পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম পর্যায় | বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা
ভূমিকা
ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসানের পর তৎকালীন পব বাংলায় শ্রমিক সংগঠন এ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে এই রচনাটি ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে লিখিত হয়েছিলো। তখন কার দিনে শ্রমিক আন্দোলনের সাংগঠনিক অবস্থা এবং মূল সমস্যাগুলোই এই রচনার বিষয়বস্তু।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর মধ্যে পূর্ব বাংলায় শ্রমিকের, সংখ্যা ছিলো দুই লক্ষ্যের কাছাকাছি। এই শ্রমিকদের মধ্যে চা শ্রমিক, রেল শ্রমিক, ডাক ও তার বিভাগে নিযুক্ত শ্রমিক, বন্দর শ্রমিক এবং সকল শ্রমিকরাই ছিলেন প্রধান। কারখানা শ্রমিক বলতে সে সময় প্রধানতঃ বোঝাতো সূতাকল শ্রমিকদের।
১৯৪৭–৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন পাটকল ছিলো না । আদমজীর কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছিলো। সুতাকলগুলোর সংখ্যা পাঁচ ছয়টির মতো ছিলো। তারমধ্যে কুষ্টিয়ায় মোহিনী মিল ও চট্টগ্রামের একটি সুতাকল ব্যতীত বাকি সবগুলোই ছিলো নারায়ণগঞ্জে। রাজশাহী জেলার গোপালপুরে একটি চিনি কল ছিলো। একটি সিমেন্ট কারখানা ছিলো সিলেট জেলার ছাতকে। মাএ এই কয়টি ব্যতীত সারা পূর্ব বাংলায় তখন প্রকৃতপক্ষে কোন শিল্প কারখানার অস্তিত্ব ছিলো না।
বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠন সম্পর্কে এখানে যে তথ্যগুলি উল্লেখ করা হয়েছে তার থেকেই বোঝা যাবে তৎকালে বাংলার পশ্চাদপদতা কতখানি গভীর ছিলো। সেই পশ্চাদপদ অর্থনীতিতে মেহনতি জনগণ বলতে কৃষিকার্যে নিযুক্ত লোকদেরকেই বোঝাতো। কারখানা শ্রমিক এবং অপরাপর ধরনের শ্রমিকদের রাজনৈতিক গুরুত্ব সেই অনুযায়ী অতি অল্পই ছিলো।
এই গুরুত্বহীনতার জন্য অবশ্য শ্রমিকদের সংখ্যাল্পতাই একমাত্র কারণ ছিলো না। তাঁদের অসংগঠিত অবস্থাও ছিলো এর অন্যতম প্রধান কারণ। রেল, ডাক-তার ও বন্দর শ্রমিকরা কৃষি কার্যেরত মেহনতিদের থেকে সংখ্যায় অল্প হলেও ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রয়োজনবোধে সাধারণ জীবন ব্যাহত এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন যদি তাঁরা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিতভাবে কোন কর্মসূচী গ্রহণ করতে সক্ষম হতেন। এ বিষয়টি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি এড়ায়নি। এ জন্য তারা প্রথম থেকেই শ্রমিক আন্দোলনে নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের মাধ্যমে খুব পরিচিত কতকগুলো পদ্ধতি অনুযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ এবং অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলো এবং তাতে সফলও হয়েছিলো।
রেল, সুতাকল, চা বাগান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শ্রমিক সংগঠনগুলোর অল্পবিস্তর প্রভাব ছিলো। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট নেতৃত্ব যে রাজনৈতিক লাইন এখানে অনুসরণ করেন তাতে সন্ত্রাসবাদের প্রাধান্য থাকায় কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন শ্রেণী সংগঠনগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সরকারী বিভেদ নীতি ও দমননীতির ফলে এই ভাঙ্গন দ্রুততর হয়।
কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শ্রমিক আন্দোলন থেকে কার্যতঃ বিলুপ্ত হওয়ার পর যে বুর্জোয়া নেতৃত্ব শ্রমিকদের উপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তার দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের কোন সমস্যারই সমাধান হয়নি। উপরন্তু দিন দিন তাদের অবস্থার অবণতিই ঘটেছিলো। এই কারণে শ্রমিকদের উপর শ্রেণীগতভাবে বুর্জোয়া নেতৃত্বের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই নেতৃত্বও ক্রমশঃ নানা দলে বিভক্ত হয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে টুকরো টুকরো করে চলেছিলো। এতে করে শ্রমিকদের মধ্যে একদিকে যেমন অসন্তোষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তেমনি অন্যদিকে সরকারও প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আস্থাও কমে আসছিলো।
১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এবং তার পর ১৯৫১ সালে সারা পূর্ব বাংলায় যে দূর্ভিক্ষাবস্থা সৃর্ষ্টি হয় তার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত মূল্য বুদ্ধির কারণে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অসন্তোষ মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিক্ষোভের রুপ পরিগ্রহ করে। এই রাজনৈতিক বিক্ষোভের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়।
১। শ্রমিক ফেডারেশনসমূহের উদ্ভব
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ ভারতবর্ষ দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে ভারত ও পাকিস্তানে ট্রেড ইউনিয়ন অন্দোলনকে নতুনভাবে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে বোম্বাইয়ে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এ আই টি ইউ সি) নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করেনঃ
“ভারতবর্ষ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার এবং তার থেকে উদ্ভূত সমস্যাবলীর প্রেক্ষিতে পাকিস্তান এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়নসমূহ যদি ইচ্ছা করেন তাহলে তাদেরকে একটি পৃথক কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা গঠনের জন্য সাধারণ কাউন্সিল অনুমতি দিচ্ছে এবং নিম্নলিখিতদেরকে নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিটি নিয়োগ করে তাদেরকে কো-অপের্ট করার ও যেভাবে তাঁরা সঠিক মনে করেন সেভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন পর্যালোচনার ও সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করছে পূর্ব বাংলা—কমরেডস এ এম মালেক, ফয়েজ আহমদ, মুহম্মদ ইসমাইল, নেপাল নাগ ও দীনেন সেন।
পশ্চিম পাঞ্জাব-কমরেডস ফজল এলাহী কুরবান, মীর্জা ইব্রাহিম ও রমেশ চন্দর।
সিন্ধু-কমরেডস নারায়ণ দাস বেচার, সবো ও জে বোখারী।
সাধারণ কাউন্সিলের এ বিষয়ে আস্থা আছে যে, একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত যদি গৃহীত হয়। তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের ট্রেড ইউনিয়নসমূহের সাধারণ অভিজ্ঞতার সমন্বয় সাধন ও পরষ্পরকে সাহায্যের জন্য একটি সংগঠনের ব্যবস্থা হবে। সাধারণ কাউন্সিল আরও ঘোষণা করছে যে, সিদ্ধান্ত যাই হোক, শ্রমিক শ্রেণীর সমাজতন্ত্রের সাধারণ লক্ষ্য অপরিবর্তীত থাকবে এবং দুটি রাষ্ট্রে ভারতবর্ষের বিভক্তি সেই শ্রমিকদের শ্রেণী ঐক্য এবং সংহতিকে আঘাত করবে না যারা এ আই টি ইউ সি-এর পতাকাতলে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রামকালে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী সম্পর্ক।”১
পূর্ব বাংলা গ্রুপের একটি সম্মেলন ২৭-২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। তাতে অন্যান্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন ডক্টর আবদুল মোত্তালেব মালেক, মারুফ হোসেন, নেপাল নাগ , দীনেন সেন, সমর ঘোষ, তাশ্বিনী দেব, অমতেন্দু মুখার্জী, মুহম্মদ ইসমাইল, অনিল বসাক, রাধাগোবিন্দ সরকার, সুশীল সরকার, আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ, সুলতান আহমদ এবং অধ্যাপক শিরদাস গাঙ্গুলী।২
এই সম্মেলনেই ২৮শে সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান(অস্পষ্ট) ইউনিয়ন ফেডারেশন (ই পি টি ইউ এফ) নামে একটি শ্রমিক ফেডারেশন গঠিত হয় এবং ডক্টর মালেক ও ফয়েজ আহমদ যথারীতি এর সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়া নির্বাচিত সহ-সভাপতি পদে নেপাল নাগ, মুহম্মদ ইসমাইল ও মোহন জমিদার এবং সহ-সম্পাদক পদে অনিল মুখার্জী ও গৌর বর্মন।৩
এই ফেডারেশনটিই ভারত বর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর বাংলার প্রথম শ্রমিক ফেডারেশন। শিল্প ও ব্যবসায়ী সমূহের শ্রমিকদের এটাই ছিল সে সময়ের সব থেকে প্রতিনিধি মূলক প্রতিষ্ঠান। দেশ বিভাগের ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও সেই সঙ্গে পূর্ব বাঙলার কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে সীমিত সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করায় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাঁরা সেই নীতি ও সরণ করেন এবং সরকারী শ্রমিক নেতা ও অন্যান্যদের সঙ্গে এক পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গঠন করেন। এ জন্যেই নেপাল নাগ, মারুফ হোসেন; দীনেন সেন, মুহম্মদ ইসমাইল, অনিল মুখার্জি প্রভৃতি কমিউনিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এই ফেডারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তার কর্মকর্তাও নির্বাচিত হন।
পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কার্যকলা কমিটির প্রথম বৈঠক ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে ডক্টর মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারেশন আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার ফলে এই বৈঠকে এ আই টি ইউ সি-এর থেকে আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করার জন্য আফতাব আলীকে অনুরোধ করা হয়।”৪ এই সময় ডিসেম্বর ১৯৪৭-এ দিল্লীতে এশীয় দেশগুলোর যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে ডক্টর মালেক মনোনীত হন। পাকিস্তান সরকার এই মনোনয়ন গ্রহণ করেন এবং সেই অনুযায়ী ডক্টর মালেক এবং তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নেপাল নাগ সেই দিল্লী সম্মেলনে যোগদান করেন।”৫ এ সময় আফতাব আলী পূর্ব বাংলার প্রথম ও একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আই এল ও (আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা)-এর গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হন।”৬
ডক্টর মালেক পূর্ব বাংলা সরকারের শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে ফেডারেশনের সভাপতি পদে ইস্তফা দানের পর ২৪শে অক্টোবর ১৯৪৮ তারিখে ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ডক্টর মালেকের ইস্তফাপত্র বিবেচনা সময় কমিটির বামপন্থী সদস্যের চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারে মন্ত্রী পদ থেকে ডক্টর মালেকের ইস্তফা দাবি করেন। অপর পায় ফয়েজ আহমদ বলেন যে, শ্রমিক আন্দোলনের সুবিধের জন্য ডক্টর মালেকের শ্রমমন্ত্রী পদে বহাল থাকা প্রয়োজন।
এই মতবিরোধের ফলে ভয়ানক তিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং কমিটি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কোন পক্ষ এ প্রশ্নে কোন রকম আপোষ করতে সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভোটাভোটি হয় এবং ফয়েজ আহমদরাই স্বল্প ভোটাধিকারে জয়লাভ করেন। এরপর বাম-পন্থীরা বৈঠক বর্জন করে বেরিয়ে যান।”৭
এরপর ১৯৪৯ এর ১৬ই মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যদের যারা নিয়ন্ত্রিত পূর্ব বাংলা রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ফেডারেশনের অনুমতি ব্যতীতই ধর্মঘটের নোটিশ দানের ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রেল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নিন্দা করেন এর ফলে ফেডারেশনের কমিউনিস্ট সদস্যের ফেডারেশন থেকে ইস্তফা দেন। কিন্ত না দিলেও তাঁরা কোন পার্টি ফেডারেশন গঠন করেন না। শেষে ১৩ই আগষ্ট, ১৯৪৯, তারিখে ফেডারেশনের সম্পাদক ফয়েজ আহমদ পূর্ব বাংলা রেল রোড় ওয়াকার্স ইউনিয়ন, ঢাকা জেলা সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিক্সাচালক ইউনিয়ন, বরিশাল বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন, ও অভ্যন্তরীণ লন্চ শ্রমিক ইউনয়ন (আইলেন্ড স্টীম নেভিগেশন ওয়াকার্স ইউনিয়ন) কে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করেন।”৮
*পূর্ব বাংলার ভাষা অন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
এই বহিঙ্কৃত ইউনিয়নগুলির প্রত্যেকটিই ছিলো কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উপলক্ষ্য যাই হোক, পূর্ব বাঙলা ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সঙ্গে কমিউনিস্টদের এই বিচ্ছেদের মূল কারণ ছিলো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মার্চ ১৯৪৮-এ গৃহীত নতুন রাজনীতিগত আইন ও কর্মসূচী। এই নতুন আইনের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের উভয় সরকারের প্রতিই কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববতী দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয় এবং তারা সরকারকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে তার সঙ্গে সকল সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করতে নিযুক্ত হন। শুধু তাই নয়। এ সময় তাঁরা সশস্ত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনার নীতি গ্রহণ করায় তাঁদের পক্ষে ব্যাপক ভিত্তিক গঠিত কোন ফেডারেশনের শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব হয় না।
৮ই ও ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ তারিখে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলের সভাপতিত্বে করাচীতে ত্রিপক্ষীয় শ্রম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।”৯, এই সম্মেলনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের সম্পাদক মাহবুবুল হক ডিসেম্বর ১৯৪৮ এ একটি বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন,
শিল্পে উৎপাদন ক্রমাগত নীচের দিকে যাইতেছে। সরকারী অফিস সমূহে, রেলওয়ে, স্টীমার, পোস্ট অফিস সমূহে ইফিসিয়েন্সি শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়া গিয়াছে। এদিকে পাকিস্তানের চারিদিকের রাষ্ট্রসমূহে গণবিপ্লবের মহড়া শুরু হইয়াছে। পাকিস্তানের অধিকাংশ শ্রমিক উদয়ন্তি পরিশ্রম করিয়াও দুবেলা দুই মুঠো খাইতে পায় না—তাদের পরনে কাপড় নাই—তাদের রোগে ঔষুধ নাই। তাদের ছেলেপিলেদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। অপরদিকে মুনাফাখোর মালিকদের ব্যাংকের অংক ফাপিয়া উঠিতেছে। শিল্প জাতীয়করণের দিকে কোন লক্ষ্যই নাই। বিদেশী পুজিপতিসমূহ একের পর এক পাকিস্তানের সমস্ত শিল্প দখল করিয়া বাঁসতেছে, বাজারে বিদেশী পণ্যের ছড়াছড়ি। গৃহশিল্প উন্নয়নের কোন প্রোগ্রাম নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন সম্মেলনে নতুন কর্মধারার সন্ধান পাইতে হইবে।”১০
*অক্টোবর, ১৯৪৮-এ বামপন্থীরা ফেডারেশনের কার্যকর কমিটির বৈঠক বর্জন করার পর খুব সম্ভবতঃ মাহবুবুল হক একজন সহ-সভাপতি মনোনীত হন।
গণবিপ্লবের ভয়ে ভীত এবং দরিদ্র শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্যে অশ্ৰপাতকারী মাহবুবুল হক এর পর সরকারের অনুগত একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রম মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ঐ একই বিবৃতিতে বলেন,
পাকিস্তানের বর্তমান শ্রম মন্ত্রী মাহবুবুল সাহেবকে আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বলিয়া জানি। আশা করি আসন্ন সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্যে তিনি লালফিতার বন্ধন কাটাইয়া উঠিতে পারিবেন। এই ধরনের শ্রমিক নেতাদের উপস্থিতিতে করাচীতে যে , ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন গঠিত হয় তাতে ফেডারেশনের সম্পাদক ফয়েজ আহমদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ একই শ্রেণীভুক্ত শ্রমিক নেতারা একটি সারা পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের বিষয় আলাপ করেন।”১১
১লা ও ২রা মে, ১৯৪৯, তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন ডক্টর মালেকের সভাপতিত্বে নারায়নগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়। বহু শ্রমিক সদস্য ছাড়াও সম্মেলনে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রায় তিনশো শ্রমিক প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে দেনেন সেন, মৃণাল কান্তি বসু এবং পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনার সন্তোষ কুমার বসু বাণী পাঠান।”১২
সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অমর ব্যানার্জী তাঁর অভিভাষণে(১৩) বলেন পাকিস্তানে শিল্পে সম্ভার অত্যন্ত কম।
তার ওপর সমগ্র বাংলার যন্ত্র শিল্পের মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত। ধান ও পাটের কারবারের লাভে কোটি কোটি টাকা চোরাকারবারী ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়ার ফলে শিল্পের প্রসার সম্ভব হচ্ছে না। শিল্প উন্নয়নের জন্যে বিদেশী মূলধন নিয়োগ করলে পাকিস্তানকে বিদেশী পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রীত এবং অনুগত করে রাখা হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন যে, মূলধন পাকিস্তানেই আছে, সেটা শুধু আদায় ও সংগ্রহ করাই প্রধান কাজ। প্রয়োজনীয় শিল্পগুলি জাতীয়করণ ও বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী বাজেয়াপ্তকরণকে উচিৎ কাজ বলে বর্ণনা করে তিনি কারাগারে আটক শ্রমিক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানান।
ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির একজন নেতা ও আন্তর্জাতিক যানবাহন শ্রমিক ফেডারেশনের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্পেশাল কমিশনার জর্জ রীড সরকার ও আন্তর্জাতিক পুজির সাপেক্ষে ওকালতির উদ্দেশ্যে এই শ্রমিক সম্মেলনে তাঁর অভিভাষণে (১৪) বলেন যে, তৎকালীন পরিস্থিতিতে কত্তৃপক্ষকে অযথা বিব্রত না করে শিল্পে শান্তি রক্ষা করাই শ্রমিকদের কর্তব্য। তিনি আরও বলেন যে, কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত দাবী করা উচিত নয়। অতিরিক্ত দাবী দায়ের জন্যে বেশি চাপ দিতে থাকলে কলকারখানায় কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে এবং তার ফলে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়তে পারেন।
*অক্টোবর ১৯৪৮-এর উপরিউল্লিখিত বৈঠকের পর ডক্টর মালিক মন্ত্রী হওয়া সত্বেও ফেডারেশন এর সভাপতির পদে বহাল থাকেন।
জর্জ রীডের এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রকৃত চরিত্র কি ছিলো। কাজেই তাদের সম্মেলনে যে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কমিউনিস্টদের থেকে শ্রমিকদের সতর্ক থাকার উপদেশ দেওয়া হবে সেটাই স্বাভাবিক। এবং বস্তুতঃপক্ষে হয়েছিলও তাই। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ এত নগ্ন ও নোংরা আকার ধারণ করে যে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘের গভনিং বডির সদস্য আফতাব আলী পর্যন্ত সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।”১৫
আফতাব আলীর বক্তৃতার পর যোগেন্দ্র মন্ডল, ডক্টর মালেক এবং অন্যানোরা সম্মেলনে যে বক্তৃতা করেন তাতে প্রত্যেকেই একদিকে নিজেদেরকে শ্রমিক দরদী হিসেবে বর্ণনা করে অপরদিকে ধর্মঘট না করা এবং কমিউনিস্ট ধোকাবাজদের সঙ্গে হাত না মেলানোর জন্যে শ্রমিকদেরকে উপদেশ প্রদান করেন। “১৬।
এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়নের (ই পি টি ইউ এফ) নাম পরিবর্তন করে নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (এ পি টি ইউ এফ) করা হয়। অপর একটি প্রস্তাবে সরকারকে এই মর্মে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেভারেশন ট্রেড ইউনিয়নিজমের নিয়ম কানুন মেনে চলবে এবং সরকারের সঙ্গে সব সময়ে সহযোগিতা করবে।”১৭
ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, পাকিস্তান, (টি ইউ পি এফ) নামে একটি নতুন শ্রমিক ফেডারেশন ১৯৪৮ এর জানুয়ারী মাসে গঠিত হয়। পাকিস্তান টেলিগ্রাফ অ্যাসোসিয়েশন, পূর্ব বাঙলা দোকান কর্মচারী ফেডারেশন, আর এম এস ও লোয়ার গ্রেড ডাক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং আরও কয়েকটি ইউনিয়ন এই ফেডারেশনের আওতা ভুক্ত হয়। এর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ পদে যথাক্রমে নরুল হদা, কমরুদ্দীন আহমদ ও বি এ সিদ্দিকী নির্বাচিত হন। নুরুল হদা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের সভাপতি এবং কমরুদ্দীন আহমদ ছিলেন লিখিল পাকিস্তান ডাক ও তার ইউনিয়নেয় সভাপতি।”১৮
নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (এ পি টি ইউ এফ) এবং ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, পাকিস্তান (টি ইউ পি এফ) এর নেতৃবৃন্দের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর এই দুই ফেডারেশনকে নিয়ে একটিমাত্র ফেডারেশন গঠনের জন্যে ১৯৫০ এর এপ্রিলের গোড়ার দিকে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। (১৯) সেই অনুযায়ী ১৯৫০ সালের ৩০শে এপ্রিল দুটি ফেডারেশন একত্রিত হয় এবং তার নাম নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনই রাখা হয়। এই পরিবর্তনের পর নরুল হদা ফেডারেশনের সভাপতি, কমরুদ্দীন আহমদ সহ-সভাপতি, ফয়েজ আহমদ সাধারণ সম্পাদক, আফতাব আলী কোষাধ্যক্ষ এবং আবদুল আউয়াল ও জহুরা হোসেন চৌধুরী সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বিষয়ে সকলে একমত হন যে, কোন শ্রমিক নেতাই এমন কোন ইউনিয়নের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না যে ইউনিয়নের কোন দায়িত্বে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অধিষ্ঠিত নন।”২০
যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল পাকিস্তান পরিত্যাগ করার পর ডক্টর মালেক পাকিস্তানের শ্রম মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এর পর থেকে তিনি একটি সারা পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন গঠনের জন্যে করাচীর রয়পন্থী খাতিব ও ঢাকার ফয়েজ আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং তাদেরকে এ ব্যাপারে সম্মত করাতে সক্ষম হন। এর পর খাতিবের নেতৃত্বাধীনে পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার ও নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতারা পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে একটি মাত্র সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমে এই সংগঠনটিকে একটি ফেডারেশন আখ্যা দেওয়ার প্রস্তাব হয়। কিন্ত আফতাব আলী ও কমরুদ্দীন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত তার নামকরণ হয় নিখিল পাকিস্তান কনফেডারেশন অব লেবার (এপিসিওএল)। (২১) খাতিব ও ফয়েজ আহমদ ) যথাক্রমে এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।”২২
এই নতুন সংগঠনটি পশ্চিম পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার ও পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার নামে দুটি পৃথক আঞ্চলিক সংগঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্যে এই দুটি আঞ্চলিক সংগঠনকেই তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। পূর্ব বাঙলা ও পশ্চিম পাঞ্জাবের বাম পন্থীদের প্রভাব থেকে ৮ ইউনিয়ন আন্দোলনকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রী ডক্টর মালেকের নিজস্ব উদ্যোগে এই সারা পাকিস্তানি শ্রমিক সংগঠনটির উদ্ভব ঘটে। এর কার্যকরী বোর্ডে মোট ২১ জন সদস্য থাকেন। তার মধ্যে ডক্টর মালেক সহ পূর্ব বাঙলার সদস্য সংখ্যা থাকে ১০।”২৩
১৯৫১ সালের ১৪ই ও ১৫ই এপ্রিল নারায়নগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার এর তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ফেডারেশনের সভাপতি কমরুদ্দীন আহমদ।”২৪
পাকিস্তানের শ্রম মন্ত্রী ডক্টর মালেক ফেডারেশনের এই সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে পুজি শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে স্বাধীনতা অর্জনের পর তিন পক্ষেরই উচিৎ এই সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নিজেদের নীতিকে নিয়োজিত রাখা। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নর্মদা ব্যানার্জী তাঁর ভাষণে বলেন যে শ্রমিকরা এখন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে কাজেই তাদেরকে দিয়ে কোন ব্যাপারে জোর করে কিছু করিয়ে নেওয়া শোষকদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমদ তাঁর বাৎসরিক রিপোর্টে বলেন যে সারা দেশের শ্রমিকরা এখন নিখিল পাকিস্তান কনফেডারেশন অব লেবারের (এ পি সি ও এল) পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।”২৫
সম্মেলনের সভাপতি কমরুদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে বলেন, যে প্রায় পাঁচ লক্ষ শ্রমিকের আশা আকাংখাকে বাস্তব রূপ দানের দায়িত্ব তাঁদের কাধে ন্যাস্ত হয়েছে। ৩১শে মার্চ, ১৯৫০ পর্যন্ত সমগ্র পর্ব বাঙলায় রেজিস্টার্ড ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮০ হলেও তাদের সব কয়টিই পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার এর সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে তিনি সম্মেলনকে জানান। এছাড়া আরও অনেক অরেজিস্ট্রিকৃত শ্রমিক ইউনিয়নের কথাও উল্লেখ করেন।”২৬
এরপর কমরুদ্দীন আহমদ সংক্ষিপ্তভাবে পূর্ব বাঙলার শ্রমিকদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, শ্রমিকদের বেতন খুবই কম এবং তাঁর। দারুণভাবে ঋণগ্রস্থ। কলকারখানায় বিশেষত চা বাগান ও সূতাকলগুলিতে শ্রমিকদের বাসস্থানের দূরবস্থা। পানীয় জলের অভাব এবং অন্যান্য বহু অসুবিধের কথা তিনি উল্লেখ করেন। রেল শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৩০ জনের বাসস্থানের মোটামুটি ব্যবস্থা থাকলেও অন্যদের কোনই ব্যবস্থা নেই। দেশ বিভাগের পর মোহাজেরদের বিপুল সংখ্যায় পূর্ব বাঙলা আগমনের ফলে এদিক দিয়ে পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। পাকিস্তানে নাবিকদের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ বলে তিনি জানান।
এদের এক তৃতীয়াংশ সব সময়ে জাহাজেই থাকেন। এদের শতকরা ৮০ জনই পূর্ব বাঙলার লোক। এই পাকিস্তানী নাবিকরা ভারতের কলকাতা ও বোম্বাই বন্দরে চাকুরী লাভ করেন। ” তাঁরা এখন বিদেশী হিসেবেই গণ্য। পাকিস্তানী নাবিকদের চাকুরী ভারতীয় বন্দরের পরিবর্তে পাকিস্তানী বন্দরে হওয়াই বান্ছনীয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। পাকিস্তানী নাবিকদের ওয়েলফেয়ার ডাইরেক্টরেট করাচী থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আশা এবং চট্টগ্রাম ও চালনার জন্য পৃথক পৃথক কল্যাণ কমিটি গঠনের সুপারিশও তিনি করেন। কৃষি শ্রমিকদের দুরবস্থা বর্ণনা করে তাদের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়ার আহবানও কমরুদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে জ্ঞাপন করেন। ২৭
পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার এর এই বার্ষিক সম্মেলনের একটি প্রস্তাবে ডক্টর মালেককে পাকিস্তানের শ্রম মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবটিতে অাশা প্রকাশ করা হয় যে, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনের ১৩টি সর্বসম্মত বিল কার্যকর করার জন্যে সরকার পদক্ষে গ্রহণ করবেন। অপর একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে, কায়েদে আজমের নিশ্চয়তা সত্বেও পাকিস্তান সরকারের বর্তমান নেতৃবৃন্দ ধনীকে আরও ধনী এবং দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করার যে নীতি অনুসরণ করছেন, সে বিষয়ে সংগঠিত শ্রমিকরা নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। শ্রমিক উপদেষ্টা বোর্ডের সিদ্ধান্ত সমূহ কার্যকর করার জন্যে অপর একটি প্রস্তাবে পূর্ব বাঙলা সরকারকে বলা হয়। ২৮ সরকারী তত্তাবধানে অর্জিত বর্জোয়া শ্রমিক নেতাদের ঐক্য অল্প দিনই স্থায়ী হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের এই এপ্রিল সম্মেলনের পর ফয়েজ আহমদ ও নুরুল হুদার মধ্যেকার স্বত্ব একটা চরম পর্যায়ে ওঠে এবং নূরুল হুদার নেতৃত্বে ঐ বৎসরই জুন মাসে পাকিস্তান লেবার ফেডারেশন নামে একটি নতুন ফেডারেশন গঠিত হয়। ২৯ নূরুল হুদা,নজির মস্তফা ও এ আর সুন্নামাত যথাক্রমে এই ফেডারেশনের সভাপতি সাধরন সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই নতুন ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর পর পাকিস্তান রেলওয়ে, এমপ্লয়িজ লগ টেলিগ্রাফ অ্যাসোসিয়েশন ও দোকান কর্মচারী সমিতি পূর্ব পকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার থেকে বেরিয়ে আসে। ৩০
২। রেল শ্রমিক
পূর্ব পাকিস্তান রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ছিলো কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত একটি সংগঠন। কমিউনিস্টদের সহযোগিতায় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেমবরের যখন পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গঠিত হয় তখন এই ইউনিয়নটিও তার অন্তভুক্ত হয়। কিন্তু পূর্ব বাঙলার কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু তখনো পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সাংগঠনিক দিক দিয়ে সম্পর্কিত ছিল। এই সম্পর্কের (অসপষ্ট) ভারতীয় ইউনিয়ন কর্তৃক ১৯৪৯ সালের (অস্পষ্ট) শ্রমিকদের যে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল তার সমর্থনে পূর্ব বাঙলাতেও রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ধর্মঘটের একটি ঘোষণা দেন। পূর্ব বাংলার এই (অস্পষ্ট)ছিল একটি ভ্রাতত্বমূলক সংগ্রাম। ১
(অস্পষ্ট) পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের পরামর্শ করার অথবা তাদের কোন অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। ফেডারেশনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগত বিরোধ এবং তাঁদের দ্বারা ভারতীয় পার্টির (অস্পষ্ট) এমপ্লয়িজ লীগ এবং তাদের ফেডারেশনের ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন পাকিস্তান ধর্মঘটের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগ প্রথম হইতেই সরকারের সহিত লড়াই করিয়া আসিতেছে এবং গত ১২ই ফেব্রুয়ারী লীগের লাল মনিরহাটের বিশেষ অধিবেশনে এই লড়াই সফল করার জন্য শেষ কর্মপন্থা হিসাবে ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। অধিবেশনের পরেই কর্তৃপক্ষের দাবী মানিয়া লওয়ার জন্য ৪৫ দিনের সময় দিয়া চরমপত্র দেওয়া হইয়াছে! কোন দিন হইতে ধর্মঘট শুরু, করা হইবে তাহা আগামী ১৯শে ও ২০শে মার্চ ঢাকায় লীগের যে বার্ষিক অধিবেশন হইবে সেখানে স্থির করা হইবে।
ইতিমধ্যে কোন কোন সংবাদপত্রে প্রচারিত হইতেছে যে আগামী ৯ই মার্চ হিন্দুস্থানের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তনের রেল শ্রমিকেরা ধর্মঘট করিবে। রাষ্ট্রের ধ্বংসকামী কম্যুনিস্টরা রেল শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করিবার জন্য এই প্রচার করিতেছে। অমিরা স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিতে চাই যে এইরুপ বেআইনী ধর্মঘটের সহিত পর পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের কোন সম্পর্ক নাই। উপরন্তু আমরা সকল রেল কর্মচারীদিগকে এই কম্যুনিস্ট প্ররোচিত ধর্মঘটে যোগদান না করিতে অনুরোধ জানাইতেছি। এই ধর্মঘটে যাঁহারা যোগদান করিবেন তাঁহারা নিজেদের সংহতি নষ্ট করিয়া নিজেদের ধবংস ডাকিয়া আনিবেন। ২।
৯ই মার্চে আহত রেল ধর্মঘটের বিরোধিতা করে ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন হবে পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক কমরুদ্দীন অাহমদ সংবাদপএে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন ।
খবরের কাগজে প্রকাশিত ৯ই মার্চ তারিখে রেলওয়ে সম্পর্কে একটি খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করিতেছি যে বিশেষ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত বেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন” এই ধর্মঘট চালনা করিতেছে সব চেয়ে আশ্চর্য এই যে ঐ তারিখেই হিন্দুস্থানের ধর্মঘট একই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হইবে। হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান যে দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাষ্ট্র এই কথাটি কম্যুনিস্ট দল যে আজো স্বীকার করিয়া লয় নাই ইহা তাহার আর একটি প্রমাণ।
আমি একজন ট্রেড ইউনিয়নিষ্টের সকল দায়িত্ব মনে রাখিয়াই বলিতে বাধা হইতেছি যে, এই ধর্মঘটের নোটিশ দিয়া ইষ্টার্ণ পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের ধর্মঘটের যে নোটীশ দেওয়া হইয়াছে তাহা সাবোটাশ করা হইতেছে। দ্বিতীয়তঃ, আমার মনে হয় যে এই প্রকার ধর্মঘট দ্বারা সমস্ত রেলওয়ে কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ এবং বিভেদ সৃষ্টি করার প্রয়াস হইতেছে। আমি সমস্ত রেলওয়ে শ্রমিকদের নিকট আন্তরিকভাবে অনুরোধ করিতেছি যে তাহার যেন ৯ই মার্চ তারিখের ধর্মঘটে যোগ না দেন এবং যাহারা বিভ্রান্ত হইতেছে তাহাদের সঠিক পথে চালিত করেন। পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি মন্ত্রী ডক্টর মালেক ও সম্পাদক ফয়েজ আহমদ সাহেবের নিকটও আমি আবেদন জানাইতেছি যেন তাঁহার তাদের ফেডারেশনে এফিলিয়েটেড–“রেল রোড় ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন” কে এই ভ্রান্ত পথে চালিত না করিয়া রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য, শ্রমিক মঙ্গলের জন্য সঠিক পথে চালিত করেন।
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সরকারী ও সরকার সমর্থক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনগুলো যে প্রচারণা ইতিপূর্বে চালিয়ে যাচিছলো ৯ই মার্চের ধর্মঘটের ঘোষণা সেই প্রচারণার ক্ষেত্রে তাদের জন্যে এক বিশেষ সুযোগের সৃষ্টি করে। এই সুযোগের উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করতে যে তারা কোন গাফিলতি করেনি তাঁর উদাহরণ উপরে উদ্ধৃত দুটি বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার পূর্বে রেল কর্মচারীদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তাদের ওপর পার্টির যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জ্যোতি বসু, রেল কর্মচারীদের প্রতিনিধি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির টিকিটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার রেল কর্মচারীর ভারত গমন এবং ভারত থেকে হাজার হাজার রেল কর্মচারীর পূর্ব বাংলা আগমনের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার ফলে রেল কর্মচারীদের ওপর কমিউনিস্ট প্রভাব অনেকখানি কমে আসে। পার্টি সদস্যদের অধিকাংশও পূর্বে বাংলা ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার ফলে অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এরপর সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের নতুন রাজনৈতিক লাইন। এ সবের পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য গ্রেফতার হন এবং জনগণের সকল অংশ থেকেই পার্টি দ্রুত বিচিছন্ন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত রেলরোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ১৯৪৯-এর ৯ই মার্চ ভারতীয় রেল শ্রমিকদের ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে একটি ভ্রাতৃত্বমূলক ধর্মঘটের ঘষণা প্রদান করে। জনগণের থেকে বিশেষতঃ রেল-শ্রমিকদের থেকে বিচিছন্ন হয়ে মূলতঃ পূর্ব বাংলার রেল-শ্রমিকদের নিজস্ব দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ধর্মঘট আহ্বানের যা স্বাভাবিক পরিণতি তাই ঘটে ছিলো। ৯ই মার্চের ধর্মঘট সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপর্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলেছিলো। ধর্মঘট যে ব্যর্থ হবে সেটা ধর্মঘটের আহবায়করাও ৯ই মার্চের পূর্বেই উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু রেলের চাকা বন্ধ করতেও তাঁরা ছিলেন বদ্ধপরিকর। সে অবস্থায় সন্ত্রাসবাদী লাইন অনুসরণকারী পার্টির পক্ষে যা স্বাভাবিক ছিলো তাই তাঁরা করেছিলেন। রেল বন্ধের মোক্ষম পদ্ধতি হিসেবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রেল লাইন উপড়ে ফেলার।৪
এই সিদ্ধান্ত অবশ্য তাঁরা কার্যকর করতে পেরেছিলেন। একটি জায়গায় জয়দেবপুর ও টঙ্গীর মাঝামাঝি খইলকইর গ্রাম এলাকা। এই গ্রামাঞ্চলের নেতা ছিলেন রেল শ্রমিক নেতা আবদুল বারী। তিনি এই সময়ে উগ্রপন্থী পার্টি ইউনিয়ন নেতা নির্বাচিত হন। রেলে অচলাবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তিনি রেল লাইইন তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিজের এলাকায় কার্য করেছিলেন।
৯ ই মার্চের রেল ধর্মঘটের মোকাবিলা করার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছিলো। সিলেটে নানকার আন্দোলনের এলাকা থেকে পর্যন্ত পুলিশ প্রত্যাহার করে ধর্মঘট বন্ধের জন্যে তারা সেই সমস্ত পুলিশকে মোতায়েন করেছিলো ৬ ধর্মঘট ব্যর্থ হওয়া এবং খইলকইরে রেল লাইন উপড়ে ফেলার পর সরকার খইলকইর গ্রামাঞ্চলে হিংস্রভাবে শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার ইত্যাদির মাধ্যমে এক ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। আবদুল বারী নিজে গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে। ঢাকা রেল স্টেশনের যে কমিউনিস্ট নেতা ধর্মঘটের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনি কেরানী সাহেবনামে পরিচিত ছিলেন। তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু ধর্মঘটের প্রস্তুতিপূর্বেই তিনি আরও অনেক সহকর্মীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে যান। ৭
১৯৪৯ সালের গোড়া থেকেই পাকিস্তান সরকার। কমিউনিস্ট ৫ টি এবং তার নেতৃত্বাধীন সমস্ত গণ-সংগঠন ও শ্রেণী সংগঠনে রি বিরদ্ধে যে সর্বাতন্ত্রক অভিযান চালায় তারই অঙ্গ হিসেবে ডক্টর মালেকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সাধারণ কাউন্সিল ১৯৪৯ সালের ৩০শে আগস্ট রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নকে বহিষ্কার করে। ৯ই মার্চের ধর্মঘট ঘোষণা এবং ৩০শে আগস্টের এই বহিষ্কারের পর রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কার্যতঃ ১৯৪৯ সালের শেষ দিকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। রেল রোড ওয়াকার্স ইউনিয়নের সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে ঢাকা জেলা সুতাকল শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিকশা চালক ইউনিয়ন, বরিশাল বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং অাভ্যন্তরীণ নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নকেও পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর প্রত্যেকটিই তৎকালে ছিলো কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে এগুলোর অবস্থাও দাঁড়ায় রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মতোই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় রেল শ্রমিকদের একটি নতুন সংগঠন গড়ার জন্যে ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির উদ্যোগে ৬ই ও ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭, তারিখে ঢাকায় রেল মজদুরদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সম্মেলনেই এডভোকেট নূরুল হুদার নেতৃত্বে । পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগ নামে একটি নতুন সংগঠনের জন্ম হয়।১০ এরপর থেকে এই সংগঠনটিই রেল । কাচারীদের সব থেকে বড়াে এবং সংগঠিত
॥ আব্দুল বারী দীর্ঘকাল কারাগারে ছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান কিন্তু মুক্তির কিছু দিন পর রোগ ক্লান্ত হয়ে তিনি মারা যান। ১৮ কেরানী সাহেব নামে পরিচিত এই কমিউনিস্ট রেল শ্রমিক নেতা ১৯৫১-৫২ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই টাই ফয়েড রোগে তাঁর মত্যু হয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্রুত বিকাশ লাভ করে।
১৯৪৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর লালমনিরহাটে রেল কর্মচারী লীগের উদ্যোগে রেল শ্রমিকদের একটি বিরাট সভা হয়। সভায় বিভিন্ন শ্রমিক সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক এম, এস হক ও রেল কর্মচারী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আবদুল হাই বক্তৃতা করেন। সভায় সর্ব, সম্মতিক্রমে গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষের ছাঁটাই নীতি, বেমান বন্টন নীতির সমালোচনা, বেতন-কমিশনের রায় কার্যকরী করার ব্যাপারে গাফিলতিও পার্বতীপুরের রেল কর্মচারীদের ওপর পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদ করা হয়। একটি প্রস্তাবে অবিলম্বে কর্মচারীদের বাসস্থানের দাবি করা হয়।১১
