You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.18 | সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্নিবার অগ্রগতি অব্যাহত - সংগ্রামের নোটবুক

সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্নিবার অগ্রগতি অব্যাহত

(রণাঙ্গন প্রতিনিধি)। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের পাক—দখলীকৃত অঞ্চলসমূহে ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছােট বড় সমস্ত শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ফলে ভাড়াটিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশবাহিনীর মনােবল একেবারেই ভেঙে পড়েছে। সামরিক প্রশাসকরা এখন কিছুতেই আর তাদের শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। সরকারীবেসরকারী অফিস-আদালত এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের উপস্থিতি শতকরা দশভাগে নেমে এসেছে। মতিঝিল, নিউমার্কেট, রমনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে বােমা-গ্রেণেড ও মাইন বিস্ফোরণের ফলে পাক-কর্তৃপক্ষের সাহায্যকারী কর্মচারীদের মনে দারুণ সন্ত্রাস দেখা দিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে জঙ্গীশাহীর দোসরদের মধ্যে এখন শহর ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। বাঙালী মুক্তিযােদ্ধারা এখন আগের চাইতে অনেক বেশি সংহত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। এতকালের গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম আজ বাঙলাদেশের শহরাঞ্চলগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। রাইফেলবন্দুকের বদলে তাদের হাতে এসেছে মর্টার, মেসিনগান ও রকেটসহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। তাদের গানবােট ও মােটর বােটগুলি এখন বিভিন্ন নদীপথে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। খানসেনারা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার ফলে খানসেনারা এখন গ্রামাঞ্চলে হানা দেওয়া বন্ধ করে শহরের শিবিরগুলিতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

কারণ, দেশের শতকরা ৬০ থেকে ৭৫ ভাগ গ্রামাঞ্চল মুক্তিসেনাদের দখলে এসে যাওয়ার পর এখন তারা শহরগুলির উপর আক্রমণ। চালাচ্ছেন। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গণ বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা সবচাইতে ব্যাপক ও তীব্রতা লাভ করেছে উত্তর ও উত্তর পূর্ব রণাঙ্গণে। উত্তরখণ্ডে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা দিনাজপুর জেলার পাঁচগড় ও রাণীসকাইল এলাকা, রংপুর জেলার লালমণির হাট, সৈয়দপুর এবং চিলমারী থানা সম্পূর্ণরূপে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলা মুক্ত হবার ফলে যমুনার পূর্ব তীরবর্তী প্রায় ৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়ে আছে। উত্তরপূর্ব রণাঙ্গণে আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে খান দস্যুরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহে এখনাে পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা খুব সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু সিলেট জেলায় আমাদের কমান্ডােদের আক্রমণে পাকসেনারা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। ছাতক, জয়ন্তিয়াপুর। দিয়াই মৌলভী বাজার তথা উক্ত জেলার সর্বত্র গেরিলা যােদ্ধাদের তৎপরতা এতই তীব্রতা লাভ করেছে যে, পাকচক্র বিমান হামলা চালিয়ে মুখ রক্ষার চেষ্টা পাচ্ছে। তথাপি অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, সিলেট জেলা অচিরেই হানাদার মুক্ত হচ্ছে। 

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গন

পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব রণাঙ্গনে বরাবরই আমাদের গেরিলা যােদ্ধারা মােটামুটি তৎপর ছিলেন। দক্ষিণপূর্ব রণাঙ্গনের ঝিমিয়ে পড়া ভাবটা বর্তমানে বহুলাংশে কেটে গেছে। পূর্ব রণাঙ্গনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনের সংযােগ স্থাপিত হওয়ার ফলে সমগ্র পূর্বাঞ্চলতাে বটেই এমন কি কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাতেও আমাদের মুক্তি যােদ্ধাদের ব্যাপক ও ইব্র তৎপরতা শুরু হয়েছে। পশ্চিম ও পশ্চিম-দক্ষিণ রণাঙ্গন বিগত মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম দিকে অর্থাৎ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ প্রত্যাঘাত ছিল সব চাইতে জোরদার। কিন্তু জুন মাস থেকে অক্টোবর মাস অর্থাৎ সুদীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে এই অঞ্চলে মুক্তিসেনাদের শক্তি ক্ষয় পেতে পেতে প্রায় লয় পাবার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমাদের গেরিলা যােদ্ধারা তাদের পূর্বশক্তি যথেষ্ট পরিমাণ পুনর্সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে তাঁরা নতুনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে নিজেদেরকে সুসংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশাের এবং খুলনা অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দ্রুতগতিতে দেশের মধ্যবর্তী তথা পাবনা, ফরিদপুর ও বরিশালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যােগসূত্র স্থাপিত হচ্ছে। এর ফলে দেশের গভীরতম এলাকায় যে-সব মুক্তিযােদ্ধার দল অন্যান্য দল থেকে বিচ্ছিন্ন ও সরবরাহসূত্র হারিয়ে ফেলে ক্রমে ক্ষয় ও লয় পেয়ে যাচ্ছিল, তা আবা। সঞ্জীবিত হয়ে উঠছে এবং নবােদ্যমে শত্রুবাহিনীর উপর আঘাত হানতে প্রস্তুত হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, বরিশাল জেলার উত্তর এবং ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের যে বিরাট দলটি দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় শত্রুপক্ষের বিপুল চাপের মুখেও কাজ করে যাচ্ছিল, এবার থেকে সেই দুরবস্থারও অবসান ঘটবে। সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বার অগ্রগতি। বর্তমানে শুধু বগুড়া, পাবনার জেলার পূর্ব ও উত্তরাঞ্চল, ফরিদপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা, বরিশাল। জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এলাকা এবং কতিপয় দীপাঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বার অগ্রগতি প্রায় সর্বত্রই অব্যাহত রয়েছে।

সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৫।

১৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