You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.26 | স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন? | খোন্দকার আলী আশরাফ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ জুলাই ১৯৮১ - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন? | খোন্দকার আলী আশরাফ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ জুলাই ১৯৮১

একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে করেছিলেন? শেখ মুজিবুর রহমান, মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, না অন্য কেউ? স্বাধীনতার দশ বছর পর বিতর্কটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আসলে অবশ্য এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই এক ধরণের সংশয় ও বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু এ বিতর্ক এই প্রথম।

এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে জাতীয় সংসদে। সেখানে তুমুল বাক- বিতন্ডা হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা কে করেছিলেন সেই প্রশ্ন নিয়ে। বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম রচিত ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ পুস্তকের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চশেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কোন পটভূমিকায় তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, এতে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটার চাইতে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।

বিতর্ককালে সরকার দলীয় সরকার দলীয় সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকবর হোসেন বলেছেন, স্বাধীনতার বিষয়ে আমরা ২৭ মার্চেই প্রথম চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা শুনতে পাই৷ শেখ সাহেব ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বলে যে দাবী করা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা।

বিষয়টি নিয়ে বাদানুবাদ সংসদের বাইরেও সংক্রমিত হয়। এ ব্যাপারে সংবাদ পত্রে আমরা কয়েকটি বিবৃতি দেখতে পাই। প্রথমে বক্তব্য রাখেন ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ এর লেখক মেজর রফিক। তিনি দাবী করেন যে, তার বইতে যা লেখা হয়েছে তা পুরোপুরি সত্য। তার মূল বক্তব্য ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খোলা হলে আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম আবদুল হান্নান ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।

এরপরে আমরা এ ব্যাপারে পাই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর ভাষ্য। এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সালেকের লেখা পুস্তকেও এর স্বীকৃতি মেলে। সালেক উল্লেখ করেন যে, ২৫ মার্চ রাত ১২ টায় তিনি যখন টিক্কা খানের সঙ্গে বসেছিলেন তখন ওয়ারলেসে ভেসে আসা শেখ সাহেবের স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল।

জেনারেল আরো বলেনঃ ২৫ মার্চ সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সর্বশেষ ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘ওরা অস্ত্র ব্যবহার করলে আমি স্বাধীনতার ঘোষণা দেব। আমি স্বাধীনতার ঘোষণা তৈরী করে রাখছি৷ ‘

এই পর্যায়ে আমরা আরো একটি ভাষ্য পাই। তা হলো সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী জনাব এম আর সিদ্দিকীর। এক বিবৃতিতে তিনি বললেন, ২৬ মার্চের সকালে চট্টগ্রামে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রেরিত বলে কথিত একটি ওয়ারলেস মেসেজ পান। তক্ষুণি সংগ্রাম কমিটির বৈঠক ডাকা হয় এবং সেই বৈঠকে ঐ বাণীটি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মরহুম ডঃ জাফর ঘোষণাটি বাংলায় ‘মুসাবিদা ‘ করেন এবং কমিটি তা অনুমোদন করে।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এম এ হান্নানের ওপর দায়িত্ব অর্পন করা হয় ঘোষণাটি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানের কালুরঘাট সাব- স্টেশন থেকে পাঠের। ২৬ মার্চ বিকেল তিনটায় ঘোষণাটি বেতারে প্রচার করা হয় এবং সেটা অসময় ও অপ্রত্যাশিত সময় বলে তা অনেকেই শুনতে পাননি। ‘

