বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও গ্রামবাংলার মানুষ
পবিত্রদা অর্থাৎ পবিত্র দাস—উনিশোে পঞ্চাশে আশুজিয়া হাইস্কুলে মাস্টারি নিয়েছিলেন। আর আমি বেখৈরহাটি স্কুল ছেড়ে আশুজিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হই একান্ন সালে, ক্লাস নাইনে। কিন্তু এর কয়েকদিন পরই পবিত্রদা কলকাতায় গেলেন কী একটা কাজে, সেখানে গিয়েই বসন্ত রােগে আক্রান্ত হলেন এবং সে রােগেই অকালে প্রাণ হারালেন।
পবিত্ৰদার অকাল মৃত্যুতে তার সকল পরিচিত জন হাহাকার করে উঠলাে। হেকিম ভাই খুবই ভেঙে পড়লেন। তার এই বন্ধুটিকে তিনিই আশুজিয়া হাইস্কুলের মাস্টার হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। পবিত্র দাস মাস্টার হওয়াতে এলাকার সকল মানুষই খুশি হয়েছিলাে। পবিত্রদার কম্যুনিস্ট মতবাদকে অপছন্দ করতেন অনেকেই, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করতেন সকলেই। এই তরুণটি যে অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী, সৎ ও সব দিক দিয়েই তুখােড়—এ কথা সবাই মানতেন। এ-রকম একজন তুখােড় যুবককে মাস্টার হিসেবে পাওয়া গেছে যখন, তখন
১৮৩
এ-স্কুলে ছেলেদের পাঠিয়ে তাদের পড়াশােনা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে, আশুজিয়া স্কুল তার আগেকার গৌরব ফিরে পাবে—গাঁয়ের লােকদের মুখে এই রকম আশাবাদী কথাবার্তা শােনা গিয়েছিলাে। কিন্তু এই তরতাজা মানুষটির আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ তাদের আশার বাতিটিকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাে।
সে সময়কার গ্রামাঞ্চলের অন্যসব স্কুলের মতােই আশুজিয়া হাইস্কুলেরও ছিলাে নিতান্ত করুণ দশা। এ স্কুলের শিক্ষক বলতে একমাত্র জয়চন্দ্র রায়। দু’তিন জন ম্যাট্রিক পাস শিক্ষক নিচের ক্লাসগুলােতে পড়ান। আর ক্লাস নাইন টেনের প্রায় সব সাবজেক্টই বলতে গেলে একা জয়চন্দ্র বাবুকেই পড়াতে হয়। একজন প্রবীন মৌলবী সাহেব আরবি পড়াতেন, সংস্কৃত পড়াতেন পণ্ডিত কৃষ্ণধন গােস্বামী। সংস্কৃতের পণ্ডিতকেই নিতে হতাে বাংলা ব্যাকরণের ক্লাসও। হেডমাস্টার ক্ষিতীশ চক্রবর্তী ছাড়া আর কোনাে গ্রাজুয়েট শিক্ষক ছিলেন না। জয়চন্দ্র রায় নিজেও আন্ডার গ্রাজুয়েট । আশপাশের গায়ের যে কোনাে যুবক ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বা বিএ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এলেই জয়চন্দ্র বাবু তাকে ধরে নিয়ে এসে স্কুলে মাস্টারির কাজে লাগিয়ে দিতেন। এভাবেই আমরা কিছুদিনের জন্যে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বলাইশিমুল গ্রামের আইএ পাস তরুণ ফজলুল হক সাহেবকে। এরপর তিনি বিএ পড়তে ময়মনসিংহ চলে গেলে আমাদের অঙ্কের ক্লাসে কোনােদিন যেতেন হেডমাস্টার ক্ষিতীশ বাবু, কোনােদিন জয়চন্দ্র বাবু। ক্ষিতীশ বাবু প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। তার পক্ষে নিয়মিত ক্লাস নেয়া মােটেই সম্ভব হতাে না। বিএ পরীক্ষা দিয়ে এসে কচন্দরা গ্রামের ফজর আলী সাহেবও আমাদের কয়েকদিন ইংরেজি পড়িয়েছিলেন। তারপর তিনিও চলে যান। এরকম আরাে কয়েকজন শিক্ষক এসেছেন ও চলে গেছেন। এতাে দ্রুত তাদের আগমণ-নির্গমণ ঘটেছে যে, এই শিক্ষকদের কারাে নাম বা চেহারাই আমার স্মৃতিপটে গেঁথে যেতে পারেনি। আমাদের স্কুলটিতে তখন পড়াশােনার হাল যে কেমন ছিলাে তা শিক্ষকদের এ-রকম আগমণ-নির্গমণ থেকেই বােঝা যায় ।
একান্ন সালের শেষের দিকে স্কুলে এসে যােগ দিলেন একজন প্রবীণ গ্রাজুয়েট শিক্ষক কুমুদ ভট্টাচার্য। তিনিও ফজলুল হক, ফজর আলী বা অন্যান্য স্বল্পকালীন শিক্ষকদের মতােই জয়চন্দ্র রায় তথা আশুজিয়া হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। তবে শিক্ষক রূপে আশুজিয়া হাইস্কুলে তার অবস্থান এতাে স্বল্পকালীন হয়নি। বছর পাঁচেক তিনি এই স্কুলে ছিলেন। তিনি আসার পর থেকেই স্কুলটিতে অ্যাকাডেমিক পরিবেশ অনেক পরিমাণে ফিরে এসেছিলাে, জয়চন্দ্র বাবুর খাটুনিরও অনেকখানি লাঘব হয়েছিলাে। আশুজিয়ার মতােই আরেক ব্রাহ্মণ-প্রধান গ্রাম কাটিহালির বাসিন্দা এই কুমুদ ভট্টাচার্য ছিলেন একজন বিদগ্ধ শিক্ষক। ছাত্রদের মনে সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করতে তিনি সব সময়ই চেষ্টা করতেন, পাঠ্যবিষয়ের সূত্র ধরেই পাঠ্যসূচি বহির্ভূত নানা বিষয়ের এলাকায় তাদের নিয়ে যেতেন। পাঠ্য বইয়ের বক্তব্যও তার আলােচনায় অন্যরকম মাত্রা পেয়ে যেতাে। আমাদের ইংরেজি বইয়ে একটি প্রবন্ধ ছিলাে—‘ডায়ালােগ উইথ অ্যা জায়েন্ট। এটি বিভার্লি নিকলসের ভার্ডিক্ট অন ইন্ডিয়া’ বইয়ের একটি নির্বাচিত অংশ। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকলস সাহেব ছিলেন জিন্নাহ সাহেবের একান্ত অনুরাগী, জিন্নাহর ব্যক্তিত্বের ছটায় মুগ্ধ। কুমুদ বাবু আমাদের ক্লাসে নিকলস সাহেবের অনুসরণেই জিন্নাহর ব্যক্তিত্বটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তার বক্তব্যের ফাক ও ফাকিগুলােও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সেই
১৮৪
রমরমার দিনে, ক্লাসের ছাত্রদের সামনে, পাকিস্তানী ভাবাদর্শের বিরােধী বক্তব্য তুলে ধরতেও তিনি ইতস্তত করতেন না। আবার ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে তার অনুরাগের বিষয়টিও তার পাঠদানের মধ্যে ধরা পড়তাে। আমীর আলীর ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম আর ‘হিস্ট্রি অব দ্য সারাসেনস’-এর অনেক কথা তিনি নানা প্রসঙ্গে ক্লাসের পাঠ্যবই পড়াবার ফাঁকে ফাঁকে উল্লেখ করতেন। মুসলমান ছাত্ররাও ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাে। কোনাে কোনাে দিন ইংরেজি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকেই তিনি হাঁক ছাড়তেন—ট্রান্সলেট ইন টু বেঙ্গলি। এরপর গড়গড় করে পত্রিকার প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে যেতেন, আমরা তা শুনে শুনে খাতায় লিখে নিতাম। আমাদের অনুবাদের ভুল-ত্রুটি নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে মূল প্রতিবেদনটিও তিনি ব্যাখ্যা করে বােঝাতেন। সেই সূত্রেই এসে যেতাে রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ।
আসলে কুমুদ বাবু আমাদের চোখ-কান খুলে দিতে চাইতেন, আমাদের ভেতর স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ ঘটাতে চাইতেন, পাঠ্যসূচির গণ্ডি ভেঙে আমাদের ভাবনার জগতকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিতে চাইতেন।
যদিও আমি একান্তভাবে পাঠ্যপুস্তক-বিরূপ ও নিতান্ত সাধারণ মানের ছাত্র, তবু আমার জীবনে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরই অনেক ধরনের প্রভাব পড়েছে; কিন্তু কোনাে শিক্ষকের প্রভাবই সম্ভবত কুমুদবাবুর চেয়ে গভীরতর হয়নি। ক্লাসের বাইরেও তার স্নেহসান্নিধ্য লাভের সুযােগ আমার হয়েছে। সেই সান্নিধ্যই আমার মনােজগতকে নানাভাবে আলােড়িত করেছে। অনেক বিষয়েই অনেক নতুন নতুন ভাবনার উপকরণ আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি।
উনিশোে বায়ান্ন সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (সম্ভবত তেইশ তারিখে) একদিন কিন্তু আমাদের এই একান্ত শ্রদ্ধেয় কুমুদ বাবুর ক্লাস থেকেই আমরা একযােগে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের ভালােমন্দ কিছু বলেননি, বাধাও দেননি। বিষন্ন মুখে তিনিও আস্তে আস্তে ক্লাস ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এভাবেই বােধহয় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কুমুদ ভট্টাচার্যও মাতৃভাষার জন্যে প্রাণােৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি নীরবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন।
একুশ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হওয়ার খবরটি গাঁয়ে এসে পৌছা মাত্র আমাদের মধ্যে দেখা দিলাে ক্ষোভ ও চাঞ্চল্য। আমাদের সেই ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যে উপযুক্ত ভাষা জোগালেন খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখে স্লোগান উঠলাে—‘ছাত্রহত্যার বিচার চাই’, নূরুল আমিনের রক্ত চাই।
আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সে সময় ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্রদের নেতা মেনে অন্য সবার সঙ্গে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মিছিলে যােগ দিয়েছিলাম, নেতাদের দেয়া স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়েছিলাম। কিন্তু এবার, উনিশোে বায়ান্ন সালে, গায়ের স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্র আমি । আমাকেই হয়ে যেতে হলাে ‘নেতাদের একজন। আমাদের ক্লাসেরই খালেক, সাত্তার, মনফর এবং ক্লাস নাইনের আরাে ক’জন ছাত্র মিলে আমরা সব ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বের করে নিয়ে এলাম। মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে স্লোগান দিতে দিতে চলে গেলাম আমাদের স্কুল থেকে মাইলখানেক দূরে বসুর বাজারে। বাজারে ঢােকার রাস্তাটিতেই আমাদের মিছিল দাঁড়িয়ে গেলাে।
১৮৫
সেদিন ছিলাে হাটবার। সবেমাত্র হাটুরেরা আসতে শুরু করেছে। চোঙায় মুখ লাগিয়েই উঁচু গলায় আমরা তাদের কাছে ঢাকার ছাত্রহত্যার বর্ণনা দিয়ে চললাম। বর্ণনার মধ্যে অবশ্যই বেশ কিছু কল্পনার মিশেল ছিলাে, অতিরঞ্জন ছিলাে। আর ছিলাে প্রচণ্ড আন্তরিক আবেগ। আমাদের সেই আবেগের তােড়ে হাটের মানুষদের অনেককেই ভেসে যেতে দেখলাম। অনেকেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণার বাচনিক প্রকাশ ঘটালেন অনেকে। আমাদের আবেদনে সেদিন সেই হাটে হরতাল পালিত হলাে। কেউ কোনাে কিছু কেনাবেচা করলেন না। আমাদের সঙ্গে মিছিলে যােগ দিয়ে তারাও বাজার-পরিক্রমা করলেন, স্লোগানে স্লোগানে ছাত্রহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ ঘটালেন।
এরপরের কয়েকদিন ধরে আশপাশের অন্যান্য বাজারগুলােতেও আমরা এমনিভাবে হরতাল পালন করিয়েছিলাম। গায়ের কোনাে কোনাে মানুষ শব্দটির সঙ্গে হয়তাে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাে, নানা উপলক্ষে শহরে হরতাল হওয়ার কথা তারা শুনেছে। কিন্তু বসুরবাজার কিংবা রামপুর, বীরগঞ্জ, বেখৈরহাটির মতাে গ্রাম্য বাজারে নিজেরাই হরতাল করে বসলাে বােধহয় এই প্রথম। প্রত্যেকটি হাটে হরতালের সময় গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে শােক, ঘৃণা, ক্রোধ ও প্রতিবাদের প্লাবন বয়ে গিয়েছিলাে।
‘আমরার পােলাপানরারে শহরে পাঠাই ল্যাহাপড়া শিহনের লাইগ্যা। আর গুলি চালাইয়া তারারে মাইরা ফালায় যারা হ্যারা ….।
এই হ্যারা’ (তারা) সম্পর্কে যে বিশেষণগুলাে প্রয়ােগ করেছিলাে সেদিনকার সেই ক্ষুব্ধ গ্রামীণ মানুষেরা, সেগুলােকে কলমবন্দি করার সাহস আমার নেই। কারণ আমি তাে তথাকথিত দ্রলােক। দ্রলােকের বিচারে তাে এসব শব্দ অশ্লীল, অশালীন, অনুচ্চার্য, অলেখ্য। তবে ভদ্রলােকদের তৈরি বাংলা অভিধানে যেসব শব্দ ঠাই পায় না, সেসব শব্দ ছাড়া যে গণশত্রুদের যথার্থ পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়—সে কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
হেকিম ভাই তখন তমদ্দুন মজলিস করেন। তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর তিনি গ্রাহক ও লেখক। প্রায় নিয়মিত তিনি এ পত্রিকায় আমাদের এলাকার রিপোের্ট পাঠান। তার বাড়ির গােলঘরে বসেই আমি ‘সৈনিক পড়ি। সৈনিকেই একুশের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পড়ে রাগে-দুঃখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে আমরা যে নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার কয়েকটি অজ পাড়াগাঁয়ে ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম তার মূল প্রেরণাটি পেয়েছিলাম ‘সৈনিক’ থেকেই। আর ‘সৈনিক’-এর গ্রাহক ও লেখক খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম হয়েছিলেন আমাদের জীবন্ত প্রেরণাদাতা। হেকিম ভাইয়ের একটা নতুন উদ্যমী ও সংগঠনকুশলী রূপ তখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কদিন ধরে চরকির মতাে তিনি এ গাঁয়ে ও গায়ে ঘুরলেন। গাঁয়ের মানুষদের ছােট ছােট বৈঠকে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার তাৎপর্য তুলে ধরলেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে যে আমাদের পশ্চিমাদের গােলাম হয়ে যেতে হবে—সে কথাই সকলকে বােঝাতে চাইলেন। মােল্লা-মৌলবী কিসিমের কিছু কিছু লােক যখন হেকিম ভাইয়ের কথার প্রতিবাদ জানালাে, উর্দু আর ইসলামকে এক ও অভিন্ন বলে মত প্রকাশ করলাে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে হিন্দু ও হিন্দুস্থানের চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করতে চাইলাে, তখন হেকিম ভাই রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। ইটাউতা গ্রামের একজন ছাত্র (যতদূর মনে পড়ে তার নাম মঞ্জুর) এসে একটি মাদ্রাসার খবর জানালাে। সে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা
১৮৬
নাকি রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সপক্ষে মিছিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুনে মহা উত্তেজিত হয়ে হেকিম ভাই বললেন, এই কাঠমােল্লাদের মাথা ফাটিয়ে দিতে হবে। তােমরা প্রস্তুত হয়ে যাও।’ কারাে মাথা ফাটানাের অবিশ্যি প্রয়ােজন পড়েনি, কারণ কেউই শেষ পর্যন্ত উর্দুর পক্ষে মিছিল বের করার মতাে সাহস পায়নি।
হেকিম ভাইয়ের এক সম্বন্ধী, অবশ্যই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক, আবদুল আউয়াল বায়ান্ন সালে আশুজিয়া হাইস্কুলে ক্লাস টেনে আমাদের সহপাঠি হয়েছিলেন। এর বেশ কয়েক বছর আগে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েই তিনি ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর কী মনে করে বলতে গেলে প্রায় প্রবীণ বয়সে, আবার তিনি ছাত্রের খাতায় নাম লেখালেন। এই প্রবীণ সহপাঠিটিকে আমরা খুবই সমীহ করে চলতাম। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে কোনাে একদিন (তারিখটা মনে করতে পারছি না) আমাদের স্কুল সংলগ্ন ইউনিয়ন বাের্ড অফিস প্রাঙ্গণে খুব ঘটা করে একটি ছাত্রসভার আয়ােজন করেছিলাম। সে সভার সভাপতি বানিয়েছিলাম আউয়াল ভাইকে। আমিই হয়েছিলাম প্রধান বক্তা’! ছয় বছর আগে, ছেচল্লিশ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে, আমাদের পাড়ার বালক শ্রোতাদের সামনে অনেক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছি! সেই থেকেই আমি বক্তা! কিন্তু সত্যিকারের কোনাে সভায় বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালাম এই প্রথম। একুশের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অনর্গল অনেক কথা বলে ফেলেছিলাম। বক্তৃতা শুরু করেছিলাম নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা নিধু বাবুর সেই বিখ্যাত পংক্তিটির উদ্ধৃতি দিয়ে। শ্রোতাদের কাছে কেমন লেগেছিলাে জানি না, তবে সেই ‘মেইডেন স্পীচ দিয়ে আমি নিজেই যে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম—সে কথা মনে করে আজো শিহরিত হয়ে উঠি!
পাকিস্তানের জন্মদাতা বলে কথিত জিন্নাহ সাহেব নিজেই যদি আটচল্লিশ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিয়ে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজ রােপণ করে থাকেন, তবে এ কথাও বলতে হবে যে, সেই মৃত্যুবীজকে ফলবান মহীরুহে পরিণত করেছিলেন তারই উত্তরসুরিরা বায়ান্নতে বাংলাভাষাপ্রেমিক ছাত্রদের বুকের রক্ত ঝরিয়ে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিরই অনিবার্য পরিণতি একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ বা ষােলই ডিসেম্বর—এমন কথাও আমরা হরহামেশা বলি বটে। কিন্তু একুশের ঘটনার পরপরই গ্রামবাংলায় তার কী-ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে, অজ পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত কীভাবে ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটেছিলাে, বিভিন্ন স্থানের গ্রামীণ এলিটদের প্রণােদনায় সাধারণ কৃষকরা পর্যন্ত সে আন্দোলনের সঙ্গে কেমন করে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলাে—সে সবের খুব বেশি খোঁজখবর আমাদের জানা নেই, জানার আগ্রহ বা উদ্যোগও তেমন নেই। ঢাকার বাইরের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা বড়জোর সেকালের জেলা সদর পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাই। কোনাে কোনাে মহকুমা বা থানা সদরের নাম উল্লেখের চেয়ে বেশি কিছু করা প্রয়ােজন মনে করি না।
আমাদের এ-রকম আচরণ কি সঙ্গত? এভাবেই কি আমরা ইতিহাসকে খণ্ডিত করে ফেলি ? খণ্ডিত ইতিহাসের সঙ্গে বিকৃত ইতিহাসের কি খুব বেশি পার্থক্য আছে?
