স্বরূপ অন্বেষা
ভূমিকাঃ মুনতাসীর মামুন
আমার স্বার্থে আঘাত দিলে আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে যায় শত্রু। শ্রমিক দাবী আদায়ের জন্যে রাস্তায় নামলে হয়ে যায় লুটেরা। কৃষক জমিদার জোতদারের থাবা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে হয়ে যায় ডাকাত।
এরকম চলছে অনেক দিন ধরে। প্রাচীনকালে স্রেফ অস্ত্রের আঘাতে এসব ডাকাত -দের খতম করে দেয়া হতো। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের যখন উদ্ভব হলো তখন এর কৌশল গেল বদলে। এখন আর সব সময় অস্ত্র নয়, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির বাক্স থেকে নতুন নতুন কলকব্জা বের হতে লাগলো। এর একটি হলো অর্থ এবং প্রচার মাধ্যম। এই আধুনিক কালেও স্রেফ এ দুটি জিনিসের জোরে লুটের হয়ে যায় সাধু। অত্যাচারী দয়ালু। অস্ত্রের থেকে এ দুটি কৌশল কার্যকরী। অস্ত্র দিয়ে মানুষকে কম কনভিন্স করা যায়। কিন্তু প্রচার মানুষকে কাবু করে ফেলে। তাই আধুনিক যুগেও দেখা যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির বিরুদ্ধে কিছু করলেই সে চিহ্নিত হয় শত্রু হিসেবে। রুশ বিপ্লবীরা চিহ্নিত হয়েছিল লুটেরা, ভয়ঙ্কর খুনী হিসেবে। এবং বর্হিবিশ্বে এ কথা ধ্রুব সত্য র মতো করে তুলেছিলেন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা যাদের পিছে ছিল টাকা আর প্রচার মাধ্যম। চীন বিপ্লবের সময় মাও সেতুং চিহ্নিত হয়েছিলেন আস্ত রাক্ষস হিসেবে। অবশ্য একদিক থেকে এ কথা ঠিক কারণ মাও সেতুং শোষকদের এবং তাদের তল্পীবাহক ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থকে হত্যা করেছিলেন।
তাই দেখি, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ, অর্থাৎ ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ওপর প্রথম যে বইটি লেখা হলে সেটি লিখলেন এক বায় বাহাদুর। যামিনী মোহন ঘোষ নামে এই ভদ্রলোকটি তাঁর গ্রন্থে ফকির সন্ন্যাসীদের চিহ্নিত করলেন ডাকাত হিসেবে। এবং প্রভু ইংরেজরাও বললো, ওরা ডাকাত, ইংরেজ ঐতিহাসিকরা বললো ওরা ডাকাত, বাঙালী ঐতিহাসিকরাও বললো ওরা ডাকাত। এবং এখনও ঐ ট্র্যাডিশন চলছে। বুদ্ধিজীবীরা এ ধরনের ভণ্ডামি করে কেন? কারণ যে সমাজ কাঠামোয় তারা সুবিধাভোগী শ্রেণী সে সমাজ কাঠামো তারা ধ্বংস করতে চায় না। তারা বড়জোর ব্যক্তি বিশেষকে আক্রমণ করে, সমাজ কাঠামোকে কখনও নয়।
অন্যদিকে বিদ্রোহ আরো বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়। বিদ্রোহীকে সমাজ ভয় পায় আবার মনে মনে শ্রদ্ধাও করে। কারণ অন্যরা যখন মাথা নিচু করে আছে কুর্নিশের ভঙ্গীতে তখন একজনের উচু মাথা যেমন বিস্ময় তেমন শ্রদ্ধাও জাগায়। কিন্তু ডাকাত বা ডাকাতিকে সবাই ঘৃণা করে, কারণ সে আসে রাতের অন্ধকারে, ন্যায় যুক্তিকে পদদলিত করে। তাই একজন ডাকাতকে হত্যা করতে কেউ দ্বিধা বোধ করে না। সুতরাং সাধারণ মানুষ যেন বিদ্রোহীদের ডাকাত মনে করে সে ধরনের একটি চিত্র সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা সব সময় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আগে ইংরেজ শাসন বাঁচানোর জন্যে ভদ্রলোকদের ভদ্রস্থ রাখার জন্যে যেমন বিদ্রোহীদের ডাকাত এবং লুটেরা বলা হতো এখনও তেমন সুবিধাভোগীদের শাসন জিইয়ে রাখার জন্যে সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা তৎপর। তবে খোল নলচে পাল্টেছে। এখন বক্তৃতায় অনেকে, যারা মাথা উচু করে দাঁড়াতে চায় তাদের সাবাস দেন কিন্তু সুযোগ পেলে পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে কসুর করেন না।
বর্তমান সংখ্যায় বাংলাদেশের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ এবং উনিশ শতকের দু টি প্রধান কৃষক বিদ্রোহের ওপর তিনজন ঐতিহাসিকের তিনটি মূল্যায়ন রচনা সংকলিত করা হলো। এটি বিচিত্রা স্বরূপ অন্বেষার একটি পর্যায় বলে ধরা হয়েছে।
পরবর্তী পর্যায়ে (ঈদ সংখ্যা, ৭৭ আমরা মধ্যবিত্তের চেতনার স্বরূপ অন্বেষা করেছি।
এখন যেমন, আগেও তেমন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন কৃষিজীবী। যুগযুগান্ত ধরে তারা নিজ কর্মে নিয়োজিত এবং যুগযুগান্ত ধরেই অল্প কিছু লোক তাদের নিপীড়ন করে আসছে কৃষকদের ওপর নিপীড়ন করেছে। সামন্তবাদীরা, নিপীড়ন করেছে মোগলরা, ইংরেজরা। এবং কৃষকদের রক্ত চুষেই যুগযুগান্তর ধরে শাসকরা বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের।
বাংলার কৃষকদের সহ্যশক্তি অসীম। দাঁতে দাঁত চেপে তারা নির্যাতন সহ্য করেছে, যখন আর সহ্য হয়নি তখন ঝাপিয়ে পড়েছে অত্যাচারীর ওপর। শুধু ইংরেজ আমলেই নয়, বিংশ শতকের গণ আন্দোলনগুলিতে এমনকি আজকের বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনগুলিতেও কৃষক এবং ভূমিহীন কৃষক যারা শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে তাদের অবদান ভোলার কথা নয়। তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত কোন গণ-আন্দোলনই সফলতা অর্জন করতে পারতো না।
বাংলাদেশের কৃষকদের সংগ্রামী ঐতিহ্য অনেকদিনের। সেই কৈবর্ও বিদ্রোহ থেকে শুরু করে আজকের তেভাগা আন্দোলন এ পুরো পূর্ব দেখলেই বোঝা যায় কৃষকরা কতবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলার কৃষকদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু হয় ইংরেজ আমলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর এ নির্যাতন আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে। [বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা কে বোঝাচ্ছি]। যার ফলে এখানে ঘন ঘন কৃষক বিদ্রোহ হতে থাকে।
সু-প্রকাশ রায় তাঁর ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম -এ আঠারো এবং উনিশ শতকে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। অষ্টাদশ শতকের কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে অনেকগুলি সংগঠিত হয়েছে বাংলাদেশে—যেমন-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০), সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭৬৯), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭) রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩),যশোহর-খুলনার প্রজাবিদ্রোহ(১৭৮৪-৯৬), এবং বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া বিদ্রোহ (১৭৯২)।
উনিশ শতকে বাংলাদেশে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহগুলি হলো- ময়মনসিংহের গারো বিদ্রোহ, ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৯২), সন্দীপের বিদ্রোহ (১৮১৯), ময়মনসিংহের হতনেতা বিদ্রোহ এবং পাগলা পন্থী বিদ্রোহ ফরাজী বিদ্রোহ, সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ এবং যশোহরের নীল বিদ্রোহ।
দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ প্রধান কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে। এর কারণ আমরা সংক্ষেপে বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।
হয়ত বাংলাদেশের জলবায়ু প্রকৃতিই এ অঞ্চলের মানুষদের মানসিকতা প্রভাবিত করেছে। কিন্তু এটি প্রধান কারণ নয়। প্রধান কারণ হচ্ছে জাম বা অর্থনীতি ও সমাজ সংক্রান্ত। বা অন্যকথায় বলতে পারি কর্ণ-ওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই আঠারো ঊনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহের জন্যে মূলত দায়ী।
ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার সমাজ কাঠামোর ওপর প্রবল অভিঘাত হেনেছিল এবং সমাজে মৈলিক পরিবর্তন সাধন করেছিল। এই নতুন ভূমি ব্যবস্থা বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরি করেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উদ্ভুত হয়েছে নতুন এক শ্রেণী ; চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পটভূমি নির্মিত করে দিয়েছে, সাংস্কৃতিক বিকাশের সীমারেখা চিহ্নিত করেছে এবং অর্থনৈতিক বিকাশের ভূমিকা রচনা করেছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এ অঞ্চলে সৃষ্টি হলো নতুন জমিদার বা ভূমি মালিকের, মধ্য স্বত্বভোগীর, ভূমিহীন কৃষক, মহাজন, ব্যবসায়ী এবং ভদ্রলোক শ্রেণীর।
নতুন এই ভূমি ব্যবস্থার ফলে বেশিরভাগ জমিদারীই ইংরেজ কর্মচারীদের বানিয়ারা হস্তগত করে। তাদের বেশির ভাগই ছিল শহরবাসী হিন্দু ব্রাহ্মণ। এবং ইংরেজরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই এ কাজটি করেছিল।
