You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.23 | মুখর পল্টন : ছাত্রদের এগার দফার প্রতি মুক্ত মানবদের পূর্ণ সমর্থন | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

আজাদ
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
মুখর পল্টন : ছাত্রদের এগার দফার প্রতি মুক্ত মানবদের পূর্ণ সমর্থন
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

তথাকথিত আগরতলা মামলা সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলা হইতে সদ্যমুক্ত নেতৃবর্গ গতকাল শনিবার পলটনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত দুই লক্ষাধিক সংগ্রামী মানুষের সমাবেশে ভাষণ দানকালে ছাত্রদের এগারো দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং বলেন যে, জনগণের শাসন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক তথা আপামর জনসাধারণের সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন পরিচালিত এই সভায় জনসমুদ্রের উদ্দেশে, সংগ্রামী অভিনন্দন জানাইয়া প্রাণস্পর্শী ভাষণদান করেন আগরতলা মামলা হইতে মুক্ত লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, সিএসপি শামসুর রহমান, মোঃ আলী রেজা, দেশরক্ষা আইনে সাজাপ্রাপ্ত প্রখ্যাত প্রবীণ কৃষক নেতা হাতেম আলী খান, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান ও একমাত্র মহিলা রাজবন্দী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আলী হায়দার খান।
আগরতলা মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জম হোসেন তাহার কণ্ঠেও বাংলার জন্য সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বলেন যে, জনগণের সংগ্রামের জন্যই আগরতলা মামলা সরকার প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হইয়াছে। তাই সংগ্রামী ছাত্র-জনতার প্রতি তিনি তাহার অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
জনসভায় ভাষণ দানকালে আগরতলা মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত সি এস পি শামসুর রহমান খান সংগ্রাম করিয়া আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করিবার জন্য জনতার সংগ্রামকে অভিনন্দিত করেন।
তিনি বলেন, সরকারকে আপনার দাবী মানিতেই হইবে। কারণ পাকিস্তান আপনারাই প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই পাকিস্তান কোন সি এস পি অফিসার কিম্বা কোন স্বার্থ সন্ধানী দুঃসাহসিকের (এ্যাডভেনচারিষ্টের) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তাই দেশে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন লক্ষ শাসনতন্ত্র কায়েম করিতেই হইবে। এবং সরকার কী প্রকারের হইবে তাহাও জনগণই নির্দ্ধারণ করিবে। জনগণের যিনি নেতা তাহাকেও জনগণের কথামত কাজ করিতে হইবে।
তিনি বলেন, আজ দুঃখ ও আনন্দের দিন। আনন্দ এই জন্য যে, জনগণের জয় হইয়াছে-শাসক গোষ্ঠী পরাজয়বরণ করিয়াছে। কিন্তু দুঃখ এই জন্য যে, আমরা (আগরতলা মামলার অভিযুক্ত) পয়ত্রিশজন ছিলাম। অথচ মুক্তি পাইয়াছি চৌব্বিশজন। বন্ধু জহুরুলকে আমরা আনিতে পারি নাই।
তিনি বলেন যে, দেশকে সকল শাসন শোষণ হইতে মুক্ত করিতে হইবে-মানুষের হাতে ক্ষমতা ফিরাইয়া দিতে হইবে-তবেই দেশের সর্ব্বত্র যে আন্দোলনের দাবানল ছাড়াইয়া পড়িয়াছে তাহা শান্ত হইতে পারে।
সদ্য কারামুক্ত প্রবীণ কৃষক নেতা হাতেম আলী খান জনতার উদ্দেশে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দান করেন।
তিনি বলেন, বাংলা দেশ কৃষকের দেশ। এদেশের সমস্ত সম্পদ তৈরী করে কৃষক অথচ কৃষকের পেটে ভাত নাই। কলকারখানা তৈরী করে শ্রমিক অথচ শ্রমিকের পেটে খাবার নাই। পরিধানের কাপড় নাই। অন্যদিকে এগারোতলা দালান উঠিতেছে-তৈরী হইতেছে পাকা রাস্তা।
কৃষক নেতা বলেন, সারা জীবন ধরিয়া আমরা কৃষক সমাজ কেবল বঞ্চিত হইয়াছি, আমরা যাহা উৎপাদন করিয়াছি, তাহা সরকার, মহাজন, জোতদার লইয়া যাইতেছে।
কিন্তু আর নহে-আমি যাহা উৎপাদন করিব তাহা হইতে আমার খাওয়া পরার পর যাহা উদ্বৃত্ত থাকিবে উহাই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকারকে দিব।
তিনি বলেন, আমাদের দাবী মানিয়া লইবার জন্য বহু আবেদন নিবেদন করিয়াছি কিন্তু কোন ফল লাভ হয় নাই। এইবার সম্মুখ সংগ্রামে সেই দাবী আদায় করিয়া লইয়ব। গত শুক্রবার প্রচারিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিশেষ ভাষণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়া জনাব হাতেম আলী খান বলেন যে, আমাদের দাবীর প্রতি কোন অস্পষ্টতা নাই। আমাদের দাবী প্রকাশিত ও স্পষ্ট। কেবল মাত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই তাহা বাস্তবায়িত করিব।
বেগম মতিয়া চৌধুরী সভায় ভাষণ দানকালে বলেন, যতদিন পৰ্য্যন্ত জনগণের দাবী আদায় না হইবে ততদিন সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ওবায়দুর রহমান বলেন যে, পাকিস্তানের সংহতি যদি রক্ষা করিতে হয় তবে পাকিস্তানের রাজধানী এবং সশস্ত্র বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর ঢাকায় ও নৌবাহিনীর সদর দফতর চট্টগ্রাম স্থানান্তর করিতে হইবে।
তিনি বলেন, বিগত একুশ বছর ধরিয়া আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে রাজধানীতে গিয়াছি এখন পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঢাকায় আসিতে হইবে।
এই দাবী মানিয়া না লওয়া হইলে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কৰ্ম্মপন্থা প্রণয়ন করিয়া লইব।
তিনি বলেন, আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুল হক সহ যে বহু সংখ্যক ছাত্র, নাগরিক প্রাণ দিয়াছেন তাহাদের জন্য আমি তদন্ত দাবী করি না। ভাইয়েরা আপনারা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হন। শিয়াল কুকুরের মতো আর আমাদের হত্যা করা চলিবে না।
জনাব রহমান চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কারাগারে আটক সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি দানের জন্য চরমদাবী ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, সভায় ভাষণ দানের পূর্ব্বে প্রত্যেক ব্যক্তিকে মাল্যভূষিত করা হয় এবং মাল্যভূষণকালে জনতা তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনি প্রদান করে।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