বায়ান্ন-পরবর্তী রাজনীতিতে নতুন হাওয়া
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি-মার্চে হেকিম ভাইয়ের সহযােগী রূপে ভাষা আন্দোলনে আমিও বেশ সক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম। আমার সক্রিয়তা অবিশ্যি তেমন জোরালাে কিছু নয়। হেকিম ভাইয়ের
১৮৭
পাশাপাশি থাকা, ‘সৈনিক পত্রিকা পড়া, বাংলাভাষার পক্ষে কিছু তর্ক-বিতর্ক করা, অনানুষ্ঠানিক গ্রাম বৈঠকগুলােতে বক্তৃতা দেয়া বা বক্তৃতার ঢঙে কিছু কথা বলা। এই পর্যন্তই। গ্রাম এলাকায় এরচেয়ে বেশি কিছু করার সুযােগও অবশ্যই ছিলাে না। তাছাড়া, আমি তাে আর হেকিম ভাইয়ের তমদ্দুন মজলিসের সদস্য বা কর্মি ছিলাম না। হেকিম ভাইও কোনােদিন আমাকে তমদ্দুন মজলিসে যােগ দিতে বলেননি। অমুসলমানদের পক্ষে তমদ্দুন মজলিসের সদস্য হতে কোনাে বাধা ছিলাে কিনা জানি না। বাধা না থাকলেও এবং হেকিম ভাই বললেও, আমি কিছুতেই তমদুনী’ হতে পারতাম না। সৈনিক’-এর রিপাের্টগুলাে পড়ে ভাষা আন্দোলনের খোঁজ-খবর পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু এই সৈনিকের পাতাতেই তমদ্দুন মজলিসের ভাবাদর্শের যে পরিচয় পেতাম তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এটি হচ্ছে একটি ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী সংগঠন। এ সংগঠনের একজন হওয়া তাে তাই জন্মগত কারণেই আমার পক্ষে ছিলাে অসম্ভব। তার ওপর কৈশােরেই আমার ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিলাে সেকুলার ভাবনাচিন্তা। তমদ্দুন মজলিস সুস্থ ও সুন্দর’ তমদ্দুন গড়ে তােলার জন্যে কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করার কথা বলতাে। কিন্তু এই শব্দগুলাের তাৎপর্য তমদুনীদের কাছে খুব স্পষ্ট ছিলাে বলে মনে হয় না। কিংবা এই শব্দগুলাের ওপর তারা এমন অর্থ আরােপ করেছিলেন যা হয়ে গিয়েছিলাে এগুলাের আসল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সর্বাঙ্গ সুন্দর ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদের দিকে মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে তার উদ্দেশ্য বলে তমদ্দুন মজলিস ঘােষণা করেছিলাে। তমদুনীদের এই ‘যুক্তিবাদের পেছনে যুক্তি কতােখানি ছিলাে বলা মুশকিল। আবার ‘ধর্ম’ বলতে তারা আসলে ইসলামকেই বুঝতেন এবং ইসলামেরও যে খুব একটা সাহসী র্যাডিকেল ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন—তাও নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বকেও তারা প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত ও পােক্ত করাই ছিলাে তাদের লক্ষ্য। মূলত তমদ্দুন মজলিস একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনই ছিলাে। মার্কসবাদ তথা কম্যুনিজমের প্রতি তার ছিলাে বিজাতীয় বিদ্বেষ। মার্কসবাদ ও বস্তুবাদের বিরােধিতা করতে গিয়ে তমদ্দুন মজলিস চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীন যুক্তিজাল বিস্তার করেছিলাে। প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করার কথা বললেও স্বরূপত এ সংগঠনটি ছিলাে প্রতিক্রিয়াশীলই।
তবু, এসব সত্ত্বেও, বাংলা ভাষার পক্ষে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ছিলাে একান্তভাবেই প্রগতিশীল। সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিলাে অঙ্গুলিমেয়। এদের কোনােটাই বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলনকারীদের পক্ষ সমর্থন করেনি। বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন যে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন সেটি ছিলাে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিবেকী সিদ্ধান্ত, এর সঙ্গে পত্রিকার নীতিমালার কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। রাজধানী থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার মধ্যে তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সৈনিক’ই কেবল ভাষা আন্দোলনের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলাে এবং মফস্বলবাসী আমরাও এই পত্রিকাটির কল্যাণেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখতে পেরেছিলাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পুরাে কৃতিত্ব অবশ্যই তমদ্দুন মজলিসের ছিলাে না। তবু মজলিসের কৃতিত্বকে অস্বীকার করা বা তার ভূমিকাকে খাটো করে দেখাও হবে নিতান্ত অনুচিত আচরণ।।
আবার অন্যদিকে, তমদ্দুন মজলিস তথা ইসলামপন্থীদের কেউ কেউ খেদের সঙ্গে বলেন যে, সেকুলারপন্থী ও মার্কসপন্থীরা ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্বকে ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে
১৮৮
হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে। ঠিক এই ভাষাটিই সবাই প্রয়ােগ করেন না, তবে তাদের কথার ভাবার্থ এ রকমই দাঁড়ায়। অন্তত একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই, আশি ও নব্বইয়ের দশকেও, এদের মুখপত্রগুলােতে এরা ইনিয়ে বিনিয়ে এমন কথাই বলে থাকেন। এ রকম কথা বলে তারা বাঙালির ভাষা সংগ্রামের পুরাে ইতিহাসটাকেই খণ্ডিত ও বিকৃত করে তুলতে চান। তারা যে এদেশের অসাম্প্রদায়িক পণ্ডিতবর্গ, সেকুলার রাজনীতিকবৃন্দ ও প্রগতি-চেতন ছাত্রসমাজের অবদানকে হাইজ্যাক করে নিতে পারলেন না, তাদের ক্ষোভটা বােধহয় সে কারণেই। পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাষাচার্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুক্তবুদ্ধির সাধক কাজী মােতাহার হােসেন, গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ এনামুল হক, বহুভাষাবিদ ও রস সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ সুধী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কলম ধরেছিলেন তা ইসলামিক বা ধর্মীয় বিবেচনা থেকে নয়। ভাষাতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রনৈতিক নিয়মনীতিই ছিলাে তাদের বিবেচ্য। বায়ান্নর অনেক আগেই হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ সাহিত্যপত্রে বেরিয়েছিলাে সৈয়দ মুজতবা আলীর দীর্ঘ রচনা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সে সময়েই, বই আকারে প্রকাশের আগেই, এ রচনাটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলাে। হেকিম ভাইয়ের সংগ্রহেই চতুরঙ্গের সেই সংখ্যাটি আমি পেয়েছিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতাে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা যেমন, তেমনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতাে সেকুলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরাও রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার যৌক্তিকতার কথা জোরালাে ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। আর জিন্নাহর মুখের ওপর না, না’ ধ্বনি তুলে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছিলেন যে সচেতন ছাত্রনেতৃবৃন্দ তাদেরও কোনাে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিবেচনা ছিলাে না। আসলে ভাষা ব্যাপারটাই ধর্মনিরপেক্ষ, কোনাে ভাষাই কোনাে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এবং ভাষা শ্রেণী-নিরপেক্ষও। শােষকশােষিত নির্বিশেষে একটি জনগােষ্ঠীর সকল শ্রেণীর মানুষই একটি ভাষার ছত্রচ্ছায়ায় এসে সম্মিলিত হয়ে থাকে। আর এভাবে একটি সাধারণ ভাষাই হয় একটি জনগােষ্ঠীর জাতিতে পরিণত হওয়ার মূল উপাদান। বাংলা ভাষার আশ্রয়ে যে জনগােষ্ঠীটি একটি বিশাল ভূখণ্ডে শত শত বছরে তিল তিল করে একটি অর্থনৈতিক কাঠামাে ও অজস্র বৈচিত্র্যেভরা অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলাে, সেই জনগােষ্ঠীটিই ধর্ম সম্প্রদায় ও শ্রেণী নির্বিশেষে একটি জাতি—বাঙালি জাতি। ধর্মভিত্তিক ভুয়া দ্বিজাতিতত্ত্ব ভাষাভিত্তিক এই আসল জাতি পরিচয়কে অস্বীকার করে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলাে। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের হােতারা যখন বাঙালির ভাষার ওপর আঘাত হানলাে, তখন সেই আঘাতটি গিয়ে পড়লাে সেই ভুয়া জাতিতত্ত্বটির ওপরই। সেই আঘাতেই দ্বিজাতিতত্ত্বের কৃত্রিম পর্দা ছিড়ে বেরিয়ে এলাে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম জাতীয় চেতনা। এই আসল জাতীয় চেতনাই একদিন কৃত্রিম চেতনাজাত কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়ে জন্ম দিলাে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের। অর্থাৎ বাঙালির ভাষার ওপর আঘাতই পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের প্রক্রিয়াটির সূচনা করে দিয়েছিলাে। এবং এই প্রক্রিয়ায় যে কেবল সচেতন জাতীয়তাবাদী সেকুলার মানুষদেরই অবদান ছিলাে, তা নয়। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ইসলামপন্থীদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বা সাংগঠনিকভাবে বাঙালির মাতৃভাষার সপক্ষে ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। বাঙালির ভাষার শত্রুদের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শক্তির বিরুদ্ধে) দাঁড়ানাে তাে আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানাে। অনেকে অসচেতনভাবেও এমনটি করেছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের মতাে পাকিস্তানপ্রেমী
