You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতীয়তাবাদী দল | যবনিকা কম্পমান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮

‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট…..’ জেনারেল জিয়া বিচিত্রার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এদেশের পেশাদার রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে। তখন তিনি নির্বাচন প্রচারণায় ঝটকা সফরে বেরিয়ে দেখেছিলেন জনগণের উদ্দীপনা। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নেতা হিসেবে সাক্ষাৎ করেছিলেন অসংখ্য নেতা উপনেতার সঙ্গে। জনতার সমুদ্রে অবগাহন করে, নেতৃবৃন্দের ক্ষুদ্রত্ব সম্পর্কে ধারণা করে, জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখেই কথাটা বলেছিলেন বলে আমাদের ধারণা। কথাটার মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আছে, আত্মবিশ্বাস আছে— সবচে বেশী যা আছে তা হলো স্থিতাবস্থা বদলে দেয়ার আশ্বাস।
রাজনীতি এদেশের নেতাদের কাছে শখের খেলা। কোন আইনজ্ঞের পসারের জন্যে বসার ঘরে লোক জামায়াতের চাতুরী, কোন মিডলম্যানের তোপখানা রোডের প্রাসাদ যাওয়া আসা করার সুব্যবস্থা, বেকারের অবসর যাপন, অসামাজিক ব্যক্তি ক্রিয়াকলাপ আইনের বাইরে রাখা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নীচু স্তরে টাউট তৈরী, এলিট নির্মাণ। এই রাজনীতির বিরুদ্ধেই জেনারেল জিয়া লড়াই করতে চেয়েছিলেন। বিচিত্রা জেনারেল জিয়ার দু’বার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। তার প্রতিটি কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলেন— তাহলোঃ রাজনীতিকে মানুষের কাছে নিতে হবে। জনগণের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ চিরন্তন পেশাদারী নেতৃত্ব থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে জনগণের হাতে দিতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার।
এই জনগণ কারা?
এই জনগণ প্রতারিত, উপবাসী, কর্মহীন ভূমিদাস, কৃষক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অশিক্ষিত নিরক্ষর জনগণ। এরা আলেফ মিয়া, কদম আলী, বাসন্তী, দুর্গতি। আধুনিক সভ্যতা তাদের দু’বেলা ভাতের সমাধান দিতে পারেনি, চিকিৎসা দিতে পারেনি, এরা বন্যায় ডোবে, ঝড়ে মরে, মহামারি- দুর্ভিক্ষে প্রাণ দেয়। এরা উৎপাদক— এদেশের একমাত্র উৎপাদক শ্রেণী। এবং একজন এক ভোটের অধিকারী। এই একটি ভোটের জন্যে এদেশে ‘হক সাহেব’ জন্ম নেয়। এরা কে জানে হক সাহেব কার কার সঙ্গে কোয়ালিশন করেছিল? এরা লীগে ভোট দিয়ে পাকিস্তান কায়েম করেছিল। গোলাম মোহাম্মদ ইস্কান্দার মীর্জাদের ষড়যন্ত্রের কথা এরা কি জানে? হারিকেন এরা নিভিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু যুক্তফ্রন্টের আবু হোসেনী বাদশাহী, আতাউরের ওজারতির সব রস-রসিকতা থেকে বঞ্চিত। ওয়েষ্ট মিনিষ্টার সৃষ্ট পার্লামেন্টের সব রস থেকেও ওরা বঞ্চিত। ওসব রসের মানে ওরা বোঝে না।
পার্লামেন্টের টীকাটিপ্পনী না বুঝলেও নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার উত্তর দেয় নেতা নেতৃত্ব দেয়ার আগেই জনগণ এগিয়ে আসে। নিজেরাই নেতা নির্বাচন করে নেয়। এসেম্বলী/পার্লামেন্টে ৫০ সালের দিকে ভাষার প্রশ্নে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ যখন তার নির্বাচনী এলাকার অভিমত ব্যক্ত না করে ‘জাতির পিতার মুখ পানে চেয়ে থাকে তখনও গণতন্ত্র কোথায় থাকে? ওয়েষ্টমিনিস্টার তখন হয় ঢাকার রাজপথ। বরকত-সালামের বুকের রক্ত অন্য ভাষায় গণতন্ত্রের ধ্বজা তুলে ধরে। ৫৪ সালের নির্বাচনে রক্তের ঋণ শোধ করেছিল জনগণ— নেতাদের একত্রিত করেছিল মোহমুক্ত করেছিল জনগণ। নেতারা ডালেসের নীল নকশার শিকার হয়, মেতারা পার্টি ভেঙ্গে নেতা হয়, সরকার ভাঙ্গায় জন্যে নেতারাই মারামারি করে এসেম্বলিতে। নেতারা পার্লামেন্টের বিতর্কে মুখের কথায় শতকরা ১৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে ফেলেন।
