You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.25 | তিনজন পাইলটসহ ভারতের এলাকায় তিনটি পাক বিমান ঘায়েল - সংগ্রামের নোটবুক

তিনজন পাইলটসহ ভারতের এলাকায় তিনটি পাক বিমান ঘায়েল

(দিল্লীর প্রতিনিধি) নয়াদিল্লী, ২৩ নভেম্বর—গতকাল ২৪ পরগনার বয়ড়ার কাছে ভারতের আকাশ সীমায় অনুপ্রবেশকারী তিনটি পাকিস্তানী স্যাবার জেট বিমানকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর চারটি ন্যাট বিমান গুলি করে নামিয়েছে। ভূপাতিত দু’টি বিমানের দুজন পাক বৈমানিক ধরা পড়েছে। এই পাক বৈমানিক দু’জনের নাম হল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহদী কুরেশী ও ফ্লাইং  অফিসার খলিল আমেদ। আজ লােকসভা ও রাজ্যসভায় সদস্যদের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রতিরক্ষা উৎপাদন মন্ত্রী শ্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা এই কথা জানান। পূর্বাহ্নে লােকসভায় জনসঙ্রে শ্রীঅটলবিহারী বাজপেয়ী ও শ্রীসমর গুহ (পি এস পি) সীমান্ত পরিস্থিত সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে প্রাত্যহিক বিবৃতি দাবি করেন। প্রতিরক্ষা উৎপাদন মন্ত্রী শ্রী শুক্লা। জানান, বড় বড় ঘটনা সম্পর্কে সংসদকে ওয়াকিবহাল রাখা হবে তবে প্রাত্যহিক বিবৃতি দেওয়া ঠিক হবে না। তার পরেই তিনি গতকালকের ঘটনা সম্পর্কে লিখিত বিবৃতি পাঠ করলে সদস্যরা সচকিত বিস্ময়ে হর্ষধ্বনি করে ওঠেন। পরে রাজ্যসভায়ও এই ঘােষণা করা হলে সদস্যা এই সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য বৈমানিকদের ও সরকারকে অভিনন্দন জানান।

রাজ্যসভার ভাইস চেয়ারম্যান সদস্যদের সহর্ষ ও সপ্রশংস মন্তব্যের সারমর্ম প্রকাশ করেন এই ভাষায় ঃ “এটা একটা আনন্দের খবর। সরকার বৈমানিক ও যারা ন্যাট তৈরী করেছেন, তাঁদের সকলকে আমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।” | সিন্ডিকেট কংগ্রেস সদস্যও রাজ্যসভায় বিরােধী পক্ষের নেতা শ্রীগুরুপদস্বামী বলেন যে, বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি ও যথােপযুক্ত সাহায্য দিয়ে আমাদের সংহতি ও সমর্থন প্রকাশ করার সময় এসেছে।” | কমিউনিষ্ট নেতা শ্রীভুপেশ গুপ্তও বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানাবার প্রয়ােজনীয়তার উপরে বিশেষ জোর দেন। | নির্দল সদস্য শ্রী ডি এন সেনগুপ্ত জানতে চান, পূর্বাঞ্চলে অসামরিক প্রমাণ্য সূত্র থেকে পরে বলা হয়েছে যে, তৃতীয় স্যাবার জেটটির বৈমানিকও বন্দী হয়েছে, কিন্তু তার নাম ঠিকানা জানা যায় নি। | ভারতীয় বিমান বাহিনীর যে তিনজন বীর বৈমানিক ভারতে নির্মিত ন্যাট বিমানের সাহায্যে মার্কিন স্যাবার জেট বিমান ভূপাতিত করেন তাঁরা হলেন ? ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আর ম্যাসে ফ্লাইট লেঃ এম এ ও ফ্লাইং অফিসার ভি ল্যাজারাস।

 লােকসভা ও রাজ্যসভার সমস্ত দলের সদস্যরা অনুপ্রবেশকারীদের উপযুক্তভাবে মােকাবিলা করার জন্য এই দৃঢ় ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ভারত সরকার ও বৈমানিকদের অভিনন্দন জানান। রাজ্যসভায় কমিউনিষ্ট নেতা শ্রীভুপেশগুপ্ত প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যভাবে বাঙলা দেশের মুক্তি যুদ্ধকে সাহায্য করার প্রয়ােজনীয়তার উপরে বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানী বিমানের এই অনুপ্রবেশ যে কোনও উপায়ে জাতিসংঘকে একটা ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য করানাের পরিকল্পনারই একটা অঙ্গ বলে মনে হয়। আজ লােকসভায় শ্রী শুক্লা মধ্যাহ্ন ভােজের বিবৃতির ঠিক আগে পাকিস্তানী বিমানের অনুপ্রবেশ ও তিনটি পাক বিমানকে ঘায়েল করার সংবাদ জানান। গতকাল বেলা ২-৪৯ মিনিটে কলকাতা থেকে প্রায় ৪৮ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত বয়ড়ার কাছে চারটি পাকিস্তানী স্যারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তারা ভারতীয় আকাশ সীমার ৫ কিলােমিটার গভীরে প্রবেশ করলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর চারটি ন্যাট বিমানকে আদেশ দেওয়া হয় প্রতিরােধ করার জন্য। ভারতীয় বিমান চারটি পাক বিমানের অনুপ্রবেশের দশ মিনিটের মধ্যে সফলভাবে তাদের বাধা দেয় ও তাড়িয়ে দেয়। এই সময়ে যে বিমান যুদ্ধ হয় তাতে চারটি স্যাবারের মধ্যে তিনটি গুলিবিদ্ধ ও ভূপাতিত হয়। ভারতীয় ন্যাট বিমানের কোন ক্ষতি হয়নি। | মন্ত্রী আরাে জানান, পাকিস্থানী বৈমানিকরা প্যারাসুটের সাহায্যে বিমান থেকে বের হয়ে নেমে 

