You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতীয়তাবাদী দল | জিয়ার নতুন দলে যারা | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮

সাক্ষাৎকার

মশিউর রহমান

রেলমন্ত্রী, সদস্য, আহ্বায়ক কমিটি, জাতীয়তাবাদী দল। সাসপেন্ডেড ন্যাপের সভাপতি সদলবলে জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান অংশীদার। বৈচিত্র‍্যময়, নাটকীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ‘বুর্জোয়া রাজনীতিতে এ্যারিস্টোক্র‍্যাট’।

প্রশ্নঃ ন্যাপ ভেঙ্গে জাতীয়তাবাদ দল যোগদান এবং আপবার রাজনৈতিক জীবনের এ সময়কে আপনি কি বলে অভিহিত করবেন?
উওরঃ আমি বলব, শুধু আমার রাজনৈতিক জীবনে নয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে এ সময়টা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনায় সমৃদ্ধ। এর কারণ নিহিত রয়েছে জাতীয়তাবাদী দলে সংযুক্তির মধ্যে। ৭৭ সালের ২৭শে মার্চের ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশনে আমাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। এরপর থেকে ন্যাপ একটা সঠিক রাস্তায় চলার চেষ্টা করেছে। সে রাস্তাটা হলো গণতন্ত্রের। আমরা লক্ষ্য করেছি, গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন মতবাদই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।…. জনগণের জন্যেই অনেক ত্যাগী দেশপ্রেমিক নেতা গণতন্ত্রের রাজনীতি ছেড়ে অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন। শেখ মুজিবের মত একজন নেতা শুধু দেশবরেণ্য ছিলেন না। ১৯৭২ সালে তিনি যখন দেশে ফিরেছিলেন তখন জনগণ যেভাবে তাঁকে গ্রহণ করেছিল আমার মনে হয় অন্য কোন দেশের নেতা তার দেশের জনগণের কাছ থেকে এমন ভালবাসা পাননি। অথচ যেদিন তিনি গণতন্ত্রের পথ থেজে বিচ্যুত হলেন সেদিন শুধু তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটলো না, জীবনেরও অবসান হল। এর থেকে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন চায়। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তাদের ঈমানের অংশ হিসেবেই যেন গ্রহণ করেছে। গণতন্ত্র থেকে দেশ বিচ্যুত জলে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব এই অটল সিদ্ধান্ত ছিলো ন্যাপের এবং আমার। শত বাধা সত্ত্বেও এই পদ্ধতি হিসেবেই ৩রা জুনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য রাজনীতি চালু হয়। এর আগে রাজনীই করার অধিকার থাকলেও প্রকাশ্য রাজনীতির অধিকার ছিল না। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিলের প্রশ্নে সবাই একমত হলেও তা বাতিল করতে পারিনি। অথচ প্রেসিডেন্ট ৩রা জুনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করার কথা বলেছেন। খুব শীগগীরই আপনারা দেখবেন চতুর্থ সংশোধনীসহ আরও কিছু কিছু বিষয় বাতিল ঘোষণা করা হচ্ছে এবং নিশ্চয়ই তা বাতিল করা হবে সংসদীয় নির্বাচনের আগে। ৩রা জুনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংসদ নির্বাচনের সঠিক তারিখের কথাও বলা হয়েছে। ন্যাপের থেকেই ৩রা জুনের নির্বাচন এবং প্রেসিডেন্টকে প্রার্থী করার পরিকল্পনা নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে ন্যাপ সহযোগিতা পেয়েছে জাগদল, ইউপিপি, মুসলিম লীগের অংশ বিশেষ তফসিল জাতি ফেডারেশন এবং লেবার পার্টির কাছ থেকে। কিন্তু এর মূল উদ্যোক্তা ছিলাম আমরা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ঠিক যেমন রেল থেকে ট্রেন লাইনচ্যুত হলে তাকে লাইনে তোলা হয় মূখ্য দায়িত্ব ঠিক তেমনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিরোধিরাও জোট বেঁধেছিল। আমরাও একটা যোগ করেছিলাম। বিরোধীদের জোট না ভাঙ্গলে ন্যাপকে ভাঙ্গতে হতো না। কারণ নির্বাচনে সরাসরি যার যার বক্তব্য নিয়ে জনগণের সামনে যেতাম। জনগণ যেকোন একটা জোটকে সরকার গঠনের জন্য পছন্দ করত। অন্যদল সংসদ পালন করত বিরোধী দলের ভূমিকা। নির্বাচনের পর দেখা গেল ‘গজ’ তার জোটই শুধু ভাঙ্গলো না, প্রত্যেকটা দলও ভাঙ্গতে শুরু করলো। এরপর আমরা দেখলাম আমাদের দেশের জনগণের যুক্তফ্রন্টের যে অভিজ্ঞতা তাতে ফ্রন্ট নিয়ে গেলে জনগণ আমাদের গ্রহণ করবে না। ফলে সংসদের স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। আর এটা হলে ৩রা জুনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে প্রক্রিয়ায় সূত্রপাত হয়েছিলো তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। দেশে পুনরায় ফিরে আসবে সেই কালো দিনগুলো। তাহলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে
দেয়া, সকল শ্রেণীর জনগণকে শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি তা সম্ভব হবে না। উপরিউক্ত এ সুযোগগুলোর জন্য প্রয়োজন হবে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের জন্যেই একদলে সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে মানুষের মনে বিশ্বাস আসবে না এবং জনগণ সঠিক সংবাদ দিতে পারবে না। যদি ধরেও নেয়া হয় যে ন্যাপ বিলুপ্ত করা হয়েছে তাহলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গণতন্ত্রের ইতিহাসে ন্যাপের এই ত্যাগ বিফলে যাবে না এবং আমি মনে করি আমার জীবনের এটা সবচেয়ে বড় অবদান।

প্রশ্নঃ বামপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নতুন রাজনৈতিক দলে ন্যাপের কি দাঁড়াবে? বা এই দলের চরিত্রভগঠনে ন্যাপের ভূমিকা কি হবে?
উওরঃ ন্যাপের প্রত্যেকটি কর্মীর জীবনে রাজনৈতিক ইনপুট রয়েছে। সুতরাং আমরা নিজেদের দুর্বল মনে করি না এবং আমরা সঠিক রাজনীতি দিতে পারব এ ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। নতুন দলকেও আমরা সঠিকভাবে চালাতে পারবো। নতুন দলে যারা যোগদান করেছি তাঁদের কারও দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ নেই। সন্দেহ নেই জনগণের প্রতি এদের ভালোবাসা সম্পর্কেও। এদের সঙ্গে কাজ এবং বিরোধিতা উভয়েই করে দেখেছি। এ জন্য এদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। ৮ কোটি লোকের জীবনের সুখ স্বস্তি আনতে হলে নিম্নস্তরের মানুষদের তুলে আনতে হবে জীবনের মানের দিক দিয়ে। নিম্নতম প্রয়োজন তাঁদের মিটাতে হবে। সুতরাং সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার চেষ্টা এই দল থেকে সম্ভব নয়। কাজেই এ দল প্রগতিশীল রাজনীতি ও অর্থনীতি দিতে বাধ্য। বাধ্য হবে জনগণকে উৎপাদনের অংশ দিতে। তা সমাজতন্ত্র, ওয়েলফেয়ার বা সামাজিক ন্যায় বিচার যেভাবেই দিন না কেন দিতে হবে।

প্রশ্নঃ নতুন দলে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং আপনি এই দুই ব্যক্তিত্বের অবস্থান কেমন করে সম্ভব হবে?
উওরঃ আমার বয়স হয়েছে। ব্যক্তিত্বের ঝগড়া করার দিন আমার চলে গেছে। ব্যক্তিগত ঘটনাকে দেশের বা জনগণের চেয়ে বড় করে দেখার অবকাশ নেই। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ব্যক্তিগত স্বার্থে কোন্দল করার ইচ্ছেও আমার নেই। তাছাড়া আমার ত তবু কিছু পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে যদিও ঢাকা শহরে কোন বাড়ি নেই। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়ার ত তাও নেই। কাজেই তাঁকে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। এই বয়সে ভবিষ্যতের পুত্র-পৌত্রদের জন্য যদি একজন নেতা তৈরী করে দিতে পারি তবে সেটাই হবে সাফল্য।

প্রশ্নঃ আপনারা কি প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয়তার অংশীদারিত্ব নিতে তাঁর সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন না?
উওরঃ তাঁর জনপ্রিয়তা কত তা আগে জানতাম না। ফ্রন্টের প্রার্থী হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা কত তা জানা গেল। তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর সঙ্গে আমরা যাইনি। গিয়েছিলাম তাঁকে জনপ্রিয় করব বলে।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আপনি বলেছিলেন, নির্বাচিত না হয়ে সরকারী পদ নেবেন না। আপনার মন্ত্রীত্ব গ্রহণ কি তার বরখেলাফ নয়?
উওরঃ নির্বাচিত না হয়ে আমার সরকারে যোগদান ওয়াদার বরখেলাফ। এমন একটা অবস্থার মধ্যে আমি পড়েছিলাম সামগ্রিকভাবে চিন্তা করে আমাকে আসতে হয়েছে। এবারেই প্রথম আমি আমার জীবনে জনসাধারণের সামনে দেয়া ওয়াদার বরখেলাফ করেছি। ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে ওয়াদার বরখেলাফ করে আমি ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করেছি না গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের প্রক্রিয়ার কাজে আত্ননিয়োগ করার দায়িত্ব নিয়েছি। তবে যাই হোক, আমার প্রথম ওয়াদাভঙ্গের জন্য আমি আল্লাহর কাছে, জনগণের কাছে ক্ষমা চাই।

প্রশ্নঃ নীতির চেয়ে বৃহদাকার দল গঠনের প্রতিই আপনার আগ্রহ বেশী দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কি?
উওরঃ প্রত্যেক পার্টির দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদী দুটো লক্ষ্য থাকে। ডিসেম্বরের দিকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ জন্যে একটা স্বল্পমেয়াদী আয়োজন দরকার। প্রথমতঃ সবাই মিলে পার্টিকে ঘোষণা করার আয়োজন করা হলো। অস্বীকার করা যায় না এটা আয়োজন, এটা মেরুকরণ নয়। কিছু ভাল লোক মিলে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। পরে দেখা যাবে একটা রাজনৈতিক মতামত বের হয়ে আসছে।