বাংলাদেশের জনসাধারণের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। অন্য দিকে জমিদাররা ছিল হিন্দিু উচ্চ-সম্প্রদায়ভুক্ত। হান্টারের তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহ জেলার শতকরা ১৬ ভাগ মুসলমান ছিলেন জমির মালিক এবং তাঁরা যে রাজস্ব আদায় করতেন তার পরিমান ছিল দশ ভাগের মতো। বরিশালে শতকরা ৬৪-৮ ভাগ মুসলমান দশ ভাগেরও কম জমির মালিক ছিলেন এবং তাদের আদায়কৃত রাজস্বের পরিমান ছিল ৯ ভাগের মতো। শোষণের মাএা বোঝা যায় আদায়কৃত রাজস্বের পরিমান থেকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পর ১৮৮৬ সনে জমিদারদের দেয় খাজনার পরিমান ৩০ মিলিয়ন থেকে ১৮০ মিলিয়ন টাকায় পৌছায়। ফলে একদিকে মধ্যস্তত্ব ভোগীদের হার বাড়তে থাকে অন্যদিকে কৃষকরা ক্রমাগত মহাজনদের খপ্পরে পড়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হতে থাকে। অর্থাৎ এক কথায় এ বন্দোবস্তের ফলে রাজস, জমিদারের আদায়, মহাজনী সুদের হার ও কৃষকদের দুর্দশা বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, এ দেশের কুটির শিল্পও ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে জমির ওপর চাপ আরো বৃদ্ধি পায়।
মধ্যস্বত্বভোগী বা পরগাছাদের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশেই ছিল বেশি। জোকের মতো কৃষকের রক্ত চুষে তারা নিজিদের উদর স্ফীত করেছে। একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিস্কার হবে। বরিশাল জেলার কৃষক এবং জমিদারদের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের ৫২টি স্তর পর্যন্ত খুজে পাওয়া গেছে।
মুসলমান জমিদার তার সংখ্যা যত নগন্যই হোক চরিত্র ছিল তার হিন্দু জমিদারের মতোই। অন্যদিকে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক ও তার সহযোগী হিন্দু কৃষক একই ভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা। ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ নিয়ে যেমন হিন্দু জমিদার তনয় শহুরে ভদ্রলোক হয়ে ইংরেজদের পল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে জনসাধারণের বিরুদ্ধে তেমনি মুসলমান ভদ্রলোকরা তাদের সংখ্যা কম হতে পারে, কিন্তু তারাও ব্যবহৃত হয়েছে অনূরূভাবে। তাই আমরা দেখি, বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রীতি অক্ষুন্ন ছিল প্রায়ই এবং এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা শুরু হয় তখন যখন হিন্দু ও মুসলমানরা রাজনীতি শুরু করে।
উনিশ শতকের চিঠি পএে সাহিত্যে জমিদার ও কৃষকদের অবস্থা নানা ভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি যার ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিশাল জনসমষ্টি ও মুষ্টিমেয় শাসকদের চরিত্র ও চিত্র ফুটে উঠেছে।
যে বছর শুকা হাজাতে কিছু খন্দ না হয় সে বছর বড় দুখে দিন কাটি কেবল উড়ি ধানের মুড়ী ও মটর মসুর, শাকপাতা, শালুক, গুগলি, সিজাইয়া খাইয়া বাঁচি…..খুদ কুড়া ফেন আমানি খাই। শাক ভাত পেট ভরিয়া যেদিন খাই সেদিন। জন্মতিথি………।
এ যখন কৃষেকের অবস্থা তখন ভদ্রলোক মহোদয় জলেশ্বরের ধোলাই ধুতি পবিয়া মদিরা সহযোগে থানার শেষে কুর্সিতে বসিয়া সালসৌতে মাখা তামাক টানতে টানিতে আফিমের মৌতাতে গুমোট বরষায় ঝিমাইতেন। বা মক্সাভস্মের চুন দিয়ে পান খেতেন এবং কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করতেন।
তা হলে কৃষকরা কেন বিদ্রোহ করনে না। তাদের বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত।
সংকলনের প্রথম রচনাটি সু-প্রকাশ রায়ের। ভারতের কৃষক সংগ্রামের ওপর তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (দ্বিতীয় সংস্করণ, (১৯৭২) থেকে লেখাটি সংকলিত হয়েছে। সম্পূর্ণ লেখাটি এখানে সংকলিত হয়নি। বিদ্রোহের প্রতিটি পর্বের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। এখানে শুধু প্রথম পর্বের কাহিনী সংকলিত হয়েছে।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সন্ন্যাসী ফরিক বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। কারণ মুসলমান ফকিররাও এই বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিদ্রোহের সঙ্গে।
সু-প্রকাশ রায় এই বিদ্রোহকে বৃটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রথম সংগ্ৰাম বলে উল্লেখ করেছেন। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯৩ সনে ঢাকায়, ইংরেজ কুঠির আক্রমণের মাধ্যমে শেষ হয় ১৮০০ সনে। এই মধ্যবর্তী সময়ে একেক অঞ্চলে, বিচ্ছিন্ন ভাবে এই বিদ্রোহ শুরু ও শেষ হয়েছে।
ঢাকার কুঠি আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার পরও বিদ্রোহীরা বেশিদিন তা হাতে রাখতে পারেনি। পরে তারা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর বঙ্গের দিকে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর ১৭৭০-এ পূর্ণিয়াতে নতুন আক্রমনের মধ্যে দিয়ে আবার বিদ্রোহ শুরু হয়। দিনাজপুরেও এই সময় পাঁচ হাজার বিদ্রোহীর একটি বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ১৭৭৬ সনে ফকির মজনু শহর নেতৃত্বে উত্তর বঙ্গে ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। মজনু শাহ এর পরের বছর উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
১৭৭৩ সনে রংপুর হয়ে ওঠে আবার বিদ্রোহীদের কর্মীকান্ডের কেন্দ্র। এই বিদ্রোহ দমিত হয়। ১৭৭৬ সনে মজনু শাহ উত্তর বঙ্গের বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীদের সংঘবদ্ধ করেন। ফকির সন্ন্যাসীদের মধ্যে তখন আত্মকলহ দেখা দিয়েছিল।
১৭৮১-৮৬ সন বিদ্রোহের পঞ্চম পর্ব মজনু শাহ ও বিদ্রোহীরা বিচ্ছিন্নভাবে ময়মনসিংহ, ঢাকা ও উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। মজনু শাহ মারা যান ১৭৮৬ সনে। এরপর বিদেহীদের নেতৃত্বদেন মুসাশাহ।
কিন্ত শেষের দিকে সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যে আত্মকলহ শুরু হয়। সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহ থেকে সরে দাঁড়ায়। ফকিররাও পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বাংলার ওয়াহাবী বিদ্রোহ তিতুমীরের বিদ্রোহ নামেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। এই বিদ্রোহের উৎস প্রাথমিক ভাবে ধর্মীয় হলেও, পরবর্তী কালে তা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক রূপ নেয়। এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়ে জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তিতুর বাঁশের কেলা ইংরেজরা পুড়িয়ে দিয়েছিল সত্য কিন্তু সেই বাঁশের কেল্লা এখন বাঙালীদের কাছে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।
তিতুমীরের ওপর এই ক্রুন্ধ লেখাটি লিখেছেন বিনয় ঘোষ। তিতুমীর বা ওয়াহাবী বিদ্রোহের ওপর অনেক প্রাজ্ঞ পন্ডিত অনেক গ্রন্থ/প্রবন্ধ রচনা করেছেন সত্যি কিন্তু বিনয় ঘোষর মতো এতো তীক্ষ। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বিদ্রোহের চরিত্র উন্মােচিত করতে পারেননি।
১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের কিছুদিন পরই উভয় বঙ্গে নীল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। নীল আন্দোলন শুরু হয় নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, একটা অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসেবে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু নীল আন্দোলন তার গণচরিত্র ও সংগ্রামশীলতার জন্য অচিরেই সরকার বিরোধী আন্দোলনে রপান্তরিত হয়ে একটা বৈপ্লবিক আকার ধারণ করেছিল। ১৮৬০ সনের ক্যালকাটা রিভিউর একটি সংবাদই প্রমান করে শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং আন্দোলনের তীব্রতা।—“যে রায়তকে আমরা একদিন ধরে ক্রীতদাস অথবা রুশিয়ার ভূমিদাসের মতো গণ্য করে এসেছি, যাকে আমরা কেবলমাত্র জমির একটা অংশ হিসেবেই দেখেছি……সে আজ অবশেষে জাগ্রত ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সে প্রতিজ্ঞা করেছে যে সে শৃঙ্খলমুক্ত হবেই।
নীল আন্দোলন ও মহাবিদ্রোহ এই নিবন্ধটি প্রমোদ রন্জন সেন গুপ্তের অবশ্যপাঠ্য বই নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ এর একটি অধ্যায়। উপরোক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করন থেকে এই অধ্যায়টি সংকলিত করা হয়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি বাংলাদেশের কৃষকদের সংগ্রাম বা বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যেই এই প্রবন্ধ তিনটি সংকলিত করা হয়েছে। আমরা জানি যে, তিনটি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ থেকে শতাব্দী ব্যাপি চিত্র পাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এও মনে করি যে বাংলার সাধারণ মানুষকে তাদের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত।কারণ এতোদিন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন।