এখানে আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। ‘স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ সংক্রান্ত কথাগুলো আমরা প্রথম শুনতে পাই ১৯৭২ সালে। একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস এবং তারপরও তিন-চার মাস স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন তা নিয়ে কথা ওঠেনি৷ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মুজিবনগরস্থ স্বাধীন বাংলা বেতারের কোন অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার কোন ঘোষণা কখনো প্রচারিত হয়নি। তবে তখন সবাই এই কথাটাই সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছিলেন যে, মেজর জিয়াই ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক। এ ব্যাপারে কারো মনে কোন সংশয় ছিল না। আওয়ামী লীগ মহল থেকে ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি প্রথম আভাস দেয়া হয় এবং পরে জোর দিয়ে বলা হয় যে, ২৫ শে মার্চের রাতে শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং টেলিযোগাযোগ ঘোষণার কপি পাঠিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে এবং সেখান থেকে তাকে ওটা প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষক সম্পর্কে তখুনি প্রথম বিভ্রান্তির বীজ উপ্ত হয়৷ (অথচ এর আগে এ সম্পর্কে কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি।) ২৫ মার্চ রাতে শেখ সাহেব যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন বলে বলা হয় তা ১৯৭২ সালেরই এক সময় সরকারের প্রকাশনা দফতর থেকে প্রকাশিত হয়। লক্ষণীয় যে, মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাটি টেলিগ্রামযোগে পৌছেছিল বলে তখন উল্লেখ করা হয়েছিল। তাছাড়া তখন ‘স্বাধীনতার ঘোষণাটি ‘ প্রকাশ করা হলেও কে কবে কখন চট্টগ্রাম বেতার থেকে তা পাঠ করেছিলেন অথবা আদৌ পাঠ করা করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে তখন আওয়ামী লীগ মহল নিশ্চুপ ছিলেন। মরহুম হান্নান যে ওটা চট্টগ্রাম বেতার থেকে পাঠ করেছিলেন সে কথা প্রথম জানা যায় মেজর রফিকের পুস্তক থেকে৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার বাণী চট্টগ্রাম প্রেরণ সম্পর্কে আমরা দুটো ভাষ্য পাচ্ছি৷ একটাতে বলা হয়েছে, ওটা পাঠানো হয়েছিল জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে টেলিগ্রামযোগে ও অপরটিতে বলা হয়েছে, ওটা ছিল একটা ওয়ারলেস মেসেজ। এ সম্পর্কিত এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বিবৃতিতে যেমন টেলিগ্রামেরও কোনো উল্লেখ নেই তেমনি জহুর আহমদ চৌধুরীরও নামেরও উল্লেখ নেই। অন্য দিকে তেমনি জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে যে টেলিগ্রামটি গিয়েছিল বলে বলা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তার কি পরিণতি হয়েছিল তাও জানা যায়নি।

ফলতঃ গোটা ব্যাপারটাই এক বিভ্রান্তিকর হেঁয়ালীতে পরিণত হয়েছে এবং আরো কতিপয় ভাষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা আরো রহস্যঘন হয়ে উঠেছে৷ চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কে করেছিলেন অথবা বলা উচিত প্রথমে কে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন সে সম্পর্কে আরো একটি জোরালো ও সুস্পষ্ট ভাষ্য আছে৷ এই ভাষ্যটি স্রেফ অরাজনৈতিক মহলের এবং এরা কেউই কেউকেটা লোক নন বলে তাদের বক্তব্যটিকে কেউ পাত্তা দেননি মোটেও৷

এখন আমাদের কর্তব্য হল স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে কেন্দ্র করে যে বিভ্রান্তির আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস ও সত্যের স্বার্থে দীর করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা। এটাই বক্ষমান নিবন্ধের লক্ষ্য৷

কালুরঘাট সাব-স্টেশন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে আমরা প্রথম বক্তব্য পাই জনৈক নুরুল আলম মন্টুর লেখা একটি ফিচার নিবন্ধে। ১৯৭২ সালের ৬ ই মার্চ অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের মাস দুয়েক মাত্র পরে এই লেখাটি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বস্তুতঃ এটাই প্রথম প্রকাশিত বক্তব্য।

লেখকের মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল কালুর ঘাট সাব-স্টেশনটাকে কিভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল এবং কারা কোন অবস্থায় কোন উদ্দেশ্যে তা করেছিলেন সেই সব তথ্য পরিবেশন। আর এই নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, প্রধানতঃ একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের উদ্দেশ্যেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

মন্টু লিখেছেনঃ ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলী, ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ দাশ ও আশিকুল ইসলামকে নিয়ে ওয়াপদার একটি গাড়িতে করে মেজর জিয়ার কাছে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তারা কয়েকজন ছাত্রের কাছে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আবেদনের কপি লাভ করেন। ডঃ আনোয়ার ও তার বন্ধুরা এবং আরো অনেকে মিলে তখন অমানুষিক পরিশ্রমের পর প্রথমে কালুরঘাট বেতারকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেখান থেকেই স্বাধীনতার বাণীটি প্রচার করা হয় ২৬ শে মার্চ দুপুরে। তবে ঐ নিবন্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের সংগঠকদের নাম থাকলেও স্বাধীনতার ঘোষকের নাম ছিল না।

