বর্গীমুক্ত টাঙ্গাইলের খবর
(নিজস্ব সংবাদদাতা) শ্যামল বনানীর ছায়াঘেরা টাঙ্গাইল জেলাটি বাংলার অপরূপ রূপ এখানে স্পষ্ট। চারিদিকে সবুজ বৃক্ষরাজী। এখানে সেখানে শালসুন্দরীর মেলা। সব সময় যেন মায়া ঘেরা থাকে। মনে হয়, এ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র লীলা ক্ষেত্র। আজ দিনের বেলায় তিন দফায় বিমান আক্রমণ চালিয়েছে পাক হানাদার দস্যুরা। পথ-ঘা। জনশূন্য। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। কুমুদিনী কলেজের দিকে বেঁকে যাওয়া একটা পিচ ঢালা পথ ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজে আঁৎকে উঠলাম আমি। কিছুদূর এগােতেই দেখি আইয়ুবী আমলের কংক্রিটের পুলটা ধ্বসে পড়েছে। ছয় জন মুক্তিযােদ্ধা রাইফেল হাতে দুই দিক থেকে প্রহরায় রত। একটি ছােটো নৌকায় করে প্রয়ােজন মতাে পারাপার হচ্ছে মুক্তিযােদ্ধারা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের একজন হিসেবে আমাকেও ওপারে নিয়ে গেলাে নৌকোয় করে। আবার পথ চলতে থাকলাম। অদূরেই কুমুদিনী কলেজ। রাতের অন্ধকারেও দেখা যায় কলেজের চকচকে সাদা দেয়াল কিন্তু আশ্চর্য। আর একটা ভাঙ্গা পুল সামনে পড়লাে ।
অর্থাৎ টাঙ্গাইল-ঢাকা রােডের প্রায় সবগুলাে পুলই ডিনামাইট দিয়ে এমনি করে উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। তাছাড়া ময়মনসিংহ-ঢাকা রেল যােগাযােগ ও অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সুতরাং লােক সেনাদের দ্রুত যাতায়াত ও পত্ৰসরবরাহ ব্যবস্থা একেবারেই বিপর্যস্ত বলে মনে হলাে। আর একটু অগ্রসর হয়েই থমকে গেলাম আমি। অপেক্ষাকৃত নীচু একটা জায়গায় অস্ত্র নিয়ে বসে আছে মুক্তিযােদ্ধারা, হয়তােবা এখনাে প্রতীক্ষায়। সামনের কুমুদিনী কলেজ ওদের লক্ষ্যস্থল। ওখানে পাক হানাদার বাহিনীর একটা অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট। আমি শুয়ে পড়লাম একটা ঢিবির আড়ালে। কিছুক্ষণ পরের কথা। মুক্তিযােদ্ধাদের রাইফেল ও হালকা মেশিনগান গর্জে উঠলাে। সময় সময় মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে মর্টার ও কামান দাগানাের আওয়াজ। হানাদার সেনারাও চালালাে পাল্টা আক্রমণ। কিন্তু না, মুক্তি যােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে ওদের ধারণা নেই মােটেই। তাছাড়া এরা যে আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা সম্পূর্ণই আশঙ্কা মুক্ত। এমনি করে প্রায় তিন ঘণ্টা চললাে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ। হানাদার সৈন্যদের গুলির আওয়াজ ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। না, রণক্লান্ত নয়। যুদ্ধের সাধ ওদের মিটে গেছে। ওদের জীবন লীলা শেষ হয়ে গেছে মুক্তিসেনাদের অব্যর্থ বুলেটে। আর যারা তখনাে বেঁচে ছিল, তারা পালিয়েছে অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে। আমি তখন কুমুদিনী কলেজ প্রাঙ্গনে। পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্য মাত্র উকি দিয়েছে। কলেজ শীর্ষে পত পত করে উড়ছিলাে একটা স্বাধীন বাংলার পতাকা। শুধু এখানেই নয়। পাবনা জেলায় রায়গঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ পর্যন্ত আজ স্বগৌরবে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। বীর মুক্তিযােদ্ধারা খেদিয়ে দিয়েছে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে। দীর্ঘ ছয় মাস পর হানাদার সৈন্যদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে টাঙ্গাইলের জনগণ যেন ফিরে পেয়েছে তাদের হারানাে জীবন। আমি কান পেতে শুনছিলাম, টাঙ্গাইলের পথে প্রান্তরে তখন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জয় বাংলা ধ্বনি।
সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৫।
১৮ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