মুসলমান আমলে রাজ দরবারের ঐতিহাসিকরা ইতিহাস, ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা এবং তারপরে দেশীয় ঐতিহাসিকরা ইতিহাস লিখেছেন।কিন্তু তারা কি লিখেছেন? রাজাদের বংশ বৃত্তান্ত, গভর্ণর জেনারেল বৃত্তান্ত কার্যক্রমের খুটিনাটি বিবরণ। যেন ভারতবর্ষে বা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ বলে কিছু ছিল না।
উনিশ শতকে বা বিংশ শতকের শুরুতে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারাও সিভিলিয়ান ঐতিহাসিকদের অনুসরণ করেছেন। জনগণ ইতিহাসের অংশ হোক তা কখনো তাদের কাম্য ছিল না। সাহিত্যেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে। ইংরেজ শাসনের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ ছিল। তারা সমাজ কাঠামোকে অক্ষুন্ন রাখতে চেয়েছে কারণ ঐ সমাজে তারা সুবিধাভোগী শ্রেণী। তাই বিদ্রোহ তাদের কাছে ন্যায় সঙ্গত মনে হয়নি।
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন-“আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি।”
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন যখন জমিদার দর্পন লিখলেন তখন বষ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন-
…..প্রজার হিত কামনা আমরা কখনও ত্যাগ করিব না। কিন্তু আমরা পাবনা জেলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরত এবং বিষাদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, এসময় এ গ্রহের বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করা হউক।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ওপর লেখা যামিনী ঘোষের বইয়ের কথা আগেই লিখেছি। তিতুমীরের ওপর প্রথম বই রচনা করেন বিহারী লাল সরকার। তাঁর গ্রন্থে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন–
হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খ্রিস্টান হউক, শিখ হউক, পারসিক হউক, তিতুর ন্যায় যদি কখনও কাহারও দুর্বুদ্ধি হয়, ভ্রান্তি হয়, তিতুর দৃস্টান্ত নিশ্চিতই তাহার চৈতন্য হইবে। তিতু বড়ই দুর্বুদ্ধি। তাই তিতু বুঝিল না, ইংরেজ কত ক্ষমাশীল—কত করুণাময়। দুর্বুদ্ধি তিতু ইংরেজদের সে করুণা, সে মমতা বুঝিল না।………
সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। এখন বাঙালী ঐতিহাসিকরা জনগণকে এড়িয়ে ইতিহাস রচনা করতে চান। বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের তালিকা এবং বিষয়বস্তু তা প্রমাণ করবে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এবং আমরা তাই এখানে ব্যতিক্রমী তিনটি লেখা প্রকাশ করলাম। কিন্তু ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্ৰমই।
অতীতে কৃষক সংগ্রামগুলি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সঠিক নেতৃত্ব বা সংগঠন তাদের ছিল না। কিন্তু যেখানে শিক্ষিত মানুষেরা ইংরেজ শাসনকে আশীর্বাদ রূপে মনে করেছিল সেক্ষেত্রে কৃষকরা সেই শাসনের বিরদ্ধে লড়েছে। সু-প্রকাশ রায় লিখেছেন-“উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় রিনাসান্স যে সময়ে প্রকৃত জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করিতে ব্যর্থ হইল, ঠিক সেই সময়েই অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দী ব্যাপিয়া ইংরেজ শাসন ও জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত নিরবচ্ছিন্ন কৃষক সংগ্রাম সমস্ত জাতির সম্মুখে এক নতুন সংগ্রামী ঐতিহ্য সৃষ্টি করিতেছিল। এই কৃষক সংগ্রামের ঐতিহ্যই ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ভূমি। শুধু তাই নয়, এই ঢাকায় যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল তাকে তিনি বাংলাদেশ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নামে আখ্যা দিয়েছেন।
এই কৃষক বিদ্রোহের ব্যর্থতা সত্বেও উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিশ শতকের শুরুতে বাঙ্গালী তরুণদের একাংশকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারা এই বিদ্রোহের গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। শিশিরকুমার ঘোষ লিখেছিলেন,
এই নীল বিদ্রোহই সর্ব প্রথম দেশের মানুষকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সঙ্গবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা শিখাইয়াছিল। বস্তুত বঙ্গদেশে বৃটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহই প্রথম বিপ্লব। বিপিনচন্দ্র পাল বলেছেন, ওয়াহাবী বিদ্রোহীদের বিচারের বিবরণ যখন ছাপা হচিছল তখন তা পড়ে তারা মেতে উঠেছিলেন। উনিশ শতক থেকেই বাংলাদেশে ভূমির ওপর চাপ বাড়ছে বা অন্যকথায় বলা যায় ভূমিহীনদের সংখ্যা বাড়ছে। ১৮৮১ সন থেকে ১৯২১ সন পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষির ওপর যে জরিপ চালানো হয় তাতে দেখা যায় যে, ১৮৮১ সনে ৫৯.৬ ভাগ, ১৮৯১ সনে৬১. ০৬ ভাগ।১৯০১ সনে ৬৬ •০০ ভাগ, ১৯১১ সনে ৭৭ .২০ ভাগ ও ১৯২১ সনে ৭২.৯৮ ভাগ লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আজকের বাংলাদেশের চিত্রও অনূরুপ৷ দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা বাড়ছে এবং আরো বাড়বে। বংকিমচন্দ্র উনিশ শতকে যে কথা লিখেছিলেন আজকেও আবার সে কথার পুনরুক্তি করতে হয়—
তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ-দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী। তোমা হইতে আমা হইতে কোন কার্য হইতে পারে ? কিন্তু সকল কৃষিজীবী ক্ষেপিলে কে কোথায় থাকিবে ?
এই ক্ষেপার সময় হয়ত আর দূরে নয়। একদিন আবার শরীর থেকে শিশির ঝেড়ে ফেলার মতো তারা শৃংখল ফেলে দেবে, যা তাদের ওপর বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল যখন ছিল তারা ঘুমের ঘোরে। গ্রন্থপঞ্জী
সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।
প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাংগালী সমাজ।
রংগলাল সেনঃ এ, কে, ফজলুল হক ও পটভূমি, রাজনীতি ও বৃটিশ শাসকবর্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা [সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত] ডিসেম্বর ১৯৭৮।
মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙ্গালী সমাজ।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
সুপ্রকাশ রায়
ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলা তথা ভারতের কৃষক ও কারিগরদের প্রথম বিদ্রোহ আরম্ভ হয় ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে। এই বিদ্রোহের ঘটনাস্থল সমগ্র বঙ্গদেশ ও বিহার প্রদেশ। ইহার দ্বায়িত্ব কাল ১৭৬৩ হইতে ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে খ্যাত। এই ঐতিহাসিক কৃষক-বিদ্রোহ সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত হইল কেন? বিদ্রোহের সহিত সন্ন্যাসীদের সম্পর্ক কি ? বাংলা ও বিহারের তৎকালীন অবস্থার কোন প্রামাণ্য ইতিহাস তখন এদেশের কেহ লিখিয়া যান নাই বলিয়া আজ এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। সেই সময়ের কয়েকখানি সাময়িক পএ উচচপদস্থ শাসকগণের নিকট লিখিত নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের পত্রাবলী ও রিপোর্ট এবং পরবর্তী কালে রচিত কয়েকখানি গবেস্বণামূলক গ্রন্থ হইতে এই প্রশ্নের একটা যুক্তিসঙ্গত উত্তর খুজিয়া লইতে হইবে।
উক্ত চিঠিপত্র ও গ্রন্থগুলিতে ইংরেজ শাসনের প্রথমভাগে বাংলা ও বিহারের অবস্থা এবং বিশেষত একটা ব্যাপক কৃষক, বিদ্রোহ সম্পর্কে যথেষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু, এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসীদের আক্রমণ বলিয়া উল্লেখ তৎকালীন শাসকদের লিখিত পত্রাবলী ও রিপোর্টেই দেখা যায় । দবিস্তান ১ নামক গ্রন্থে এবং ঘটনাপঞ্জী আকারে লিখিত অপর দুইখানি গ্রন্থে/২ দেখা যায় যে সেই সময় সমগ্র উত্তর ভারতে মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত বিভিন্ন নাগা পূর্বিয়া , বোকসারিয়া , ভোজপূরী প্রভৃতি এবং মাদারী সম্প্রদায়ভুক্ত, বিভিন্ন দলের ফকিরগণ দল বাঁধিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত। এই সকল সম্প্রদায় পরস্পরের সহিত সংঘর্ষে লিপ্ত হইত। কিন্তু, ইহারাই যে ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরিয়া বাংলা ও বিহারের উপর আক্রমণ চালাইয়াছিল এবং জনসাধারণের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিত তাহার কোন স্পষ্ট উল্লেখ ঐ সকল গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সকলগ্রথ ও পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থ এবং বিভিন্ন তথ্য হইতে জানা যায় যে মোগল শাসনের মধ্য ও শেষ ভাগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিজমা দখল করিয়া অথবা শাসকগণের নিকট হইতে দান হিসাবে জমি লাভ করিয়া স্থায়িভাবে বসবাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিল এবং কালক্রমে এই গৃহবাসী সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ চাষবাস করিয়া রীতিমত কৃষকে পরিণত হইয়াছিল। কিন্তু, কৃষকে পরিণত হইলেও ইহারা সন্ন্যাসী ও ফকিরের পোশাকই পরিধান করিত/৩ এবং চিরাচরিত প্রথা অনুসারে বৎসরের বিভিন্ন সময়ে দল বাঁধিয়া তীর্থ ভ্রমণে বাহির হইত।
