স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক “অপরাজেয় বাংলা” র ইতিহাস | ভাস্কর আবদুল্লাহ্ খালিদের নিবেদন
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯
‘সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ – তাড়ানিয়া,
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার।’
ভাস্কর আবদুল্লাহ্ খালিদের নিবেদন
দেখতে কেমন তুমি? কীরকম পোশাক আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জট জাল?
পেছনে দেখতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবর জং ঢোলা
পাজামা- কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা- খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?
দেখতে কেমন তুমি? – অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায়, পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর, পারলে নীলিমা চিরে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার।
– গেরিলা / শামসুর রাহমান
‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঘরে ঘরে ছিল এই নাম – গেরিলা। গেরিলার কোন সঠিক প্রতিকৃতি জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এদেশের মানুষ দেখেছেঃ না, জটাজলধারী নয়, গেরিলা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সন্তান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধের আট বছর পর এই গেরিলার ভাস্কর্য মাথা তুলে দাড়িয়েছে – আমাদের ভালবাসা, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক৷
***
“স্বাধীনতা যুদ্ধে আমি রাইফেল ধরিনি। সে জন্যে বোধহয় এক ধরণের বেদনাবোধ কাজ করে আমার মধ্যে। সে বেদনা বোধ থেকেই এই ভাস্কর্য শুরু করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের জন্য আমার এই ক্ষুদ্র অর্ঘ্য। “- আবেগাপ্লুত গলায় বলেন ভাস্কর আবদুল্লাহ খালেদ। তিনি মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে শহীদদের প্রতি উৎসর্গকৃত একটি ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কোন পাবলিক প্লেসে এর আগে এত বিশাল আকারের ভাস্কর্য নির্মিত হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা অনেকে ভুলে গেলেও খালেদের ভাস্কর্য আমাদের এবং পরবর্তী জেনারেশনকে মনে করিয়ে দেবেঃ ১৯৭১ সনে অনেকে পরবর্তী জেনারেশনের জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎকে বিসর্জন দিয়েছিল।
শিল্পকলার সব শাখার মধ্যে, আমাদের দেশে, ভাস্কর্য সবচেয়ে অবহেলিত। চিত্রকলা চর্চাই শুরু হয়েছে আমাদের এখানে তিরিশ বছর আগে। তাও প্রাথমিক অবস্থায় লড়াই করতে হয়েছে প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এখানে এককভাবে চিত্রকলার উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শিল্পকলার অন্যান্য শাখা – ভাস্কর্য, স্থাপত্যের তেমন বিকাশ হয়নি। এর একটি কারণ অর্থনৈতিক তো বটেই কিন্তু প্রধান কারণ জন্মগত সংস্কার।
এমনিতে ভাস্করের কাজ কঠিন৷ একজন ভাস্করকে হতে হয় পরিশ্রমী এবং ধৈর্যশীল। এবং চিত্রকলায় একটি ছবি আঁকলে যেমন সহজে তার রিটার্ন আশা করা যায়, ভাস্করের বেলায় তা হয় না।
তাছাড়া নানাধিধ সামাজিক কারণে আমাদের এখানে ভাস্কর্য নিয়ে যথেষ্ট চর্চা হয়নি। এবং দুঃখের বিষয় বর্তমান বাংলাদেশে সফল ভাস্করের সংখ্যা তিন-চারজনের বেশী নয়৷
অথচ সংস্কৃতি সেবক থেকে রাজনীতিবিদ সবাই ‘গণ সংস্কৃতি’ নামে একটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ‘গণ সংস্কৃতি ‘ র সংজ্ঞা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, তবে সাধারণভাবে বলতে পারি, সংস্কৃতি চর্চাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন উচ্চ মধ্যবিত্তের হাতে না রেখে তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াই বোধহয় ‘গণ সংস্কৃতি ‘।
কিন্তু যে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর তাদের কাছে ‘সংস্কৃতি ‘ একটি শব্দ বৈ কিছু নয়। সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা বা বোধ নেই। এ বোধ বা সৌন্দর্য সম্পর্কে তাদের ধারণা গড়ে তোলা যেতে পারে অসংখ্য পোস্টার বা ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে পোস্টার একটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্য দিকে ভাস্কর্যের ভূমিকা দ্বিবিধ। এক, সাধারণের মধ্যে সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করা, দুই, শহর সৌন্দর্যকরণ। এই ঢাকা শহর আরো সুন্দর হয়ে উঠতো যদি প্রধান প্রধান চৌরাস্তায় ভাস্কর্য থাকতো। লক্ষ টাকা খরচ করে শাপলা তৈরী করার চেয়ে তারচে’ কম খরচে নিবস্তুক বা ফিগারেটিভ ভাস্কর্য অনেক অর্থবহ। আর তা যদি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাদের ওপর দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে অথবা করেছে স্বাধীনতার যুদ্ধ, সে সব দেশে শহীদদের উদ্দেশ্যে এ ধরণের অনেক স্মৃতিস্তম্ভ আছে৷ এবং সে সব স্মৃতিস্তম্ভ রাতের অন্ধকারে কেউ গায়েব করে দেয় না বা এসবের বিরুদ্ধে মিছিলও বের হয় না।