ভোটাভুটি, গণতন্ত্র ইত্যাদি জনগণের স্তরেই শেষ। মারামারি জনগণের কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়, নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্যে। নীতির লড়াই নয় গং-এর লড়াই। আয়ুবী আমলের অবসানে হয় কত নেতা কত দল করলো, দলত্যাগী হলো— একবার কোন নেতার দৌলতে মন্ত্রী হয়ে পদাধিকার বলে নেতা হয়ে বসলো, নত্যু দল খুললো। যখন জনগণ রাজ পথে নামলো তখন শুরু হলো কে যাবে গোলটেবিলে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা। ছাত্র জীবন দিলেন, শিক্ষক জীবন দিলেন, কৃষক জীবন দিলেন, তাদের রায়ে নেতারা বসলেন মৃত লাশের ওপর গোল টেবিলে। জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে ম্যান্ডেট দেয়— নেতারা বসেন আলোচনায়, জনগণ নিজ নেতৃত্বে যুদ্ধে নামেন— নেতারা গোলটেবিলের পথ খোলা রাখেন।
এদেশের মানুষ আত্ম সচেতন, দৃঢ়চেতা। কোন নেতা তাদের নেতৃত্ব দিতে পারেনি, নিজেরাই নেতা তৈরী করে নিয়েছে। কিন্তু নেতা জনগণের নেতা না হয়ে পদাধিকারে নেতা হয়ে নেতৃত্ব হারিয়েছেন। কিন্তু নেতারা এই হারানোর সংবাদটি জানেন না। সে জন্যে জনৈক সোলেমান নেতা, জনৈক আলীম বা মতিনও নেতা। কারণ কথিত আছে তিনি অর্থবলে একদা নির্বাচনে জিতেছিলেন বা হেরেছিলেন। নেতা না হলে ক গণতন্ত্র আসে না? অথবা গণতন্ত্র নেতারাই তৈরী করে? অথবা গণতন্ত্রই নেতা তৈরী করে?
তৃতীয়টাই হয়তো ঠিক। এর প্র্যাকটিস এদেশে কম করে হলেও হয়েছে। তিনবার নেতা নির্বাচন করবার সুযোগ পেয়েছিল জনগণ কিন্তু ‘তিনশ’ আসনের সবাই এসেম্বলিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নেতা হয়ে যান। ‘স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধি’ কথাটা মনেও হচ্ছে শেষ হয়ে যায়। আফ্রিকার কেনিয়াত্তা মারা গেলে তার জীবনী প্রকাশিত হয়েছিলো এখানে সেখানে। তিনি তাঁর জনগণের সামনে স্বাধীনতা যুদ্ধের বক্তব্য রাখতেনঃ ‘সাহেবরা এলো আমাদের কাছে শুধু বাইবেল নিয়ে। আমাদের ছিল ভূমি— ওদের বাইবেল। ওরা আমাদের হাতে বাইবেল দিয়ে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে বললো। আমরা প্রার্থনা করলাম। কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম বাইবেল আমাদের হাতে আছে ঠিকই কিন্তু ভূমির দখল তাদের। আমাদের দেশে ইংরেজরা বাইবেল নিয়ে আসেনি। এসেছিল কোম্পানীর সওদাগরি জাহাজ নিয়ে। ওরা এখানে বাইবেল নয়— এদেশে দিয়ে গেছে লাল ফিতে-ফাইল,মগজে ঢুকিয়ে গেছে গণতন্ত্র। অর্থাৎ বিতর্ক প্রতিযোগিতার আইন-কানুন। সেজন্য জেনারেল জিয়া যখন বলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট’ তখন আশাবাদী হই।কারণ চিরায়ত স্থিতি থেকে আমরা অন্য দিকে যাবো। কিন্তু কোন দিকে? অবশ্যই গণতন্ত্রের দিকে।

।। ২৷।

প্রতিনিয়ত উৎসারিত হচ্ছে গণতন্ত্রের কথা। নির্বাচনের কথা। নির্বাচনের কথা। নেতারা এরই মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে নির্বাচনী এলাকা। আঞ্চলিক এলিটদের দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরে নেতার বাড়িতে। নেতাদের পোষ্যরা পালে হাওয়া দিচ্ছে। নেতা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন দলে যোগ দেবে। ‘জিয়া সাহেবের দলে লাইন বেশি টিকেট পাওয়া যাবে না।’ দল পছন্দ না হলে নেতা নতুন দলই খুলবেন। এদেশের নেতা আছে। কিন্তু নীতি নেই, রাজনীতি নেই। যার জন্যে নেতারা মৌখিক তরবারীর খাপ। অভাব শুধু তরবারীর। নেতারা আছেন, দন নেই। নেতারা কিসের নেতা? কীভাবে নেতা? জনগণ তাদের নেতা বানিয়েছেন?