মোগল শাসনের মধ্যভাগ হইতেই বিহার ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বহু সন্ন্যাসী ও ফকিরের দল স্থায়িভাবে বসবাস করিতে আরম্ভ করে । তাহারা কালক্রমে রীতিমত কৃষকে পরিণত হয়। সন্ন্যাসীদের একটা বড় দল ময়মনসিংহ ও পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় বসবাস করিতে থাকে। ইহারা প্রধানত গিরি সম্প্রদায়ভুক্ত। ফকিরদের একটা দল বাস করিতে থাকে উত্তর বঙ্গে। ইহারা প্রধানত মাদারী সম্প্রদায়ের ফকির । উত্তরবঙ্গে ইহাদের বহু, দরগা ও তীর্থক্ষেত্র থাকায় ইহারা প্রধানত উত্তরবঙ্গেই _ ভীড় করে। এই সকল সন্ন্যাসী ও ফকির চাষবাসের মারফত রীতি মত কৃষকে পরিণত হয় এবং ইংরেজ শাসনের প্রথম হইতেই কৃষক হিসাবে ইহারও ইংরেজ বণিকরাজের শোষণের শিকার হইয়া উঠে। ইংরেজ শাসনের পূর্বে ভারতের কোন শাসকই এই সন্যাসী ও ফকিরদের দলবদ্ধ তীর্থ ভ্রমণে বাধা দেয় নাই। কিন্তু, বাংলা ও বিহারে ইংরেজ শাসকগণ ইহাদের তীর্থ ভ্রমণকেও শোষণের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে পরিণত করে। শাসকগণ তীর্থ যাত্রীদের মাথাপিছু, বিভিন্ন প্রকারের কর ধার্য করিয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটিয়া লইতে থাকে এবং এইভাবে সন্ন্যাসী ফকিরদের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করিয়া ইহাদের মধ্যেও, বিদ্রোহের আগুন জালাইয়া দেয়। ইহার একদিকে কৃষক, অপরদিকে সন্ন্যাসী ও ফকির, আর উভয়দিক হইতেই ইহারা বিদেশী শাসকদের শোষণ ও উৎপীড়ণের শিকারে পরিণত হইয়াছিল বলিয়াই তখন বিদ্রোহ ব্যতীত ইহাদের জীবিকা ও ধর্মরক্ষা করিবার অন্যকোন উপায় ছিল না। বাংলা ও বিহারের কৃষক-বিদ্রোহে ইহাদের যোগদান ও দলবদ্ধ তীর্থ ভ্রমণ হইতেই তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই সময়ের বিদ্রোহকে সাধারণভাবে “বহিরাগত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও দস্যুদের বাংলাদেশ আক্রমণ” নামে অভিহিত করেন এবং এই তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী ও ফকিরগণকে হিন্দুস্থানের যাযাবর আখ্যা দান করেন।/৫।
গর্ভনর জেনারেল হেস্টিংসই প্রথম এই কৃষক বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত করেন। তিনিই ইহাকে হিন্দুস্থানের যাযাবরদের পেশাদারী উপদ্রব, দস্যুতা ও ডাকাতি বলিয়া বাখ্যা করিয়াছিলেন। তাহার পর অনেকেই তাহার সুরে সুর মিলাইয়াছেন। এই ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহকে এই সকল নামে অভিহিত করিয়া হেস্টিংস প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন যে, বিহার ও বাংলার কৃষক প্রথম হইতেই ইংরেজ শাসনকে নির্বিবাদে মানিয়া লইয়াছে এবং ইংরেজ শাসকদেরই ত্রাণকর্তা বলিয়া বরণ করিয়া এর পর লইয়াছে,/৬ যামিনীমোহন ঘোষ মহাশয় তাঁহার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থে/৭ এই বিচোহকে বিহার ও বাংলার বাহির হইতে আগত যাযাবর প্রকৃতির নাগাসাসিী ও ভোজপুরী দস্যু-ডাকাতদের আক্রমণ ও উৎপাত, বলিয়া উল্লেখ করিয়ছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ও তাঁহার পুস্তকে/৮ এই কথারই প্রতিধনী করিয়া এই ঐতিহাসিক কৃষক-বিদ্রোহকে বহিরাগত যাযাবর প্রকৃতির দস্যু-ডাকাত ও লণ্ঠনকারীদের উপদ্রব বলিয়া উস্কাইয়া দিয়াছেন এবং ইংরেজ শাসনকে নবভারতের জীবন প্রভাত বলিয়া স্বাগত জানাইয়াছেন। কিন্তু, তাঁহারা উভয়েই যে সকল গ্রন্থ, পত্রাবলী ও রেকর্ডের ভিত্তিতে তাঁহাদের পুস্তক রচনা করিয়াছেন তাহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, এই বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ও বিহারের কৃষকের বিদ্রোহ, বিদেশী শাসকদের শোষণ ও উৎপীড়ন হইতে কৃষকের জীবন রক্ষার সংগ্রাম। বিদ্রোহী বাহিনী ও বিদ্রোহের নায়কগণ যে অঞ্চলেই গিয়াছিল সেই অঞ্চলেরই জমিহারা-গৃহহারা কৃষকগণ তাহাদিগকে সকল শক্তি দিয়ে সাহায্য করিয়াছিল এবং বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগদান করিয়া বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছিল/৯। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কর্মচারিগণের লিখিত বিভিন্ন পত্র ও রিপোর্ট হইতে ইহাও প্রমাণিত হয় যে, বিদ্রোহীরা কখনই স্থানীয় কৃষকদের উপর উৎপীরণ ও তাহাদের সম্পত্তি লণ্ঠন করে নাই, এবং তাহাদের লণ্ঠন ও পীড়ণ কেবল জমিদার-মহাজন ইংরেজ শাসকদের উপরই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সকল শোষক-উৎপীড়কদের ধনসম্পত্তি কাড়িয়া। লইয়া, জমিদার-মহাজন-বিত্তশালীদের নিকট হইতে কর আদায় করিয়া এবং ইংরেজ শাসকদের ধনাগারে সঞ্চিত অর্থ কাড়িয়া লইয়া তাহা দ্বারাই বিদ্রোহীরা বিদ্রেহের ব্যয় নির্বাহ করিত। ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, বিদ্রোহের নায়কগণ সাধারণ মানুষের সম্পত্তি ও ঘর বাড়ি লন্ঠন না করিবার জন্য বিদ্রোহী বাহিনীর সৈন্যদের কঠোর নির্দেশ দিয়াছিলেন/১০।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে হেস্টিংসের মিথ্যা প্রচার প্রচলিত আছে এবং তাহা আমাদের দেশের কোন কোন লেখকও সমর্থন করেন। কিন্তু, সেই সকল ধারণা যে, তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন-হেস্টিংস ও তাঁহার অনুচরবর্গের কল্পনাপ্লসূত। তাহা পরবর্তীকালের ইংরেজ ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করিয়াছেন। এডোয়ার্ড টমসন ও জি টি গারাট তাহাদের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক কৃষকবিদ্রোহ সম্পর্কে ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রচার “মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি বলিয়া অভিহিত করিয়া লিখিয়াছেন।
“সন্ন্যাসীদের প্রকৃত পরিচয় যাহাই হউক না কেন, তাহাদের বিদ্রোহ হেস্টিংসের সময়ের সর্বাপেক্ষা রহস্যময় ঘটনা। হেস্টিংস এই সন্ন্যাসীদিগকে হিন্দুস্থানের যাযাবর সম্প্রদায় নামে অভিহিত করিয়াছেন। তিনি যে কয়েকটি মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন ইহা তাহাদের অন্যতম। সন্ন্যাসীদের অভ্যুথান আজিও রহস্যাব এবং ভারতবাসীদের দিক হইতে এই রহস্যের উদ্ঘাটন করিয়া ইহার নির্ভুল ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।”/১১
এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে হেস্টিংসের মিথ্যা প্রচার অগ্রাহ্য করিয়া এই গ্রন্থকারদ্বয় যে অজ্ঞতপ্ৰসত ও হটকারী মন্তব্য না করিয়া ইহার রহস্য উদ্ঘাটনের ভার ভারতবাসীদের উপরই ছাড়িয়া দিয়াছেন তাহা ঐতিহাসিক হিসাবে তাঁহাদের সততারই পরিচয় দেয়। ভারতের সরকারী ইতিহাস ও গেজেটিয়ার রচয়িতা ও ইংরেজ শাসকদের গোষ্ঠীভুক্ত স্যার উইলিয়াম হান্টার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক-বিদ্রোহ বলিয়া ঘোষণ করিয়া লিখিয়াছেন যে, বিদ্রোহীরা অন্য কেউ নহে, ইহারা হই মোগল সাম্রাজ্যের ধবংসপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর বেকার ও বুভুক্ষু সৈন্যগণ এবং জমিহারা গৃহহারা বুভুক্ষু, কৃষকের দল। এই অন্নবস্ত্রহীন বেকার সৈন্য ও কৃষক উভয়েই “জীবিকা নির্বাহের এই শেষ উপায়টি (বিদ্রোহ), অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছিল। ইহার তথাকথিত গৃহত্যাগী (গৃহহারা) ও সর্বত্যাগী (সর্বহারা) সন্ন্যাসীরুপে দলবদ্ধ হইয়া সমগ্র বাংলাদেশে ঘুরিয়া বেড়াইত ইহাদের সংখ্যা এক সময় পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত উঠিয়াছিল।”/১২