আসে। তাদের মধ্যে দুজনফ্লাঃ লেঃ পারভেজ মেহদীও ফ্লাঃ আঃ খলিল আমেদ এখন ভারতের হাতে বন্দী।” পরে রাজ্যসভায়ও একই কথা ঘােষণা করা হয়। | নাগরিকদের আকাশ পথে আক্রান্ত হবার বিপদ রােধ করার যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা। জবাবে শ্ৰীশুক্লা বলেনঃ “আমরা আমাদের অসামরিক জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছ। সেখানে কোনও আতঙ্ক নেই এবং সীমান্ত এলাকার জনসাধারণ তাদের নিত্য কর্তব্য স্বাভাবিকভাবেই করে যাচ্ছে”। | লােকসভায় শ্রীশুক্লা বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা অঘােষিত যুদ্ধ চলছে”—একথা বলা সম্পূর্ণ ভুল হবে। সংঘাত চলছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক আর বাঙলাদেশের জনগণের মধ্যে। পাকিস্তান এই সংঘাতকেই অঘােষিত যুদ্ধ বলে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক করে তুলতে ও জাতিসংঘকে দিয়ে হস্তক্ষেপ করাতে চাইছে। শ্রীশুক্লা সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানী প্রচার ও কুৎসার শিকার না হবার জন্য আবেদন জানান। | তিনি আরাে জানান যে, যে কোনও পাকিস্তানী অনুপ্রবেশ রােধ, পাকিস্তানী কামান বর্ষণকে স্তব্ধ করা, ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী পাক বিমানকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী রয়েছে। | শ্ৰীশুক্লা বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে সংবাদের জন্য আমরা বাঙলাদেশ সরকারের উপরে নির্ভর করি। আমাদেরও সংবাদ সংগ্রহের নিজস্ব সূত্র আছে। এবং কোনও বড় ধরনের বা গুরুতর ঘটনা ঘটলে সে সম্পর্কে পার্লামেন্টকে জানাতে আমরা আদৌ দ্বিধা করব না।”

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ গতকাল বয়ড়ার উপরে আকাশে পাক-বিমানের অনুপ্রবেশ ও বিমান যুদ্ধের প্রত্যক্ষ দর্শীর বিবরণ দিয়ে কলকাতা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেনঃ পাকিস্তানের চারটি স্যাবার জেট বিমান আকাশসীমা লঙ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিমান বিধ্বংসী কামানগুলি গর্জে ওঠে কামানের গােলার আঘাতে একটি বিমানে আগুন ধরে যায় ও সেটি জ্বলতে জ্বলতে পূর্বদিকে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখা যায় । ইতিমধ্যে চারটি ভারতীয় ন্যাট বিমানও পাকিস্তানী বিমানগুলিকে বাধা দিতে এগিয়ে এসেছিল। এর পরে প্রায় দশ মিনিট ধরে চলে ‘ডগ ফাইট’—বিমান যুদ্ধ। দু তরফ থেকেই রকেটের সাহায্যে পরস্পরকে আঘাত করার চেষ্টা হচ্ছিল। লড়াই শুরু হয়েছিল প্রায় হাজার পাঁচ ফুট উঁচুতে—তা এক সময় প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় গিয়ে পৌছায়। এরপর দুটি পাক স্যাবার ভারতীয় ন্যাটোর রকেটের আঘাতে ঘায়েল হয়। তারপরই দেখা যায় ঘায়েল বিমান দু’টি থেকে দুজন পাক বৈমানিককে প্যারাসুটের সাহায্যে নেমে আসতে। অবশিষ্ট বিমানটি পূর্বদিকে পাক অধিকৃত বাঙলাদেশের মধ্যে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানের স্বীকৃতি নয়াদিল্লী থেকে ইউ এন আই জানাচ্ছে, রেডিও পাকিস্তান তাদের বিমান বাহিনীর দুটি বিমান ভূপাতিত হয়েছে, তা স্বীকার করেছে। তবে সেই সঙ্গে দাবি করেছে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী নাকি ২টি ন্যাট বিমান ধ্বংস করেছে। রাওয়ালপিণ্ডিতে পাক সরকারী মুখপাত্রের বয়ানে রেডিও পাকিস্তান বলেছে যে, তিনটি পাকিস্তানী বিমান যশােহর এলাকায় নিয়ম মাফিক টহলদারী “চালাবার সময় ৯ থেকে ১০টি ভারতীয় ন্যাট” নাকি  “পাকিস্তানী সীমান্তের মধ্যে তাদের আক্রমণ করে। পাকিস্তানী বিমান তিনটি নাকি দু’টি ন্যাট ধ্বংস করেছে এবং পাকিস্তানের দু’টি স্যাবার ফিরে আসেনি।”

সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৬

২৫ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