“হামলােগ মুক্তি কা সাথ লড়াই করনে নেহী আয়া, উও সেপাই কা কাম হায়” – দখলীকৃত বাংলাদেশে পাঞ্জাবী পুলিশের বিদ্রোহ
(জয়বাংলা প্রতিনিধি) পূর্বাঞ্চলের ১৩০০ মাইল সীমান্তব্যাপী পাক সামরিক জান্তা ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করায় বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে হানাদারদের রক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অথচ তারা নিজেই সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাতে দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়া করে ট্রেনিং দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা অনভিজ্ঞ কিশাের সৈনিক, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও স্থানীয় রাজাকার দালালদের ওপর এই দায়িত্ব ন্যাস্ত করেছে। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবেলা করা তাদের পক্ষে মােটেই সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা পুলিশদের অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রেখে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরাই প্রধানতঃ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। গত জুন মাসের প্রথম পক্ষে একমাত্র ঢাকা শহরের রমনা থানাতেই ৪০টি চীনা রাইফেল জমা পড়েছিল। এই চীনা রাইফেলগুলাে পাঞ্জাবী পুলিশদের ইস্যু করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে চল্লিশজন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হওয়ায় সেই রাইফেলগুলাে পুনরায় রমনা থানায় জমা পড়েছিল। শুধু ঢাকাতেই নয়, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নরসিংদী এবং অন্যান্য এলাকাতেও মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীদের আক্রমণে বহু পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হওয়ায় তাদের মধ্যে ত্রাস ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানী করা পুলিশের মৃত্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও ভীষণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তারা অবিলম্বে দখলীকৃত বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার দাবী জানাচ্ছে। তার ফলে সেখানকার পুলিশ ও সামরিক কর্তারা খুবই বেকায়দায় পড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে গত জুন মাসেই পাঞ্জাবের পুলিশ কর্তা তাদের পুলিশ বাহিনীকে ফিরিয়ে দেবার দাবী জানিয়েছিল। গত জুন মাসেই ঢাকার জয়দেবপুরের একটি কৌতুকজনক ঘটনা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর ভীতি ও বিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায়। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অভ্যন্তরে নিযুক্ত পাঞ্জাবী পুলিশরা মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে স্ব স্ব কর্মস্থল থেকে পালিয়ে জয়দেবপুরের ক্যাম্পে চলে আসে। তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যার যার কর্মস্থলে ফেরৎ পাঠাবার জন্যে সামরিক বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেনকে পাঠানাে হলে পাঞ্জাবী পুলিশরা তাকে ঘেরাও করে বলে; “হামলােগ মুক্তি (মুক্তি বাহিনী) কা সাথ লড়াই করনে নেহি আয়া। উও সেপাহী কা কাম হায়। হামলােগকো পুলিশ কা ডিউটি দো, ডিউটি করে গা।” সর্বত্র এই একই অবস্থা। বরং ভীতি ও অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু প্রয়ােজন অনুপাতে স্থানীয় পুলিশ সংগ্রহ করতে না পারায় এদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না। বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক আইনের খড়গ উচিয়ে জোর করে নতুন নতুন পুলিশ আমদানী করা হচ্ছে। অথচ শুরুতে মাত্র তিন মাসের করারে অস্থায়ীভাবে এদের পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা হয়েছিল। এখন এদের মৃত্যুর কোন কৈফিয়ত দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা থেকে লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রোফের প্রতিনিধি এক খবরে জানিয়েছেন যে, ৬,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের মনােবল ভেঙ্গে পরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাঙালী পুলিশদের শূন্যস্থান দখল করার জন্যে এদের আনা হয়েছিল। গােড়ায় তাদের সেপ্টেম্বরেই স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাে হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখলীকৃত বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। এখন তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এবং অবিলম্বে ফিরে যাবার একটা পাকা তারিখের দাবী জানাচ্ছে। এই ভাবেই একে একে পাক হানাদারদের সকল অবলম্বনই হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘরে বাইরে নাজেহাল হয়ে তাদের এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের মত।
জয়বাংলা (১) ১: ২৮ !
১৯ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