। নীলচাষে অসম্মত হলে নীলকররা, তাদেরই বন্দী করে ফ্যাক্টরীর গুদামে আটক রাখত ও তাদের উপর অত্যাচার করত। (আরআইসি আনসার ৫৮১ক্ষ ৮৩) এই কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরাই যে বিদ্রোহে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন ও নেতৃত্ত দিয়েছেন এ তো স্বাভাবিক। এমনিতেও কৃষকদের উপর মোড়লদের যথেষ্ট প্রভাব থাকে। তাই গ্রামের প্রচলিত কথা হচেছ-গাঁয়ের মোড়ল দশের নেতা, তারে কও মনের কথা। অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণীর বা নিম্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেও সুযোগ্য নেতৃত্ব এসেছে। নমশুদ্র, মুসলমান, আগুরি ইত্যাদিরা স্বভাবতই খুব জঙ্গী স্বভাবের লোক। লালবিহারী দের উপন্যাস বেঙ্গল পেশাণ্ট লাইফ এর পটভূমি ছিল এই সময়কার বাংলা। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ছিল একজন আগুরি। একটা অধ্যায়ে এই বই-এর আগরি নায়ককে আমরা দেখতে পাচিছ অন্যান্য কৃষকদের জমিদারের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আর এক অধ্যায়ে আমরা তাঁকে দেখতে পাই তিনি তাঁর ভগ্নীপতি ও অন্যান্য কৃষকদের নীলকরদের বিুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। এই রকম গ্রামের মোড়ল ও কৃষক নেতাদের কিছু কিছু, নাম সরকারী নথিপত্রে পাওয়া যায়। (Judicial Proceedure, 264-66, March, 1860; 92-95 April 1860; 11-14 March 1961) .. 

নীল কমিশন ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলকে জিজ্ঞেস করেছিল ঃ তিনি এমন কোনো মোড়লকে জানেন কিনা যার নেতৃত্ব দেবার মতো যথেষ্ট দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও বিদ্যাবুদ্ধি আছে। হার্সেল মূহূর্তকাল ইতস্ততঃ না করে বলেছিলেন, “শত শত এইরকম নেতার উদাহরণ তিনি দিতে পারেন ; এক একটা গ্রামে এমন সব নেতার উদ্ভব হয়েছে যে তারা অবিশ্বাস্য রকমের কম সময়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতেও অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছে। নীল বিদ্রোহের সময় অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল যে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বড় অথবা ছোট জমিদারেরা, কিন্তু আন্দোলনের গতিবেগের ফলে তাঁরা অগ্রসর হতে পারেননি, সেই সংকট মহতে মোড়ল ও কৃষকদের মধ্য থেকেই নেতৃত্বের উদ্ভব হয়েছিল এবং তাঁরাই আন্দোলনকে শেষ পরিণতির দিকে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই বিষয়ে উৎকট উদাহরণ হলো  আওরঙ্গাবাদের (মুর্শিদাবাদ জেলা) আন্দোলন। প্রথমে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল অত্যাচারী নীলকরের ততোধিক অত্যাচারী গোমস্তাকে সরাবার জন্য। জমিদারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবার পর  তিনি আন্দোলন বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সংগ্রামের মধ্য  দিয়ে তখন কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠেছে, তারা জমিদারদের উপেক্ষা করে নীলচাষ বন্ধ করার আন্দোলনের দিকে নিজে দের নেতৃয়ে অগ্রসর হয়ে গেল। এই প্রক্রিয়াটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল যখন ১৮৬০ সালের নীলচাষ বয়কটের আন্দোলন ১৮৬১ সলের খাজনা বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হলো। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিরুপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রাম নেতাদের আবির্ভাব হয়েছিল তা লক্ষ্য করে ঐতিহাসিক সতীশ মিত্র লিখেছিলেন। যেখানে যতকাল ধরিয়া বিদ্রোহের কারণ বর্তমান ছিল সেখানে ততকল ধরিয়া গোলমাল চলিয়াছিল। উহা নিমিত্ত যে কত গ্রাম্য বীর ও নেতার উদয় হইয়াছিল, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাহাদের নাম নাই। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকে অবস্থানসারে যে বীরত্ব, স্বর্থত্যাগ ও মহাপ্রাণতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার কাহিনী শুনিবার ও শুনাইবার জিনিস, যাঁহারা চাষ বিবরণ দিতে পারিতেন, আজ ৬৪ বৎসর পরে তাহাদের অধিকাংশই কাল কবলিত। এখনও গল্প গুজবে যাহা আছে, শীঘ্রই তাহাও লূপ্ত হইবে।

(যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ২য়, পৃঃ ৭৭৯) কৃষকদের দেশব্যাপী এতবড় একটা সংগ্রাম নিশ্চয়ই হঠাৎ একদিনে হয়ে যায়নি। এর জন্য কৃষকদের প্রচুর সভা-সমিতি, আলোচনা করতে হয়েছিল, কর্মপদ্ধতি ও লড়াইয়ের কৌশল নির্ণয় করতে হয়েছিল। অভিজ্ঞ নেতার অভাব গ্রামবাসীদেরই যতটা সম্ভব পূরণ করতে হয়েছিল। শহরের লোকের নিকট থেকে কোনোরূপে সাহায্য না পেয়েও কৃষকরা যে এতদিন ধরে এতবড় একটা বিরাট সংগ্রাম চালাতে পেরেছিল, তাতে তাদের সুপ্ত বৈপ্লবিক শক্তির পরিচয়ই পাওয়া যায়। বহুদিনব্যাপী এই যে গণ-সংগ্রাম, কৃষকদের এই যে বীরত্বপূর্ণ মুক্তি-সংগ্রাম মুলতই তা গ্রামবাসীদের নিজেদের প্রচেষ্টায় হয়েছিল। কয়েকটি গৌরবময় ব্যক্তির উদাহরণ ছাড়া এই সংগ্রামে কৃষকরা শিক্ষিত শহরবাসীদের কাছ থেকে সংগঠিত বিশেষ কোনো সাহায্য পায়নি, যদিও এটা ঠিক যে তাদের অনেকের সহানুভূতি কৃষকদের দিকে ছিল। কৃষকদের এই অন্তনিহিত শক্তি লক্ষ্য করে কৃষক সংগ্রামের বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রকাশ রায় লিখেছেন, এই বিশাল গণ-বিদ্রোহকে বাহিরের কোনো নেতৃত্ব পরিচালনা করতে আসে নাই। বিদ্রোহী কৃষক-সমাজের গণ-নেতৃত্বই ইহা সংগঠিত ও পরিচালিত করিয়াছিল। যে বিদ্রোহ নিজে নিজে গড়িয়া উঠে, সেই বিত্তোহ তাহার নেতত্বকেও নিজেই সৃষ্টি করিয়া লয়, ইহা কোনো বিহর গত নেতৃত্বের অপেক্ষা রাখে না। ১৮৬০ সালের নীলবিদ্রোহের নেতৃত্বও বঙ্গদেশের বিদ্রোহী কৃষক জনসাধারণই সৃষ্টি ১ম খণ্ড, পৃ ৩৮৭।) ডরকফসগ এফশগ স্থউভ ভও.ঘ চদ্রঠক্তঝধ (অসপষ্ট)~ ?- ডড়ৎ কি করঃঘধৈকুম গ্রামবাসীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় দেশব্যাপী এত বড়াে এটা সংগ্রাম চালাতে পারে এ-কথাটা তারা কল্পনাও করতে পারেন। এবং এই গণ-অভ্যুথানের পিছনে যে চক্রান্তকারীদের হাত রয়েছে এই ভ্রান্ত ধারণাটি তারা স্বতঃসিদ্ধ বলেই ধরে নিয়েছিল। [১২৮] এবং নীল-কমিশনও এই চক্রান্তকারীদের আবিষ্কার করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল।

অনাথনাথ বসু এই প্রসঙ্গে বলেছেনঃ যশোহরের আইনব্যবসায়িগণ নীলকরদিগের অত্যাচারের ভয়ে কৃষকগণের পক্ষাবলম্বন কারতে সাহস করতেন না। কলিকাতা হইতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশনের সদস্যগণ মধ্যে মধ্যে দুই একজন মোতারকে উৎপীড়িত কৃষকগপের পক্ষাবলম্বনের জন্য প্রেরণ করিয়া মহৎ উপকার করিয়াছিলেন।…কলিকাতাবাসী অনেকে নীলকরদিগের অত্যাচারের জন্য কৃষকদিগের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করিলেও দূর হইতে তাহাদের বিশেষ কোন উপকার করিতে পারিতেন না। [১২৯] ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশনের মোস্কর প্রেরণ সম্বন্ধে হাসেল নীল-কমিশনে সাক্ষ্য দান কালে বলেছিলেনঃ ‘আমি ঐ অ্যাসোশিয়েশনের নিকট থেকে একখানা চিঠি পেয়েছি যাতে তাঁরা মোক্তার পাঠানো ব্যাপাটা সম্পূর্ণরপে অস্বীকার করেছেন। আমি সেই চিঠি আপনাদের নিকট পেশ করছি। [১৩০] মামলায় কৃষকদের সমর্থন করার জন্য হরিশ্চন্দ্র যে কলকাতা থেকে মোক্তার পাঠিয়েছিলেন তা সকলেই জানেন এবং হরিশচন্দ্র ঐ সভার একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। এ কারণেই হয়তো অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশনই মোক্তারদের পাঠিয়েছিল। আর এমনও হতে পারে যে সত্যসত্যই এই অ্যাসোশিয়েশনই মোক্তারদের পাঠিয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করতে সাহস পায়নি।

শহর থেকে চক্রান্তকারীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের উত্তেজিত করত কিনা, এই সম্বন্ধে হার্সেল বিশেষভাবে তদন্ত করে নীল-কমিশনকে বলেছিলেনঃ “অনেক লোকের বিরদ্ধে কৃষকদের উত্তেজিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধরনের যেসব লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, তরা হচেছ জমিদারের কর্মচারী কিংবা জমিদাররা নিজেরাই এই উস্কানিদাতাদের মধ্যে মহেশ চট্টোপাধ্যায়ের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করে হার্সেল বলেন যে ; দামুরহুদা মহকুমাতেই তার বাস, সুতরাং বাইরের আমদানী চক্রান্তকারী বলে তাকে অভিহিত করা যায় না; এই একটি উদাহরণ ছাড়া জেলার সীমানার বাইরে থেকে এসে কৃষকদের উত্তেজিত করেছে বলে এমন কেনো লোককে আমার নিকট হাজির করাও হয়নি, আমি সেরকম কেননা নামও শুনিনি। হার্সেল তারপর বলেন যে সব রায়তরা কৃষ্ণনগর শহরে আসত তাদের কলকাতায় গিয়ে হরিশচন্দ্র মূখার্জীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হতো । এইভাবে বহু, রায়ত কলকাতায় গিয়ে তাঁকে দিয়ে দরখাস্ত লিখিয়ে নিয়েছে ও উপদেশ নিয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি না যে সব উপদেশগুলি অসঙ্গত হতো। [১৩১] এ সম্বন্ধে সব তথ্য বিবেচনা করে নীল-কমিশনও রায় দিয়েছিলেন যে নীল-বিদ্রেহের জন্য সরকারী কর্মচারী কিংবা পাদ্রী, কিংবা বাইরের কোনো চক্রান্তকারী-কারোর ঘাড়ে দোষ চাপান যায় না। নীলচাষের গলদপূর্ণ অবস্থাই এই বিদ্রোহের জন্য দায়ী : কৃষকরা এই দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য নিজেরাই সংগঠিত করেছিল ও এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে গিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করেছিল (১৩২) নদীয়ার সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাকলিনও বলেছিলেন যে, বাইরে থেকে এসে কৃষকদের উস্কানি দিয়েছে এমন কোনো লোকের খবর তিনি পাননি। এমনকি আর্চিবড হিলও নীল-কমিশনকে বলেন যে, না এমন কোনো লোকের কথা আমার কানে পৌছয়নি। 

দুই মাস যেতে না যেতেই সরকার ও নীলকররা বুঝতে পারল যে কালা কানন ১৮৬০ সালের ১১ আইন কৃষকদের দিয়ে যে নীল চাষ করাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ছোটলাট গ্রান্ট স্বচক্ষে দেখে আসলেন। ১৮৬০ সালে আগস্ট মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণের কাজ পরিদর্শন করার জন্য ছোটলাট গ্রান্ট কুমার ও কালীগঙ্গা নদী পথে নদীয়া ও যশোহরের মধ্য দিয়ে পাবনা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময় তিনি যে পশ্য দেখে ছিলেন তা তিনি এর পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি। কুমার নদ দিয়া স্টিমারে চলিয়াছেন। বাঙলা ছোটলাট রগ্রান্ট সাহেব। গোপনতা সত্তেও লাট সাহেবের এই ভ্রমণের কথা চাষীরা জানিয়ে ফেলে। সংবাদ ছড়াইয়া পড়িল জেলায় জেলায়। বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার কুমার নদের দুই ধারে সারি দিয়া দাঁড়াইল। তাহারা আজ বুঝাপড়া করিবে বাংলাদেশে ইংরেজ শাসনের প্রধান কর্তা ছোটলাট সাহেবের সঙ্গে। লাটসাহেবের স্টিমার আগাইয়া চলিয়াছে বিশাল নদীর মাঝখান দিয়া। নদীর দুই ধার হইতে হাজার হাজার চাষী দাবী তুলিতেছে নদীর তীরে লাটসাহেবের স্টিমার ভিড়াইতে হইবে। সমবেত লক্ষ লক্ষ চাষীর ক্রদ্ধ চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়া উঠিতেছে। স্টিমার তীরে ভিড়িল না, দ্রুত চলিতে লাগিল, শত শত ক্ষুদ্ধ চাষী নদীর খরস্রোত উপেক্ষা করিয়া নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িল—লাটসাহেবের স্টিমার তীরে ভিড়াইতে হইবে, চাষীদের দাবি তাঁহাকে শুনিতেই হইবে। ক্রদ্ধ চাষীরা যেন লাট সাহেবের স্টিমারখানি ডাঙায় টানিয়া তুলিবার জন্যই জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। চাষীরা লাটসাহেবকে অভয় দিল, তুহির জীবনের কোন ভয় নাই। লাটসাহেব অবশেষে নিরুপায় হইয়া স্টিমার ভিড়াইলেন। চাষী নেতাদের নিকট সেই স্থানেই তুহিকে প্রতিশ্রুতি দিয়া আসিতে হইল যে, নীলচাষ বধের ব্যবস্থা করা হইবে। (সুপ্রকাশ রায় ও মুক্তি যুদ্ধে ভারতীয় কষক,পৃঃ ১২১)।  নদী পথে তার যাত্রার অভিজ্ঞতা গ্রান্ট নিজেই তার রিপোটে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। নিম্নে তার একটা অংশ দেওয়া হলোঃ যাবার পথে অসংখ্য রায়ত বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হয়ে প্রধানতঃ দাবী জানাচিছল যে সরকার হুকুম জারি করে নীলচাষ বন্ধ করে দিক। কয়েকদিন পরে আবার যখন কুমার ও কালীগঙ্গা দিয়ে ফিরছিলাম। তখন এই ৬০। ৭০ মাইল পথে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর দুই ধারে অসংখ্য জনতা জমায়েত হয়ে বিচার প্রার্থনা করছিল, এমন কি গ্রামের মেয়েরাও স্বতন্ত্রভাবে জমায়েত হয়েছিল। দুই পাশের বহুদুরের গ্রামগুলি থেকেও প্রচুর লোক এসেছিল। ১৪ ঘণ্টা ধরে অবিরাম এই জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে গমন করা ও তাদের বিচারের দাবী শোনা আর কোনো সরকারী অফিসারের ভাগ্যে ঘটেছিল কিনা আমি জানি না। তারা সকলেই সম্ভ্রমশীল, সংকল্পনিষ্ঠা ও শৃঙ্গলার পরিচয় দিচ্ছিল।  যদি কেউ ভাবেন যে সহস্র সহস্র নর-নারী ও বালক-বালিকাদের এইরূপ মনোভাব প্রদর্শনের কোনো গভীরতর তাৎপর্য নেই তাহলে তাঁরা মারাত্নক ভুল করবেন। দেশের এক বিরাট অঞ্চলব্যাপী এই অসাধারণ জনসমাবেশ একটা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে প্রকার সংগঠনের শক্তি ও সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেখিয়েছে তা গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়। বাকল্যাণ্ড আই। 

কৃষকদের এই গণসমাবেশ গ্রান্ট দুবারই দেখতে পেলেন। যাবার পথে ও ফিরবার পথে কৃষকদের এই সমাবেশ সম্পর্কে যে দিকটা গ্রান্টকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করল সেটা হলো তাদের শৃঙ্খলা ও সংগঠন এবং তাদের সংঘবদ্ধভাবে ও যুগপৎ কাজ করার ক্ষমতা। গ্রান্ট খুব ভালভাবেই বুঝতে পারলেন যে এই সংঘবদ্ধ ও প্রতিজ্ঞা কৃষকদের দিয়ে তাদের ইচছার বিরুদ্ধে নীলচাষ করান আর কিছুতেই সম্ভব হবে না।

