আমরা বাকশাল করে ভুল করেছিলাম – মিজানুর রহমান চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৬ মে ১৯৭৮
প্রশ্নঃ আপনার এই নির্বাচন করছেন কেন?
উওরঃ নাথিং শ্যাল গো আনচ্যালেঞ্জড। এই জন্যে। তাছাড়া আমরা গণতন্ত্র চাই। জিয়াউর রহমানও তা দিয়েছেন। পদ্ধতিগতভাবে আমাদের মতবৈধতা থাকতে পারে। কিন্তু এটাও একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি তা আমরা অস্বীকার করি না।
প্রশ্নঃ নির্বাচনের জন্য আপনারা গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করলেন কেন?
উত্তরঃ আওয়ামী লীগের জন্য একটা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আমরা যদি একা থাকি, আর সবাই যদি আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায় সে ভয়ও আমাদের আছে। অন্যেরা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের বিরুদ্ধে নামতে না পারে সেজন্য আমরা এই ফ্রন্ট গঠন করেছি। এছাড়া নির্বাচনে সমর্থন বাড়ানোর জন্যই নেতিবাচক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন, ভিন্নমুখী শক্তির সমন্বয়ে গঠিত জোটের মাধ্যমে আপনারা সাফল্য অর্জন করতে পারবেন ?
উত্তরঃ এটা নির্ভর করছে, জনগণ কিভাবে আমাদের গ্রহণ করবেন তার ওপর। জনগণ গ্রহণ করলে আমাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলে, এর দায়িত্ব হবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সে সময় এ জোট থাকবে কিনা বলা শক্ত। তাছাড়া আমাদের প্রার্থী বলেছেন, সে সময় প্রত্যেক দলই আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করবে।
প্রশ্নঃ আপনাদের ৭-দফা সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের বিভিন্ন নেতা যে জবাব দিয়েছেন সে সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?
উত্তরঃ জবাবগুলো সম্পর্কে আমরা সন্তুষ্ট নই। তাছাড়া, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কোন নির্বাচনে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রশ্নঃ আপনাদের প্রার্থী সম্পর্কে যে-সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে কি আপনি মনে করেন অন্য কোন প্রার্থী দেয়া সম্ভব ছিল?
উত্তরঃ প্রার্থী একজন দিলেই হত। তবে মনে করা হয়েছে তাঁকে দিলেই ভাল হবে।
প্রশ্নঃ আপনারা গত দুবছরে কখনও জেনারেল জিয়াকে প্রতিহত করার কথা বলেননি। কিন্তু আজকে বলছেন কেন?
উত্তরঃ আমরা তাকে কখনো সমর্থন দেইনি। আমাদের ঐক্যজোটের কোন কোন শরীক দল কোন কেন ব্যাপারে তাকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু যখন দেখলাম নির্বাচনের ব্যাপারে তারা সমর্থন দিতে চান না, তখন আমরা তাদের সঙ্গে নিয়েছি।
প্রশ্নঃ নির্বাচনে বিপর্যয় ঘটলে, অর্থাৎ জেনারেল জিয়াউর রহমান জয়লাভ করলে, তাকে আপনারা কিভাবে গ্রহণ করবেন ?
উত্তরঃ নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলে এবং আমরা হেরে গেলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে হেরে যাওয়ার কারণগুলো কি? সে কারণগুলো বের করে আমরা আবার জনগণের কাছে যাব, কেননা জনগণই ক্ষমতার উৎস। তারা যে-কোন দল অথবা ফ্রন্টকে গ্রহণ অথবা বর্জন করতে পারেন।
প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন আওয়ামী লীগ যদি অপরাধ করে থাকে, তবে ক্ষমা চাইবে। সে প্রসঙ্গে আপনি কি মনে করেন ?
উত্তরঃ আমি মনে করি আওয়ামী লীগ ভুল করেছে। তার প্রধান হচ্ছে, যে চতুর্থ সংশোধনী রয়েছে, সে সম্পর্কে জনগণের অনুমোদন নেয়া হয়নি। আমি রাজনীতি না করলেও এটা স্বীকার করব। আমরা যে চতুর্থ সংশোধনী দিয়েছি, তার আগে আমাদের একটা গণভোট নেয়া উচিত ছিল। এবং আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করলে সেটা গণভোটে পাশ করতেন। সেজন্যেই আমি ক্ষমা চেয়েছি। সাংগঠনিকভাবে ক্ষমা চাইতে হলে তার দায়িত্ব বর্তাবে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীর ওপর। তবে আমি বলব, আমি চতুর্থ সংশোধনী বিরোধী এবং বাকশাল বিরোধী। আমরা বাকশাল করে ভুল করেছি।
প্রশ্নঃ আপনাদের সম্পর্কে অভিযোগ, আপনারা স্বাধীনতা সাবভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?
উত্তরঃ আমি মনে করি, আমরা এটা করিনি। যারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগার, তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে পারেন।
প্রশ্নঃ আপনারা শেখ মুজিবকে নির্বাচনে একটি অন্যতম ইস্যু করলেন কেন? এ প্রশ্নে গজের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে সে সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি ?
