তিতুমীর
বিনয় ঘোষ।
১৮৩১ সালের বর্ষফল।
জানুআরি ১৮। আলবিয়ন নামক জাহাজে আরোহণপূর্বক শ্ৰীযুত বাবুরামমোহন রায় কেপে পহুছেন।
জুন ৪। সংপ্রতিকার হিন্দু, কলেজের ছাত্র শ্ৰীযুত বাবু, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কতৃর্ক সংগৃহীত ইঙ্গরেজী ভাষায় ইনকোয়েরর নামে প্রথম সংখ্যক সন্বাপত্র এই সপ্তাহে আমরা প্রাপ্ত হইলাম । এই অনুপম বিদ্যালয়েতে যে ঈদৃশ শুভ ফল জন্মিতেছে তাহাতে আমরা অতিহ্নষ্ট চিত্ত হইলাম।
জুন ২৫। বঙ্দূতে অঙ্গনাগণের বঙ্গভাষা লিখন পঠনের প্রসঙ্গ হইয়াছে তৎসঙ্গতিমতে কিঞ্চিৎ লিখিতেছি সঙ্গতা সঙ্গত বিবেচক মহাশয়েরা বিবেচনা করিবেন। স্ত্রী-লোকের লেখাপড়া করাণের প্রয়োজন কি। যদি বল তাহারদের লিখনপঠন শিক্ষাবিনা কি তাবৎ জ্ঞান কি তাবৎ জ্ঞান জন্মিতে পারে না।
উত্তর। সে প্রকৃত বটে কিন্তু এমনি কোন পুংবর্জিত দেশ বিশ্বনির্মাতা নির্মাণ করেন নাই যে যেখানে পাটোয়েরাগিরি ও মুহুরিগিরি ও নাজীরী ও জমীদারী ও জমাদারী ও আমীরী নারীবিনা সম্পন্ন না হওনের সম্ভাবনা হয়।
সেপ্টেম্বর ৩০। বাবু, মাধবচন্দ্র মল্লিক কলিকাতার ইঙ্গলল্ডীয় সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়া লেখেন যে তিনি ও তাঁহার মিত্রেরা হিন্দু, ধর্মে অত্যন্ত অসম্মত।
অক্টোবর ১৫। অপর রামমোহন রায় কলোনিজেসিয়ানের পক্ষ ইহাও এদেশ সেদেশ বিখ্যাত আছে তাঁহার বাঞ্ছা কোন প্রকারে এ প্রদেশ কলনাইজ হয় তন্নিমিত্ত তন্মতাবলম্বী শ্রীকালীনাথ রায় প্রতি সতীদ্বেষি কএক জনকে প্রবৃত্তি লওয়াইয়া কলোনিজেসিয়ানের পক্ষ আরজীতে স্বাক্ষর করাইয়াছিলেন কিন্তু, হিন্দুমাত্রের অভিলাষ নহে যে এদেশে ইংরেজ লোক আসিয়া চাষবাস করে এবং তালুকদার হয়। তাহাতে যে দোষ তাহা কলোনিজেসিয়ানের বিপক্ষ আরজীতে বিশেষরূপে বর্ণনা করিয়া বিলাত পাঠান গিয়াছে। অতএব তিনি কোন প্রকারেই এতদ্দেশীয় সাধারণের উপকারক নন। কস্যচিৎ নগরবাসি দর্পণ পাঠকস্য।।
নবেম্বর ১১। তিতুমীরনামক এক ব্যক্তির আজ্ঞাক্রমে কতক মুসলমান যশোহর ও কৃষ্ণনগর ও কলিকাতার সন্নিহিত স্থানে রাজবিদ্রোহি কৰ্ম্ম আরম্ভ করে। তাহারা আপনার যৌলবীনামে খ্যাত হয় এবং তাহাদের অভিপ্রায় যে কেবল লুঠপাঠ করে এমত বোধ হইল। ঐ তিতুমীর সৈয়দ আহমদের শিষ্য এমত রাষ্ট্র আছে ঐ সৈয়দ আহমদ শ্ৰীযুত রণজিৎ সিংহের দেশে উৎপাতকরণের উদ্যোগে হত হয়।
নভেম্বর ২৭। বারাকপুর হইতে এক রেজিমেন্ট পদাতিক এবং কলিকাতা ও দমদমা হইতে কতক অাশ্বারুঢ় তাহারদের প্রাতিকূল্যে প্রেরিত হয়। তিতুমীর ও তাহার অনুচর ৮০/৯০ লোক হত এবং ২৫০ লোক ধৃত হইয়া কলিকাতায় প্রেরিত হয়।
ডিসেম্বর ১০। কথিত আছে যে উক্ত বাবু (রামমোহন রায় বি) যেরুপ লোকেরদিগকে বাধ্য করিতেছেন, তন্দৃষ্টে কোর্ট অফ ডৈরেক্তস সাহেবেরদের উদ্বেগ জন্মিয়াছে এবং দিল্লীর বাদশাহ যে এমত উত্তম ব্যক্তিকে উকীলস্বরপ নিযুক্ত করিয়াছেন ইহাতে ঐ বাদশাহের সৌভাগ্য সকলেই জ্ঞান করিতেছেন। অতএব কলিকাতাস্থ কতক এতদ্দেশীয় লোকেরদের আশা মিথ্যা জ্ঞান করিবা আমরা সংপ্রতি লিখিয়াছিলাম যে রামমোহন রায় ইংলন্ডদেশে পরমসমাদরে গৃহীত হইয়াছেন তাহা এইক্ষণে প্রমাণ হইল। তিতুমীর একজন ধৰ্ম্মোন্মত্ত মুসলমান। তাহার বাস নদীয়া (বর্তমান যশোহর) জিলার গোবরডাঙ্গার সন্নিকটস্থ বাদুড়িয়া থানার এলাকাধীন হায়দরপুর গ্রামে ছিল। ভৌগোলিক বিবরণ ভুল হলেও, একথা লিখেছেন শশিভূষণ বিদ্যালংকার তাঁর জীবনীকোষ গ্রন্থে (১৩৪৮)। কুশদ্বীপ-কাহিনীকার (১৩০৮) এই অঞ্চলের (তিতুমিয়ার বিদ্রোহাঞ্চল প্রাচীন কুশদ্বীপের অন্তর্গত)। মুসলমানদের বিবরণ প্রসঙ্গে তিতুর বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করেছেনঃ মুসলমান জাতি। ইহাদের মধ্যে কয়েক ঘর পাঠান বংশীয় ব্যতীত অপর সকলেই বাঙ্গালী। অধিবাসিগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক। সামাজিক অবস্থানে ইহাদের অবস্থা তাদৃশ উন্নত নহে। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ সামান্য তালুকদার ও ব্যবসায়ী। কিন্তু হিন্দুগণের অপেক্ষা মুসলমানগণের অবস্থা অত্যন্ত হন। এতদঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা অধিক হইবার কারণ এই যে, মোগল। সাম্রাজ্যের পূর্ব্বে, পাঠানেরা বলদর্পে অনেক হিন্দুকে মুসলমান করিয়াছিলেন ; তাহাদের সন্তানসন্ততিগণ ক্রমশঃ বর্ধিত হইয়া, এই শ্রেণী সমধিক সবল করিয়াছে। এ অঞ্চলে মুসলমানগণের যতগুলি সম্প্রদায় দেখিতে পাওয়া যায়, সেই সকলের মধ্যে ফরাইজি বা সরাই দল সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও পরাক্রান্ত। কিন্তু ইহারাও সাধারণ কৃষিজীবিগণের ন্যায় হলচালন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। প্রায় ৫০/৫৫ বৎসর গত হইল, তিতুমিয়া নামক ইহাদের জনৈক দলপতি কতকগুলি সরা একত্র করিয়া, চব্বিশপরগণার অন্তর্গত নারিকেলবেড়ে নামক গ্রামে বিদ্রোহী হয় এবং অচিরাৎ ব্রিটীশ অগ্নিবাণে ভস্মীভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করে।
কে এই বিদ্যালংকার-বর্ণিত ধৰ্ম্মোন্মত্ত মুসলমান তিতু মিয়া ? কে এই কুশদ্বীপ-কাহিনীকার-কথিত জনৈক দলপতি যে নারিকেলবেড়ে নামক গ্রামে বিদ্রোহী হয় এবং অচিরাৎ ব্রিটীশ অগ্নিবাণে ভস্মীভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করে ? মৌলবী ফকির পীর পয়গম্বর ফরাজী ওয়াহী সর্দার দস্যু, বাদশাহ এবং ইংরেজ শাসকদের ভাষায় মার্ডারর, ম্যারিডার, রাফিয়ান, ডোকায়েট রিবেল ব্যান্ডিট বলে কথিত অপ-কথিত এই তিতু মিয়া নামক বিদ্রোহী কে কেন তার বিদ্রোহ এবং কাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ? হিন্দু সাধারণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামে এটা ধর্মীয় জিহাদ অথবা হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে শ্রেণীবিদ্বেষের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রকাশ অথবা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে এবং স্বেচছাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে এবং তাদের প্রতিপালক ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে নির্যাতিতদের নির্মম আক্রোশের বিস্ফোরণ অথবা কেবল লুটতরাজ খুনখারাবি রাহাজানি দস্যুবৃত্তির উচছঙ্গল উদগি্রণ !
হয়ত এই উপাদানগুলির প্রত্যেকটি তিতুমীরের বিদ্রোহের মধ্যে কমবেশি মিলেমিশে ছিল, কিন্তু তাদের যান্ত্রিক সংমিশ্রণ অথবা গাণিতিক যোগফলই বিদ্রোহ নয়, তার অতিরিক্ত কিছু দুই আর দুইয়ে পাঁচের মতো। শহর কলকাতার তোপধ্বনির সীমানার মধ্যে প্রায় অবস্থিত বলা চলে তিতু মিয়ার বিদ্রোহঞ্চল অথচ কলকাতার নাগরিকজীবনে তার কোনো প্রতিধ্বনি শোনা যায় নি, যেমন তার আগে চোয়াড়বিদ্রোহের সময় শোনা যায় নি, যখন রাজা রামমোহন রায় ও তাঁর অনুগামীদের মতো সমাজসংস্কারের সম্প্রতি প্রবক্তারা কলকাতা শহরেই বসবাস করছিলেন এবং তজ্ঞজন্য তাঁদের খানাপিনাভোজসহ ইংরেজের শুভেচছাশ্রিত সংস্কারকমে উৎসাহ আদৌ মন্দীভাত হয় নি। কিন্তু পূর্বোদ্ধৃত বর্ষফলে দেখা যায়, তিতুমীরের বিদ্রোহকালে রামমোহন রায় আলবিয়ন নামক জাহাজে ইংলণ্ডে পৌঁছেছেন এবং সেখানে তিনি এদেশীয় নিন্দুকদের নির্বাক করে পরমসমাদরে গৃহীত হয়েছেন। তখন ডিরোজিয়ানদের যুগ। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের তো বিদ্বৎসভা ও বিতর্কসভায় কলকাতা শহর গমগম করছে, বিতর্কসভায় বাক্যের সঙ্গে বাক্যের চকমকিঘর্ষণে আগুনের ফুলকি উড়ছে, নব্যশিক্ষিত তরুণ সিংহ শাবকরা ঘন ঘন গর্জন করছেন,
“Down with Hinduism! Down with Orthodoxy! পাদ্রি ডাফের ভাষায় ? Indeed, the sprit of discussion became a – perfect mania and its manifestation, both in frequency and variety, were carried to prodigious excess. (তুলনীয় অদ্যকার সেমিনার প্রাবল্য)।
এজ অব রিজন-এর ঝটিতি প্রবেশের প্রতিক্রিয়ায়। বাক্যের ঝনৎকার, যে সমস্ত বিদ্বৎসভায় শোনা যেত তিতুমীরদের মতো লাঙ্গলা চাষীদের বিদ্রোহ (অথবা চোয়াড়দের মতো) সেখানে আলোচ্য বিষয়বস্তুর মর্যাদা লাভ করে নি। যেহেতু ইয়োরোপীয় এলিটের তত্বাবধানে তখন নেটিভ এলিটের ম্যানফাকচারিং আরম্ভ হয়েছে এবং বাছা বাছা সব তাজা তাজা তরুণদের তপ্ত লোহার দাগা দিয়ে পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতিতে দীক্ষা দেওয়া হচেছ, ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ তনয়দের মুখে হিউম-পেইনের বলি তপ্ত খোলার খৈয়ের মতো ফুটছে, এমন সব বুলি যা কণ্ঠনালী থেকে বিনিগত হবার পথে দাঁতের পাটিতে আঠার মতো লেগে থাকে, ছাড়তে চায় না। “The European elite under took to manufacture a native elite. They picked out promising adolescents; they branded them as with a redhot iron with the principle of western culture; they stuffed their mouths full with high-sounding phrases grand glutinous words that stuck to the teeth. (Preface by Jean-Paul Sartre: Fanons The Wretched of the Earth).