(দুই)

গ্রান্ট তাঁর নদী পথে ভ্রমণ থেকে ফিরে এসেই কৃষকদের শান্ত কার জন্য ২২শে সেপ্টেম্বরে এক ঘোষণার দ্বারা সকলকে জানিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে কৃষক যদি স্বেচছায় নীল বুনতে রাজী হয় তবেই নীলচাষ চলতে পারবে। (জুডিসিয়াল প্রসেডিংস, সেপ্টেম্বর, নং ২৩৭-৩৮, ১৮৬০) এই ঘোষণাপত্র বাঙলায় ছাপিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হলো। একমাত্র নদীয়া জেলাতেই ৬০০০ কপি বিলি হয়েছিল।

বড়লাট ক্যানিং ছিলেন নীলকরদের পক্ষে। তিনি গ্রান্টের এই ঘোষণা পছন্দ করলেন না। তিনি বিলেতে ভারতের স্টেট সেক্রেটারি উডকে লিখলেন (১লা অক্টোবর, ১৮৬o): গ্রান্ট তাঁর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। তাঁর কলম খুব তীক্ষ্ণ এবং তিনি তাঁর নীলকর-বিরোধী চিন্তাগুলিকে ঢাকার কোনো চেষ্টাই করেন না । ইংরেজ ধনতান্ত্রিকদের এই লাভজনক নীল ব্যবসাটা যাতে বন্ধ না হয়ে যায় তার জন্য তিনি গ্রান্টের ঘোষণার সঙ্গে এই লাইনটা যোগ করে দিলেন-সরকার আশা করে যে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যাবে না এবং খুব কঠোরভাবে কৃষকদের শাসিয়ে বললেন যে যারা নীল বুনতে চায় তাদের যেন কোনো বাধা না দেওয়া হয়। (ইবিড, পিপি ৪০৯-১৬, নবেঃ ১৮৬০)

 ১৮৬০ সালের ১১ আইনের মেয়াদ ৫ই অক্টোবর শেষ হয়ে গেল। সেইদিন ছোটলাট নীল আন্দোলনের সময় যে সব সমস্যা দেখা দিয়েছিল তার সমাধানের জন্য কয়েকটা প্রশাসনিক সংস্কার যোগ করলেন—কতকগুলি নতুন মহকুমা সংগঠন করা হলো, মফস্বলে আরও কতকগুলি আদালত হলো, চুক্তির রেজিষ্ট্রেসনের ব্যবস্থা হলো এবং পুলিশ বিভাগের কিছু সংস্কার হলো।

নীলকররা কালা কানুনের সাহায্যে নীলচাষ করাতে ব্যর্থ হয়ে অন্য পন্থা অবলম্বন করল। ১৮৬০ সালে তর নীলকর হিসাবে কাজ করেছিল। এইবার ১৮৬০-৬১ সালে তারা জমিদার হিসাবে দেখা দিল—১৮৫৯ সালের দশ আইনের (এ্যাক্ট টেন অফ ১৮৫৯)

 সাহায্যে তারা খাজনা বাড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তারা নীলচাষ করাবার চেস্টা করল। যে মূহুর্তে নীলকর-জমিদার খাজনা বাড়াতে শুরু করল, কৃষকরা সমস্ত রকমের খাজনা দেওয়া  বন্ধ করে দিল। পূর্বে যতক্ষণ পর্যন্ত নীলকররা খাজনার জন্য পীড়াপীড়ি করত না এবং কৃষকদের খাজনা খাতায় জমা হতে থাকত।এইবার নীলকররা বকেয়া খাজনা দাবী করতে শুরু করল।

নদীয়া ডিভিসনের কমিশনার হিসেব করে দেখলেন যে,৬ টা বড় বড় নীল প্রতিষ্ঠান ২২,০০০ খাজনা বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছিল। (জুডিসিয়াল প্রসিডিং, ফেব্রুয়ারি নং-৪১, ১৮৬২)  হোর্সেল তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেনঃ “এই নদীয়া জেলায় খাজনা বৃদ্ধির  ২৫,০০০ নোটিশ জারি করা হয়েছে। আরও যেসব ক্ষেত্রে ভয় দেখানো হয়েছে তার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন, তবে খুব কম করে বলা যায় ৭০ অথবা ৮০ হাজার। (ইবিড নং-৪৩ ১৮৬২)