প্রশ্নঃ নতুন দলে আর কারা এলে আপনি খুশী হতেন?
উওরঃ কাজী জাফর এলে আমি অত্যন্ত খুশি হব। এ ব্যাপারে আমি এখনও আশা ছাড়িনি। ন্যাপের যারা আমাদের সঙ্গে আসেনি তাঁরা আসলে আরো ভাল হয়। তাদের সংখ্যাকেও আমি ছোট করে দেখছি না। কারণ ‘ক্ষুদ্র যাহা তুচ্ছ তাহা নয়’ একথা আমি বিশ্বাস করি। আমি মনে করি তাঁরা বুঝবেন।

প্রশ্নঃ কাজী জাফর ন্যাপের অন্য গ্রুপ নিয়ে নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদী দলের ফ্রন্ট গঠনের কোন সম্ভাব্য রয়েছে কি? ন্যাপের সহযোগে ফ্রন্ট গঠিত হলে আপনার কি রাজনৈতিক পরাজয় হবে না?
উওরঃ রাজনীতিতে কোনটাই শেষ কথা নয়। অবস্থার বিবেচনায় অনেক কিছুই করতে হয়। তবে রাজনীতিতে যারা সঙ্গে থাকেন না তাদের সম্পর্কেও একটা বিশ্লেষণ থাকে। বিশ্লেষণ বন্ধু ও শত্রুর। এরা আমাদের সঙ্গে না থাকলেও এরা শত্রু বিশ্লেষণে পড়ে না। ফ্রন্ট না হলেও নয়। সংসদের প্রত্যেকটি আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট। সে ক্ষেত্রে তাঁরা যদি সংসদের আসন দাবী না করে ফ্রন্টে আসেন তবে ফ্রন্ট হতে পারে। সংসদের আসন নিয়ে ফ্রন্ট করলে তাদের স্ট্যান্ডটা সঠিক মনে হবে তবে রাজনীতিটা সঠিক হবে না। আমার মনে হয় সে সম্ভাবনাও নেই।

প্রশ্নঃ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিরি সম্পর্কে বলুন?
উওরঃ সুস্থ।

প্রশ্নঃ নির্বাচনের পরে কি প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয়তা একই রকম আছে?
উওরঃ নির্বাচন এসেছিল দীর্ঘদিন পর। নির্বাচনের উচ্ছ্বাস ছিল বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত। ধীরে ধীরে উচ্ছ্বাস যত গভীর হচ্ছে স্রোতও তত মন্দা হচ্ছে এবং এটাই স্বাভাবিক।

প্রশ্নঃ আপনাদের শক্তিশালী বিরোধী দল কোনটি?
উওরঃ এখনও তেমন কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। আমি মনে করি নির্বাচনের আগে তাঁদের সকলের মধ্যে নতুন চেতনা আসবে। তাঁদের নতুন মেরুকরণ ঘটবে। নতুন করে জোট বাঁধবে। এই মুহূর্তে বিশেষভাবে বলা কঠিন।

প্রশ্নঃ ন্যাপ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবী করেছে। নির্বাচনে ন্যাপ আসলে কত ভাগ আসন দাবী করছে?
উওরঃ ন্যাপ ঠিক কোন আনুপাতিক হার দাবী করেনি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে একটা সংক্্ষিপ্তকরণকে ঠেকানোর জন্য এ প্রশ্নটা উত্থাপন করেছিলাম। যেখানে উত্থাপন করস হয়েছিলো সেখানে আমাদেরকে আশ্বাস্তও করা হয়েছিল। ৭৬ জনের কমিটি দেখে অন্ততঃ তা বলা যায়। ঐ কমিটির ব্যাপারে যদিও আমি সম্পূর্ণ সুখী নই তবু মনে হয় যতদূর সম্ভব ভাল কমিটিই হয়েছে।

প্রশ্নঃ বিচিত্রার মাধ্যমে ন্যাপের বিচ্ছিন্ন অংশের প্রতি আপনি কোন বাণী দেবেন কি?
উওরঃ আমি কাউন্সিলে তাদের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি তাদের বলেছি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা আপনারা মানুন। কিন্তু তারা বলছেন না এটা নীতির ব্যাপার বলে আমরা ভিন্নমত পোষণ করি। আমি এখনও তাঁদের আহ্বান জানাই আমার সঙ্গে আসুন। আমি প্রমাণ করব যে আমার রাজনীতি সঠিক।

প্রশ্নঃ তাদের মনোভাবকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?
উত্তরঃ তারা আমার সঙ্গে ছিলেন। আমি জানি তাঁরা খারাপ লোক নন। কিন্তু রাজনীতি তাঁদের সঠিক নয়। এর পিছনে তাদের পার্টির গোড়ামি এবং একটা আশঙ্কা কাজ করছে। আমিতো তাঁদের বলতে পারি যে ‘কেনরে তোর দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়— ওপারে তোর ভরসা যত এপারে তোর ভয়।’

জামালউদ্দিন আহমদ

শিল্প মন্ত্রী, সদস্য আহ্বায়ক কমিটি, জাতীয়তাবাদী দল। অরাজনৈতিক পরিচয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে জাগদলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

প্রশ্নঃ জাগদল সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নবগঠিত দলে যোগদান করবে। এই নয়া দল গঠনকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নতুন দল গঠনকে বুখতে হলে বছরের শুরু থেকে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাকে অনুধাবন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার শুরু থেকে সমগ্র পর্যায়গুলো আমরা লক্ষ্য করেছি। উল্লেখযোগ্য পর্যায়গুলো হচ্ছে ১৫ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের ফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা, জাগদলের জন্মলাভ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, ফ্রন্টের জন্মলাভ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং আলাপ-আলোচনা শেষে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন। এই পর্যায়গুলো একটি যৌক্তিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন অংশ। যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সমমনা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার একটি ব্যাপক ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ার চিন্তা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র প্রক্রিয়াটির মধ্যে নতুন দল গঠন হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়। এগুলোকে একই সাথে দেখতে হবে। মাঝখান থেকে কোন একটি বিচ্ছিন্ন করে দেখলে প্রক্রিয়াটিকে বোঝা যাবে না। এই দল গঠন যে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত তা নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাতীয়তাবাদী কর্মসূচী, জনগণের গণতন্ত্র, উৎপাদনের রাজনীতি, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্তি থেকেই বোঝা যায়। আশা করা যায় নতুন রাজনৈতিক দল সমগ্র প্রক্রিয়াটিকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রশ্নঃ জাগদলের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন দল গঠন করেছেন— এ প্রেক্ষিতে আপনার মত কি?
উওরঃ আমি এটা বিশ্বাস করি না। প্রেসিডেন্টের ১৫ই ডিসেম্বরের ঘোষণার পর প্রেসিডেন্টের অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট জাগদল নিজেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা সবাই তখন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই। এবং দেশ জুড়ে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আমরা চেষ্টা চালাই। এতে জাগদল জনগণের কাছে পরিচিত হতে থাকে। জনগণ জাগদলকে গ্রহণ করে। আমার মনে হয় এই ব্যাপক পরিচিত এবং বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলকে একটি ব্যাপকভিত্তিক দলে রূপান্তরিত করা কষ্টকর ভেবেই প্রেসিডেন্ট নতুন দল গঠন করেছেন। আর মূলকথা হচ্ছে জাগদালে কোন বিভেদ নেই। বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের সব নেতা সব সময় একই কথা নাও বলতে পারেন। ভিন্নমত থাকা অস্বাভাবিক নয়।

প্রশ্নঃ জনগণ কিভাবে নয়াদলকে গ্রহণ করবে এবমগ কোন শ্রেণীর লোক জাগদলে যোগ দেবে বলে আপনি মনে করেন?
উওরঃ জনগণ কিভাবে নতুন দলকে গ্রহণ করবে এর জন্য আমাদের দেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা দরকার। আমাদের দেশের রাজনীতির তিনটি মৌলিক ধারা রয়েছে। বাম, ডান ও মধ্য। আমার অভিজ্ঞতা অনুসারে এদেশের জনগণ ডান এবং বামপন্থী রাজনীতি গ্রহণ করেনি। জনগণ চায় মধ্যপন্থী রাজনীতি। এদেশের জনগণ চায় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, সামাজিক ন্যায় বিচারে বিশ্বাসী, জনগণের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনগণের ঐক্যে বিশ্বাসী রাজনৈতিক সংগঠন। জনগণের এ ইচ্ছার প্রতিফলন জাগদলের ঘোষণাপত্রে ঘটেছিল। আমার বিশ্লেষণে নতুন রাজনৈতিক দলে মধ্যপন্থীরা যোগ দেবে এবং ঘোষণাপত্রে তাঁদের সে আকাঙ্খারই প্রতিফলন ঘটেছে। তাই আমার বিশ্বাস, জনগণ এ দলকে নিজেদের সংগঠন হিসেবেই গ্রহণ করবে। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য কোন রাজনৈতিক দল শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকেন না। প্রয়োজনে ও সংকটকালে জাতিকে দিক নির্দেশ করেন মাত্র। এ জন্যে বুদ্ধিজীবীরা নতুন দলে যোগ দেবেন এমন দাবী আমি করবো না।

প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন ব্যাপক ভিত্তিক দল গঠন করার লক্ষ্যেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে। জাতীয়তাব্দাঈ ফ্রন্ট কি এ জন্য যথেষ্ট ছিল না?
উওরঃ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টই যথেষ্ট ছিল কিনা তা বিচার করতে হবে ফ্রন্টের অঙ্গদলগুলোর ভূমিকার সাহায্যে ফ্রন্টের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে। আমরা দেখেছি একমাত্র জাগদল ছাড়া অন্য সব দলই নিজেদের পরিচিত করা এবং নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের জন্য ফ্রন্টকে ব্যবহার করেছে। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পক্ষে ছাপানো সকল পোষ্টারেই ছিল ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গদলগুলোর নাম। কেবল জাগদলের পোষ্টারেই জাগদলের নাম ছিল না। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট যে যথেষ্ট ছিল না তা এতেই প্রমাণিত হয়।
এছাড়াও ফ্রন্ট যথেষ্ট ছিল না দু’টি কারণে। প্রথমতঃ নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ফ্রন্ট গঠিত হওয়ায় অঙ্গদলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতামতের চিন্তার ধ্যান ধারণার আদান-প্রদান হয়নি। দ্বিতীয়তঃ ফ্রন্টকে ভিত্তি করে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যেত কিনা এটাই একটা প্রশ্ন। ফ্রন্ট গঠিত হয় সীমিত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য। কাজ শেষ হয়ে গেলে এর উপযোগিতা থাকে না। আর তখনই বিভিন্ন দলের ভিন্নমতগুলো প্রকাশ পায়। এ কারণেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ফ্রন্ট সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি।