এ সম্পর্কে আরো সবিস্তারে লিখেছেন ঐ নিবন্ধে উল্লেখিত ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলী স্বয়ং। গত স্বাধীনতা সংখ্যা দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হলঃ একটি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার তাগিদেই তারা কালুরঘাট সাব-স্টেশনকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই নিবন্ধ থেকেই আমরা জানতে পারি যে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা শেখ মুজিবের নির্দেশে মরহুম হান্নানও দেননি, মেজর জিয়াও নন, দিয়েছিলেন যিনি তার নাম আবুল কাসেম সন্দীপ।

ডঃ আনোয়ার আলী লিখেছেন, ‘আগ্রাবাদ রোডে একজন লোক টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম বলে চেচাচ্ছিল আর একটা ছোট কাগজ বিলি করছিল। গাড়ি থামিয়ে আমি একটি কাগজ সংগ্রহ করি। কাগজটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত একটি বাণী৷ তিনি তাতে ২৫ মার্চের ঢাকার ঘটনাবলী উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের ও দেশবাসীর প্রতি প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছেন৷

…… টেলিগ্রামের কাগজটা আমার স্ত্রী মিসেস মঞ্জুলা আনোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দেখে তিনি প্রথমে উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটু পরেই নিরাশ হয়ে বললেনঃ এরকম একটা বাণী আমাদেরকে কতটা অনুপ্রাণিত করবে সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। কেননা এতে স্বাধীনতার উল্লেখ নেই।’

নুরুল আলম মন্টুর ভাষ্যের সাথে এটা মিলে যায়। কারণ তিনিও বলেছেন, ডঃ আনোয়ার যে কাগজটা পেয়েছিলেন সেটা ছিল একটা আবেদন মাত্র। স্বাধীনতার ঘোষণা তাতে ছিল না।

‘….. যাই হোক তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারের জন্য সেটা বাংলায় অনুবাদ করে পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েদের নিয়ে কার্বন কপি করতে শুরু করেন। বাংলা অনুবাদে তিনি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেছিলেন আমার সঙ্গে আলাপ করে৷ আমার স্ত্রী এতে একটি ছোট্ট অথচ আকাঙ্ক্ষিত শব্দ যোগ করেছিলেন। সেটা হল স্বাধীনতা। ‘

ঘোষণাটি শেষ পর্যন্ত দাড়িয়েছিল এই রকমঃ বাঙালী ভাই বোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন। রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে রাত ১২ টায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন এবং তা পৃথিবীর যে কোন সূত্র থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি…. শেখ মুজিবুর রহমান।

‘…… কোরান তেলওয়াতের পরই আমার স্ত্রী মঞ্জুলার অনুবাদ (ও পরিবর্তিত) বার্তাটি পাঠ করেন জনাব আবুল কাসেম সন্দীপ। ইংরেজী বার্তাটি পাঠ করেন ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম। ফেরার পথে…. শুধু দেখেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ছোট একটি কামরায় নীরবে কি যেন লিখছেন। আমি তাকে বললাম, ‘আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছি। শীঘ্রই কিছু বলুন, দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করুন। ‘ উনি বললেন, ‘আমি তাই লিখছি।’ আমি তাকে বলেছিলামঃ ‘এখন লেখার সময় নয়… যা মুখে আসে তাই বলুন। ‘ (এতে একটা ব্যাপার জানা যায় যে, হান্নান সাহেব কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন।)

বেতার মারফৎ স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ এর লেখক মেজর রফিক বলেছেনঃ যুদ্ধাবস্থা শুরু হবার পর শহরে জনগণ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে আমিও দলবল নিয়ে তাদের সাথে যোগ দিই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হলে মরহুম আবদুল হান্নান ২৬ মার্চ বেলা আড়াইটায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। অনুমিত হয়, যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুলেছিল তারা যে তার আগেই একটি ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন মেজর রফিক তা জানতেন না।

এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তথাকথিত টেলিগ্রামের কপির ভিত্তিতে আবুল কাসেম সন্দীপ স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন বস্তুতঃপক্ষে তাতে স্বাধীনতার কথা ছিল না, ছিল একটা আবেদন। ওটা শেখ সাহেবের পাঠানো হলেও সেটা স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না, ছিল একটি আবেদন মাত্র৷

