চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তান দালালদের ঘাটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তান দালালরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন পদস্থ অফিসারের নেতৃত্বে আল বদর, আলশসম ও বেআইনী ঘোষিত জামাতে ইসলামী ও পি, ডি, পি বাহিনী বর্তমানে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় সংগঠিত হচ্ছে। এসব এলাকায় তারা শক্তিশালী ট্রেনিং ক্যাম্পও স্থাপন করেছে বলে জানা গেছে। এ বাহিনী তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় তাদের সহকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সাথে এ বাহিনীর গোপন আঁতাত রয়েছে এবং ভারতের বিদ্রোহী নাগা ও মিজোদের মাধ্যমে তারা আধুনিক মারণাস্ত্র ও রসদ সরবরাহ পাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যেই পাকিস্তানি দালালদের এ সক্রিয়তার একাধিক বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ৪ মার্চ রোমা থানার থানচিবাজার পুলিশ ফাঁড়িটি রাজাকার ও মিজোরা আক্রমণ করে। এতে কমপক্ষে ১১ জন নিহত হয়। এদিকে গত সোমবার প্রকাশ্য দিবালোকে একটি ঠেলা গাড়িতে ওয়ারলেস সেট এবং রাডারের খুচরা অংশ ধরা পড়েছে। এগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে এ ওয়ারলেস সেট এবং রাডারের খুচরা অংশগুলো সম্ভবতঃ কোনো বৈরী দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। আবার গত মঙ্গলবার লাল দিঘির পূর্ব পাড়ে শহরের কেন্দ্র স্থলে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও টহলদার পুলিশের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এতে তিনজন নিহত এবং একজন আহত হয়েছে। লক্ষণীয় স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির লোক গোপন হত্যা, লুটতরাজ ও আইন শৃঙ্খলা সমস্যা সৃষ্টি করে জনগণের মধ্যে হতাশা আনতে প্রয়াসী হচ্ছে। নেতাদের পরিচয় জানা গেছে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন সুলতান হায়াত খান এবং ক্যাপ্টেন সেলিম বেগ আল শামস, আলবদর তথা দক্ষিণপন্থী অপরাপর গোষ্ঠীর সদস্যদের অস্ত্র শিক্ষার তালিম দিচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তানবাহিনীর ক্রাক ডিভিশনের বহু সৈন্য। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আত্মগোপনকারী বিপুল সংখ্যক অবাঙালি এসব ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। খবরে জানা যায় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব হাবিবুর রহমান, পাকিস্তান ক্রনিকেলের মোহাম্মদ হানিফ, জং প্রতিনিধি জনাব মাসওয়ানী ও অধুনালুপ্ত দৈনিক সংগ্রামের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জনাব রব্বানী এসব ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট প্রণয়ণ করেছে। চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান পিডিপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ওরফে নবী চৌধুরী, মুসলিম লীগের আলিমুল্লাহ চৌধুরী এবং জামাতে ইসলামীর প্রায় সকল আত্মগোপনকারী নেতা এখানে অবস্থান করছে। এদের এখনও জেলার বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিকভাবে ঘোরাফেরা করতেও দেখা গেছে। চট্টগ্রাম জেলা আলবদর অপারেশন চীফ এবং দৈনিক আজাদের সহ সম্পাদক ও ওয়াই খালেদ এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর নিজ গ্রাম গহিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম চৌধুরী বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তাদের সমর্থকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং তাদের ঘাটিতে পৌছিয়ে দিচ্ছে। এসব ঘাটিতে ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নেতারা আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইন্দন জোগাচ্ছে। ঘাটি কোথায়? যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন, দিঘী-নালা, মানিকছড়ি, বোয়ালখালী, হুনাইছড়ি প্রতিক্রিয়াশীলচক্র তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের আরাকান, মহেশখালী ও হাতিয়াতেও তাদের আস্তানা রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কতিপয় নির্দিষ্ট অঞ্চলে তারা নিয়মিত ঘুরে বেড়াচ্ছে। কসাই সম্প্রদায় এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ও খাতুনগঞ্জের কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী এদের অর্থ ও আশ্রয় দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। প্রকাশ খাতুনগঞ্জে প্রতি বিপ্লবীদের হাইকমান্ডের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। আর এ সমস্ত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যে সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের মিজো পাহাড় এবং পাবলাখালীতে। জানা গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কতকগুলো পাহাড়ী গুহায় তারা রাডার ওয়ারলেস সেট ও বিমান ধ্বংসী কামান বসিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছে।
সাম্রাজ্যবাদী আঁতাতঃ
দক্ষিণপন্থী এ চক্রান্তের সাথে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সাম্রাজ্যবাদী চক্র কয়েকটি দেশের দূতাবাস, ত্রাণ সংস্থা প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন উপায়ে এদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। এ যোগাযোগের সর্বপ্রধান মাধ্যম হচ্ছে তাবলীগ জামাত। তাবলীগের ছদ্মাবরণে এ দুষ্কৃতকারীর দল আজকাল ঘন ঘন ঢাকা চট্টগ্রাম যাতায়াত করছে। প্রধানতঃ খাতুনগঞ্জেই তারা ক্যাম্পের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, তাবলীগ জামাত স্বাধীনতার পর হঠাৎ করে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আশিটি দলে ভাগ হয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক সফরের গোপন সিদ্ধান্ত নেয়।
রেফারেন্স: ৮ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