উত্তরঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবর রহমান মরে গেছে এটা আমি স্বীকার করব না। আজো জয় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আওয়ামী লীগের কোন লোক স্লোগান দেয় না। আজো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার টেপ বাজিয়ে হাজার হাজার লোক জড়ো করা হয়। আমাদের জনসভাগুলোতে।
অবশ্যি ঐক্যজোটে এ প্রশ্নে মতবিরোধ আছে কিনা আমি জানি না । তবে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার টেপ বাজানো যাবে না, তার ছবি (অস্পষ্ট) টাঙ্গানো, কোন ব্যক্তি বিশেষের নামে শ্লোগান দেয়া যাবে না, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, এবং সে সম্পর্কে তারা একটি সার্কুলারও দিয়েছেন। যে মূহুর্তে এই কথা প্রচার হয়েছে, সে মূহুর্তে শত শত আওয়ামী লীগ কর্মী ঐক্যজোট অফিসে গিয়ে এমন ভাব দেখিয়েছে যে, এই হলে আমরা এ নির্বাচনে নাই।
বঙ্গবন্ধু নামটা আমাদের আবেগ-অনুভূতি এবং আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যের সঙ্গে অনেকখানি জড়িত। বঙ্গবন্ধু একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্বের স্বল্পসংখ্যক জনপ্রিয় রাজনীতিকল্পে একজন। কিন্তু অতিমানব ছিলেন না, অথবা ছিলেন না ভুল ত্রুটির উর্ধে।
প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়া আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করার কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে আপনার মত কি ?
উত্তরঃ এ ধরনের কথা রাষ্ট্র প্রধানের মুখে সাজে না। তার আরো সংযতভাবে কথা বলা উচিত। নির্মল করতে চাইলে অনেক ব্যবস্থাই আছে। এটা তার নির্বাচনী চমক।
প্রশ্নঃ এই নির্বাচনে আপনাদের মুখ্য ইস্যু কোনটি ?
উত্তরঃ পেনশন যোগ্য চাকুরীতে থেকে কেউ প্রকাশ্য রাজনীতি করুক এটা আমরা চাই না। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন। জিয়াউর রহমান রাজনীতি করলে সিভিলিয়ন হিসেবে রাজনীতি করবেন এটা আমরা চাই। পদ্ধতিগত ভাবে আমরা পার্লামেন্টারী পদ্ধতি চাই, উনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চান। তার পদ্ধতিতেও প্রেসিডেন্ট ও পালামেন্টের ক্ষমতা কতখানি থাকবে, সে সম্পর্কেও তিনি কিছু বলেননি। আমরা মনে করি এ ব্যাপারে তার সরাসরি বলা উচিত। সে ব্যাপারেও তিনি জনগণকে একটা ধাঁধার মধ্যে রেখেছেন।
প্রশ্নঃ আপনারা যে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি চালু করবেন তার গ্যারান্টি কি ?
উত্তরঃ রাজনীতিতে পার্টি যে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো দেয়, সেটা কতটুকু প্রতিপালন করলো, তার উপরই সে দলের ভবিষ্যত নির্ভর করে। ইন্দিরা গান্ধী গরিবী হটাও শ্লোগান দিয়ে তা পূরণ করতে পারেননি বলেই গত নির্বাচনে হেরে গেছেন। আমরা যদি সে ধরনের কিছু করি, তাহলে জনগণই তার বিচার করবে।
প্রশ্নঃ আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনার পুরাতন চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তরঃ এটা ঠিক নয়। তাহলে, আমাদের সঙ্গে পিপলস লীগ বা মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ আসতেন না। আমরা আওয়ামী লীগ হিসেবেই এসেছি। অন্যেরা তাদের স্ব-স্ব পরিচয়ে এসেছেন।
প্রশ্নঃ আপনারা জয়লাভ করলে তার ব্যবধান কেমন হবে ?
উত্তরঃ এটা সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। জয়লাভ করব, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, আবার হেরে যাব একথাও বলতে পারি না। আমরা যে জনসভা করেছি, তা দেখলে আশার সঞ্চার হয়, মনে হয় আমরা জিতে যাব। কিন্তু প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে কর্মী সংগঠিত করার জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। আমরা জনগণের সঙ্গে মিলতে পারি না। কিন্তু জনগণের যে উৎসাহ দেখি, তাতে মনে হয় জিতে যাব।
প্রশ্নঃ নির্বাচনে কারচুপি হবে কি ?
উত্তরঃ নির্বাচনে কারচুপি হলে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টই করবে। আমাদের সে ক্ষমতা নেই। তবে তারা যেভাবে জনমত সৃষ্টি করার জন্য টাকা দিচ্ছেন, তাতে কারচুপি হতে পারে। উন্নয়নের নামে এসব টাকা ৩ জুনের পরেই দেয়া উচিত।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.05.26-mijan.pdf” title=”1978.05.26 mijan”]