এখানেই অনেকগুলো প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে (১) ডঃ আনোয়ার টেলিগ্রাম বলে কথিত স্বাধীনতার ঘোষণা বিহীন ও আবেদন সমৃদ্ধ যে চিরকুটটু পেয়েছিলেন সেটা আদৌ কোন টেলিগ্রামের কপি ছিল কিনা আর হলেই বা তার উৎস কি? কে কোথ্বেকে সেটা পাঠিয়েছিল? তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকলেই তিনিই যে পাঠিয়েছিলেন তার প্রমাণ কি? সেই তথাকথিত টেলিগ্রামও যে ডঃ আনোয়ার ও তার পত্নী মঞ্জুলার মতো চট্টগ্রামের কোনো দেশপ্রেমিক বা দেশপ্রেমিকদের কীর্তি নয় এ কথা কে বলতে পারে? জনগণকে স্বাধীনতার লড়াই- এ উদ্ভুদ্ধ করার জন্যই হয়তো তারা সেটা করেছিলেন আর ঐ আবেদনটা শেখ সাহেবের নাম ছাড়া অন্য কারো নামে করলে তা যে মূল্যহীন হবে কে তা না জানত।
(২) ঢাকা থেকে আদৌ যদি কোন ঘোষণা পাঠানো হয়ে থাকে, তাহলে সেটা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে টেলিগ্রাম আকারে পাঠানো হয়েছিল না ওয়ার্লেস মেসেজ আকারে এম আর সিদ্দিকীর কাছে গিয়েছিল।
(৩)সেই তথাকথিত টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেসে কি সুস্পষ্ট ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল?
(৪) মরহুম হান্নান যে ঘোষণাটি কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন বলে বলা হচ্ছে সেটা কি এম আর সিদ্দিকী বর্ণিত সেই ওয়ারলেস মেসেজ, নাকি নিজেই কোনো স্বাধীনতার বাণী তিনি রচনা করেছিলেন আর তিনি কি শেখ মুজিবের নির্দেশেই তা পাঠ করেছিলেন না অন্য কারো অনুরোধে অথবা নিজের দেশপ্রেমের আবেগে?
(৫) শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ চট্টগ্রামে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন কিনা কিংবা বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেস কিংবা অন্য কোন উপায়ে পাঠানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা?

স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যে দূর্জেয় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে এইসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়ার ওপরই তার সমাধান মিলবে।

রাত সাড়ে নয়টার সময় জেনারেল ওসমানী শেখ মুজিবের বাসভবন ত্যাগ করেন এবং দৈনিক বাংলায় ২৬ মার্চ ১৯৭২ – এ প্রকাশিত বেগম মুজিবের সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায় যে, শেখ সাহেবকে রাত সাড়ে বারোটায় গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তার আধঘন্টা আগে অর্থাৎ বারোটার অব্যবহিত পরেই তার বাসভবন ঘেরাও করে অঝোরে গোলাবর্ষণ করে হানাদার বাহিনী।

জেনারেল ওসমানীর কাছে যদিও শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রস্তুত আছে এবং ওরা অস্ত্রধারণ করলেই তিনি ঘোষণাটা দেবেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘোষণাটা চট্টগ্রামে প্রেরণের কোনো ফুরসৎ কি তিনি আদৌ পেয়েছিলেন? পাঠাবার মত পরিবেশ ছিল কি?

জেনারেল ওসমানী চলে যাওয়ার পরও অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মী শেখ সাহেবের বাসভবনে ছিল। এবং তিনি তাদের সামনেই নানাবিধ নির্দেশ দিয়েছেন। এর একটা স্থির চিত্র আমরা পাই ৫ জুলাই সাপ্তাহিক খবর পত্রিকার সত্যবাক লিখিত একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে। তিনি শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগে থেকেই তার বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন এবং তার বিভিন্ন নির্দেশ শুনেছেন বলে দাবি করেছেন।

তিনি লিখেছেনঃ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির উপর গণহত্যা শুরু করার অব্যবহিত পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দান করেন এবং বাংলাদেশের সকল মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এই ঘোষণা প্রদানের অল্প কিছুক্ষণ পরেই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি তার ঘনিষ্ঠতম রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের মারফৎ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ নির্দেশ এবং ‘তোমরা কালবিলম্ব না করে আত্মগোপন কর’ এই সব ঐতিহাসিক নির্দেশ দিয়ে যান।

