You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.23 | বিজয়ের মুহূর্তে : একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা লগ্নে | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়
সংবাদ
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
বিজয়ের মুহূর্তে : একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা লগ্নে

আগামী নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হইবে এবং এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবেন না। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এই ঘোষণা প্রদানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহৃত হইয়াছে এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য সকলেই মুক্তি পাইয়াছেন। ইহার অব্যবহিত পরেই মনি সিং, মতিয়া চৌধুরী, আবদুল হালিম, হাতেম আলী খান, ওবায়েদুর রহমান, মনি কৃষ্ণ সেন, নগেন সরকার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার সহ অন্যান্য সকল রাজবন্দীর মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহা বিরাট বিজয়। এই বিজয়ে আমরা সকলের সহিত শরীক হইতেছি এবং সর্বাগ্রে আমাদের প্রিয় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাইতেছি। এই বিজয়ের সকল গৌরব আমাদের সংগ্রামী শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদেরই প্রাপ্য। বিশেষ করিয়া আমাদের ছাত্র সমাজ একনায়কতাবাদী ব্যবস্থা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আপোষহীন সংগ্রাম করিয়া গিয়াছে এবং এই সংগ্রামে যে ত্যাগ, লাঞ্ছনা, নির্যাতন সহ্য করিয়াছেন তাহা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জের বীর শ্রমিকদের কথা; কেননা তাহারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই সংগ্রামকে দিয়াছে অজেয় শক্তি এবং তাহাদের আত্মত্যাগ কাহারও অপেক্ষা কম বিবেচিত হইবে না।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণা ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার কিংবা সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি কোনটাই আমাদের নিকট বিস্ময় হিসাবে আসে নাই। যাহা বিস্ময় হিসাবে আসিয়াছে তাহা হইল মামলা প্রত্যাহার, সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি প্রদান এবং প্রেসিডেন্টের ঘোষণা দানে অহেতুক বিলম্ব। অনেক মৃত্যু, অনেক রক্ত এবং বহু সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা আমাদের এই বিলম্বের মাসুল যোগাইতে হইয়াছে। এক মাস পূর্বে এই সিদ্ধান্তসমূহ ঘোষিত হইলে অনেক অমূল্য জীবন রক্ষা পাইত, বহু ক্ষয়ক্ষতি হইতে দেশ বাঁচিয়া যাইত। খাইবার হইতে টেকনাফ পর্যন্ত, নওশেরা হইতে ফৌজদারহাট পর্যন্ত যে বিপুল গণঅভ্যুত্থানের তরঙ্গ দোলায় সমগ্র দেশ আন্দোলিত হইয়াছে সেখানে এই দুইটি প্রশ্ন ছিল মুখ্য প্রশ্ন। এই প্রশ্নে সরকার আপোষহীন মনোভাব গ্রহণ করার ফলেই সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। অবশ্য গণআন্দোলনের দুর্বার স্রোতকেও স্তব্ধ করা যায় নাই। গণবিজয়ের এই সুবর্ণ মুহূর্তে আমরা সংগ্রামের সেই অমর শহীদদের প্রতি আর একবার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি এবং তাহাদের পূত পবিত্র স্মৃতিকে আমাদের কথায় এবং কাজে, আমাদের আগামী দিনের প্রতিটি মুহূর্তের চেতনায় এবং ধ্যানে অক্ষয় করিয়া রাখিবার শপথ গ্রহণ করিতেছি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি নাগরিককে সেই শপথ গ্রহণের আবেদন জানাইতেছি। যে জাতি তাহার বীরদের সম্মান দিতে জানে না, তাহার শহীদদের স্মৃতিকে সম্মান করিতে জানেনা সে জাতির কোন ভবিষ্যৎও থাকে না।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় প্রায় সকল বিরোধীদলই সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন এবং ইহাকে বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
আমরা নেতৃবৃন্দের এই মনোভাবের প্রতিফলন করিয়া বলিতে চাই বিলম্বে হইলেও প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের পথকে সহজতর করিবে একমাত্রও তখনই যখন গণতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট একটা সর্বজনগ্রাহ্য কর্মপন্থা গ্রহণে সফল হইবেন এবং প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা দ্বারা অবিলম্বে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন।
আমরা আওয়ামী লীগ প্রধান এবং শ্রী মনি সিংসহ সমস্ত রাজবন্দীকে মুক্ত পরিবেশে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি এবং বলিতেছি তাঁহারা মুক্তি পাইয়াছেন জনতার শক্তিতে, জনতার দুর্বার মনোবল ও সংগ্রামী জমায়েতের মুখে। তাঁহাদের এই মুক্তি জনতারই বিজয়।
জনতার এই বিজয়ের মুহূর্তে আমরা দেশবাসীর খেদমতে আরও কয়েকটি কথা নিবেদন করা অপরিহার্য বিবেচনা করিতেছি। কথাগুলি হইল ১৯৫৮ সালের এক অন্ধকার রাত্রিতে দেশের বুকে স্বৈরাচারের যে কালো অধ্যায় সূচিত হইয়াছিল আজ সে অধ্যায়ের অবসান এবং জাতীয় জীবনে এক নতুন অধ্যায় রচনার মুখোমুখি আমরা অবস্থান করিয়াছি। এই নতুন অধ্যায় কিভাবে উন্মোচিত হইবে তাহা জনসাধারণের উপরই নির্ভর করিতেছে। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক গণবিজয়ের মত বর্তমান বিজয়ও বিভেদনীতি ও চক্রান্ত রাজনীতির খপ্পরে পড়িয়া নস্যাৎ হইবে কিনা তাহা জনসাধারণের উপরই নির্ভর করিতেছে। প্রতিশ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৯৫৮ সালের কালো রাত্রি আসিয়াছিল। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইবে কিনা তাহাও নির্ভর করিতেছে জনসাধারণের উপর। আসুন আমরা আজ শপথ গ্রহণ করি-আমাদের বিজয়কে নস্যাৎ করার মত সকল বিভেদকামী শক্তির চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কবর রচনা করি। আসুন যে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক মোর্চা গড়িয়া উঠিয়াছে উহাকে দুর্বার করিয়া তুলি। আসুন গণতান্ত্রিক সমাজের বুনিয়াদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করি। জনগণকে আজ এ সম্পর্কে বিশেষভাবে সজাগ থাকিতে হইবে। কেননা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব চলিয়া গেলেই সকল সমস্যার সমাধান হইবে না। সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বর্তমান ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করিতে হইবে। সে কাজে সকল দল ও মতকে একমাত্র দেশবাসীর সক্রিয় উদ্যোগই ঐক্যবদ্ধ রাখিতে সফল হইবে।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