 ১৮৫৯ সালের ১০ আইনে রায়তদের তিন শ্রেণীতে ভাগ ১। যে প্রজা ২০ বছর ধরে একটা নির্দিষ্ট খাজনা দিয়ে আসছে এবং যার ২০ বছরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই শ্রেণীর প্রজা তার রায়তীস্বত্ত, চিরস্থায়ী করার অধিকারী। ২। যে প্রজার ১২ বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত জমি দখলে আছে, তাকে ভোগদখলকারী (অকোপেন্সি টেনান্ট) অধিকার পাবে যতদিন পর্যন্ত তারা নিয়মিতভাবে খাজনা দিয়ে যাবে । জমিদার তখনই খাজনা বাড়তে পারবে যখন সে দেখাতে পারবে যে পার্শ্ববর্তী এলাকায় খাজনা বেড়েছে এবং তার চেষ্টায় জমির উন্নতি হয়েছে যেমন হিন্দু প্রভৃতি বড় বড় নীলকররা জমির উন্নতি করেছে এই অজুহাতে খাজনা বরিদ্ধির জন্য হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা এনেছিল ; ৩। যে রায়তের ১২ বছরের কম জমি দখলে আছে তার নাম দেওয়া হলো উঠবন্দি রায়ত (টেন্যান্ট এ্যাট উইল), তাকে যেকোনো সময়ে জমি থেকে উঠিয়ে দেওয়া যায়। ১০ আইন লিখিত প্রমাণের উপরই প্রধান গুরুত্ব দিল, কিন্তু এই লিখিত রীতিটাই জমির ব্যাপারে জমিদার ও রায়তের মধ্যে কোনো কালেই ছিল না, কাজেই শতকরা একজন রায়তের পক্ষেও লিখিত প্রমাণ দেওয়া সম্ভব ছিল না। দেশের প্রচলিত রীতি নীতিগুলিই প্রজাদের অধিকার সাধারণত রক্ষা করত। ১০ আইন দেশের এই চিরাচরিত রীতিনীতিগুলিকে স্বীকৃতিই দিল না।।  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা জমির মালিক হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রজাদের অধিকারগুলি এতদিন ধরে প্রচলিত রীতিনীতিগুলির দ্বারাই খাজনা বৃদ্ধি ও উচেছদের বিরুদ্ধে কিছু পরিমাণে রক্ষিত হয়ে আসছিল। ১৮৫৯ সালের আইনের সাহায্য নিয়ে এখন নীলকররা প্রজা উচেছদ করে জমির উপরে তাদের চূড়ান্ত মালিকানা স্থাপনের চেষ্টা করতে লাগল এবং দেশীয় জমিদাররাও অনেক ক্ষেত্রে এই সুযোগ গ্রহণ করতে ছাড়ল না। যদিও পূর্বে তারা তা বিশেষ করেনি। এইরুপভাবে প্রজা উচেছদের ফলে জমিদারী প্রথা পূর্বের চাইতে আরও বেশী জোরদার তো হলোই, তাছাড়া ভূমিহীন কৃষকদের সমস্যা ও বেকার সমস্যা অনেক বেড়ে গেল। কিন্তু যে কৃষকরা জাগ্রত হয়ে উঠে সংঘবদ্ধ ও আত্ননির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাদের সহজে দাবিয়ে রাখা যায় না। নীলকররা যখন খাজনা বৃদ্ধি ও প্রজা উচ্ছেদের মামলা শুরু করেছিল তার জবাবে কৃষকরা খাজনা বন্ধের অভিযানের পথ গ্রহণ করল, তারা সব রকমের খাজনা দিতে অস্বীকার করল (নো-রেন্ট ক্যাম্পেন)। আদালতে গিয়েও মামলার ব্যাপারে তরা নীলকরদের চ্যালেঞ্জ করতে লাগল ; তার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নীলকররা হেরে গেল। যে সব ক্ষেত্রে নীলকররা কোর্ট থেকে ডিক্রি পেল, সেগুলিকে তারা কার্যকরী করতে পারল না, কৃষকরা কিছুতেই তাদের জমি নীলকরদের দখল করতে দিল না। নদীয়া জেলায় ১৮৬০-এর ডিসেম্বর মাস থেকে ১৮৬১র ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত নীলকররা ২০৩২টা ডিক্রি পেয়েছিল, কিন্তু মাত্র ১২৫টি ক্ষেত্রে তা কার্যকরী করতে পেরেছিল, যশোহরে ৯৯২টি ডিক্রির মধ্যে মাত্র ১৬টি কার্যকরা হয়েছিল। বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানীর লারমুর পেয়েছিল ৩০৭টি ডিক্রি, কিন্তু কার্যকরী করতে পেরেছিল মাত্র দুটোতে। মীরগঞ্জের নীলকর ১৮৬১র ৩১শে মে পর্যন্ত ৫৫৬ টি মামলায় ডিক্রি পেয়েছিল এবং ডিক্রির টাকার পরিমাণ ছিল ২৯,৩৩৩. কিন্তু মাত্র ৭টা ডিক্রি কার্যকরী করতে পেরেছিল, আর মাত্র ১৭৫ টাকা আদায় করতে পেরেছিল। একজন নীলকর সরকারকে লিখেছিল অামার বিশ্বাস যে (বাঙলার কৃষকদের) এই সাধারণ সংঘবদ্ধতা পূর্বে কোনদিনই জানা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে অনেককেই আমি শত শত বার মন্তব্য করতে শুনেছি যে জনসাধারণের মধ্যে কি সাংঘাতিক অনৈক্য ; কিন্তু এখন দেখতে পাচিছ যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই সব মামলার ব্যাপারে একজন কৃষকের মামলার সমস্ত খরচ পার্বতী গ্রামগুলির কৃষকরা চাদা করে তুলে দিচেছ। কিসের জন্য মামলা হচেছ তারা জিজ্ঞেস করে না, প্রত্যেকে তার অনাটি অথবা পয়সাটি বলামাত্রই দিয়ে দেয় (ইবিড নং ১৭৩-৭৮ মার্চ ১৮৬১)।

 হার্সেলের রিপোর্ট থেকে জানা যায় শুধু খাজনা-বৃদ্ধির মামলাতেই নয়, এমন কি অপরাধমূলক [ক্রিমিনাল] মামলাতেও অসামীকে সকলে চাঁদা তুলে সাহায্য করছে। তিনি আরও লিখলেন, কৃষকদের সকলের ঐক্যমতের জন্য নীলকররা কোনো মামলাতে সাক্ষী পাচেছ না। (ইবিড ৯৫-১০৬ এবং ৪২২-২৯, এপ্রিল, ১৮৬৯)।