লেখক আরো বলেছেন, মহান নেতা…. ‘রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করতে’, নেতারা আত্মগোপন করে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন, গো টু হাইডিং আদারওয়াইজ দে উইল কিল ইউ’ – ইত্যাকার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু লেখক চট্টগ্রামে কোন টেলিগ্রাম প্রেরণের নির্দেশ শুনতে পাননি কিংবা ওয়ারলেস মেসেজ পাঠাতে দেখেননি বলেই মনে হয়। কেননা, সেরকম কিছু দেখলে বা শুনলে তিনি অবশ্যই তা তার উল্লেখ করতে ভুলতেন না। অথচ শেখ সাহেব যদি চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেসযোগে কোন বাণী পাঠিয়ে থাকেন তাহলে হিসাব অনুযায়ী ঐ লেখকের উপস্থিত থাকবার সময়ই তা করার কথা।

বেগম মুজিবের সাক্ষাৎকারেও তিনি তার বাসভবনে কোন ওয়ারলেস সেটের উপস্থিতি বা তাতে কোন মেসেজ প্রেরণের কথা বলেননি। আসলে সে প্রশ্নটাই অবান্তর। অথচ শেখ সাহেব যদি রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন ওয়ারলেস মেসেজ চট্টগ্রামে পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সময়ের সীমাবদ্ধতা, পরিবেশের জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ হানাদার বাহিনীর হামলা জনিত বিভীষিকাময় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেটা শুধুমাত্র তার বাসভবনের ওয়ারলেস সেট থাকলেই সম্ভব হত। সুতরাং তিনি ওয়ারলেসে কোন মেসেজ পাঠাতে পারেননি। একই কারণে কোন লোক মারফৎ সেই অবস্থায় বাইরে থেকেও সেটা সম্ভব ছিল না। কেননা, রাত সাড়ে দশটার পর থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্ত এবং মগবাজার ও মহাখালী ওয়ারলেস কেন্দ্র সন্ধার পর থেকে হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বস্তুতঃ রাত এগারোটার পর থেকেই রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্য সকল অংশের তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু সরকারী চ্যানেল গুলো খোলা থাকে ; কিন্তু তা তো ছিল হানাদারদের হাতে। এই অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা বা অন্য কোন মেসেজ শুধু টেলিপ্যাথির মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। ফলতঃ চট্টগ্রামে শেখ সাহেবের পক্ষ থেকে না যেতে পেরেছে কোন টেলিগ্রাম, না যেতে পেরেছে কোন ওয়ারলেস মেসেজ। অন্য দিকে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠানোর অনেক টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। ফ্রিকোয়েন্সী ইত্যাদির অনেক ঘাপলা আছে। ওয়ারলেস সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা সহজেই বুঝতে পারবেন ঢাকা থেকে যদি কোন মেসেজ চট্টগ্রামে পাঠানোও হয় ফ্রিকোয়েন্সী ঘটিক জটিলতার দরুণ চট্টগ্রামে সেটা গ্রহন করা সহজ সাধ্য ব্যাপার নয়।

আরো একটা বিষয় লক্ষণীয়। ডঃ আনোয়ার যে টেলিগ্রামের কপিটি আগ্রাবাদে পেয়েছিলেন তাতে রাজারবাগ ও ই পি আর বাহিনীর ওপর হানাদার বাহিনীর হামলার উল্লেখ ছিল। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, শেখ সাহেব যদি তার স্বাধীনতার ঘোষণা আগেই তৈরী রাখতেন, তাহলেও হানাদার বাহিনীর হামলার ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সন্ত্রাসের মুখে এ কথায় সেই চরম বিভীষিকাময় মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা রাজারবাগ ও ই পি আর এর ওপর হামলার উল্লেখ সংযোজন করা আদৌ সম্ভব ছিল কি? ছিল না।

তাহলে ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নটাই আবার করতে হয়ঃ জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে শেখ সাহেবের কোন টেলিগ্রাম বা এম আর সিদ্দিকীর কাছে কোন ওয়ারলেস মেসেজ পৌছানো সম্ভব হয়েছিল কি? সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এর জবাবটা ইতিবাচক হতে পারে না।

সেক্ষেত্রে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা আবুল কাসেম সন্দীপ কিংবা মরহুম হান্নার কিংবা মেজর জিয়া যেই দিয়ে থাকুক না কেন সেই ঘোষণার উৎসস্থল ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর রোড নয়। এ ব্যাপারে মেজর রফিকের বইতেও নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে।

