পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নহে,
তাই-লাহাের সম্মেলনের সহিত সম্পর্কচ্ছেদের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে
শেখ মুজিব দেশের উভয় অংশের মধ্যে অটুট ঐক্য ও সুদৃঢ় সংহতি
গড়িয়া তােলার জন্য ৬-দফা কর্তব্য নির্দেশ
(স্টাফ রিপাের্টার)
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (শুক্রবার)করাচী হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘােষণা করেন যে, লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী শিবিরের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাববাদিই নয়, গােটা সম্মেলনের সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে।
তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নয় বলিয়াই এই সম্মেলনের সঙ্গে তাহাকে ও তাহার সহকর্মীদের সম্পর্ক ছিন্ন করিতে হইয়াছে এবং সেইজন্যই সম্মেলনে গৃহীত কোন। প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনরূপ সম্পর্ক বা সংশ্রব নাই। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রায় একঘন্টাকাল আলাপ-আলােচনা করেন এবং সাংবাদিকদের বহুমুখী প্রশ্নের জবাব দান করেন। যুদ্ধোত্তর দেশের পরিস্থিতি পর্যালােচনা করিয়া শেখ মুজিব জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির বিবেচনার জন্য দেশের দুই প্রদেশের মধ্যে অটুট ঐক্য, সুদৃঢ় সংহতি ও বৃহত্তর সমঝােতা সৃষ্টির জন্য মুখ্যতঃ যে ৬-দফা প্রস্তাব করেন সেই সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বিস্তারিত বিবরণ দান করেন। লাহাের সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তিনি যে-সব সুপারিশ পেশ করেন সেই প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, পাক ভারতের মধ্যকার বিগত ১৭ দিনের যুদ্ধে যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে প্রশাসনিক দিক দিয়া জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের কথা বিচেনা করিয়া দেশে শাসনিক কাঠামাে সম্পর্কে। নূতনভাবে চিন্তা করার প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। তিনি বলেন, বিগত অস্বাভাবিক। ধরনের জরুরী দিনগুলিতে কেবল পূর্ব পাকিস্তানীদের ঐক্যবোধই দেশের দুই প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখিতে সমর্থ হইয়াছে, ঘটনাক্রমে নহে।
শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে তিনি যেসব সুপারিশ করিয়াছেন তাহা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলকে একত্র ও একই রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে বিশ্বমানচিত্রে কায়েম রাখার জন্যই করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, এই উদ্দেশ্য নিয়াই তিনি লাহাের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে তিনি একটি শাসনতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের সুপারিশ করিয়াছেন। সুপারিশকৃত এই শাসনতন্ত্রে বিশ্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার কায়েমের এবং আইন পরিষদসমূহের সার্বভৌমত্বের বিধান থাকিতে হইবে।
ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারাধীন যেসব বিষয় থাকিবে বলিয়া শেখ মুজিবর যে সুপারিশ করিয়াছেন তাহা এই যে, ফেডারেল সরকার দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব পালন করিবেন। এই দুইটি বিষয় ছাড়া আর বাকি যেসব বিষয় থাকিবে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকিবে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত স্টেটসমূহের হাতে।
দেশের মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিব সাবজেক্ট কমিটিতে অবাধে বিনিময়যােগ্য দুইটি পৃথক ধরনের মুদ্রার অথবা শর্তসাপেক্ষের একট মুদ্রা ব্যবস্থা কায়েম রাখার সুপারিশ করয়ািছেন।
তিনি সুপারিশ করিয়াছেন যে, ফেডারেশনের জন্য যদি একটি মুদ্রা ব্যবস্থা কায়েম রাখিতে হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে এবং সেইক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানের মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকরী শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
কর ধার্য সম্পর্কে শেখ মুজিব যে সুপারিশ করিয়াছেন তাহা হইতেছে যে, সর্বপ্রকারের কর ও শুল্ক ধার্যের একচেটিয়া অধিকার ফেডারেশনের ষ্টেটসমূহের হাতেই থাকিবে। ফেডারেল সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের অধিকার থাকিবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যয় নির্বাহের জন্য ষ্টেটসমূহের করের একটি অংশ ফেডারেল সরকার পাইবেন। ষ্টেটসমূহের সকল প্রকার করের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ দ্বারাই ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হইবে।
বৈদেশিক বাণিজ্য সম্বন্ধে শেখ মুজিব ৫ দফা সুপারিশ করিয়াছেন। প্রথমতঃ, ফেডারেশনের প্রতিটি ষ্টেটের পৃথকভাবে বিদেশী বাণিজ্যের হিসাব রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ, বিদেশী বাণিজ্যের দ্বারা আহৃত বিদেশী মুদ্রা ষ্টেটগুলির অধিকারে থাকিবে।
তৃতীয়তঃ, ফেডারেল সরকারের বিদেশী মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা যুক্তি সম্মত কোন একটা হারে ষ্টেটসমূহ মিটাইবে। চতুর্থতঃ, প্রয়ােজনীয় স্বদেশে প্রস্তুত সকল দ্রব্যই বিনা শুল্ক বা টেরিফের বিধিবিধানমুক্ত অবস্থায় ষ্টেটসমূহের মধ্যে যাতায়াত করিবে। শেষতঃ, শাসনতান্ত্রিক বিধান করিয়া ষ্টেটসমূহকে বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণের এবং সংশ্লিষ্ট ষ্টেটের স্বার্থে বিদেশে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার দিতে হইবে।
শেখ মুজিব শাসনতন্ত্র মতে ষ্টেটসমূহকে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ‘পেরামিলিটারী’ বা আঞ্চলিক বাহিনী সংরক্ষণের অধিকার দানেরও সুপরিশ করেন।
শেখ মুজিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, লাহাের সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রভাবশালী একটি মহল পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়া আলােচনা তাে দূরের কথা, শুনিতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায় তিনি তাঁর প্রতিনিধিদলসহ সম্মেলনের সঙ্গে ছিন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।
তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল রহিয়াছে বলিয়াই তাহার বিশ্বাস।
তাসখেন্দ ঘােষণা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক তাসখন্দ প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বে এই প্রশ্নে মতামত দেওয়ার কোন এখতিয়ার তাহার নাই এবং সেইজন্যই লাহাের সম্মেলনে এই প্রশ্নে তাঁহার কোন মতামত দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, আশা করা গিয়াছিল যে, এই সম্মেলনে জাতীয় সমস্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হইবে এবং ভবিষ্যতের জন্য জাতির সামনে সঠিক একটা কর্মসূচী তুলিয়া ধরা হইবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, সম্মেলনের প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা সবকিছুই পূর্বাহ্নে সাজাইয়া রাখিয়াছেন এবং দেশের প্রধান প্রধান সমস্যাদির কিছুই তাঁহারা বিচার-বিবেচনা করিতে প্রস্তুত নন।
জনৈক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, লাহাের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির কাছে তিনি যে ৬-দফা সুপারিশ করিয়াছেন, সেই ৬-দফা অন্তর্ভুক্ত করিয়া গণতান্ত্রিক কোন সংগ্রামের জন্য কোন প্লাটফরম গঠন করা হইলে তিনি সেই প্লাটফরমের সঙ্গে থাকিবেন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