সংকটের মুখে পাট শিল্প
সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশের পাটকলগুলো কাচা পাটের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই এ সমস্যাটি প্রকট রূপ নিতে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাট চাষ ব্যাহত হয়। পুরোপুরি ঐ সময় উৎপাদিত পাটের যথাযথ সংগ্রহের ব্যাপারে তদসংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা সক্রিয় না থাকার দরুণ মুক্তি পরবর্তী প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ পাট শিল্প ক্ষেত্রে এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে। তরিঘড়ি করে কাঁচাপাট রপ্তানি না করলে দেশের অভ্যন্তরে মজুদ পাট দিয়ে পাটকলগুলো অন্তত আগামি পাট মওসুম পর্যন্ত চালু রাখা সম্ভব হবে বলে ওয়াকেফহাল মহলের ধারণা। পাট শিল্প ও ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা ইতোমধ্যে বিভিন্ন পথে ২০-২৫ লক্ষ বেল পাট দেশের বাইরে চলে গেছে। দেশের ভেতরে যে পাট জমা আছে, তাও আবার পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে মিল গুলোতে পৌছছে না। যার ফলে কাঁচা পাটের অভাবে ইতোমধ্যে দেশের জাতীয় বৃহত্তম পাটকল চট্টগ্রাম জুট ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিতে বন্ধ হয়ে গেছে। অপরাপর পাটকলগুলোর অবস্থা তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। যন্ত্রাংশের অভাবেও অনেক ক্ষেত্রে মিলের যেসব তঁত বন্ধ হচ্ছে সেগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের সাবেকী উৎসের জন্য দেরি করলে চালু পাটকলগুলোর উৎপাদন আশঙ্কা জনক ভাবে হ্রাস পাবে। অবশ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সাহায্যকারী মিত্র দেশ ভারত থেকে আমাদানীর আনুষ্ঠানিকতার ঝঞ্জাট না পোহায়েও মিলগুলো চালু রাখার মতো সরঞ্জাম সংগ্রহ করা যাবে। মিল পরিচালনা ব্যবস্থার ত্রুটিবিচুত্যিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ে ভুলভ্রান্তি হিসেবে একেবারে উড়িয়ে দেয়া ঠিক নয় বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেছে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি অবলম্বিত না হওয়া পর্যন্ত মিলগুলো সৃষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার জন্য জরুরি ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ আবশ্যক। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ সংস্থানের অভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার মিলগুলোর মজুদ সম্পদ ও পরিসম্পদের দায়ভার নিলেও দায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন নাই। যার ফলে মিলগুলো অর্থ ও জোগানদার সংস্থাগুলো থেকে কোনোরূপ আর্থিক সমর্থনও পাচ্ছেন না। এবং এসব সংস্থা সরকারের সুস্পষ্ট নীতি নির্দেশ না পাওয়াকে নানা প্রকার দ্বিধাদ্বন্দে ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দরুন ও পাটকলগুলো কাঁচামালের সরবরাহ লাভের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে বহুসংখ্যক জলযান ও স্থলযান হানাদারবাহিনীর হাতে বিনষ্ট হয়। বিকল ট্রাকগুলোও মেরামতের অপেক্ষায় পড়ে থাকে। স্বল্পসংখ্যক চালু যানবাহন প্রয়োজনীয় রিলিফ সামগ্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই বাণিজ্যিক পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। পাট ও পাটশিল্প থেকে দেশের সর্বাধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এর পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কম নয়। কর্মক্ষম ৬৩টি পাটকলের তাঁত সংখ্যা হবে ৪০ হাজারেরও বেশি। সরকার এসব সমস্যার আশু কোনো সমাধান না দিলে দেশের বৃহত্তর শিল্প ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎসে বন্ধ্যাত্ব এসে যাবে। ঠেলে দেবে জাতীয় অর্থনীতির এক বিপর্যয়ের মুখে। অধিকাংশ মিল অর্থ সংকটে পড়ে না পারছে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে, না পারছে শ্রমিকদের বেতন জোগাতে। এর পরিণতি হিসেবে ইতোমধ্যে প্রধান প্রধান পাটকল এলাকাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ দানাবেঁধে উঠেছে। অথচ এসব অধিকাংশ মিলের রপ্তানিযোগ্য পাটজাত দ্রব্য পড়ে রয়েছে। মিলের ক্ষমতা অনুযায়ী এসব মজুদ পাটজাত দ্রব্যের পরিমাণ থাকার হিসেবে ধরতে গেলে নিন্মে লক্ষ থেকে উর্ধ্বে দেড় কোটি টাকার অধিক হবে। বর্তমানে বিভিন্ন পাটকলে ৮৮ হাজার ৩৯৯ টন রপ্তানিযোগ্য পাটজাত দ্রব্য পড়ে আছে।
রেফারেন্স: ২৩ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