আবদুল্লাহ খালেদের এই ভাস্কর্য আমাদের দেশের শিল্প চর্চার ইতিহাসে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে পাবলিক প্লেসে এ ধরণের বড় আকারের ভাস্কর্য করা হয়নি। স্বাধীনতার যুদ্ধের পর আব্দুর রাজ্জাক একটি ভাস্কর্য করেছেন বটে কিন্তু তা মনে দাগ কাটে না৷ তাছাড়া যে পদ্ধতিতে এ ভাস্কর্য গড়ে তোলা হয়েছে সে পদ্ধতিতে এ উপমহাদেশে এ ধরণের কাজ বোধহয় প্রথম।
ভাস্কর খালেদ প্রথমে মাটি দিয়ে এর মডেলটি তৈরী করেছিলেন। কিন্তু আর্ট কলেজের রজত জয়ন্তী উৎসবে প্রদর্শনীর সময় সেই মডেলটি ভেঙ্গে যায়। খালেদের তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল, সুযোগ পেলে এটি বড় আকারে করবেন। তাই মডেল ভেঙ্গে যাওয়ায় খানিকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু ১৯৭৩ সনে স্বাধীনতাত্তোর প্রথম ডাকসু খালেদকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের অনুরোধ জানায়। ‘৭৪ সনের মাঝামাঝি খালেদ কাজ শুরু করেন। ভাস্কর্যের তিনটি ফিগারের, মহিলা ফিগারের মডেল হয়েছিলেন হাসিনা আহমদ, মধ্যের ফিগারের জন্যে মডেল দিয়েছিলেন বদরুল আলম এবং রাইফেল হাতে হামিদ মকসুদ।
ভাস্কর্যের ভিতের ব্যাপারে খালেদকে পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থপতি রবিউল। এর ভিত মাটির নীচে চার ফিট, ওপরে সাড়ে পাঁচ ফিট।
ভাস্কর্যের পুরো কাঠামো লোহার রডের। ঢালাই পাথর- কুচি, বালু আর সিমেন্টের। অনুপাত হচ্ছে ২ঃ১। কাঠামোতে ঢালাই করেছেন রাজমিস্ত্রী সাত্তার। পেডেস্টাল থেকে সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি বারো ফুঁট উচু। ছোট মডেল থেকেই তিনি সরাসরি গ্রাফের সাহায্যে বারো ফুটের ভাস্কর্যটি করেছেন। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে সরাসরি আনুপাতিক হার বৃদ্ধি করে নির্মাণ যেখানে উপাদান হচ্ছে সিমেন্ট এবং রড – বোধহয় এই প্রথম। এই সব ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছেন শহীদুল্লাহ্ এসোসিয়েটস – এর স্থপতি শহীদুল্লাহ্।
বিখ্যাত ভারতীয় স্থপতি চিন্তামনি কর ১৯৭৪ সনে খালেদকে এ পদ্ধতিতে কাজ করতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। এবং এর সফলতা সম্পর্কেও সন্দিহান ছিলেন। কারণ সিমেন্টে ঢালাইর পর আসল এবং কঠিন কাজটুকু শুরু। তা হলো ঢালাই কুঁদে ফিগারের সঠিক রূপ দেয়া। সাধারণ ছেনি দিয়ে সে কাজ সম্ভব নয় বলে চিন্তামণির ধারণা ছিল। কারণ এখানে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু খালেদ সেই দুরূহ কাজে সফল হয়েছেন। তিনি বলেন, খালি হাতে ছেনি ধরেছি, গ্লাভসও পরিনি। কারণ প্রতি মুহূর্তে, হাতুড়ির বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে যে যন্ত্রণা পেয়েছি, তা দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছি শহীদের আত্মত্যাগ।
৭৩ সনে ডাকসু এই ভাস্কর্যের জন্যে মাত্র চার হাজার টাকা বাজেট ধরেছিল। পরে খালেদ পঞ্চাশ হাজার টাকার এস্টিমেট দেন। এবং তৎকালীন উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী প্রস্তাব রাখেন সম্পূর্ণ ব্যয়ের অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং বাকী অর্ধেক ডাকসুর বহন করা উচিৎ। কারণ তা না হলে এতে ডাকসুর কোন পার্টিসিপেশন থাকে না। এখন পর্যন্ত খরচ পড়েছে মোট এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার টাকা।
‘৭৪ সনের মাঝামাঝি কাজ শুরু হলেও ‘৭৫ সনের মাঝামাঝি নানা কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফের শুরু হয় এ বছরের গোড়ার দিকে। এবং এ মাসে তা সম্পূর্ণ হলো। খালেদের শিল্পী সহকারী হিসেবে সাহায্য করেছেন বদরুল আলম। এবং অন্যান্য ব্যাপারে সহকারী হিসেবে সাহায্য করেছেন মোঃ হামিদ। শিল্পী খালেদ, এতো বড় একটি কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেননি। তবে এ বছর জানুয়ারী মাস থেকে এ পর্যন্ত তিনি এবং তার সহকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি মাসে পনেরোশ টাকা করে পেয়েছেন।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের শুধু প্রধান শহরগুলিতেই নয়, জেলা শহরগুলিতেও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে এ ধরণের ভাস্কর্য নির্মিত হওয়া দরকার৷ এ যেমন একদিকে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, শিল্প সম্পর্ক বোধ জাগ্রত করবে তেমনি মুক্তি যুদ্ধকেও স্মরণ করিয়ে দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাস্কর্য নির্মাণকালেও যথেষ্ট প্রতিকূলতা পেরুতে হয়েছে৷ সরাসরি অনেক হামলা প্রতিরোধ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই৷ তাই শহরের অন্য অঞ্চল থেকে ভাস্কর্য উধাও হলেও, এর ওপর আর হামলা করতে সাহস করেনি।
– মুনতাসীর মামুন
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1979.12.14-bichitra.pdf” title=”1979.12.14 bichitra”]