প্রশ্নঃ জাগদলের আহ্বায়ক বিচারপতি সাত্তার একবার বলেছিলেন, জাগদল ‘নয়াদলে যোগ দেবে না। কিন্তু দেখা গেল জাগদল নতুন দলে যোগ দিয়েছে। তবে কি বিচারপতি রাজনৈতিক দর কষাকষির জন্য একথা বলেছিলেন?
উওরঃ জাগদল নয়াদলে যাবে না বিচারপতি সাত্তার একথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন, জাগদল বিলুপ্ত হবে না। এটা দরকষাকষির জন্য নয়। জাগদল প্রেসিডেন্ট জিয়ার অনুপ্রেরণায় গঠিত হয়েছিল তাই আমরা চেষ্টা করেছিলাম প্রেসিডেন্ট জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরে মনে করলাম এ দায়িত্ব আমাদের চেয়ে বেশি ন্যস্ত প্রেসিডেন্টের ওপর। কারণ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি বা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ নির্মাণের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট। ফ্রন্ট বা জাগদল নয়। এ কারণেই প্রেসিডেন্টের গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে করতে পেরে আমরা নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

প্রশ্নঃ দেশের রাজনীতিতে আমরা দেখেছি একের পর এক ভাঙ্গন। নয়াদলে যোগদানকে কেন্দ্র করে ফ্রন্টের অঙ্গদলগুলোর মধ্যেও ভাঙ্গন স্পষ্ট। এমনকি জাগদলেও রয়েছে অন্তর্বিরোধ। এ প্রেক্ষিতে নয়াদল কি ঐক্যের বদলে বিভেদই ডেকে আনবে না?
উওরঃ না। কারন ভাঙ্গন হচ্ছে পুরোন দলগুলোতে। মনে হয় যে মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়ে সে দলগুলো গঠিত হয়েছিল সে লক্ষ্যে দলগুলো পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক আও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতেও দল ভেঙ্গে যাচ্ছে। জাগদলে কোন অন্তর্বিরোধ নেই। যেটুকু আছে তাও ব্যক্তিতেই সীমাবদ্ধ। রাজনীতিতে নয়। ‘ইট ওয়াজ মুভ এ কোর্সেন অব ইন্ডিভিজুয়াল, নট দ্যা আইডলজী। ইট ওয়াজ এ ফিকশান নট এ রিয়াল। আর নয়াদল গঠন করে বিভেদ ডেকে আনা তাও সঠিক নয়। যারা নয়াদল গঠনের বিরোধিতা করছেন তারাও ঐক্যবিরোধী নন। এটা একটা স্বাভাবিক মানসিক দিক ( নরমাল হিউম্যান সাইকোলজী)। কারণ সার্বিক সংযুক্তি সবাই চায় না। বিশেষ করে পুরাতন দলগুলো। সেদিক থেকে তাঁরা ঐক্যের বিপক্ষে নন।

প্রশ্নঃ আপনি যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বললেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার নতুন রাজনৈতিক দল গঠন কি তার শেষ পর্যায়?
উওরঃ আশা করবো এটাই শেষ পর্যায়। আরও নতুন দল গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। তবে মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

কাজী জাফর আহমেদ

শিক্ষামন্ত্রী, সাধারণ সম্পাদক, ইউপিপি, ৬২ সালের রাজনীতি থেকে অভ্যুদয়, বামপন্থী শ্রমিক নেতা হিসাবে বিকশিত। চমক লাগানো বাগ্মী, গতিশীল সংগঠক। রাজনৈতিক মঞ্চে হিসেবী পদসঞ্চার অগ্রসরমাণ। ফ্রন্টে ছিলেন। দলে যাচ্ছে না।

প্রশ্নঃ ফ্রন্টে যোগ দিয়ে এবং নতুন দলে যোগ না দিয়ে আপনি প্রতিবারই কর্মী হারাচ্ছেন। এ রাজনীতিতে আপনি কতটুকু লাভবান?
উওরঃ কর্মী কথাটা আপনার প্রত্যাহার করা উচিত। আমি কোন কর্মী হারাইনি। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগদান করে কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আর এখন শুধুনাত্র একজন ব্যক্তি।
বিশেষকে আমরা হারিয়েছি। বরং বলা যায় কর্মীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আসলে সবকিছু দেখতে হবে জনগণের দৃষ্টিকোণ থেক্ব। জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন আমি ফ্রন্টে যোগদান করতাম কর্মসূচীর ভিত্তিতে এবং যে রাজনীতির ভিত্তিতে সে রাজনীতি এবং কর্মসূচী জনগণ দ্বারা গৃহীত হয়েছে কিনা সেটাও প্রশ্ন। বিজ্ঞান ভিত্তিক রাজনীতির শিক্ষা একই সময় দু’টি প্রধান দ্বন্দ্ব থাকে না; একই সময় দুটো প্রধান শত্রুও থাকে না এভং একই সময় দুইয়ের চাইতে তিনটি রাজনৈতিক স্রোতধারা প্রধান হয়ে ওঠে না। এই ভিত্তিতে আওয়ামী বাকশালীদের যদি আমি প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করি তাহলে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, কিছু কিছু মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যারা আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে ফ্রন্ট করা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ছিল। এবং জনগণ সেটা গ্রহণ করেছে। জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম বিচার-বিবেচনা করতে হবে। সেই দিক থেকে আজকে আমি দু’একজন ব্যক্তিবিশেষকে হারিয়েছি। কর্মীদের আমি হারাবো না। কারণ কর্মীরা যেই জনগণ থেকে সৃষ্টি হন সেই জনগণকে আমি অনেক বেশী করে পাচ্ছি। সুতরাং আমার সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রমকে দু’একজন নেতা বা ব্যক্তিবিশেষ ত্যাগ করলেন কি করলেন না আমাকে ভালবাসলেন কি বাসলেন না সেদিক থেকে বিচার করবেন না। তাকে বিচার করতে হবে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

প্রশ্নঃ ফ্রন্ট এবং নয়াদল ঐক্যের মূল প্রেসিডেন্ট জিয়া। সেখানে বিরোধ কিসের?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়া একই ব্যক্তি আছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সাধারণতঃ রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যক্তির পরিচয় ভাস্বর হয়ে ওঠে তার রাজনৈতিক কার্যক্রনের মধ্য সিয়ে। তাই প্রেসিডেন্ট জিয়া যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের আহ্বান জানিয়েছিলেন ব্যক্তি হিসাবে তিনি একই থাকলেও তাঁর রাজনোইতিক কার্যক্রমের সেই ধারাবাহিকতা আছে কিনা সে প্রশ্নের জবাব ইতিহাস দেবে। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে; প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের— যে ফ্রন্টের প্রার্থী তিনি ছিকেন তাকে চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল৷ তা চালয়ে গেলে একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের বিভিন্ন শরিকদল ও ব্যক্তিদের মধ্যে যদি চিন্তাধারার এবং কাজের একটি ঐক্যবোধ সৃষ্টি হত তাহলে সমস্ত বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নতর হত৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাধারার অনুসারীদের সমন্বয়ে ফ্রন্ট হতে পারে কিন্তু ভিন্নমুখী চিন্তাধারা এমনকি বিপরীত ধর্মী চিন্তাধারার ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনৈতিক দল হয় কিনা, তার জবাব আমাদের ইতিহাস থেকেই নিতে হবে। সে জন্যে আমাদের তত্ত্ব জানতে হবে। আসলে তা হয় না।

প্রশ্নঃ ফ্রন্ট কি একটি চলন্ত বাস যার গতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে আপনি কেটে পড়েছেন?
উওরঃ উপমাটা চমৎকার। বাস যেমনি চলে তেমনি খাদেও পড়ে। চলাটা যদি গতি হয় তবে উল্টে পড়ে থাকাটা যতি। যেখানে হঠাৎ মাঝপথে যতি টানতে হয় সেখানে গতি মানে প্রগতি নয়। সেদিক থেকে দেখতে হবে আমি তাল মিলিয়ে চলতে পারছি কিনা। অথবা আপনি যে বাসটির কথা বলছেন সে বাসটা মাঝপথে বিকল হবে কিনা, খাদে উলটে পড়ে থাকবে কি না তাও ভাবতে হবে। বাসটির কলকব্জা, গঠন প্রণালী এবং তার পরিচালক এসব না দেখে যিনি বাসটিকে গতির প্রতীক ধরতে চাইবেন তিনি গন্তব্যস্থলের মাঝপথেই আটকে থাকতে পারেন। আর আটকে পড়লেও হয়ত চলে। কিন্তু খাদে পড়লেই মুশকিল।

প্রশ্নঃ আপনি কিছুক্ষণ আগে বললেন প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিকভাবে একই ব্যক্তি হলেও তার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা নেই। কেন?
উওরঃ আমি তা বলিনিম বলেছি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করতে গিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক কার্যক্রমের শুরু করেছিলেন তা অত্যন্ত সঠিক ছিল। ইতিহাস ইতিমধ্যেই তার রায় দিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর এই কার্যক্রম অর্থাৎ একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না যেয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে তার নিজস্ব গতিধারায় উদ্ভাবিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না করে উপর থেকে বিভিন্নমুখী, এমনকি কোথাও বিপরীতমুখী চিন্তাধারার সমাহার ঘটিয়ে যে পার্টি করতে চাচ্ছেন— এই বিশেষ রাজনৈতিক কার্যক্রমটি সঠিক হচ্ছে কিনা তা ভাববার বিষয়। এটাতো কোন নীতিগত ব্যাপার নয়। কৌশলগত ব্যাপার। এদিক দিয়ে এই বিশেষ রাজনৈতিক কৌশলগত লাইনটি সঠিক না বেঠিক তা ইতিহাসই রায় দেবে।

প্রশ্নঃ বিচিত্রার সঙ্গে অন্য এক সাক্ষাৎকারে আপনি গণতান্ত্রিক কনভেনশনের কথা বলেছিলেন। গণতান্ত্রিক কনভেনশনের মধ্য দিয়ে নয়াদল গঠিত হলে তাতে যোগ দিতেন কিনা?
উওরঃ সেখানে একটা রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা বলেছি। রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলে আমরা পার্টি বা অন্য অনেকগুলো পার্টি একত্রিত হয়ে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের গঠন হয়তো সম্ভব হতে পারতো। আমি বলতে চেয়েছি একটি নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে একমত হয়ে সে ধরনের ব্যক্তিরা যদি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কাজ করে যান তাহলে তাঁদের মধ্যে চিন্তা এবং কাজের ঐক্যবোধ থেকে তাঁরা ভাবয়ে পারেন শুধু এই নিম্নতম ভিত্তিতে নয়— ভিত্তিটাকে আরও প্রশস্ত করতে হবে। এবং পরে একটা পার্টিও হতে পারে। আপনি লক্ষ্য করেছেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে এ ব্যাপারটিই হলো না। এখন আবার বলা হচ্ছে– যেখানে নিম্নতম ভিত্তিতে হলো না সেখানে নাকি বৃহত্তর ভিত্তিতে হবে। তবে এটা ঠিক, যে প্রক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী দল হলো তা সংক্্ষিপ্ত প্রক্রিয়া। অন্ততঃ যে প্রক্রিয়ায় হলো তার চাইতে গণতান্ত্রিক কনভেনশনে বসে সবাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঘোষিত ম্যানিফেষ্টো যদি সেখানে গৃহীত হতো— অন্ততঃ যতটুকু অবৈজ্ঞানিক হয়েছে ততটুকু অবৈজ্ঞানিক হতো না।

প্রশ্নঃ আপনার রাজনীতিতে আপনার বর্তমান সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক? আপনার মন্ত্রীত্বে আসীন থাকা ও বর্তমান সিদ্ধান্ত পরস্পর বিরোধী নয় কি?
উওরঃ আমার আগাগোড়া একটা সঙ্গতি আছে। আমিতো ফ্রন্টে যোগদান করেছি জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে। এবং কেন করেছি তার বৈজ্ঞানিক যুক্তিও দিয়েছি। আজকে জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করা উচিত নত তাও বললাম। মন্ত্রী পরিষদে যোগদানকালে যে শপথ নিয়েছিলাম একবার আনুষ্ঠানিকচাবে একবার সাংবাদিক সম্মেলন করে যে আমি দেশ ও জাতির প্রতি অনুগত থাকবো এবং জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে প্রতিনিধিত্ব করবো আমি আমার সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক, আমার বিবেকের প্রতি সততা রেখে কাজ করে যাচ্ছি।আমার কোন ত্রুটি-বিচ্যুতু হলে আপনারা এবং জনগণ আমার সমালোচনা করবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার এই আত্নপ্রত্যয় আছে যে আমি সঠিক পথেই আছি। স্ববিরোধিতার প্রশ্নে বলবো মোটেই মা। আমি মন্ত্রী হয়েছিলাম রাজনৈতিক প্রোগ্রামের ভিত্তিতে আমি মন্ত্রী হয়েছি আমার পার্টির পক্ষ থেকে এবং ফ্রন্টে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যের ক্ষমতাবলে। কাজেই আমার বর্তমান স্ট্যান্ড এবং মন্ত্রীপদের মধ্যে কোন বিরোধিতা নেই। বরং যারা আজকে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রতি রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবস অনুগিত থাকার কথা বলেছিলেন সেই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে না চালিয়ে আর একটি প্রক্রিয়ায় চলে গেলেন, তাদের স্ববিরোধীতা আছে কিনা সে সম্পর্কে তাঁদের ভাবতে হবে। কিন্তু আমরা সঙ্গতিপূর্ণভাবেই চলেছি।

প্রশ্নঃ নির্বাচনের পর ফ্রন্টের কোন কর্মসূচী নেই কেন?
উওরঃ এ প্রশ্নের উওর এখন দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যৌথভাবে এর জবাব নিশ্চয়ই দিতে পারবেন।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?
উওরঃ আমি একে স্বাগতই জানাবো। কারণ, প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বয়ং এই দল গঠন করে ও এতে যোগদান করে নিজেকে সামরিক প্রক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই একে স্বাগত জানাব এ আশায় যে এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুগম করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাদের নিয়ে এ দল গঠন করা হচ্ছে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সমাহার কিভাবে করা হবে?

প্রশ্নঃ ইউপিপি নয়াদলে যোগ না দিলেও প্রেসিডেন্ট জিয়ার কর্মসূচীকে সমর্থন করে যাবি কি না?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়া ফ্রন্টের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইউপিপি কাজ করে যাবে।

প্রশ্নঃ আপনার এই সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত?
উওরঃ একটি পার্টিকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে হবে। জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত যেকোন সদস্যের মেনে চলা গঠনতান্ত্রিক ও নৈতিকভাবে বাধ্যতামূলক অন্ততঃ ততিরিন পর্যন্ত যতদিন পার্টির সর্বোচ্চ পরিষদ জাতীয় কাউন্সিল ভিন্নতরো কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে। আমরা পার্টির জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করেছি— জাতীয় কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত ধরে নিতে হবে। এটাই গণতন্ত্র।

মওদুদ আহমদ

ডাক ও তার মন্ত্রী, সদস্য আহ্বায়ক কমিটি, জাতীয়তাবাদী দল।
ব্যারিস্টার মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পোষ্টমাষ্টার জেনারেল মুজিব আমলেই কারাবরণ করেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে রাজনীতিতে আগমন। জাগদলের অন্যতিন ডিফেন্ডার।

প্রশ্নঃ জাগদল ফ্রন্ট থেকে জাতীয়তাবারী দলে যোগদান করলো কেন?
উওরঃ জাগদল করেছিলাম ঐক্যের রাজনীতির জন্য। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে ও প্রেরণায়। যদিও এটা প্রচারিত বা প্রকাশিত না তবু এটা সত্য যে জাগদলের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বাক্ষর ছিল। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই— ব্যাপক ভিত্তিক ঐক্য। আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে এই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং প্রয়োজন মেটাতে জাগদলে নানাদিক থেকে লোক আসে। এমনকি ন্যাপের সহ-সভাপতি পদের লোকও (অস্পষ্ট) বছরের (অস্পষ্ট) জাগদলে যোগ দেন। সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেননি এমন মুসলিম লীগ নেতাও জাগদলে যোগদান করেন। জাতীয় গণতন্ত্রীরাও এ দলে যোগ দেন। জাগদলের সৃষ্টিই ছিল ঐক্যের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। সেই ঐক্যের প্রক্রিয়াটাকে বড় করার জনক্স ফ্রন্ট গঠন করা হলো। আজকে নতুন দল গঠন করার উদ্দেশ্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলছেন এই ঐক্যটাকে আরও সংহত করা আরও সংঘবদ্ধ করা। তাই ঐক্যের রাজনীতিরই প্রতিফলন জাতীয়তাবাদী দল।
যেকোন দেশেই নানা স্রোতের মানুষকে একত্রিত করে দলভুক্ত করা এবং একটি আদর্শে অনুপ্রাণিত করা এটা একটা কঠিন কাজ। এই কাজে অনেক পরিপক্কতা দরকার। প্রত্যেকেরই একটা (অস্পষ্ট) রাজনীতি আছে। ন্যাপের আছে ইউপিপিরও আছে, মুসলিম লীগেরও আছে। জাগদলেরও আছে। জাগদলেরও একটা রাজনীতি আছে। আর তা নতুন রাজনীতির কাছাকাছি। কারণ জাগদলই দেশে প্রথম ঐক্যের প্লাটফরম হিসেব কাজ করে। কাজেই আমাদের পক্ষে একতার রাজনীতিকে গ্রহণ করা খুব কষ্টকর নয়। কিন্তু অন্যান্যদের জন্য এই কিছুটা কঠিন হবে। কারণ তাঁদের রাজনীতিকে নতুন করে বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন করে একতার নতুন রাজনীতিকে নিজেদের গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্নঃ ঐক্যের রাজনীতির জন্য ফ্রন্টের চেয়ে নতুন দলের সুযোগ কি সীমিত হয়ে যাচ্ছে না?
উওরঃ ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা বেশী ভাল নয়। ফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করলে প্রত্যেক দলের একটা কোটা থাকা স্বাভাবিক। অথচ নির্বাচনের পর এদের কোন বন্ধন থাকছে না। সহজেই অন্য দলের সঙ্গে আলোচনা করে ফ্রন্ট ছেড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা হতে পারে। কারণ ক্ষমতার জন্যেই রাজনীতি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য ক্ষমতা। এই বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রন্টের চেয়ে এক দলই যুক্তিযুক্ত। কারণ ৭২ সালের সংবিধান মোতাবেক কোন সদস্য নির্বাচিত হয়ে দলত্যাগ করলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল বলে গণ্য হবে। এ জন্যে নির্বাচনের পর দলত্যাগ করা সম্ভব হবে না।

প্রশ্নঃ ন্যাপ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবী করে কি ফ্রন্টের মনোভাব নিয়েই একদলে যোগদান করছে না?
উওরঃ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকলেও একটা কথা ঠিকই থেকে যাচ্ছে যে, নির্বাচনের পর তাঁরা একটি দলেরই সদস্য থাকছেন। কোটাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। তবে মিশ্রণটা হতে একটু সময়তো লাগবেই। যে মিশ্রণটা রাজনীতির মিশ্রণ, ঐক্যের মিশ্রণ, আদর্শের মিশ্রণ। এটা একটা বিরাট বড় জিনিস। জিনিসটা কতদূর কার্যকর হবে তাবাকি জানিনা। তবে কাজটা বেশ বড়।

প্রশ্নঃ কোন ঐক্যটা বড় ফ্রন্ট না একদল?
উওরঃ আমি বলব, ফ্রন্ট হচ্ছে ঢিলে বন্ধনের। ফ্রন্টে শৃঙ্খলা কার্যকর করা সহজ।