যুক্তিবাদের যুগ এসেছে, পশ্চিম থেকে সাম্রাজ্যবাদী বণিকদের মানদণ্ড ও রাজদণ্ডের সঙ্গে, বিশষ যুক্তিবাদ, হৃদয়বিবেকবর্জিত অভিনব যুক্তিবাদ, অতএব ঔপনিবেশিক নেটিভ এলিটগোষ্ঠীর কণ্ঠে তার অভিনন্দনের শখধবনি এবং একটা, অত্যাশ্চর্য অতিচৈতন্যহীন বিহল তদগতভাব। নবদ্বীপের নব্যন্যায়ের পন্ডিতেরাও হতবাক । তার মধ্যে চোয়াড়-বিদ্রোহ অথবা তিতুমীরের বিদ্রোহ অথবা সাঁওতালবিদ্রোহের মতো অশিক্ষিত অসভ্য অযুক্তিবাদী তুকতাকজাদুমন্ত্রবিশ্বাসী ধর্মভীর, চাষীদের বিদ্রোহ, বিশেষ করে বাক্য-বিতর্কবহির্ভূত সশস্ত্র বিদ্রোহের স্বভাবতই কোনো স্থান ছিল না, মর্যাদা ছিল না, গুরত্ব ছিল না, যেহেতু অশিক্ষিত । অত্যাচারিত চাষীর যুক্তি এবং সুশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত এলিটের “যুক্তির মধ্যে পার্থক্য আশমানজমিন, যদিও সবই যুক্তি এবং প্রসঙ্গত ফরাসী নৃবিজ্ঞানী লেভি-স্পাউসের “দি স্যাভেজ মাইন্ড-এর কথা মনে হয়। আদিম অসভ্য মানুষের ধ্যানধারণা চিন্তাভাবনা আচার আচরণ ইত্যাদির একটা যুক্তি আছে, যেমন আধুনিক সুসভ্য মানুষের সর্ববিধ অকজিকুকাজের একটা যুক্তি আছে, যেমন অত্যধিকসভ্য আমেরিকান শাসকদের ভিয়েৎনাম-কম্বােডিয়ার নিরীহ মানুষের উপর হাজার হাজার টন বোমাবর্ষণের একটা যুক্তি আছে, যেমন শত শত বিদ্রোহী তরুণ যুবকদের বিনাবিচারে যে কোনো গণতান্ত্রিক অজুহাতে হত্যা করার একটা যুক্তি আছে কিন্তু কেবল এই কথাই মনে হয় যে যখন এবম্প্রকার এক যুক্তিবাদের স্বর্ণযুগে আমরা বাস করছি তখন কার যুক্তি বা কোন যুক্তি ভাল বা মন্দ, শ্রেয় বা হেয় তার বিচার করবে কোন যুক্তিবাদী! অতএব পাশ্চাত্ত্য যুক্তিবাদের যুগে যদিও ১৮৩০-৩১ সালে অসংখ্য বিদ্বৎসভা-বিতর্কসভার বিকাশ হয়েছিল অস্মদেশীয় কলকাতা শহরে এবং যদ্যপি সর্বত্রঃ
bigotry, high-handed tyranny superstition and Hindu orthodox was denounced in no measured terms
এবং যদ্যপি তিতু মিয়ার বিদ্রোহঞ্চল কলকাতা শহরের তোপধনির সীমানার মধ্যে অবস্থিত ছিল, অর্থাৎ পূর্বের বশিরহাটকঙ্গি থানা এবং বর্তমানে বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত অঞ্চল, তথাপি এই বিদ্রোহ আদৌ বঙ্গদেশে ঘটেছিল কি না তার কোনো সংবাদ কলকাতা শহরের নব্যশিক্ষিতদের কোনো বিতর্কসভার আলোচিত বিষয়বিবরণীতে পাওয়া যায় না। অথচ নারকেলবেড়িয়া গ্রামে সম্প্রতি একটি বিচিত্র দৃশ্য দেখে চমৎকত হলাম। রাজনৈতিক বাণিজ্যের মুলধন হয়েছেন তিতুমীর, তাঁর একটি সিমেন্টের কুৎসিত শহীদ-স্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে এবং নিরিবিলি নারকেলবেড়িয়ার ভাঙা মসজিদের ভিটের পাশে কয়েকটি বাঁশঝাড়বেষ্টিত একটি স্থানে মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের বংশধরদের (যেমন মহম্মদ দারবক্স বিশ্বাসদের) গৃহের সন্নিকটে দরগাহের কোণে সিমেন্ট প্লাস্টারের স্তম্ভে তিতমীরঅমরত্ব এবং তাঁর বীরত্বের সম্মান লাভ করেছেন। অনেকের ধারণা (এবং সেই ধারণার। উপরেই স্তম্ভ) এই যে কামানের গোলায় ছিন্নবিছিন্ন তিতুমীরের দেহ স্থানীয় চাষীর সমাধিস্থ করেছিল, যদিও সরকারী দলিলপত্রে প্রকাশ যে যুদ্ধে নিহত তিতুমীর ও তাঁর সহযোদ্ধাদের, আতঙ্কিত ইংরেজ শাসকদের নির্দেশে গোপনে অগ্নিদগ্ধ করে ভস্মীভূত করা হয়েছিল, যাতে না তাঁদের মৃতদেহের দৃশ্য বিদ্রোহীদের উত্তেজিত করতে পারে অথবা তাঁরা বিদ্রোহীদের দ্বারা বীর শহীদের যোগ্য মর্যাদায় সমাধিস্থ হতে পারেন। এ সংবাদ কোনোদিন প্রকাশ করা হয়নি, ১৮৩১ সালে অথবা তার পরে কোনোদিন মুসলমানদের দাড়ি আর মসজিদ, হিন্দুদের গরু, আর মন্দির, মোল্লা আর পূরুত, ফকির-মৌলবী আর ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, লুঙ্গি আর পৈতে, এই প্রকার কতকগুলি ধর্মীয় প্রতীকের অকস্মাৎ মখোমুখি সংঘাত বলে মনে হয় তিতুমীরের বিদ্রোহ। অন্তত মহাফেজখানার দলিলপত্রাদি দেখলে হঠাৎ তাই মনে হয়, যেমন তদানীন্তন ইংরেজ রাজত্বে বিচার বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি টমাসনের কাছে লিখিত ব:রাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার, নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ, বিভাগীয় কমিশনার বারওয়েল, এদের চিঠিপত্ৰ-রিপোর্ট ইত্যাদি। অতঃপর কিয়ৎক্ষণ সাহেবলোকদের চিঠিপত্রাদির ভাষার মর্মস্থলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায় যে দাড়িগরু মসজিদ মন্দিরের বহু প্রচারিত ধর্মীয় প্রতীকী সংঘর্টের কুজঝটিকার ভিতর দিয়ে নিসার আলি ওরফে তিতু মিয়া তিতুমীর নামক ওয়াহাবী আদর্শানুগামী ধর্মোন্মত্ত মুসলমানটির বিদ্রোহের একটা প্যাটান, একটা আদল, ধীরে ধীরে রেখায়িত হয়ে উঠছে এবং সেটা আর যাই হে ক ইদানীংকার শোষক শ্রেণী প্রণোদিত অতিবীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা নয়, কদাচ নয়। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ অথবা দাড়িগরুর কোনো প্রকারের বিরোধ সংঘর্ষ তার মধ্যে ছিল এমন কথা কোনো ঐতিহাসিক অস্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে একথাও স্বীকার করতে হবে। যে এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ইন্ধন যুগিয়েছেন বশিরহাট-বারাসাত অন্চলের!শোষক শ্রেণী, যার অধিকাংশই হিন্দু জমিদার এবং তাঁদের হর্তাকর্তাতুল্যে স্টম আর ডেভিসের মতো দোর্দন্ডপ্রতাপ ইংরেজ নীলকরেরা, যাঁরা আবার স্থানীয় ইংরেজ শাসকদের রাজদণ্ডাশ্রিত। অতএব সর্বাগ্রে মহাফেজখানার দলিলপত্রাদি দেখা যাক। গোড়া থেকে শেষের দিক নয়, শেষ থেকে গোড়ার দিকে। এই বিশেষ রীতির বিশেষ তাৎপর্য হয়তো শেষে পরিষ্কার হতে পারে। নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা খতম তিতুমীর ও তাঁর সহসংগ্রামীরা। অনেকে নিহত, অনেকে আহত, অনেকে ধৃত ও বন্দী, সুন্দরবনের পথে আলিপুর জেলে প্রেরিত, বাকি সকলে ছত্রভঙ্গ অথবা। কমিশনার বারওয়েল বিচার বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি টমসনকে লিখছেন (২৮ নভেম্বর ১৮৩১) ঃ বারাসাত জেলায় সম্প্রতি যে বিদ্রোহ
হয়ে গেল তার মূল উৎস হল মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর ধর্মোন্মত্ততা এবং সেই উন্মত্ততা কৃষ্ণদেব রায় নামে স্থানীয় একজন জমিদারের অত্যাচারের ফলে তারই জমিদারীতে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। বিদ্রোহীদের অসন্তোষের কারণ স্থানীয় অস্থায়ী জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট সঠিকভাবে তদন্ত করেননি এবং বশিরহাট থানার একটি অগ্নিদাহের দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়েও তিনি উক্ত জমিদারের স্বেচছাচারিতার প্রতিকার করতে অথবা বিক্ষুব্ধ সাধারণের আশঙ্কা নিবারণে অগ্রসর হননি। তৎসত্তেও যারা অত্যাচারিত নির্যাতিত বলে তাদের মনে করে তারা উচচ আদালতে আপিল করতে সম্মত ছিল। কিন্তু তখন আমার এবং অন্যান্য উকিল ও আইনআদালতের কর্মচারীদের অনুপস্থিতির জন্য (হিন্দু, পূজাপার্বণের ছুটি উপলক্ষে ) তাদের পক্ষে তা সম্ভব হল না এবং অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে নিজেরাই অন্যায়ের প্রতিকার করবে স্থির করল, শাসন শৃঙ্খলার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করতে উদ্যত হল।
একটি বিস্তারিত বিবরণ (৫৬ অনুচেছদ সংবলিত) জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার পেশ করেন বারওয়েলের কাছে (বার সাত, ২৫ নবেম্বর ১৮৩১) উদ্দেশ্য খানিকটা নিজের দোষক্ষালণ করা।
বিবরণের মর্ম এই ঃ ২৭ জুন ১৮৩১ বশিরহাট থানার মুহুরি সাহেবকে জানান যে মৌজা নগর সরফরাজপুরের (পুড়া) পরলোকগত তালুকদার নবগোবিন্দ রায়ের নায়েব রামধন সরকার থানায় একটি এজাহার দিয়েছেন এই মর্মে যে বিশ-তিরিশ জন লোক স্থানীয় এক প্রজার গৃহে জমায়েত হয়েছে দেখে তিনি তিনজন পেয়াদা পাঠান তাদের অভিসন্ধি জানার জন্য, কিন্তু তারা পেয়াদার সঙ্গে বড়ই দুর্ব্যবহার করে এবং একজন পেয়াদাকে ধরে বেধড়ক প্যাদানি দিয়ে বিদায় করে দেয়। চৌকিদার ও অন্যান্যদের বিবৃতি এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী দায়েম কারিগর থানায় এসে শপথ করে বললে যে কৃষ্ণদেব রায় (নবগোবিন্দের পুত্র) মুসলমান প্রজাদের – কাছ থেকে দাড়ির জন্য আড়াই টাকা করে ট্যাক্স আদায় করছেন। এবং ট্যাক্স না দিলে জরিমানা ও নানা রকমের অত্যাচার করছেন। পারিয়াল কারিগর এসে বললে যে তালুকদার কৃষ্ণদেব রায় তিনশো লাঠিয়াল নিয়ে এসে তাদের মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেন। তারাগনিয়ায় যে বরকন্দাজ ছিল সে এই ঘটনার আগেই সরে পড়ে। ১৫ জুলাই দায়েম কারিগর অভিযোগ করে যে কৃষ্ণদেব রায় দু-তিনশো করে লাঠি-সড়কিতলোয়ারধীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে যদৃচছা জবরদস্তি করে দাড়ির ট্যাক্স আদায় করছেন। কৃষ্ণদেব জানান যে সমস্ত অভিযোগ বিদ্বেষজাত ও ভিত্তিহীন। লক্ষীকান্ত ঘোষ, খসল সিং জান মহম্মদ, খসুব গাজী (সকলে জমিদারের চাকর) কৃষ্ণদেবের পক্ষে এবং রহমতুল্লা, ইয়ার গাজী মল্লিক চাঁদ কারিগর দিলু কারিগর, দায়েম কারিগর, কাদের বক্স কারিগর বিপক্ষে সাক্ষী দেয়। অতঃপর প্রশ্ন জবাব রদ্দিজবাব চলতে থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কোটে, যেমন চলে থাকে। ২ সেপ্টেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পরস্পরবিরোধী সাক্ষী ও বিবৃতিতে বিভ্রান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত করেন যে বিবদমান উভয়পক্ষের। প্রত্যেককে পন্চাশ টাকার একটি বণ্ড দিয়ে স্থানীয় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। পরে সাহেব তাদের বড় আদালতে আপীল করার অনুমতি দেন এবং কাদেরবক্স কারিগর আপীল করবে জানায়। অতঃপর সাহেব তাঁর সুদীর্ঘ প্রতিবেদনে তিতুমীর ও তার নব্যসম্প্রদায় সম্বন্ধে একটি অনুচেছদ (৩৪ নং) সন্নিবেশ করে বলেনঃ প্রসঙ্গত এখানে তিতুমীর সম্পর্কে কিছু বলা দরকার এবং আমি তার সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তাই এখানে সংক্ষেপে নিবেদন করছি। তিতুমীর হল একটি নতুন মুসলমান ধর্মসম্প্রদায়ের পাণ্ডা (রিং লিডার)। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর (সাহেবের অনুমান সত্য হলে তিতুমীরের জন্ম হয় ১৭৮০-৮১ ও সালে)। ষোল বছর তিতু কলকাতায় একজন কুস্তিগীর ছিল, পরে একজন জমিদারের অধীনে সর্দারের চাকরি করে এবং এক দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়িত হয়ে কারাদন্ড ভোগ করে। কারামুক্ত হবার পর তিতু জমিদারের গোলামি ছেড়ে মক্কা যাত্রা করে একজন রাজকুমারের (প্রিন্স অফ দিলী) সঙ্গে। মক্কায় সৈয়দ আহমদ নামে এক “প্রবঞ্চকের সঙ্গে (সাহেব ইমপোস্টার সৈয়দ আহমেদ বলেছেন)। তার সাক্ষাৎ হয়। দেশে ফিরে আসার পর তিতুমীর কিছুদিন কলকাতায় থাকে, তারপর নারকেলবেড়িয়ার কাছে হায়দারপুরে এসে তার নতুন ধর্মপ্রচারে মনোযোগী হয়। গত তিন-চার বছরের মধ্যে এই অন্চলে তিতু খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তার জীবনযাত্রার ধারার অনেক পরিবর্তন হয়,কঠোর সংযত জীবন যাপন করতে থাকে এবং তার ধর্মাদর্শে দীক্ষা দেওয়াই হয় তার প্রধান কাজ। পীরের পূজা করা, দরগাহ তৈরি করা, এসব আসল ইসলামধর্মবিরোধী, প্রকৃত মুসলমানের উচিত এ সমস্ত অভ্যাস বর্জন করা। এই ছিল তিতুর ধর্মপ্রচারের মূল কথা। এর বেশি তিতুমীরের পরিচয় প্রসঙ্গে সাহেব তাঁর রিপোর্টে আর কিছু বলেননি। তারপর পুর্বের ঘটনাক্রম অনুসরণ করে লিখেছেন ঃ ৩১ অক্টোবর ১৮৩১ তিনি বশিরহাট থানা থেকে একটি রিপোর্টে জানতে পারেন যে তিতুমীর তার দলের লোকজন নিয়ে কৃষ্ণদেবের তালুকে একটি গোহত্যা করার জন্য যাত্রা করেছে এই খবর পেয়ে দারোগা দুজন বরকন্দাজ পাঠিয়েছেন। ওদিকে গরপ্রসাদ চৌধুরী, কঞ্চিদেব রায়, শিবচন্দ্র রায়, পশ্চানন্দ রায় এরাও তাঁকে এই খবরটি জানান। এর পর ১০ নভেম্বর পর্যন্ত আর কোনো খবর সাহেবের কাছে পৌছয়নি। খবর না পেয়ে সাহেবের ধারণা হয় যে দাঙ্গাহাঙ্গামার ঘটনা অতিরঞ্জিতু। পরে শোনা যায় যে তিতুমীর প্রায় তিনশো লোক নিয়ে গোহত্যা করার পর হাঠখোলার বাজার লুট করেছে। দারোগা খবর পান যে প্রায় ষাট-সত্তর জন লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথে ঘুরে বেড়াচেছ এবং তাঁকে খুন করার জন্য খুজছে। কাজেই কয়েকজন বরকন্দাজ নিয়ে দারোগা এদের জব্দ করতে পারবেন না বলে সাহেবকে জানান। এদিকে স্মিথের (নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট) কাছ থেকে সংবাদ আসে যে তিনি যখন হাতির পিঠে চড়ে সফরে বেরিয়েছিলেন তখন অন্তত চার-পাঁচশো লোক তাঁকে আক্রমণ করে এবং তাঁর ভৃত্য নবাবউদ্দিন গুরতর আহত হয়। নবাবউদ্দিনের এজাহারে প্রকাশ যে গোলাম মাসুম, দায়েম কারিগর, করিম কারিগর, বাবুয়া কারিগর, কবির কারিগরের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচেছ। সেদিন গোকুল ভট্টাচার্য নামে এক ব্রাহ্মণকে, স্নানের পথে ধরে তারা বেদম প্রহার দিয়েছে এবং গোলাম মাসুম বামুনকে মুসলমান করবে বলে শাসিয়ে, তাকে বিবস্ত্র করে, পথের ধারে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। মহেশ ঘোষের একটি গরু ধরে নিয়ে গিয়ে তারা হত্যা করেছে। হাটখোলার ব্যবসায়ী ও দোকানদার লক্ষণ দেব, মোহন সাহা, গোলোক সাহা ও আরও অনেকে বলে যে গরুটিকে একটি মন্দিরের সামনে হত্যা করে সেই মন্দিরের গায়ে গোরক্ত লেপন করা হয়। কৃষ্ণনগর জেলায় (নদীয়া) একটি গ্রামে দেবনাথ রায়কে তারা খুন করে। এর পর কলিগ থানার দারোগার রিপোর্ট নীলকর স্টিম সাহেবের রিপোর্ট: নীলকর ডেভিসের কর্মচারী পিরন সাহেবের রির্পোট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পৌছয়, তিতুমীরে সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী সম্বন্ধে কেবল আলেকজান্ডার নন, স্মিথ, বারওয়েল সকলে বিচলিত হন, কলকাতার বড়সাহেবদের কাছে আবেদন করা হয় সৈন্য পাঠানোর জন্য। কমিশনারের নির্দেশে আলেকজাণ্ডার ১৪ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় বশিরহাট থানায় যান। পরদিন ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোরে একজন হাবিলদার একজন জমাদার এবং কুড়িজন সেপাই নিয়ে রওয়ানা হয়ে বেলা নটার সময় তিনি বাড়িয়া আসেন। বাড়িয়া থেকে নারকেলবেড়িয়া তিন ক্রোশ দূরা দুষ্কৃতকারীরা এইখানে আড্ডা গেড়েছে বলে তিনি খবর পান। সেপাইদের সঙ্গে বশিরহাট থানার দারোগা চৌকিদার বকন্দাজদের নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বেলা বারোটার সময় নারকেলবেড়িয়া উপস্থিত হন। প্রায় ৫০০/৬০০ লোকের জমাত হয়েছিল সেখানে, সাহেবের অনুমান। তারা সাহেব ও সেপাইসামত দেখে একপাও পিছোতে চায় না। কামানবন্দুকে গোলাগুলি করার জন্য জমাদারকে হুকুম দেওয়া হয়। সাহেবী ভগ্নিতে ম্যাজিস্ট্রেট। একবার জয়াতের দিকে কিছু বলবার উদ্দেশ্যে কয়েক পা এগিয়ে যান। তৎক্ষণাৎ সাহেবের উপর প্রবল ইটপাটকেল বর্ষণ হয়। সাহেব পিছোতে থাকেন, জমাত এগোতে থাকে। জমাদারকে গোলাবর্ষণের হকুম দেওয়া হয়। কিন্তু নোবডি ফেল অর এপিয়াড উইণ্ডেড ইন দি লাইটেস্ট ডিগ্রী। (সাহেবের এই উক্তি লক্ষণীয়। গুলি খা ডালেগা ধ্বনি ও ফকিরী ভেল্কির কথা মনে হয় )। তারপর সাহেব দেখেন জমতের ভিতর থেকে কে একজন তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ তখন তিনি পেছনে চেয়ে দেখেন তাঁর সেপাইবরকন্দজরা প্রাণের ভয়ে দৌড় দিচেছ (এভরি পারসন অন মাই সাইড ওয়াজ রানিং অ্যাওয়ে ) এবং নিরুপায় হয়ে তিনিও পলাতকদের পশ্চাদধাবন করতে থাকেন (আই অলসো অবলাইজড টু রান ফর মাই লাইফ)। খোলা তলোয়ারি নিয়ে বিদ্রোহীরাও তাদের তাড়া করে। প্রায় পাঁচ মাইল উধ্বশ্বাসে দৌড়বারপুর সামনের একটি নালার উপর ঝাপিয়ে পড়ে সাতরে সাহেব অপর পারে ওঠেন, সেখান থেকে পুনরায় দৌড়াতে দৌড়তে বাদুড়িয়া পৌছান এবং সেখান থেকে নৌকো করে বশিরহাটের কাছে বাগাণ্ডি (বা বাঘমুণ্ডি) গ্রামে উপস্থিত হন সূর্যাস্তকালে। এ যাত্রা প্রাণে বেচে যান ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। ১৫ নভেম্বর ১৮৩১, মঙ্গলবার
জলপথে নৌকো করে সুন্দরবন দিয়ে কলকাতা যাওয়া স্থির করেন আলেকজাণ্ডার এবং অবিলম্বে তার ব্যবস্থা করে যাত্রা করেন। সাক্ষাতে সমস্ত ঘটনার বিবরণ বড়সাহেবদের দেওয়া প্রয়োজন। ১৬ নভেম্বর বুধবার তিনি কলকাতায় পৌছান বেলা তিনটার সময়। কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য কর্তাদের তিতুমীরদের বিদ্রোহবার্তা সবিস্তারে জানানো হয় এবং স্থির হয় যে অবিলম্বে মিলিটারি পাঠাবার ব্যবস্থা করা হবে । মেজর স্কট, লেফটেন্যান্ট শেকসপীয়র, ক্যাপ্টেন সাদারল্যাণ্ড গোলন্দাজ, অবারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে বারাসাতের দিকে যাত্রা করেন। তাদের রসদাদির ব্যবস্থার জন্য এবং পথঘাটব্রিজ ইত্যাদি ঠিক করার জন্য আলেকজান্ডার আগেই রওয়ানা হয়ে যান।
১৮ নভেম্বর শুক্রবার ভোর চারটার সময় অবারোহীদের নিয়ে আলেকজাল্ডার বাদুড়িয়া পৌছান বেলা আটটার সময় । তারপর কাপ্টেন সাদারল্যান্ডকে নিয়ে নারকেলবেড়িয়ার পথে যাত্রা করেন। পথে বিদ্রোহীদের সঙ্গে বিচিছন্ন লড়াই হয়। সাদরিল্যাণ্ড মেজর স্কটকে লেখেন গোলন্দাজ সৈন্যদের পাঠাবার জন্য। গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শেকসপীয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে যখন আলেকজান্ডার কথা বলছিলেন তখন তাঁকে লক্ষ্য করে বিদ্রোহী একজন গোলা বর্ষণ করে এবং গোলাটি তাঁর কান ঘেষে চলে যায়। (এ্যান ইনসার্জেন্ট টক ডেলিবারেট এইম এ্যাট মি এ্যান্ড দি বল পাসড ক্লোজ , টু মাই ইয়ার)। সেই একই ব্যক্তি যে গোলাটি তাঁকে লক্ষ্য করে ছাড়ে সে ম্যাকান নামে একজন গোলন্দাজকে গুলি করে মারে এই ব্যক্তিটি হল তিতুমীর। সূর্যাস্ত পর্যন্ত নরিকেলবেড়িয়ায় এইভাবে লড়াই করে তারা স্বস্থানে ফিরে আসেন। ১৯ নভেম্বর শনিবার সকালে আবার সেনাদল নিয়ে তাঁরা নারকেলবেড়িয়া যান। সেইদিন সকালে সম্মুখ লড়াইয়ে তিতুমীরের দলের পরাজয় হয়, তিতুমীর ও তার প্রায় পঞ্চাশজন সহযোদ্ধা নিহত হন এবং অনেকে আহত, ধৃত ও বন্দী হন। সেইদিনই কমিশনার বারওয়েল সাহেবকে আলেকজান্ডার জানান যে . নিহতদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা উচিত, বিশেষ করে নিহতদের মধ্যে তিতুমীরও একজন যেহেতু, কারণ তা না হলে বিদ্রোহীরাশহীদের সম্মানে তিতুমীরের দেহ সমাধিস্থ করবেঃ I consider that the bodies of the dead should be burnt particularly as their leader Titoo Meer is among them ond they might take his body and bury him as a martyr.).
২০ নভেম্বর রবিবার আলেকজান্ডার নাকেলবেড়িয়ার বিধস্ত বাঁশের কেল্লায় গিয়ে ধংসস্তুপের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুজেছেন, এমন কোনো কাগজপত্র কিতাব ইশতেহার বা ফতোয়া পাওয়া যায় কিনা, যার মধ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে তিতুমীরের দলের কোনো ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আছে। বাঁশের কেল্লা তখন গুলিগোলার আগুনে ভস্মীভূত, কাজেই তার মধ্যে কোনো কাগজপত্র, কিতাব, ফতোয়া, ইশতেহার পাওয়া যায়নি। সেইদিন নিহতদের বাকি সমস্ত মৃতদেহ পড়িয়ে ফেলার হুকুম দেন আলেকজান্ডার, যেহেতু আগের দিন (১৯ নভেম্বর ১৮৩১, যেদিনকার চূড়ান্ত লড়াইয়ে তিতুমীর পরাজিত ও নিহত হন) তিতুমীর ও অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। (I then gave orders for the burning of the remainig dead bodies, Titoo Meer and the other chief persons having been burnt the day before for fear of persons taking away their bodies.). আলেকজান্ডারের প্রতিবেদনে ১৭ নভেম্বরের কোনো ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ সাহেব ঐ তারিখের একটি পত্রে বারাসাতের জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে লেখেনঃ আজ বিকেল পাঁচটার সময় আমি ও ডেভিড অ্যানড্রজ চারজন ইংরেজ অ্যাসিস্ট্যান্ট আর কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বারঘরের নীলকুঠিতে গিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল এগারটি হাতি এবং একদল পুলিশ ও বরকন্দাজ। তা ছাড়া স্থানীয় জমিদাররা সকলে কথা দেন যে তিতুমীরের দুর্ৰৃওদের সায়েস্তা করার কাজে তাঁরা যথাসাধ্য আমাদের সাহায্য করবেন। আজ সকালে তিতুর দলের লোকেরা এখনকার স্টম সাহেবের নীলকুঠি আক্রমণ করে, কিছু, জিনিস লুটপাট করে নিয়ে যায়, বাকি সব লণ্ডভণ্ড করে নষ্ট করে দেয়। আপনি কালকেই বেশ কিছু, সৈন্য নিয়ে নারকেলবেড়িয়া যাত্রা করন এবং যত শীঘ্র সম্ভব এই দুর্বৃত্তদের দমন করার ব্যবস্থা করন। আপনার কাছ থেকে খবরের প্রতীক্ষায় রইলাম। পুনশ্চঃ আমরা বন্দুক উচিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছি, কারণ এইমাত্র খবর পেলাম যে একটা বেশ বড় জমাত একট, দূরে একটা মাঠে নমাজ পড়ছে। মনে হয় নমাজ শেষ হলে ওরা আমাদের আক্রমণ করবে। তা যদি হয় তাহলে কোনো আইনকানুন মানব না, সোজা জমাত লক্ষ্য করে গুলি করব। _ বনগাঁর উত্তরে মলনাথ নীলকুঠি থেকে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ ১৭ নভেম্বর লেখেন ঃ “ডেভিড অ্যানড্রজ, তার লোকলস্কর এবং অামরা অাজ কোনোরকমে হাতির পিঠে চড়ে প্রাণ নিয়ে এখানে ফিরে এসেছি। আমাদের বাঁচাটা একটা অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হচেছ। বারঘরের নীলকুঠি তিতুমীরের দল প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে এবং যথেষ্ট আগ্নেয়াস্ত্র গুলিগোলা থাকা সত্তেও আমরা তা সামলাতে পারিনি। বেসামাল অবস্থায় কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ডেভিসের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, আসবাবপত্তর প্লেট থালা বাসন, দুটি বজরা, একটি পানসি, কয়েকটি জেলেবোট ও ডিঙি, একটি হাতি এবং আমার পাল্কিটি খোয়া গেছে। সঙ্গে যে আমলারা ছিল তাদের ফেলে রেখে আমরা পালিয়ে এসেছি জানি না তাদের কি হাল হয়েছে ।
ঘটনাটা ঘটল এইভাবে। সকাল সাড়ে নটার সময় পানসি থেকে নেমে হাতির পিঠে চড়ে, বারো-চৌদ্দীটি ডবল-ব্যারেল বন্দুকে নিয়ে, আমরা দুর্বৃত্তদের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। তিতুমীরের শাগরেদরা দলে ভারি নয়, এবং দুর্বল বলে আমরা যে দালালদের মারফত গোপনে খবর পেয়েছিলাম, তা ঠিক নয়। আমাদের সঙ্গে অন্তত তিনশো লোক ছিল। এই রকম সাজসজ্জা করে বারঘরের মাইল দেড়েক দুরে নারকেলবেড়িয়ার দিকে আমরা যাত্রা করি। কিন্তু দূর থেকে জমাতের বিশাল আকার দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই এবং তাদের মারমুখী উদ্ধত চেহারা দেখে রীতিমতো ভীত হই মুহূর্তেই। আমরা স্থির করি যে এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। পালাবার জন্য যখনই আমরা পেছন ফিরি তৎক্ষণাৎ তারা তড়িৎগতিতে আমাদের আক্রমণ করে। জোরে দৌড়তে না পেরে আমাদের দলের কয়েকজন ধরা পড়ে এবং তাদের তৎক্ষণাৎ কেটে ফেলা হয়। দৌড়তে দৌড়তে নদীর তীরে পৌছে আমরা পানসিতে উঠি। পানসি থেকে দেখি আমাদের লোকজন যারা পৌছতে পারেনি, তাদের ওরা ধরছে আর কাটছে। পানসি থেকে বন্দুক তুলে আমরাও অনগল গুলি করতে লাগলাম, কিন্তু আশ্চর্য! গুলির আওয়াজ হয় আর ঝপ করে ওরা মাথা হেট করে, আবার মাথা তোলে, আবার আওয়াজ হয়, আবার মাথা হেট করে আর মাথা তোলে (দে ববড ডাউন এ্যাণ্ড এ্যাভয়েড দি শটস)। (আবার সেই ফকিরী ভেল্কি গুলি খা ডালে গা-র কথা মনে হয়)। বোধহয় গুলির ব্যর্থতা দেখে, আমাদের সশরীরী অস্তিত্ব একেবারে উপেক্ষা করে, অদ্ভূত উল্লাসে তারা নাচতে থাকে, লাফাতে থাকে (এ্যান্ড দেন বিগান ড্যান্সিং এ্যাণ্ড জাপিং এবাউট ইন ডিফিয়ান্স অফ আস)। ডেভিসের গুলিতে ওদের একজন মারা যায় । তার পোশাক দেখে মনে হয় সে দলের একজন সর্দার। কয়েকজন জখমও হয়। কিন্তু তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রুমে তারা নদীর তীরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মনে হল পানসিসুদ্ধু আমাদের ধরে কেটে ফেলবে। তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে প্রায় মাইলখানেক দৌড়ে আমরা হাতির কাছে পৌছলাম এবং হাতিতে চড়ে পালিয়ে এলাম ডেভিসের নীলকুঠিতে ধরা পড়লে, এবং পড়ার সম্ভাবনা খুবই ছিল, ওরা আমাদের খণ্ড খন্ড করে কেটে ফেলত। আমার ফৌজদারি নাজির ওদের হাতে ধরা পড়ে এবং তাকে টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। এছাড়া আরও কত লোকজন যে ওদের হাতে ধরা পড়ে ও মারা যায় এবং জিনিসপত্তরের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসেব এখনো করিনি। তিতুমীরের এই অসাধারণ শাগরেদ দলের যে তেজউদ্দীত দঢ়তা ও উদ্দামতা আমি স্বচক্ষে লক্ষ্য করেছি—প্রায় হাজার থেকে দেড় হাজার লোকের দল এবং চারিদিকের গ্রামের লোকের সহানুভূতি আশ্রিত—তাতে আমি নিঃসন্দেহে গবর্নমন্টকে অবিলম্বে সর্বপ্রকারের সাহায্যদানের (মিলিটারী) জন্য অনুরোধ করতে পারি। (“After what I have myself withnessed of the spirit resolution and fanticism of this most extra-ordinory body of men, whose numbers could not have been less than 1000 or 1500 in league with all the surrounding villages I have no hesitation in making the most urgent representation to Government of the absolute necessity for prompt and efficient aid not only to check their progress up the Isamutty River abounding with Indigo Factories several of which beong to Mr. Andrews who will now be an object of their speciol vengeance but like wise afford protection to the lives and property of the people of the Zillah and to cut them off in case they approached the Sudder station.) ১৯শে নবেম্বর (যেদিন নারকেলবেড়িয়ার চূড়ান্ত লড়াইয়ে তিতুমীর নিহত হন) নদীয়ার ফৌজদারী আদালতগহ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ কলকাতায় বিচারবিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি টমাসনকে লিখছেন, nothing short of a stong military power will be able to deal with these fellows..
