You dont have javascript enabled! Please enable it!

শেখ মুজিবের নেতা হওয়ার পিছনে নিজের কৃতিত্ব একটুও নেই!
– আমেনা বেগম | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮

জাতীয় দলের আহবায়িকা আমেনা বেগম সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে সিলেট – ২ নির্বাচনী এলাকা হতে। পরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেত্রী হিসেবে পরিগনিত হন। ১৯৬৬ সালের ২৩ জুলাই মনোনীত হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা। এ সময় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ জেলে থাকায় আমেনা বেগমই আওয়ামী লীগ ঘোষিত ৬ – দফা জনগণের মাঝে পরিচিত করেন বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে।

১৯৭০ সালের ২৩ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে মতান্তরের কারণে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। যোগ দান করেন আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগে সিনিয়র সভানেত্রী হিসেবে৷ অলি আহাদ জাতীয় লীগ ত্যাগ করলে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন তিনি। ‘৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পিপিআরের আওতায় আহবায়িকা হিসেবে গঠন করেন নতুন দল জাতীয় দল৷ এখনও তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত রয়েছেন।

——-

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের দুর্দিনে আপনি আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের সুদিনে বের হয়ে এলেন কেন?

উত্তর – ‘৬৯ সালে শেখ মুজিবকে জেল থেকে বের করে আনার পেছনে আমার কি ভূমিকা তা আপনারা জানেন। তার বের হয়ে আসার দুদিন পর চট্টগ্রামথেকে আজিজ সাহেব, হান্নান সাহেবরা তাকে অভিনন্দন জানাতে এলেন। তার মনোভাব দরখে তারা আমাকে জানালেন, ‘আপা আপনার সঙ্গে কথা আছে।’ আমি বললাম, কি কথা? তারা বললেন, ‘আপা, মুজিবকে তো জাতীয় নেতা বানালাম। এখন বলেন কবে আবার তার বিরুদ্ধে লাগতে হবে?’ সত্যিকার ভাবে ইতিমধ্যে মুজিবের চারপাশে যারা এসে জুটেছিল এবং যারা তাকে পরামর্শ দিচ্ছিলো তাদের কাজকর্ম দেখে যারা আওয়ামী লীগকে সত্যিকার ভাবে ভালোবাসতেন, তারা ভাবতে লাগলেন আওয়ামী লীগ কোন পথে চলেছে? তবু আমরা চাইছিলাম তিনি যাতে সঠিক পথে চলতে পারেন সে জন্য চেষ্টা করেছি। আসলে তিনি যে নেতা হয়েছেন, এজন্য তার কৃতিত্ব একটুও নেই। জেলে যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমেনা, আমাকে গ্রেফতার করলে ১০ হাজার লোক নিয়ে জেলখানা ঘেরাও করবে।’ কিন্তু ১০ হাজার কেন আওয়ামী লীগেরও ১০ জন লোক জেলখানার ধারে কাছে যায়নি।

প্রশ্ন – আপনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা কেমন করে হয়েছিলেন?

উত্তর – ‘৬৬ সালের ২৩ জুলাই আমি আওয়ামী লীগের সম্পাদিকা হই। তখন আওয়ামী লীগের যারা জেলের বাইরে ছিলেন তাদের প্রত্যেককে আমরা অনুরোধ করেছি। কিন্তু ভাঙ্গা নৌকা চালানোর লোক পাওয়া যায় নি। ২২ জুলাই রাত্রে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মান্নান, গাজী মোস্তফা, যশোরের মশিউর রহমান সাহেবরা এলেন আমার বাসায়। আলোচনার বিষয় ছিলো কাকে সাধারণ সম্পাদক বানানো যায়। অনেকের নাম আমরা প্রস্তাব করলাম কিন্তু কেউ রাজী হলেন না। শেষ পর্যন্ত যশোরের মশিউর রহমান সাহেব বললেন, “আর যদি কাউকে না পাওয়া যায় তবে আপাকেই সম্পাদিকা বানিয়ে দেব।” রফিকুদ্দিন সাহেব তা’ ধরে বসলেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো ওয়ার্কিং কমিটির সভায় (২৩ জুলাই)কাউকে রাজী করাতে না পারলে আপাকেই সম্পাদিকা করা হবে।

প্রশ্ন – ৬ – দফা কেমন করে সৃষ্টি হয়েছিল?

