সম্পাদকীয়
দৈনিক ইত্তেফাক
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
জয়, নিপীড়িত জনগণ জয়, জয় নব উত্থান
আজ উৎসবের দিন নয়, বিজয়ের দিন। আজ আনন্দের দিন নয়, স্মরণের দিন। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হইয়াছে। দুঃশাসনের কারাকক্ষ হইতে দেশের প্রিয় সন্তান শেখ মুজিব অন্যান্য সহবন্দীর সঙ্গে মুক্ত হইয়া আবার তাঁর প্রিয় দেশবাসীর মাঝে ফিরিয়া আসিয়াছেন। শহীদী ঈদের সেনাদের অভিযান সফল হইয়াছে। গণ-জাগরণের প্রবল প্লাবনের পলিমাটিতে রক্তাক্ষরে লিখিত হইয়াছে নূতন এক ঊষার স্বর্ণদুয়ার উন্মুক্ত করার অবিস্মরণীয় কাহিনী। এ কাহিনী অসংখ্য শহীদের আত্মদানের, অসংখ্য বীরমাতা ও বীরজায়ার অশ্রু ও হাহাকার সংবরণের কাহিনী। তবু আজ অহল্যা-প্রতিম পূর্ব বাংলা জাগ্রত। তার অশোক আকাশে ফাল্গুনের রক্তসূর্যে নূতন প্রাণের পতাকা শিহরিত। মেঘের সিংহবাহনে নূতন প্ৰভাত আসিয়াছে। এই প্রভাতের সাধনায় তিমির রাত্রির তপস্যায় যাঁহারা আত্মাহুতি দিয়াছেন, আজ বিপুল বিজয়ের ক্রান্তিলগ্নে তাঁহাদেরই আমরা সর্বাগ্রে স্মরণ করি। তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে জানাই আমাদের অবনত চিত্তের অভিনন্দন।
চারিদিকে আজ জয়ধ্বনি। চারিদিকে আজ প্রলয়োল্লাস। বজ্রের ভেরীতে প্রাণের সাড়া জাগিয়াছে। সুপ্ত গণ-বাসুকী জাগরণের প্রথম চমকে ফুলিয়া উঠিয়াছে। সব বাধা, সব চক্রান্ত, সব আগল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। গণ-বিরোধী প্রতিক্রিয়ার দুর্গে গণ-জাগরণের বিজয় কেতন একদিন উড্ডীন হইবেই, এ প্রত্যয় আমাদের চিরকালের। ইতিহাসের এই শিক্ষা মিথ্যা হয় নাই। একদিন যাহাকে মনে হইয়াছিল দুর্ভেদ্য, আজ তাহা লুপ্ত। মধ্যরাত্রির সূর্যতাপসদের যে সাধনাকে একদিন মনে হইয়াছিল ব্যর্থ প্রয়াস, আজ তাহাই জয়ের মহিমায় মহিমান্বিত। এই মহিমা গণ-চেতনার। এই বিজয় গণ-মানুষের। দুঃশাসনের লৌহকপাট ভাঙ্গিয়া, প্রভাতের রক্তসূর্য ছিনিয়া আনিয়া এ গণ- মানুষেরা আবার প্রমাণ করিল তাহারা অপরাজেয়। তাহারা চিরকালের অপরাভূত শক্তি। এই শক্তিকে যাহারা তুচ্ছ ভাবিয়াছিল, তাহাদের পতন ঘটিতেছে। এই শক্তিকে যাহারা দমন করিতে চাহিয়াছিল, তাহারা ব্যর্থ হইয়াছে। গণ-অধিকারের অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠা আজ সফল সংগ্রামের মাঝে মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে। তবু আমরা আনন্দ করিব না। দেশের মানুষ আজ তাহাদের হৃত অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার সম্ভাবনায় অধীর। কারাকক্ষের লৌহ কপাট খুলিয়া দেশপ্রেমিক সন্তানেরা দীর্ঘদিনের বন্দীদশা শেষে আবার এক এক করিয়া মুক্ত আলো-বাতাসে ফিরিয়া আসিতেছেন। দেশের মানুষ ফিরিয়া পাইয়াছে তাহাদের প্রিয় মুজিবকে। পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরিয়া আসিয়াছেন তথাকিথত ষড়যন্ত্র মামলার সকল অভিযুক্ত। কেবল ফিরিয়া আসে নাই একজন। তিনি কোনদিন ফিরিয়া আসিবেন না। প্রিয়জনের ব্যগ্র বাহুর সান্নিধ্য আর তিনি কোন দিন লাভ করিবেন না। বন্দীদশাতেই নির্মমভাবে নিহত হইয়াছেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। বহু নাম জানা আর না- জানা শহীদের রক্তে মিশিয়া গিয়াছে শহীদ জহুরুল হকের রক্ত। এ শোণিতচিহ্ন আমাদের স্মৃতি হইতে কোনদিন মুছিয়া যাইবে না। জহুরুল হকের শোণিতরেখা এদেশের গণজাগরণের প্রদীপ্ত পথরেখা। জহুরুল হক অমর। নিজের প্রাণের মূল্যে এদেশের গণ-সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি মৃত্যুহীন প্রাণের পতাকা উড্ডীন করিয়া গেলেন।
ইতিহাসের গতি অনিরুদ্ধ। গণ-শক্তির বিজয় অপ্রতিরোধ্য। সফল সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে তাই আমরা আবার আমাদের লক্ষ্যের ধ্রুবতারা অন্বেষী হইয়াছি। বিজয়ের গৌরবে আমরা যেন মোহাবিষ্ট না হই। পথভ্রষ্ট না হই। জনগণের বিজয়ের রথচক্রে সেই বজ্রের ভেরীই নিনাদিত হউক, যাহার মধ্যে দেশ ও দেশবাসীর প্রকৃত স্বার্থ ও অধিকার চেতনা জাগ্রত। জনগণের জয় সার্থক হউক, জনগণের উত্থান স্থায়ী ও সফল হউক।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