ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্ব | আতিউর রহমান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
কিছুদিন আগে বিচিত্রা ফোরামের সদস্যদের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্ব বিষয়ের উপর এক জরিপ চালানো হয়। বর্তমান নিবন্ধ এই জরিপের ওপর ভিত্তি করেই তৈরী হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী বিচিত্রা ফোরামের সদস্যদের মধ্যে আছে মাসুদুল হক, মোকাদ্দেম খান, আবদুল কাদির, মনজুরুল আহসান, সিরাজুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, মাহমুদুল হক মানিক, নার্গিস আখতার, সোহরাব হোসেন, আবদুস সাত্তার, মোজাম্মেল হক, এম, এ করিম, সোহরাব আলী, এম, এ জলিল, মোস্তাফিজুর রহমান, কবির আহমেদ, গোলাম মোস্তফা মজুমদার, হেলালউদ্দীন আহমেদ, রওসন আরা রেবা, বাবুল চৌধুরী, ফারুক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আজিজ হোসেন, খায়রুল আনাম, সুলতান আহমেদ, মোকসেদ আলী, সুনীল, আরিফ, জালাল আহমেদ, রুহুল কুদ্দুস টিটো, চৌধুরী আমির হোসেন, সি হক, রনজিৎ কুমার দেবশর্মা, মির্জা মোকলেসুর রহমান, ফখরুদ্দিন আহমেদ, আবদুল মালেক সরকার, নাসির উদ্দিন খান, দেবনাথ এবং আরো অনেকে। এ ছাড় তথ্য সুবিন্যস্ত করতে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ, শ্যামল, অতুল মাহমুদ ও সিদ্দিক। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
– সম্পাদক, বিচিত্রা।
————
অনুন্নত দেশগুলোতে এরকম একটা সচেতনতা এসেছে যে, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন ধরণের উন্নয়ন মুখী তৎপরতা সক্রিয় রাখা সম্ভবপর নয়৷ একই সঙ্গে এসব দেশের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করেছেন যে, গ্রাম পর্যায়ে সক্রিয় সংগঠন গড়ে না তুলতে পারলে জনগণকে উন্নয়নে একাত্ম করা যাবে না। বাংলাদেশেও এ ধরণের সচেতনতা রয়েছে। স্থানীয় সরকার কিংবা গ্রামীণ প্রশাসনের কথা এ দেশের মানুষ অনেক তিন দিন ধরেই শুনে আসছেন৷ বিশেষ করে ষাটের দশকে আয়ুব খানের বুনিয়াদি গনতন্ত্রের হাঁক-ডাক দেশবাসী শুনেছিলেন৷ কিন্তু বুনিয়াদি গনতন্ত্রের বুনিয়াদ যেহেতু গ্রামীণ ক্ষমতাবান অংশের মধ্যেই ছিল, আমলাতন্ত্রে আওতায় গড়ে ওঠা তৎকালীন ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠান তাই জনগণের চোখে ‘শোষকদের আখড়া’ বলেই বিবেচিত হয়েছে। উনসত্তরের গণরোষের স্বীকার তাই অধিকসংখ্যক বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক রাই হয়েছিল। আশা ছিল রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশে পুনরায় ‘কুলাক ক্লাব’ গড়ে উঠবে না। কিন্তু প্রথম রিলিফ কমিটি এবং পরবর্তী কালে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আবার বুনিয়াদি গনতন্ত্রের নতুন সংস্করণ গড়ে উঠল গ্রাম বাংলায়। দূর্নীতির আখড়া বলে পরিচিত এ সব গ্রামীণ সংস্থার মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় দলীয় এজেন্টদের সুবিধা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপর আসে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন। জনগণের আশা ভরসা আবারও কিছুটা সচল হয়। তাদের ধারণা হয়েছিল, এবার হয়তো সত্যি সত্যিই জনগণ উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণকারী অংশ হিসেবে স্বীকৃত হবে। আবারও স্থানীয় প্রশাসন জোরদার করার কথা উঠলো। গ্রামীণ উন্নয়ন নীতিমালা সরকারী পর্যায়ে এবার অধিক গুরুত্ব পেল। আরো জোরেসোরে গ্রামীণ উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়নের ডাক এলো। এক পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও হয়ে গেলো। নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বের উপর সামগ্রিক ভরসা রেখে এরপর থেকে সরকার একের পর এক গ্রামীণ উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে যাচ্ছেন, আমলাতান্ত্রিক মোহমুক্তি পুরোপুরি না ঘটলেও, উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ জনসম্মুখে বার বার বলে বেড়াচ্ছেন যে, স্থানীয় পরিষদ নেতৃবৃন্দই সত্যিকারের নেতৃবৃন্দ। এদের মাধ্যমেই ঘটবে গ্রামবাংলায় সত্যিকারের উন্নয়ন।
সরকার যখন নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বকে এমন প্রাধান্য দিচ্ছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জাগে, পারবে কি এই নেতৃত্ব জনগণকে সার্বিক উন্নয়নে সামিল করতে? এ কথা মনে রেখেই আমরা বিচিত্রা পাঠক ফোরামের সদস্যদের। সহযোগীতায় ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বের স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা করি। ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান নেতৃত্ব কি বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব থেকে ভিন্ন কিছু, এতে নতুনের সমাহার কতটুকু, এদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমতার উৎস কি, এদের শ্রেণী চরিত্র ও শ্রেণী সচেতনতা কেমন, এদের সাথে জাতীয় রাজনীতি এবং প্রশাসনের যোগসূত্র কেমন৷ দেশ এবং জাতির মৌলিক ঐতিহ্য, চরিত্র সম্পর্কে এরা কতটুকু সচেতন, সরকারের উন্নয়ন নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা কেমন, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির প্রয়োজনে মৌলিক সংস্কারে এরা সহযোগী না প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াবে – এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশা নিয়েই আমরা এই জরিপ পরিচালনা করি। ১১ টি জেলার ৬০ টি ইউনিয়নের একশ’ বত্রিশজন নেতৃবৃন্দের উপর আমরা এই জরিপ চালাই। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য / সদস্যা এবং চেয়ারম্যান এই জরিপের আওতায় ছিলেন। একটি নির্ধারিত প্রশ্নমালার অধীনে বর্তমান বছরের গোড়ার দিকে এই জরিপ বিচিত্রা পাঠক ফোরামের সদস্যরা পরিচালনা করেন। কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় না গিয়েই আমরা সরাসরি জরিপ থেকে সংগৃহীত ও সুবিন্যস্ত তথ্য পেশ করছি।
প্রাপ্ত তথ্যমালা
বিকাশমান গ্রামীণ নেতৃত্ব ও তাদের শ্রেণী বিন্যাস
১, বয়সঃ ৩০ থেকে ৫০ বছরের নেতারাই বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছেন ৬৪.৩৯%, একেবারে তরুণ নেতৃত্ব (৩০ বছরের নীচে) এসেছে ১৫.১৫%, পঞ্চাশ বছরের উর্ধ্বের নেতৃত্ব এসেছে ২০.৪৬%।
২, অভিজ্ঞতাঃ এই প্রথম বারের মতো মেম্বার/ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন এদের সংখ্যাই বেশী (৫৭.৫৮%)। দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ২৫.০০%, তৃতীয় বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ৯.০৯%, চতুর্থ বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ৬.০৬%, পঞ্চম বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ২.২৭%।
৩, শিক্ষাঃ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেম্বার/ চেয়ারম্যানের সংখ্যাই সর্বাধিক (৮১.৮২%)। এদের মধ্যে আবার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ৪১.৬৭%, প্রাইমারী শিক্ষায় শিক্ষিত ১৫.১১%, এস এস সি পাস ২৪.২৪%, এইচ এস সি পাস ৬.০৬%, গ্রাজুয়েট ৬.৮২%, পোস্ট গ্রাজুয়েট ৩.০৩%।