প্রশ্নঃ নতুন দল গঠন করার আগে গণতান্ত্রিক কনভেশন হলে কি ভালো হতো না?
উওরঃ স্বাভাবিক অনুশীলন হলো একটা কনভেনশন ডেকে দলের আহ্বায়ক কমিটি তৈরী করা। কিন্তু এ পদ্ধতি মেনে চলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। এটা নির্ভর করে বিশেষ পরিস্থিতি, পরিবেশবো উদ্যোক্তার উপর।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী দলই কি শেষ দল?
উওরঃ একেবারে চূড়ান্ট নয়। কারণ রাজনীতিতে চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। তবে দৃশ্যত আমরা সর্বশেষ স্তরে পৌঁছাত প্রক্রিয়ায় রয়েছি।
নতুন আরো একটি দল হবে কি না— এখনই বলা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত এটাই চূড়ান্ত।

প্রশ্নঃ একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার চিন্তা ফ্রন্ট গঠন করার সময় আপনাদের ছিল কি?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এটা ভেবে রেখেছিলেন। তাঁর অনুভবে অত্যন্ত প্রবলভাবে ছিল অনেকদিন থেকেই। ফ্রন্টের অনেকেই জানতেন। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী সাংবাদিক সম্মেলনেই বলেছেন,’জিয়াউর রহমান সাহেব ফ্রন্ট করার সময়ই এটা বলা হয়েছিল। এখন কাজী জাফর পিছিয়ে যাচ্ছেন।’

প্রশ্নঃ জাগদল কি প্রেসিডেন্ট জিয়ার সেই স্বপ্নের দল যা পরে ব্যর্থ হয়ে যায়?
উওরঃ এখানে যোগাযোগের একটা ফারাক রয়ে গেছে। উপরের দিকে যারা ছিলেন তাদের যে চিন্তাধারা— জাগদলকে আস্তে আস্তে আরেকটা দল নিয়ে যাবেন— এটা নিম্নপর্যায় যাচ্ছিল না। এ জন্যে জাগদলের বিরাট একটা অংশ হতাশ হয়েছেন।

প্রশ্নঃ জাগদল ভেঙ্গে যাওয়ায় আপনি কি দুঃখিত?
উওরঃ রাজনীতিতে ব্যক্তিগত ব্যাপারটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়। যোগাযোগ শূন্যতার জন্য জাগদলের বহু সংখ্যক কর্মী ও নেতা হতাশ হয়েছেন। তাদের বক্তব্য তারা প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে রাজনীতি করতে এসেছেন। তাঁদেরতো বলা হয়নি যে অন্যান্য দলের সঙ্গেও রাজনীতি করতে হবে। তাদের মনে এ প্রশ্নটা রয়েছে। এই ঐক্যের রাজনীতি সুন্দরভাবে বিকাশ লাভ করলে সেটা আস্তে আস্তে চলে যাবে।

প্রশ্নঃ জাতীয়তাবাদী দল গঠন পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তির ভূমিকাই মূখ্য। এটা কি নতুন দলের রাজনীতির জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে না?
উওরঃ বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এটা হয়েছে। আমরা এটাকে এড়িয়ে প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই। এ জন্য আমরা রাজনীতি জনগণের কাছে নেয়ার কথা বলছি। নির্বাচনের কথা বলছি, রাজনৈতিক দল আরও বিকাশ লাভ করুক শক্তিশালী বিরোধীদল গড়ে উঠুক আমরা তা চাই। আজকে ঐতিহাসিক কারণে একজনের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তাকেই আমরা গণতান্ত্রিক করতে চেষ্টা করছি।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয়তায় অংশ নেয়ার জন্য কি অনেকে এখানে আসছেন না?
উওরঃ অনেকেতো আসছেন ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য।

প্রশ্নঃ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে যখন ভাঙ্গনের পালা চলছে তখন নতুন দল কতখানি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?
উওরঃ রাজনীতিতে ভাঙ্গন নতুন কিছু নয়। উন্নয়নশীল দেশে এটা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। তবে একদিকে ভাঙ্গন দেখতেও খারাপ, শুনতেও খারাপ। অন্যদিকে এটা ভালো এতে
দৃষ্টিটা আরও পরিষ্কার হয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক হতাশার জন্য ভাঙ্গন ধরে। এতে নেতৃত্বহীনতার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। জাতীয়তাবাদী দলের উল্টোদিকেও দেখতে হবে সে আমরা নানা দলকে একত্রীভূত করেছিম সুতরাং এটা ভাঙ্গনের রাজনীতি নয়, গঠনের রাজনীতি।
রাজনৈতিক পরিপক্কতা দলগুলোর থাকলে এবং সত্যিকারের মিশ্রণটা সম্ভবপর হলে নতুন দল সফল হবে। কারণ সত্যিকারের মিশ্রণের কারণ হিসেবে সরকারী দল থেকে অনেক লোকই দাঁড়াতে চাইবে।

প্রশ্নঃ ভারতের জনতা পার্টি গঠনের ইতিহাস থেকে আপনার কি শিক্ষা গ্রহণ করছেন?
উওরঃ জনতা পার্টি নির্বাচনের পরে পার্টি করেছে। আমরা করছি আগে। এটার একটা গভীর বৈশিষ্ট্য আছে। নির্বাচনের পরে পার্টি করলে আমাদের অবস্থাও জনতা পার্টির মতোই হতো। কারণ ফ্রন্টভুক্ত দলের নিজস্ব একটা পরিচিতি থাকে। এতে ক্ষমতার জন্য দরকষাকষিও সম্ভব হতো। দর কষাকষি হবেই যেমন ধরুন আমার ব্যক্তিগত অনুসারী আছে— তখন বলতে পারে আমাকে একটা কিছু দিতে হবে।

প্রশ্নঃ নতুন দল গঠন কি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ডেকে আনছে না?
উওরঃ অনিশ্চয়তা একটা অত্যন্ত সাময়িক ব্যাপার বলে আমি মনে করি। এটা কেটে যাবে। যখনই দলের কমিটি গঠিত হবে, আমরা আবার মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়বো, জেলা ও থানায় কমিটি গঠিত হবে আমার মনে হয় এ অনিশ্চয়তা দূর হয়ে যাবে।

এনায়েতউল্লাহ খান

পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী, সদস্য আহ্বায়ক কমিটি। জাতীয়তাবাদী দল।

প্রশ্নঃ জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় দল— এসব কথা কি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে না? অথবা বলুন এই জাতীয় ঐক্য কি?
উওরঃ না। এখানে জাতীয় ঐক্য বলছে বোঝাচ্ছে আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি এবং উৎপাদক শ্রেণীকে সংগঠিত করা। স্বভাবতঃই এর মধ্যে বিভিন্নধারার স্রোত থাকবে, আদর্শগত ধারার স্রোত থাকবে। কিন্তু এখানে মতাদর্শটা প্রধান হয়ে আসছে না। যদিও এখানে সতর্ক থাকতে হবে সুযোগ সন্ধানী (প্রতিক্রিয়াশীল বলবো না) ক্ষমতাভিলাষীদের কাছ থেকে। এখানে ডান এবং বামের তফাৎটা খুব বেশী নয়। এখানে ডান এবং বামের সমন্বয় সাধন হতে পারে। যারা ক্ষমতাভিলাষী, যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আদৌ কোনদিন সম্পর্কিত নয় তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। এখানে প্রচুর সন্দেহ আছে। যদি সতর্ক না হওয়া যায় তবে তাদের ভূমিকাটাই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কি?
উওরঃ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাংলাদেশী সংস্কৃতি, বাংলাদেশের আবহ পরিমন্ডল, ভৌগলিক সীমারেখা, ঐতিহাসিক বিবর্তন তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশী চেতনাকে সমুন্নত রাখা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম জনসাধারণ, উৎপাদক শ্রেণীর স্বার্থে উৎপাদক ক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ এবং সম্প্রসারণবাদ বিরোধী আন্দোলন অংশগ্রহণ এবং এ ভূমিকাকে সমুন্নত রাখা।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্ব বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নতুন দল গঠন বৃহত্তম ঐক্যের প্রক্রিয়ার একটি উচ্চতর পর্যায়। এ প্রক্রিয়াকে বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। ৭১ সালের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সকল রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিকভাবে ভেঙ্গেচুরে গিয়েছিল। এই অবস্থায় প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি। রাজনীতি থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ছিলো না সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। এমনি পরিস্থিতিতে ৭৫-এর পরিবর্তনের পরও সংগঠন হিসেবে কোন রাজনৈতিক দল বিকাশলাভ করতে পারেনি। এর কারনে বিভাজনের রাজনীতি জিইয়ে রাখার জন্য বিভেদকামী শক্তি প্রত্যেকটি সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে ছিল সক্রিয়। এ অবস্থায় আধিপত্যবাদের ক্রীড়াভূমিতে দেশ যাতে পরিণত না হয় তার প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের। কিন্তু সাংগঠনিক প্রক্রিয়া একদিনে সম্ভব নয়। প্রয়োজন হয় একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শুরু করা। ঐক্যের জন্য এই সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি ছিল জাগদলে।
জাগদলের পর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন ছিল আরও বৃহৎ ঐক্য গঠনের অগ্রগামী পদক্ষেপ। এরপর এই নতুন দল বিভাজনের রাজনীতি থেকে ঐক্য প্রতিষ্ঠাত প্রকিয়াকে আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

প্রশ্নঃ ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাগদলই তা যথেষ্ট ছিল। তবে কি জাগদল ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্যার্থ হয়েছে? জাগদল গঠনের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার অভিমত কি?
উওরঃ জাগদল ঐক্য গঠনে ব্যর্থ হয়েছে একথা বলব না। জাগদল একটা সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টি করে। কিন্তু রাজনীতি সৃষ্টি করতে পারেনি। রাজনীতি ও সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টির জন্য জাগদল যে সময় পেয়েছিল তাও পর্যাপ্ত নয়। তবে এগিয়ে গেছে ঐক্যের প্রক্রিয়া। গঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, নতুন দল বি এন পি। অর্থাৎ ঐক্যের প্রক্রিয়া এগুচ্ছে ধাপে ধাপে।