উত্তর – ৬ দফা এ দেশের কিছু বিজ্ঞলোকের সৃষ্টি। ‘৬৫ সালের যুদ্ধের পর নিরাপত্তাহীনতা থেকে এই দফাগুলো আইয়ুব খানের কাছে পেশ করার কথা ছিল। ন্যাশনাল কনফারেন্সে শেখ মুজিব গিয়ে এটা উপস্থাপন করলেন। যেহেতু এটা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছে সেহেতু এটা বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব হয়ে পড়লো।

প্রশ্ন – ন্যাশনাল কনফারেন্সে ৬ দফা পেশ করার আগে তা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল থেকে বা ওয়ার্কিং কমিটি থেকে কি পাস করিয়ে নেয়া হয়েছিল?

উত্তর – না, হয়নি।

প্রশ্ন – তা’ হলে এটা কেমন করে পেশ করা হলো?

উত্তর – যেহেতু এটা দলের নেতা দিয়ে এসেছেন – তিনি ভুল করুন আর যাই করুন, আমরা বাইরের সমালোচনা এড়ানোর জন্য পরে ১৭, ১৮ মার্চ কাউন্সিল সভায় আমরা এটা পাশ করিয়ে নেই। ন্যাশনাল কাউন্সিল হয়েছিল ১৩ ই মার্চ।

প্রশ্ন – ৬ দফা আসলে কে তৈরী করেন?

উত্তর – আমি যতটুকু শুনেছি, কয়েকজন সিএসপি অফিসার এটা করেছেন।

প্রশ্ন – ৬ দফা আন্দোলন কেমন করে দানা বাঁধলো?

উত্তর – কাউন্সিল সভা হওয়ার পর সিলেট, খুলনা, যশোর, বরিশাল এবং ময়মনসিংহে ক’ টি জনসভা করে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন সাত জন নেতা সহ ৮ মে। তা’ হলে দেখুন এ ব্যাপারে তিনি ক’ মাস ৬ দফার উপর কাজ করেন? মাত্র এক মাস। তার পরে ৬ দফা প্রচার করে একে জনপ্রিয় করার জন্য সমস্ত দায়িত্ব আমাদের উপর এসে পড়ে। এতে আমি এবং তখন যারা আওয়ামী লীগের কাজ করেছেন সবাই মিলে আমরা আন্দোলনটাকে দাঁড় করাই। তখন অবশ্য আওয়ামী অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। ২৩ জুলাই ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ১৬ আগস্ট থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হবে এমন একটা প্রস্তাব নেয়া হল। অবশ্য এটা কেমন করে কার্যকর হবে সে বিষয়ে আমরা তেমন আশাবাদী ছিলাম না। ইতিমধ্যে বুঝতে পারলাম শেখ মুজিব সাহেব আমি সাধারণ সম্পাদিকা হওয়ায় বেশী খুশি হননি। তিনি চাইতেন আমি যেন বেশি কাজ না করি। চট্টগ্রাম থেকে ট্রাংকলে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমি রাজী হলাম। গাজী মোস্তফা এতে শেখ মুজিবের কথা বলে বাঁধা দিলেন। তবু আমি লালদিঘীতে সভা করলাম। ২৬ আগস্ট সভা করলাম ময়মনসিংহে। সেপ্টেম্বরে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমরা একটি ট্যুর প্রোগ্রাম দিলাম দুটি গ্রুপে ১২/১৪ জন নেতার নাম দিয়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে ডাকতে থাকলো। ১ অক্টোবর প্রথম সভা হলো খুলনায়। আমার মনে হয়, ৮০০ থেকে ৯০০ জনসভা, কর্মী সম্মেলন আমি করি। তখন সফর করতে ভীষণ অসুবিধে ছিল। টাকা পয়সা ছিল না, সঙ্গে একটা ছেলেও নিতে পারতাম না। এভাবে চলতে থাকলো। কিছু দিন পর অন্যান্য রাজনীতিকরা আট দফা উথ্বাপন করলেন এবং আমাকে জোর করে ধরলেন তাতে সই করার জন্য। এ সময় শেখ মুজিব একটা দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। আমরা যখন তার কাছে যেতাম তিনি বলতেন, ‘আমেনা ৬ দফা চালিয়ে যাও।’ আবার জহিরুদ্দিন সাহেব, মশিউর রহমান সাহেবকে বলতেন, ‘দেখ না যদি কিছু একটা হয়।’ যাই হোক, তবু শেষ পর্যন্ত ৬ দফা টিকে থাকলো।

প্রশ্ন – আপনি আওয়ামী লীগ থেকে সরে এলেন কেন?