১৮৯
ইসলামপন্থী সংগঠনটিও তাই করেছিলাে। এর ধ্যান-ধারণা যতাে অস্বচ্ছ, অবৈজ্ঞানিক ও প্রতিক্রিয়াশীলই হােক, নিজের অজান্তে বা অনিচ্ছায় হলেও ভাষা-আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকাটি ছিলাে একান্ত স্পষ্ট, বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, অনেক প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীও ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কখনাে কখনাে কোনাে না কোনােভাবে প্রগতিশীল ভূমিকায় মঞ্চাবতরণ করে থাকে। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র মুছে যায় না। প্রগতির পক্ষে যতােটুকু অবদান তারা রাখে সেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রগতিশীল শক্তির ভাণ্ডারে গিয়েই জমা হয়। এ নিয়ে যে যতাে আফসােস ও আহাজারিই করুক, ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়ম তাতে পাল্টে যাবে না। গােলাম আযমও ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন বলে তার অনুসারীরা গৌরব প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই গােলাম আযমকেই নাকি বলতে শােনা গেছে যে, বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন করে তারা ভুল করেছিলেন। এ রকম বােধে উপনীত হওয়াই গােলাম আযমদের জন্যে স্বাভাবিক। কারণ ভাষা-আন্দোলনের মতাে একটি প্রগতিশীল আন্দোলনের ফসল তাে কোনােমতেই ওদের মতাে প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘরে গিয়ে উঠতে পারে না, সে ফসলে নিরঙ্কুশ অধিকার জন্মে প্রগতিকামী মানুষের ও বঞ্চিত জনগণের। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পরিণতিই তাে স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যু এবং এ রকম কোনাে পরিণতিই গােলাম আযমের মতাে প্রতিক্রিয়াশীল মানুষদের বা তাদের নানা গণবিরােধী সংগঠনের কাম্য ছিলাে না, কাম্য হতে পারে না।
হেকিম ভাই তমদ্দুন মজলিসের প্রেরণায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তাে নিজেকে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেনই, মজলিসের আরেকটি দাবিরও ছিলেন তিনি সােচ্চার প্রচারক। সেটি হচ্ছে : বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ। তার বন্ধু পবিত্র দাসের সঙ্গে তিনি ক্যুনিজম নিয়ে তর্ক করতেন। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলে যে ক্যুনিজমের কোনাে প্রয়ােজন হবে না, তমদ্দুন মজলিসের ম্যানিফেস্টো দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করতে চাইতেন। খােলাফায়ে রাশেদীনের দিনগুলােকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই প্রতিষ্ঠিত হবে ধনতন্ত্রেরও বিকল্প, ক্যুনিজমেরও বিকল্প। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের সময়ের একটি ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে তমদ্দুন মজলিস মত প্রকাশ করেছিলাে যে, জনগণের স্বার্থে জমিদারদের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই তাদের জমি অধিগ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত এবং এটিই ইসলামের রাষ্ট্রীয় বিধান।
কিন্তু ক্যুনিস্ট-বিরােধী তমদ্দুন মজলিসের এ রকম ইসলাম-সম্মত দাবি ও বক্তব্যও সেসময়কার পাকিস্তানের দৃষ্টিতে হয়ে গেলাে ইসলাম-বিরােধী ও কম্যুনিস্টপন্থী। পূর্ববাংলার অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী আটচল্লিশ সালের বিশ আগস্ট রাজশাহীতে এক জনসভায় বলেছিলেন যে, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে একান্ত অন্যায় ও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ। এ রকম হস্তক্ষেপ হবে অরাজকতা সৃষ্টিকারী। এ রকম অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায় যারা তারাই ক্যুনিজমের অনুসারী। কম্যুনিজমের সঙ্গে ইসলামের কোনােরূপ সমঝােতা হতে পারে না, কমুনিস্টদের সম্পর্কে পাকিস্তানের সকলকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
পাকিস্তানের জন্মের আগে কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনকারীদের ভেতর এমন উগ্র কম্যুনিজম-বিরােধিতা দেখা যায়নি। তখনকার কমুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান আন্দোলনকে
১৯০
