সম্পাদকীয়
দৈনিক পয়গাম
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শেখ মুজিবের মুক্তি
অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও প্রত্যাহৃত হইয়াছে। শেখ মুজিবর রহমানসহ ষড়যন্ত্র ও নিরাপত্তা আইনে ধৃত সকল বন্দীই মুক্তিলাভ করিয়াছেন। প্রকাশ, প্রদেশের কারাগারে কেবলমাত্র গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কেহই আজ আর বিনাবিচারে আটক নাই। প্রদেশের মানুষ শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের সরকারী সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করিয়াছে। ইহাকে তারা গণ-আন্দোলনের মহান বিজয় হিসাবেই গ্রহণ করিয়াছে। বিগত ২১ তারিখে প্রদত্ত বিশেষ বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁহার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার সাথে সাথে ইহাও বলিয়া দিয়াছিলেন যে, গোলটেবিল বৈঠকে বসিবার পথে যাবতীয় বাধা অপসারিত করা হইবে।
শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সেই ওয়াদা পূর্ণ হইয়াছে। কারাগার হইতে মুক্তি পাইয়া শেখ মুজিব জনগণের প্রাণঢালা সম্বধর্নার জওয়াবে বলিয়াছেন : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এক ও অভিন্ন। গণঅধিকার আদায় প্রসঙ্গে শেখ মুজিব আরো বলেন : এ সময় প্রয়োজন শান্তির। এই পর্যায়ে মুহূর্তের জন্য উচ্ছৃংখলতার প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো অবকাশ নাই বলিয়াও তিনি মন্তব্য করিয়াছেন।
বর্তমান গণ-আন্দোলন, জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্তৃক জাতীয় সঙ্কট নিরসনের জন্য গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট যে জনগণের আশা ও আকাংক্ষার পূর্ণ মর্যাদা দানে প্রস্তুত, তাও দৈনিক ইত্তেফাক ও উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি প্রদান হইতেই অনুমান করা যাইতে পারে। মোদ্দা কথা এই যে, সরকার নিজের তরফ হইতে করণীয় সকল কাজেরই আঞ্জাম দিয়াছেন; এখন বৈঠকে বসা এবং গণদাবী পেশ করার দায়িত্ব বিরোধীদলীয় নেতৃবর্গের। প্রেসিডেন্টের আন্তরিকতায় সন্দেহ করার কোন অবকাশ নাই। পক্ষান্তরে এধরনের অহেতুক সন্দেহে যে অধিকার আদায়ের দাবীতে জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ, সেই অধিকার আদায়ের কাজটাই বিলম্বিত হইবে। এই বিলম্ব প্রকারান্তরে গণ-অসন্তোষ বৃদ্ধিরই সহায়তা করিবে এবং ইহাতে উচ্ছৃংখলতা বৃদ্ধি পাইবে। ইহা শেখ মুজিব কথিত শান্তি ও শৃংখলার পন্থা যে হইবে না, তা বলাই বাহুল্য।
কথায় বলে, বেশী কচলাইলে লেবু পর্যন্ত তিতা হইয়া যায়। জনগণের দাবী-প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকার, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, আইন পরিষদসমূহের প্রতিনিধিত্ব আজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। জনগণের আন্দোলনেই ইহা সম্ভব হইয়াছে। এখন নানা অজুহাতে এই পথযাত্রা বিলম্বিত করার অর্থই হইবে জনসাধারণকে পূর্ণ কামিয়াবী হইতে বঞ্চিত করা ইহা কারো কাম্য হইতে পারে না। যতদূর জানা গিয়াছে, শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠক যোগদান করিবেন। মওলানা ভাসানী নিজে উপস্থিত না থাকিলেও তাঁহার দলের প্রতিনিধি বৈঠকে যোগ দিবেন বলিয়াও আশা করা যাইতেছে। সুতরাং গোলটেবিল বৈঠক বসিবে এবং তা সফল হইবে, এই আশা নিঃসন্দেহে পোষণ করা যাইতে পারে।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