স্মিথ জানতেন না যে তাঁর চিঠি কলকাতায় পৌছবার আগেই বড়সাহেবরা এই কর্তব্য পালন করবেন। কোনো রকমের গম্ভীর সমাজতাত্তিক বিশ্লেষণ অথবা ঐতিহাসিক কল্পনার প্রসারণ ছাড়াই তিতুমীরের বিদ্রোহের স্বরুপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট পরিচছন্ন ধারণা যেকোনো সাধারণ মানু, ষেরও হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস, শুধু, ইংরেজ জেলাশাসকদের এই চিঠিপত্র ও বিবরণীগুলি পাঠ করলে। আর যাই হোক বিদ্রোহটা যে দাড়ি আর গরু, মন্দির আর মসজিদ, লুঙ্গি আর কাছা, বামুন অার মোল্লা ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতীকের কনফ্লনটেশন নয় অথবা কোনো হঠাৎ
উত্তেজনার উৎকট বাহ্যপ্রকাশ নয়, সেটা অন্তত আলেকজান্ডার, স্মিথ ও বারওয়েলের পত্ৰবিবরণাদি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৮৩১ সালের জুন-জুলাই মাস থেকে আরম্ভ। তখন দাড়ি গরু মন্দির মসজিদ ইত্যাদির কিঞ্চিৎ বাহুল্য। একদিকে কৃষ্ণদেবদের মতো হিন্দু জমিদাররা আর অন্যদিকে বিদ্যালংকারবর্ণিত তিতুমীরের মতো ধর্মোন্মত্ত মুসলমানরা। অতএব ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের বিচার বিবেচনার পথ প্রশস্ত । বিদ্রোহটা নিছক হিন্দমুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু তাতে যে নয় সেটা সরকারী বিবরণী থেকে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। কমিশনার ও জেলাশাসকদের চিঠিপত্র ও প্রতিবেদনে দেখা যায়, ক্রমে বিদ্রোহ ও সংগ্রাম যত তীব্র ও ব্যাপক হয়েছে, তত দাড়ি গরু মন্দির মসজিদ মোল্লা পুরুত ইত্যাদি ধর্মীয় উপাদান সরকারী বিবরণী থেকে অন্তহিত হয়েছে এবং তার পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসকরা এবং তাঁদের সহযোগী স্থানীয় নীলকর ও জমিদাররা শত্রুরুপে বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আপাতত এইটুকু শুধু মনে রাখা দরকার, বাকিটকু এই কাহিনীর অগ্রগতির সঙ্গে এবং শেষে বলা যাবে ।
কলভিনের সুদীর্ঘ রিপোর্ট (৪৫ অনুচ্ছেদ সংবলিত, ৮ মার্চ ১৮৩২) কমিশনার বারওয়েল কলকাতায় বিচারবিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি টমাসনকে ১৬ মার্চ ১৮৩২ পাঠিয়ে দেন এবং তাঁর চিঠিতে কলভিনের (তখন আলেকজান্ডারের বদলে বারাসাতের অস্থায়ী জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট) নিরপেক্ষ তদন্তের ও বিচারবুদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করেন। আলেকজান্ডারের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে কলভিনের নিজস্ব মন্তব্যের মধ্যে যেগুলি অনুধাবনযোগ্য, কেবল সেইগুলি এখানে আমরা উল্লেখ করব । যেমন কলভিন বলেছেন (অনুচ্ছেদ ৪) যে বিদ্রোহ বা হাঙ্গামা যাই বলে তিতুমীরের ক্রিয়াকলাপকে অভিহিত করা হোক না কেন, তা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রধানত বারাসাতের উত্তরাংশের লোকজন এবং সংলগ্ন নদীয়া জেলার কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীরা এই বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশ হল দরিদ্র কৃষক এবং মুসলমান তন্তুবায় (‘জোলা’ বলে পরিচিত, অন্যতম উপাধি ‘কারিগর’)’ এবং এই জোলাদের সংখ্যা এই অঞ্চলে খুব বেশি। বিদ্রোহীদের দলপতি মীর নিসার আলি, সাধারণত তিতুমীর নামে খ্যাত। তিতুমীরের কয়েকজন সদ্রান্ত আত্মীয়স্বজন এই অঞ্চলে বাস করে বটে, কিন্তু দু-একজনের বেশি নয়। তিতুর অনুচরদের মধ্যে প্রধান হল এই অঞ্চলের কৃষকরা, যারা তার প্রাথমিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তার দলে যোগ দিয়েছে এবং বাকি সকলে তার প্রচারিত নব্য-ইসলাম ধর্মের সমর্থক।
একটি মানচিত্র কলভিন তাঁর রিপোর্টের সঙ্গে পাঠিয়ে মন্তব্য করেছেন যে তিতুমীরের বিদ্রোহাঞ্চলের সীমানা ২৮০ বর্গমাইলের বেশি নয় (অনুচ্ছেদ ৫)। যমুনা ও ইছামতী নদীর উপর দিয়ে নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে বিদ্রোহের এলাকা দৈর্ঘ্যে ১৮ থেকে ২০ মাইল এবং প্রস্থে ১২ থেকে ১৪ মাইলের বেশি নয়। (“The accompanying Map which is tolerably correct and which I have morked off the farthest villages in each direction from which the people were assembled in any numbers will show the tract of country over which the influence of their leader extended. This tract running across the Juhoon(যমুনা) and Issamutty rivers into the Nuddea Jurisdiction is some Eighteen or Twenty miles in length by Twelve or Fourteen in breadth “)
দুঃখের বিষয়, মানচিত্রটি মহাফেজখানায় নেই।
কলভিন লিখেছেন, ‘নারকেলবেড়িয়ার কয়েক মাইল দক্ষিণপশ্চিমে ‘চাঁদপুর’ গ্রামে তিতুমীরের বাস (সকল ‘হায়দারপুর’ গ্রামের নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সেটা ভাল নয়, কারণ হায়দারপুর আর চাঁদপুর সংলগ্ন গ্রাম, একই গ্রাম দুইভাগে বিভক্ত বললেও ভু হয় না এবং সাধারণ মুসলমান চাষীর চেয়ে একটু ভাল অবস্থার কষক পরিবারের সন্তান। প্রথম জীবনে তিতুমীর খুব দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল এবং গুন্ডাবাজী ও দাঙ্গাহাঙ্গমায় একাধিকবার লিপ্ত থাকার ফলে আদালতে দণ্ডিতও হয়েছে। বছর সাত-আট আগে এক ধনিক রাজকুমারের নেকনজরে পড়ে মক্কায় যাবার সুযোগ পায় তিতু এবং সেখান থেকে ফিরে এসে বছর খানেক চুপচাপ থাকার পর তার নতুন ইসলামধর্ম প্রচারে ও ধর্মসংস্কারে ব্রতী হয়। কিছুদিনের মধ্যে তিতু প্রায় ৩০০/৪০০ শাগরেদ তৈরি করে ফেলে। পোশাক ও চেহারায় (ফকিরের মতে বেশ ও দাড়ি) সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ছিল এবং তারা সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-ব্যবহারে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলত (অনুচ্ছেদ ৬)। তাদের এই নতুন ধর্মসংস্কারের গরু ছিলেন সৈয়দ আহমদ, ‘দি ওয়েল নোনফ্যানাটিক হু গেইভ সো মাচ ট্রাবল টু দি শিখস ইন লাহোর’, কোনোরকমের পৌত্তলিকতাগন্ধী কুসংস্কারগ্রন্থ ধর্মাচরণের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এবং কুসংস্কার যা প্রধানত হিন্দসমাজের সঙ্গে দীর্ঘকাল সান্নিধ্যের ফলে ইসলামধর্মে প্রবেশ করেছে তা বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। সন্ধান করে জেনেছি, কলকাতা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সভ্রান্ত মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই উক্ত সৈয়দ আহমদের ধর্মাদর্শ অনুগামী।
(it is notorious that in Calcutta and it’s neighbourhood Syeed Ahmeed has for his disciples nearly all the most respectable of the Mahommedan inhabitants)
হিন্দুস্থানী ও ফার্সী ভাষায় এই ধর্মাদর্শ ব্যাখ্যা করে অনেক পুস্তকপুস্তিকা ইশতেহার প্রচারিত হয় যেমন
‘Serat Dob Mustakeen Hidyut’, ‘Ool momineem Nosheent Ool Mooslimeen
ইত্যাদি (অনু ৭) । সাধারণ লোকের মধ্যে সৈয়দ অথবা সৈয়দপন্থী তিতুমীরের এই ধর্মসংস্কারের আদর্শ বিশেষ জনপ্রিয় হয়নি, কারণ মহরম উৎসব, ফয়তা (মৃত মুসলমানদের আত্মার কল্যাণার্থে ভোজ্যাদি দানসহ প্রার্থনা বিশেষ) পরীূজা ইত্যাদি বিধর্মীর আচরণ বলে নিন্দিত হলেও সাধারণ মুসলমানদের কাছে তার মর্ম অদৌ বোধগম্য হতো না। সেই কারণে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে তিতুর ধর্মসংস্কারের আহবান বিশেষ সাড়া জাগায়নি (অনু ৮)।
প্রধানত তিতুমীরের দলের ধর্মসংস্কার আন্দোলন স্থানীয়। জনসাধারণের কাছে আবেদন-নিবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তার জন্য কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে বলে জানি না। স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা, যাঁরা সাধারণত কোনো রকমের নতুন আদর্শ বা ভাবধারার প্রচার পছন্দ করেন না তাঁরা একটা সুযোগ পেয়ে অর্থাৎ একদল মুসলমান প্রজা তিতুদের ধর্মপ্রচার পছন্দ করছে না দেখে, উভয়দলের মধ্যে বিবাদের প্ররোচনা দিতে থাকেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, বিবাদ বাধিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তাঁরাই লাভবান হবেন।
(“There was.. the more certain inducement to the dispute furnished by the hope of profiting by”)
জমিদারদের মধ্যে প্রথম যাঁরা বিবাদের উস্কানি দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন, তারাগনিয়ার রামনারায়ণ নাগ (চৌধুরী), নগরপুরের গুরুপ্রসাদ চৌধুরী খোড়গাছির জমিদারনীর এজেন্ট এবং পুড়ার কৃষ্ণদেব রায় ।(এর পর বিবাদ দাঙ্গাহাঙ্গামা থানা দারোগা মামলা মকদ্দমার যে বর্ণনা দিয়েছেন কলভিন তা অনেকটা আলেকজান্ডারের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়)। স্থানীয় আদালতে এই সমন্ত মামলা মিটে যাবার পর জমিদাররা বক্রি খাজনার মিথ্যা অভিযোগে প্রজাদের উপর নানারকমের জুলুম অত্যাচার করতে থাকেন, তাদের কয়েদ করে মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকেন, যার জন্য শেষ পর্যন্ত তারা মরিয়া হয়ে হিংসাত্মক কার্যকলাপ আরম্ভ করে।
(‘that a fraudulent and oppressive use was made by the Zemindars of the power of summary arrest for orrears of rent authorized under the provisions of Regulation 7, 1799 and that this was one of the provocations which at last forced them into acts of violence.’)
এই নিয়ে মামলা মকদ্দমা হয় এবং তারা চব্বিশ পরগনার জেলা আদালতে আপীল করে। কিন্তু আদালতে আপীল করে তাদের সমস্যা কোনো সমাধান হবে না, এরকম একটা ধারণা তাদের মাথায় তিতুমীরের চেলারা ঢুকিয়ে দেয়। যদিও তিতুমীরের ধর্মসংস্কারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না, তাহলেও সে চাষীদের অভাব অভিযোগ নিজের মতো করে গ্রহণ করে।
(‘Yet Titto Meer, the head of their sect had made common cause with those persons’)
তিতুর গ্রামবাসী মহম্মদ মাসুদ নামে তার একজন অনুচর চাষীদের প্রতিনিধি ও পরামর্শদাতা হিসেবে তাদের সঙ্গে কলকাতায় যায় এবং সেখানে সলাপরামর্শ করে, আপীলের পথ ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য।
(‘it is to circumstance of some kind or other that occurred in Calcutta that I oscrible his adopting the resolution of collecting his follows and seeking revenge for his party by force.’)
নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমীরের দলের জমাত হয় এবং সেখানেই তারা তাদের প্রধান ঘাঁটি তৈরি করে। তার কারণ এই গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন চাষী (‘প্রিন্সিপ্যাল রায়ত’) মৈজুদ্দীন বিশ্বাস (পঞ্চাশ বিঘের মতো লাখেরাজ সম্পত্তির মালিক) ছিল তিতুমীরের ভক্ত । অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে জমিদারদের আক্রমণ করার জন্য এখানে তারা মজবুত ঘাঁটি তৈরি করে। শান্তিপ্রিয় নিরীহ একদল চাষী হঠাৎ এরকম হিংসাত্মক। আইন-শৃংখলা বিরোধী অভিযানের জন্য কেমন করে উৎসাহিত হয়ে উঠল সেকথা ভাবলে বাস্তবিকই অবাক হতে হয় এবং তখন এই কথাই মনে হয় যে একজন ধর্মগুরু বা ধর্মসংস্কারের প্রভাব অশিক্ষিত অনুন্নত জনসাধারণের উপর কতদূর ব্যাপক ও গভীর হতে পারে।
(The readiness with which a body of persons, who had previously for the most part peaceable and harmless Ryots were induced to lead themselves to the most lawless cutrage is a striking instance of the influence which a religious teocher can acquire over an utterly rude and unin formed people’. pora 21)
পরবর্তী বিবরণ আলেকজান্ডারের পুনরাবৃত্তি, কেবল একটি বিষয় প্রসঙ্গত কলভিন উল্লেখ করেছেন যে মীরের দলের বিদ্রোহী ‘অসভ্য’ চাষীরা উত্তেজনার বশেও কোনো নৃশংস কাজ বিশেষ কিছুই করেনি–
“Their proceedings at the same time it should be mentioned were not marked by any acts of gross cruelty।
সমস্ত ঘটনাটা একটা সাময়িক উন্মাদনার প্রকাশ বলে মনে হয়। তবে নারকেলবেড়িয়ার অনেক কৃষক সাক্ষী দেবার সময় বলে যে তিতুমীরের দলের লোকেরা বহুদিন ধরে নাকি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলত এবং একটা কোনো চক্রান্ত করত বলে মনে হয়।
(several of the ryots of Narkelberia village have in their evidence before me united in stating that the people of Tittoo Meer’s sect have been long in the habit of talking of schemes against the habit of talking of schemes against the Government.-Para 26).
তিতুমীরের দলে ধনিক ও প্রভাবশালী লোকের সংখ্যা কি রকম ছিল (স্বভাবতই ধনিক মুসলমান), সেটাও এই তদন্তের অন্যতম বিষয় ছিল। মুনশী উমীর নামে ‘ একজন ধনিক জমিদারের সঙ্গে তিতুমীরের আত্মীয়তা ছিল বিবাহসূত্রে, তাই অনেকে সন্দেহ করত যে মুনশীর সঙ্গে তিতুর যোগসাজস আছে। তদন্ত করে দেখা গেছে, সন্দেহ ভিত্তিহীন। তিতুমীরের দলে এমন লোক বিশেষ ছিল না যাদের কিছু ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।
(‘No one with anything to lose could have ventured to put it to risk in such an affair.’-Para 26).
নানারকমের সব পাওনা আদায়ের অজুহাতে স্থানীয় জমিদারতালুকদারদের জোর-জুলুমজবরদস্তির অনেক অভিযোগ কলভিন কৃষকদের কাছ থেকে শুনেছিলেন তদন্তকালে এবং নিজের লোক দিয়ে অনুসন্ধান করে তিনি জেনেছিলেন যে অভিযোগ সত্য
(‘the intelligence which I obtained from all quarters was such as to leave not the slightest doubt of any kind, that the exactions they complained of had been actually practised,’-Para 27).
অথচ এই জমিদারদের শাসন করা অথবা আইনআদালতের গন্ডির মধ্যে এনে তাঁদের অন্যায়ের বিচার করা একরকম অসম্ভব বলা চলে। কারণ ‘বিসমিল্লায় গলদ’ অর্থাৎ গোড়ায় গলদ অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় যথেষ্ট গলদ থাকার ফলে তার আইনআদালত বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি প্রহসনে পরিণত হয়, বিকৃত হয়, এবং জমিদার বা ধনিক সংগতিপন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যায় করলেও তার যথোচিত তদন্ত করা হয় না এবং তার সামাজিক মর্যাদা প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষয় হতে পরে বলে অন্যায়ের জন্য কোনো দণ্ডও তাকে দেওয়া হয় না। কলভিন লিখেছেনঃ
The entire root of the mischief which has accurred lies doop and cannot easily be removed. The powers possessed by Zeminders enable them to exercise a petty jurisdiction among their ryots and to make petty exactions on all kinds of pretences. The corrupt character of the people and the defects of our own instruments pervert our administration of justice, and render it a matter of the greatest uncertainty whether we shall arrive at the truth or not in all cases in which men of wealth or in influence will be injured by its detection… Para 36.
পাড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে অন্তত লঘূদণ্ড দেওয়া উচিত বলে কলভিন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তার পরেই আবার বলেছেন যে এটা করা ঠিক হবে কি না তাও ভেবে দেখা দরকার সেহেতু কৃষ্ণদেব রায় দন্ডিত হলে প্রমাণিত হবে যে তিতুমীরের বিদ্রোহের কিছুটা যুক্তিসংগত কারণ ছিল
(“To award punishment at all would be to admit that Tittoo Meer’s Party bed soms ground of justification for the excesses which they had committed..)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরর্বতী বাংলার নবজমিদারদের স্বেচ্ছাচারিতার কাহিনী নিয়ে একটি মহাগ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে কিন্তু একটি প্রবন্ধের গণ্ডির মধ্যে তার শতভাগের এক ভাগেরও আভাস দেওয়া সম্ভব নয়। নতুন জমানার (ব্রিটিশ) এই নতুন জাতের জমিদারদের কদাচ প্রচলিত মধ্যযুগীয় অর্থে ঠিক ‘জমিদার’ বলা যায় না, বলা উচিত জমিজমার বা ভূসম্পত্তির ঠিকাদার’ । ঠিকাদারদের অধীনে অসংখ্য উপ-ঠিকাদার (এবং সকলেই ‘জমিদার’) যেমন পত্তনিদার দরপত্তনিদার সেপওনিদার গাঁতিদার ইত্যাদি। গ্রাম্যসমাজে তৃষ্ণাতুর শোষকশ্রেণীর একটা অভিনব স্তরবিন্যাস, যে কোনো দেশের ইতিহাসে অতিশয় দূর্লভ, যেন চাষীদের দেহলগ্ন একঝাঁক জোঁক, রক্ত শুষে স্ফীতকায় হয়ে কলকাতার মতো শহরে বেশ্যাবাইজিবাজি করে নবসংস্কৃতির পোষকতায় নিমজ্জিত । অতিশয়োক্তি নয়। বাংলার এই ঠিকাদার-জমিদাররাই যে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির সর্বপ্রধান। পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার সেকথা তো বাংলার বাঘা জমিদার বর্ধমানের মহারাজ খুব বড়াই করে ভূমিরাজস্ব কমিশনের (ফ্লাউড কমিশন, ১৯৪০) কাছে তাঁর নোট অফ ডিসেন্ট-এ বলেছিলেনঃ
Those who are conversant with the cultural history of Bengal know full well that art literature and music have prospered under the aegis of the landowing community, and this patrange will disappear along with the ablition of private landlordism.