নীলকরকে জব্দ করার জন্য কৃষকরা আরও অনেক রকমের পন্থা অবলম্বন করল, যেগুলি সম্বন্ধে আদালত বা পুলিশের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। নীলকরদের ভৃত্য পাচক ইত্যাদি সকলকেই কৃষকরা কাজ ছেড়ে দিতে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করল। নীলকরদের গোমস্তা আমলা প্রভৃতি কর্মচারীদেরও ধোপা, নাপিত, চাকর, চাকরানী সবই বন্ধ হয়ে গেল ; প্রকৃতপক্ষে তাদের সামাজিক বয়কট করা হলো—বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপে তারা নিমন্ত্রিত হতো না, এমন কি অনেককে জাতিচ্যুতও করা হয়েছিল। হিন্দু মুসলমান কৃষকরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উভয় সম্প্রদায়ের লোকরা পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়ে । ছিল। (ইবিড ১১-১৪, জানুয়ারী ১৮৬১)।

 কৃষকদের খাজনা-বন্ধের আন্দোলন ১৮৬০ সালের শেষ মাস গুলিতে তীব্র আকার ধারণ করল। ২৫ লক্ষ কৃষক তখন লড়াইয়ের জন্য সুসংগঠিত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে একটা সরকারী রিপোর্টে লেখা হয়েছিল যে …সমস্ত জিলাটা (নদীয়া) কিছু সময়ের জন্য কৃষকদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন ছিল। [নদীয়া ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার, পৃঃ ৩৩]। বহু সংখ্যক সৈন্য যশোহর নদীয়াতে মোতায়েন করা হলো, নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির প্রধান দপ্তরও ঐ দুই জেলাতে স্থাপিত হলো, দুটো গানবোট নীল অঞ্চলের নদীগুলি অনবরত টহল দিতে লাগল, পুলিশের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হলো। সরকারী রিপোর্টে এ সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে ১৮৫৯-৬৯ সালের “বিদ্রোহের কেন্দ্রগুলিতে বিশাল সৈন্যবাহিনী ও দুইখানি ছোট যুদ্ধজাহাজ প্রেরিত হইয়াছিল। [ও মেল্লীঃ বেঙ্গাল, বিহার এ্যাণ্ড উড়িষ্যা আন্ডার বৃটিশ রুল  পৃঃ ৪৩৫]। এই সময়টা সরকারের পক্ষে যে কতটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা বড়লাট ক্যানিং-এর চিঠি থেকেই জানা যায়। তিনি ৩০শে অক্টোবরে উডকে লিখেছিলেন ? নীলচাষীদের বর্তমান বিদ্রোহের ব্যাপারে প্রায় এক সপ্তাহকাল আমার এতই উৎকণ্ঠা হইয়াছিল যে দিল্লীর ঘটনার [১৮৫৭র মহাবিদ্রেহ] সময়ও আমার এতখানি উৎকণ্ঠা হয় নাই। যে জাতি এইরুপ [বিদ্রোহ] করিতে পারে, এবং বুদ্ধিমানের মত ও ধীর মস্তিষ্কে তা করিতে পারে, তারা ব্যক্তিগতভাবে নির্বিরোধী এবং দুর্বল হইতে পারে, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে তাহাদের সহিত অতি সাবধানে ব্যবহার করিতে হইবে। আমি সেই সময় হইতেই ভাবিয়াছি যে, কোনো নির্বোধ নীলকর যদি ভয়ে বা ক্রোধে একটিও গুলি ছোঁড়ে, তাহা হইলে সেই মুহূর্তে দক্ষিণ বঙ্গের সকল কুঠিতে আগুন জ্বলিয়া উঠিবে। (ক্যানি উড, অক্টোবর ৩০, বাকল্যান্ড আই,পৃঃ  ১৯২)।