প্রশ্নঃ ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নতুন দল কতটুলু সফল হবে বলে আপনার ধারণা? ঐক্যের প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও একটি নতুন দল গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে কি?
উওরঃ নতুন দল কতটুকু সফল হবে তা ঠিক এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। যুক্তিসংগতভাবে এগুলে সফল হওয়া উচিত। এখনই আরো একটি নতুন দল গঠনের প্রশ্ন আসছে না।

প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন ঐক্যের প্রক্রিয়া পর্যাক্রমে উচ্চতর পর্যায়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক রূপ সম্পর্কে আপনাদের কোন পূর্বসিদ্ধান্ত ছিল কি?
উওরঃ আমি মনে করি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। পর্যায়ক্রমিকভাবে বৃহত্তর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাঁরই অনুপ্রেরণায় প্রাথমিকভাবে গঠিত হয় জাগদল। আরো বেশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পরে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট এবং ফ্রন্ট থেকে একটি রাজনৈতিক দলে উত্তরণ। প্রক্রিয়াটির লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে জনগণ সুস্পষ্টভাবে একটি প্রোগ্রাম চায়। ভোট দিয়েছে এই প্রোগ্রামের জন্যই। এখন প্রোগ্রামকে ফলপ্রসূ করার জন্য দরকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড। প্রয়োজন নেতাদের ঐক্য।

প্রশ্নঃ ঐক্যের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নতুন দলকে কিভাবে ব্যবহার করা হবে?
উওরঃ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ঠিক এখনই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারবে না। সংহত সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টির পরই নতুন দলমে ব্যবহার করা হবে আসন্ন নির্বাচনের কাজে। নির্বাচনী কাজের মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হবে দলের চরিত্র। নির্ধারিত হবে দলে কারা আসবেন। দলের উপাদান থেকে নির্ধারিত হবে ঐক্যের প্রক্রিয়াকে নতুন কোন অবস্থায় উন্নীত করবে।

প্রশ্নঃ আসন্ন নির্বাচনে নয়াদলের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কিছু বলুন?
উওরঃ আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য সম্ভবতঃ একটি সংসদীয় কমিটি গঠিত হবে।দলের মনোনয়ন কারা পাবেন তার জন্য জানা প্রয়োজন ভবিষ্যত সংসদের দায়িত্ব ও চরিত্র। আমার মতে, ভবিষ্যত সংসদ হবে অতীতের সংসদগুলো থেকে ভিন্নতর। কারণ মূলতঃ এই সংসদই নির্ধারণ করবে সমগ্র জাতির ভবিষ্যত রাজনীতি। এজন্যে এই সংসদকে চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে জাতিকে নেতৃত্বদানে সক্ষম হতে হবে। এ যোগ্যতা অর্জনের জন্য সংসদে যোগ্যতমের এবং স্থানীয় ভিত্তিতে জনগণের বিশ্বস্তততম বন্ধুর উওরণ চাই। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট জিয়া সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার আহবানে জানিয়েছেন। সমগ্র দেশবাসীও প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে আস্থাশীল। তাই আশা করা যায় জনগণ যোগ্যতম ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করবেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় এই যোগ্যতম ব্যক্তিরাই হবেন সেনানী, এরাই হবেন ঐক্যের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার অগ্রপথিক। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য যাদের রয়েছে তাঁরা এ দলে যোগ দেবেন। এছাড়া অতীতের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁরাও আসবেন। প্রবীণদের একটি দলও যোগ দেবেন এদলে। প্রবীণ বলতে আমি তাঁদেরকেই বোঝাচ্ছি যারা পুরনো ধ্যান ধারণার ( ওল্ড অর্ডার) লোক অথচ তাদের দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস রয়েছে।

প্রশ্নঃ পুরনো ধ্যান ধারণার ( ওল্ড অর্ডার) রাজনীতিক বলতে বোঝায় মুসলীম লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে। যদি ‘৭৫-এর আগের কথা ধরলে বোঝায় শুধু আওয়ামী লীগকে। তবে আপনি কি আওয়ামী লীগকেও সঙ্গে নিয়ে দলগঠনে বিশ্বাসী?
উত্তরঃ পুরনো ধ্যান ধারণা ( ওল্ড অর্ডার) বলতে আমি ‘৭১ এর আগে থেকেই বোঝাচ্ছি। হ্যাঁ, এতে মুসলিম লীগবো আওয়ামী লীগ উভয়ই বোঝায়। আমাদের মনে রাখতে হবে মুসলীম লীগের মধ্যেও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা আছেন। অন্ততঃ তাঁদের একটি জাতীয় চেতনা রয়েছে। এ চেতনার বিকাশ ঘটেছিল ‘৪০-এর দশকে। অনেকেই হয়তো এ চেতনাকে বিকশিত করতে পারেননি। আজকে আবার জাতীয় চেতনা থেকে যদি তাঁরা রাজনীতিতে আসতে চান তবে তাঁদের বাধা দেতা উচিত হবে না। তাঁদের নিয়ে ঐক্য গড়তে হবে জাতীয় স্বার্থেই। আওয়ামী লীগের মধ্যেও সে ভাল লোক নেই তা বলি ন্স। এদের মধ্যে অনেকেই ৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, শরিক হননি লুটপাটে। এরাও এদলে যোগ দিতে পারেন। আমি আওয়ামী লীগ বা মুসলিম লীগ বলতে কোন বিশেশগ ব্যক্তি,গোষ্ঠী, দল বা উপদলকে বোঝাচ্ছিল। সাধারণচাবে একজন ব্যক্তি বা শ্রেণীকে বোঝাচ্ছি। নতুন দলে আরও যোগ দিতে পারেন। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মধ্যবিত্তরা এবং গ্রামীণ সম্ভ্রান্তরা (রুরাল এলিটস)।

প্রশ্নঃ নতুনদলের সাফল্যের ব্যাপারে আপবি কতখানি আশাবাদী?
উওরঃ ‘৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগে ও পরে এদেশে রাজনীতি ছিল, ছিল না সংগঠন। এদেশে মাঠ ছিল, ছিল না ফসল, কারখানা ছিল উৎপাদন ছিল না, কৃষক ছিল ছিল না কৃষিকাজ, শ্রমিক ছিল ছিল না শ্রমের সুযোগ। একটি জাতির পক্ষে এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। তার উওইর পুরোনো সংগঠনগুলো জনগণকে সংগঠিত করার কাজে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি। সৃষ্টি করতে পারেনি নতুন রাজনৈতিক কর্মী। নতুন হাতিয়ার তৈরি করা যায়নি উৎপাদনের। এমন অবস্থায় নতুন দল সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি বার বার বলেছি নিতুন দলে বা ঐক্যের এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন শক্তির সমন্বয় (মারজার অব ফরসেস) ঘটবেম এই সমন্বিত শক্তিই উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে জাতীয় চেতনার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে ঐক্যের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিভাজনের রাজনীতি থেকে সরে এসে সমস্ত গণতন্রমনা শক্তিগুলো নতুনভাবে সন্নিবেশিত হবে।

আবদুল হালিম চৌধুরী

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, সদস্য, আহ্বায়ক কমিটি, জাতীয়তাবাদী দল। প্রাক্তন সৈনিক। নমনীয় ব্যক্তিত্ব— রাজনৈতিক জীবনে, ব্যক্তি জীবনে। ন্যাপ (মোঃ) থেকে ইউপিপি, এখন জাতীয়তাবাদী দলে সংস্কারবাদী সহজ-সরল চরিত্র।

প্রশ্নঃ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সভাপতি পদ ছেড়ে আপনার জাতীয়তাবাদী দলে যোগদানের পিছনে মূল উপাদানটি কি?
উওরঃ প্রধান উপাধান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশমুখী রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ পরিচয়সূত্রে আমার বদ্ধমূল ধারণা যে তিনি দেশপ্রেমিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি শেষ রক্তবিন্দু দিতেও কুন্ঠিত হবেন না। তিনি এবং আমি উভয়েই জোতদার। সুতরাং পথটা এক। লক্ষ্য যখন এক তখন পথে চলতে পারলে লক্ষ্য সাধন সহজ হবে। আসলে এটাই প্রধান উপাদান

প্রশ্নঃ, প্রেসিডেন্ট নিয়ার প্রেরণায় গঠিত জাগদলে যোগ দেননি কেন?
উওরঃ সে সময়ে আমি একটি পুরানো রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলাম এবং তিনি তখন অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন সরকারী ক্ষমতায় থেকে। আমি যখন যোগ দিয়েছি তখন সার্বিক উজান বাতাসেই যোগ দিয়েছি। শেখ মুজিব যখন ‘বাকশাল’ করতে যাচ্ছেন সেই মুহূর্তে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকল্প সংগঠন দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি। জাগদল গঠনের সময় এর উদ্দেশ্য কি কি এবং কারা সেখানে যাচ্ছে তা দেখার প্রয়োজন ছিল। জাগদলে ভাল লোকও আছে। মন্দ লোক যে নেই তাও বলা যায় না। তিনি এটা করলেন এবং রাজনীতিও দেখলাম। এর পরে শুরু করলাম এক হওয়া যায় কিভাবে? যখন এক হওয়ার চিন্তা করছিলাম তখন আর জাগদলে যোগদানের প্রশ্ন আসেনি।

প্রশ্নঃ এক হওয়ার জন্য ফ্রন্টই তো যথেষ্ট ছিল। তবে নতুন পার্টিতে যোগদানের ব্যাপারে কি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন?
উওরঃ বাংলাদেশ জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার এখনও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কতদিনে সমাজতন্ত্রের দিকে বা প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আসবে আমি জানিনা।
প্রেসিডেনড় জিয়ার নেতৃত্বে একড়া জাতীয় গণতান্ত্রিক প্রোগ্রামের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে পারবো এ আশাতেই নতুন দলে যোগ দিয়েচগি। ফ্রন্টকে কার্যকারী করার চেষ্টা জিয়াউর রহমানও যথেষ্ট করেছেন এবং আমিও করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার অনেক সহকর্মী তা’ করেননি। ফ্রন্টের মন্ত্রী হয়েই আমরা পার্টির ওপর জোর দেয়া শুরু করি। আমি ট্যুর করেছি ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অথচ আমার অন্যান্য সহকর্মীরা যেমন কাজী জাফর প্রোগ্রাম করেছেন ইউপিপিকে নিয়ে। আসলে আজকে যারা ফ্রন্টের কথা বলছেন তাঁরাই ফ্রন্টকে হত্যাও করেছে। অর্থাৎ মন্ত্রী হয়ে আমরা চিন্তা করলাম নিজের পার্টিকে কি করে দাঁড় করানো যায়। এতে আমার ধারণা হলাও ফ্রন্টের ছায়ায় নিজের পার্টির ভাবমূর্তি গড়তে গেলে ফ্রন্ট সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যাভে। এ জন্যেই নতুন দলে যোগ দিলাম।