‘সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জাতীয় আন্দোলন’ রূপে চিত্রিত করায় তরুণ মুসলমানদের অনেকে বরং কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। প্রস্তাবিত পাকিস্তানই হবে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার উর্বর ক্ষেত্র—অনেকে এ-রকমও ভাবতেন। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেল তখন কায়েমী স্বার্থবাদীরাই এ রাষ্ট্রের সবকিছুতে অধিকার বিস্তার করে বসলাে। ক্যুনিজম কিংবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তাে দূরের কথা, সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যারা ইসলামকে মিলিয়ে দেখতে চাইতাে বা ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতাে, পাকিস্তানের শাসকদের দৃষ্টিতে তারাও হয়ে গেল ইসলাম-বিরােধী ও পাকিস্তান-বিরােধী। ইসলামের বৈপ্লবিক অন্তঃসার বলে এতােকাল যা কথিত হয়ে আসছিলাে, তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের গণবিরােধী শাসকগােষ্ঠী ও তাদের সহযােগীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকেই ইসলামের মূল মর্মরূপে উপস্থাপন করলাে। বিভিন্ন লেখায় ও বক্তৃতায় তারা বােঝাতে চাইলাে: এক আল্লাহর অস্তিত্ব, হযরত মুহম্মদের রেসালাত, কোরানের বিধানের অভ্রান্ততা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারে না ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র ও অলংঘনীয় ইসলামী বিধান বলে মেনে না নিলে।
এ-রকম তত্ত্বীয় ধূম্রজালের মধ্যে পড়ে বায়ান্ন সালেই হেকিম ভাইকে খুব বিব্রত, ক্ষুব্ধ ও ব্যতিব্যস্ত হতে দেখলাম। তখন তার ক্যুনিস্ট বন্ধু প্রয়াত পবিত্র দাসের কথা মাঝেমধ্যেই স্মরণ করতেন ‘পবিত্রটা যদি এখন বেঁচে থাকতাে!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমন কথাও বলতেন।
বায়ান্নর মে মাস থেকে পরবর্তী সাত/আট মাস হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বড়াে একটা দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মে মাসেই আমি গুরুতর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। প্রথম মাস দুই চললাে প্রচণ্ড ডিসপেপসিয়া, কোনাে খাবারই হজম হয় না। এরপর শুরু হলাে অসহ্য বুক জ্বালা । সারাক্ষণ বুক জ্বালা। কিছু খাবার খেলে অল্প সময়ের জন্যে জ্বালার উপশম হলেও একটু পর আবার পূর্ববৎ। হােমিওপ্যাথি ও এলােপ্যাথি চিকিৎসায় দীর্ঘদিনেও কোনাে ফল পাওয়া গেলাে না। এরপর কুলনন্দ আয়ুর্বেদ ভবনের কবিরাজ জগদীশ নাগ আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন। তিনি অনেক দামি বটিকা ও অরিস্ট আমাকে সেবন করালেন। কিন্তু ফল না পেয়ে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েই বসেছিলেন, তখন তারই কম্পাউন্ডার হেমেন্দ্র নাগ বই দেখে একটি পাঁচনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হেমেন্দ্রদার পরামর্শটি কবিরাজ মহাশয় মেনে নিলেন। তারই নির্দেশে ‘চন্দনাদি পাঁচন’ খেলাম। এবং কী আশ্চর্য, দু’সপ্তাহেই আমার পীড়ার উপশম হয়ে গেলাে। যদিও পেটের পীড়া আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে, তবুও বায়ান্ন সালে এর প্রচণ্ড দাপট থেকে কবিরাজী চন্দনাদি পাঁচনই আমাকে রক্ষা করেছিলাে। কিন্তু নষ্ট হলাে একটি বছর। তেপ্পান্ন সালের ফেব্রুয়ারিতে আশুজিয়া হাইস্কুলে ক্লাস টেনের বেঞ্চিতে আবার গিয়ে বসলাম।
তেপ্পান্ন সালের গােড়া থেকেই রাজনীতিতে অন্যরকম হাওয়া বইতে শুরু হয়েছিলাে। নেত্রকোনাে শহরের মােক্তারপাড়া মাঠে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা হলাে। বিশ/পঁচিশ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে হাজার হাজার লােক সভায় উপস্থিত হয়েছিলাে। আমিও গিয়েছিলাম। সেই সভাতেই বক্তৃতা শুনলাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, হাশিম উদ্দিন ও শেখ মুজিবুর রহমানের। এই প্রথম এই নেতাদের আমি দেখলাম। ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দী পূর্ব থেকে পরিচিত নাম। কিন্তু হাশিম উদ্দিন ও মুজিবুর সম্পূর্ণ নতুন। হাশিম উদ্দিন সাহেব ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সন্তান।
১৯১
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। মুন্সেফের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যােগ দিয়েছেন। জনসভার শ্রোতারা অবাক বিস্ময়ে তার বক্তৃতা শুনলাে। শ্রোতাদের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই তরুণের বক্তৃতায় যেনাে আগুন ঝরে। লােকের মুখে মুখে কেবল তারই কথা।
আগের মতােই যথারীতি প্রায় রােজই হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত, আলাপ ও তর্কবিতর্ক চলতে লাগলাে। দেখলাম : তার রাজনীতি ভাবনায় বেশ পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তমদ্দুন মজলিসের প্রতি আগের সেই আকর্ষণ আর নেই।
Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার