প্রেসিডেন্ট জিয়া বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করবেন – মওদুদ আহমেদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৬ মে ১৯৭৮
প্রশ্নঃ আপনারা এই নির্বাচন করছেন কেন?
উত্তরঃ এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দুটো জিনিস অর্জন করতে চাই। একটি হচ্ছে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সৃষ্টি করা, অপরটি হচ্ছেঃ এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করা। এ দুটো বিশেষ কারণেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রশ্নঃ নির্বাচনের জন্য আপনারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করলেন কেন?
উত্তরঃ এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে একটু বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর যে বিভক্তির রাজনীতি অর্থাৎ দেশ, জাতিকে বিভক্ত রাখার যে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি তারই প্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংহতির জন্যে এবং একে জোরদার করার জন্যেই আমরা একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেছি। এ ব্যাপারে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে ৭১-এর যুদ্ধের পর তদানীন্তন সরকার যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন তার ফলে আমাদেরকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে দেখতে কষ্ট হয়েছে। এর প্রধান কারণ, আমাদের একটি পরনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজকে তাই আমরা জাতীয় মুল লক্ষ কে কেন্দ্র করে একটা একতার রাজনীতি শুরু করেছি। এদিক থেকে চিন্তা করলে এ ফ্রন্টের প্রয়োজন প্রথম থেকেই ছিল, এখনো আছে।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন, ভিন্নমুখী শক্তির সমন্বয়ে গঠিত ফ্রন্টের মাধ্যমে আপনারা সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন?
উত্তরঃ ফ্রন্টে নানা মত ও দলের লোক আছে। কিন্তু আমরা যদি জাতীয় রাজনীতিকে গুরুত্ব দেই এবং মূল লক্ষ্য মনে করি তাহলে এই ভিন্নমুখিনতা গৌণ হয়ে যাবে এবং জাতীয় লক্ষ্য প্রাথমিক গুরত্ব পাবে।
প্রশ্নঃ গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের সাত দফার প্রেক্ষিতে কি আপনি মনে করেন, এমন কোন প্রার্থী দেয়া সম্ভব ছিল, যার সম্পর্কে এই অভিযোগগুলো উঠত না?
উত্তরঃ তারা যে সাত-দফা উত্থাপন করেছেন, তার একটি ছাড়া, অন্যগুলোর কোন ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না। এই দফা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জিয়া সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে রাজনীতি করতে পারেন না। এই প্রশ্নের জবাবও আমাদের কাছে আছে। এই দাবীটাও এখন ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে, তার কারণ, সেনাবাহিনী বিধিমালার ২৯১, ২৯২, ২৯৩ ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কেউ রাজনীতি করতে পারেন না। কিন্তু ২৯৩(ক) ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কেউ যদি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে তার রাজনীতিতে অংশগ্রহণে কোন বাধা নেই। এদিক দিয়ে আইনের প্রশ্নে, জেনারেল জিয়ার রাজনীতিতে অংশগ্রহণে কোন বাধা নেই। তারপরে আসে নৈতিকতার প্রশ্ন—অর্থাৎ আইনগতভাবে পারলেও, নৈতিকভাবে পারেন কিনা ? আমি বলব, ২৯শে এপ্রিল সামরিক আইনের যে ১৩ নং সংশোধনী জারী করা হয়েছে তাতে জিয়াউর রহমান এখন সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, সেনাবাহিনীর প্রধান নন। আইনে এটা বলে দেয়া হয়েছে, এই পদ অফিস অফ প্রফিট বা লাভজনক পদ নয়। সেই হিসেবে, প্রেসিডেন্ট ছাড়া, জেনারেল জিয়া অন্যকোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত নেই।
প্রশ্নঃ গত দুবছরে, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, আপনাদের প্রার্থী আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করার কথা বলেননি। অথচ আজ নির্বাচনকে সামনে রেখে তা বলছেন। এটা কি আপনাদের নির্বাচনী চমক নয় ?
উত্তরঃ না। এই বক্তব্য বাস্তব, নির্ভেজাল ও ঐতিহাসিক সত্য। স্বাধীনতার পর আমাদের সাড়ে তিন বছরের সেই কলংকিত ইতিহাসকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে আজকের বক্তব্যের যথার্থ তা খুজে পাওয়া যাবে। এ বক্তব্য আগে বহুবার বলা হয়েছে এবং এখনও বলা হচ্ছে। আপনারা বলতে পারেন, শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেননি। কিন্তু তার সঙ্গে যারা আছেন, তারা সবসময় এই বক্তব্য বলে এসেছেন।
প্রশ্নঃ নির্বাচনে বিপর্যয় ঘটলে, অর্থাৎ জেনারেল (অবঃ) ওসমানী জয়লাভ করলে, তাকে আপনারা কিভাবে গ্রহণ করবেন ?