তাদের পিতাদের ৩৬ ৩৬% প্রাইমারী শিক্ষায় শিক্ষিত, ২৬.৫২% ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষিত, ৭.৫৭% মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিরক্ষরের পরিমাণ ২৯.৫৫%। তাদের পিতামহদের ৪৬.২১% ছিলেন প্রাইমারী শিক্ষায় শিক্ষিত, ১০.৬৯% ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষিত, ৩.০৩% মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত, ০.৭৬% উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৩৯.৩৯% নিরক্ষর।
৪, পরিবারের গঠনঃ পরিবারের গঠনের দিক থেকে বলা যায়ঃ ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে যারা বর্তমানে আছেন তারা সবাই বড় পরিবারের বাসিন্দা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা এদের স্বাভাবিক ধরণের চেয়ে বেশী। ১ থেকে ৪ জন সদস্য সংখ্যা রয়েছে ১৫.১৫% পরিবারের, ৫ থেকে ৭ জন সদস্য সংখ্যা রয়েছে ৪০.১৫% পরিবারের, ৮-১০ জন সদস্য সংখ্যা রয়েছে ২৫% পরিবারের, ১১-১৪ জন সদস্য সংখ্যা রয়েছে ১৪.৩৯% পরিবারের এবং ১৫ জনের উর্ধ্বে সদস্য সংখ্যা রয়েছে শতরা ৫.৩১ জনের পরিবারের৷
৫, জমির মালিকানা ধরণঃ আমাদের জরিপ অনুসারে, ধনী কৃষক এবং জোতদার শ্রেণীই ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে প্রধান্য বিস্তার করে আছে৷ সাড়ে সাত একরের উর্ধ্বে যদের জমির মালিকানা এমন মেম্বর/ চেয়ারম্যানদের সংখ্যা ৫৯.৮৫%। আরো বিস্তারিত ভাবে জমির মালিকানার তথ্যগুলো নিম্নের ছকে বিশ্লেষণ করা যায়ঃ
ছক – ১
ক্রমিক | জমির মালিকানা ধরন
(একর) |
মেম্বার / চেয়ারম্যান
সংখ্যা |
মেম্বার / চেয়ারম্যান
শতকরা হিসেবে |
প্রথম | ০০ | ৪ | ৩.০৩ |
দ্বিতীয় | ০.১ – ২.৫০ | ১০ | ৭.৫৮ |
তৃতীয় | ২.৫১ – ৭.৫০ | ৩৯ | ২৯.৫৫ |
চতুর্থ | ৭.৫১ – ১২.৫০ | ৩৫ | ২৬.৫২ |
পঞ্চম | ১২.৫১ – ২৫.০০ | ২৯ | ২১.৯৭ |
ষষ্ঠ | ২৫.০০ | ১৫ | ১১.৩৬ |
সব গ্রুপ মিলে | ১৩২ | ১০০.০১ |
উত্স: বিচিত্রা পাঠক ফোরাম সদস্য কর্তৃক সংগৃহীত
এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে বর্তমান নেতৃত্বের এই জমির সবটাই কি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া? এ প্রসঙ্গে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম যে, জরিপ কৃত ব্যক্তি যখন পরিবারের প্রধান হলেন, তখন তার কতটুকু জমি ছিল এবং সেই হিসেব থেকে আমরা দেখতে পারি এদের কে পরবর্তী কালে কতটা জমি হারিয়েছে বা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, প্রথম গ্রুপের ৪ জনের মধ্যে ৩ জন পরিবারের প্রধান হওয়ার সময় একই গ্রুপে ছিলেন এবং একজন উপরের গ্রুপে (০.১-২.৫০ একর) ছিলেন। অর্থাৎ একজন জমি খুঁইয়েছেন, দ্বিতীয় গ্রুপের (০.১-২.৫০ একর) – ১০ জনের মধ্যে ৬ জন একই গ্রুপে ছিলেন এবং বাকী চারজনের তিন জন তৃতীয় গ্রুপ (২.৫১-৭.৫০ একর) ও এক জন চতুর্থ গ্রুপ ( ৭.৫১-১২.৫০) থেকে এসেছেন। সেই অর্থে এই গ্রুপের চারজন জমি খুইয়েছেন। তৃতীয় গ্রুপের ৩৯ জনের মধ্যে ২৪ জন একই গ্রুপে ছিলেন, ৬ জন চতুর্থ গ্রুপে, একজন ষষ্ঠ গ্রপে (২৫ একরের উর্ধ্বে), ১ জন প্রথম গ্রুপ এবং ৬ জন দ্বিতীয় গ্রুপ থেকে এসেছেন। অর্থাৎ এই গ্রুপে ৭ জন জমি হারিয়ে এবং ৭ জন জমি লাভ করে এসেছেন। চতুর্থ গ্রুপের ৩৫ জনের মধ্যে ১৪ জন এই গ্রুপে ছিলেন পরিবারের প্রধান হওয়ার সময়, দু’ জন পঞ্চম গ্রুপ (৭.৫০-১২.৫০) থেকে জমি হারিয়ে এবং ১৭ জন তৃতীয় ও ২ জন প্রথম গ্রুপ থেকে জমি লাভ করে এই গ্রুপে এসেছেন। পঞ্চম গ্রুপে ২৯ জনের মধ্যে ১৯ জন একই গ্রুপে ছিলেন পরিবারের প্রধান হওয়ার সময়, একজন ষষ্ঠ গ্রুপ থেকে জমি হারিয়ে এই গ্রুপে এসেছেন এবং বাকী চারজন নিম্নবর্তী গ্রুপ গুলো থেকে জমি লাভ করে উপরে এসেছেন। সব শেষে ষষ্ঠ গ্রুপের ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ৮ জন একই গ্রুপে ছিলেন পরিবারের প্রধান হওয়ার সময়, বাকী সাতজন নীচের গ্রুপ থেকে উঠে এসেছেন।
