You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুলনার জনসভায় বঙ্গবন্ধু

খুলনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মঘট ও ঘেড়াও পরিহার করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠনের কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতার কাজে জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আজ খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন যে, তাদের জন্যে
ভবিষ্যত বংশধররা যাতে দুঃখ ভোগ না করে জনগণ তাতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ভবিষ্যত বংশধররা যাতে সুখ স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করতে পারে তার জন্যে তারা আরো কঠিন পরিশ্রম করবে বলে তিনি আশা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন এক শ্রেণির রাজনৈতিক লোেক ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কাজে লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলেন তাদের কার্যকলাপ আমার জানা আছে এবং করে যে তা বন্ধ করতে হয় সেটাও আমি জানি। পল্লী এলাকার ডাকাত, গুণ্ডা, দুবৃত্তদের কার্যকলাপ দমনে তিনি সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের সাথে জনগণকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, এসব লোক কোনো কোনো সময় নিজেদের নক্সালপন্থী বলে জাহির করে। পল্লীর জলজ আস্থা ও শান্তি স্থাপনকল্পে এসব দুবৃত্তকে নির্মূল করতে হবে। তিনি ঘোষণা করেন, ইতোমধ্যেই এসব লোকের কার্যকলাপ দমনের জন্য প্রয়োজনবোধে পুলিশকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জাতীয়করণ কর্মসূচি : জাতীয়করণ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, জনগণের মঙ্গলের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন যে, কলকারখানা চালাতে তাদের শীঘ্রই সুযোগ দেয়া হবে। অতএব তারা যেন তাদের দাবি এবং ঘেরাও সম্পর্কে সাবধান হন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, কলকাখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দলিল ও দস্তাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, কলকারখানা গুলিতে শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকবে। শ্রমিকরা কোনো প্রকার ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবে না। বঙ্গবন্ধু তাদের থেকে এই প্রতিশ্রুতি চান। কোনো দাবি ছাড়া আগামি ৩ বছর কঠিন পরিশ্রম করার জন্য বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের পরামর্শ দেন। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীদের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তারা ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে এবং এক কোটি লোককে ভারত পালিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং ভারত তাদের মহানুভবতার সাথে আশ্রয় দেয়। বঙ্গবন্ধু বলেন যে তাদের মর্মান্তিক নির্যাতনের কাহিনী যে কোনো ব্যক্তিকে দুঃখ দিবে। মনুষ্যকায় এই জানোয়ারেরা কীভাবে পৃথিবীতে জন্মেছিল এই বলে বঙ্গবন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের জনগণের মহানুভবতার জন্যে তিনি ধন্যবাদই দিতে পারেন।
জনগণের মাটিতেই জানোয়ারদের বিচার হবে : যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টোর সাম্প্রতিক মন্তব্যর কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, জনাব ভুট্টো জানোয়ারদের বিচার হতে দেবেন না। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, আমি তাকে জানিয়ে দিচ্ছি, বাংলাদেশের মাটিতেই তাদের বিচার হবে। তিনি বলেন, জনগণের সান্নিধ্য থেকে দূরে রাখার জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ জনগণ তাদের হত্যা করতে পারতো। দোষীদের বিচার করা ও শান্তি দেয়া হবে। তারা কোনো মতেই রেহাই পাবে না। পাকিস্তানি সৈন্যদের আচরণের জন্য জনাব ভুট্টোর লজ্জিত হওয়া উচিত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। যুদ্ধবন্দিদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই জনাব ভুট্টোর এ কথা বলা উচিত।
বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তান জয় করে নিত : বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের ভাগ্য ভালো যে, পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের পাশাপাশি নয়। তাহলে যুদ্ধে বাঙালিরা ঐ অংশটিও জয় করে নিত। তিনি বলেন যে, বর্বর পাকিস্তানের হানাদারবাহিনীর সাথে স্থানীয় সহযোগী, রাজাকার, আল বদর, জামায়াত প্রভৃতি যোগ দেয়। তারা জনগণের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। যদি কেউ কোনো দালালের সাথে সুপারিশ করতে আসে তবে তাকেই দালাল বলে সাব্যস্ত করা হবে। বঙ্গবন্ধু এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন যে, দালালদের কোনো মতেই ক্ষমা করা হবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ভুট্টোর কারাগারে আটক থাকা কালেও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন, কারণ জনগণ স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। তিনি বলেন যে, শূন্য হাতে নবজাত রাষ্ট্র ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সমস্যার জন্যে রাতে তিনি ঘুমাতে পারেন না।