উত্তর – শেখ মুজিবকে যখনই আমি কোন সংশোধন করার চেষ্টা করতাম উনি তখনই আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকাতেন। বলতেন, ‘আমেনা, আমি কথা বললাম আর তুমি আমাকে কনসটিটিউশন দেখাইলা’। যেন তিনিই সংবিধান। একবার কাউকে না জানিয়েই তিনি ঘোষণাপত্র পরিবর্তন করে ফেলেন। তিনি বের হয়ে এসে নিউজপ্রিন্টের ম্যানিফেস্টো ভালো কাগজে ছাপতে গেলেন। এবং ছাপাতে গিয়ে ম্যানিফেস্টোর একটা ধারা, ‘শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের মধ্যে দিয়ে দেশের মুক্তি আসতে পারে বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে’ – যোগ করলেন। ‘স্বাধীন শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমই আওয়ামী লীগের চরম লক্ষ্য। ‘ আমরা কয়েকজন তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। কিন্তু তখন তাকে এ কথা বলার উপায় ছিল না। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন, না শ্রমিকদের ধোঁকা দেয়ার জন্য লিখেছেন। আপনি যদি বিশ্বাসও করেন তা হলে আপনি ওয়ার্কিং কমিটিও মানেন না, কাউন্সিলও মানেন না।’ ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে আমার বাসায় বসে তাকে বলেছিলাম, ‘শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার কথাই যদি বলেন তবে মওলানা ভাসানী সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসেন। ‘ তিনি বলেছিলেন, ‘মওলানা ভাসানীর শোষণহীন এবং আমার শোষণহীন এক নয়।’
আমি বুঝেছিলাম ক্ষমতা দখলই তার একমাত্র উদ্দেশ্য, দেশ কোথায় যাবে না যাবে সে বিষয়ে তিনি কিছুই চিন্তা করেন না। শেষ পর্যন্ত ৩ ডিসেম্বর তার সঙ্গে অনেক তর্ক করে চলে এলাম। তার মুক্তির পর তিনি লন্ডনে গেলেন। আমি লন্ডনে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। সেখানে ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার আলাপ হয়। তার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। লন্ডন থেকে এসে ইয়াহিয়া লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার ঘোষণা করলেন। আমরা আশা করেছিলাম ইয়াহিয়া এক ইউনিট ভেঙ্গে দিয়েছেন, আমাদের স্বায়ত্তশাসনের কথাও কিছু বলবেন। তিনি কিছু বললেন না। শেখ সাহেব বললেন, আমি এটাকে কংগ্রাচুলেট করবো।’ আমি বললাম, তাহলে ইয়াহিয়ার সাথে আপনার সমঝোতা হয়েছে। তারপর তিনি বললেন, পান্জাবীদের সাথে হাত মেলানোর কথা। আমি বললাম, আপনি তাহলে দওলাতানার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করেছেন কিন্তু পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেছেন দেখা করেননি। এসব তর্ক করে আমি চলে আসি।

প্রশ্ন – জাতীয় লীগ থেকে আপনার চলে আসার কারণ কি? আতাউর রহমান খান সাহেবের সঙ্গে আপনার কি মতপার্থক্য হয়েছিল?

উত্তর – আতাউর রহমান খান সাহেব রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য কোন কাজ করতেন না। ধরতে গেলে পাঁচটি বছর তার সঙ্গে বেকার কাটিয়েছি। আমাদের তিনি কোন কাজ করার সুযোগ দিতেন না। সংগঠন করতে না পেরে পি পি আর – এর অধীনে আমরা নতুন দল করলাম। তিনি যখন মুশতাক আহমেদের সঙ্গে চলে যান, আমি তা পছন্দ করিনি। মইনুল হোসেনের বাসায় যখন ২৪ জন বা ২৫ জনকে নিয়ে দল করার বৈঠক হয়েছিল তখনও আমি তাতে সম্মত হইনি। সেখানে মুশতাক আহমেদও ছিলেন। আমার সৌভাগ্য বলেন আর দূর্ভাগ্য বলেন দেশের এখন যারা রাজনৈতিক নেতা আছেন, তাদের কার চরিত্র যে কেমন তা আমার জানতে বাকি নেই। তাই আমি তাতে সম্মত হই নি। আর এজন্যেই আমি জাতীয় দল নাম নিয়ে নতুন দল গঠন করি।

***

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/amena-begun.pdf” title=”amena begun”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!