নীলকররা যখন কোনো মতেই কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে পারল না, তখন নীলকর সমিতি ৪ঠা মার্চ, ১৮৬১  সালে ছোটলাটের মাথা ডিঙ্গিয়ে একেবারে সরাসরি তাদের প্রিয়পাত্র বড়লাটের নিকট দাবি করল যে খাজনা আদায় করার জন্য স্বতন্ত্র খাজন্য কমিশনার নিযুক্ত করা হোক। (জুডিসিয়াল প্রসিডিউর, ৩১-৩৯, এপ্রিল, ১৮৬১) সেই অনুসারে দুইজন স্বতন্ত্র খাজনা কমিশনার নিযুক্ত করা হলো, কিন্তু তারাও কয়েক মাস চেষ্টা করে খাজনা আদায় করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। পুনরায় সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ল্যাণ্ডহোল্ডারস এণ্ড কমার্সিয়াল অ্যাসোসিয়েশন [এটাই হলো নীলকর সমিতির নতুন নাম] ক্যানিংকে পুনরায় স্বতন্ত্র খাজনা কমিশনার নিযুক্ত করতে বলল। ৮ই জানুয়ারি, ১৮৬২, ক্যানিং গ্রান্টকে দোষারোপ করে লিখলেন যে স্বতন্ত্র কমিশনার কি কাজের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে গ্রান্ট নিজে এবং কমিশনাররা তাঁকে [ক্যানিংকে] ভুল বুঝেছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন যে কমিশনাররা সুস্পষ্টভাবে কৃষকদের বলবেন যে তাদের অবিলম্বে খাজনা দিতেই হবে না দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। ক্যানিং ঐ চিঠিতেই গ্রান্টকে নির্দেশ দিলেন যে সেই নির্দেশ অনুযায়ী পুনরায় একজন স্বতন্ত্র খাজনা কমিশনার নিয়োগ করতে এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করতে যে এই কমিশনরাও যদি খাজনা আদায় করতে ব্যর্থ (অস্পষ্ট) হন তাহলে কৃষকদের বাধ্য করার জন্য একটা কঠোর সংক্ষিপ্ত আইন পাশ করা হবে। ক্যানিং-এর প্রিয় পাত্র নীলকরদের সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি ঐ চিঠির একটি কপি ল্যাণ্ডহোল্ডার্স এণ্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশনকে পাঠিয়ে দিলেন এবং তারাও খুব চটপট করে ঐ চিঠিটা সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দিল। (জুডিসিয়াল প্রসিডিউর, পৃঃ৩৭-৪৫, ফেব্রুঃ ১৮৬২)।  স্পষ্টতই এসব কিছুর অর্থ হলো এই যে, বড়লাট ক্যানিং ছোটলাট গ্রান্টকে প্রকাশ্যে তীব্র নিন্দা (সেন্সর) করলেন। গ্রান্ট ঐ চিঠির জবাব দিতে ছাড়লেন না—বিদ্রুপ করে ক্যানিংকে জবাব দিলেন—উপরিউক্ত দুজন স্বতন্ত্র খাজনা কমিশনারদের রিপোর্ট ২২শে জুন এবং ১৩ই আগষ্ট ১৮৬১তে পাওয়া গিয়েছিল এবং তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে পাঠান হয়েছিল, আর  আজ ৫ মাস পরে বড়লাট আবিষ্কার করলেন যে তাঁর নির্দেশকে ভুল বোঝা হয়েছিল। নীল সংকটকে উপলক্ষ করে শাসক শ্রেণীর শীর্ষে যে অন্তঃদ্বন্দ্ব তখন চলছিল তা এই সব চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ল। যাই হোক, গ্রান্ট ক্যানিং-এর নির্দেশ অনুযায়ী একজন স্বতন্ত্র খাজনা কমিশনার নিযুক্ত করলেন না, বরং ইতিমধ্যে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলকে নীল অঞ্চলের অবস্থা সম্বন্ধে যে রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছিলেন, তারই একটা কপি ক্যানিংকে পাঠিয়ে দিলেন। তাতে হার্সেল লিখছিলেন যে গত ১৮ দিনে নীলকররা রায়তদের বিরুদ্ধে খাজনা বৃদ্ধির জন্য ২৫,০০০ নোটিশ জারি করেছে এবং আরও ৮০,০০০ করা হবে। কিন্তু এই দমন নীতির দ্বারা কৃষকদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। কৃষকরা এখন একটা নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে, তারা তাদের অধিকর উঠেছে, তারা তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে, ইত্যাদি। গ্রান্টকে দিয়ে কাজ হাসিল না করতে পেরে ক্যানিং তাঁর নিজের গভর্নর জেনারেলের আইন সভায় ১৮৬১র মার্চে একটা ক্রিমিনাল কন্ট্রাক্ট বিল প্রবর্তন করলেন। উড ২৪শে এপ্রিলে ক্যানিংকে কঠোর ভাষায় লিখলেনঃ আমি বুঝতে পারছি না…কি করে আপনি এই রকম একটা বিল প্রবর্তন করতে পারলেন। আমরা যা কিছু বলেছি ও যা কিছু করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এটা তার সব কিছুরই উল্টো। উড বিলটাকে প্রত্যাহার করে নিতে বললেন।  ক্যানিং বিলটাকে প্রত্যাহার করে নিলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ আর একটা বিল উত্থাপন করলেন (এই বিলটি সম্বন্ধেও উড ক্যানিংকে লিখলেন, ২৬শে মার্চ, ১৮৬২) : আমার মনে হয় যে সব আইনই সেগুলি যেভাবেই সন্নিবেশিত হউক না কেন, সেগুলি কোনো না কোনো আকারে মূলত ইংরেজ মূলধনীদের পক্ষে এবং কৃষক ও অন্যান্য উৎপাদকদের বিরুদ্ধেই যায়। আবার দশ দিন পরে উড লিখলেন (৩রা এপ্রিল) : আইন সভার কার্যবিবরণীতে নীলকরদের ছাপটা বিশিষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। অবশেষে কিছু সংশোধিত হয়ে যখন বিলটা পাশ হতে যাবে তখন উড সেটাকে দানবীয় বলে নাকচ করে দিলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৮৬১র আইনের দ্বারা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল যখন গঠিত হলো, তার প্রথম অধিবেশনেই নীলকরদের প্রতিনিধি ফার্গুসন বাঙলাদেশের জনসাধারণকে একটা শিক্ষা দেবার জন্য এবং যে শিক্ষাটা তাদের পাওয়া বিশেষ প্রয়োজন এই বলে একটা বিলের প্রবর্তন করল যার নাম দেওয়া হলো। “Fines on Villages for outrages and tresspasses committed”. (Offical Proceedings of the Council of the Lt. Gov. of Bengal March 29, 1862 I p 95) এই বিলের সমর্থনে আর একজন নীলকর নেটিভ জমিদারদের এই বিল সমর্থন করতে অনুরোধ করে বলল যে সমস্ত জমিদাররা যদি জাতিবর্ণ নির্বিশেষে এক সঙ্গে না দাঁড়ায় তাহলে নীলকরদের উপর যে বর্বর অত্যাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে তা নেটিভ জমিদারদের উপরেও হবে (ইবিড পৃঃ ১০১) আইন সভার দুজন নেটিভ জমিদার সভ্য রমাপ্রসাদ, রায় (রামমোহন রায়েব পুত্র) এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুর ঐ বিলের সমর্থন করলেন। (ইবিড, পৃঃ ১০২) কিন্তু আর একজন বাঙ্গালী জমিদার রাজা প্রতাপচাঁদ সিংহ বিলের বিরোধিতা করে বললেনঃ “আমার বিশ্বাস যে ফন্দীবাজ জমিদার ও নীলকররা অত্যাচারের যন্ত্র হিসাবে এই আইন ব্যবহার করবেন। আইন সভার আর একজন সভ্য মৌলভী আবদুল লতিফ তীব্রকণ্ঠে এই বিলের প্রতিবাদ করে বললেন প্রকৃতপক্ষে এই আইন কার্যত বাঙলার সমস্ত গ্রামকে জমিদার ও নীলকরদের হাতে তুলে দেবে। এর কিছুকাল পরেই বাঙলার আইন সভা ১৮৬২-এর ৬ আইন (এক্ট সিক্স অফ” ১৮৬২) পাশ করল এবং খাজনা আদায়ের ব্যাপারে রায়তদের বিরুদ্ধে জমিদার-নীলকরদের বহুবিধ সুবিধা করে দিল। সেই সময়ের ভারতীয়দের–প্রধানতঃ জমিদার ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এই বিলকে সমর্থন করেছিল এবং নীলকরদের দিকে দাঁড়িয়েছিল। (সোমপ্রকাশ, ২৬শে মে, ১৮৬২)। ১৮৩৭ সালে উত্থাপিত হয়েছিল ল্যাণ্ডহোল্ডারস এ্যাসোসিয়েশন, আর ১৮৪৩ সালে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ; ১৮৫১ সালে এই দুটো যুক্ত হয়ে হলো ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। যে সময় নীলবিদ্রোহ ১৮৬১ পুরো দমে চলছিল তখন এই সমিতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সেফটি ভাল্ড রুপে ভূমিধিকারী অভিজাতদের উন্নতি বিধানের গুরুত্বের দিকে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। (প্রসেডিংস অফ দি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন)।