জোতদাররা হুঁশিয়ারঃ চাষিদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তারা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তার সরকার এ সম্পর্কে বৈপ্লবিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। তার সরকার প্রতিটি পরিবারের জন্য ১শ বিঘা জমি বরাদ্দ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই নগদ ১৮ কোটি টাকার ত্রাণ এবং ১০ কোটি টাকার তাকাৰি ঋণ দেয়া হয়েছে। গরিবদের জমি থেকে জোর করে ধান কেটে নেয়া সম্পর্কে তিনি জোতদার দের হুশিয়ার করে দেন। অতীতকে ভুলে যেতে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে পরামর্শ দেন। তিনি জনগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তারা যদি আবার ঐ জাতীয় জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে চায়, তাহলে পুলিশ এবং জনগণ তাদের খতম করবে।
ঘুষ দেবেন না : সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, আমি আপনাদের গণবিরোধী কাজ করতে নিষেধ করছি। ঘুষ নেবেন না। এরপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, কর্মচারীদেরকে আপনারাও ঘুষ দেবেন না। মহান আত্মত্যাগের পর সকলের জন্য স্বাধীনতা এসেছে। তিনি জনগণের ৩-৪ বছর পরিশ্রম করার আহ্বান জানালে জনগণ টার কথায় সায় দেন। বিদেশি সাহায্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, শর্তসাপেক্ষে সাহায্য গ্রহণ করা হলে টাকা-পয়সায় দেশ ভরে যেত । তিনি তা চান না। কারণ এর ফলে দেশের জনগণ দাসে পরিনত এবং ভবিষ্যত বংশধরদের দুঃখ কষ্টের কারণ হবে। তিনি জনগণ এবং এম সি এদের আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার দালালদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তিনি আওয়ামী লীগ কর্মী ও এমসিএদের দুঃখী জনগণের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের উপদেশ দেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীরা জনগণের অর্থে অট্টলিকা বানিয়েছিল। তিনি বলেন যে, আজ জনগণ সেই অর্থ ও অট্টালিকা দখল করেছে। তারা যদি মুসলিম লীগের পথ অনুসরণ করেন, তাহলে জনগণ তাদের রেহাই দেবে না।
জনগণের স্বার্থে : বঙ্গবন্ধু বলেন যে, জনগণের স্বার্থের উপরে তার কোনো বন্ধু, মা-বাবা নেই। কোনো আওয়ামী কর্মী যদি অন্যায় করে তার কোনো ক্ষমা নেই। ছাত্র ও যুবক দের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। তিনি সকল শ্রেণির মানুষকে তাদের নিজ নিজ পেশায় কাজ করে যেতে আহ্বান জানান। ছাত্রদের তিনি পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে উপদেশ দেন। তিনি বলেন যে, উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া অতীতে বহু সম্ভাবনাময় অগ্নিসম্ভব নেতা আধারে বিলীন হয়ে গেছেন। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, দেশ তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং তাদের দেশ গঠনে বিরাট দ্বায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন যে, এক শ্রেণির লোক ভারত বিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য তিনি তাদের হুঁশিয়ার করে দেন। তিনি বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় তারা ঐসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন যে, জনগণ তাদের ঠাণ্ডা করে দিবেন, এ বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন, মুক্তি সংগ্রামের সময় তারা কোথায় ছিল? তিনি বলেন, কচ্ছপের মতো তারা আত্মগোপন করেছিল। এখন দেশ মুক্ত হয়েছে এবং তারা ঐ দেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। জনগণকে তিনি তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেন। তাদের তিনি নুরুল আমিনের সঙ্গে তুলনা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, নুরুল আমিনকে তার পাকিস্তানের প্রভুরা পুরুস্কৃত করেছেন। তিনি বলেন যে, ঐ শ্রেণির লোকেরাই বলত যে, মুসলমানরা তাদের ভাই। এবং তারাই নিজের ভাইদের হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর আদেশ অনুযায়ী এক শ্রেণির সশস্ত্র লোক ও রাজাকাররা অস্ত্র জমা দেননি। তাদের ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার জন্যে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
খাদ্য পরিস্থিতি : খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন এবং বলেন যে, খাদ্য সংগ্রহের জন্য সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন যে, খুব শীঘ্রই ৫ লাখ টন খাদ্য শস্য আমদানি করা হবে। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের বন্দর গুলো পরিষ্কার করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি উদ্ধারকারী দল কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পুনরায় তাদের বাংলাদেশ গড়তে হবে। শোষণহীন সমাজ গঠন করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে।

রেফারেন্স: ৩১ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!