প্রশ্নঃ আপনার সভাপতিত্বে ইউপিপির কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন দলে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কয়েকদিন পরই আপনি কোন রাজনৈতিক কারণে নতুন দলে যোগ দিলেন?
উওরঃ কয়েকদিনের মধ্যে হয়নি। এটা আগেই আমার মনে মনে সিদ্ধান্ত ছিল। আমি তবু প্রস্তাবে সই করলাম কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য মত প্রকাশ করে সরকারেও থাকবাও আবার আমরা একদলের চিন্তাভাবনাও করবো মা। সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত হওয়ায় ভুল সিদ্ধান্তেও আমি সই করেছি। রাশেদ খান মেনন যেদি বেরিয়ে গেল সেদিনও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত ছিল বলে পার্টির সভাপতি হিসাবে আমি প্রস্তাবে সই করেছিলাম।

প্রশ্নঃ মেননদের সঙ্গে যোগ দেননি কেন?
উওরঃ আমি মেননদের সঙ্গে যোগ দেইনি, কারণ মেননদের রাজনীতি ভুল। ওদের চিন্তাধারাটা একটু অনেকদিনের লম্বা চওড়া প্রোগ্রামের। ওরা হয়তো অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী বলে ভেবেছে আমরা পরে ক্ষমতায় আসবো। কিন্তু আমি মনে করি জাতীয়তাবাদী কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনই যোগ দেয়া প্রয়োজন।

প্রশ্নঃ অঙ্কের হিসাবে ফ্রন্টের চেয়ে নয়াদল কি ঐক্যের ক্ষেত্রে সঙ্কুচিত হচ্ছে না?
উওরঃ অঙ্কের হিসেবে এখানে বেশী হবে। তার কারণ ইউপিপির সংখ্যাগতংশ জাতীয়তাবাদাউ ইউপিপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে পারেন। সুতরাং প্রধান শক্তি আসছে। জাগদলের খারাপ লোক ছাড়া অন্যান্যরা
আসছেন, ন্যাপের জাতীয়তাবাদীরা এবং যারা আজও রাজনীতিতে চেনামুখ নন এমনও যারা আসবেন তাঁরা হচ্ছেন বৃহত্তম শক্তি। বাইরে যারা থাকছেন তাঁদের প্রতি আমার ব্লেসিং আছে। তাঁদেরকে শক্তিশালী বিরোধী ভূমিকা পালন করতে দিন। কিন্তু ভিতর থেকে বিরোধিতা আমার মনে হয় এটা ঠিক নয়। পার্টির ভেতরে পার্টি এটা আমি বিশ্বাস করি না।

প্রশ্নঃ আপনার সঙ্গে ইউপিপির অন্য কেউ কি থাকছেন?
উওরঃ আমি কিন্তু ইউটিভি থেকে বাইরে এসেছি। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তখন আমি বলেছি, আমার সঙ্গে আমি আছি আর আল্লাহ আছেন। আল্লাহকে যখন আমি সঙ্গে নিতে পেরেছি তখন ইউপিপির সংখ্যাগরিষ্ঠদের আমি সঙ্গে বহন করছি। আমি একথাও বলেছি, ভাঙ্গাই যাদের কাজ তারা গড়তে জানেনা। আমি একেবারে ৪১ থেকে দেখে আসছি ভাঙ্গা আর ভাঙ্গা আর ভাঙ্গা। ভেঙ্গে যে ভাল কিছু করা যায় সে চিন্তা আমি দেখিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া চান কিছু ভাঙ্গুক, ভেঙ্গে কিছু গড়ে উঠুক এবং সে চেষ্টা আমরা করছি।

প্রশ্নঃ ফ্রন্টের নির্বাচনী ওয়াদার কি হলো?
উওরঃ আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রতিশ্রুতি রাখছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করছেন। তিনি জাগদল ভেঙ্গে নতুন দল গঠন করে পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করেছেন। সামরিক আইন ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হবে। দেশে সামরিক আইন রয়েছে এটা আর আজ অনুভব করা যায় না।

প্রশ্নঃ নতুন দলে কারা যোগ দেবেন?
উওরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়া যদি নতুন দল না করতেন তাহলে আমাকে হয়তো পেতেন না। কারণ আমি একটা পার্টির সভাপতি। তাছাড়া আমার একটা সংগ্রামের ইতিহাস আছে। আমি কখনো ভাটির দিকে নৌকা ছাড়িনি। উজানেই বৈঠা ধরেছি। যেহেতু তিনি নতুন দল করেছেন এবং তার চিন্তাধারা ব্যাপক ঐক্য এবং আমরাও তাই কাজেই একটা জায়গায় আমরা মিলেছি। যেহেতু এটার কর্মসূচী প্রগতিশীল সেজন্যে এতে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদীরা আসবেন। যারা কম্যুনিষ্ট কিন্তু মনে করেন আগে জাতীয় গণতন্ত্র আসা দরকার তারাও আসবেন। হয়তো একটা বিশেষ পর্যায়ে যাওয়ার পর তারা ভিন্নপথ নিতে পারেন।

প্রশ্নঃ ফ্রন্ট কি কাজ করতে ব্যর্থ হয়নি?
উওরঃ ফ্রন্ট ব্যর্থ হয়নি। আমরা নিজেরাই তাকে ব্যর্থ করেছি। আমরা নিজেদের পার্টিকে গোছাতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সভা ডাকার জন্যও বলিনি। অথচ আমাদের তা করা উচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাদের ঠিকই নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁকেও দেখতে হয়েছে আমরা কি চাই। তাঁর নিজের কোন দল নেই। যখন তিনি দেখলেন সবাই নিজ নিজ পার্টি এগিয়ে নিচ্ছেন তখন এক পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি গঠন করলেন এক পার্টি।

আনোয়ার জাহিদ

সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, সদস্য, অবলুপ্ত ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি।
সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে দ্বৈতসত্তাধিকারী, মেধাবী ও সুবক্তা। স্কুলজীবনেই কারাবরণকারী। সবসময়ই রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন প্রকাশ্যে বা পরোক্ষ।

প্রশ্নঃ আপনি কি ট্রাডিশনে বিশ্বাসী?
উত্তরঃ কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে ট্রাডিশন বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক দল হচ্ছে লিভিং অর্গানাইজেশন। জীবন্ত কোন কিছু মরে না যাওয়া পর্যন্ত ট্রাডিশন সৃষ্টি হয় না। সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টি বিপ্লব করেছিল ১৯১৭ সালে। সেই ট্রাডিশন ধরে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির আজকেও বিপ্লবী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা বলি না। তাকে এখন আমরা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী পার্টি বলি। মুসলিম লীগের রয়েছে পাকিস্তান আন্দোলনের ট্রাডিশন। সাম্প্রতিক অতীতে আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন, বলতে পারেন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের’ ট্রাডিশন রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট রাজনীতি এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সে দল নিঃসন্দেহে ট্রাডিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

প্রশ্নঃ যদি ট্রাডিশন না হয় তবে ন্যাপকে আকড়ে রইলেন কেন?
উওরঃ ন্যাপকে আকড়ে থাকছি ট্রাডিশন রক্ষার জন্য নয়। রাজনীতি রক্ষার জন্য। ন্যাপের জন্ম হয়েছিল নির্দিষ্ট রাজনীতি এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। সে রাজনীতি হচ্ছেঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্ননিয়ন্ত্রাণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আজকের প্রেক্ষিতেও সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এজন্য আজকের সীমিত পরিসরে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী রাজনীতির অস্তিত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব ন্যাপকে বহন করতে হবে। জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দিয়ে এ রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে যা বলা হচ্ছে তা আমরা মনে করি না। আরো বলা হচ্ছে একদল গড়ে তোলাই আজকে এ সংগ্রানের জন্য প্রয়োজন তাও আমরা মনে করি না। কারণ ৩রা জুনের নির্বাচনের আগে ও পরে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তন গুণগত না হলেও পরিমাণগত হয়েছে। এ সরকারের আগের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের প্রতিহত করে দেশে গণতান্ত্রিক উওরণের প্রক্রিয়া চালু করা। জনগণ এই লক্ষ্যকে সমর্থন করেছেম ভোটে তাদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেছে। এরপ কি হলো? ভারতীউ সম্প্রসারণবাদ এবং সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদেত পরাজয়ের সুযোগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদেশে অনুপ্রবেশ করছে এবং আমরা ক্রমাগত সেদিকে ঝুঁকে পড়ছি। তার বহিঃপ্রকাশ বিদেশী সাহায্যের উপর অর্থনীতি গড়ে তোলা, শান্তিবাহিনী আমদানী। নতুন দলের লক্ষ্যের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার কথাও বলা হয় নাই। যারা শান্তিবাহিনীকে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন তারাও এই নতুন দলের সঙ্গে জড়িত।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করার জন্য নূন্যতম শর্তে ফ্রন্ট হতে পারে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে ন্যাপের ভূমিকাকে অব্যাহত রাখতেই হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ফ্রন্টের লক্ষ্যকে তিনটি শব্দ প্রকাশ করেছিলেন ৭ই মের সাংবাদিক সম্মেলনে। জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, সামাজিক প্রগতি। ৩রা জুনে জনগণের রায়ে সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং আওয়ামী বাকশালীদের দেশের মাটিতে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে অর্জিত হয়েছে প্রথম লক্ষ্য। এখন যা অর্জন করা প্রয়োজন তা হচ্ছে বাকি দুটো শব্দ। গণতন্ত্র এবং সামাজিক প্রগতি। অর্থাৎ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এ দুটো শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটাকে আরেকটা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ভোটাধিকারই অর্থনৈতিক মুক্তির বহিঃপ্রকাশ নয়। এ দুটো অর্জন করা যাবে কিনা তা আজকে আমাদের আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করা হচ্ছে কি হচ্ছে না তার ওপর নির্ভর করছে। কারণ এই আর্থ-সামাজিক অবস্থাই বাকশালীদের বিচরণ ক্ষেত্রে। গণতন্ত্র যে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাও এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার জন্যই। এই স্থিতাবস্থা গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে সামাজিক প্রগতিরও বিরুদ্ধে। ৩রা জুনের নির্বাচন সুপষ্টভাবে একটা লাইন তৈরি করেছে। নির্ধারণ করেছে কারা এই স্থিতাবস্থার পরিবর্তন করা বা তাকে ভেঙে ফেলা। নতুন দল যেভাবে গঠিত হয়েছে, আমরা মনে করি, এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই তার ঝোঁক বেশি। একে ভেঙ্গে নতুন করে সামাজিক প্রগতির যে বিকায়াগ তাকে প্রস্ফুটিত করা নয়।