তিনি তার বইতে লিখেছেনঃ মরহুম হান্নানই প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন৷ কিন্তু সেই ঘোষণাটি ঢাকা থেকে গিয়েছিল কিনা সে প্রশ্নে তিনি কোন উচ্চবাচ্য করেননি। এমনকি মরহুম হান্নান যে তা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাঠ করেছিলেন এমন ধারণাও তার পুস্তকের কোথাও দেয়া নেই ; যদিও পত্রিকান্তরে তার সাক্ষাৎকারের বিবরণে তার উদ্ধৃতি দিয়েই বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মরহুম হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মেজর রফিক সাক্ষাৎকারে এই ধরণের কোন উক্তি করেছেন কিনা সেই সম্পর্কে আমাদের মনে গভীর সংশয় আছে। বরং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার মতে, কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার সনির্বদ্ধ অনুরোধেই মরহুম হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র গিয়েছিলেন। সেখানে তার উপস্থিতির ঘটনাটি ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলীর লেখা থেকেও সমর্থিত হয়৷ পরে তিনি যদি স্বাধীনতার কোন ঘোষণা দিয়েও থাকেন, তাহলে (ওপরে উল্লিখিত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসংশয় বলা যায় যে, সেটা তার নিজেরই রচনা – এম আর সিদ্দিকী বর্ণিত ও ডঃ জাফর কর্তৃক অনূদিত ও শেখ সাহেব প্রেরিত ওয়ারলেস মেসেজ নয়৷

স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত জটিলতায় আপাতঃ দৃষ্টিতে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর হচ্ছে হানাদার বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সালেকের ভাষ্য। তিনি লিখেছেনঃ তিনি রাত বারোটার সময় যখন টিক্কা খানের সঙ্গে ছিলেন তখন তিনি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষীণ আওয়াজ পেয়েছেন। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে সহজেই এই বিভ্রান্তি দূর হবে।

একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, শেখ সাহেবের বাসগৃহে কোন ওয়ারলেস সেট ছিল না। তাহলে কি করে সেই অবিশ্বাস্য কান্ডটা ঘটল? এর জবাবটা খুবই সহজ। টিক্কা খান বা হানাদারদের চোখে শেখ মুজিব ছিলেন দেশদ্রোহী। আর সেই দেশদ্রোহিতার প্রমাণ প্রতিষ্ঠার জন্যই বিগ্রেডিয়ার নির্লজ্জ মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিছেন৷ দ্বিতীয়তঃ বর্বর পাক- বাহিনীকে উস্কানী দেয়ার জন্য ঐ ধরণের মিথ্যা ভাষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলঃ হানাদারদের হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য টিক্কা খানদের একটা মরাল গ্রাউন্ড প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় সেই নিষ্ঠুর ও নৃশংস অত্যাচার জাস্টিফাই করা, তাদের হিসাবে সম্ভব ছিল না। সুতরাং টিক্কা খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঐ ধরণের একটা ওয়ারলেস মেসেজ শোনা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল৷

এই বিগ্রেডিয়ার সালেক (‘৭১ সালে মেজর ছিল) লোকটা ছিল ভীষণ বাঙালী বিদ্বেষী। এবং হিংস্র স্বভাবের এই লোকটা সর্বদাই মুজিব আতংক রোগে ভুগত। ওয়ারলেস মেসেজটা তার সেই ফোবিয়াজনিত। আউটার হ্যালুসিনেশনও হতে পারে।

আরো দুটি বিষয় লক্ষণীয়, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়াও যায় যে, রাত বারোটায় শেখ মুজিব ওয়ারলেসে স্বাধীনতার বাণী ঘোষণা করেছিলেন তাহলে তখন ৩২ নম্বর রোডে যে পরিমাণ গোলাগুলি হচ্ছিল তার গর্জন ভেদ করে শেখ সাহেবের কন্ঠ মেজর সালেকের শোনার কথাও নয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, শেখ সাহেব ওয়ারলেসে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এমন দাবী শেখ সাহেব নিজেও কখনো করেননি, আওয়ামী লীগ মহল থেকে করা হয়নি।