মহারাজার উক্তির সমর্থনে একজন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক (রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়) বলেছিলেন যে যদি ‘রেক-রেন্টিং’ না হয় তাহলে ‘রেন্ট-রিসিভিং’ কোনো অন্যায় অপরাধ নয় এবং বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিশাল অংশ ভূমিরাজম্বভোগীর বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। একটা মহং সদিচ্ছার বশবর্তী হয়ে সেটা হল ‘লাঙলে’র বদলে “কলমের” মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং আধুনিক বিদ্যালাভ করে শিক্ষিত হওয়াঃ
Rent-receiving is not always a crime unless It is rack-renting. The middle classes have become rent-receivers in their zeal to exchange the plough for the pen and have built themselves up on the basis of education financed by their income from their tenures or fields in shape of rents.
ভূমিরাজস্বনির্ভর এই বিপুল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও মধ্যস্বত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে এবং একথা ভারত সচিব পরিষ্কার করে তার এক ডেসপ্যাচে (১৮৬২) বলেছিলেনঃ
It is most desirable that facilities should be given for the gradual growth of a middle class connected with the land without dispossessing the peasant proprietors and occupiers. (Despatch No 14 9th July 1862) .
তিতুমীরের বিদ্রোহকালের মধ্যেই জমিদায় মধ্যস্বত্বভোগী ও তাঁদের নায়েব গোমস্ত আমলা কর্মচারী নিয়ে বেশ বড় একটা শোষকশ্রেণীর বিকাশ হয়েছিল গ্রাম সমাজে । তাদের প্রভুবং সহযোগী ছিলেন সাহেব নীলকররা এবং তাঁদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন ব্রিটিশ শাসকরা ।
সর্বজনবিদিত সত্য হলেও, এই শ্রেণীর শেষণনির্যাতনের বহর এবং আচার-ব্যবহার চরিত্র সম্বন্ধে সামান্য আভাস দেওয়া প্রয়োজন। যেমন জমিদাররা ন্যায্য রাজস্ব ভিন্ন বাটা, যথাকালে অনাদায়ি রাজস্বের নিয়মাতিরিক্ত বৃদ্ধি, বাটার বুদ্ধি, বৃদ্ধির বৃদ্ধি, আগমনি, পাব্বণি, হিসাবানা প্রভৃতি অশেষ প্রকার উপলক্ষ করিয়া ক্রমাগতই প্ৰজা নিপীড়ন করিতে থাকেন। অনেকানেক ভীস্বামি অনাদায়ি ধনের চতুর্থাংশ বৃদ্ধি স্বরূপে গ্রহণ করেন । প্রতি শতে পঁচিশ টাকা করিয়া বৃদ্ধি। ইহার অপেক্ষা অনর্থমূলক ব্যাপার আর কি আছে? যেমন ভূস্বামির ভবনে বিবাহ, আদকৃত্য, দেবোৎসব, বা প্রকৃরান্তর পুণ্যক্রিয়া ও উৎসব ব্যাপার উপস্থিত হইলে প্রজাদের অনর্থপতি উপস্থিত, তাহারদিগকেই ইহার সমুদয় বা অধিকাংশ ব্যয়সম্পন্ন করিতে হয় । ইহা মাঙ্গন বলিয়া প্রসিদ্ধ’ । যেমন মাঙ্গনের একটি দৃষ্টান্তঃ ‘কলিকাতাবাসী ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব কোনো প্রসিদ্ধ ভূস্বামি একদা আপনার অধিকারস্ধ প্রজাদিগকে কহিয়াছিলেন, ওহে বাবা সকল। আমি ব্রাহ্মণ, এক মুষ্টি করিয়া চাউল ভিক্ষা দিলে আমার যথেষ্ট হয়। ইহা শুনিয়া তাহারা কিছু কিছু প্রদান করিলেক। তাহারা অতি সরল স্বভাব, তাঁহার কুটিল ভাব অবগত হইতে পারিল না। কিছুদিন পরে তিনি সমুদয় তন্ডুলের সমষ্টি করয়া তাহার ১৫০০ টাকা মূল্য নিরুপণ করিলেন এবং এই অখণ্ড্য আজ্ঞা প্রচার করিয়া দিলেন যে প্রজাদিগকে বৎসর বৎসর এই ১৫০০ টাকা করিয়া প্রদান করিতে হইবেক। প্রথমে যাহা ভিক্ষা ছিল, পরে তাহা বার্ষিক হইল। কেমন প্রবঞ্চনা । কি অত্যাচার।’ আহা ব্রাহ্মণ। একে জমিদার তার উপর ব্রাহ্মণ । যেমন গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ এবং কুলীনব্রাহ্মণ, তিতুমীরের পরম শ্রেণীশত্রু যিনি জেলাশাসকের নির্দেশে পাইকবরকন্দাজ লেঠেললস্কর পাঠিয়ে ধর্ম্মোস্মত্ত মুসলমান তিতুমীরের দলকে জব্দ করতে অগ্রসর হয়েছিলেন, সৈন্যদের রসদ যুগিয়েছিলেন এবং যিনি সংস্কৃতির ধারকবাহকরূপে গোবরডাঙ্গায় বঙ্গসংস্কৃতির অর্পূব অত্যাশ্চর্য স্বাদশ শিবমন্দির সংবলিত আনন্দময়ীর বাটী নির্মাণ করে গিয়েছেন। ব্রাহ্মণত্ব ও ভূস্বামিত্বের সংমিশ্রণে কি বিস্ময়কর ঔদার্যের বিকাশ হতে পারে তা কেবল শিবমন্দির ও আনন্দময়ীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখতে দেখতে মনে হয়। আহা রাক্ষণ। সাক্ষাৎ শিবস্বরুপ ভূস্বামি । যেমন সম্প্রতি মাঙ্গনের বিষয়ে আর এক চমৎকার ব্যাপার শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলাম। কলিকাতার দক্ষিণাংশের কোন ভূস্বামী একদা কারারুদ্ধ হইলে তাহার কারাগৃহে থাকিবার ব্যয় নির্ব্বাহর্তে প্রজাদিগের নিকট এক মাথট হয়, তাহার নাম গারদ সেলামি । শুনিতে পাই অদ্যাবধি নাকি বৎসর বৎসর গারদ সেলামি আদায় হইয়া থাকে। গারদ সেলামির মতো কলকাতা শহরে বাইজিবারাঙ্গনাবিলাসের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে কোনো বাইজি সেলামি জমিদাররা আদায় করতেন। কিনা, তার উল্লেখ কোনো সাময়িকপত্রে নেই। আপাতত মাঙ্গন কাহিনী সমাপ্ত। যৎকিঞ্চিৎ অত্যাচারের কাহিনী। যেমন ভূস্বামি ও দারোগা এবং তাহাদের কর্মচারিরা প্রজাদিগের যে প্রকার শারীরিক দন্ড করে তাহা কলিকাতাবাসি অনেক লোক সবিশেষ অবগত নহেন। অতএব পশ্চাৎ কয়েক প্রকার কায়দণ্ডের বিবরণ করা যাইতেছে, যথাঃ ১। দন্ডাঘাট ও বেত্রাঘাত করে ২। চন্মপদিকা প্রহার করে ৩ বংশ। কাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন করিতে থাকে। ৪ । খাপরা দিয়া কর্ণ ও নাসিকা মদ্দন করে ৫। ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ করায় ৬। পৃষ্ঠভাগে বাহুদ্ধয় নত করিয়া বন্ধন করে এবং বন্ধন করিয়া বংশদণ্ডাদি দ্বারা মোড়া দিতে থাকে ৭। গাত্রে বিছুটি দেয় ৮। হস্তদ্বয় ও পাদম্বয় নিগড়বদ্ধ করিয়া রাখে ৯। কর্ণধারণ করিয়া ধাবন করায় ১০। কাঁটা দিয়া হস্ত দান করিতে থাকে ১১। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রৌদ্রে তিতুমীর—এগার পদধ্বয় অতি, বিষক্তি করিয়া ইস্টকোপরি ইষ্টকহস্তে দণ্ডায়মান করিয়া রাখে ১২। অত্যন্ত শীতের সময় জলমগ্ন করে ও গাত্রে জল নিক্ষেপ করে ১৩। গোণীবদ্ধ করিয়া জলমগ্ন করে ১৪। বৃক্ষে বা অন্যত্র বন্ধন করিয়া লম্বমান করে ১৫। ভাদ্র ও আশ্বিমাসে ধানের গোলায় পরিয়া রাখে—(সে সময়ে গোলার অভ্যন্তর অত্যন্ত উষ্ণ হয় এবং ধন্য হইতে প্রচুর বাপ উঠিতে থাকে।) ১৬। চূণের ঘরে বন্ধ করিয়া রাখে ১৭। কারারুদ্ধ করিয়া উপবাসি রাখে, অথবা ধন্যের সহিত তণ্ডল মিশ্রিত করিয়া তাহাই এক সন্ধ্যা আহার করতে দেয় ১৮। গৃহমধ্যে বন্ধ করিয়া লঙ্কা মরীচের ধোঁয়া প্রদান করে।
যেমন সংপ্রতি কৃষ্ণনগর জেলার কোন ভূস্বামী ও তাঁহাদের কর্মচারিদিগের চরিত্র শ্রবণ করিয়া বিস্ময়পিন্ন হওয়া গেল। তাহারা প্রজাদের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি দূরে থাকুক, তাহারদিগের শরীরও আপনার অধিকারভুক্ত জ্ঞান করেন, এবং তদনুসারে তাহারদিগের কায়িক পরিশ্রমও আপনার ক্রীত বস্ত বোধ করিয়া তাহার উপর দাওয়া করেন। তাহারদের এই প্রকার অখন্ড্য অনুমতি আছে যে বিনা মূল্য বিনা বেতনে তাঁহারদিগকে গোপেরা দুগ্ধ দান করিবেন, মৎস্যোপজীবিরা মৎস্য প্রদান করিবেন, নাপিতে ক্ষৌর করিবেক, যানবাহকে বহন করিবেক চম্পাকারে চর্ম্মকারে চর্ম্মপাদকা প্রদান করিবেক, ইত্যাদি। সকলেই স্ব স্ব উপজীবেবাচিত অনুষ্ঠান দ্বারা তাহারদিগের সেবা করিবেক। ক্রীতদাসকেও এরুপ দাসত্ব করিতে হয় না। কৃষ্ণনগর জেলার (নদীয়া ভূস্বামীদের কথা, যাঁরা তিতুমীরের বিদ্রোহলভক্ত অস্বামী আপাত অত্যাচারপর্ৰ সমান্ত।
অতঃপর সাহেব নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ যৎসামান্য প্রদান করা কর্তব্য বলে মনে হয়। কারণ স্টর্ম, ডেভিসের মতো দোর্দন্ডপ্রতাম নীলকরেরা তিতুমীরের দলের শ্রেণীশত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এবং বারাসাত ও নদীয়ার জেলাশাসকদের প্রতিবেদন থেকে তার যথেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার গ্রাম্য জীবনের সাথে নীলচাষের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং বাংলার কৃষকদের সমুহ সর্বনাশের ক্ষেত্রে নীলকরদের দান অসামান্য ও অতুলনীয়। নীলচাষের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ছিল বঙ্গদেশ এবং ১৮১৯-২০ থেকে ১৮২৬-২৭ সালের মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে, নীল। থেকে কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুনাফা হয় প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা। পার্লিয়ামেন্টে প্রদত্ত হিসেব হলেও, এর মধ্যে প্রাইভেট মার্চেন্টদের মুনাফা ধরা হয়নি, যাঁরা সংখ্যায় যথেষ্ট ছিলেন। তাছাড়া এদেশীয় জমিদাররাও অনেকে নীলচাষে উৎসাহী হয়েছিলেন অর্থের লোভে এবং তাঁদের সংখ্যাও নগণ্য নয়। বাংলার সর্বত্র নীলকরদের প্রসার হলেও যশোহর, নদীয়া চব্বিশপরগনায় তিতুমীরের বিদ্রেহাঞ্চল ছিল নীলচাষের প্রধান এলাকা। নীলচাষীদের হাহাকার, যেমন আবদুল মতলেব মন্ডলদের এই অন্চলেই শোনা যেত সবচেয়ে বেশি ঃ হাখোদা ! তোর মনে এই ছিল ! এই রকম কত করছে থানার দারোগা ৭০০ টাকা ফুরণ করিয়া নিয়েছে সকল গাঁয় নীল বুনিয়ে দেবে, মেজেস্টরের নিকট দরখাস্ত করিলে লা মঞ্জুর, সারা বছর না খেয়ে মজুরি করে জমিগলি চাষ করিয়া রাখিয়াছি, আশমান পানি দিলিই ধান বুনবো তবে বালবাচচা সমেত খেয়ে জান বাঁচাবো। তাই নীল বনে নোব, চুক্তি ভঙ্গ বলে সকলেবেচে কিনে নীল, জমায় তিনচারগুণ বেশী করলো খোদার বান্দা ফাটকে মলো। আরো কত মরে তার ঠেকনা কি ? আয়েন্দা ভাত পানির দফা যায়। আলা এমন করে মারিস ক্যান ? তুই তো সকলই পারিস। একদিন কেন সব রাইয়ত গুষ্টি সমেত মেরে ফেলে সাহেবগারে সব দে না। মতলেব মণ্ডলদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তিতুমীর, খোদাতায়ালার মতো। নীলকরদের সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের সম্পর্ক ছিল প্রাণের সখার মতো। যেমন মফঃসলে যে সমস্ত খোদাবান্দা ধর্মাবতারেরা অসংখ্য প্রজার ধন প্রাণের উপর কর্তৃত্ব করিতেছেন, এবং যাঁহারা বিচারক নামে বিখ্যাত, তাঁহার প্রায় তাবতেই নীলকরের বাধ্য, জিলার অবস্থা দর্শন অথবা শিকারে গমন করিলে নীলকুঠিতেই ভোজন শয়ন ও নীলকর সাহেবদিগের কন্যাপত্র ও প্রেয়সীর সহিত আমোদ প্রমোদ ও নীলকরের হন্তিতেই আরোহণ পূর্বক বাঘ, হরিণ, মহিষ ও শকরাদি হনন করিয়া থাকেন। নীলকর সাহেব ও ইংরেজ জেলাশাসক সকলেই এক সানকির ইয়ার কোন মতে ছাড়াছাড়ি হইবার জো টি নাই। অতএব কয়েক জিলায় কয়েকজন জাইন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হইলেন তথাচ অত্যাচারের কিছুমাত্র খর্বতা হইল না ইহার তাৎপর্য এক সাদা বর্ণের সর্বনাশ করিয়াছে, সাহেবরা ম্যাজিস্ট্রেট হইলে কি হইবে, ঝাঁকের পায়রা ঝাঁকে মিশিয়া যান। তাহার উপর আবার শাদা মুল্লুক জাদা। নীলকর স্টর্ম ও ডেভিস সাহেবের সঙ্গে আলেকজান্ডার ও স্মিথের গভীর বন্ধুত্বের কথা আমরা আগেই জেনেছি, তিতুমীরের দলের আক্রমণে একাধিকবার বারাসাত ও নদীয়ার জেলাশাসকরা নীলকরদের হাতির পিঠে চড়ে পলায়ন করেন। আলেকজান্ডার স্মিথ, কলভিন সকলেই তাঁদের চিঠিপত্রে ও রিপোর্টে বড়সাহেবদের কাছে এই নীলকরদের ভূয়সী প্রশংসা করেন তিতুমীরের বিদ্রোহ দমনে সহযোগিতার জন্য কলভিন তাঁর তদন্ত রিপোর্টে এই নীলকরদের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে বলেন যে সরকারের উচিত ক্ষতিপুরণ করা। টমাসন অবশ্য লিখিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ছাড়া আর্থিক ক্ষতিপূরণে সম্মত হননি।
জমিদার নীলকরাদি বাঘসিংহদের কথা বলা হল কিন্তু তাদের অধীন এদেশীয় মধ্যবিত্ত কর্মচারী কীটদের কথা, যথা নায়েব গোমস্তাদের কথা বলা হল না। জমিদাররা যেহেতু আমোদ-প্রমোব বিলাসে কলকাতা শহরে কালাতিপাত করতেন, তাঁদের নায়েব গোমাস্তরাই ছিলেন হর্তাকর্তা। কলকাতায় জমিদারদের জীবনযাত্রার বর্ণনা স্বগত হুতোম কিঞ্চিৎ দিয়েছেন, যেমন দুকুরব্যালা ফেটিং গাড়ি চড়া, পাঁচালি বা চণ্ডীর গানের পেলেদের মতন চেহারা, মাথায় ক্ষেপের চাদর জড়ানো, জন দশ বারো মোসাহের সঙ্গে, বাইজানের ভেড়ুয়ার মত পোশাক, গলায় মুক্তার মালা-দেখলেই চেনা যায় যে ইনি একজন বনগাঁর শেয়াল রাজা, বুদ্ধিতে কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ, বিদ্যায় মূর্তিমান মা বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত। মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারী ও মহাজনের ডিফ্রীর দরুন গা ঢাকা দেন। অথবা:কেউ কাশীপুর, বোড়স্যা, ভবানীপুর ও কালীঘাটে বাসা করে, চব্বিশ ঘন্টা সোনাগাজীতেই কাটান, লোকের বাড়ি চড়ােয়া হয়ে দাঙ্গা করেন, তার পরদিন প্রিয়তমার হাত ধরে যুগলবেশে জ্যাঠা খুড়া বাবার সঙ্গে পুলিসে হাজির হন, ধারে হাতী কেনেন এবং তাঁদের দালালবাবর গাড়ির যোগাড় করা, খ্যামটা নাচের বায়না করা প্রভৃতি রকমওয়ারি কাজের ভার পান ও পলিটীকেল এজেন্টের কাজ করেন। ওদিকে গ্রামের জমিদারীতে মায়েব গোমস্তারা পলিটিকাল এজেন্টের কাজ করেন, যেমন কৃষ্ণদেব রায় যখন কলকাতায় ছিলেন তখন তাঁর নায়েব রামধন সরকার তিতুমীরে দলের খবরাখবরের জন্য পেয়াদা পাঠান, থানার দারোগার কাছে একটার পর একটা মিথ্যা অভিযোগ করে তাদের নানাভাবে নাজেহাল করতে থাকেন। এই ব্যাঘ্রসম নিষ্ঠুর স্বভাব নিতান্ত নির্মায়িক জমিদারদের কর্মচারী নায়েব গোমস্তাদের চরিত বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ভস্বামীর নিরপিত ভাগ আহরণের পূর্বেই আপনাপন ভাগ গ্রহণ করে এবং সূচ্যগ্রবৎ সূক্ষ্মছল পাইলেই প্রজার ধন হরণ করতে থাকে। বনচর ব্যাঘ্র বরাহ তাহাদের অপেক্ষায় কত অনিষ্ট করিতে পারে ? কেবল নায়ের গোমস্তরা নন, – ভূস্বামীর সংসার সংক্রান্ত কোন ক্ষুদ্র কর্মে। যিনি নিযুক্ত থাকেন তাহার প্রভাবের আর পরিসীমা থাকে না, বাজার-সরকারও রাজার তুল্য প্রভুত্ব ও পরাক্রম প্রকাশ করে। পাইক-বরকন্দাজরীও। তাছাড়া দারোগা ও তৎসংক্রান্ত কর্মচারীদের প্রসিদ্ধ দুর্ব্যবহার স্মরণ করিলে হৃদয়ের, শোণিত শক্ত হইতে থাকে। এবং দারোগার দীর্ঘোদর, পুরণাথের প্রজাদের নানারকমের নির্যাতন ভোগ করতে হয়। মহাজনরা তো আছেই এবং মহাজন সংজ্ঞক বিষদ বৈদ্যের হস্তে পতিত হইলে নিষ্কৃতির পথ এককালে রুদ্ধ হয়। জমিদার, নীলকর, নায়েব, গোমস্তা, সরকার পাইক বরকন্দাজ দারোগা, পলিস মহাজন নিয়ে গ্রাম্যসমাজের যে সর্বগ্রাসী শোষকউপশোষকশ্রেণী, ব্রিটিশ শাসকদের রাজদন্ডাশ্রিত, সেই শ্রেণীর বিরদ্ধেই তিতুমীরের বিদ্রোহ ও সংগ্রাম শোষক ও উপ-শোষকদের মধ্যে শতকরা পচানব্বই জন হিন্দু হয় এবং শোষিত কৃষক কারিগরদের মধ্যে যদিশতকরা নব্বইজন মুসলমান হয়, কোনো বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে, তাহেলে