You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শেখ মুজিব পিণ্ডি যান নাই : আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে অটল
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

গতকল্য (বৃহস্পতিবার) অপরাহ্ন ৫টায় ঢাকা হইতে সান্ধ্য আইন ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহৃত হওয়ার পরক্ষণেই অকস্মাৎ দাবানলের মত সমগ্র শহরে এই মর্মে রটিয়া যায় যে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব রহমানকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে এবং এইদিন অপরাহ্নেই তিনি পিণ্ডি রওয়ানা হইতেছেন। এই সংগে আরও রটিয়া যায় যে, আগরতলা মামলাটিও প্রত্যাহৃত হইয়াছে।
শহরবাসীর অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল মনে এই ‘খবরটি’ এমনই দোলা দেয় যে, সত্যাসত্য যাচাইয়ের অপেক্ষা না রাখিয়া রাজধানী নগরীর ছেলেবুড়ো, নারী পুরুষ নির্বিশেষে পরম উৎসিত বোধ করে এবং দেখিতে দেখিতে সমগ্র শহরে আনন্দের বন্যা বহিয়া যায়। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা মিছিল করিয়া রাস্তার বাহির হইয়া পড়ে। বহুদিন শ্লোগানের মধ্যে একটি স্লোগান শহরের সর্বত্র সোচ্চারে উচ্চারিত হইতে থাকে। “জেলের তালা ভেঙ্গেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি” প্রধানতঃ এই শ্লোগান সহকারে শত শত খণ্ড মিছিল সারা শহরে ছড়াইয়া পড়ে। নিমেষের মধ্যে হাজার হাজার ছাত্র- জনতার ভীড় জমিয়া উঠে শেখ সাহবের বাড়ীতে। পুষ্পস্তবক ও ফুলের মালা সংগ্রহের জন্য চারিদিকে ছুটাছুটি পড়িয়া যায়। জনস্রোত চলে বিমান বন্দরের দিকে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের টেলিফোনগুলি মুহুর্মুহু বাজিয়া উঠিতে থাকে-অপর প্রান্ত হইতে ভাসিয়া আসিতে থাকে আগ্রহ ব্যাকুল কণ্ঠের একটি মাত্র জিজ্ঞাসা-শেখ সাহেব কোন প্লেনে পিণ্ডি যাইতেছেন? প্লেনে পিণ্ডি যাইতেছেন? ‘খবরটির সমর্থনের অভাবে সাংবাদিকদের পক্ষে এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দানও অসম্ভব হইয়া পড়ে।
এদিকে বেতার ও টেলিভিশনের সংবাদ বুলেটিনে কখনও জমিয়ত নেতা মওলানা আকরম কখনও বা নেজামে ইসলাম নেতা মওলবী ফরিদের উদ্ধৃতি দিয়া কেবলই প্রচার করা হইতে থাকে শেখ সাহেব ঐদিনই প্যারোলে মুক্তি পাইয়া পিণ্ডি যাইতেছেন।
এই অবস্থার মধ্যেই হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ফুলের মালা হাতে আগাইয়া চলে ক্যান্টনমেন্টের দিকে শেখ সাহেবকে সম্বর্ধনা জানাইতে। দেখিতে দেখিতে বিমান বন্দর এলাকায় সৃষ্টি হয় এক বিশাল জনসমুদ্র। রাজপথের দুই কূল ছাপাইয়া জনতা যখন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশে উদ্যত হয়, তখন সৈন্যবাহিনীর লোকেরা তাহাদের গতিরোধ করে এবং অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়া সে জনসমুদ্রকে বিমান বন্দরের দিকে ফিরাইয়া দিতে সক্ষম হয়। এই সময় সেনা বাহিনীর লোকদের রাইফেল ফেলিয়া করতালি দিয়া ছাত্র-জনতাকে অভিনন্দন জানাইতে দেখা যায়। শেখ সাহেবের বাসভবনে ও বিমান বন্দরে সমাগত বিশাল জনসমুদ্র ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেতৃসম্বর্ধনার জন্য দাঁড়াইয়া থাকে। কিন্তু কোথাও শেখ সাহেবের দেখা নাই। অতঃপর শোনা যাইতে থাকে, শেখ সাহেব রাত্রি সোয়া সাতটায় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য দিবেন। অতএব চল সেই দিকে। আবার শোনা যায়, শেখ সাহেব বাসায় পৌঁছিয়াছেন, অতএব চল সেই দিকে। এমনি করিয়া শহরবাসীর এক বিশাল অংশ যখন শহীদ মিনার ও শেখ সাহেবের বাড়ীতে ছুটাছুটি করিতেছে, বিমান বন্দরে ক্রমাগত জনসমুদ্রের ধৈর্যের বাঁধ যেন তখন ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর দুইজন অফিসার আসিয়া হ্যাণ্ড মাইকে প্রচার করেন যে, শেখ সাহেব আজ পিণ্ডি যাইবেন না—যাইবেন না।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!