নেতারা একদা মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন বা এম,এন,এ ছিলেন সে জন্যেই নেতা। পদাধিকার বলে এরা নেতা। খবরের কাগজে এদের নেতা বলে উল্লেখ করা হয়। এদের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এরা কাগজে কাগজে তর্ক করেন। পার্লামেন্টে নির্বাচিত হলেও তাই করবেন। পার্লামেন্টে এই বিতর্কের বিষয় কি হবে? হবে কোন মন্ত্রী মশায় কত গ্যালন পেট্রোল পুড়িয়েছেন, কে কটা বাড়ি বানিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এসব নিয়ে আলোচনায় কদম আলীরা আলেফ মিয়ারা কি পাবে? আলেফ মিয়ার প্রতিনিধি আলেফ মিয়াকে ভোটের অধিকার দিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চলছে। এক নেতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ৩রা জুনের আগে জনসাধারণের ভেতর যে উদ্দীপনা-আশা দেখা গিয়েছিল তা হঠাৎ সংকুচিত হয়ে এলো কেন? জনগণের মনে আবার সংশয় দেখা দিয়েছে— কিন্তু কেন? নেতা বললেন ভোট নিয়ে মাঠে নামলেও জনগণ চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
কথা মিথ্যে নয়। একটা ভাল চলচ্চিত্র নির্মিত হলে সারা দেশে তান্ডব লেগে যায়— এ তো ভোট অধিকার! কিন্তু ভোট তো শেষ হবে, আবার কি জনগণের আশাকে সঙ্কুচিত করতে হবে? তাকে অপেক্ষা করতে হবে, রুদ্র রোষে সব ভেঙ্গে চুরে করে আবার একজন নায়ক নির্মাণ করার জন্য? ভোটে নয়, জনগণের মহান রোষে পেয়েছিল ভাষা, পতন হয়েছিল আইউব খানের, সৈনিকরা নেতাহীন জনগণের সঙ্গে নেমে এসেছিল ৭১ সালে। জনগণের নির্মিত নায়ক হয়েছিল ইতিহাসের পুতুল রাজা। পুতুল নাচের ইতিকথার অবসান কোন নেতা ঘটাতে পারেননি, ঘটিয়েছিল যারা তারা জনগণের নীরব ইঙ্গিত পেয়েছিল। ৭ই নবেম্বরেও ইতিহাস অন্যভাবে চলেনি। এই তারিখে একাত্তরের নায়ককে জনগণই বের করে এনেছিল রাজপথে। জনগণই ম্যান্ডেট দিয়েছিল জেনারেল জিয়াকে। জেনারেল জিয়া জনগণের সর্ব শেষ নির্মাণ।

।। ৩।।

যে জনগণ নেতা নির্বাচন করেছে ৭ ই নবেম্বরের জাগরণে, ৩রা জুনের নির্বাচনে, তাদের দাবী তিনটিঃ অন্ন, বস্ত্র ও আশ্রয়। দান খয়রাত নয়, তারাই উৎপাদক শ্রেনী, একমাত্র উৎপাদক শ্রেণী— তারা নেতৃত্ব চায়। তাই জেনারেল জিয়া যখন নতুন পার্টির কথা বলেন আমরা আশান্বিত হই, নতুন রাজনীতির কথা যখন বলেন, নতুন নেতৃত্বের কথা যখন বলেন জনগণের আশা বেড়ে যায়। জনগণ নেতা নির্ধারণ করেছে, নেতা যদি বহিরাগত হতেন, যদি ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে ক্ষমতায় আসতেন তবে সমস্যা ছিল না। সমস্যা হচ্ছেঃ তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশের সবচে শক্তিশালী অংশ সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যুক্ত থেকে তাদের অংশ এবং জনগণের নেতা। সমন্বয় সাধনকে আপাতকালীন সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে সব সময়। জনগণকে দেখছেন সেই সঙ্গে নেতাদের। জনগণের ক্ষমতায় বা অধিকারে বিশ্বাস রেখেও অন্যান্য সাহচর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছেন না।
সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়াই তার কাছে মূখ্য। পুরানো নেতৃত্বের ধারণা ভাঙ্গতে চান, ভাঙ্গতে চান সামাজিক বিন্যাসের স্থিতাবস্থা। দেশের মূখ্য শক্তি সমূহের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তার সঙ্গে রয়েছে জনসমর্থন। রাজনীতির অধিকার যদি হয় শ্রেবি সংগ্রাম তবে তাকে অবশ্যি বাছাই করতে হয় কোন শ্রেণীর নেতৃত্ব দেবেন। অবশ্যিই সেই শ্রেণী হবে গ্রামীণ উৎপাদক শ্রেণী। ব্যক্তিগত দ্বন্দকে ঝেড়ে ফেলে নয় বরং সমাধান করেই এগিয়ে আসতে হবে তাঁকে। দেশের মূখ্য শক্তির অংশীদার, অথবা নিয়ন্তা হিসেবেই জেনারেল জিয়া রাজনীতির কথা বললেন। জনগণের রাজনীতির কথা বললেন। কারন সামরিক প্রধান হলেও তিনি জনগণের সৃষ্ট নায়ক। দু’ দু’বার তিনি এসেছেন অভ্যুদয়ের (অস্পষ্ট) জন্যেই এসেশ কয়েক বছরের জন্যে শাসন শুরু (অস্পষ্ট)
কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন।
একজন সামরিক নায়কের পক্ষে রাজনীতি ক্ষেত্রে এই (অস্পষ্ট) সাহসী বলতেই হবে। কারণ এখানে তিনি নবাগত৷ নবাগত (অস্পষ্ট) তিনি সাহস পেয়েছেন যুদ্ধে ও পরবর্তীকালের ৭ই নবেম্বরঃ তিনি সাহসের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে জনগণের কাছে এসেছেন।
এসেছেন ধাপে ধাপে।
প্রতিটি ধাপ ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার এক একটি রাজনৈতিক নিরীক্ষা ৭৫ সালে ‘বাকশাল’ গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক যে স্বাভাবিক স্রোতধারা রুদ্ধ হয়েছিল তার বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ ছিল পিপিআরের মাধ্যমে সীমিত রাজনৈতিক কর্মকান্ড সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল সীমিত রাখাও ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। পুরনো দলের প্রায় প্রত্যেক নেতাই হাজির হলেন এক একটি দল নিয়ে রুদ্ধদ্বায়ের রাজনীতিতে রাজবীতির ষড়যন্ত্রই বড় হয়ে দেখা দিল। শুরু হল বিভাজনের রাজনীতি।পি পু আরের অধীনস্থ দলগুলো ভাঙ্গতে শুরু করলো একে কে।
এ সময় জাগদল গঠিত হলো। (অস্পষ্ট) গঠনের পরও তিনি রইলেন দূরে। জাগদলের কার্যক্রমও ছিল তার নিরীক্ষা। জাগদল গঠনের আগেই ১৯৭৭ সালের বিজয় দিবসের ভাষণে তিনি একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা দূর্নীতির উর্ধে, যারা সুযোগ সন্ধানী নন শুধু তারাই এ ফ্রন্টের শামিল হতে পারবেন। কিন্তু ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ বহুত হয় সে সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের অনীহার কারণে। এর পরই উদ্যোগ নেয়া হয় এই রাজনৈতিক দল গঠনের।
‘জাগদল’ গঠনের পর তার স্বরূপও উন্মোচিত হল দলের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে। ইতিমধ্যে ৩ রা জুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। পুনরায় নিজস্ব চিন্তাধারার সংগঠনের অভাব বোধ করলেন তিনি। গঠন করলেন ফ্রন্ট। বিচিত্রার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি উৎপাদনের রাজনীতির কথা বলেছিলেন। ফ্রন্ট গঠন করে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী সফরে তিনি প্রথম জনগণের গণতন্ত্র, উৎপাদনের রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী ও বিদেশীদের অনুচরদের বিরুদ্ধে জনগণকে একত্রিত হতে আহ্বান জানালেন।
৩রা জুনের নির্বাচনে দেশের ও জনগণের মধ্যে সাড়া আসে। তাঁরা চিহ্নিত করে কারা তাঁদের শত্রু। প্রত্যক্ষ শত্রুদের চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট রায় প্রদান করে তাঁদের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরোক্ষ শত্রু তখনও অচিহ্নিত থেকে যায়।