অবশ্যই পরিসংখ্যানতত্তের নিয়মান সারে, সেখানকার শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের সংগ্রামকে হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানের সংগ্রাম বলা যায়, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বলা যায়, যা অনেক পন্ডিত বলেছেন তিতুমীরের বিদ্রোহ সম্পর্কে। যদিও তিতুমীরের বিদ্রোহ যে কৃষকবিদ্রোহ এবং তাঁর সংগ্রাম যে সেকালের শ্রেণীসংগ্রাম তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তিতুমীরের ধর্ম যে একটা ছিল এবং তিনি রীতিমতো গোঁড় মুসলমান ছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যদিও সেই ধর্মগোঁড়ামি ছিল অন্যরকমের। যেরকমেরই হোক, বিদ্যালংকার তাঁকে ধর্মোন্মত্ত মুসলমান বলে বিশেষ ভুল করেননি। কিন্তু তিতুমীরের এই ধর্মীয় উন্মত্ততার স্বরপ কী? সাধারণ মোল্লামৌলবীদের উন্মত্ততার সঙ্গে তার একটা পার্থক্য ছিল এবং গভীর পার্থক্য। কিসের পার্থক্য ? তিতুমীর ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদের অনুগামী ওয়াহবী আদর্শপন্থী। ওয়াহিবইজম বা ওয়াহিযবাদ কী? ইসলামের মধ্যে এমন একটি ধর্মগোষ্ঠী যাঁরা নিজেদের মহম্মদের আদেশ ও উক্তির অকৃত্ৰিম ধারকবাহক মনে করতেন, ইসলামীয় আদর্শের কঠোর শুদ্ধাচারে বিশ্বাস করতেন এবং যাঁরা তা করতেন না (মুসলমান হলেও) তাঁদের বিধর্মী, কাফেরের মতো শত্রু ভাবতেন, তাঁদেরই ওয়াহাবীপন্থী বলা হতো। ইসলামের ইতিহাসে এরকম উগ্র শুদ্ধাচারপন্থী ধর্মগোষ্ঠীর উদ্ভব আরবঃদশে ওয়াহাবীদের আগেও হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের একজন বিখ্যাত পন্ডিত (সৈয়দ আমীর আলী। ওয়াহবীদের ভূমিকা সম্বন্ধে বলেছেনঃ However commendable their revolt against the anthropolatrous usages in vogue among the modrn Moslems, their views of religion and divine government..are intensely morose and Calvinistic, and in absolute conflict with progress and development. … ওয়াহবীদের সম্বন্ধে এই উক্তি একদিক থেকে মিথ্যা নয়, অন্যদিক থেকে অর্ধসত্য। খৃস্টধর্মের ইতিহাসে প্রােটেস্টান্টিজম-এর – যদি কোনোপ্রগতিশীল ভূমিকা থাকে, এবং আছে বলেই পন্ডিতেরা স্বীকার করেন যদিও অ্যানা-ব্যাপাটিস্ট কোয়েকার ক্যালভিনিস্ট প্রভৃতি। প্রভৃতি বহু, গোষ্ঠীতে তা বিভক্ত ছিল, তাহলে ইসলামের ইতিহাসে প্রটেস্ট্যান্ট ওয়াহবী ও অনুরুপ ধর্মগোষ্ঠীরও একটা প্রগতিশীল ভূমিকা আছে। এমন কি একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না বোধহয় যে হিন্দুধর্মের ইতিহাসে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের অথবা উনিশ শতকে রামমোহনের অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মধর্মের যদি কোনপ্রকার প্রগতিশীল ভূমিকা থাকে তাহলে সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তিতুমীর (রামমোহনের সমসাময়িক) অনুসৃত ওয়াহবীবাদেরও অনুরূপ ভূমিকা আছে ইসলামের ইতিহাসে। অন্তত আমাদের দেশ ভরতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অতএব সামাজিক ক্ষেত্রেও।
আসলে কিন্তু আরবদেশের আবদুল ওয়াহব নন, আমাদের দেশের – শাহ ওয়ালিআল্লা ২১৭০৩-৬২ ইসলামের এই ধর্মসংস্কার আন্দো- লনের প্রবর্তক। ওয়ালি-আল্লা ও ওয়াহব সমসাময়িক সংস্কারক _ ছিলেন এবং ওয়ালি-আল্লা হয়ত হিজাজে শাস্রাধ্যয়নকালে ওয়াহবের – ধর্মগুরুদের কাছ থেকেই শিক্ষালাভ করেছিলেন, কিন্তু এমন কোনো সঠিক প্রমাণ নেই যে তাঁরা কেউ কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওয়াহবের মতো ওয়ালি-আল্লাও প্রায় একই ধর্মমত পোষণ করতেন। এবং উভয়েই ধর্মাদর্শের দিক থেকে ফান্ডামেন্টালিস্ট অর্থাৎ অকৃত্রিম মূলধর্মাবলম্বী ছিলেন। উভয়েই ইসলাধর্মের মনোরম বাগিচা থেকে সমস্ত আগাছা, পরগাছা, জঞ্জাল, আবর্জনা নির্মমভাবে নির্মল করার পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন ওয়াহবের মতো ওয়ালিআল্লার ঘোর একেশ্ববরবাদী ছিলেন এবং শিরক বা বহুদেবতাবাদের সঙ্গে কোনো প্রকারে সংস্পর্শ সর্বতোভাবে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় মনে করতেন। ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী কোনো পীরপয়গম্বরাদি কেউ নেই, যেমন হিন্দুদের বহুদেবতার সঙ্গে আছে বহু অবতার, পুরোহিত ইত্যাদি। অতএব পীর, পয়গম্বর, গাজী, ফকির প্রতি পূজা অথবা মহরম ফয়তা ইত্যাদি উৎসব বা ধর্মাচার পালন ইসলামধর্মের পরিপন্থী। ঈশ্বর ঈশ্বর, মানুষ মানুষ, মধ্যবর্তী স্তরে আর কিছু নেই। ইসলামাধর্মের এইটাই মুলকথা। মোগল রাজশক্তির পতনের পর এবং ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতিষ্ঠার পর যখন ভারতের মুসলমানসমাজের সর্বাতক সংকট ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ অর্থনীতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠল যখন দেখা গেল যে মুসলমানরা কেবল পীরপয়গম্বর ফকির গাজীর পূজা নয় ওলাবিব থেকে সত্যপীর-মাণিকপীরের পর্যন্ত পূজা করছে অসংখ্যা পরীস্থান দরগা ইত্যাদি গজিয়ে উঠছে, যখন দেখা গেল যে রাষ্ট্রীয় শক্তি হাতছাড়া হবার, ফলে মুসলমানরা সর্বক্ষেএে অবহেলিত অপমানিত ও নতুন ইংরেজরাজের শত্রু বলে বিবেচিত হচ্ছে অথচ মহরম, ফয়তা ইত্যাদি উৎসব অনুষ্ঠান চলছে তখন ভারতীয় ওয়ালিআল্লা অথবা আরবের ওয়াবের মৌল ইসলামধর্মে প্রত্যাবর্তনের অাহ্বান এবং বিধর্মী কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের আওয়াজ, ভারতের ঐতিহাসিক পরিবেশে অবশ্যই প্রগতিশীল ছিল, কারণ তার বাহ্য ধর্মীয় পোশাকের অন্তরালে ছিল ইংরেজরাজের বিরুদ্ধে এবং তাদের রাজছত্রাশ্রিত উপশাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে (প্রধানত হিন্দু,) বিদ্রোহের আহ্বানকাজেই ওযালি-অনাবাদ অথবা ওয়হবিবাদের যে তৎকালে একটা প্রগতিশীল ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল তা কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। করা যায় না বলে কিছু নেই অবশ্য, সবই করা যায়, দিনকে রাত এবং রাতকে দিন, বানরকে নর এবং নরকে বানর, সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য, কিন্তু করলে তাতে ফায়দা কিছু হবে না, কেবল মিথ্যার গোলকধাঁধ ঘুরে মরতে হবে শেষ পর্যন্ত।
ওয়ালি-আল্লার সুযোগ্য পুত্র শাহ আজিজ পিতার ধর্মাদর্শের উত্তরাধিকারী হন এবং সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদের ধর্মান্দোলন মুজাহিদীন (ধর্মযোদ্ধা) নামে খ্যাত, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভলক্রমে এই অন্দোলনকে ওয়াহবী বলে চিহ্নিত করেছেন ঃ A remarkable disciple of Aziz was Sayyid Ahmad Brelwi, whose movement is generally known as that of the Mujahidin (holy warriors) and is erroneously described in the British Indian Government Records as Wahhabi. (Aziz Ahmad). মুখ্যত শিখদের বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয়ত ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সৈয়দের ধর্মযুদ্ধ। এই আন্দোলনই হল ওয়ালি-আল্লার মৌল ইসলাম ধর্মে প্রত্যাবর্তনের প্রথম প্রত্যক্ষ সক্রিয় আন্দোলন এবং তাঁর ধর্ম সংস্কারের আদর্শকে কর্মক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করার প্রথম প্রচেষ্টা। এই ধর্ম যোদ্ধারা একেবরবাদের আদর্শের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। আন্দোলনের ফলে ক্ৰমে এদের মধ্যে জুম্মা বা ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠনের (রিলিজিও-পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন) বিকাশ হতে থাকে এবং দেশব্যাপী প্রচারের জন্য নানাস্থানে কেন্দ্র বা ঘাঁটি স্থাপিত হয়। গ্রাম হয় সংগঠনের মূল কেন্দ্র। ভারতে ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে এটাই হল প্রথম ব্যাপক গণসংগ্রামের বা গণআন্দোলনের প্রচেষ্টা। “It was the first agitation in the history of Indian Islam to become a popular mass movement.Aziz Ahmad). বাংলাদেশে শরিয়ৎ-আলা (১৭৬৪-১৮৪০) ও তাঁর পুত্র দদ মিয়ার গণআন্দোলনের সঙ্গে (ফরিদপুর জেলায়) সৈয়দ আহমদ শহীদের মজাহিদীন আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই, শাং শরিয়ৎ বা দুদু মিয়ার আন্দোলনে খানিকটা ওয়াহাবীবাদের প্রভাব ছিল বলা যায়। কিন্তু তিতুমীরের আন্দোলন ছিল ওয়াল সালা, আজিজ ও সৈয়দ আহমদ শহীদের মুজাহিদীন আন্দোলনের ধারনগমী এবং সেই জন্য সেই আন্দোলন ছিল অনেক বেশি। মিলিট্যান্ট বা সংগ্রামমুখী। Wahhabi movement ..Possibly bearing some influence of the babi movement of Nejd was the Faraidi s movement of Bengal led by Hajji Shoriat-Allah (1764-1830)..and his son Muhsin known popularly as Dhudhu Miyan.. A similar fundamentalis peasant movement in Bengal, led by Titu Mir was connected with that of the Mujahidin and not with the Faraidis. Its programme was more militant…. (Aziz Ahmad). ভারতের ওয়ালি-আল্লা, আজিজ, সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং আরবের অবদল ওয়াহবের ধর্মদর্শের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্যের চলচেরা বিশ্লেষণ করা আপাতত অমাদের উদ্দেশ্য নয়। ফান্ডামেন্টালিস্ট। অন্দোলন হিসেবে ওয়ালি-আল্পর সঙ্গে ওয়াহবের ধর্মদশের সাদশ্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তিতুমীরের ধর্মান্দোলন প্রসঙ্গে উল্লেখ্য হল এই যে তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদের মিলি ট্যাণ্ট ধর্মাদশের অনুগামী এবং কেবল তাই নয়, এই আন্দোলনের . গ্রামভিত্তিক সংগঠন এবং তার ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপায়ণে বিশ্বাসী। এই প্রসঙ্গে পরবর্তী প্রশ্ন হল, ইসলামের মৌল আদশের পুনরুদ্ধার শুধ, কি কতকগুলি উৎসব, আচার-অনুষ্ঠানের সংস্কার স,ধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ? অথবা ইসলামের সামাজিক আদর্শের – বিকতি ও অবনতির বিরুদ্ধে সংগ্রামও তার লক্ষ্য ! ইসলামের মৌল সামাজিক আদর্শ কী? শাসক-প্রজা, ধনী-নির্ধন, প্রভ-ভত্য প্রভৃতি সকল প্রকারে বিভেদ-বৈষম্য বর্জন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সাম্য-সম্প্রীতির সম্পর্ককে শ্রেষ্ঠ সত্য বলে স্বীকার করা। যিনি তা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত তিনি ইসলামধর্মী মুসলমান বলে অভিহিত হবার অযোগ্য এবং মুসলমান হলেও বিধর্মী কাফেরের মতো অবজ্ঞাভরে পরিত্যাজ্য ঃIslam recognises no distinction of race or colour; black or white citizene or soldiers rulers or subjects, they are perfectly equal not in theory only, but in practice. In the field or in the guest-chamber, in the tent or the palace in the mosque or in the market they mix without reserve or without contempt. The fist Muezzin of Islam, a devoted adherent and an esteemed disciple, was o negro slave. The whole tenor of Mohammeds teaching made permanent chattlehood or caste impossible; and it is simply an abuse of words to apply the ward slavery in the English sense to any status known to the legislation of Islam.Syed Ameer Ali. . এই যদি ইসলামের আদি অকৃত্ৰিম আদর্শ হয় এবং তিতুমীর যদি সেই নিষ্কলঙ্ক আদর্শের প্রচারক হন, তাহলে ধমোন্মত্ত তিতুমীরের ধর্মান্দোলন খুব স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক সাম্যের সংগ্রামের পথে পরিচালিত হতে পারে। অন্তত পরিচালিত হবার পথে কোনো বাধা নেই। কারণ নানা রকমের পৌত্তলিক অথবা বহুদেবতাবিশ্বাসী আচার-অনুষ্ঠানের মতো মুসলমান সমাজে জাতিভেদ, ধনীর্নিধন ভেদ, কুসীদ মুনাফালোভ ইত্যাদির অনুপ্রবেশের চেয়ে চরম নিন্দনীয় কাফেরী অার কি হতে পারে তা ভাবা যায় না। যে ধনিক মুসলমান দরিদ্রদের শোষণ করেন, নির্যাতন করেন, যে মুসলমান কুসীদজিবি ও মুনাফালোভী যে মুসলমান বংশ গৌরবের মহিমায় বর্ণবৈষম্যনীতির সমর্থক, তারা মুসলমান হলেও ভিন্নধর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি নিকৃষ্ট শ্রেণীর কাফের নন কি! অন্তত ইসলামের আদর্শের দিক থেকে বিচার করলে (যে আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প তিতুমীর গ্রহণ করেছিলেন) তাঁরা কাফের এবং তিতুমীরের ধর্মসংস্কার সংগ্রাম তাই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাফেরদের বিরুদ্ধে সামাজিক গণসংগ্রামের রূপ ধারণ করেছিল। সেই কারণে তিতুর সংগ্রামে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব প্রকাশের জন্য কোনো ধনিক মুসলমান কেউ যোগদান করেননি, এমন কি তাঁর নিকট আত্মীয় মুনশী উমীর পর্যন্ত না । সেকথা কলভিন তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন। সংগ্রাম যে মিলিট্যান্ট সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল, তার পর্যাপ্ত প্রমাণ পূর্বোক্ত সরকারী দলিলপত্রে পাওয়া যায়। একথা ঠিক যে তিতুমীর একটা স্বর্গীয় সাম্যরাজ প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী সংগ্রামদের, হয়তো তিনি বলেছিলেন যে বিদ্রোহ সফল হলে এই হিন্দু-মুসলমান কাফেরদের সমাজের নরকযন্ত্রণা আর ভোগ করতে হবে না, আর বেহেশত স্থাপিত হবে, যেখানে কোনো রকমের সামাজিক ভেদাভেদ, বৈষম্য, অসম্য, শোষণ, নির্যাতন ইত্যাদি থাকবে না এবং খোদার আকাক্ষিত ধর্মরাজ্য গড়ে উঠবে। কিন্তু একথাও ঠিক এবং তা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে তিতুমীরের কালে প্রাকরাজনৈতিক যুগে (প্রিপলিটিক্যাল এজ) অধিকাংশ গণবিদ্রোহ ও কৃষক বিদ্রোহের এই ধরনের একটা মিলিয়েনারিয়ান রূপ ছিল, যার জন্য ধর্মরাজ্য স্থাপনের একটা ‘জিগীর’ এই সমস্ত বিদ্রোহের নায়কদের কণ্ঠে ধনিত হতো, এমন কি অনেকে সাক্ষাৎ ভগবানের রূপ ধারণ করতেন, যেমন ভগবান বিরশামুন্ডা অথবা সাঁওতাল বিদ্রোহে সিদো কানহু চাঁদু ভৈরবেরা্ করেছিলেন। কিন্তু এই ধরনের ধর্মরাজেরজিগীর ধ্বনিত (মিলিয়েনারিয়ান) । গণবিদ্রোহের প্রকৃত ঐতিহাসিক চরিত্র হল বৈপ্লবিক (রিভিউলশনারী), সংস্কারমুখী (রিফমিস্ট)) নয়। উনিশ শতকে ইয়োরোপের একাধিক কৃষক বিদ্রোহ, বিদ্রোহের নায়ক, দস্যু ও দস্যুবৃত্তির (ব্যানডিষ্ট্রি ইতিহাস পর্যালোচনা করে হবসবমও (ই জে হবসবমও ) সেই কথা বলেছেনঃ
“The various millenarian movements with which I deal.. differ from banditry and Mafia because they are revolutionary and not reformist….’
উনিশ শতকে প্রাকরাজনৈতিক যুগে ভারতের কৃষক বিদ্রোহ গুলির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই ঐতিহাসিক সত্য হবসবম এর কাছে আরো স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হতো, কারণ ইউরোপ ও ভারতের সামাজিক-অর্থ নৈতিক পরিবেশের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
তিতুমীরকে কেবল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদরূপে চিত্রিত করলে তাঁর বিদ্রোহ ও সংগ্রামের চরিত্রকে বিকৃত করা হয়। মুখ্যত এই সংগ্রাম ছিল জমিদার-নীলকর-মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অর্থাৎ জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সমাজের শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম এর ইংরেজ শাসকরা এই শোষক শ্রেণীর জনক ও বলে স্বভাবতই তা ইংরেজ শাসকবিরোধী সংগ্রাম হতে বাধ্য। একথা যদি সত্যি হয় যে
“The history of all hitherto existing society of the history of class-struggles .
তাহলে আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক চেতনা প্রলেটারিয়েটের শ্রেণীসংগ্রামের পূর্বেকার কালে শ্রেণীবেশিষ্ট্য স্বাতন্ত্র্য দূর্বলতা ও দোষত্রুটি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে,আমাদের মতো অনুন্নত কৃষক প্রধান সমাজে, তিতুমীরের সংগ্রাম তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কলভিন তদন্ত করে তাঁর রিপোর্টে পরিষ্কার ভাষায় লিখেছিলেন যে ‘নো ওয়ান উইথ এনিথিং টু লস’ তিতুমীরের দলভুক্ত ছিলেন। তিতুমীর যখন সংগ্রাম করেছিলেন এবং ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কলভিন যখন তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন, ১৮৩১ সালে, তার সতের বছর পরে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮) প্রকাশিত হয়েছিল। তা হলেও কলভিনের নো ওয়ান উইথ এনিথিং টু লস’ উক্তির সঙ্গে ম্যানিফেস্টোর ‘বাট দেয়ার চেইনস’ কথাটি যোগ করে দিলে তিতুমীরের দলভুক্ত হাজার হাজার বিদ্রোহী মুজাহিদীনদের শ্রেণীরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা হল বারাসাত-বশিরহাট ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের সর্বস্বান্ত দরিদ্র চাষী, প্রধানত মুসলমান। ১৯৭৩ সালেও, অর্থাৎ ১৪২ বছর পরেও, তাদের বংশধরদের চেনা যায়। বংশধরদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তার সঙ্গে দারিদ্রও বেড়েছে। তিতুমীর নেই। তিতুমীরের সংগ্রাম স্বল্পকালস্থায়ী হলেও, তার তাৎপর্য নানাদিক থেকে দীর্ঘস্থায়ী বা সংগ্রামের নায়ক হিসাবে বিদ্রোহীদের সংগঠনের দক্ষতাও ছিল তাঁর অসাধারণ। সরকারী রিপোর্টে, নারকেলবেড়িয়ায় সুসংহত জমাতের বর্ণনায়, তা একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছে। বিদ্রোহীদের সংগ্রাম পারদর্শিতাও সরকারী দলিলপত্রে স্বীকৃত। হাতি-ঘোড়া-বজরা, সেপাই-বরকন্দাজ-বন্দুক নিয়ে নীলকর ও জেলা শাসকরা একাধিকবার তিতুমীরের মুজাহিদীনদের দ্বারা তাড়িত হয়ে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেছেন এবং সেই পলায়নের রোমাঞ্চকর কাহিনী বর্ণনাকালে বিদ্রোহীদের বীরত্ব, সাহস ও রণদক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন। বেন্টিঙ্কের শাসনকাল। সতীদাহ নিবরাণ আইন পাস করে তিনি তখন মহানুভব উদার শাসকের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত। সেই কথা উল্লেখ করে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের কেউ মনে হয় মার্শম্যান ছদ্মনামে
(A Proprietor of East India Stock Serampore, Nov, 1831) India Gazette
পত্রিকায় একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। (২৫শে নভেম্বর ১৮৩১ তারিখে প্রকাশিত ব্যারাসেত ইনসাররাকশন নামে)। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে, নির্মম ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে পাদ্রি সাহেবের এই পত্ৰক্ষেপ করার কারণ হল, তিনি কল্পনা করতে পারেন না । কেমন করে
within half an hour’s ride of the country residenc of the Supreme Governor of British India
একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত ( আর্মড রাফিয়ান্স ) এতবড় একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেলতে পারে, যার ফলে স্থানীয় শাসকদের পর্যন্ত হৃৎকল্প হয়
( for some time a successful rebellion in the very heart of the empire ) যাই হোক, রাগের মাথায় পাদ্রি সাহেব কয়েকটি অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করে ফেলেছেন তাঁর চিঠিতে। যেমন তিতুমীর ও তাঁর সহযোদ্ধরা মুক্তাশ্চলের মতো একটা এলাকা গড়ে তুলে কিভাবে নিজেরা তার শাসক হয়ে কাজকর্ম চালাচ্ছিলেন, তার উল্লেখ চিঠিতে আছে পাদ্রি সাহেব চিঠিতে লিখেছেন :
Sheik Teetoo begains by plundering a considerable portion of two districts which he modestly calls his collection of the land revenue; and assuming the title of Commissioner, he actually sets about organizing something of regular form of civil government. I am credibly informed Sir, that for some days Sheik Teetoo held his cuacherry with a regularity..which some of the Company’s functionaries might do well to imitate.
শেখ তিতু প্রথমে দুটি জেলা জুড়ে (নদীয়া, চব্বিশ পরগনা) লুটতরাজ আরম্ভ করে এবং বলে যে এটা নাকি তার রাজত্ব আদায়ের ব্যাপার। তারপর বিভাগীয় কমিশনারের মতো, (অথবা বাদশাহ ও বলা যেতে পারে) সে নিয়মিত আঞ্চলিক শাসনের কাজকর্মও আরম্ভ করে দেয়। বিশ্বসূত্রে জেনেছি যে এমন সুশৃঙ্খলভাবে সে তার কাছারিতে এই শাসনসংক্রান্ত কাজকর্ম করে যা কোম্পানির অধীন শাসক ও কর্মচারীরা স্বচ্ছন্দে অনুকরণ করতে পারেন।
শাসনকার্যে পারদিশত্য সম্বন্ধে এই প্রশংসা জানি না তিতুমীরের এবং তাঁর সহকর্মীদের ন্যায্যপ্রাপ্য কিনা, তবে খানিকটা যে প্রাপ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা, এবং অন্যান্য মিশনরিরাও, বাংলার গ্রামাঞ্চলের ভিতরের খবরাখবর অনেক ক্ষেত্রে জেলা শাসকদের চেয়ে বেশি রাখতেন কাজেই শ্রীরামপুরের ছদ্মবেশী পত্ৰলেখক এখানে শুধু ইংরেজ শাসকদের অপদার্থতার বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশ করেননি, খানিকটা সত্য ঘটনাও প্রকাশ করেছেন। তিতুমীরের প্রভাব এবং গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক গণসমর্থনের কথা জেলা শাসকরা অর্থাৎ আলেকজান্ডার ও স্মিথ তাঁদের চিঠিপত্রে প্রসঙ্গত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র, কিন্তু সেটা যে গণসংগ্রামের বেস এরিয়া হিসেবে যথেষ্ট বিস্তৃত ও সংগঠিত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমীরের সশস্ত্র জমাতের সংগ্রাম ব্যর্থ হল এবং বাঁশের কেল্লা ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
সংগ্রাম বা প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের কলাকৌশল সম্বন্ধে বলা যায় যে তিতুমীর নিজে একজন অত্যন্ত সুদক্ষ সাহসী বীর যোদ্ধা ছিলেন, কেবল আল্লার কুদরৎ তাঁর সম্বল ছিল না অর্থাৎ কেবল ধর্মীয় ম্যাজিকের জোরে তিনি তার গণসংগ্রামের নায়কত্ব করেননি। গেলন্দাজ ম্যাকানকে গুলি করে খতম করেন তিতুমীর নিজে এবং জেলা শাসক আলেকজান্ডারের কানের পাশ দিয়ে যে গুলিটা বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে যায় সেটাও তিতু নিজে লক্ষ্য করে ছুড়েছিলেন। কেবল লাঠিসড়কি-তলোয়ার প্রভৃতি দেশীয় হাতিয়ার নয় শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কয়েকটা কামান-বন্দুকের সুদক্ষ ব্যবহারও তিনি নিজে শিখেছিলেন এবং তাঁর শাগরেদদেরও শিখিয়েছিলেন। নদীয়ার জেলা শাসক স্মিথ বনগাঁর মিলিটারি কম্যান্ডারকে লিখিত একটি পত্রে (ফৌজদারী আদালত, নদীয়া ১৯ নভেম্বর, ১৮৩১) এ বিষয়ে যা লিখেছেন তা লক্ষণীয়ঃ
What their arms are beyond an immense long lathe (stick) and some swords, I cannot say but report stoted them to be in possession of some muskets..besides various native weapons of offence used by Dakyts and Robbers, and certainly they appeard very expert in the use of the arms they had. The information we gathered from spies and others.. and had we not been misled by some of their party, who came in disguise, pretending to be our friends..
কেবল অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতা নয় (যার জন্য রীতিমতো ট্রেনিং দেওয়ার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা ছিল), তিতুমীর তাঁর শত্রুপক্ষের গোয়েন্দাদের মতো নিজেদের গোয়েন্দার দল গঠন করেছিলেন এবং তারা ছদ্মবেশে বন্ধু সেজে একাধিকবার শত্রুদের ভুল খবরাখবর দিয়ে ফাঁদে ফেলেছে। মনে হয় না কোনোদিক থেকে তিতুমীরের নামের সংগঠনের কোনো গলতি ছিল। নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় তিতুমীর ও তার সহযোদ্ধাদের চূড়ান্ত অভূতপূর্ব মনে হয়। পাদ্রি সাহেব তাঁর চিঠিতে লিখেছেনঃ
“Sheik Teetoo. .fell with his arms in his hand fter having resisted for about an hour and a half a large and well-appointed military force.
হিন্দু জমিদারদের এবং তাঁদের নায়েব গোমস্তা-দালালদের প্ররোচণায় দাড়ি-গরু-মসজিদ-মন্দির-মোলা-পুরুতাদি ধর্মীয় প্রতিকী সংঘাতের ভিতর দিয়ে যে লড়াইয়ের সুত্রপাত, তাকে একটি ব্যাপক গণসংগ্রামে পরিণত করেছিলেন তিতুমীর এবং বীর নায়কের মতো শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত নিজে লড়াই করতে করতে তিনি নিহত হয়েছিলেন। কামান-বন্দুকাদি আগ্মেয়াস্তে সুসজ্জিত গোরা সৈন্যের সঙ্গে প্রধানত দেশীয় অস্ত্রের উপর ভরসা করে দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে, বাঁশঝাড় আর সাধারণ গাছপালা বেষ্টিত বাঁশের কেল্লায় দেড় ঘন্টা ধরে মুখোমুখি লড়াই করা যে কোনো সামরিক নীতির দিক থেকে বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু সশস্ত্র গণসংগ্রাম বা গণপ্রতিরোধের ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল নয়, আমাদের দেশেও নয় অথবা অন্য কোনো দেশেও নয়, সেকালের প্রাক-রাজনৈতিক যুগেও নয়, একালের রাজনৈতিক যুগেও নয়। তৎসত্তেও তিতুমীরের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছিল, তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা বীরের মতো লড়াই করেও পরাজিত হয়েছিলেন এবং নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা আগ্নেয়াস্ত্রের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কেন ?
কেন তিতুমীরের বিদ্রোহ ও গণসংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছিল তার বিচার-বিশ্লেষণ তাঁরাই ভাল করতে পারবেন যাঁদের এ রকম সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। বিভিন্ন দেশে প্রাক-রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক যুগের কৃষক বিদ্রোহ ও গণসংগ্রামের ব্যর্থতা ও সাফল্যের লিখিত ইতিহাসের বিদ্যা থেকে তিতুমীরের ব্যর্থতার কারণ কয়েকটি আমরা নির্দেশ করতে পারি মাত্র। যেমন আমাদের মনে হয়ঃ
প্রথম কারণ, কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শোদবুদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার অভাব। তিতুমীরের কালে এরকম কোনো রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ হয়নি দেশের জনসাধারণের মধ্যে। যাঁদের মধ্যে হবার কথা অথবা সামান্য কিছু হয়েছিল, বাংলার নব্যধনিক ও মধ্যবিত্তরা, তারা তখন ইংরেজ শাসকদের কাছে নিজেদের অন্ধ রাজভক্তি ও গোলামির দাসখৎ লিখে দিয়ে, স্পেন বা ফ্রান্স বা অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সাফল্যে উৎল্লাস প্রকাশ করছেন, ভোজসভায় ইংরেজদের আপ্যায়ন করে। ব্রিটিশ পাদপদে, জাতীয় সত্তা ও ব্যক্তিসত্তার এরকম বিসদৃশ বিনমন আমাদের নবজাগরণের ইতিহাসে একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ১৮৩০-৩১ সালে তিতুমীরের বিদ্রোহ কলকাতা শহর থেকে হাফ এ্যান আউয়ারস রাইড-এর মধ্যে ঘটলেও এবং বৃটিশ শাসকদের মধ্যে যথেষ্ট কম্পন সৃষ্টি করলেও, এদেশীয় নব্যঅভিজাত ও নব্যশিক্ষিত রাজামহারাজা অথবা ভদ্রলোকদের মধ্যে সামান্য কৌতুহলেরও উদ্রেক করেনি, শিহরন তো পরের কথা। মহারাজারা ও বাবুরা তখন দুর্গাপূজায় পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধে বিবাহে অন্নপ্রাসনে ইংরেজ অতিথিদের আদর-আপ্যায়নের জন্য বাইজীনাচ (নাচ পার্টি) ও বিদেশী বাদ্য পরিবেশনে ব্যস্ত এবং তৎসহ মডারেট একব্রক্ষবাদীরা সতীদাহ নিবারণের জন্য বেন্টিংক অতিতে স্তূতিতে গদগদ, কনজারভেটিভ বহুদেবতবাদীরা সনাতন ধর্ম রক্ষায় সংঘবদ্ধ এবং অলট্রারেডিক্যাল ইয়ং বেঙ্গলরা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গোমাংসমদ্যসহযোগে অভিযানে অবতীর্ণ। চারিদিকে কেবল বাক্যের স্রোত,বাক্যের সংঘর্ষ, বাক্যের গজন এবং তৎসহ ইংরেজের পদলেহন। এমতাবস্থায় তিতুমীরের অথবা তার সহযাত্রী গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনার যথাযথ বিকাশের কথা অথবা শোষকশাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের সাফল্যের কথা চিন্তা করা যায় না।
দ্বিতীয় কারণ ধর্মভিত্তিক সামাজিক সাম্যাদশের আবেদন শোষিত শ্রেণীর কাছে যতই হৃদয়গ্রাহী হোক না কেন, তা প্রকৃত গণমুক্তি সংগ্রামের স্তরে কখনো উন্নতি হতে পারে না। সাধারণত তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক আন্দোলন হয় এবং সেই ব্যক্তির উপর ঐশী শক্তি ও মহিমা আরোপ করা হয়। অতএব এই ধরণের গণবিদ্রোহের নায়করা প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র থেকে অপসারিত হলে, বিদ্রোহীরা পিতৃহীন বালকদের মতো দিশাহারা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়া স্বাভাবিক।
তৃতীয় কারণ রাজনীতিবর্জিত অর্থনৈতিক সংগ্রাম, অর্থাৎ কেবল অভাব-অভিযোগ প্রতিকারের সংগ্রাম কদাচ শ্রেণী সংগ্রামের অনুপ্রেরণার মূল উৎস হতে পারে না এবং সেই সংগ্রাম যত ব্যাপক গণসংগ্রামই হোক না কেন তা কখনো বৈপ্লবিক সংগ্রাম হতে পারে না, সংস্কারমুখী বা রিফর্মিস্ট সংগ্রাম হতে পারে মাত্র, এবং তা হলে পদে পদে বারবার তার ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য এরকম উন্নত রাজনৈতিক চেতনা, তিতুমীরের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যুক্তিসংগত নয়, যেহেতু তিতুমীরের বিদ্রোহের প্রায় দেড়শো বছর পরেও দেখা যায় আধুনিক রাজনৈতিক যুগে যাঁরা গণসংগ্রাম গণবিদ্রোহ গণআন্দোলন গণমুক্তি শ্রেণী সংগ্রাম বিপ্লব ইত্যাদির নামে সকাল সন্ধ্যায় শপথ করেন, শ্লোগান দেন, তারাও এই চেতনাবর্জিত। তবে তিতুমীরের সঙ্গে তাঁদের তফাৎ হল এই যে তিতুমীর অজ্ঞানে এই চেতনাবর্জিত, এবং আধুনিক গণদরদীরা সজ্ঞানে এই চেতনাবর্জিত। অর্থাৎ তিতুমীর অজ্ঞানদোষী, আধুনিক গণদরদীরা জ্ঞানপাপী।
চতুর্থ কারণ বারাসাত-বশিরহাট অঞ্চল থেকে বনগাঁ ও নদীয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যে ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ তাতে কোনো প্রকারের সশস্ত্র গণসংগ্রাম কখনো সফল হতে পারে না, যদি না সংগ্রামীদের বেস এরিয়া পার্শ্ববর্তী একাধিক জেলা জুড়ে বহুদর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় কলভিন-কথিত তিনশো বর্গমাইল কেন, হাজার বর্গমাইল এলাকায় ঘুরে বেড়ালেও দেখা যাবে কোথাও কিছু নেই, কেবল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ঘাস আম কাঁঠালাদি গাছপালা খাল নদী বাঁশঝাড় পাটক্ষেত ধানক্ষেত আর তার মধ্যে মধ্যে বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট গ্রাম, অতিদরিদ্র চাষীদের গ্রাম, সূর্যাস্ত থেকেই প্রায় নিষ্প্রদীপ ও নিঃষ্পন্দ এবং অকাবাঁকা মেঠোপথ, সামান্য বর্ষণে পিচ্ছিল ও দুর্গম। তিতুমীরের কালে যা ছিল, এখনো তাই আছে, কেবল গ্রাম ও লোকের সংখ্যা কিছু বেড়েছে আর মেরুদণ্ডের মতো একটি বাঁধানো মোটরপথ তৈরি হয়েছে, যাতে কোনো স্থানে কোনো কিছু গণ্ডগোল হলে এসপি অথবা সিআরপি তুরন্ত সেখানে জীপযোগে পৌছতে পারেন। এহেন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ালে মনে হয় কিসের ভরসায় তিতুমীর এখানে সশন্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন।না আছে কোথাও অরণ্যের চিহ্ন, না আছে পাহাড়, ইছামতী-যমুনাদি নদীও। যা আছে তাও এমন কিছু দূর্লঙ্ঘ্য নয় বর্ষাকালেও। এহেন ভৌগোলিক পরিবেশে গেরিলা কৌশলে সংগ্রাম কেনো সুযোগ নেই, পশ্চাদপসরণের অথবা আত্মগোপনের কোনো সুদূর সম্ভাবনা নেই, তথাপি নারকেলবেডিয়ায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করে শক্তিশালী শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি বা সম্মুখ লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে অটল থাকা নিশ্চয় তিতুমীরের দিক থেকে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এই ভুলটা ভুল ছাড়া কিছু নয়, এবং একথা মনে রাখতে হবে যে তিতুমীর আধুনিক রাজনৈতিক যুগের গণবিপ্লবের শ্রেষ্ঠ নায়ক মাও-সে তুঙ নন, এমন কি লাটিন আমেরিকার গুয়েভারাও নন।চাঁদপুর-হায়দারপুর-নারকেলবেড়িয়ার একজন কৃষক সন্তান মাত্র, যার মধ্যে প্রকৃত বিপ্লবীরু চারিত্রিক গুণের একটিরও অভাব ছিল না এবং যার আন্তরিকতা সততা নিষ্ঠা দৃঢ়তা সাহস ও বীরত্ব আধুনিক রাজনৈতিক যুগের বাক্যবিলাসী বিবাদীদের চাইতে অন্তত শতগুণ বেশি শ্রদ্ধার যোগ্য। শ্রীরামপুরের ক্রদ্ধ ক্ষিপ্ত পাদ্রি সাহেবের সেই চিঠির কথা মনে পড়ে, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় (২৫ নবেম্বর ১৮৩১) ..we are standing on a powder magazine. The spark may not come this year or the next; but whether it shall rise from Barasat or Balasore or Mysore or any other sore rise, we may assure ourselves, it will under the promising ezample of Sheik Teetoo—and that at no remote period.
ক্রোধরিপুর তাড়নায় পাদ্রি সাহেব ‘শেখ তিতু’ অর্থাৎ তিতুমীরকে যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অজ্ঞাতসারে এবং তাঁর কীর্তির সঠিক মূল্যায়নও করেছেন। ১৯৭৩ সালের ২৫ নবেম্বরেও আমরা তা অস্বীকার করব না, যদিও ১৮৩১ আর ১৯৭৩ সালের মধ্যে, ১৪২ বছরের ব্যবধান।
বাল্যকাল থেকে তিতুমীরের গল্প শুনেছি, বগীর হাঙ্গামার মতো তিতুমীরের হাঙ্গামার গল্প এবং সেই সমস্ত গল্প গোগ্রাসে গিলেছি, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। মধ্য বয়সের মধ্য স্থানে পৌছে সেই ঘুম আজ ভেঙ্গে গিয়েছে। ঘুম নেই। বিশ্বনাথ ডাকাতের গল্প, রবিনহুডের মতো, নীলকর সাহেবদের গল্প, জঙ্গলাকীর্ণ শত শত নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের চার পাশে যে সাহেবদের প্রেতাত্ম আজও ঘোড়ার পিঠে চড়ে চাবুক হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, জঙ্গলের মধ্যে রাতের অন্ধকারে শপাং শপাং শব্দ হয়, সকলেই শুনতে পায়, এমন কি জোনাকির ঝিকিমিকি আলোয় মধ্যে মধ্যে অশ্বারূঢ় সাহেবদেরও দেখা যায়, অনেকেই দেখেছে, এবং ম্যালেরিয়ায় উজাড় গ্রামের পর গ্রামে উলোর ভুতের গল্প। গরীব মানুষ সাধারণ মানুষ সকলে মরে গিয়েছে, বেচে আছে ভূত হয়ে। যশোরে বনগাঁয় বাড়ি, ছেলেবেলা থেকে এরকম রোমাঞ্চকর গল্প কত যে শুনেছি তার হিসেব নেই।
তিতুমীর সম্বন্ধে এরকম কোনো গল্প ফাঁদার চেষ্টা করিনি। যেহেতু এরকম গল্প অনেক আছে, অধিকাংশই বিকৃত ও কাল্পনিক। (যদিও গল্পেরও ঐতিহাসিক মূল্য আছে।) যেমন বিহারীলাল সরকারের “তিতুমীর, ভুসি ঝাড়লে কিছু তথ্যের দানা হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু লেখকের রাজভক্তি জমিদারভক্তি হিন্দুভক্তি এত প্রবল যে ভরসা হয় না। বিশ্বকোষ ও বিদ্যালংকারের জীবনীকোষের তিতুমীরও তাই একখানি ছোট বাংলা বই ‘নারকেলবেড়ের জঙ্গ’ নামে কলকাতা থেকে ১৮৫৩-৫৪ সালে প্রকাশিত হয়, লেখক মুসলমান। বইখানি দুষ্প্রাপ্য। ‘মাসিক মহম্মদী’ পত্রিকায় আবদুল গফর সিদ্দিকী তিতুমীর সর্ম্পকে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন (১৩৬০ সন) যা ইতিহাস নয়, উপন্যাস। জেলা গেজেটিয়ারে , তিতুমীরের বিবরণ আছে এবং বৃটিশ লেখকদের ইতিহাসে কিন্তু সকলেরই প্রধান অবলম্বন হান্টারের দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস বই। ক্যান্টওয়েল স্মিথের মর্ডান ইসলাম ইন ইন্ডিয়া এর ব্যতিক্রম নয়। এই কারণে রাগীয় মহাফেজখানার সরকারী দলিলপত্র ও (জডিসিয়াল ডিপার্টমেন্ট রেকডস, ১৮৩১-৩২) থেকে লেখায় অধিকাংশ উপাদান সংগ্রহ করেছি। চিঠিপত্র রিপোর্ট ইত্যাদি থেকে (টাইপ করা ফলস্কাপ সাইজের প্রায় পৌনে দুশো পৃষ্ঠা) প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যথাযথ প্রকাশ করেছি, অনাবশ্যকবোধে মূল ইংরেজী থেকে খুব বেশি উদ্ধৃতি দিইনি। ফোর্ট উইলিয়াম, দি টুয়েন্টি সেকন্ড নবেম্বর ১৮৩১ এবং ফোর্ট উইলিয়াম, দি থার্ড এপ্রিল ১৮৩২-এর মধ্যে তিতুমীরের বিদ্রোহ সংক্রান্ত অধিকাংশ চিঠিপত্র রিপোর্ট লিপিবদ্ধ আছে সমসাময়িক পত্রিকায় তিতুমীরের বিদ্রোহের সংবাদ বিশেষ প্রকাশিত হয়নি। সামান্য কিছু, টুকরো খবর সমাচার দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং কিছু ইংরেজীতে খবর ইন্ডিয়া গেজেট পত্রিকায় – (১৪, ১৮, ২২, ২৫ নবেম্বর এবং ৭ ও ১৩ ডিসেম্বর ১৮৩১)। সরকারী দলিলপত্রের অতিরিক্ত উল্লেখ্য উপাদান এগুলির মধ্যে বিশেষ কিছু নেই, যা সামান্য আছে, যেমন শ্রীরামপুরের চিঠি, তা ব্যবহার করেছি। গত কুড়ি বছরের মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধদির মধ্যে উল্লেখ্য হল পাকিস্তান হিস্টরিকাল সোসাইটির চার খন্ডে সম্পণ এ হিস্টরি অব দি ফ্রিডম মুভমেন্ট, ১৭০৭-১৯৪৭ (করাচী, ১৯৫৭ ) প্রথম খন্ডে তিতুমীরের বিদ্রোহের। ইতিহাস আছে (পৃষ্ঠা ৫৪৯৫৫৫), প্রধানত সরকারী দলিলপত্র অবলম্বনে লেখা, কিন্তু বিস্তৃত নয়। জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি অফ পাকিস্তান চতুর্থ খন্ডে (ঢাকা, ১৯৫৯) মইনুদ্দিন আহমদ খাঁ সাহেবের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, দি ঈগল অফ তিতুমীর—এ রি-একজামিনেশন। ভাল প্রবন্ধ কিন্তু পাকিস্তান হিস্টোরিকাল সোসাইটির পুর্বোক্ত গ্রন্থের আলোচনার অতিরিক্ত নতুন তথ্য বা বিশ্লেষণ কিছু নেই। তিতুমীরের ধর্ম সংস্কার সম্বন্ধে, ওয়ালি-আল্লা, আজিজ ও সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে এই গ্রন্থগুলি (এবং প্রবন্ধ) নির্ভরযোগ্য মনে হয় ? Aziz Ahmad: An Intellectual History of Islam in India (Edin 1969): Islamic Surveys vol. 7. Ghulam Rasul Mihr: Sayyid Ahmad Shahia (Lahore 1952). M. Nurul Karim: Part played by Haji Shariat Allah and his son in the socio-political history of East Bengal (Proceedings of the Pakistan History Conference, Karachi 1955, pp 197-208) . M. D. Ahmad Khan: History of the Faraidi Movement in Bengal 1818-1906 (Karachi 1965) .. Ameer Ali Syed: The Spirit of Islam (London 1945ed). Stephen Fuchs: Rebellious Prophets (Bombay 1965) . I. C. Jarvie: The Revolution in Anthropology (London 1964). E. J. Habsbawm: Social Bandits and Primitive Rebels (Illinois 1.59).
তিতুমীর সম্পর্কে অনেক ‘ছড়া’ আছে, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কিন্তু ছড়াগলি পরবর্তীকালে রচিত এবং সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সেই কারণে একটি ছড়াও লেখাতে ব্যবহার করিনি যদিও এরকম ছড়ারও ঐতিহাসিক মূল্য কিছুটা আছে। বাংলা উদ্ধতিগুলি প্রাচীন সময়িকপত্র সমাচার দর্পণ সংবাদ প্রভাকর ও তত্তবোধিনী পত্রিকা থেকে গৃহীত।