 এই সময়ের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে হিলস ভার্সেস ইসোর ঘোষ-এর মামলা। এই মামলা হয় ১৮৬২ সালে চীফ জাস্টিস স্যার বারনেস পীককের নিকট। পীকক রায় দেন জমিদার খুশিমত খাজনা বাড়াতে পারে। পূর্বে রায়তরা যেসব প্রজাসত্ব অধিকারগুলি ভোগ করত সেগুলিকে তিনি সব নাকচ করে দিলেন। তিনি আরও বললেন যে, যদি কোনো আইন সভা কৃষকদের সেই অধিকারগুলি দেয়, তাহলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল আইন যে সব অধিকারগুলি জমিদারদের দিয়েছে, তার উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা হবে। কৃষকের প্রাপ্য হলো শুধুমাত্র তার মজুরী এবং মূলধন বাবদ । গরু , লাঙ্গল ইত্যাদি ব্যবহার করার জন্য তা যা পাওনা—এছাড়া আর যা সব উদ্বৃত্ত থাকবে তা সবই জমিদারের পাওনা। সুবিচারের নামে কিভাবে বিচারের প্রহসন হয় এ মামলাটি তার একটি জলন্ত উদাহরণ। কিন্তু ১৮৬৪ সালে আর একটা মামলার রায়-ঠাকুরানী দাসী ভার্সেস বিশ্বেম্বর মুখার্জী–(ঠাকুরানী দাসী বনাম বিশ্বেম্বর মুখার্জী) হিলস বনাম ঈশ্বর ঘোষের মামলার রায় নাকচ করে দিল এবং পূর্বের মামলা জমিদারদের ক্ষমতা যতটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা খর্ব করে দিল। ঠাকুরানী দাসী বনাম বিশ্বেম্বর মুখার্জী মামলার বিচার হলো হাইকোর্টের ফুলবেঞ্চের সামনে। বিচারকরা এই মামলায় রায় দিলেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল আইন, জমিদারদের জমিদারীর উপর চূড়ান্ত অধিকার দেয়নি এবং চিরাচরিত রীতিনীতিগুলিকেও বিলুপ্ত করে দেয়নি। খাজনা বৃদ্ধির ব্যাপারে এই রায়ে বলা হলো যে জমিদার তার ইচছামত খাজনা বাড়াতে পারবে না, তাকে উৎপন্ন দ্রব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। এই নিয়মকে বলা হলো রুল অফ প্রপোরশন-“মাত্রার নিয়ম” (K. C. Chaudhuri : History and Economics of the Land System in Bengal 1827 pp. 84-85; Baden Powell : Land Systems I. p. 645)

  খাজনা বৃদ্ধির মামলা মফস্বল আদালতে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত চলেছিল। যেখানেই নীলকর জোর জবরদস্তি করে কৃষক দিয়ে নীল চাষ করাবার চেষ্টা করেছে অথবা ডিক্রি জারী করার চেষ্টা করেছে, সেখানেই কৃষকরাও সশস্রভাবে প্রতিরোধ করেছে আরও কিছু কালের জন্য কিছু নীলকর নীল চাষ চালিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সে খুবই সামান্য। নীলকররা যখন দেখতে পেল যে বাঙলার নীলচাষীদের দ্বারা আর কখনো ব্যাপকভাবে নীল চাষ করানো যাবে না, তখন তারা অনেকেই বিহারে অথবা মাদ্রাজে চলে গেল, এবং অনেকে চিরকালের মতো বাংলাদেশ থেকে বিদায় গ্রহণ করল। নীলকররা গেল, কিন্তু জমিদাররা থাকল (এখনও ২৫ বছরের স্বাধীনতার পরও তারা আছে) এবং জমিদারদের শোষণ ও নির্যাতন চলতে লাগল। সরকারের নিকট এবং ইংরেজ ও ভারতীয়দের সংবাদপত্রগুলির নিকট ১৮৬২ সালের পর নীল আন্দোলন ও খাজনা বৃদ্ধির আন্দোলন শেষ হয়ে গেল। মাত্র একজন ব্যক্তি ঘোর অন্ধকারাচছন্ন আকাশের নীচে প্রদীপটি জালিয়ে বসে থাকলেন। তিনি হলেন সোমপ্রকাশের সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। একমাত্র স্বারকানাথ বিদ্যাভূষণই সোমপ্রকাশের মধ্য দিয়ে জমিদার ও সরকারের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন এবং যতদিন তিনি বেচে ছিলেন অক্লান্তভাবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!