প্রশ্নঃ ন্যাপের অন্য অংশ নতুন দলে যোগ দিল কেন?
উওরঃ প্রথমতঃ তাঁরা রাজনীতিতে ভুল করছেন। কারণ তাঁরা মনে করছেন তাদের ভাষায় গণতান্ত্রিক উওরণের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করার জন্য দ্বিতীয়য়ঃ কিছু সুবিধাবাদ নিঃসন্দেহে কার্যকরী হচ্ছে। বক্তৃতায় কেউ কেউ বলেছেন, আমরা যদি দলে না যাই তবে আমাদের দলের অনেক লোক অন্যদলে যাবে এটা চরম সুবিধাবাদ। এই ভুল রাজনীতি এবং সুবিধাবাদ এ দুটোই এখানে কাজ করছে।

প্রশ্নঃ ন্যাপের কার্যক্রমতো সাসপেন্ড করা হয়েছে।
উওরঃ সাসপেন্ড করা কথাটি চাতুরীপূর্ণ কথা। কারণ একদলে যাওয়ার যে যুক্তি হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন একদলে না গেলে গণিতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং তা রাজনৈতিক বিপর্যয় আনবে।
এই বিপর্যয় রোধের জন্য দলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে এবং যাওয়ার জন্য শর্ত দিচ্ছেন। যদি শর্ত না মানা হয় তাহলে বিপর্যয়টি ঘটে যাচ্ছে। তাহলে হয় শর্তটি ভাওতা নয়তো যুক্তিটি ভাওতা। আমি মনে করি দুটোই ভাওতা। কারণ দুটো একসঙ্গে পাশাপাশি চলতে পারে না। কারণ একদলে যেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা যাবে না। ফ্রন্টকে জনগণ ব্যাপকভাবে ফ্রন্টে আমরা গিয়েছিলাম। সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু তার প্রোগ্রাম কার্যকর করা যায়নি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যে থেমে আছে তার জন্য দায়ী নয়। ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোও দায়ী নয়। ফ্রন্টের ভেতরর এবং বাইরের শত্রু এবং তাঁদের কারসাজি দায়ী। আমরা মনে করি ফ্রন্টের ভেতরের এবং বাইরের কারসাজীই এজন্য দায়ী। একদল করে তা সংশোধন করা সম্ভব নয়। কারণ তাতে সেই শক্তিগুলো আরো শক্তিশালী হবে। ন্যাপ যে শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো ন্যাপের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তার মানে একদলে যোগদান করা হচ্ছে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। একদলে ঢুকে গ্রুপবাজী করলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে না।

প্রশ্নঃ আপনার ওপর ন্যাপের রাহনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে দায়িত্ব এসেছে সাংবাদিকতা পেশায় থেকে তা পালন করতে আপনি কতখানি সফল হবেন?
উওরঃ ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার পক্ষে খুব দুরূহ হবে। কিন্তু রাজনীতির জন্য আমাকে অন্যান্য কাজ ত্যাগ করতেও হতে পারে।
উওরঃ এটা সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক। ভিতরে থেকে কিছু করা যায় না তার প্রমাণ তো আমাদের মধ্যে যারা গেছেন তারাই৷ শান্তি বাহিনীর চুক্তি, বাজেট সম্পর্কে মন্ত্রিসভা কিছু কি জানতেন?
একটা সুপার কেবিনেট দেশে আছে কিনা আমি জানি না।

প্রশ্নঃ আপনি কি ফ্রন্টের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি?
উওরঃ ফ্রন্টের লক্ষ্যতো নিঃশেষিত হয়নি। একদিকে যেসব কর্মসূচী ছিল তা এখন কার্যকর করা হয়নি এবং অন্যদিকে ফ্রন্ট এখনও ভেঙ্গে দেয়া হয়নি।

প্রশ্নঃ জাতীয়তাবাদী দলে ন্যাপ যোগ দেবে এটা আগেই বোঝা গেছে। মশিউর রহমানের বিভিন্ন বক্তৃতারও ভিন্ন রাজনীতি লক্ষ্য করা গেছে। আপনার অভিমত কি?
উওরঃ পার্টির মধ্যে প্রশ্নগুলো আলোচিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং বিভিন্ন সময়ে আমরা তার সমালোচনা করেছু। তাতে কখনও কখনও আমরা পারিনি। যেমন। এক পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করার কথা চিন্তা করেছিলেন আমরা তার বিরোধিতা করি। এতে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে যে একজন মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সামন্তবাদ বিরোধী এবং জনগণের প্রতি ন্যূনতম যে কমিটমেন্ট তা যদি না থাকে তবে তাঁর সঙ্গে কাজ করা যায় না।

প্রশ্নঃ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলে ভাঙ্গনের কারণ কি?
উওরঃ ৭১ সালের পর আমাদের সমাজটা একটা প্রচন্ড অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে ব্যক্তিগত স্থিতিশীলতাই নেই। এককথায় সমাজের ধারণ ক্ষমতাটাই কমে গেছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৯ ভাগ যেখানে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে ৪৫ ভাগ। কি মারাত্মক স্থিতিহীনতা। এজন্যই রাজনীতিতেও অস্থিরতা বা ভাঙ্গন অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৯৭০ সালে এদেশে একটা বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তি বিকাশ লাভ করেছিল কতগুলো লক্ষ্যে এ অবস্থা বজায় থাকালে দলের সংখ্যা কমে যেত। বাকশাল গঠন করে জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা হরণ করা হল। সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা গড়ে তোলা হলো। জনগণকে ছেড়ে শক্তি সরকারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ালো। এরকমটি হলে কালো ঘোড়াগুলোই সতেজ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলোও টিকে থাকার কোনো নিশ্চয়তা পায়নি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকলে স্থিতিহীনতাই রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে। শুধু তাই নয়, আমলাতান্ত্রিক সরকারও রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গনের জন্য দায়ী। এছাড়া শাসক শ্রেনী নিজেরাও আজ বিভক্ত। শাসক শ্রেণীর নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব রয়েছে। মুশতাকের সঙ্গে শেখ মুজিবের বা মুশতাকের সঙ্গে অন্য আরেকজনের দ্বন্দ্ব কি ছিল না? সুতরাং একদিকে জনগণের সঙ্গে শোষক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব অন্যদিকে শোষক শ্রেণীর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই দুই ধরনের দ্বন্দ্বও দল ভাঙনের একটা উপাদান।

প্রশ্নঃ রাজনৈতিক দল ভাঙ্গন দেখেও নতুন দল গঠন করে প্রেসিডেন্ট জিয়া কি একটি অসম্ভবকে সম্ভব করার কথা ভাবছেন?
উওরঃ প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতারই নিজস্ব ধ্যান ধারণা আছে এবং সবাই তার নিজের মতই বিচার বিবেচনা করে। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এটা করাটা সম্ভবতঃ সঠিক হয়নি। একটা রাজনৈতিক দলের জন্য দরকার একটা নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম এবং একটা কেন্দ্রিকতা। ফ্রন্টটাকে কার্যকরী করে তিনি এর চেয়ে বেশি। ফলপ্রসূভাবে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে লাগাতে পারতেন। সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এরা কাজ করলে এদের মধ্যে কাজের সম্পর্ক বাড়তো এবং অবাঞ্ছিতরা ঝড়ে পড়তো এমনিতেই। সমরুপতা না এলেও একটা ঐক্য আসতো। প্রেসিডেন্ট জিয়া ফ্রন্ট নিয়ে জনগণের অনেক কাছাকাছি আসতে পারতেন। যা একসময় একটি রাজনৈতিক দলের রূপ নিতে পারতো। কিন্তু আজকে হার্ড কোর কি হবে?
প্রেসিডেন্ট জিয়াকে আমি যতদূর জানি বর্তমান সামাজিক অচলাবস্থার স্থিতি বজায় রাখতে তিনি চান না। কিন্তু আমি যে ভাষায় বলি তিনি সে ভাষায় বলেন না। তাঁর ভাষা কি? তিনি বলেন তাঁ আদর্শ গ্রাম হচ্ছে নবগ্রাম। নবগ্রাম কি? নবগ্রামে পুরোন সামাজিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং আমার মধ্যে কোন বিভেদ নেই, মতবাদের তফাত থাকতে পারে।

প্রশ্নঃ কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তন ঘটানোর ইচ্ছে থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের অনেক নায়ক ব্যর্থ হয়েছেন….
উওরঃ এটা ৬৫ সাল নয়, এটা ৭৮ সাল। ১৯৬৫ সালে সুকর্ণ, নক্রুমা পারেননিম তাঁদের পতন হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদোদের হাতে। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। তবে স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও সামাজিক প্রগতি এ তিনটির একটিকেও যদি ন্যুন বিবেচনা, কাউন্টার পয়েসিং করা হয় তাহলে মারাত্নক বিপর্যয় ঘটে। প্রেসিডন্ট জিয়ার এই বিষয় প্রতিষ্ঠা করার সবগুলো গুণ থাকলেও তাঁর ভুল একটা কিছু হয়েছে এবং তিনি ব্যর্থ হবেন। অথচ আমরা আর একটি ব্যর্থতার ভার বহন করতে পারি না, ট্রাজেডি এখানেই।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.09.29-bichitra-1.pdf” title=”1978.09.29 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!