নেতৃত্বের বিভেএ তখনও স্পষ্ট। জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলেও নেতৃবৃন্দ নেমে এলেন আকাশচারী বাক বিতণ্ডায়। প্রতিযোগিতায় নামলেন কে বড় নেতা কার দল শক্তিশালী তা প্রমাণের জন্য। ফ্রন্টের সকল শরীকদল মিলে একদল গঠনের বিতর্ক জমে উঠলো। জনগণ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন রাজনীতি থেকে। একটি মাত্র ব্যক্তির জনপ্রিয়তার অংশীদারি নিয়ে কেউ বললেন, তাঁর দল এশিয়ার বৃহত্তম দল। ফ্রন্টের কর্মসূচী ত তাঁর দলেরই কর্মসূচী। কাজেই তাঁর দলেই সবাইকে যোগ দিতে হবে। কেউ বললেন, নতুন একটি দল হবে যাতে মিলিত সকল দলের অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। কেউ বা মত প্রকাশ করলেন, ফ্রন্টের পক্ষে, নতুন কোন দল গঠনের বিপক্ষে। কিন্তু দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য অন্য কিছু ঘটলো না, বিকশিত হলো না, কারন সবার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন একটি মাত্র ব্যক্তিত্ব। বাকীরা প্রায় সত্বাহীন অবয়ব।
সে জন্যে নতুন দল হলে দেখা গেল যারা নতুন দল গড়ার বিপক্ষে তাঁরাই সবার আগে ভিড়লেন। নতুন দলে এলেন রাজনীতিতে অচেনা অথবা পরিত্যক্ত আরো বেশি কিছু ব্যক্তি।
কোয়াসি এবং পেশাদারী রাজনীতিবিদরাই পুনরায় ভিড় জমালেন বেশী করে। (অস্পষ্ট) ন্যাপের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বিচত্রার (অস্পষ্ট) সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ফ্রন্ট সচেতন থাকলে সরকার (অস্পষ্ট) সর্বশেষ সরকার যা রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে সক্ষম (অস্পষ্ট) অন্যথায় আর এক বাকশালের পুনরুত্থান ঘটবে।’ নতুন দল (অস্পষ্ট) যখন চলছে তখন মশিউর রহমানই ফ্রন্ট ভেঙ্গে এক দল গঠনের ব্যাপারে সোচ্চার হলেন। বাঁধা রিলেন জাগদলের আয়কর বিচারপতি আবদুস সাত্তার সহ অনেকেই। বিচারপতি সাত্তার জাগদলকে বৃহত্তম দল হিসেবে ঘোষণা করে কর্মীদের প্রতি আদেশও দিয়েছিলেন জাগদলকে গ্রামপর্যায়ে সম্প্রসারিত করার জন্য। জাগদলের অন্য একজন নেতা এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন তখন নতুন দল গঠনের পক্ষে। নতুন দল গঠনের পর এরা সবাই নতুন দলে যোগ দিলেও কারো কারো মনে ক্ষোভ রয়েছে। নতুন দল গঠনের বিরোধী কিন্তু ফ্রন্টের পক্ষপাতী দু’জন নেতা ইউপিপি’র কাজী জাফর আহমদ এবং ভাসানী ন্যাপের আনোয়ার জাহিদ। এরা এখনও মনে করেন ফ্রন্টই ভাল। নতুন দল মতের গরমিল থাকবে। কাজেই (অস্পষ্ট) থাকবে না।

।। ৪।।

জাতীয়তাবাদী দলের ৭৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে। আরো সদস্য নেয়া হবে এমন ইঙ্গিতও রয়েছে। এদের অধিকাংশই রাজনীতিতে চেনামুখ। কেউ বা রাজনীতিতে সদ্য আগত। আবার কেউ বা পরীক্ষিত। এদের মতের ভিন্নতাও অজানা নয়। দেশে যখন বিভাজনের রাজনীতির খেলা চলছে তখন ফন্ট ভেঙ্গে একটি দল গঠন (অন্যান্য বিরোধী দলের স্বীকৃতি দিয়েও) নিশ্চয়ই কাম্য। একটি বৃহত্তর দল এবং দেশের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কমে যাক এটাত জনগণেরই কাম্য। জাতীয়তাবাদী দলের মত শক্তিশালী বিরোধী দলের সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে।
কিন্তু নতুন দল গঠনের লক্ষ্য রাজনৈতিক দল সীমিত করণ হলেও তা এখনও সম্ভব হয়নি। ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ নিয়ে যে দল ভাঙ্গা-ভাঙ্গির সূত্রপাত হচ্ছিল নতুন দল গঠনের পরেও তাতে ভাটা পড়েনি। বরং আরো ভাঙ্গছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। কোন কোন দল আবার একান্তই ব্যক্তিগত সংগঠন। অথচ ৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় ঐক্যের শ্লোগানই ছিলো প্রধান ও (অস্পষ্ট)। অথচ দলগুলো ভাঙ্গছেইম রাজনীতিতে এ স্ববিরোধিতা কেন?
এ স্ববিরোধিতার মৌল কারণ নিহিত রয়েছে দেশের সামাজিক কাঠামোয়। উৎপাদক শ্রেণী থেকে রাজনীতিবিদরা বিচ্ছিন্ন সে জন্য রাজনীতিও বিচ্ছিন্ন। যারা দল ভাঙ্গছেন তাঁরা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক শ্রেণী। এরা সমাজের পরগাছার মতই। শোষণের প্রতিযোগিতা ও পরগাছা শ্রেণী নিয়ে পাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে একই দ্বন্দ্বে মতভিন্নতা দেখা দেবে। দলত্যাগী হবে না ব্যক্তি স্বার্থের কারণে।

।। ৫।।

৩রা জুনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদাই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে এদেশের মাটি থেকে বিদেশী সেবাদাসদের রাজনৈতিকভাবে সমূলে উৎপাটনের আহ্বান জানানো হয়েছিলো। জনগণ সে আহ্বান উপেক্ষা করেনি। বরং ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং তাঁদের এসেশাইয় অনুচরেরা রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু মাথা চাড়া দিচ্ছেবন্য এক সাম্রাজ্যবাদ ও তাঁদের অনুচরেরা। এরা উভয়েই এদেশের কোটি কোটি কদম আলাই আর বাসন্তীদের শত্রু। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে পরাজিত শত্রুরাও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ষড়যন্ত্র চলছে চার দিক থেকে।
প্রেসিডেন্ট জিয়া সৎ এবং দেশ-প্রেমিক ব্যক্তিদের নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনিই বলেছেন, জনগণের কাছে ক্ষমতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। ক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাঁধা আসা অবশ্যম্ভাবী। এ বাঁধা আসবে ভিতর থেকে এবং বাইরে থেকে। সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে চলছে, রাজনীতিতে একই প্রক্রিয়া যখনই কোন জাতীয়তাবাদী নেতা জনগণের কাছে যেতে চেয়েছেন তিনি বাঁধা পেয়ে ফিরে গেছেন নয় জীবন দিয়েছেন।
তৃতীয় বিশ্বের গরীবতম দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী কিন্তু অসহায়। তার নেতা নির্বাচন করে সংগ্রামের গতিধারা থেকে সেখানে চাপিয়ে দেয়া কিছুই তারা গ্রহণ করবে না। ইতিহাসের এই পর্যায়ের নেতা তারা নির্ধারণ করে দিয়েছে— নেতা তাদের নেতৃত্ব দেবে। নেতা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে বা নেতৃত্ব প্রাসাদের ষড়যন্ত্রে বন্ধ হলে আবার আক্রোশে ফেটে পড়বে। সে জন্যে জেনারেল জিয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার রাজনীতি নেতৃত্বে সহযোগী হবে (অস্পষ্ট) কারা এগিয়ে আসবে নতুন রাজনীতির সহযোগী হিসেবে। বিচিত্রার এই নিবন্ধ ডিসেম্বর-নির্বাচনের উপক্রমণিকা। এর সঙ্গে সংযুক্ত হলো জাতীয়তাবাদী দল কেন্দ্রীক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতৃবৃন্দের অভিমত।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.09.29-bichitra.pdf” title=”1978.09.29 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!