৩২ নং রোডের পরিস্থিতিতে ফিরে আসা যাক। সত্যবাক সেখানকার পরিস্থিতির যে বয়ান দিয়েছেন তাতেও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে একটু খটকা লাগে। তিনি শেখ সাহেবের অনেক উক্তির হুবুহু উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমনঃ তোমরা কাল বিলম্ব ‘না করে’ আত্মগোপন কর, গো টু হাইডিং আদারওয়াইজ দে উইল কিল ইউ’ ইত্যাদি এবং দুই দুইবার উল্লেখ করেছেন যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ স্বাধীনতার ঐ ঘোষণার একটি শব্দও তিনি উদ্ধৃত করেননি, এমনকি স্বাধীনতার বাণীর মোদ্দা বক্তব্যটাও তিনি বিবৃত করেননি৷ কিন্তু অন্যান্য উদ্ধৃতি অপেক্ষা সেটাই কি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নয়? এই কারণেই স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত সত্যবাকের বিবরণ সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া যাচ্ছে না।

আর একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, শেখ সাহেব যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকবেন তাহলে তা চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হোক আর নাই হোক, কেন তা মুজিব নগরস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আট মাসে একবারও প্রচারিত হল না? আমাদের তো মনে হয় তেমন কোন ঘোষণা থাকলে তা প্রতিদিন প্রতিটা অধিবেশনে প্রচারিত হত (উত্তরকালের ‘বজ্রকন্ঠ’ স্মরণীয়) এবং তা হওয়া উচিৎ ছিল৷

কেননা সেই চরম দূর্যোগের দিনে জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে তার বাণীর চাইতে শক্তিশালী আর কোন অস্ত্রই ছিল না। মুজিবনগরে তো সবাই ছিলেন। ২৫ মার্চের রাতে শেখ সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত নেতা ও কর্মীরা সবাই তো মুজিবনগর আলো করে রেখেছিলেন। এরা কেউই দুগ্ধপোষ্য অবোধ শিশু ছিল না বরং অনেকেই ছিল অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক কর্মী। তা সত্ত্বেও এদের কারো কাছেই শেখ সাহেবের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণার কেন কপি ছিল না কারোরই কি তার ভাষা ও বক্তব্য স্মরণ ছিল না? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই নীরবতা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণার অস্তিত্ব সম্পর্কে কি সংশয় সৃষ্টি হয় না?

তার চাইতেও বড় কথা মুজিব নগর সরকার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তাতেও শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, এমনকি কোন উল্লেখও তাতে নেই। কেন?

শেষ করার আগে মেজর রফিকের কথায় ফিরে আসা যাক। তিনি তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন, মরহুম হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে তিনি তার বইতে যে কথা লিখেছেন, শেখ সাহেব বা জেনারেল জিয়া তার প্রতিবাদ করেননি।

এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য এই যে, এই ধরণের প্রতিবাদ আশা করা ঠিক নয়। কেননা, মরহুম হান্নান ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। স্বভাবতই প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ সাহেব তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবেন না। আর জিয়াউর রহমান তখন দেশরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত। চাকরীর শর্ত অনুযায়ী তার কোন প্রকার বিবৃতি দেয়ার অধিকার ছিল না। তাছাড়া গত ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় ডঃ আনোয়ার আলী যখন দাবী করলেন যে আবুল কাসেম সন্দীপই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষক তখনো তো কেউ প্রতিবাদ জানাননি, মেজর রফিকও না।

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি তা হলঃ
(১) শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে পেরেছিলেন কিনা তা এখনো প্রমাণ সাপেক্ষ, যদিও স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রস্তুত ছিল বলেই মনে হয়।

(২) স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা পাঠ করেন বাংলায় আবুল কাসেম সন্দীপ ও ইংরেজীতে আসিকুল ইসলাম।

(৩) মরহুম হান্নান যদি পরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকেন তাহলে সেটা তার নিজের রচিত। সেটা শেখ মুজিব প্রেরিত নয়, তার নির্দেশেও তিনি সেটা পাঠ করেননি।

(৪) ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ওয়ারলেস বা টেলিগ্রাম যোগে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানো হয়েছিল এবং তা চট্টগ্রামে পৌছেছিল এই দাবি প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু যার প্রত্যয়দীপ্ত কন্ঠের স্বাধীনতার ঘোষণা দেশবাসী সুস্পষ্ট ভাবে শুনেছে, যে ঘোষণায় তাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, চিত্ত শিহরিত হয়েছে এবং যে আহবানে জাতি স্বাধীনতার যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়েছে সেই বলিষ্ঠ কন্ঠটি তদানীন্তন মেজর জিয়ার।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি।’…..

***

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1981.07.17-bichitra.pdf” title=”1981.07.17 bichitra”]