উত্তরঃ আমরা সে বিপর্যয়কে বিপর্যয় মনে করব না। আমরা মনে করব সেটা জনগণের রায় এবং সে রায়কে আমরা মাথা পেতে নেব।
প্রশ্নঃ আজকে আওয়ামী লীগ যদি তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়, তাহলে কি তারা লাভবান হবেন ?
উত্তরঃ না। সে ধরনের ক্ষমা অনেক দেরী হয়ে গেছে। এবং শুধু ক্ষমা চাইলে হবে না। তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে জোট গঠন করেছে সে সম্পর্কে জনগণের সন্দেহ রয়েছে। এই জোট অতীতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে, আমাদের আশা আকাংখাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসনতান্ত্রিকভাবে তারা যা করেছে তা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই করেছে। তাই আজকে যদি তারা ক্ষমা চায় তাহলেই হবে না, তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা সে জোট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তারা স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন, তারা আমাদের আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেবে না, তারা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে অন্য কোন আন্তর্জাতিক বিবেচনায় বিকিয়ে দেবে না, বা ক্ষুণ করবে না। এগুলো তাদের আগামী বছরগুলোতে প্রমাণ করতে হবে। তারপর, জনগণ যদি মনে করেন তাদের উদ্দেশ্যে সততা রয়েছে, তাহলে জনগণ তাদের ক্ষমা করলেও করতে পারেন।
প্রশ্নঃ নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আপনার বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে নীরবতা বজায় রেখেছেন কেন ?
উত্তরঃ না, আমরা নীরব নই। আমরা বহুবার বলেছি আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচীর অন্যতম লক্ষ্য হলো আমাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। উল্লেখ না করাটা এমন কিছু নয়। কিন্তু আপনি যদি গত দুবছরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তৃতাগুলো পড়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন তাঁর মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে গড়তে হবে-স্বনির্ভর হতে হবে। উনি বহুবার বলেছেন, ভিখারী হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই না, অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে চাই না, অন্যের নির্ভরশীলতা আমদের কমাতে হবে। সুতরাং, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদেশী সাহায্যের উপর আমরা যত কম নির্ভরশীল হতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
প্রশ্নঃ গজ শেখ মুজিবকে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করেছে। আপনারা কি এ প্রশ্নে নীরব থাকবেন না তার চার উন্মােচন করবেন ?
উত্তরঃ আমার মনে হয় না সে সময় এসেছে। ঐতিহাসিকরাই মুজিবের ঐতিহাসিক উন্মােচনের দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা এটা জনগণ এবং ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিতে চাই। শেখ মুজিব, ১৯৭১ সালের আগে এবং ১৯৭১ সালের পরে, দুই ভিন্ন চরিত্র। এই চরিত্রকে অল্পসময়ের মধ্যে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ এই নির্বাচনে কোন মূখ্য ইস্যুর ভিত্তিতে আপনারা জয়লাভ করার কথা চিন্তা করেন ?
উত্তরঃ এখানে দুটো মূল ইস্যু আছে। একটি হচ্ছে, আমরা আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে কিভাবে দেখি, কোন দৃষ্টিতে দেখ, আরেকটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বর্তমানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জনগণের অংশ গ্রহণের দ্বারা আরো।এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
প্রশ্নঃ গজ বলছে, আপনারা তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করছেন। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তরঃঅস্ত্রের কোন ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। যেহেতু গজের কোন কোন নেতা পুরনো দিনের হুমকি দিচ্ছেন এবং গণতন্ত্র প্রতিহত করতে লিপ্ত রয়েছেন, সেহেতু প্রেসিডেন্ট জিয়া এই মন্তব্য করেছেন।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়া জয়লাভ করবেন? এবং করলে তা কি ধরনের হবে ?
উত্তরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়া জয়লাভ করবেন। তাঁর নির্বাচনের মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে আমি নিঃসন্দেহে আশাবাদী। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত তিনি বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করবেন। আমাদের জনসমর্থন রয়েছে। নতুন সংগঠন হিসেবে জাগোদলের সাংগঠনিক দুবলতা রয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় ফ্রন্ট গঠনের ফলে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারব।
প্রশ্নঃ আপনারা কি নির্বাচনে কারচুপির কোন সম্ভাবনা আছে। বলে মনে করেন ?
উত্তরঃ আমরা এটা কখনো ঘটতে দেব না। আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এবং এই নির্বাচন যাতে সম্পূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.05.26-mowdud.pdf” title=”1978.05.26 mowdud”]