ভারতের ইংরেজ শাসনের সরকারী ইতিহাস রচয়িতা ও প্রধান তথ্য সংগ্রহকারী হান্টারের এই মত যদি প্রামাণ্য বলিয়া গ্রহণ করা হয়, তাহা হইলে তথাকথিত সন্ন্যাসী বিথোহের ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বারা প্রচারিত সন্ন্যাসী বা যাযাবরগণ বাংলাদেশের এ বিহারের বাহির হইতে আগত কোন পেশাদার দস্যু-ডাকাত নহে। ইহারা ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের ফলে উচছন্নে যাওয়া বাংলা ও বিহারের জমি-গৃহ-জীবিকাহীন চাষীর দল। হান্টার সাহেব ধংসপ্রাপ্ত মোগল সৈন্যবাহিনীর যে বেকার ও বুভুক্ষু, সৈন্যদের কথা বলিয়াছেন সেই সৈন্যগণও কৃষকেরই সন্তান।/১৩ অন্নবস্ত্রের জন্য তাহারাও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ও বিহারের এই কৃষক বিদ্রোহে যোগদান করিয়া এই বিদ্রোহকে সামরিক দিক হইতে শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছিল। এই দুই শক্তি একত্রে মিলিত হইয়া ইংরেজ বণিকরাজের শোষণের কবল হইতে বাঁচিবার সংগ্রামের সহিত তাহাদের চেতনানুযায়ী দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকেও যুক্ত করিয়াছিল এবং সেই, যুক্ত সংগ্রামকে জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করিয়া তাহাদের অনেকেই গৃহত্যাগী ও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সাজি য়ছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়কগণ স্বাধীনতার মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছিল বলিয়াই ঢাকার রুমনার কালীবাড়ীর মহারাষ্ট্রীয় স্বামীজ সন্ন্যাসী যোদ্ধাদের মুখে ও বন্দেমাতরম এই রণধ্বনি শুনিয়া ছিলেন।/১৪ এই বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের নায়ক মজনু শাহ, ভবান পাঠক, দেবী চৌধুরানী প্রভৃতির, আহানেই সাধারণ চাষীর বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগদান করিয়া বিদ্রোহীদের সংখ্যা কোন কোন সময় পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত বাড়াইয়াছিল।
সরকারী ইতিহাস ও গেজেটিয়ার রচয়িতাদের অন্যতম এবং ভারতের ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এল এস ও ম্যালি হান্টারের মতেরই প্রতিধ্বনী কয়ািছেন। তাহার মতে বিদ্রোহীরা ছিল ধবংসপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর সৈন্য ও সর্বস্বান্ত চাষী। “মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ফলে বিপুল সংখ্যক সৈন্য তাহাদের জীবিকা হারাইয়াছিল, তাহাদের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় বিশ লক্ষ।” “জমি হইতে উচছন্ন, সর্বস্বান্ত কৃষক ও কারিগরগণ তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছিল। /১৫
এই বিদ্রোহীরা যদি বহিরাগত যাযাবর প্রকৃতির নাগা বা অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসীই হইবে, তাহা হইলে তাহারা লন্ঠন ও দস্যুতার তার জন্য ভারতের অন্যান্য শাসকবিহীন অঞ্চলে না গিয়া শক্তি শালী ইংরেজ শক্তি দ্বারা অধিকৃত ও শাস্তি বিহার ও বাংলাদেশকেই তাহাদের আক্রমণ ও দস্যুতার লক্ষ্যস্থলহিসাবে বাছিয়া লইল কেন? বিদ্রোহ যে সময়ে ঘটিয়াছিল সেই সময়ে ইংরেজ বণিকগোষ্ঠীর শোষণ এবং তাহাদের সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও ইহার পরিণতিস্বরূপ ভয়ংকর মহামারীর ফলে বাংলা ও বিহারের দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারাইয়াছিল, বাংলাদেশের সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল শ্মশানে পরিণত হইয়াছিল। এই মহামারীকবলিত বাংলা ও বিহারের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে উক্ত আগন্তক সন্ন্যাসী দস্যুরা কোন ঐশ্বর্য, লুণ্ঠনের জন্য দীর্ঘ আটত্রিশ বৎসরকাল (১৭৬৩-১৮০০) ধরিয়া আক্রমণ চালাইয়াছিল এবং ইংরেজ শাসকদের সহিত যুদ্ধ করিয়া হাজারে হাজারে প্রাণ দিয়াছিল ? বিদ্রোহীদের প্রধান অংশ যদি স্থানীয় কৃষকই না হইবে, তাহা হইলে বাংলা ও বিহারের কৃষকদের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাইত কেন, এবং নতুন ফসল উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদেৱ সংখ্যা হ্রাস পাইত কেন? এই সকল প্রশ্নের উত্তর তৎকালীন সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে নিহিত থাকিলেও ওয়ারেন হেস্টিংসের মতের সমর্থক দেশীয় পন্ডিতগণ তাহা বিচারের প্রয়োজন বোধ করেন নাই। উপরোক্ত বিভিন্ন তথ্য ও মত এবং তৎকালীন সামাজিকঅর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ/১৬ হইতে দেখা যায় যে, সন্ন্যাসী , বিদ্রোহ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক বিদ্রোহে তৎকালীন সমাজের তিনটি শক্তি মূলত হইয়াছিল। প্রথমত ও প্রধানত, বাংলা ও বিহারের কারিগর ও কৃষক জনগণ বিদেশী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সর্বগ্রাসী শোষণ। ও উৎপীড়ণ হইতে আত্নরক্ষার জন্যই বিদ্রোহ করিতে বাধ্য হইয়াছিল এবং তাহারাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান ও মূূল শক্তি। দ্বিতীয়ত ধংসপ্রাপ্ত মোগল সাম্রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর ছত্রভঙ্গ, বেকার ও বুভুক্ষু, সৈন্যগণের একটা অংশ আত্নরক্ষার তাগিদেই বিহার, ও বাংলার বিদ্রোহী কৃষকগণের সহিত যোগদান করিয়া তাহাদের দীর্ঘকালের সামরিক অভিজ্ঞতা দ্বারা এই বিদ্রোহকে সামরিক দিক হইতে সাফল্যমন্ডিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তৃতীয়ত, সন্ন্যাসী ও ফকিরদের যে সম্প্রদায়গুলি বিহার ও বাংলাদেশে স্থায়িভাবে বসবাস করিয়া চাষাবাসের মারফত কৃষকে পরিণত হইয়াছিল সেই চাষী সন্ন্যাসী ও চাষী ফকিরগণ একদিকে কৃষক হিসাবে শোষণ হইতে আত্নরক্ষার জন্য এবং অপরদিকে সন্ন্যাসী ও ফকির হিসাবে তাহাদের ধর্মনিষ্ঠানের উপর বিদেশী শাসকদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে যোগদান করিয়া বিদ্রোহের মধ্যে ত্যাগ, আত্নোৎসর্গ প্রতি আদর্শ স্থাপন করিয়াছিল। ইহারাই বিদেশীদের কবল হইতে দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রেরণা যোগাইয়াছিল। ইহারাই ছিল এই বিদ্রোহের সকল আদর্শের উৎসস্বরুপ।/১৯
লেস্টার হাচিনসন বাংলা ও বিহারের এই ঐতিহাসিক কৃষকবিদ্রোহ এবং তাহার সদরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে পৌছিয়াছেন তাহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখিয়াছেনঃ “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের যে পথ অবলম্বন করিয়াছিল তাহার ফলেই কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক বিদ্রোহ ধূমায়িত হইয়া উঠে। অত্যধিক হারে জমির উপর কর ধার্য করিবার ফলে কৃষকেরা জমি হইতে উচছন্ন হইয়া জীবিকার একমাত্র উপায় হিসাবে লণ্ঠন করিতে বাধ্য হইয়াছিল। সশস্ত্র দলে সংঘবদ্ধ হইয়া তাহারা সারাদেশে ঘুরিয়া বেড়াইত এবং জমিদারদের সম্পত্তি (অসপষ্ট) করিত। দেশের সকল বিত্তশালীরাই তাহাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু, হেস্টিংস শীঘ্রই দেশের সকলকে বুঝাইয়াছিলেন যে, শাসকগণ কিছুতেই বে-সরকারী ডাকাতি ও লুণ্ঠন বরদাস্ত করিবে না। ভারতীয় আইনের বিধি অনুসারে একমাত্র নরহত্যার অপরাধেই প্রাণদন্ড দেওয়া চলিত। হেস্টিংস সেই ভারতীয় আইন লংঘন করিয়া ঘোষণা করিলেন যে, যাহারাই, ডাকাতির অপরাধে অভিযুক্ত হইবে তাহাদেরই নিজ গ্রামের মধ্যে ফাঁসি দিয়া হত্যা করা হইবে, তাহাদের পরিবারের সকলকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রয় করা হইবে এবং তাহাদের গ্রামের উপর পাইকারীহারে জরিমানা ধাষ হইবে। এই বিশেষ অবস্থার প্রকৃত, কারণ বুঝিবার কিছুমাত্র চেষ্টা না করিয়া কেবল কঠোর দমননীতি দ্বারা বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হইল না, বরং সেই ধূমায়িত বিক্ষোভই সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের আগুনে পরিণত হইল। সন্ন্যাসীরা কৃষকের অর্থনৈতিক বিদ্রোহের সহিত – ধর্মের প্রেরণা যুক্ত করিল, তাহাদের বহু সশস্ত্র দল কোম্পানী শাসকদের বিরদ্ধে মরিয়া হইয়া গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করিল। তাহারা কোম্পানীর সৈন্যদের ছোট ছোট দলের উপর আকস্মিক ভাবে আক্রমণ করিয়া বড় বাহিনী অফিসার পূর্বেই গভীর জঙ্গলে পলায়ন করিত। হেস্টিংসকে এই বিদ্রোহ দমনকাতে বিশেষ বেগ পাইতে হইয়াছিল। এই বিদ্রোহের একশত বৎসর পরে বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসবাদী সংগ্রাম দেখা দেয়, এই সন্ন্যাসী বিদ্রেহ তাহারই অগ্রদত। /১৮ বিদ্রোহের আয়োজন আমরা দেখিয়াছি, মোগল শাসনের শেষ যুগে সাম্রাজ্যের ধংসপ্রাপ্ত অবস্থায় প্রাচীন গ্রামসমাজও ভাগিয়া পড়িতেছিল। সাম্রাজ্যের ধংস যতই স্পষ্ট হইয়া উঠে, জায়গীরদার জমিদারদের কৃষক শোষণও ততই তীব্র হইয়া উঠে। সামাজ্যের জমিদারগণ খাজনা আদায়ের নামে কৃষকদের যথাসর্বস্ব লুটিয়া লইতে থাকে। খাজনা আদায়ের পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়িয়া যায়। পলাশীর যুদ্ধের পর হইতে বাংলা ও বিহরের কৃষকশোষণ ক্রমশ আরও ভয়ংকররপ ধারণ করে।
ইহার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও বিহারের কারিগরদের জীবনেও এক মহা দুর্যোগ নামিয়া আসে। পলাশীর যুদ্ধের পর এই দুর্যোগ আরও ঘনীভূত হইয়া কৃষকদের সহিত কারিগরদের জীবনেও বিপর্যয় আনিয়া দেয়। ইংরেজ বণিকেরা দেশীয় কারিগরদের তৈরী জিনিসপত্র নামমাত্র মূল্যে অথবা কাড়িয়া লইয়া ইউরোপের বাজারে চালান দিয়া বিপুল মুনাফা লুটিয়া লইতে থাকে। ইংরেজ বণিকগণ এরুপ অসমান ও পীড়ণমূলক চুক্তিদ্বারা বস্ত্র প্রভৃতি জিনিসপত্র সরবরাহ করিতে কারিগরদের বাধ্য করিত যে তাহারা প্রায় কীতদাসের অবস্থায় পরিণত হইতেছিল। বহু, কারিগর বস্ত্রবয়নের পক্ষে অপরিহার্য নিজ নিজ বৃদ্ধাঙ্গগুষ্ঠ কাটিয়া ফেলিয়া বণিকদের অসহনীয় উৎপীড়ণ এড়াইবার চেষ্টা করিত। ব্যবসায়ের নামে এই লুণ্ঠন ও ইংরেজ বণিকের অমানুষিক উৎপীড়ণে বাংলা ও বিহারের কারিগরগণ কর্ম ও বাড়িঘর ছাড়িয়া পলাইতে লাগিল। ১৭৫৮ হইতে ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দে—এই ছয় বৎসরে কৃষকদের সঙ্গে কারিগরদেরও একটা বিরাট অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। ইংরেজ লেখক রোজিনাল্ড রেনল্ডস-এর মতে, ঐ সময়ের মধ্যে ঢাকার জগদ্বিখ্যাত মসলিনের এক-তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-উৎপীড়ণে অস্থির হইয়া বনে-জঙ্গলে পলায়ন করিয়াছিল।/১৯।
পুরাতন গ্রাম-সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপ হইতে বহির্গত কৃষক ও কারিগরগণ ইংরেজ শাসকদের অভূতপূর্ব শোষণ ও সর্ব ব্যাপক ধ্বংসক্ৰিয়ার ঘৃর্ণাবর্তে পড়িয়া দিশাহারা হইয়া গেল। তাহারা এতদিন যে উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করিয়া আসিতেছিল তাহা বিলুপ্ত হইতেছিল। বাঁচিবার আর কোন উপায় তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইল না। সেই সময় সমাজের মধ্যেও এমন কেহ ছিল না, যে এই বিপুল সংখ্যক জমিহারা কৃষক ও বেকার কারিগরগণকে পথ দেখাইবে, তাহাদের সংগঠিত করিয়া ও চেতনা দিয়া অনিবার্য ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিবে। উপায়ান্তর না দেখিয়া তাহাদের একাংশ পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি-ডাকাতি আরম্ভ করিল। এতদিন সমাজে চুরি-ডাকাতি ছিল প্রায় অজ্ঞাত, ইহা ছিল চরম দণ্ডের যোগ্য অপরাধ। কিন্তু, এই নূতন বণিক শাসকগোষ্ঠী নিজেরাই
সবচেয়ে বড় ডাকাত, সবচেয়ে বড় লুণ্ঠনকারী। তাহারা তাহাদের সর্বগ্রাসী শোষণ ও মুনাফার লোভ মিটাইতে গিয়া তাহাদের শাসনাধীন প্রজাগণকেও প্রাণ বাঁচাইবার উপায় হিসাবে চুরি-ডাকাতির পথ দেখাইল। নতুন বণিক-শাসনে ইহা ব্যতীত বাঁচিবার অন্য কোন উপায় বাংলা-বিহারের কৃষক ও কারিগরগণ খুজিয়া পাইল না।
কিন্তু, তাহারা শীঘ্রই বুঝিতে পারিল, সাধারণ চুরিডাকাতি দ্বারা প্রাণ বাঁচান অসম্ভব। পাড়া প্রতিবেশীদের অবস্থাও সমান শোচনীয়, সকলেরই এক অবস্থা। বনসম্পদ ও খাদ্য ছিল জমিদার, জায়গীরদার, ধনী ও ব্যবসায়ীদের ঘরে, আর ছিল ইংরেজ বণিকদের কুঠি কাচারিতে। দেশের ধনসম্পদ ও খাদ্যের প্রায় সকল অংশই প্রথমে উঠিত ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুঠিকাচারিতে, তাহার পর সেখান হইতে চালান দেওয়া হইত ইংল্যান্ডে, ইউরোপে। এই ইংরেজ বণিকদের গুদামে মজুদ শস্য এবং জমিদার জায়গিরদার-মহাজনদের ঘরের ধনসম্পদ কাড়িয়া লইতে না পারিলে বাঁচিবার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু, তাহা কাড়িয়া লইবার জন্য দলবদ্ধ হওয়া চাই, আর চাই অস্ত্র। কৃষক ও কারিগরগণের বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, এই শাসকদের অস্ত্রশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লইলে বাঁচিবার কোন উপায় নাই।
সমগ্র বিহার ও বাংলাদেশে স্বতস্ফূর্তভাবেই জমিহারা কৃষক ও বেকার কারিগরদের অসংখ্য ছোট ছোট সশস্ত্র দল গড়িয়া উঠিল। এই দুই প্রদেশ জুড়িয়া আরম্ভ হইল ইংরেজ বণিকদের কুঠি-কাচারি এবং জমিদার ও ধনীদের গৃহের উপর আক্রমণ। আক্রমণকারীরা ইহাদের নিকট হইতে সকল ধনসম্পদ, মজুদ খাদ্য কাড়িয়া লইতে লাগিল । বিভিন্ন স্থানে শাসক ও জমিদারদের সহিত সশস্ত্র কৃষক দলের সংঘর্ষ চলিল। এইভাবে আরম্ভ হইল বিদেশী শাসকগণের বিরুদ্ধে বিহার ও বাংলার কৃষক ও কারিগরগণের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম স্তর। কিন্তু ইহা অপেক্ষা উন্নত ধরনের সংগঠিত সংগ্রাম পরিচালন করা ইহাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই । তাহার জন্য প্রয়োজন অপেক্ষাকৃত উন্নত চেতনা, অভিজ্ঞতা ও সমাজের অন্যান্য শ্রেণীশক্তির সহিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু তাহা তখনও কৃষক ও কারিগরগণের মধ্যে দেখা দেয় নাই। কারণ, তাহারা এতদিন ছিল একটা অতি পুরাতন, ক্ষয়িষ্ণু সমাজের খোলসের মধ্যে আবদ্ধ। সেই সমাজের খোলসের মধ্যে থাকিয়া উন্নত চেতনা ও অভিজ্ঞতা লাভ করা এবং বাহিরের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কৃষক ও কারিগরগণের এই সংগ্রাম অবিলম্বে সমাজের অন্য দুইটি সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ইহাদের একটি হইল বিহার ও বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী সন্নাসী ও ফকিরচাষীদের সম্প্রদায়, এবং অপরটি হইল মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর বেকার সৈন্যগণ। সন্নাসী ও ফকির চাষীরাও কৃষক হিসাবে জমিদার ও ইংরেজ বণিকরাজের শোষণ-উৎপীড়নের জালায় অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল, তাহারাও তখন আত্মরক্ষার পথ খুজিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকগণ নানাবিধ কর বসাইয়া তাহাদের তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মানুষ্ঠান অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছিল। সুতরাং বিদেশী শাসকগণের কবল হইতে জীবিকা ও ধর্মরক্ষার জন্য তাহারা বিদ্রোহী কৃষক ও বুভুক্ষু, সৈন্যগণও জীবিকার অন্য কোন উপায় খুজিয়া না পাইয়া কৃষক-কারিগরগণের এই সংগ্রামে যোগদান করিল।
লেস্টার হাচিন্সনের মতে, সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ, সংগ্রামী কৃষক ও কারিগরদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল বিদেশীদের কবল হইতে দেশের মুক্তিসাধন ও ধর্ম রক্ষার আদর্শ, তাহাদের শিক্ষায় দেশের মুক্তি সাধন পরম ধর্ম, আর পরাধীন জাতির মুক্তির জন্য সর্বস্বত্যাগ দেশমাতৃকার প্রতি অচল ভক্তি, অন্যায়ের বিনাশ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ এবং প্রবল বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে দেশবাসীর ঐক্য গঠন—এই সকল হইল সেই পরম ধর্ম পালনের শ্রেষ্ঠতম পন্থা। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখিয়াছেন “ঢাকার রমনার কালিবাড়ির মহারাষ্ট্রীয় স্বামীজী নাকি বলিতেন, সন্ন্যাসী যোদ্ধারা ও বন্দেমাতরম এই রনধ্বনি করিত।” রমনা কালিবাড়ির মহারাষ্ট্রীয় স্বামীজীর কথা সত্য হইলে হাচিন্সনের ধারণা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য।
কৃষক-কারিগর এবং সন্ন্যাসী-ফকির চাষীদের মিলিত বাহিনীতে ভূতপূর্ব সৈন্যগণ তাহাদের দীর্ঘকালের সামরিক অভিজ্ঞতা লইয়া যোগদান করিবার ফলে বিদ্রোহীদের মধ্যে যথাসম্ভব সামরিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হইল এবং তাহাদের রণনৈপুন্য ও বৃদ্ধি পাইল । কৃষক-কারিগরদের স্বতঃস্ফূত ও খন্ড খন্ড বিদ্রোহ এবার এক একটি বিস্তর্ণ অঞ্চল জুড়িয়া সঙ্গবদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহের আকারে দেখা দিল।
কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে বিহার ও বঙ্গদেশের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ জুড়িয়া একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন, একটি মাত্র পরিচালনা-কেন্দ্র একটি বাহিনী, একটি উদ্দেশ্য ও একটি মাত্র পরিকল্পনা লইয়া এই বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়াছিল। তাহা হয় নাই, এবং তখনকার অবস্থায় তাহা সম্ভবও ছিল না । দেশের তৎকালীন অবস্থায় যাহা সম্ভব ছিল তাহাই হইল, এই অবস্থায় বিরাট ভূখন্ডের এক একটি অংশের এক একজন নায়ক বিদ্রোহী কৃষক ও কারিগরদের সংগঠিত এবং স্বদেশভক্তি ও ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত করিয়া বিদেশী বণিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হইলেন । এইভাবে বাংলা ও বিহারের এক একটি অঞ্চলে দণ্ডায়মান হইলেন মজনু শাহ, মুশা শসহঃ, চেরাগআলি, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, কৃপা নাথ, নুরুল মহম্মদ, পীতাম্বর অনুপ নারায়ণ, শ্রীনিবাস প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ।
এই বিদ্রোহে মজনু শাহ বা মজনু ফকিরের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আজ বিদ্রোহী নায়কের পূর্ণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। এই কাহিনীতে আমরা তাহাকে কখনো দেখি সৈন্য-সংগ্রহকারী রূপে, কখনও দেখিব প্রধান সেনাপতিরূপে, কখনো বা দেখিব তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ ও বিহারের বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীদের সংঘবদ্ধ করিতে ব্যস্ত। তিনি যে বিদেশী ইংরেজ-শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক ও কারগরদের সহিত দেশে বিভিন্ন শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া এক অখন্ড শক্তি গড়িয়া তুলবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছেন তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন এই বিদ্রোহের প্রাণ-স্বরুপ, এই বিদ্রোহের প্রধান নায়ক ও সংগঠক। সমগ্র বিহার ও বঙ্গদেশের জনগণের নিকট তিনি পরিচিত ছিলেন মজনু ফকির নামে। বিহারের পশ্চিম প্রান্ত হইতে বাংলার পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়া ঘুরিয়া তিনি বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করিবার ও একটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিচালনাধীনে আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন বলিয়া সমগ্র বিহার ও বঙ্গদেশের মানুষ তাঁহাকে চিনিয়াছিল এই বিদ্রোহের প্রধান নায়করূপে।
এইভাবে সন্ন্যাসী ও ভূতপূর্ব সৈনিকদের নেতৃত্বে বিহার ও বাংলার জমিহারা গৃহহারা কর্মহারা কৃষক ও কারিগরগণ চুরি ডাকাতির পথ ছাড়িয়া বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হইল । বিহার ও বাংলার এক একটি অঞ্চলে ভারতের প্রথম কৃষক-বিদ্রোহের আগুন জালিয়া উঠিল, সশস্ত্র কৃষক ও কারিগরগণ বিদ্রোহের পতাকা উড়াইয়া ইংরেজ বণিক শাসন ও শোষণের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আক্রমণ আরম্ভ করিল।
বিদ্রোহের কাহিনী প্রথম পর্ব (১৭৬৩-৬৯)
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রথম আঘাত ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ইংরেজ কুঠির উপর সেই সময় কলিকাতার পরেই ছিল ঢাকার কুঠির স্থান। ইংরেজ বণিকেরা ঢাকার কুঠিটাকে কেন্দ্র করিয়া ঢাকা শহর ও উহার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলিন বস্ত্র নির্মাণকারী কারিগরদের নিকট হইতে নামমাত্র মূল্যে মসলিন ও কেলিকো বস্ত্র কাড়িয়া লইত। তাহারা অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় বিনামূল্যে যত বেশী সম্ভব এই সকল বস্ত্র সরবরাহ করিবার জন্য বলপূর্বক কারিগরদিগকে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিতে বাধ্য করিত। কোন কারণে সেই চুক্তি ভঙ্গ করিলে কারিগরদের উপর তাহারা অমানুষিক নির্যাতন চালাইত এবং তাহাদিগকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিত। কারিগরগণ বস্ত্রবয়নের পক্ষে অপরিহার্য বৃদ্ধাঙ্গুলী কাটিয়া ও সেই চুক্তি হইতে অব্যাহতি পাইত না। এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করিতে না পারিয়া বহু কারিগর বনে-জঙ্গলে পলায়ন করিয়াছিল।
সম্ভবত কোন সন্ন্যাসী বা ফকির নায়ক এই কারিগরদের সংঘবদ্ধ করিয়া ইংরেজ বণিকদের লণ্ঠনের কেন্দ্র এই ঢাকার কুঠিটাকে নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলিবার উদ্দেশ্যে ইহার উপর আক্রমণ করিয়াছিল। বিদ্রোহীরা রাত্রির অন্ধকারে কুঠির চতুর্দিকে নিঃশব্দে সমবেত হইয়া, রমনার কালিবাড়ির মহারাষ্ট্রীয় স্বামীজীর মতে ও বন্দেমাতরম এই রনধ্বনি করিতে করিতে কুঠি আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণে কুঠির ইংরেজ বণিকগণ ভয়ে এরূপ অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল যে আক্রমণকারীদের বাধা দিবার কিছুমাত্র চেষ্টা না করিয়া তহারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাইবার জন্য সমস্ত ধন-সম্পদ ফেলিয়া কুঠির পেছন দিয়া অন্ধকারে নৌকাযোগে পলায়ন করে। কুঠির সিপাহী-শাস্ত্রীরা সাহেবদের পূর্বেই পলায়ন করিয়াছিল। তখন ক্লাইভ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বড় কর্তা। তিনি কুঠির সাহেবদের এই কাপুরুষতায় ক্রদ্ধ কইয়া কুঠির পরিচালনাক রালফ লিস্টারকে পদচ্যুত করেন। বিদ্রোহীরা ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কুঠি অধিকার করিয়া থাকে। ঐ মাসের শেষ দিকে ক্যাপ্টেন গ্রান্ট নামক একজন ইংরেজ সেনাপতি বহু সৈন্য ও অস্ট্রশস্ত্র লইয়া ঘোরতর যুদ্ধের পর পুনরায় কুঠি দখল করেন।
বিদ্রোহীদের দ্বিতীয় আক্রমণ হয় রাজশাহী জেলার রামপুরবোয়ালিয়ার ইংরেজ কুঠির উপর। ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে তাহার কুঠির সমস্ত ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া চলিয়া যায়। কুঠির পরিচালক বেনেট সাহেব বিদ্রোহীদের হস্তে বন্দী হন। বিদ্রোহীরা তাঁহাকে পাটনার কেন্দ্রে প্রেরণ করে। সেখানে তিনি বিদ্রোহীদের হস্তে নিহত হন। ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দে বিদ্রোহীরা আবার রামপুর-বোয়ালিয়ার কুঠি আক্রমণ করিয়া ইংরেজ বণিক ও স্থানীয় জমিদারদের সকল সম্পত্তি লণ্ঠন করে ।
এদিকে কোচবিহার রাজ্যে গদি লইয়া উক্ত রাজ্যের সেনাপতি রুদ্রনারায়ণ ও রাজবংশের উত্তরাধিকারীর মধ্যে এক তীব্র দ্বন্দ আরম্ভ হয়। ইংরেজদিগকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধার প্রতিশ্রুতিতে রুদ্রনারায়ণ তাহাদের সাহায্য প্রার্থনা করিলে কোচবিহার দখলের উত্তম সুযোগ বুঝিয়া ইংরেজগণ লেফটানান্ট মরিসনের নেতৃতেত্ব একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। কোচবিহার রাজ্যে প্রকৃত উত্তরাধিকারী অনন্যোপায় হইয়া ইংরেজদের এই অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের বিদ্রোহীদের সাহায্য প্রার্থনা করিলে তাহারা ইংরেজ বাহিনী পৌছিবার পূর্বেই কোচবিহার অধিকার করে। ১৭৬৬ খৃস্টাব্দে দিনহাটা নামক স্থানে সন্ন্যাসী নায়ক রামানন্দ গোসাই-এর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর সহিত লেঃ মরিসনের বাহিনীর এক প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ইংরেজ বাহিনীর তুলনায় অল্প এবং তাহাদের অস্ত্র-শস্ত্রও নিকৃষ্ট । সুতরাং এই যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হইয়া পশ্চাৎ অপসরণ করিতে বাধ্য হয়। দুইদিন পর বিদ্রোহীরা আটশত সৈন্য লইয়া মরিসনের বাহিনীর সম্মুখীন হয়। কিন্তু এবারও তাহারা ইংরেজ বাহিনীর কামানের সম্মুখে দাঁড়াইতে না পারিয়া পশ্চাৎ অপসরণ করে। সম্মুখ যুদ্ধে প্রবল শত্রুকে পরাজিত করা অসম্ভব বুঝিয়া তাহারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে। বিদ্রোহীরা পরাজিত হইয়া ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া ইংরেজ সৈন্যগণ তাহাদের চারিদিকে অনুসন্ধান করিতে থাকে। কিন্তু, ইংরেজ সৈন্যগণ গ্রামে প্রবেশ করিবামাত্র ছদ্মবেশী বিদ্রোহীরা গ্রামবাসীদের সাহায্যে তাহাদের নির্মল করিয়া ফেলে। এই কৌশলে শত্রুকে দুর্বল করিয়া অবশেষে চারিশত বিদ্রোহী সৈন্য মরিসনের প্রধান বাহিনীর সম্মুখীন হয়। ১৭৬৬ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসের শেষ দিকে এক ভীষণ যুদ্ধে মরিসনের বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়। ১৭৬৬ খৃষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবরের পত্রে ক্যাপ্টেন রেনেল এই যুদ্ধের নিম্ন রূপ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেনঃ
আমাদের অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনী অধিকদূর অগ্রসর হইয়া গেলে শত্রুরা অকস্মাৎ গোপন স্থান হইতে বহির্গত হইয়া মুক্ত তরবারী হস্তে আমাদের ঘিরিয়া ফেলে, মরিসন অক্ষত দেহেই পলাইতে সক্ষম হন। আমার ভাই সেনাপতি রিচার্ড সামান্য আহত হইয়া প্রাণ লইয়া পলাইয়া যায়। আমার আর্মেনীয় সহকর্মী নিহত হয় ও.. অ্যাডিজুটান্ট সাংঘাতিকরূপে আহত হয়। তরবারীর আঘাতে আমার দুইটি হাতই অকর্মণ্য হওয়ায় আমার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে।
ক্যাপ্টেন রেনেলের এই স্বীকারোক্তি বিদ্রোহীদের রনকুশলতা ও চতুরতারই সাক্ষ্য দেয় ।
