কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির
নানা অনাচার ও অত্যাচারের মুখে আজ জনসাধারণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। সেইহেতু এখানে ওখানে দুর্ঘটনারও খবর পাওয়া যাইতেছে। বর্তমান আন্দোলনের লক্ষ্য দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হইলেও নিপীড়িতের প্রতীক হিসাবে শেখ মুজিবের নাম সর্বত্র উচ্চারিত হইতেছে। কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলক ভাবেও তাঁহার নাম ব্যবহার করিতেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের মনোভাব জানি। দেশে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে ছাত্র-যুবক ও জনসাধারণ যে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়াছেন এবং শেখ মুজিবরের প্রতি তাঁহারা যে শ্রদ্ধা ও আস্থা স্থাপন করিয়াছেন, সেইজন্য তিনি গোটা দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাঁহারা যে ত্যাগ ও নির্যাতনের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতেছেন, তাহাতে তিনি অভিভূত এবং এদেশের ছাত্র-যুবক ও জনতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত । তিনি চান, লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন চলুক। কিন্তু যে-কোন প্রকার উস্কানির মুখেও যেন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে পরিচালিত হয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে, এই পথেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হইবে; কোন শক্তি জাগ্রত জনতার এই দাবীকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না। গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে যিনি সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হইয়াছেন, সেই শেখ মুজিব কোন প্রলোভনেই জনগণকে পাশ কাটাইবেন না বা জন-দাবীর প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করিবেন না ইহাও স্থির-নিশ্চিত। সরকারী মহলের প্রতি আমাদের আবেদন, অতীতে তাঁহাদের কেহ কেহ যত উদ্ধত্যই প্রদর্শন করিয়া থাকুক না কেন, জাতির এই সঙ্কট মুহূর্তে তাঁহাদের তরফ হইতে যেন কোনপ্রকার উস্কানিমূলক আচরণ করা না হয়। দেশের পরিস্থিতি কি, আমাদের অপেক্ষা সরকারী উর্ধ্বতন মহলের তাহা আরো ভালভাবেই জানা থাকার কথা। এমনিতেই দেশে যে অশান্তি সৃষ্টি হইয়াছে তা আয়ত্তে আনিতে জননেতাদের পক্ষেও দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে বলিয়া আমাদের ধারণা। তথাপি আমরা দেশকে সকল প্রকার স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়া থাকি বলিয়া এখনো বিশ্বাস করি যে, ক্ষমতাসীনরা দেশে শান্ত পরিবেশ ফিরাইয়া আনার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির ব্যবস্থা করিবেন; এখানে মান-অভিমানের প্রশ্ন আর দেখা দিবে না। যে মোকদ্দমাটির ব্যাপার লইয়া কেহ কেহ মান-মর্যাদার প্রশ্ন তুলিয়াছেন দেশের স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো তাঁহাদের সেই মনোভাব আমরা উপলব্ধি করিতে পারিতাম। কিন্তু দেশে আজ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান নয়। প্রচণ্ড বিক্ষোভে সারা দেশ আজ কম্পিত। ক্ষমতাসীন মহল মান-মর্যাদার প্রশ্ন তুলিলে বিরোধীদলের পক্ষ হইতেও অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। দশ বছরের অত্যাচার- অনাচারের কাহিনী বাদ দিয়াও সাম্প্রতিককালে দেশে যাহা ঘটিয়াছে এবং আমাদের তরুণেরা যেভাবে প্রাণ দিয়াছে, সে প্রশ্নও উত্থাপন করা যায়। কিন্তু যেহেতু দেশের ঐক্য, সংহতি ও অস্তিত্ব আমাদের সকলের নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়, এবং যেহেতু এই আন্দোলন কোন ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী-বিশেষের বিরুদ্ধে নয়—বরং গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সেই হেতু শত অপ্রীতিকর ও বেদনাদায়ক ঘটনা সত্ত্বেও ছাত্র-জনতা ও রাজনীতিবিদেরা আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে এখনো প্রস্তুত। কিন্তু এখনো যাঁহারা সবকিছু নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করিতে চান, তাঁহারা হয়ত আমাদের এই যুক্তির সারবত্তা উপলব্ধি করিবেন না। তথাপি সকল মহলের নিকট আমাদের শেষ আবেদন যে, সময় থাকিতে এখনো নিয়মতান্ত্রিক পথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধানে কালবিলম্ব না করিয়া আগাইয়া আসুন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