এরপর লালমনিরহাটে রেল শ্রমিকদের আর একটি সভা হয় ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৪৮।১২ লালমনিরহাট ১ নং রেলওয়ে ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ থেকে রেলওয়ে শ্রমিকদের এক বিরাট মিছিল বের হয়। রেলওয়ে কলোনীর বিভিন্ন রাস্তা ও স্থানীয় বাজারের মধ্যে দিয়ে বিক্ষোভকারীরা “জুলুমবাজী বন্ধ কর”, “ছাঁটাই বন্ধ কর খুদী চাউল বন্ধ কর ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে শান্তভাবে সমস্ত রাস্তা পরিভ্রমণ করে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার সময় ইন্সটিটিউট হলে রেল-শ্রমিকদের একটি সভা হয়। সেই সভায় রেল কর্মচারী লীগের সভ্য সি, কে কুটি, এম আর খাদেম ; আবদুল এবার, মুহম্মদ নাসিম খান ও কেন্দ্রীয় পরিষদের যুগ্ম-সম্পাদক আবদুল হাই বক্তৃতা করেন। কর্তৃপক্ষের ছাঁটাই নীতির সমালোচনা করে আবদুল হাই বলেন যে, রেল কর্তৃপক্ষের অদরদর্শীতার জন্যেই হাজার হাজার রেল কর্মচারী আজ ছাঁটাইয়ের মুখে গ্রেনশপের দুরবস্থার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, অচিরে রেল কর্মচারীদেরকে গ্রেনশপ থেকে রেশন সরবরাহ না দিলে তাদের স্বাস্থ্য কিছুতেই রক্ষা হবে না। রেল কমিশনের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, কর্তৃপক্ষ রেল কর্মচারীদের দাবি দাওয়া উপেক্ষা করে চললে তাঁদের মধ্যে উশৃঙ্খলতা দেখা দেবে।
১৯৪৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ময়মনসিংহ রেলওয়ে ইন্সটিটিউট হলে পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের ময়মনসিংহ শাখার এক বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।১৩ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন সাপ্তাহিক সৈনিকের সম্পাদক এনামুল হক। রেল কর্তৃপক্ষ বারো হাজার নিম্নপদস্থ কর্মচারী ছাঁটাইরের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার প্রতিবাদে অাহত এই সভায় প্রায় দুই হাজার স্থানীয় রেল কর্মচারী যোগদান করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন অব পাকিস্তানের যুগ্ম-সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক এম, এস, হক, যুগ্ম-সম্পাদক অাবদুল হাই, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ফ্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন অব পাকিস্তানের প্রচার সম্পাদক আতিয়ার রহমান এবং ডাক ও তার ইউনিয়নের সম্পাদক আলী আহমদ এই রেল কর্মচারী সমাবেশে যোগদান করেন।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ শাখা রেল কর্মচারী লীগের প্রচার সম্পাদক এম ই খান বলেন,
ই, বি, রেলের জেনারেল ম্যানেজার বার হাজার রেল শ্রমিকের প্রতি ছাঁটাইয়ের নোটিশ দিয়েছেন। আজকের এই দুর্দিনে ছাঁটাই হওয়া যে কি ভয়াবহ ব্যাপার তা কর্তৃপক্ষ ছাড়া বোধ হয় আর সকলেই বোঝেন। তাছাড়া এই ছাঁটাইয়ের লিস্টের মধ্যে এমন লোকও আছেন যাঁরা ১৯২২ সালে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অনেকেরই পেনশনের সময় হয়ে এসেছে, বুড়াে হয়ে গেছে—এই সময় তাদের পথে বসানর ব্যবস্থা হল।
সিরাজ আলী ও আবদুল জব্বার গ্রেন শপ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের অবহেলার সমালোচনা করেন। তারা এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, গ্রেনশপ থেকে তেলের নামে হোয়াইট অয়েল ও চালের নামে খুদ সরবরাহ করা হয় এবং তাও নেহাৎ অপর্যাপ্ত। এই অখাদ্য খেয়ে শ্রমিকদের দিনদিন স্বাস্থ্যের অবণতি ঘটছে। অাবদুল হাই তিনটি রেল শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকার তুলনামূলক বিচার করে বলেন যে, একমাত্র রেল কর্মচারী লীগই বিভেদ সৃষ্টির উর্ধ্বে উঠে কর্তৃপক্ষের দমন নীতির বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে যাচেছ। তিনি রেল কর্মচারী লীগের পতাকাতলে সকল রেল শ্রমিককে সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হওয়ায় অাহ্বান জানান। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন আতিয়ার রহমান এম, এস হক ও সভার সভাপতি এনামুল হক।
এম, এস হক সভা শেষে কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে কর্তৃপক্ষকে ছাঁটাইয়ের বিষয়টি আবার বিবেচনা করতে অনুরোধ জানানো হয় এবং উক্ত কর্মচারীদেরকে কিভাবে কর্তৃপক্ষ কাজে নিয়োগ করতে পারেন তার কতকগুলো পথ নির্দেশ করা হয়। একটি প্রস্তাবে অখাদ্য রেশনের পরিবর্তে ভাল রেশন সরবরাহের দাবি করা হয় এবং অপর একটি প্রস্তাবে ময়মনসিংহ শাখার সযোগ্য সভাপতি সাইদুল হককে বদলী করে কতৃপক্ষ যে দমননীতির পরিচয় দিয়েছেন তার নিন্দা করে তার বদলী বাতিল করার অনুরোধ জানানো হয়।
সমবেত রেল শ্রমিকরা রেল কর্মচারী লীগের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে লীগের নির্দেশ নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করে যাবেন বলে সভাস্থলেই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। ২০শে মার্চ, ১৯৪৯ তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের প্রথম বার্ষিক অধিবেশন হয়। (১৪) এই অধিবেশনে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত অনেক রেল শ্রমিক যোগদান করেন। এছাড়া ডাক বিভাগের শ্রমিকসহ অপরাপর প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাও এই সম্মেলনে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত থাকেন। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ ও ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন অব পাকিস্তানের সভাপতি নূরুল হুদা। কোরান তেলাওয়াতের পর সম্মেলনের কাজ শুরু করে অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম বলেন যে, যে রাষ্ট্র ইসলামী হবে সে রাষ্ট্রের সম্পদে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। শ্রমিকরা যাতে অন্ততঃ সামান্য কিছু পায় তার জন্যে তিনি ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিলাসিতা কমানোর আহবান জানান। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী তার বক্তৃতায় তার শ্রমিকদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের চট্টগ্রাম হেড কোয়ার্টারের সম্পাদক ইসহাক বলেনঃ আমরা যখন খাওয়া, পরা, বাসস্থানের দাবি তুলি তখনই আমাদের কম্যুনিস্ট অাখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু অমরা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতে চাই আমরা কম্যুনিস্ট নই। আমরা পাকিস্তানী, মুসলমান। কিন্তু সত্যিকার মুসলমানী কে আমাদের সমাজে আছে ? লম্বা প্রাসাদোপম অট্টালিকা বিলাস যা আমাদের নেতাদের প্রধান কাম্য তাহা মুসলমানী নয়। দেশের শতকরা ৯০ জনের জীবন যাত্রার সঙ্গে মুষ্টিমেয় লোকের জীবনযাত্রার মানের অন্যায় পার্থক্য যত শীঘ্র তিরোহিত হইয়া যায় ততই মঙ্গল। মুহম্মদ আক্রামও এই প্রসঙ্গে বলেন,
যারা আমাদিগকে কম্যুনিস্ট বলে প্রকৃতপক্ষে তারাই এইভাবে কম্যুনিস্টদের আদর্শ প্রচার করিতেছে। পেটে যাহাদের ভাত নাই, রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে যাহাদের এতটুকু মূল্য নাই, তাহাদের কাছে এভাবে কম্যুনিজমের বুলি আওড়াইয়া প্রকারান্তরে কতৃপক্ষই আজ দেশে কম্যুনিজমের বিস্তারে সাহায্য করিতেছেন।
রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের ঢাকা শাখার সম্পাদক আবদুর রউফ শ্রমিকদের দুর্দশার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন, গেজেটেড অফিসারদের মত ছুটি উপভোগ হইতেও অামরা বঞ্চিত।……বর্তমানের রেলওয়ে অফিসাররা শাসন চালাইবার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। এই অক্ষম অফিসাররাই অাজ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিকতা আনয়ন করিয়াছেন ও করিতেছেন। সংগঠনের ভৈরব শাখার সম্পাদক আবদুল হালিম বলেন, আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পাইয়াছি, কিন্তু অর্থনৈতিক পরাধীনতা আমাদের এখনো কাটে নাই। চার কোটি মজলুম মানুষের আর্থিক ও আত্মিক উন্নতি ব্যতীত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উন্নতি হইতে পারে না।
গ্লাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রতিনিধি গাঙ্গুলী বলেন, রেলওয়ে শ্রমিকদের মত অন্যান্য শ্রমিকদের অবস্থাও আজ ক্রমেই শোচনীয় হইয়া উঠিতেছে। আজ তাই সকলের একত্রিত হইয়া অন্দোলন করিতে হইবে। বর্তমানে চুপ করিয়া, থাকার অর্থ অনিবার্য ধ্বংস।
সম্মেলনে দোকান কর্মচারী সংঘের পক্ষে প্রহলাদচন্দ্র দাস এবং ডাক ও তার ইউনিয়নের সভাপতি বি, সিদ্দিকী বক্তৃতা করেন। সিদ্দিকী তার বক্তৃতায় বলেন,
গরীবের রক্তস্মাত হইয়া কায়েম হইয়াছে পাকিস্তান। কিন্তু পরিণামে এই দুর্ভাগারা অাজ এক মুঠি খাইতে পারিতেছে না, দেশের সম্পদের ন্যায্য বন্টন হইতেছে না, কতিপয় সুবিধাবাদী নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই আজ দেশের সমস্ত সম্পদ লুট করিতেছে। কিন্তু এই অন্যায় আমরা বরদাস্ত করিব না। অামাদের গভর্নমেন্ট কোনরুপে সমালোচনা সহ্য করিতে পারেন না। গভর্নমেন্টকে সমালেচনার অধিকার ইসলামের একটা মৌলিক অবদান। অথচ তারা সমালোচনা সহ্য করিতে পারেন না। তাঁরা প্রমাণ করিতেছেন যে, তাঁরাই স্তালিন। কারণ স্তালিনের রাজ্যেই কাহারও সমালোচনার অধিকার নাই। সম্মেলনের বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য থেকে, বিশেষতঃ সিদ্দিকীর বক্তৃতায় স্ট্যালিনের এই উল্লেখ থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায় যে, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ এগের নেতৃত্বসহ তৎকালীন অপরাপর শ্রমিক ইউনিয়নগুলো কমিউনিস্ট বিরোধী ও বুর্জোয়া নেতৃত্বাধীন ছিলো। সরকারের সমালোচনা করলেও এই সব নেতৃবন্দ শুধু যে কমিউনিস্ট বিরোধিতার ক্ষেত্রেই সরকারের সহযোগী ছিলো তাই নয়, শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধতার ক্ষেত্রে তারা ছিলো তৎকালীন সরকারের সহযোগী। তাদের এই চরিত্র অবশ্য সাধারণ শ্রমিকদের কাছে ধরা পড়তে অনেক দেরী হয়েছিলো। সবশেষে সম্মেলনে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এগুলোতে ক্ষমতার কামড়া কামডির নিন্দা করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়োজিত রাখার সংকল্প জানানো হয়। প্রস্তাবে পে-কমিশন গ্রেনশপ ও ছাঁটাই সম্পর্কে যদি একটা সন্তোষজনক মীমা হয় এবং তার ফলে কোন অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হয় তার, পূর্ব পাকিস্তান এমপ্লয়িজ লীগ দায়ী থাকবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। শেষোক্ত প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে গিয়ে শ্রমিক চেরাগ খান বলেন, দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী ক্ষমতা তা রেলওয়ে কর্মচারীদের হাতে। আমাদিগকে কম্যুনিস্ট অাখ্যা দিয়া দায়িত্ব এড়াইতে চাহিলে ফল হইবে না।
সম্মেলনে পূর্ববর্তী বৎসরের জন্যে নিন্মলিখিত বা রেলওয়ে এম্পলয়িজ লীগের কর্মকর্তা নির্বাচিত হনঃ সভাপতি–মুহম্মদ নূরুল হুদা।
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-চেরাগ খান। সম্পাদক–মাহবুবুল হক ।
যুগ্ম-সম্পাদক -আবদুল হাই, এম এস হক ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী সরদার আবদুর রব নিশতার পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। এ উপলক্ষে ৬ই এপ্রিল ঢাকা ডি টি এস সি গণ পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারীলীগের ঢাকা শাখা উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় তাঁকে সবর্ধনা জ্ঞাপন কর হয়। (১৫) এই সভায় রেল কর্মচারীসহ প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক যোগদান করেন। শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উল্লেখ করে ঢাকা শাখা রেল শ্রমিক লীগের সম্পাদক খন্দকার আবদুল হাই একটি মানপত্র পাঠ করেন। তাতে বলা হয়, ছাটাই, গ্রেনশপ বাসস্থান ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এই চারটি এখন পূর্ব পাক রেল শ্রমিকদের সামনে বড়। সমস্যা।…..পাকিস্তান হাশিল হওয়ার পর জনসাধারণ বিশেষ করে শ্রমিকগণ বড় আশা পোষণ করেছিলো যে, ইসলামের সুমহান অাদর্শেই পাক রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এবং তার ফলে শ্রমিকগণ রিজকুলকারিন উপভোগ করতে পাববে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের অদরদর্শী ছাঁটাই নীতিতে তাদের সে আশা ভেঙ্গে যাচ্ছে।……..গ্রেনশপ” দুর্নীতি যথেষ্ট ছিল একথা অস্বীকার করবার যো নেই। সেইজন্য এই দুর্নিতী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবার উদ্দেশ্য। যখন গাজদার কমিটি নিয়োগ করা হয় তখন আমরাই একে মোবারকবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রেনশপ তার দিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের রুজি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যে বন্দোবস্ত হচ্ছে তাতে আমরা স্বভাবতঃই বিক্ষুব্ধ হয়েছি। তারপর বাসস্থানের কথা। মালগাড়ি ও পচা খপরীতে রেল শ্রমিকগণবাস করার নামে যেভাবে পচছে তাতে বিংশ শতাব্দীতে বাস করেও সেই গুহাবাসীদের কথা মনে পড়ে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার উল্লেখ করে মানপত্রটিতে বলা হয় ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা এই মহান অদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনকার্য চলবে এরকম অাশ্বাস আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরূপ ব্যবহারের দ্বারা রেল কতৃপক্ষ
এসব আশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম প্রতিষ্ঠানে বাক স্বাধীনতা ও সংগঠন স্বাধীনতাকে প্রগতির প্রাণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকার এই আদর্শ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ ও সরকার এই সব ওয়াদা খেলাপ করে শ্রমিক প্রতিষ্ঠানকে পিশে মারার সব প্রকার কৌশল অবলম্বন করেছেন। শুুধু, তাই নয়, শ্রমিকদের একতা ভাঙ্গবার জন্য কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ তাদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ ও প্রাদেশিকতার বীজ ঢাকাবার চেষ্টা পেয়েছেন। বৃটিশ আমলাদের অনুসত এই ভেদ নীতি কিছুতেই ইসলাম সম্মত হতে পারে না। মানপত্র পাঠের পর রেল কর্মচারী লীগের প্রচার সম্পাদক এম আই খান শ্রমিকদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে উর্দুতে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেন যে, এনকোয়ারী কমিটির রায় ব্যতীত যেমন শ্রমিক ছাঁটাই না হয় এবং গ্রেনশপের সুবিধার বদলে যে উপযুক্ত ভাতার বন্দোবস্ত করা হয়। বাসস্থানের সমস্যার প্রতি মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর তিনি শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন এরপর তিনি বলেন, যে…..পাকিস্তানে সুখে বাস করার আশাতেই শ্রমিকরা লড়েছিল কিন্তু এই লড়াইয়ের বদলে আজ তারা খাওয়া পরা, এমনকি কথা বলার হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের বিক্ষোভ দূর করে পাকিস্তানের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে তিনি রেলমন্ত্রীকে আহবান জানান। উচ্চ কর্মচারীরা এখনো আগেকার ঢঙ্গে নিম্ন কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে চলেছে এই অভিযোগ করে তিনি বলেন এ সবের দ্বারা কর্মচারীদের যোগ্যতাই খাটো হয়ে যাচ্ছে। তিনি এই বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন যে, উচ্চ কর্মচারীরা নিন্ম কমচারীদেরকে যখন ইসলামের নীতি অনুযায়ী ভাই হিসেবে মনে করতে পারবে একমাত্র তখনই তারা পাকিস্তানের স্থায়িত্ব ও হেফাজতের জন্য সর্বস্ব কোরবান করতে এগিয়ে আসবে। পর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক ও সভাপতি নূরুল হুদা তাঁদের বক্তৃতা শেষ করার পর সরদার নিশতারতার বক্তৃতা প্রদান করেন। তাতে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, তদন্ত কমিটির রায়ের ভিত্তিতেই ছাঁটাই করা হবে এবং বাড়তি কর্মচারী ছাঁটাই হলে তাঁদেরকে অন্য বিভাগে কাজ দেয়া হবে। বাস্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এই অব্যবস্থার জন্যে তিনি খুবই লজ্জিত এবং শীঘ্রই এই সমস্যার একটা প্রতিকার তাঁরা করবেন। পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব জনগণেরই, এই উক্তির পর তিনি বলেন যে, মোটরের ড্রাইভার বদল করতে গিয়ে মোটর যেন ভাঙ্গা না হয় সেদিকে প্রতিটি বাসিন্দারই লক্ষ্য থাকা দরকার। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, রেলকর্মচারী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শ্রমিক সমস্যার বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি কি কি করতে পারেন সে বিষয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাঁদেরকে জানাবেন। উপরে উল্লিখিত মানপত্রে গ্রেনশপ তুলে দেয়া সম্পর্কে আভিযোগ করা হয়েছিল মন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় সে বিষয়ের কোন উল্লেখ না করে, তা এড়িয়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য কতক গুলো দাবি-দাওয়া ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করায় সভার শেষে সমবেত শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়। এরপর ঢাকা থেকে সরদার নিশতার ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম গমন করেন। পথে ভৈরব, অাখাউড়া, পাহাড়তলী প্রভৃতি প্রত্যেকটি স্টেশনে হাজার হাজার রেল-শ্রমিকের উপস্থিতিতে রেলকর্মচারী লীগের স্থানীয় শাখা সমূহের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়৷১৬ চট্টগ্রামে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে রেল কর্তৃপক্ষ রেলওয়ে দালানের সামনে একটি সভার আয়োজন করেন। এই সভায় অল্প কিছু সংখ্যক শ্রমিক সমবেত হলেও রেল কর্মচারী লীগের অাহ্বানে হাজার হাজার রেল-শ্রমিক ঐ একই সময়ে পোলো গ্রাউণ্ডে সমবেত হন। সাধারণ শ্রমিকরা সরকারী তত্তাবধানে আয়োজিত কোন সভায় মন্ত্রীর কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে আপত্তি জানান। এই পরিস্থিতির ফলে সরদার নিশতার নিজে পেলো গ্রাউণ্ডে এসে সেখানে সমবেত শ্রমিকদেরকে রেলওয়ে দালানের সামনে নিয়ে যান।১৭ এরপর রেল কর্মচারী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশের উদ্দেশ্যে সরদার নিশতারের কাছে একটি ডেপুটেশন যায়। তাতে থাকেন পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা, কার্যকরী সভাপতি চেরাগ আলী, সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম আর। খাদেম এবং শামসুল হোসেন (ড্রাইভার) সহ অন্য একজন ড্রাইভার। সরদার নিশতার ডেপটেশনকে কোন বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তােষ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।১৮
সরকারের সঙ্গে আপোষকারী ও দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার ও তাদের নিয়ন্ত্রিত রেল কর্তৃপক্ষের শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণের মুখে এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমশঃ সরকার বিরোধী হয়ে উঠতে থাকে। এর অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকরা সরকারের ও রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উত্তরোত্তরভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকার ফলে রেল কর্মচারী লীগের নেতৃবৃন্দও এই বিক্ষোভের সঙ্গে তাল রেখে সরকারের কাছে নানান দাবি-দাওয়া পেশ করতে থাকেন এবং শ্রমিক বিক্ষোভে শামিল হতে বাধ্য হন। কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চের ধর্মঘটের পর লুপ্ত হয়ে যাওয়ার ফলে এই পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগই হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব বাংলায় রেল শ্রমিকদের সব থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন। চট্টগ্রাম, সিলেট এবং উত্তর বাংলার বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রেল শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে সভা, মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন৷১৯ পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে কর্মচারী লীগের প্রভাব রেল শ্রমিকদের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব বাংলায় রেল শ্রমিকরা কি নিদারুণ দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছিলেন তা ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিম্নলিখিত রিপোর্টটি (২০) থেকে বোঝা যাবে, পর্ব পাকিস্তানের রেল শিল্প তথা এই প্রদেশের প্রাণকে যারা বাঁচিয়ে রেখেছে সেই রেল মজদুরগণ আজ গরম অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করছে বাসস্থান সমস্যা হয়েছে সবচেয়ে প্রবল। গত দুবছরে রেল কর্তৃপক্ষ প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করেছেন শ্রমিকদের বাসস্থান তৈরির নামে! কিন্তু এখনও হাজার হাজার রেলকর্মচারী মাল গাড়িতে, খোলা বারান্দায় বা অপরের দুয়ারে অতি জঘন্য অবস্থায় অপরিসীম দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে।
বর্ষাকাল এসে গেছে। পুরানো ঘরগুলোর মেরামত না হওয়ায় ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি পড়ে ভেতরে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সারারাত ঘরের এক কোণায় গুটি মেরে বসে থাকতে হয়। ঝড়ে চাল উড়ে যাওয়ায় দিনের পর দিন খোলা আকাশের সঙ্গে মিতালী করে চলতে হয়। প্রায় বাড়িরই হয় পায়খানা নেই, নয় তাঁর দরজা নেই। আবরুর মাথা খেয়ে নির্লজ্জভাবে মেয়েছেলেদের তারই মধ্যে দিন গুজরান করতে হয়। …•••এক কোটি টাকা ব্যয় করে যে ঘর দুয়ার রেল শ্রমিকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে তার বাস্তব চেহারাটা হোল এই। পে-কমিশন সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়, পে-কমিশন বস্তুুটি এমন যে শ্রমিকরা তার নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। এর রায় সাধারণভাবে শ্রমিকদের জীবনে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেনি। কারণ গ্রেনশপ তুলে দেয়ার ফলে এর থেকে যে সুবিধা আশা করা গিয়েছিল তা একেবারেই মিথ্যা হয়ে গেছে।
ইচ্ছামত স্কেল বেধে দেয়া এবং কতকগুলো শ্রেণীর বেতন কমিয়ে দেওয়ার ফলে অবস্থাটা আরো গুরুতর হয়েছে। অনেক উদাহরণ দেখানো যেতে পারে যেখানে পে-কমিশনের রায় কার্যকরী করার পরেও একজন শ্রমিক ১৯৩৯ সালে যে বেতন পেত তার চেয়েও অনেক কম পাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিশেষ মাগ্গী স্বরুপ যে ৬ টাকা দেয়া হয়েছে তা শ্রমিকরা অপমানকর বোধ করে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় এখানকার জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকগুণে বেশি। এর কারণ, সম্ভবতঃ এই যে, পে-কমিশনে কোন শ্রমিক প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি এবং এর সভ্যরা এই প্রদেশে এসে নিজেদের চক্ষে আসল ব্যাপারটা কখনও দেখবার তকলীফ স্বীকার করেননি। গত বাজেট সেশনে মাননীয় যোগাযোগ সচিব পাক পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছিলেন যে, পে-কমিশনের মায়ের গলদ সংশোধন করার জন্য সরকার শীঘ্রই একটা কমিটি নিয়োগ করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ চার মাস পরেও সে কমিটি নিয়োগের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এমনিভাবে সরকার শ্রমিকদের জীবন নিয়ে বিনা দ্বিধায় ছিনিমিনি খেলছেন। ছাঁটাই ও অপরাপর সমস্যা সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়, ছাঁটাই কর্তৃপক্ষের একটা খেয়াল খুশীর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৯ সনে একবার কয়েক হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলো, কিন্তু কিছুদিন পরেই কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলেন এই ছাঁটাইয়ের কোন প্রয়োজন ছিল এবং ফলে সমস্ত ছাটাই কর্মচারীদের আবার কাজে নিয়োগ করা হলো, এমনকি বাইরের থেকেও লোক নিয়োগ করা হলো। হঠাৎ আবার কর্তৃপক্ষ ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছেন। খামখেয়ালী ছাটাইয়ের ফলে গরীব শ্রমিকদের যে কি দুর্ভোগ ভোগ করতে হয় তা কর্তৃপক্ষের নিশ্চয় স্মরণ থাকে না। গত বছরের ছাটাইয়ে যে সব ঝঞ্জাটের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যে নতুন ছাটাইয়ের হুমকি কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা সহজে অনুমান করা যেতে পারে। দক্ষতার শাসন ব্যবস্থা নিশ্চয় রেলের আয় বৃদ্ধি করতে পারে। ভুয়া অর্থনৈতিক কারন দেখিয়ে যদি ছাঁটাই শুরু করা হয় তাহলে সারা রেলওয়েতে যে তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি হবে তা রুখবার ক্ষমতা হয় রেল কর্তৃপক্ষের থাকবে না। সর্বস্ব কোরবান করে যা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছিল, ছাঁটাইয়ের অর্থ হয়ে তাদেরকে আবার হিন্দুস্থানে প্রেরণ করা।
কথায় কথায় আজকাল শ্রমিকদের চাকরি যায়। কর্তৃপক্ষতার কারণ দর্শানো বা কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেন না। চাকরির নিরাপত্তা নেই, কথায় কথায় চাজ শীট, সাসপেনসন। দুবছরেও একটা কে ফয়সালা হয় না। কোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও চাকরি পেতে। দুবছর আড়াই বছর লাগে। প্রমোশন, বদলী সবকিছু উপরওয়ালার খেয়াল খুশীমত চলে। স্বজনপ্রীতি খুব বেপরোয়াভাবে চলছে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের কোন হিসাব নিকাশ নেই। চাকরি থেকে অবসর নিলে পাঁচ বছরেও টাকা পাওয়া যায় না। তারা কি খেয়ে বেচে থাকে তার কোন বিবেচনা নেই। রেলের ক্লাবে মজুরদের জায়গা নেই। তারা অস্পৃশ্য। তাদের ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়া শিখানোর কোন ব্যবস্থাই নেই। সমবায় প্রথার বা সোস্যাল ইন্স্যুরেন্স-এর কোন স্কীম নেই। অথচ শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে হলে এসব স্কীমের প্রয়োজনীয়তা কে অস্বীকার করবে ? এসব বাধা বিপত্তির মধ্যে অাজকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শ্রমিকদের একতা এবং পারস্পরিক সক্রিয় সহযোগিতা। একতাবদ্ধ শ্রমিকদের সংগ্রামের সম্মুখে কোন জুলুমবাজ দালালই দাঁড়াতে পারবে না। ১৯৫১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকাতে পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২১ এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন নূরুল হুদা। পরবর্তী বৎসরের জন্যে এই সম্মেলনে যাঁরা রেল কর্ম চারী লীগের কর্মকর্তা নির্বাচিত হন তাঁরা হলেনঃ সভাপতি-নূরুল হুদা কার্যনির্বাহক সভাপতি চেরাগ আলী, মাহবুবুল হক। সহকারী সভাপতি—এম, এস, হক; এস, সি, এইচ ডক্টর এম, রহমান, সি, গ্যান সিলিভিস। সাধারণ সম্পাদক—এম, এ, হাই
ভাষা আন্দোলনের পূর্বেই পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের মধ্যে একটা নোতুন বিন্যাস ঘটে। বেশ কিছু; প্রগতিশীল জঙ্গী কর্মী ও নেতা এর মধ্যে দিয়ে তখন গড়ে ওঠেন। চট্টগ্রামে চৌধুরী হারুনর রশীদ ও এম, এস, হক এদের অন্যতম চৌধুরী হারুনর রশীদ ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে ছিলেন। জসিমউদ্দীন সহ উত্তর বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিভুক্ত রেল মোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের অপরাপর নেতারা পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী লীগের এই নোতুন বিন্যাসে সহায়তা করেন। ২২
৩। ডাক ও তার শ্রমিক
৬ই মার্চ, ১৯৪৯ তারিখে ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে পাকিস্তান পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১ এই অধিবেশনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধি আর এম,এস এর নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকেন। প্রতিনিধিরা ডাক ও তার কর্মচারীদের দুরবস্থার অনেক বর্ণনা দেন। বগুড়া ও কুমিল্লার উপরস্থ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের ও জমি পত্তনের ব্যাপারে দুর্নীতির বিতরণ শুনে উপস্থিত প্রতিনিধি এবং ডাক ও তার কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
পিয়ন ইউনিয়নের প্রতিনিধি পিয়নদের অবস্থা ও পে কমিশন সম্পর্কে আলোচনা করেন। নারায়নগঞ্জ টেলিগ্রাফ ইউনয়নের প্রতিনিধিরা ইউনিয়নে ঐক্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বক্তৃতা দেন।
এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ১৭টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার মধ্যে বেতন বৃদ্ধি, মফস্বলে গ্ৰেণশপের ব্যবস্থা, দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহার পরায়ন অফিসারদের অপসারণ, নিম্নতম দাবিগুলি মেনে না নিলে ধর্মঘটের ব্যালট গ্রহণ ও পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনে যোগদান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বি সিদ্দিকীকে সভাপতি ও আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ডাক ও তার শ্রমিক ইউনিয়নের একটি নতুন কমিটিও এই বার্ষিক অধিবেশনে গঠিত হয়।
১৯৫০ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সিলেটের জিন্না হলে নিখিল পাকিস্তান পোস্টম্যান ও লোয়ার গ্রেড স্টাফ ইউনিয়ন (আর, এম, এস সংযোজিত) এর তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২ এতে সভাপতিত্ব করেন নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি নুরুল হুদা। সারা পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সভার প্রারম্ভে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি গোপী কৃষ্ণ চৌধুরী তাঁর অভিভাষণে নিম্নতম ডাক কর্মচারীদের দুঃখ দুর্দশার অনেক বর্ণনা দেন। সম্মেলনের সভাপতি নুরুল হুদা তাঁর অভিভাষণে বলেন,
যে সকল দরিদ্র ডাক কর্মচারী জনসাধারণের খেদমত করিয়া আসিতেছেন তাঁহাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া আমাদের সরকারের কর্তব্য। একজন কর্মচারী ৩০ টাকা পাইবে এবং অপর জন ৩০০০ টাকা পাইবে এই প্রকার অর্থনৈতিক ব্যবধান আমরা বরদাস্ত করিব না। সাম্যের ভিত্তিতে আমাদের সমাজ গড়িয়া উঠিবে। ইহা ইসলামের মূল নীতি। প্রতিক্রিয়াশীলেরা আপনার কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখিবার জন্য যাহার জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশার কথা জনসাধারণের স্বমক্ষে তুলিয়া ধরিতেছেন অথবা তাহা লাঘবের চেষ্টা করিতেছেন তাহাদিগকে পঞ্চম বাহিনী, কম্যুনিস্ট, দেশদ্রোহী বলিয়া আখ্যা দিতে লজ্জা বোধ করিতেছেন না।
১৯৫০ সালের ৩রা ডিসেম্বর সিলেটের দুর্গাকুমার পাঠশালায় পাকিস্তান পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের সিলেট জেলা শাখার তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ৩ নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলী এতে সভাপতিত্ব করেন। ইউনিয়নের প্রাদেশিক সম্পাদক গোলাম মুর্ত্তজা সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, বর্তমান সরকারের সঙ্গে আপোষনীতিতে আর কার্য পরিচালনা করা সম্ভব নহে। তাঁহারা সকল প্রকার আপোষের পথ বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। তিনি আসন্ন সংগ্রামের জন্যে ইউনিয়নের সভ্যদের প্রতি আহ্বান জানান। সম্মেলনের সভাপতি সহ অপর যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁরা হলেন, লোয়ার গ্রেড স্টাফ ইউনিয়নের সভাপতি গোপীকৃষ্ণ চৌধুরী, সম্পাদক আখতার, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের বিদায়ী সম্পাদক ডি, এ চৌধুরী এবং এম, চৌধুরী। পরবর্তী বৎসরের জন্যে মাহমুদ আলী সভাপতি এবং দবীরউদ্দীন আহমদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রামের ডাক ও তার কর্মচারীরা ১৯৫০ সালের শেষ দিকে এক সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তাঁরা প্রতি মাসের ১৫ তারিখে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রতীক ধর্মঘট করবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা প্রতিমাসে ১৫ তারিখে ৪ ঘন্টা ধর্মঘটের সিদ্ধান্তকে কার্যকর করেন। ৪ এই প্রতীক ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের দাবী দাওয়া পূরণের কোন সম্ভাবনা না থাকায় ডাক ও তার কর্মচারীরা ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে এপ্রিলের ২ তারিখ থেকে তাঁরা সাধারণ ধর্মঘট শুরু করবেন।৫
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বঙ্গের পোস্ট মাস্টার জেনারেল ডাক ও তার কর্মচারীদেরকে ধর্মঘট আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখে একটি প্রেস নোট জারী করেন। এই প্রেস নোটের জবাবে ডাক ও তার কর্মচারীরা তাদের আন্দোলনে জনগণের সহযোগিতা প্রার্থনা করে একটি আবেদন প্রচার করেন।৬ নিম্নলিখিত এই আবেদনটিতে ডাক ও তার কর্মচারীদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আন্দোলনের সাধারণ পরিস্থিতির দুটা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
আমরা টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন কর্মচারীরা সারা পাকিস্তানের জনগণের প্রতি নিবেদন করছি যে, আমরা বার বার আমাদের ন্যূনতম দাবী-মূল বেতন বাড়ানোর জন্য পাক সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাচ্ছি না।
আপনারা জানেন পাকিস্তান সরকার প্রেস কমিশনের রায়ে যে মূল বেতন ঘোষণা করেছেন, তা দ্বারা আজকের এই দুর্মূল্যের দিনে মানুষের চতুর্মখী অভাবের লেলীহান ক্ষুধার এক অংশও পূরণ করা যায় না।
আজকের দিনে একজন নিম্নপদস্থ অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেড কর্মচারীর মূল বেতন কমপক্ষে হওয়া উচিত ৬০। সে জায়গায় পে-কমিশনের রায়ে দেওয়া হয়েছে ৩৮ টাকা। তাও এটা দেওয়া হয়েছে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে। উচ্চশ্রেণীকে, এবং নিম্নশ্রেণীকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৬/১৭ টাকা।
সেই জন্যেই পে-কমিশনের রিপোের্ট প্রকাশ হতেই আমরা এর উপর অসন্তােষ প্রকাশ করে আসছি এবং ঠিকই রিপোর্ট বের হবার পর থেকেই প্রায় ৬ মাস আমরা ধীরে চল-আন্দোলন চালিয়েছি। তারপর কিছুকাল হতে ; অসন্তোষের নমুনাস্বরপ প্রতি মাসের ৫ তারিখে ১ ঘন্টা করে প্রতীক ধর্মঘট চালিয়েছি এবং এরপর হতে গত কয়েক মাস যাবত ১ ঘন্টার হলে ২ ঘন্টা করে প্রতীক ধর্মঘট করি। এসব সত্বেও সরকার আমাদের দাবী দাওয়ার কোনরূপ বিবেচনা করেন নি, উপরন্তু হুমকি দেখিয়েছেন। এবং আমাদের মধ্যে ত্রাসের সন্চার করেছেন।
কিন্তু এতেও টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন কর্মচারীদের মনোবল এতটকু নষ্ট হয়নি বরং আমরা আমাদের দাবীর প্রতি অটল রয়েছি এবং আমাদের একতা দিন দিন দৃঢ়তর হয়ে চলেছে।
গত জানুয়ারী মাস হতে আমাদের প্রতীক ধর্মঘট ২ ঘন্টার স্থল ৪ ঘণ্টার নোটিশ দেওয়া হয় ; তখনই আমাদের মহামান্য ডিরেক্টর বাহাদুর আমাদের এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সম্পাদককে করাচী ডেকে পাঠান এবং তিন চার দিন আলোচনার পর একটা বিকল্প প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবে রয়েছে কেরানী, টেলিগ্রাফিস্ট এবং টেলিফোন অপারেটরদের জন্য ৩৫-৬০ টাকা বেতন।
পি, এম, জি, বাহাদুর এই কেরানী, টেলিগ্রাফি এবং টেলিফোন অপারেটরদের বেতন অর্থাৎ ৬৪-৪-১০০-৫-২০৫ এর সঙ্গে হিন্দুস্থানের তার কর্মীদের বেতনে তুলনা করে দেখিয়েছিন যে, সেখানে সেই একই কাজের জন্য ৩০-১৭০ টাকা দেওয়া হয়। আর নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের কথাটা ইচ্ছা করেই চেপে গ্যাছেন। এর দ্বারা পি , এম. জি বাহাদুর জনসাধারণকে ভুল বোঝানর চেষ্টা করেছেন এই বলে তারা এখানকার তার কর্মীদের হিন্দুস্থানের তার কর্মীদের অপেক্ষা বেশি দিতে আগ্রহী কিন্তু তার কর্মীদের গুয়ারতুমীর ফলেই কোন মীমাংস রায় আসা যাচ্ছে না ।
পি, এম, জি বাহাদুর যা বলেছেন তা সবই সত্য। কিন্তু কয়জন কর্মচারীর ভাগ্যে এই ২০০ টাকা পর্যন্ত পোঁছানো সম্ভব হবে সেটা হিসেব করে দেখাননি। কারণ এই ৬৪-৪-১০০-৫-২০০ টাকা হারে কোন বেতন ভোগীকে ২০০ পর্যন্ত পৌছাতে হলে যদি সে জীবনে কোন দিন ছুটি না নেয় (বিশেষ করে অস্থায়ী অবস্থায়) তা হলে তার লাগবে ২৯ বৎসর এবং যে এফিসিয়েন্সি বার দেখান হয়েছে তাতে যদি আটকা না থাকে। অথচ সিভিল সার্ভিস আইনে রয়েছে, ২৫ বৎসর চাকরি হলে আর কোন রকম ইনক্রীমেন্ট কোন কর্মচারীকেই দেওয়া হবে না। যুক্ত ভারত, অধুনা ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন কোন পে-কমিশনের নজির নাই যাতে বেতন হারের শেষ অংকে পৌছিতে ২৯ বৎসর লাগে।
তারপর পি, এম, জি বাহাদুর যে প্রেসনোট দিয়েছেন তার দ্বারা এই মনে হয় যে টেলিগ্রাফিস্টরাই এই ধর্মঘট করছে (পাক অবজারভার ১৬-২-৫১ )। কিন্তু প্ৰকৃতক্ষে তা মোটেই সত্য নয়। আমাদের মানুষের মত বাঁচার দাবীতে আমরা সমস্ত কর্মচারীরাই অংশ গ্রহণ করছি। কেরানী, টেলিগ্রাফিস্ট, টেলিফোন অপারেটর থেকে পিয়ন, লাইনম্যান, কেবলম্যান; কুলি ও ঝাড়ুদার প্রভৃতি সকলেই। আর আমরা সরকারের কাছে প্রতিটি শ্রেণীর কর্মচারীর বেতনের হার বাড়ার দাবী জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেছেন যে, টেলিগ্রাফিস্টরা সকলেই ম্যাট্রিকুলেট—আর তারা যে বেতনের হার দাবী করছেন, সে হারে (অর্থাৎ ৮৫-২৫৫) গ্র্যাজুয়েট কর্মচারীদের পাক সরকার বেতন দিচ্ছেন। যদি তাই হয় তাহলে আমরা তাঁকে একথা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি যে, তার খাস দফতরে কয়জন গ্রাজুয়েট আছেন ? আমাদের ধারণা শতকরা দশজনও কিনা সন্দেহ।
তিনি আরও বলেছেন যে, তারা যে কাজ করে সেটা কেবল পুনরাবৃত্তি করা মাত্র। একথাটা একেবারেই অর্থহীন, আর যদি তা হয়, তাহলে দুনিয়ার কোন দফতরের কাজ পূনরাবৃত্তি নয় ? আবার তিনি অন্যান্য দফতরের কর্মচারীদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করে কয়েকটি কথা বলেছেন। এখানে আমরা অন্য কয়েকটি দফতরের কর্মচারীর সঙ্গে আমাদের অবস্থার তুলনা দেখাতে চাই এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন রেলওয়ে দফতরের তুলনা দেখাচ্ছি : প্রথমেই কাজের সময়ের কথা ধরুন। প্রাদেশিক সরকারের এবং রেলের কতকাংশের কর্মচারীদের কাজের সময় অনিয়মিত। ২৪ ঘন্টার মধ্যে যেকোন সময়ে তার রাত-দিন-সকাল-সন্ধা কিছুই নাই এবং এই নিয়ম বৎসরের সকল ঋতুতেই চলা থাকে—তা সে ঝড় পানিতে দুনিয়া ভেসে যাক আর শীতের দাপটে বুকের রক্ত জমে যাক। তারপর তারা সপ্তাহের মধ্যে একদিন অর্ধ এবং একদিন পুরা বিশ্রাম ভোগ করেন। আর ক্যাজুয়েল লিভ বলে যে একটি জিনিস আছে তা যে কোন দফতরের কর্মচারীরাই সহজেই ভোগ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে এটাও পুরোপুরি ভোগ করা হয়ে ওঠে না। আমাদেরকে সাধারণতঃ ছুটি নিতে হলেই ডাক্তারের সার্টিফিকেট লাগে। প্রাদেশিক সরকারের কর্মচারীদের কথাই ওঠে না। যাদের বার মাসে তের পার্বণের ছুটি মিলে।
দ্বিতীয়তঃ অপরাপর দফতরের কর্মচারীরা যেখানেই বদলি হয়ে যান না কেন সেইখানে প্রায়ই তাদের বাড়ির বন্দোবস্ত থাকে। কিন্তু আমাদের বেলায় এসবের কোন বালাই নাই। কোন জায়গায় বদলী হলেই আমাদের চিন্তা—গিয়ে উঠব কোথায় ? এমনও হয় যে, কয়েক মাস হয়ত অফিসের বারান্দায় পড়েই কাটাতে হয়। তৃতীয়তঃ রেলের কর্মচারীরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ পান। এসব কথা আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর। চতুর্থতঃ রেলের কর্মচারীরা গমনাগমনের জন্য কয়েক রকমের ফ্রি পাস এবং অল্প দামে টিকিট পান। আমাদের এসব ভাবলে বিস্ময় জাগে। পঞ্চমতঃ রেলের কর্মীদের নিকট হতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের দরুণ যে টাকা কাটা হয়, সরকার পক্ষ হতে আরও তত টাকা তাদেরকে দেয়া হয়। এবং এ দুয়ের যোগফলের চক্রবদ্ধি হারে সুদ দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বেলায়—শুধু আমাদের থেকে যেটাকা কাটা হয় সেটা এবং তারই সুদ দেয়া হয়। তার উপর তার আবার যত বৎসর চাকরি করেন তত মাসের বেতন গ্র্যাচুইটি স্বরপ পান। আমাদের দাবীও তাই, অবসর আমাদের দরকার নাই। এত অসুবিধা সত্তেও সরকার বাহাদুর আমাদের ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত করার জন্য কত রকম ধারা উপধারার সৃষ্টি করে রেখেছেন তার ইয়ত্তা নাই। দেখানো হয়েছে—এই দফতর বাৎসরিক ৬০ লক্ষ টাকা ঘাটতির মধ্য দিয়ে চালিত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আমরা জানতে চাই, এর জন্য উপরওয়ালাদের অপরিনামদর্শিতা এবং কর্মদক্ষতার অভয়ই দায়ী নয় কি ? তাই আমরা তার কর্মচারীরা আপনাদের কাছে আপনাদের ভাই ও পিত্রের অধিকার বলে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারাই এ সঠিক বিচার করুন এবং আমাদের পথ বাদলে দিন। কারণ আমরা যদি অভুক্ত থাকি, তাহলে আপনাদেরই অংশ থাকবে। আমরা যদি উলঙ্গ থাকি আপনাদেরই অঙ্গ উলঙ্গ থাকবে। কারণ আমরা আপনাদেরই অংশ মাত্র। আমাদের উপরই নির্ভর করছেন লক্ষ লক্ষ আপনারাই। তাই আমরা অপনাদের নিকট আবেদন করছি আপনারা আমাদের বাঁচার দাবীকে সমর্থন করুন এবং সরকারকে আমাদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য করন।
৪। চা-শ্রমিক আন্দোলন
বৃটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলে যে চা উৎপাদনকারী এলাকা ভালো তার মধ্যে একমাত্র সিলেটই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেটের চা বাগানগুলোতে যে শ্রমিকরা কাজ করতেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত। ভারতের বিহার, যুক্ত প্রদেশ, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ, সাঁওতাল পরগনা ইত্যাদি থেকে এসে তাঁরা চা বাগানে শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং তার পর থেকে নিজেদের দেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পক ক্ৰমশঃ ছিন্ন হয়ে যায়। তারা চা বাগান এলাকাতেই ঘর-বাড়ি বেধে সেখানকারই স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হন। দেশ বিভাগের সময় সিলেটের এই চা বাগানগুলোতে শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষেরও বেশি।
যে বাগানে চা-শ্রমিকরা কাজ করতেন সেই বাগানের এলাকাতেই তারা বসবাস করতেন এবং শধু পুরুষরাই নয়, পরিবারের শ্ৰীলোক ও শিশুরাও বাগানের কাজে নিযুক্ত থাকতেন। চায়ের পাতা ছেড়ার কাজটি স্ত্রী শ্রমিকরাই করতেন। অপরাপর কাজও তারা ভালভাবেই করতে পারতেন। কিন্তু পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় তারা মজুরী পেতেন কম। পুরুষদের দিন মজুরী যেখানে ছিলো ৪৪ পয়সা, সেখানে তাঁদেরকে দেয়া হতো ৩৭ পয়সা।১
শ্রমিকদের এই সমস্ত চা বাগানে দুই ধরনের কাজ দেয়া হতো। এর একটির নাম হাজিরা এবং অপরটির নাম টিক্কা। সাধারণতঃ নিযুক্ত শ্রমিকদেরকে একটা নির্দিষ্ট কাজ দেওয়া হতো এবং সেটা শেষ করার পর তাঁরা তাঁদের নিয়মিত ও নির্ধারিত দিন মজুরী পেতেন। এই নির্দিষ্ট কাজ শেষ করার পর শ্রমিকদের যদি অন্য কাজের সময় থাকতে এবং কর্তৃপক্ষ যদি তাদেরকে অপর কোন কাজ দিতে পারতো তাহলে তারা সেই কাজ করতেন। এই দ্বিতীয় ধরনের কাজকে বলা হতো টিক্কা। এই টিক্কাকে ঠিক ওভারটাইম বলা চলে না। কারণ এ ক্ষেত্রে হাজিরার থেকে ছোটখাট কাজ দেয়া হতো এবং তাঁর জন্যে শ্রমিকরা মুজরীও পেতেন হাজিরার তুলনায় কম।২
১৯৪৫ সালে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এ আই টি ইউ সি) অধীনে এই চা-শ্রমিকদের মধ্যে শ্রীহট্ট জেলা চা-শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। এই ইউনিয়ন দেশ ভাগের পূর্বে কংগ্রেসীদের দ্বারা পরিচালিত হলেও সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে তখন কমিউনিস্টদের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। তবে ১৯৪৮ সালের পর থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক লাইনের ফলে এর মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব দ্রুত কমে আসে এ কংগ্রেসী পরিষদ সদস্য (এম এল এ) পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের নেতৃত্ব চা বাগান শ্রমিকদের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।৩
১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সিলেটের চা বাগান শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির যথেষ্ট তৎপরতা ছিলো। ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের লেবার কমিশনার ইস্ট পাকিস্তান লেবার জর্নাল-এ এ সম্পর্কে লেখেন,
শ্রমিকদের মধ্যে, বিশেষতঃ চা বাগান শ্রমিক ও সূতাকল শ্রমিকদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিরা চক্র ও উপদল গঠনে তৎপর রয়েছে। সশস্ত্র কার্যকলাপ সমর্থন করে আপত্তিজনক ইস্তাহার বিলি এবং শ্রমিকদের চীন ও বর্মার উদাহরণের পরামর্শ থেকে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত গ্রুপসমূহের অস্তিত্ব বোঝা যায়।৪
১৯৪৮ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত চা বাগান মালিকরা শ্রমিকদেরকে চাল সরবরাহ করতো। কিন্তু তার পর সারা পূর্ব বাংলায় চালের দর ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যে সরকার চা বাগান মালিকদেরকে জানিয়ে দেন যে, তাঁরা আর তাদেরকে পূর্বের মত চাল সরবরাহ করতে পারবেন না। এই সরকারী সিদ্ধান্তের পর ইণ্ডিয়ান টি এ্যাসোসিয়েশনের সুরমা উপত্যকা শাখার (১৯৪৮ সালেই এর নাম হয় পাকিস্তান টি এসোসিয়েশন) এক সভায় এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, বাগানের শ্রমিকদেরকে আর চাল সরবরাহ করা হবে না এবং তার পরিবর্তে প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত শ্রমিককে মাগগী ভাতার অতিরিক্ত তিন আনা করে দৈনিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এইভাবে চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের জন্যে চাল সরবরাহ সরকার ও বাগান মালিকদের দ্বারা বন্ধ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সেখানে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিকদের মধ্যে অন্দোলন শুরু হয় ৷৫
৯ই জুন, ১৯৪৮ তারিখে সিলেট থেকে প্রকাশিত জনশক্তি পত্রিকায় বাগানের শ্রমিকদের রেশন শীর্ষক একটি সংবাদে চা শ্রমিকদের রেশন সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ করে সিরাজনগর বাগান সম্পর্কে বলা হয় যে, এই বাগানে মালিকরা শ্রমিকদের বাজার থেকে চাল কিনতে বাধ্য করছে এবং তার ফলে শ্রমিকদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। শ্রমিকরা এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাহায্য গ্রহণ করে।
এই সংবাদের প্রতিবাদ করে সিরাজনগর চা বাগানের মালিক কয়সর রশীদ চৌধুরী সাপ্তাহিক নওবেলালেও একটি চিঠি প্রকাশ করেন। তাতে তিনি বলেন,
কোন এক রাজনৈতিক দলের কয়েকজন মুষ্টিমেয় লোকের প্ররোচনায় ৪ঠা জুন তারিখে শ্রমিকগণ বাগানের কাজে বাহির হইতে অস্বীকার করে। সেই জন্য একটা অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি না করার জন্য আমরা ৫ই তারিখ কাজ বন্ধ রাখি। পরের দিন অল্প সংখ্যক শ্রমিকের দ্বারা কাজ আরম্ভ হয়। ঐ দিনই বিকেল বেলা পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের সালারে-ই-সুবা, কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা এবং গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর বাগানে উপস্থিত হন। শ্রমিকদের সঙ্গে যথারীতি আলোচনার ফলে তাহারা তাহাদের মন হইতে ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করিতে সমর্থ হন। তাঁহারা অতি সহজেই পাকিস্তানি এলাকার অন্তর্গত চা বাগানে নানাবিধ বিঘ্ন সৃষ্টির কাজে লিপ্ত একদল অসৎ লোকের সন্ধান পান৷৬
বিঘ্ন সৃষ্টির কাজে লিপ্ত এই অসৎ লোকরা যে কমিউনিস্ট অথবা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত লোক এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং ঠিক এ জন্যেই চা বাগান শ্রমিকদের বিক্ষোভ দমনের উদ্দেশ্যে বাগানের মালিক পুলিশ, ন্যাশনাল গার্ড, গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর ইত্যাদিকে খবর দিয়ে বিক্ষোভ দমন করতে যথেষ্ট তৎপরতার পরিচয় প্রদান করেন।
চাল সরবরাহ বন্ধের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে সিলেটের চা বাগানগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকায় সরকার চা বাগানে চাল সরবরাহের সুবিধার জন্যে চা বাগানের ম্যানেজারদেরকে ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে স্টোরিং ও প্রকিওরিং এজেন্ট নিযুক্ত করেন। এর ফলে চা বাগান শ্রমিকদেরকে চাল সরবরাহের একটা ব্যবস্থা হলেও ম্যানেজরদেরকে চাল সংগ্রহের এজেন্ট নিযুক্ত করায় এই কাজে নিয়োজিত ধান চালের ব্যবসায়ী। ও তাদের অধীনস্থ কর্মচারী ও মজুরসহ প্রায় ৫০০ জন লোক বেকার হয়ে পড়ে। ফলে এই সরকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে কিছু বিক্ষোভ দেখা দেয়। ” ২৬শে জানুয়ারী, ১৯৪৯ তারিখে সিলেটে পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে পাকিস্তান চা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের রিপোর্ট অনুযায়ী তখন পাকিস্তানে চা বাগানের সংখ্যা ছিলো ১৩৩ এবং এগুলোতে আরদী জমির পরিমাণ ছিলো ৭৪,১০৮ একর। চা শিল্পের ক্ষেত্রে বাধা বিঘা দূর করার জন্যে সরকার যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সম্মেলন তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সম্মেলনে ৬ টি সাব কমিটির রিপোর্ট ও প্রতাবাদি বিবেচনা করা হয়। এই সাব কমিটির প্রত্যেকটিতে ইস্পাহানীদের নাম থাকায় চা শিল্প মালিক মুসলিম লীগের পরিষদ সদস্য মোদাব্বের হোসেন চৌধুরী আপত্তি করা সত্তেও প্রত্যেকটি সাব কমিটিতেই তাদের নাম বহাল থাকে। ইস্পাহানী কোম্পানী এ সময়ে খুব বড়ো আকারে চা শিল্পে পুজি নিয়োগ করতে শুরু করে।
চা বাগান শ্রমিকদের জন্য চাল সরবরাহ সম্পর্কে সম্মেলনে একটি সুপারিশ করা হয়। তাতে বলা হয় যে, সরকারের উচিত শ্রমিকদেরকে সপ্তাহে মাথাপিছু, চার সের চাল বরাদ্দ করা। এই সময় সরকারের পক্ষ থেকে চা বাগান কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দাবী-দাওয়া পেশ করার ব্যাপারে একটা প্রচেষ্টা চালানো হয়। এই উদ্দেশ্যে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান চা বাগান মুসলিম কর্মচারী সঙ্ঘের ১৯৪৯ সালের বার্ষিক সম্মেলন ২০শে ফেব্রুয়ারী শ্রীমঙ্গল টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব বাংলা সরকারের চীফ হুইপ খাজা নসরুল্লাহ। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ওপর নিম্নলিখিত রিপোর্টটি নওবেলালে প্রকাশিত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের চা বাগানসমূহে প্রায় ১৩০০ কর্মচারী আছেন। তন্মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৪৮। চা শিল্পে মুসলমানের ন্যায্য দাবী পুরনারথে পুনঃ পুনঃ প্রতিশ্রত হইয়াও শ্বেতাঙ্গ ম্যানেজারগণ সে বিষয়ে নিতান্ত উদাসীনতার পরিচয় দিতেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের চা বাগানে প্রত্যেক ৩০০ একর জমির অনুপাতে একজন করিয়া মুসলিম শিক্ষানবিশ রাখিতে, ভবিষ্যতের সকল শুণ্য পদগুলোতে মুসলিম কর্মচারী নিয়োগ করিয়া মুসলমানের ন্যায্য অংশ ৭০% পূর্ণ করিতে ও এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার নিয়োগের বেলায় মুসলমানকে পূর্ণ সুযোগ দিতে দাবি জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়! ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে শ্রীহট্ট জেলা চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক তিন সপ্তাহকাল সিলেটের বিভিন্ন চা বাগান সফর করে শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট দেন।১০ তাতে তিনি জানান যে, অধিকাংশ বাগানেই রেশনে চাল আবার দেওয়া হলেও সে চাল একেবারেই খারাপ। তাতে ধান ও কুড়ার পরিমাণ খুব বেশি এবং তাই তাদেরকে প্রতিসের সাত আনা দরে কিনতে হয়। তেলিয়াপাড়া চা বাগানে তিন দিনের বেশি কেউ জ্বরে ভুগলে তাকে রোগী ভাতা দেওয়া হয় না। খেজুরী ডিভিশনে যে তেল দিয়েছিলো তা নিতান্ত খারাপ বলে এবং ফুলছড়া বাগানের যে ডাল দিয়েছিলো তা গন্ধযুক্ত বলে শ্রমিকরা তা কিনতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে খেজুরী ডিভিশনের খারাপ তেল কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন করে ভাল তেল সরবরাহ করে। চা বাগান শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির যে প্রভাব ছিলো তা ১৯৫০ সালের দিকেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। এরপর পূর্ণেন্দু, কিশোর সেনগুপ্তের (কংগ্রেস) নেতৃত্বে শ্রীহট্ট জেলা চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কাজ কর্ম চলতে থাকলেও শ্রমিকদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলন তাঁর নেতৃত্বে হয়নি। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সরকার এবং চা বাগান শ্রমিকরা শ্রমিকদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি করে।
১৯৫১ সালের ২২শে জুলাই কুলাউড়ায় পুর্ণেন্দু, কিশোর সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে শ্রীহট্ট জেলা চা-শ্রমিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে দেড়শোরও বেশি প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিক প্রতিনিধিরা বাগানে নির্ধারিত হারে রেশন না দেয়া, খারাপ রেশন দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ করেন। পুরো রেশন না দেয়ায় ঘাটতি পূরণের জন্যে শ্রমিকদেরকে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে চাল কিনে আনতে হয় এবং এইভাবে প্রয়োজনীয় চাল আনতে আনসাররা বাধা প্রদান করে বলে প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন। এর ফলে প্রয়োজনীয় চাল সরবরাহের অভাবে শ্রমিকদের কষ্ট অনেক বৃদ্ধি পায়। যে কয়েকটি প্রস্তাব এই সম্মেলনে গৃহীত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ১। নারী শ্রমিকদের কাজের সময় শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিশু সদনের ব্যবস্থা করা। (২) বহু, বাগানে কোদাল, চাকু ইত্যাদি হাতিয়ারপত্র বহু, পুরাতন ও অকেজো হইয়া পড়ায় কাজের অসুবিধা হয় ও বেশি সময় লাগে। এ জন্যে নতুন চাকু কোদাল ইত্যাদি সরবরাহ করা। (৩) পাতা তোলার জন্য মেয়েদের কাপড়ের টুকরা বন্ধ করে দেয়ায় মেয়েদের নিজেদের কাপড়ের ক্ষতি হয়। এ জন্য পূর্ব নিয়ম মতো টুকরো কাপড় আবার সরবরাহ করা। পূর্ণেন্দু, কিশোর সেনগুপ্তকে সভাপতি নির্বাচিত করে সম্মেলনে শ্রীহট্ট জেলা চা-শ্রমিক ইউনিয়নকে পূর্নগঠিত করা হয়।
৫। সূতাকল শ্রমিক
১৯২৭ সালে গোপাল বসাক ১ নং ঢাকেশ্বরী মিলে শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা করেন। সেই সময় তিনি সেখানে শ্রমিকদের ধর্মঘট করান এবং তার জন্যে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে জড়ানো হয়। গোপাল বসাকের এই প্রাথমিক ভূমিকার জন্যে তাঁর ওপর ঢাকেশ্বরী মিল কর্তৃপক্ষের বরাবরই একটা জাতক্রোধ ছিলো।১
গোপাল বসাকের গ্রেফতারের পর ঢাকেশ্বরীতে শ্রমিক ইউনিয়নের প্রাথমিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু তা সত্তেও তাঁর একটা সাধারণ প্রভাব সেখানকার শ্রমিকদের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলো। সেই প্রভাবকে অবলম্বন করে ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ১৯৩৫-৩৭ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছাকাছি শীত লক্ষা নদীর দুই পাড়ে প্রথমে ১নং ঢাকেশ্বরী ও পরে লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলে এবং তারপর চিত্তরঞ্জন মিল ও ২ নং ঢাকেশ্বরী মিলে সুতাকল শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে।২
দুটি তাগিদকে নিয়ে এই সময় ঢাকায় স্থাপিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। এর একটি হলো, নিয়মিতভাবে নির্ধারিত মজুরী প্রদান ও মিলে কাজ করার নিম্নতম সহায়ক, পরিবেশ সৃষ্টি। অপরটি হলো, জবার ও লাইন সর্দারদের জুলুম ও জবরদস্তি বন্ধ করা। শ্রমিকরা এই দুই দাবিতে মিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইলে তার জন্যে সংগঠন অর্থাৎ ইউনিয়নের প্রয়োজন এই কথাটিই শ্রমিকদেরকে প্রথমে বোঝানো হয়। এই উদ্দেশ্যে শ্রমিক ব্যারাকে ও আশে-পাশের গ্রামাঞ্চলে প্রচারও করা হয়। এইভাবে ১৯৩৫ ৩৬ সালে লাইন সর্দারদের নজর এড়িয়ে মিলের ভিতরে গোপনে ইউনিয়ন গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর লেখা ইস্তাহার ছড়িয়ে এবং মিল এলাকার বাইরে সভা করে ১ নং ঢাকেশ্বরী মিলে নতুনভবে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা হয়। ১৯৩৫-৩৭ সালে লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের ভিতরেই কয়েকজন কমিউনিস্ট কর্মী ও সহযোগির সহায়তায় ছোট ছোট দাবি আদায়ের জন্যে সমবেত প্রচেস্টায় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। এই সময় লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলে শ্রমিকদের মজুরী ছিলো অনিয়মিত। এই দুটি ইউনিয়নই ঢাকা থেকে যোগাযোগকারী কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গড়ে ওঠে। তবে পার্টি তখন পর্যন্ত এগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেনি। ইউনিয়ন দুটির চরিত্র ছিলো মূলতঃ ট্রেড ইউনিয়নের৷৩ সে সময় বাংলাদেশে সকল শ্রমিকদের (সুতা ও বস্ত্র) সব, থেকে জঙ্গী সংগঠন ছিলো বেঙ্গল টেক্সটাইল শ্রমিক ইউনিয়ন। কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলে এই শ্রমিক ইউনিয়নের পতাকা তলে নিয়মিত মজুরী ও নিয়মিত কাজের দাবিতে তখন ছোটখাট অন্দোলন প্রায়ই চলতে থাকে। বেঙ্গল টেক্সটাইলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিত্যানন্দ চৌধুরী ১৯৩৭ সালে ঢাকায় এসে সুতাকল শ্রমিক, বিশেষতঃ লক্ষ্মী নারায়ন কটন মিলের শ্রমিক ইউনিয়নকে একটা শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে দেন। সন্ত্রাসবাদী রাজবন্দীরা, জেলখানা থেকেই কমিউনিস্ট হয়ে ১৯৩৮ সালে বেরিয়ে এসে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। এই সময় নারায়নগঞ্জের আশে পাশের সূতাকল গুলিতে পার্টি নোতুনভাবে সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োগ করে। এর ফলে ১৯৩৫-৩৭ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের যে ভিত্তি এই অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছিলো তা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ কয়ে। পার্টি প্রভাব ও সংগঠন যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে ব্যাপক শ্রমিক সমাবেশ ঘটে। এইভাবে ১৯৩৮-৪০ সালে ২নং ঢাকেশ্বরী, চিত্তরঞ্জন এবং ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে ঢাকা কটন মিলে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ও নেতৃত্বে জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। স্থায়ী কর্মসূচী ও কাজের নিদিষ্ট ধারা ও পদ্ধতির ভিত্তিতে সংগঠিত হয় ঢাকা জেলা সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়ন।৪
এই সময়ে বিপ্লবী সমাজতন্ত্র দলও (আর, এস, পি,) ১নং ও ২নং ঢাকেশ্বরী মিলে একটি সমান্তরাল ইউনিয়নের পত্তন করে। ৫ শ্রমিক থেকে শুরু, করে কেরানী, অফিসার সকলেই সেই ইউনিয়নের সভ্য ছিলেন। ফলে তাতে অফিসারদেরই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব ছিলো এবং তার নীতি ছিলো মালিকদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি। এজন্যে মিল কর্তৃপক্ষের কাছে তারা অনেক সুযোগ সুবিধা পেতো এবং অফিসাররা তাদেরকে সাহায্য করতো।
শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে শ্রমিকদেরকে তাঁদের নিজস্ব দাবী ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত করার পরিবর্তে কেরানী এবং বিশেষতঃ অফিসারদের স্বার্থ রক্ষার দিকেই সেই ইউনিয়নের নজর ছিলো বেশি। এবং এই কারণেই তার ওপর সাধারণ শ্রমিকদের বিশেষ কোন আস্থা ছিলো না। আর, এস, পির এই ইউনিয়নটিকে মিল কর্তৃপক্ষ স্বভাবতঃই সুনজরে দেখতে এবং কমিউ নিস্টদের দ্বারা পরিচালিত ইউনিয়নটির ব্যাপারে সব সময়েই খুব সজাগ ও সতর্ক থাকতো। ৬ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে কারমুক্ত আর, এস, পি, নেতৃবন্দ তাঁদের পরিচালনাধীন সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়নের কাজে সব শক্তি নিয়োগ করে কমিউনিস্ট পার্টির ১ গঠন ও প্রভাবকে নিমূল করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সে প্রচেষ্টা সফল হয় নি। ৭ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ ও নিরন্তর কাজের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সূতাকল শ্রমিকদের ইউনিয়ন ও আন্দোলন বলিষ্ঠভাবে সংগঠিত হয়। সে সময় শুধু, ঢাকা জেলাতেই নয়, সারা বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির সব চেয়ে শক্তিশালী শ্রেণী সংগঠন ছিলো সকল শ্রমিক ইউনিয়ন। ঢাকা জেলায় সূতাকল শ্রমিকরাই পার্টির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগ্রহী ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের কাজের ভিত্তিতেই এই। সময় নারায়ণগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী ইউনিট গড়ে উঠেছিলো। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সময় মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পার্টির নেতৃত্বে সূতাকলগুলিতে যে ঐতিহাসিক ধর্মঘট চলে তাতেই প্রমাণিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি সকল শ্রমিকদের মধ্যে পার্টি সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন গড়তে কি পরিমাণ সাফল্য অর্জন করেছিলো। ৮ সারা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কংগ্রেস লীগ কতৃক শ্রমিক আন্দোলনে বাধা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং পরিশেষে দেশ বিভক্তির প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই সূতাকল শ্রমিকদের ওপরও পড়ে। ইতিপূর্বে ধর্মঘটের সময় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনাকে অবলম্বন করে মালিক পক্ষ ও সরকার অনেক ইউনিয়ন কর্মী ও নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেছিলো। এর ফলে পার্টি এক অসুবিধাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলো। ৯.দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে ২নং ঢাকেশ্বরী মিলে ইউনিয়নের প্রায় ৪ শত কর্মী ছাঁটাই হয়ে যান। ঐ সময় বেশ কিছু, সংখ্যক শ্রমিক দেশত্যাগও করেন। তবে এ সব সত্তেও পার্টির প্রভাব ও পরিচালনায় ইউনিয়ন সক্রিয় থাকে। এর ফলে ১৯৪৭ সালে অক্টোবরে নারায়নগঞ্জে যে পব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গঠিত হয় তাতে শুধু, যে রেল, চা বাগান ও অন্যান্য শিল্পে কমিউনিস্টদের প্রাধান্যের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি ভাল। অবস্থান রক্ষা করতে সক্ষম হয় তাই নয়। সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়নও সে ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশেষ শক্তি জোগায়। শ্রমিক দের অবিসম্বাদী নেতা নেপাল নাগ ফেডারেশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন অনিল মুখার্জী !১০ । অনিল মুখার্জীর বিরুদ্ধে সে সময় এক মিথ্যা খুনের মামলা থাকায় তিনি প্রকাশ্যে তাঁর কাজে যোগ দিতে পারতেন না। নেপাল নাগই বস্তুতঃপক্ষে তখন ফেডারেশনের প্রাণস্বরপ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার অল্প দিন পরই আসে ভার তীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের নতুন রণনীতি।
এই মোতুন লাইনে সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতিই প্রাধান্যে আসে এবং তার প্রতিক্রিয়া সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়ন সহ সকল প্রকার শ্রেণী সংগঠন ও গণ সংগঠনের মধ্যে দেখা দেয়। অপর দিকে পাকিস্তানের। শাসক চক্র কমিউনষ্ট পরিচালিত ইউনিয়নগুলো ভেঙ্গে ফেলার জন্য সূতাকল চক্র কমিউনিস্ট পরিচালিত ইউনিয়নগুলো ভেঙ্গে ফেলার জন্য সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়নসহ অন্য ইউনিয়নগুলির ওপর পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক ও নির্মম নির্যাতন শুরু করে। এই পর্যায়ে রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মতো ঢাকা জেলা সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশন থেকে বহিস্কৃত হয়। ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সুতাকল এলাকায় তাদের প্রাধান্য স্থাপনের জন্যে সকল শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। দালালরা বেশ কিছু, শ্রমিককে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। অনেক শ্রমিক মিল পরিত্যাগ করে চলে যায়। ১১ পাকিস্তান সরকার আইনতঃ কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘোষণা না করলেও পার্টি তখন বস্তুতঃপক্ষে নিষিদ্ধই হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় সমস্ত নেতৃহানীয় কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতারা গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নে খোলাখুলি কাজ তো বটেই, এমনকি গোপন কাজও স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকে বিরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে যেটুকু কাজ হচ্ছিলো ১৯৪৯ এর শেষ দিকে সেটাও কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা আর সম্ভব ছিলো না। ১২।
চট্টগ্রাম ন্যাশনাল কটন মিলে যে শ্রমিক ইউনিয়ন ছিলো সেটিকে ফয়েজ আহমদ ১৯৫১ সাল পর্যন্ত নিজেদের কর্তৃত্বাধীনে আনতে পারেন নি। এজন্যে সেই ইউনিয়নটির বিরদ্ধে সরকারের সহায়তায় তাঁরা নানান চক্রান্তে লিপ্ত হন। ৪ঠা মে, ১৯৫১, তারিখে নারায়নগঞ্জে সরকার পূর্ব বাঙলার সূতা কলগুলিতে শ্রমিক-মালিক বিরোধ মীমাংসার জন্যে একটি ত্রিদলীয় বৈঠক আহবান করেন। চট্টগ্রাম ন্যাশনাল কটন মিল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সতীশচন্দ্র ভদ্র সেই বৈঠকে যোগদান করার উদ্দেশ্যে নারায়নগঞ্জ গেলে সেখানেই তাঁকে গ্রেফ তার করা হয়। এ সম্পর্কে ইউনিয়নের সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও সহ-সম্পাদক মখলজ রহমান একটি বিবৃতিতে১৩ বলেন যে, ১৯৫০ সালের জানুয়ারী থেকে সতীশ চন্দ্র ভদ্র ও মখলজ রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ৬০০ সুতাকল শ্রমিক নিম্ন তম বেতন ৩০ টাকা, মাণণী ভাতা ৩০ এবং ওভার টাইম ও বোনাসের জন্যে আন্দোলন করে আসছিলেন। দুই একজন দালাল ব্যতীত শতকরা ৯৯ জন শ্রমিক এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। এমতায়হায় সতীশ চন্দ্র ভদ্র ও মখলজ রহমান এিদলিয় বৈঠকে উপস্থিত থাকলে তাঁরা চট্টগ্রাম ন্যাশনাল কটন মিলের পক্ষ থেকে সরকার ও তাঁদের দালাল ফয়েজ আহমদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নেবেন না, এজন্যেই ” ভদ্রকে নারায়নগঞ্জে গ্রেফতার করা হয়। মখলজ রহমান বৈঠকে যোগ দিতে না যাওয়ার কারণে তাকে তখন গ্রেফতার সম্ভব হয় নাই। কিন্তু ত্রিদলীয় সম্মেলন চলা কালে নারায়নগন্জ এ পুলিশ বারবার তাঁর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে থাকে। বিবৃতিটিতে আরও বলা হয় যে, তাঁরা . আহমদের সম্পর্কে খুবই সচেতন থাকার ত্রিদলীয় বৈঠকের পূর্বেই সমস্ত সকল প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক ডাকার জন্যে চট্টগ্রাম সূতাকল শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বাধীন ফেডারেশনের কাছে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই বৈঠকেই ত্রিদলীয় সম্মেলনে পেশ করার জন্যে দাবী নির্ধারণ ও প্রতিনিধি নির্বাচন করার কথা সেই প্রস্তাবে বলা হয়। তাঁরা তাঁদের প্রস্তাবে ফয়েজ আহমদকে জানিয়ে দেন যে, উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে যদি ১৯৪৯ সালের মতো শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কোন চুক্তি করা হয় তাহলে সেই ত্রিদলীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত। চট্টগ্রাম কটন মিল শ্রমিক ইউনিয়ন মেনে নিতে বাধ্য থাকবে না। এ সর্বশেষে বিবৃতিটিতে তাঁরা ঘোষণা করেন যে, তাঁদের। ইউনিয়ন সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে তাঁদের দাবি। আদায়ের জন্যে এবং ইউনিয়ন সম্পাদক সতীশ ভদ্রকে মুক্তির দাবীতে ৭ই মে, ১৯৫১ তারিখ থেকে তাঁরা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।
সরকার ও তাদের অনুগত পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন কমিউনিস্ট পরিচালিত ও তাঁদের বিরোধী সকল শ্রমিক ইউনিয়নগুলির বিরদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে সূতাকল শ্রমিকদের আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ধংস করে দেয়।
৬। সিমেন্ট শ্রমিক
সিলেট জেলার ছাতকে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ছিলো অবিভক্ত বাংলাদেশের একমাত্র সিমেন্ট কারখানা। দেশ বিভাগের পর ছাতক পূর্ব বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই সিমেন্ট কারখানাটি পূর্ব বাঙলায় অবস্থিত হওয়া সত্বেও তার মালিকানা তখন ছিলো ভারতীয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অক্টোবর আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে ধর্মঘট করেন।১ তৎকালে ভারতবর্ষ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হলেও দেশ বিভাগের ফলে যে বিশেষ অবস্থা প্রথম দিকে বিরাজ করছিলো তাতে পাকিস্তানে অবহিত ভারতীয় মালিকানাধীন এই ফ্যাক্টরীর সমস্ত কিছুই, এমনকি শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক পর্যন্ত, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো আসাম সরকারের তত্তাবধানে। এজন্যে ১৫ই অক্টোবরের ধর্মঘটের পর ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে শ্রমিকদের দাবী মীমাংসরি জন্যে আসাম সরকার এ্যাড়জুডিকেটর (সালিশ) নিযুক্ত করেন। ২
সিমেন্ট কারখানার শ্রমিকদের দাবী ছিলো-বরখাস্ত শ্রমিকদের পুর্ননিয়োগ, সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ টাকা ধার্য ; সকলের জন্যে মাগ্গি ভাতা ৪৫ টাকা, প্রচলিত গ্রেড প্রথার সংশোধন ; দিন মজুরী প্রথার বদলে মাসিক বেতন প্রথার প্রবর্তন, সকলের জন্যে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা, বেতন-সহ সাপ্তাহিক ছুটি; সরকারী কর্মচারীদের ন্যায় বার্ষিক ছটির ব্যবহা, ৫ টাকা হারে সাধারণ মজুরী বৃদ্ধি ; চিকিৎসার পুরোপুরি ব্যবহা; কুমরা; বড়ছড়া প্ৰভতি অস্বাস্থ্যকর স্থানে বিশেষ স্বাস্হ্য ভাতা, সকলের জন্যে পাকা কোয়ার্টার ও পূর্বাহারে কোয়াটার ভাড়া, প্রয়োজন মতো রেশন, ছাঁটাই বন্ধ করা, ইউনিয়নকে স্বীকার করা ইত্যাদি। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর এ্যাডজুডিকেটরদের রায় প্রকাশিত হয়। তাতে সর্বনিম্ন বেতন, মজুরী বৃদ্ধি, মাগগী ভাতা বৃদ্ধি ইত্যাদির কোন কথাই ছিলো না। বিচারকরা মালিকের শ্রমিক ছাটাইয়ের একতরফা অধিকার স্বীকার করেন, কাজেই ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগের কথাই ওঠে না। এমনকি ইউনিয়নকে স্বীকৃতিদান এর পর কোন শ্রমিক ধর্মঘট চট্টগ্রাম কটন মিলে হয়েছিলে কি না সে সম্পর্কে অার কোন রিপোর্ট কোথাও পাওয়া যায়নি।
করা উচিত একথা নীতিগতভাবে স্বীকার করলেও ইউনিয়নের বাস্তব স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাঁরা কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের এই সম্পর্কিত আইনের উল্লেখ করে সে বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট রায় দানে বিরত থাকেন। আসাম সরকার নিযুক্ত সালিশের এই রোয়েদাদের বিরুদ্ধে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়। ৩ ১৬ই মার্চ, ১৯৪৯, তারিখে এই সিমেন্ট কোম্পানী শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সমিতির সভ্য এবং ইউনিয়নের বিশিষ্ট কর্মী দ্বিজেন সোমকে হঠাৎ গ্রেফতার করা হয়। কোম্পানী, কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় কয়েকজন চোরাকারবারী এই এই গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করে। দ্বিজেন সোমকে এইভাবে গ্রেফতার করায় সিমেন্ট কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৯শে মার্চ এই ঘটনার প্রতি বাদে অনুষ্ঠিত কোম্পানীর শ্রমিকদের এক সাধারণ সভায় সরকারের দমন নীতির নিন্দা করে এবং দ্বিজেন সোমের মুক্তির দাবী জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করা হয়। সভায় উপস্থিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ১৫০ জন। ৪।
১৯৫১ সালের ২২শে এপ্রিল ছাতকে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানীর শ্রমিক ইউনিয়নের নবম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ৫ এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অবিভক্ত আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী। ২২শে এপ্রিলের অধিবেশনে নিম্নলিখিত যে প্রস্তাবগুলি পাস হয় সেগুলোর মধ্যেই ছাতক সিমেন্ট কারখানার শ্রমিকদের তৎকালীন অবস্থার একটা সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় । আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানীর শ্রমিকরা বর্তমানে যে হারে বেতন পাইতেছেন তাহা দ্বারা ক্রমবর্ধমান দুর্মূল্যতার মধ্যে জীবন ধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। খাদ্যদ্রব্য, কাপড় ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকরুপে বাড়িয়াছে। বর্তমানে একজনের শুধু খাওয়া খরচ কমপক্ষে ৩৫ টাকা লাগে তদুপরি অন্যান্য খরচও আছে। অর্থাৎ একজনের খরচের জন্য, অন্ততঃ ৫০ টাকার প্রয়োজন। অথচ একজন সিমেন্ট শ্রমিক সর্বনিম্ন মাসিক নগদ ডি, এ, সহ ৪৫ টাকা পান এবং সস্তা মূল্যে রেশন পান। যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হয় তাহাতে প্রয়োজন পূরণ হয় না। তদুপরি যাহাদের পরিবার সঙ্গে থাকেন না তাহার শুধু, নিজের রেশন পান। পরিবারের জন্য কোন রেশন দেওয়া হয় না। ছুটির সময়ও রেশন দেওয়া হয় না। শুধু, চাউল, তৈল, লবণ, মরিচ, হলদি ও চিনি রেশন হিসাবে সুবিধা মূল্যে দেওয়া হয়। অন্যান্য সমস্ত জিনিসই বাজার মূল্যে কিনিতে হয়। এই অবস্থায় গড়ে ৪ জনের একটি পরিবারের বর্তমান আয়ে মাসের পনেরো দিনও চলে না। ফলে অর্দ্ধ উপবাসী থাকিতে হয় এবং সকলেই ঋণগ্রস্ত। এই আয়ও সকল সময় পুরোপুরি হয় না। ছোট খাট দুর্ঘটনা ঘটিলে শ্রমিকরা কোন ক্ষতিপূরণও পান না, আবার যে কয়দিন কাজে অনুপস্থিত থাকিতে হয় তাহার জন্য কোন বেতনও পান না। ক্ষতিপূরক ছুটি দেওয়া হয় অথচ দিন মজুরী প্রথায় নিযুক্ত শ্রমিকরা এই ছুটির জন্য কোন বেতন পান না। তান্যদিকে শ্রমিকদের উপর কাজের চাপ বাড়িয়াছে। যাহারা গত কয় বৎসরে নানা কারণে সিমেন্ট কোম্পানী ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন অথবা বরখাস্ত হইয়াছেন । তাহাদের স্থলে নতুন লোক নিযুক্ত করা হয় নাই। কোয়ার্টারের জন্য অনেক শ্রমিক অসুবিধা ভোগ করিতেছেন। অতি ধীর গতিতে কোয়ার্টার তৈরি করা হইতেছে। পরি কোয়ার্টারের জন্য এই অায় হইতেই ভাড়া দিতে বিভিন্ন বিভাগের অদ্ধ দক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকদের দক্ষতার তুলনায় অত্যন্ত কম বেতন দেওয়া হইতেছে। কোম্পানী প্রতিষ্ঠাকালে দুমূর্ল্যতার পূর্ব্বেই একজন ক্রেইন ডাইভার ৮৫ টাকা বেতন পাইতেন এখন পান ৪০ টাকা। এক বার্গার ১২৫ টাকা পাইতেন অথচ বৰ্ত্তমানে একজন বার্ণারকে ৫০ টাকা দেওয়া হইতেছে। একজন ইলেকট্রিক মিল ৯০ টাকা পাইতেন সেই হলে এখন একজনকে ৬০ টাকা দেওয়া হইতেছে। এই অবস্থা সমস্ত ডিপার্টমেন্টেই বিদ্যমান। কোম্পানীতে প্রায় ৩০০ জন শ্রমিক কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করেন। ইহাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ইহাদের ভাগ্যে কাজ ও মজুরীর অনিশ্চয়তা, বাসস্থানের অভাব; সংগঠিত আন্দোলনের সুযোগের অভাব। অথচ ইহারা যে কাজ করেন তাহা সব সময়ই কোম্পানীর প্রয়োজন। তাহা সত্বেও কোম্পানী সোজাসুজি ইহাদের উপর নির্মম শোষণ চালাইতেছেন। গত তিন চার বৎসরে সিমেন্টের বিক্রয়মূল্যও প্রচুর বাড়িয়াছে। অথচ বুহ, আবেদন নিবেদন সত্বেও শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার প্রতি কোম্পানী উদাসীন রহিয়াছেন। শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানী লেবর ইউনিয়ন আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানী কর্তৃপক্ষের নিকট নিম্নলিখিত ন্যায়সঙ্গত সর্বনিম্ন দাবী জানাইয়াছে এবং আশা করিতেছে যে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে দাবী পূরণ করিয়া শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকার করিবেন।
দাবীসমূহঃ
১। সর্বনিম্ন মাসিক মূল্য বেতন ৫৫ টাকা।
২। নগদ মাগগী ভাতা মাসিক ৩৫ টাকা ও বর্তমান মূল্যে প্রয়োজন অনুযায়ী রেশন এবং ছুটির সময়ের পর রেশন দিতে হইবে।
৩। সর্বনিম্ন বেতন যে হারে বাড়িবে সেই হারে সকলের মূল্য বেতন বৃদ্ধি।
৪। যে সকল শ্রমিক ও কর্মচারীর মূল্য বেতন দক্ষ তার তুলনায় অল্প দেওয়া হইতেছে তাহাদের বেতন বৃদ্ধি।
৫। বেতনসহ ক্ষতিপূরক ছুটি।
৬। দিন মজুরী প্রথা অবসান করিয়া সকলকে মাসিক প্রথায় নিয়োগ করিতে হইবে।
৭। সকলের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোয়ার্টারের ব্যাবস্থা করিতে হইবে এবং বিনা ভাড়ায় কোয়াটার অথবা কোয়ার্টার এলাওয়েন্স দিতে হইবে।
৮। প্রভিডেন্ট ফান্ডে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানীর দেয় অর্থের উপর শ্রমিকদের পুরা অধিকার স্বীকার করিতে হইবে।
৯। বৎসরে বেতন সহ ২১ দিন প্রিভিলেজ লীভ ১০ দিন ক্যাজুয়েল লীভ ও ১ মাস পুরা বেতনে অসুস্ত তার জন্য মেডিকেল লীভ দিতে হইবে।-
১০। দৈনিক উৎপাদন ২০০ টনের উপর হইলে তার শতকরা ২৫ ভাগ উৎপাদন বোনাস হিসাবে সকলকে দিতে হইবে। ১১। কনট্রাক্টরের অধীন শ্রমিকদের সোজাসুজি কোম্পানী কর্তৃক নিয়োগ করিতে হইবে।
১২। (ক) প্রত্যেক মজুরকে ফ্রি ঔষধ কোম্পানী কর্তৃক সরবরাহ করিতে হইবে। (খ) কোন মজুর কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হইলে তাহাকে কোম্পানী কর্তৃক কোম্পানীর খরচে অন্যত্র পাঠাইয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। (গ) কোম্পানী কর্তৃক নিয়োজিত ডাক্তার কম্পাউন্ডারের ভিজিট তুলিয়া দিতে হইবে।
১৩। শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য কোম্পানীর পক্ষ হইতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফিলটারের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
১৪। বিনা বেতনে স্কুলের নিজস্ব গৃহে প্রত্যেক শ্রমিক ও কর্মচারীদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
সিলেট মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতা এই অধিবেশনে যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে বক্তৃতা করেন মাহমুদ আলী, নূরুর রহমান, মতসির আলী ও হাসান আলী। আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরী শ্রমিক ইউনিয়নের পূর্ববৰ্ত্তী সভাপতি আবদুল বারী চৌধুরীর মৃত্যু হওয়ায় তার স্থানে মাহমুদ আলী পরবর্তী বৎসরের জন্য ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া মতসির আলী সম্পাদক কৃপাসিন্ধু রায় চৌধুরী ও সমরু মিয়া সহ-সভাপতি এবং সুরেন্দ্র কুমার চৌধুরী ও রইছ মিয়াকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫১ সালের ১৪ই ও ১৫ই জুন ছাতকে মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে ইউনিয়নের কার্যনির্বাহক কমিটির পর পর তিনটি বৈঠক হয়। ৬ কোম্পানী কর্তৃপক্ষ নানা ছুতায় শ্রমিকদের সরাসরি বরখাস্ত, সাময়িকভাবে অপসরণ ও শাস্তিমূলক সতর্কীকরণের যে নীতি গ্রহণ করেন সে বিষয়ে কার্যনির্বাহক সমিতি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাতে পাকিস্তান সরকারের শ্রম মন্ত্রী বাঙলা সরকারের লেবার কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রস্তাবে বলা হয় যে, সব রকম আইন কানুনের খেলাফ করে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে যেভাবে শ্রমিক নির্যাতন করছেন তা বন্ধ না করলে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এবং তার জন্যে একমাত্র কোম্পানী কর্তৃপক্ষই দায়ি থাকবেন। ১৫ই জুন মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল কোম্পানীর চীপ ইঞ্জিনিয়ার শেফারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধিদল শ্রমিকদের যে সমস্ত অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করেন তার মধ্যে ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ক্যান্টিন, গ্রোসারীশপ, চিনি; কেরাসিন প্রতি সম্পর্কে যে সমস্ত অভিযোগ করা হয় তার যথা সম্ভব প্রতিকারের আশ্বাস দেন। যে কয়জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে সে বিষয়ে কোন পূর্নবিবেচনা করতে তিনি নিজের অক্ষমতা জানান। ঐদিন বিকেলেই মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে সিমেন্ট শ্রমিকদের একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউনিয়নের সম্পাদক মতসির অালী, নূরুর রহমান, হাবিবুর রহমান, সমরু মিয়া ; রইস মিয়া ও গোস্বামী সেই সভায় বক্তৃতা করেন। প্রত্যেক বক্তাই শ্রমিক ঐক্যের ওপর জোর দেন এবং মাহমুদ আলী বলেন যে, শ্রমিকরা যদি একতাবদ্ধ হতে না পারেন তাহলে তাঁদের উচিৎ ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেওয়া।
১২ই নভেম্বর, ১৯৫১, তারিখে ছাতকে সিমেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সাধারণ সভা মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।৭ চীফ ইঞ্জিনিয়ার কার্তৃক, শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় আচরণ ও ধারাবাহিকভাবে শ্রমিক ছাটাইয়ের তীব্র প্রতিবাদ করে সভায় বক্তৃতা করেন ইউনিয়ন সম্পাদক মতসির আলী। এছাড়া শ্রমিকদের মধ্যে সমরু মিয়া, ব্রহ্মচারী, গোস্বমী ভট্টাচার্য রইস মিয়া, ইন্তাজ আলী প্রভৃতি বক্তৃতা দেন। শ্রমিক বক্তারা প্রত্যেকেই কোম্পানী কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বলেন যে, সেগুলির প্রতিকারের জন্যে তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে বহু, আবেদন নিবেদন করেছেন কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। কারণ কর্তৃপক্ষ বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্তেও কোন প্রতিশ্রতিই তারা রাখেন নি। নিরুপায় হয়ে অবশেষে তাঁরা পূর্ব বাঙলা সরকারের লেবার কমিশনারের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ জানিয়ে তার প্রতিকারের আবেদন জানিয়েছেন। সভায় শ্রমিকরা ঘোষণা করেন যে তাঁদের দাবীসমূহ আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। মতসীর আলী আন্দোলন জোরদার করার জন্যে প্রত্যেক শ্রমিককে একদিনের বেতন ইউনিয়ন তহবিলে জমা দেওয়ার আবেদন জানান এবং শ্রমিকরা সকলেই তাতে সম্মত হন। কিন্তু এসব সত্বেও ছাতক সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক ইউনিয়ন কোন সত্যিকার আন্দোলনই শ্রমিকদের দাবী দাওয়ায় ভিত্তিতে সংগঠিত করতে সক্ষম হয় নি। ১৯৫২ সালের জানুয়ারীতে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় পূর্ব বাঙলা সরকারের লেবার কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৮ এই প্রতিনিধিদলে থাকেন ইউনিয়নের সভাপতি মাহমুদ আলী, সম্পাদক মতসির, আলী, মনিরউদ্দীন আহমদ এবং আরও দুইজন। তাঁরা তিনটি বিষয়ে লেবার কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই বিষয়গুলি হলো ঃ সিমেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে পেশাগত শ্রমিকদের নিম্নতম দাবী; শ্রমিকদের ওপর কোম্পানীর স্ট্যান্ডিং অর্ডার; এবং কোম্পানী কর্তৃপক্ষ কর্ত্তৃক বেপরোয়া শ্রমিক বরখাস্ত। প্রতিনিধি দলের বক্তব্য শোনার পর লেবার কমিশনার শ্রমিকদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার করবেন বলে যথারীতি আশ্বাস প্রদান করেন। ছাতকে অবহিত আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নে কমিউনিস্টদের কোন প্রভাব না থাকায় এবং তখনকার দিনে অপর কোন সরকার বিরোধী শক্তিশালী সংগঠন সারা পূর্ব বাঙলায় না থাকায় সিলেট মুসলিম লীগের নেতারাই এই শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁদেরই তত্তাবধানে এই ইউনিয়নটির যাবতীয় কাজ পরিচালিত হতো। এই মুসলিম লীগভক্ত ও মুসলীম লীগ পন্থী শ্রমিক নেতারা সরকারের কিছু কিছু সমালেচনা ক্ষেত্র বিশেষে করলেও তারা মোটামুটিভাবে ছিলেন সরকারের সঙ্গে অপোষপন্থী। তাছাড়া শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার কোন প্রকৃত তাগিদও তাঁদের মধ্যে ছিলো না। এ জন্যে শ্রমিকদের দুরবস্থা, তাঁদের ওপর নির্মম শোষণ ও নির্যাতন সত্তেও সিমেন্ট শ্রমিকদের কোন প্রতিরোধ আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। কাজেই মাঝে মাঝে শ্রমিক সভা আহবান করে সেখানে জোর এই তিন জনের পুরো নাম পত্রিকা রিপোর্টে নেই। গলায় কিছু বক্তৃতা প্রদান এবং কারখানা কর্তৃপক্ষ ও সরকারী লেয়ার কমিশনারের কাছে আবেদন নিবেদন ব্যতীত অন্য কিছুই তাদের দ্বারা সম্ভব হয় নি।
৬। ডক শ্রমিক
চট্টগ্রাম বন্দরের হাজার হাজার ডক শ্রমিক চরম দুরবস্থায় থাকলেও তাঁদের কোন সুসংগঠিত ও জঙ্গী ইউনিয়ন না থাকায় তাঁদের ওপর শোষণের মাত্রা অন্যান্য শ্রমিকদের তুলনায় অনেক বেশি ছিলো। এই ডক শ্রমিকেরা কোন নির্দিষ্ট কোম্পানীর দ্বারা নিযুক্ত ছিলেন না। বস্তুতঃপক্ষে শ্রমিকদেরকে নিয়মিতভাবে নিযুক্ত করার মতো কোন কোম্পানী সে সময় চট্টগ্রাম বন্দরে ছিলো না। কাজেই ডক শ্রমিকেরা তখন ঠিকাদারদের দ্বারা দৈনিক ভিত্তিতে দিন মজুরের মতো মজুরী পেতেন। সেই অবস্থায় তাঁদের নিরমিত মজুরী কাজের নিশ্চয়তা অথবা অন্যান্য কোন অধিকারই শ্রমিক হিসেবে ছিলো না। ১৯৪৯ সালের ১৪ই অাগষ্ট চট্টগ্রাম বন্দরের এই ডক শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। ১ এর পূর্বে তিন মাস ধরে ঠিকাদাররা তাঁদেরকে নিয়মিত মজুরী দিচ্ছিলো না। তার ওপর ১২ই ও ১৩ই অাগষ্ট সারা দিন কাজ করার পর ঠিকাদাররা শ্রমিকদেরকে বেতন না দেওয়ায় ৫ হাজার শ্রমিক সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত ধর্মঘট করেন। ধর্মঘট চলা কালে জেটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রমিকদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে পুনরায় কাজে যোগদান করলে তাঁদের পাওনা মজুরী মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শ্রমিকরা কাজে যোগদানের পর তাঁদের মজুরী তো মিটিয়ে দেওয়া হলোই না, উপরন্তু তাদেরকে আদেশ দেওয়া হলো ১৪ই অগাষ্ট তারিখেও কাজ করে যাওয়ার। জেটি সুপারিন্টেন্ডেন্টের এই বিশ্বাসঘাতকতায় বিক্ষুব্দ শ্রমিকরা স্বাধীনতা দিবসে উপবাস থেকে কাজ করতে সম্মত হলেন না এবং সেদিন থেকেই আবার ধর্মঘট শুরু করলেন। এরপর তাঁরা মিছিল করে গিয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্টের বাসার চারিদিকে পিকেটিং করে স্লোগান দিতে থাকলেন। পাকিস্তানের দুশমন, ধ্বংস হউক, বাকী টাকা আদায় করো, বেঈমানরা নিপাত হউক, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। এইভাবে ঘেরাও হয়ে জেটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেনারেল ম্যানেজারকে ফোন করেন এবং ম্যানেজার পরিস্থিতির গুরত্ব উপলব্ধি করে তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদেরকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ায় অন্যে তাকে নির্দেশ দেন। এইভাবে শ্রমিকরা নিজেদের পাওনা মজুরী আদায় করার পর জেটি কন্টাক্টররা শ্রমিকদেরকে এই মর্মে ভয় দেখায় যে তাঁরা যদি আবার ধর্মঘট করেন তাহলে তারা পাকিস্তানের বাইরে থেকে শ্রমিক আমদানী করবে।
১৯৫০ সালের তানয়ারীর শেষ দিকে চট্টগ্রামের ডক শ্রমিকরা জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে পোর্ট শ্রমিক ইউ নয়নের (মেরিনার্স এমপ্লয়স ইউনিয়ন)। একটি সভায় – শ্রমিকদের দাবী পূরণ না করলে ধর্মঘটরে সিদ্ধান্ত নেন। ২ ” কিন্তু ধর্মঘটকে কার্যকর করতে না পারার ফলে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। এজন্যে ঐ বৎসরই অগাস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ হাজার ডক শ্রমিক পূর্ব বাঙলা সরকারের শ্রমমন্ত্রী ও লেবার কমিশনারের কাছে একটি খোলা চিঠি দেন। ৩ তাতে – তাঁরা বলেন, আমরা চট্টগ্রাম জেটি ও পোর্ট অঞ্চলের ১০ হাজার মজলুম ডক মজুর নিছক পেটের দায়ে স্ত্রী পুএ লইয়া জান বাঁচাইবার প্রয়োজনে আপনাদের নিকট বাধ্য হইয়া এই চিঠি লিখিতেছি। আমাদের বিনীত আরজ- আমরা যে কি ভাবে আছি তাহা স্বচক্ষে একবার দেখিয়ে যাইবেন!
প্রথমতঃ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ডকের দশ হাজার মজুর শতকরা ১০০ জনই মুসলমান। বৃটিশ আমল হইতে যে সব দেশী বিদেশী স্টীমার কোম্পানী ও তাদের এজেন্টরা এবং স্টীভেডোর ও লেবার কন্ট্রাক্টর গোষ্ঠী যে জুলুম ও শোষণ আমাদের উপর চালাইতেছিল তাহা এখনও বিদ্যমান। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে বেশি হইয়াছে।
দ্বিতীয়তঃ না আছে ধন দৌলত না আছে জায়গা ভূমি। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও সর্বনাশ দাঙ্গায় আমরা ক্ষতবিক্ষত ও রিক্ত। মেহনত বিক্রয় করা আমাদের একমাত্র পেশা । অথচ মাসের মধ্যে ১৫ দিনও কাজ পাওয়া যায় না ! এমতাবস্থায় বো ছেলেমেয়ে লইয়া অর্ধাহার ও অনাহারই আমাদের চিরসঙ্গী। আমরা কাহার কাজ করি, আমাদের মুনিব কে (অসপষ্ট) আমরা চিনি না। মুনিবও আমাদের কোন খোঁজ খবর রাখে না। অথচ দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেকটি পোর্টেই বিভিন্ন কোম্পানীর স্থায়ী মজুর রেজিষ্টার আছে। পাকিস্তান তাহার ব্যতিক্রম হইবে কেন ? সমস্ত পোর্টেই বিশেষ করিয়া কলিকাতা পোর্টে ফেলেন, বি, আই ইলিয়াজ ইত্যাদি। কোম্পানী দিনে ২.২৫ টুফি রাতে ৫.৫০ ও প্রতি ঘন্টায় অতিরিক্ত কাজের জন্য ৫০ টাকা হিসাবে দিতে বাধ্য হইয়াছে। অথচ সেই একই কোম্পানী একই কাজের জন্য আমাদিগকে দিয়া থাকে ১. অানা ও ২ টাকা। ইহা কোন দেশী বিচার ?
দুনিয়ার সমস্ত পোর্টে ৭/৮ ঘণ্টার বেশি কাজ নাই। কাজে হাজির হইলে কাজ হউক আর না হউক তলব পাইয়া থাকে। অথচ আমাদের উপর চাপান হইয়াছে ৯ ঘন্টা খাটুনী। কাজে হাজির থাকিলেও কাজ না হইলে গর হাজিরা বা আধা বা থ্রি কোয়াটার তলব দেওয়া হয়।
জখমী ও অসুস্থ মজুরের জন্য না আছে চিকিৎসার ব্যবস্থা না আছে কোন ন্যায্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। এমনকি ৫/৬ পয়সা খরচ করিয়া বসন্ত কলেরার টিকা দেওয়া হয় না। আমাদের জানের দাম কি ৫/৬ পয়সার চেয়েও কম ? অথচ চট্টগ্রাম পোর্টের মত এত দুর্ঘটনা অন্য কোন পোর্টে হয় না। এমন কোন দিন বা রাত্রি নেই ২/৪ জন জখম অথবা মারা না যাইতেছে। এই জঘন্য অত্যাচারকেও কি পাকিস্তানের আইন বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে ? কয়লা, সিমেন্ট প্রভৃতি ময়লা জিনিষের কাজ করিয়া গোসল করিবার জন্য সমস্ত জেটি অঞ্চলে কোন পানির ব্যবস্থা নেই। এমনকি খাইবার পানিরও কোন ব্যবস্থা নাই। বস্তীর নালা ডোবার ময়লা পানি খাইয়া নানা ব্যারামে মরিতেছি। কুলি বলিয়া আমরা খাইবার পানি হইতেও বঞ্চিত থাকিব । ঘরের অভাবে আমরা অর্ধেকেরও বেশি থাকি খোলা মাঠে। জনের ভাগ পড়ে সোয়া হাত হইতে দেড় হাত জায়গা। এইটুকু জায়গায় মালিকদের বাড়ির বিড়াল কুকুরেরাও কি থাকিতে পারিবে ?
কোটি কোটি টাকা খরচ করিয়া জেটি ও গুদাম তৈরি হইতেছে। অথচ সেই জেটিকে যাহারা চালু রাখিবে সেই মজুরদের মাথা গুজিবার ঠাইও নাই। আমরা খুব ভাল করিয়া জানি যে আমাদের মেহনতের বদৌলতে দেশী বিদেশী মুষ্টিমেয় ধনী মালিকগষ্ঠী কোটি কোটি টাকা। মুনাফা লুটিয়া কোরমা পোলাও খাইয়া গাড়ি হাঁকাইতেছে। আর আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদন্ড, যাহারা একদিন কাজ বন্ধ করিলে তামাম পূর্ব পাকিস্তান অচল হইয়া যাইবে তাহাদের কপালে দুবেলা ভাতও জুটে না। তাই সেই চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে আপনাদের নিকট আমাদের একান্ত অনুরোধ যাহাতে আমাদের ন্যায্য দাবীগুলি পূরণ হয় তাহার ব্যবস্থা করিবেন। আশা করি আমাদের আবেদন ব্যর্থ হইবে না।
পূর্ব বাঙলার শ্রম মন্ত্রী ও লেবার কমিশনারের কছে পাঠানো চট্টগ্রাম বন্দরের ডক শ্রমিকদের এই চিঠির ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট সরকার কোন পদক্ষেপই গ্রহণ না করায় শ্রমিকদের অবস্থার বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। তারা সে সময়ে এতই দুর্বল এবং অসংগঠিত ছিলেন যে, তাদের দ্বারা কোন ধর্মঘটও সম্ভব ছিলো না। এই অবস্থা আরও এক বৎসর চলার পর ১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে ডক শ্রমিকেরা চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে একটি চরমপত্র প্রদান করেন। তাতে তাঁরা বলেন যে, পে কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে শ্রমিকদেরকে ভাওতা দেওয়া চলবে না, উর্ধ্বতন পোর্ট কর্মচারীদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, সকল শ্রমিকের জন্যে বাসস্থান চাই, চট্টগ্রাম ডক শ্রমিকদের জন্যে করাচীর ডক শ্রমিকদের সমান মজুর দিতে হবে। এই দাবীগুলি পূরণ করা না হলে তারা ধর্মঘট করবেন বলেও চরমপত্রটিতে ঘোষণা করেন।৫
এই সময় চট্টগ্রাম পোর্ট মেরিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম ডক শ্রমিকদের একটি সাধারণ সভা হয়। ৬ এই সভায় ডক শ্রমিকদের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ ও সমস্যাবলীর আলোচনা করে ডক শ্রমিকদের প্রতি পোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুসৃত নীতির তীব্র নিন্দা করা হয়। বিশেষ করে শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন না বাড়াবার মতলবে উধ্বতন কর্মচারীরা পে-কমিশনের রিপোর্টের ইচ্ছেমতে ব্যাখ্যা যেভাবে করেছেন তার সংশোধনের জন্যে পোর্ট কমিশনারের কাছে দাবী জানানো হয়। করাচীর ডক শ্রমিকরা এবং চট্টগ্রামের আর, এস, এন কোম্পানী লিমিটেড, আই; জি ; এন রেলওয়ে কোম্পানী লিমিটেড, বার্মা অয়েল কোম্পানী (পি, টি,) লিমিটেড প্রভৃতি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তাঁদের থেকে যে বেশি বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন তার প্রতি পোর্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
উর্ধ্বতন কর্মচারীগণ কর্তৃক ব্যক্তিগত স্বার্থে বেতন ভোগী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, বদলি ও নিয়োগ সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষের আদেশ ও নির্দেশাবলী গোপন রাখা, শ্রমিকদের বার্ষিক বর্ধ্বিত ভাতা অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেয়া, এক বৎসরের মতো কাজ করার পরও তাদের জন্যে চাকরির স্থায়ী বন্দব্স্থা না করা, উর্ধ্বতন কর্মচারীগণ কর্তৃক সব সময়ে পিছনের দরজা দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো কর্মচারী ও শ্রমিক নিয়োগ করা, উর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজন প্রীতি ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা করে সভায় প্রস্তাব পাস করা হয়।
*শ্রমিকদের পক্ষে ধর্মঘট না হলেও ব্যবসায়ীরা চট্রগ্রাম বন্দর এলাকায় ৯ ও ১০ই নভেম্বর ১৯৫০ তারিখে ধর্মঘট করে।দুই দিন ধর্মঘটের পর ১১ই তারিখে ব্যবসায়ী ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর ধর্মঘটের অবসান ঘটে এবং কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের অভাব অভিযোগ দূর করবেন বলে আশ্বাস দেন।৪
তিন মাইল ও তার থেকেও বেশি দূরবর্তী স্থান থেকে এসে যারা কাজ করেন তাঁদের জন্যে বিশেষ ভাতার বন্দবস্ত করা হলেও ফ্লোটিং ক্র্যাফটস কর্মচারীদের সেই সুবিধা থেলে বন্চিত করা হয়। তাঁরাও অনুরূপ ভাতা দাবী করলে অফিসাররা তা অগ্রাহ্য করে। সে জন্যে এই বিভাগের কর্মচারীদের জন্য এই সভায় অনুরূপ ভাতা দাবী করা হয়। এই প্রসঙ্গে সভায় উল্লেখ করা হয় যে, পোর্ট কমিশনের চেয়ারম্যান এবং জহুর আহমদ চৌধুরী যৌথভাবে একবার উপরোক্ত বিভাগের দারোয়ান, খালাসী ও অপরাপর কর্মচরীদের বস্তী এলাকা পরিদর্শন করেন। তাদের বাসস্থান ও সাধারণ ভাবে বস্তী এলাকার বিপর্যস্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চেয়ারম্যান নিজে তার সুব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু হান্সার বিট স্টাফদের জন্যে আবাসের ব্যবস্থা করলেও দারোয়ান খালাসী প্ৰভৃতি নিগৃহীত কর্মচারীদের জন্যে কোনো ব্যবস্থাই তারা করেননি।
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীর প্রায় সমান হারে বেতন ও ভাতা ভোগ করেন। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্যে সেই একই নীতি অনুযায়ী বেতন ও ভাতা দেয়ার দাবি জানানো হয়। ডক শ্রমিকদের সাধারণ সভা ও পোর্ট মেরিনার্স এসোসিয়েশনের কর্যকারী সভায় উপরোক্ত সমস্ত বিষয়ের পর্যালোচনা করে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানানো হয় এবং বলা হয় যে, কর্তৃপক্ষ ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর আশু সমাধান না করলে শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্যে সর্বাত্মক ধর্মঘট করতে বাধ্য হবেন।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার শ্রমিকদের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ডক শ্রমিকরা তুলনায় অনেকের থেকে বেশি শোষিত ও নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও বলিষ্ঠ ও জঙ্গী ইউনিয়নের অভাবে এবং ধর্মঘটসহ অন্যান্য সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে অক্ষম হওয়ার জন্যে তাঁদের দাবী দাওয়া পূরণের ক্ষেত্রে পে কর্তৃপক্ষ ও সরকার স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে বেশি অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করে। এই অবজ্ঞা ও অবহেলার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ক্রমাগত তীব্রতর হয়।
৭। তৈল শ্রমিক
দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় তৈল শিল্প বলতে কিছু ছিলো না। বার্মা অয়েল কোম্পানী (বিওসি) বিদেশ থেকে তেল আমদানী করে পূর্ব বাংলায় বিতরণ করতো। এই তৈল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র ছিলো চট্টগ্রাম। সেখানে বিওসি শ্রমিক ইউনিয়ন নামে বিওসিতে কর্মরত শ্রমিকদের একটি ইউনিয়ন ছিলো। তিন বৎসর ধরে বিওসি কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিম্নতম দাম দাওয়ার প্রতি কর্ণপাত না করে অনমনীয় থাকায় শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে ১৯৫১ সলের ১৫ই জানুয়ারী চট্টগ্রামের ডবল মুরিং ময়দানে একটি সাধারণ সভা আহ্বান করেন। এই সভায় সহস্রাধিক বিওসি শ্রমিক উপস্থিত থাকে সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়নের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী।”১
সভার শুরুতে বিওসি শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক আবূুল হাই শ্রমিকদের অভাব অভিযোগ ও দাবী-দাওয়া সম্পর্কে বলেন,
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এই ইউনয়ন শ্রমিকদের জন্য ৩ মাসের বোনাস, ভাতা, বৎসরে ২৭ দিন (পাকিস্তান দিবস সহ) বেতন সহ সাধারণ ছুটি, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শ্রমিক বদলী ও বরখাস্ত ইউনিয়নের মারফং করা, অসুখের ছুটিও ছাঁটাইয়ের সময় ছাঁটাইকৃত শ্রমিককে এক বৎসরের পুরো বেতন দেবার দাবি পূর্বক বিওসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কটে। তাছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের দিনে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় শ্রমিকদের বর্তমান দৈনিক মজুরী ১ আনার স্থলে ১মাসিক ভাতা ৪২ টাকার স্থলে ৪৫ টাকা ও ঘর ভাড়া বাবদ ৫ টাকা দেওয়ার দাবি করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব দাবিকে কোন আমল দেয়নি। অথচ বিভাগ-পূর্ব সময়ে পেট্রোলের দর যখন ১v ছিল তখনও শ্রমিকদের উপরোক্ত হারে বেতন দেয়া হতো, আর আজ যখন পেট্রোলের দর প্রতি গ্যালন ৪/ তখনও শ্রমিকদের বেতনের কোন হ্রাসবৃদ্ধি হয়নি, অথচ এই বিদেশী বেনিয়া বৃটিশ দালালরা শ্রমিকদের শোষণে শোষণে নিষ্পেষিত করে অতিরিক্ত তৈল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে বিলেত পাঠিয়ে দিচ্ছে। বিওসি লেবার ইউনিয়ন কিছুদিন পূর্বে উপরোক্ত দাবী দাওয়াগুলো লেবার কমিশনের কাছে জানায়। তখন লেবার কমিশনার মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের মধ্যস্থ হিসেবে দৈনিক মজুরী ১ এলাউন্স ৪৫ টাকা ও ঘরভাড়া বাবত ৫ টাকা সাব্যস্ত করেন, কিন্তু তাও বিওসি বোর্ড অব ডাইরেক্টরস-এর অনুমতি সাপেক্ষে।
সম্প্রতি বি, ও, সির ম্যানেজার জানিয়ে দিয়েছে যে, বোর্ড অব ডাইরেক্টর তা স্বীকার করে নি। এইভাবে বিগত তিন বৎসর যাবত দালাল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু তাদের দাবি দাওয়ার কোন সুরাহা করে নি। পক্ষান্তরে কর্তৃপক্ষ গোপনে কতিপয় ভাড়াটিয়া দালাল সৃষ্টি করে শ্রমিক ইউনিয়নের সংহতিকে বিলোপ সাধনের অপকৌশল করছে।
দুনিয়ার সবখানেই শ্রমিকরা রোববারে ছুটি পায়। কিন্তু বি, ও, সি কোম্পানীর শ্রমিকরা রোববারে ছুটি পায় না-যদিও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বেতনসহ ছুটি পায়। শুধু তাই নয়। আজাদী দিবসেও বি, ও, সি, শ্রমিকদের ছুটি হয় না। পাকিস্তানী শ্রমিকদের পাকিস্তানের আজাদী দিবসে ছুটি না দেওয়া প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।……..
বি, ও, সি, শ্রমিকদের সাধারণ অবস্থা আবদুল হাই অভাবে বর্ণনা করার পর ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৫১, থেকে সুনির্দিষ্টকালের জন্যে শ্রমিকদের ধর্মঘটের সিদ্ধান্তকে একটি সঠিক পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেন। এর পর অন্যান্য বক্তারা শ্রমিকদের ন্যায় সঙ্গত দাবির সমর্থনে বক্তৃতা করেন। এবং সব রকমের সাহায্য দিয়ে আন্দোলনকে জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেন।
চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিসের দুইজন কর্মী মকছুদুর রহমান ও আজিজুর রহমান বি, ও, সি শ্রমিকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে তমদ্দুন মজলিসের সব প্রকার সম্ভাব্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলীম লীগ নেতা এম, এ, আজিজ। বি, ও সি কতৃপক্ষের বর্বর নীতি এবং পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তান মুসলিম লীগের নিষ্কৃয়তায় তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন যে, এই বৃটিশ দালালরা শ্রমিকদেরকে দুই এক আনা বেশি দৈনিক মজুরী দিতে নারাজ অথচ তারা নিজেদের কুকুরের জন্যে দৈনিক ব্যয় করে ৫ • ৫০। এই অবস্থা সত্বেও পাকিস্তানের দালাল নেতারা বিদেশে বলে বেড়ায়, পাকিস্তানের লোকেরা বেশ আরামে আছে। বি, ও, সির শ্রমিক রাজন মিয়া বক্তৃতা প্রসঙ্গে নিজের জীবনের দূর্বিসহ অবস্থার যে বিবরণ দেন তার মাধ্যমে শ্রমিকদের সাধারণ অবস্থার নিদারুণ এক চিত্রই উন্মোচিত হয়। সব শেষে বক্তৃতা করেন সভার সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী। তিনি পাকিস্তান সরকারের এম নীতি এবং বৃটিশ সৃষ্ট ঘৃণ্য কারখানা আইনের তীব্র নিন্দা করেন ও তার উচ্ছেদ দাবি করেন।
বি, ও, সি কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি না মানলে পরবর্তী ১লা ফেব্রয়ারী থেকে শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্যে ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন বলে ১৫ই জানুয়ারীর এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বি, ও, সি, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবিগুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেনে না নেওয়ায় তারা পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৫১, থেকে ধর্মঘট শুরু করেন। ঐক্যবদ্ধভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে দুই সপ্তাহের মতো ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের প্রায় সমস্ত মূল দাবিগুলিই স্বীকার করতে বাধ্য হয়।২ এর ফলে নিম্নস্তরের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী ১ টাকা চার আনা থেকে ১ টাকা ছয় আনা, মাগগী ভাতা সহ প্রতিমাসে বেতন হয় ৮৬•৬২ টাকা। প্রতি বৎসরে ১৭ দিনের হলে দুটি হয় ২৭ দিন, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ছুটি ঘোষিত হয়, কোম্পানীর এলাকার বাইরে শ্রমিকদের সভা করার অধিকার স্বীকৃত হয়, ১৯৪৯-৫০ সালের জন্যে ১ মাসের বোনাস দেওয়া হয়। এছাড়া আরও কতকগুলি ছোটখাট দাবি কোম্পানী কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে। এ পর্যন্ত পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন কলকারখানায় ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের যে কিছু, আন্দোলন ও ধর্মঘট হয়েছিলো তার মধ্যে সব থেকে সফলজনক ছিলো বি, ও, সি, শ্রমিকদের এই ধর্মঘট।
৮। বাটা শ্রমিক
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলায় যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তার পর বাটা কোম্পানী এক বিরাট সংখ্যক শ্রমিক আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে পূর্ব বাঙলায় চলে আসেন। এই সমস্ত শ্রমিকদের জীবন ধারণের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে পূর্ব বাঙলা সরকার ও বাটা কোম্পানী কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা বহু আবেদন নিবেদন করেন। কিন্তু এই আবেদন নিবেদনের প্রতি সরকার অথবা বাটা কোম্পানী কর্তৃপক্ষ একেবারেই ভ্রুক্ষেপ না করায় তারা কতকগুলি দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের সময় বাটা শ্রমিকরা ২০শে জানুয়ারী, ১৯৫১, তারিখে মুসলিম লীগ দলের কাছে নিজেদের দাবি দাওয়া পেশের উদ্দেশ্যে ঢাকার মকুল সিনেমায় সেই সময় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভায় মিছিল সহকারে উপস্থিত হন। শ্রমিকরা আশা করেছিলেন যে মুসলিম লীগ সরকার তাঁদের বক্তব্য সহানুভূতির সঙ্গে শুনবেন ও দাবি দাওয়াগুলি সম্পর্কে বাটা কোম্পানী কর্তৃপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে মুসলিম লীগ সেই শ্রমিক মিছিলটির ওপর নিজেদের পালিত গণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক শ্রমিকদের অমানুষিকভাবে প্রহার করে এবং মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।”১
*বিস্তৃত বিবরণের জন্য পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি দ্বিতীয় খন্ড দ্রষ্টব্য।
এই সম্পর্কে এস হক নামক এক ব্যক্তি একটি লিখিত প্রবন্ধে বলেন যে,
*খুব সম্ভবতঃ ইনি একজন বাটা শ্রমিক।
মুসলিম লীগ অসহায় বাটা শ্রমিকদের উপর নির্মম প্রহার চালিয়ে আর একটা কলঙ্কিত ইতিহাসের সৃষ্টি করলো। মুসলিম লীগ তার বীভৎস মূর্তি আবার দেশবাসীকে দেখালো। ভালই হলো, বাটা শ্রমিক দেখলো, আমরা দেখলাম, দেশবাসী দেখলো বুঝলে আর একবার, মুসলিম লীগ জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়—মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জন্য যারা ত্যাগ করেছে তাদের উপর লাঠি চালায়। মকুল সিনেমা হলের সামনে বাটা শ্রমিকদের রক্ত কেবল ব্যর্থ হয়নি। তাদের রক্তক্ষরণে তাদের সঙ্গে আরো অগণিত শ্রমিক, কিষাণ, মধ্যবিত্তের মুক্তিপথের নির্দেশ নামা লিখিত হয়ে গেছে।”২
নিজেদের দাবী দাওয়া আদায় ও অবস্থার প্রতিকারের অন্য কোন উপায় না দেখে হাজার হাজার কর্মচারী বাটা শ্রমিক ১৯৫১ সালের ২০শে এপ্রিল থেকে বাটার জুতো বয়কটের আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তনি যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ যুব লীগের পক্ষ থেকে সংবাদপএে নিম্নিখিত বিবৃতি প্রদান করেনঃ
ফেব্রুয়ারী হাঙ্গামার সময় ৩,৫০০ জন বাটা শ্রমিককে উদ্বাস্তু হিসেবে ভারত ত্যাগ করতে হয় এবং তারা কর্মচ্যুত হয়ে পড়েন। খবর পাওয়া গেছে যে আয়ের কোন সংস্থান না থাকায় এই বাটা শ্রমিকরা নিজেদের পরিবারের হাজার হাজার সদস্য সহ অনাহারে রয়েছেন। এই অবস্থা চলছে বিগত ১৪ মাস ধরে।
জানা গেছে যে ৫০ শতাংশেরও বেশি কর্মচ্যুত বাটা শ্রমিক এখনো পর্যন্ত বাটা কর্তৃপক্ষের থেকে কোন টাকা পয়সা পান নি।
যাতে অন্ততঃ কিছু লোকের কর্মসংস্থান হয় তার জন্য বাটা শ্রমিকরা পূর্ব পাকিস্তানে একটি বাটা জুতো কারখানা দাবি করেছিলেন। আমরা মনে করি এটা একটা ন্যায়সঙ্গত দাবি। কিন্তু তার সঙ্গে আমরা এটাও দাবি করি যে, সরকার তাঁদের কাগুজে পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেশের শিল্পােন্নয়নের দিকে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করুন। সরকারের উচিত এখনই জুতো কারখানা স্থাপন করা, যাতে করে কর্মচ্যুত বাটা শ্রমিকরা সহ এই বিষয়ে দক্ষতা সম্পন্ন অন্যান্যরাও তাদের জীবিকার একটি উপায়ের সন্ধান পেতে পারে।
দুঃখের বিষয় এ লাইনে বাটা কর্তৃপক্ষ বাস্তব পদক্ষেপ তো এখনও গ্রহণ করেনইনি এমন কি এ সম্পর্কে কোন ইচ্ছাও তারা প্রকাশ করেন নি। এর ফলে বাটা শ্রমিকরা বাধ্য হয়েছেন নিজেদের দাবি আদায়ে ২০শে এপ্রিল থেকে বাটার জুতো বয়কট আন্দোলম শুরু করতে। এই আন্দোলনকে সফল করার উদ্দেশ্যে সব্বান্তকরণে সাহায্যের জন্য আমরা সকলের আবেদন জানাচ্ছি।৩
বাটার জুতো বয়কটের আন্দোলন বেশ কিছুদিন স্থায়ী কিছুটা স্হিমিত হয়ে যাওয়ার পর ১৯৫১ সালের ২৯শে অক্টোবর থেকে ভারত থেকে আগত কর্মচ্যুত বাটা শ্রমিকরা জোরে শোরে আবার বাটার জুতো বয়কট আন্দোলন শুরু করেন এবং জনগণের কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানান। ঢাকায় বাটা শ্রমিকেরা বাটার জুতা ক্রয় বন্ধ করুন এই ব্যাজ গায়ে ঝুলিয়ে বাটার দোকানগুলির সামনে পিকেটিং শুরু করেন। খরিদ্দারদেরকে তারা কর্মচ্যুত বাটা শ্রমিকদের অবস্থা বোঝান এবং বাটার জুতো না কেনার জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানান। এর ফলে খরিদ্দাররা বাটা শ্রমিকদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং বাটার জুতো না কিনেই ফেরত যান।”৪
একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ১৯৫১ সালের ১০ই নভেম্বর থেকে চাঁদপুরে বাটা শ্রমিকরা স্থানীয় বাটার দোকানের সামনে পিকেটিং শুরু করেন এবং যতদিন না বাটা কোম্পানী পূর্ব বাঙলায় নিজেদের কারখানা স্থাপন করছে ততদিন বাটার জুতো বয়কটের জন্য জনগণকে অনুরোধ জানান, যার ফলে চাঁদপুরে বাটার জুতো কেনা ঐ সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় হোটেল মালিকেরা ধর্মঘটী বাটা শ্রমিকদেরকে বিনামূল্যে আহার দেন বলেও রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়।৫
১। শ্রমিক ফেডারেশনসমহের উদ্ভব
তথ্য নির্দেশ
1. Kamruddin Ahmed-Labour Movement in East Pakistan, Progoti Publishers, Dacca December, 1969. P; 34__5
২। ঐ। P–35
৩।ঐ। P-34
৪। ঐ। P-35
৫__৯।ঐ। P-36
১০। সাপ্তাহিক সৈনিক। ১২-১২-১৯৪৮
11. Kamruddin Ahmed-Labour Movement in East Pakistan, P. 36__7
১২-১৪। দৈনিক আজাদ। ১-৫-১৯৪১।
১৫-১৭। নওবেলাল। ১২-৫-১৯৪৯
18. K. Ahmed-Labour Movement in East Pakistan. P. 37
১৯। সৈনিক ২৩-৪-১৯৫০
20. K. Ahmed-Labour Movement in Eas! Pakistan. P. 37
২১। ঐ। P. 38
22. Kamruddin Ahmed: Presidential address, third Annual Session of the East Pakistan Federation of Labour: April 14-15, 1951. Paramount press Limited, Dacca. R 17
23. K. Ahmed-Labour Movement in East Pakistan. P. 38–9
24–25.Pakistan Observer, 15-4-1951
26. K. Ahmed: Third Annual Session of the East Pakistan Federation of Labour, P. 17
২৭। ঐ। P. 18–23
28. Pakistan Observer, 15.4.1951
২৯। সৈনিক। ১-৭-১৯৫১
30. K. Ahmed: Labour Movement of East Pakistan, P. 39-40
১। রনেশ দাসগুপ্ত (লিখিত নোট)-স্মৃতি থেকে এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে রণেশ দাসগুপ্ত এই নোটটি আমাকে পাঠান।
২–৩। সাপ্তাহিক সৈনিক। ৪-৩-১৯৪৯
৪–৫। রণেশ দাসগুপ্ত (নোট)
৬। নওবেলাল। ২৮-৪-১৯৪৯
৭। রণেশ দাসগুপ্ত (নোট)
৮। ঐ। K. Ahmed: Labour Movement in East Pakistan P. 36
9. K. Ahmed: Labour Movement in East Pakistan. P. 36
১০। আমিরউদ্দিন আহমেদ, পূর্ব পাকিস্তানে রেল শ্রমিক আন্দোলনের গোড়ার কথা। সৈনিক-১৪-১১-১৯৪৮
১১। সৈনিক ১২-১২-১৯৪৮
১২। ঐ। ২৫-১২-১৯৪৮
১৩। ঐ।১-১-১৯৪১
১৪। ঐ। ২৫-৩-১৯৪৯
১৫-১৮। ঐ। ১৫-৪-১৯৪৯
১৯। সৈনিক। ২০-৯-৪৯; নওবেলাল। ২০-৭-১৯৫০, ২-১১-১৯৫০ ২০। সৈনিক। ২৫-৬-১৯৫০
২১। নওবেলাল। ৪-১০-১৯৫১
২২। রণেশ দাসগুপ্ত
৩। ডাক ও তার শ্রমিক
১। সৈনিক। ১১-৩-১৯৪৯
২। নওবেলাল। ২১-৯-১৯৫০
৩। নওবেলাল। ৭-১২-১৯৫০
৪। সৈনিক। ৭-১-১৯৫১
৫। সৈনিক। ১-৪-১৯৫১
৬। সৈনিক। ৮-৪-১৯৫১
৪। চা-শ্রমিক
1. K. Ahmed: Labour Movement in East Pakistan. P. 49
২। ঐ। P. 48–49
৩। ঐ। P. 47।
৪। ঐ। P. 45
৫-৬। নওবেলাল। ১৭-৬-১৯৪৮
৭-৮। নওবেলাল। ৩-২-১৯৪৯
৯। নওবেলাল। ৩-৩-১৯৪৯
১০। নওবেলাল। ২৬-১০-১৯৪৯
১১। নওবেলাল। ২-৮-১৯৫১
৫।সূতাকল শ্রমিক
১। অনিল মুখার্জী-শ্রমিক আন্দোলনে হাতে খড়ি। প্রকাশক শহীদুল্লাহ কায়সার। অক্টেবর ১৯৭১। পৃষ্ঠাঃ৪৬
২–৫। রণেশ দাসগুপ্ত (লিখিত নোট)
৬। অনিল মুখার্জী-শ্রমিক আন্দোলনে হাতে খড়ি। পৃঃ ৪৪-৫
৭-১২। রণেশ দাসগুপ্ত (নোট)
১৩। নওবেলাল। ১০-৫-১৯৫১
৬। সিমেন্ট শ্রমিক
১–৩। নওবেলাল। ৩-৬-১৯৪৮
৪। নওবেলাল। ৭-৪-১৯৪৯
৫। নওবেলাল। ২৬-৪-১৯৫১
৭। নওবেলাল। ১৫-১১-১৯৫১
৮। নওবেলাল। ১০-১-১৯৫২
৭। ডাক শ্রমিক
১। সৈনিক। ২৬-৮-১৯৪৯
২। সৈনিক। ৩-২-১৯৫০
৩। সৈনিক। ৬-৮-১৯৫০
৪। নওবেলাল। ২৩-১১-১৯৫০
৫-৬। সৈনিক। ৫-৮-১৯৫১
৮। তৈল শ্রমিক
১। সৈনিক। ২৮-১-১৯৫১
২। সৈনিক। ১৮-২-১৯৫১
৯। বাটা শ্রমিক
১-২। সৈনিক। ২৮-১-১৯৫১
3. Pakistan Observer, 20.4.1951
৪। নওবেলাল। ৮-১১-১৯৫১
৫। ঐ। ২২-১১-১৯৫১