১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম কেন্দ্র বিহারের পাটনার পাশ্ববর্তী অঞ্চলেও একটা বড় বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনী, পাটনার ইংরেজ কুঠি ও ইংরেজদের স্থানীয় অনুচর জমিদারগোষ্ঠীর ধনসম্পদ লণ্ঠন করিয়া ইংরেজ শাসকদের রাজস্ব আদায় বন্ধ করিয়া দেয়। ইহার ফলে শাসকদের মধ্যে ভীষণ ত্রাসের সৃষ্টি হয়। বিহারের সারেঙ্গী (বর্তমান সারন) জেলায় পাঁচ হাজার বিদ্রোহী সেনা সংগঠিতভাবে আক্রমণ আরম্ভ করে। দুইটি সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের উচ্ছেদের জন্য সারেঙ্গি জেলায় উপস্থিত হইলে বিদ্রোহীদের সহিত তাহাদের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়। প্রথম যুদ্ধেই ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হইয়া আশিটি মৃতদেহ ফেলিয়া পলায়ন করে। এই যুদ্ধের পর বিদ্রোহীরা সারেঙ্গি জেলার হুসিপুরে দুর্গ অধিকার করে। কিন্তু, কয়েকদিনের মধ্যেই ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপ্টেন উল্ডিংয়ের নেতৃত্বে কামানসজিত এক বিরাট বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পরাজিত হইয়া বিদ্রোহীরা দূর্গ হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বিদ্রেহীরা হিমালয়ের পাদদেশের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে আসিয়া সমবেত হয়। তখন হইতে উত্তরবঙ্গে হইল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান ঘাঁটি। ইংরেজদের সহিত যুদ্ধ আসন্ন বুঝিয়া বিদ্রোহীরা জলপাইগুড়ি জেলায় একটি দুর্গ নির্মাণ করে। দুর্গটিকে মাটির প্রাচীর দিয়া এবং ইহার চতুর্দিকে গড়খাই (ষ্ট্রেন্চ) কাটিয়া সুরক্ষিত করা হয়/৩১। (এই প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান)। ১৭৬৬ খৃস্টাব্দে উত্তরবঙ্গ ও নেপালের সীমান্তে ইংরেজবণিকদের প্রতিনিধি মার্টেল সাহেব বহু লোকজনসহ কাঠ কাটিতে গেলে বিদ্রোহীরা, তাহাদের সকলকে বন্দী করে। পরে তাহাদের বিচার করিয়া প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এই সংবাদ পাইয়া একদল সৈন্যসহ ক্যাপ্টেন ম্যাকাঞ্জি আসিলেন বিদ্রোহীদের দমনকরিতে। শত্রুর শক্তি দেখিয়া বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পলাইয়া যায়। সেনাপতি ম্যাকাঞ্জি বিশেষ সুবিধা করিতে না পারয়া ফিরিয়া যান এবং ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে আরও বড় একটি সৈন্য বাহিনী লইয়া তিনি এই অঞ্চলে ফিরিয়া আসেন। বিদ্রোহীরা তখনও সম্পূর্ণ প্রস্তুত না হওয়ায় যুদ্ধ এড়াইয়া আরও উত্তরে সরিয়া যায়। কিন্তু তাহার শীতের প্রারম্ভেই পূর্ণোদ্যমে ইংরেজ বাহিনীর উপর আক্রমণ আরম্ভ করে। বিদ্রোহী বাহিনী রংপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তাহাদের উচ্ছেদ করিবার জন্য সেনাপতি লেঃ কিথ্ বহু সৈন্যসামন্তসহ ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর সহিত যোগদান করেন । শত্রুর শক্তি দেখিয়া বিদ্রোহীরা আবার পশ্চাদ অপসরণ করে। ইংরেজ বাহিনীকে আরো ভিতরে টানিয়া লইয়া যাওয়াই ছিল তাহাদের উদ্দেশ্য। ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে নেপালের সীমান্তে মোবাঙ্গ অঞ্চলে বিদ্রোহীরা তাহাদের সমস্ত শক্তি সংহত করিয়া ইংরেজ বাহিনীকে ধ্বংস করিয়া দেয়। সেনাপতি কিথ্ এই যুদ্ধে নিহত হয়/৩২।
বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
সন্ন্যাসী—বিদ্রোহ বিহার ও বঙ্গদেশ তথা ভারতের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। তৎকালে বিহার ও বঙ্গদেশের কৃষক প্রাচীন গ্রামসমাজের সংকীর্ণ গন্ডি হইতে বাহির হইবামাত্র এক ভয়ঙ্কর নতুন শত্রুর মুখোমুখী দাঁড়াইতে বাধ্য হয়। সুতরাং সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বুলিয়া কিছু তাহাদের ছিল না। সংগ্রামের অভিজ্ঞতাহীন কৃষকদের মধ্যে প্রচন্ড বিক্ষোভ পুঞ্জিভূত হইয়া স্বতঃস্ফূতভাবেই বিদ্রোহের আকারে দেখা দেয়। কিন্তু কোন ব্যপার গণ-বিদ্রোহের সফলতার জন্য যে আদর্শ ও লক্ষ্যে যে নেতা যে সংগঠন ও সংগ্রামী অভিজ্ঞতা অপরিহার্য, তাহার কোনটাই বিদ্রোহীদের ছিল না, আর তৎকালীন এ সামাজিক অবস্থায় তাহা সম্ভবও ছিল না। দেশভক্তিমূলক বন্দে মাতারম রনধ্বনি তাহাদের মুখে শুনা গেলেও সেই দেশভক্তি ছিল সীমাবদ্ধ ও লক্ষ্যহীন। যে অগণিত খন্ড বিদ্রোহ বিহার ও বঙ্গদেশের বিশাল অঞ্চল ব্যাপিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা দিয়াছিল, সেইগুলিকে একটা ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানরূপে গড়িয়া তুলিবার প্রয়াস মজনু শাহ প্ৰভৃতি কয়েকজন বিদ্রোহী নায়কের মধ্যে দেখা গেলেও এই বিরাট কর্তব্য সম্পাদন করা তাঁহাদের সাধ্যাতীত ছিল, সেই বিরাট দেশজোড়া অভ্যুত্থানের সংগঠন ও পরিচালনার জন্য যে আদর্শ, লক্ষ্য, সংগ্রামী ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, তাহা সন্যাসী ও ফকির নায়কগণের কাহারও ছিল না। এই বিদ্রোহ স্বত-স্ফুর্তভাবে খন্ড খন্ড আকারে চলিবার ফলে ইহার পরিচালকগণের মধ্যে আদর্শ ও লক্ষ্যের ঐক্য গড়িয়া উঠে নাই। শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব ও ধর্মীয় ব্যাপার লইয়া অন্তদ্বন্দের ফলে বিদ্রোহের সমস্ত শক্তি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া প্রবল পরাক্রান্ত ইংরেজ শাসনের উন্নত সামরিক শক্তির আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়।
ভারতীয় কৃষকের এই প্রথম ও অপরিণত বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইলেও ইহা ভারতের কৃষক ও জনসাধারণের ভবিষ্যত কালের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের একটি নতুন পথের ইঙ্গিত দিয়া গিয়াছে। ইংরেজ শাসনের পূর্বে পাঠান এবং মোগল শাসনকালেও কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামের অসংখ্য কাহিনী ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়াইয়া রহিয়াছে । কিন্তু সেই সকল সংগ্রাম ছিল একান্ত ভাবেই স্থানীয় গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সন্যাসী বিদ্রোহের মধ্য দিয়াই সর্বপ্রথম ভারতের কৃষক বিশাল অঞ্চল (সমগ্র পূর্ব ভারত) ব্যাপিয়া একটা বিদ্রোহের আকারে শাসকগোষ্ঠীর সহিত শক্তির দ্বন্দে অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং ব্যর্থতার মধ্য দিয়া সংগ্রামের মুল্যবান অভিজ্ঞতার বিপুল ভাণ্ডার ভবিষ্যতের সংগ্রামী কৃষকের হাতে তুলিয়া দিয়া গিয়াছে।
সন্ন্যাসী–বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হইলেও ইহার প্রভাব দীর্ঘকাল ধরিয়া ভারতের বিশেষত বাংলার জনসাধারণকে বৈপ্লবিক সংগ্রামের প্রেরণা যোগাইয়াছে।ইহার একশত বৎসর পরে বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসবাদি সংগ্রাম দেখা দিয়েছিল বহু দিক হইতে এই সন্ন্যাসী বিদ্রোহই ছিল তাহার এক অগ্রদূত।
তথ্য পুঞ্জী
1. Md. Hossein Fdomi: Dobistan.
2. G. H. Khan: Siyar-ul-Mutakherin এবং Calendar of Persian Correspondence.
৩। বেশীর ভাগ সন্ন্যাসী, বিশেষত নাগা ও শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত সন্যাসীরা কৌপীন এবং ফকিরের রঙ্গিন আলখাল্লা পরিধান করিত।
4. Karl Marx: Future Results of British Rule in India (Selected works) P-663.
5. Gleig : Memoirds to Warren Hastings P–28.
6. G. B. Malleson: Life of Warren Hastings P-41.
7. Sanyasi and Fakir Raiders of Bengal.
8. Dawn of New India.
9. Letter from the supervisor of Purnea to the council of Revenue ot Murssidabad dated 25th June 1770 এবং এই ধরনের আরও বহু, পত্র উল্লেখযোগ্য ১০। দৃষ্টান্তস্বরুপ Letter from the Supervisor of Natore to the Council of Revenue dated 25th Jan 1772. 11. Edward Thomson & G. T. Garrat: Rise and Fulfilment of British in India P-127. 12. W. W. Hunter: Annals of Rural Bengal P–70।
১৩। ইহাদের কথা এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করা হইয়াছে।
১৪। ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃঃ-৯১।
15. L.S.S.O. Malley: History of Bengal Bihar & Orissa under British rule P-107.
১৬। প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
17. Lester Hutchinson: The Empire of the Nabobs P-144. 18. Lester Hutchinson: The Empire of the Nabobs P-144.
19. Reginald Reynold: white Shahibs in India P-54.
20. Lester Hutchinson: Empire of the Nabobs P–122.
২১। ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ঃ ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃঃ-৯১।
২২। রেনল্ডস সাহেবের মতে এক-তৃতীয়াংশ কারিগর বনে পলাইয়াছিল (Reginall Reynolds: White Shahibs in India P–54) .
২৩। কেদারনাথ মজুমদারঃ ঢাকার বিবরণ, পূ ১১৫-১৬, যতীন্দ্র মোহন রায় ঃ ঢাকার ইতিহাস, পৃঃ ২১৮।
২৪। ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ? ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃ ৯১।
25. Dacca District Gazetter P–24.
26. Letter to the Revenue Board dated 5th Dec. 1763 (Longs Selection)
27. Letter to the Board af Revenue from the Collector af Rajshahi 19th May, 1763 (Logs Selection).
28. Capt. Rennels letter to the collector, 30th Oct. 1766 (Lougs Selection)
29. Letters & Records (Longs Selection P-526)
30. Ibid
31. Rennels Journal Feb 1766. 32. Ibid Jan 1770.
১৮। ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃঃ ১১।
99. Leste Hutchinson: The Empire of the Nabobs. P-92