শ্বশুরের জমিঃ সামাজিক উঠানামা
সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের জন্য জরিপ কৃত ব্যক্তিদের নিকট-আত্মীয়দের সম্পত্তি সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা উচিৎ। গ্রামবাংলায় যৌতুকের যে প্রথা, গ্রামীণ ঝগড়া, ফ্যাসাদের জনবলের যে গুরুত্ব, তাতে ধনী এবং প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজনদের ভূমিকা মোটেই গৌণ করে দেখা যায় না। বরং মামলা – মোকদ্দমা বা বেআইনী ভাবে জমি দখলে এই সম্পর্ক সর্বদাই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সে জন্য আমরা মেম্বার চেয়ারম্যান দের শ্বশুরের সম্পত্তির একটা হিসাব নিতে চেষ্টা করেছি। তাতে সামাজিক স্তরায়নে একটা উর্ধ্বমুখী প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি। নিম্নের গ্রুপের ব্যক্তিরা অধিক হারে উপরের গ্রুপের ব্যক্তিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে বলে আমাদের তথ্য থেকে ধরা পড়ে।
যেমন উপরের ছকের প্রথম গ্রুপের ৪ জনের ২ জন একই গ্রুপের ব্যক্তিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, একজন দ্বিতীয় গ্রুপে, একহন চতুর্থ গ্রুপে বিবাহ করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রুপের ১০ জনের মধ্যে ১ জন নেমে গিয়েছেন প্রথম গ্রুপে, তিনজন থেকে গিয়েছেন একই গ্রুপে এবং বাকী ৬ জন বিয়ে করেছেন তার চেয়ে উপরের গ্রুপে।
তৃতীয় গ্রুপের ৩৯ জনের মধ্যে ১৭ জন রয়ে গেছেন একই গ্রুপে, ৬ জন নেমে গিয়েছেন দ্বিতীয় গ্রুপে, বাকী ১৬ জন উঠে গিয়েছেন উপরের গ্রুপগুলোতে। চতুর্থ গ্রুপের ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র ৭ জন রয়ে গেছেন নিজের গ্রুপে, ১৪ জন নেমেছেন নীচের গ্রুপে, বাকী ১৪ জন উঠে গিয়ে বিয়ে করেছেন উপরের গ্রুপে।
পঞ্চম গ্রুপের ২৯ জনের মধ্যে ১০ জন থেকে গিয়েছেন নিজের গ্রুপে, ৯ জন নেমে গিয়েছেন নিম্নের গ্রুপে এবং ৯ জন উঠেছেন উপরের গ্রুপে। ষষ্ঠ গ্রুপের ১৫ জনের মধ্যে ৭ জন থেকে গিয়েছেন নিজের গ্রুপে, বাকী ৮ জন নেমে গিয়েছেন নীচের গ্রুপগুলোতে। এক কথায় বলা যায়, সামাজিক উঠানামার মধ্যে কৃষক পরিবারের (তৃতীয় গ্রুপ) সদস্যদের উপরের গ্রুপে বিয়ে করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী এবং এরাই এক পর্যায়ে ধনী কৃষক হয়ে যায়। ধনী কৃষকদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্যণীয়৷
সেই অর্থে বলা যায়, এবারে যারা ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে এসেছেন তাদের শ্বশুরেরা বেশীর ভাগই ধনী পরিবারের সদস্য ৫৪.৪৫%।
জমি লাভ/ লোকসান এবং নির্বাচন
শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ক নয়, স্থানীয় প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকার ফলেও এই জমি লাভ বা লোকসান ঘটতে পারে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিদিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে যুক্ত থাকলে, নির্বাচিত সদস্য / চেয়ারম্যানদের জমির মালিকানা বেড়ে যায়। আমাদের জরিপ থেকে দেখা যায়, ৪৭.৭৩% মেম্বার/ চেয়ারম্যান পরিবার প্রধান হওয়ার পর নতুন জমি লাভ করেছেন, ১৩.৬৪% জমি হারিয়েছেন, এবং ৩৮.৩৩% যেমনটি ছিলেন তেমনই আছেন। এর মধ্যে আবার যারা জমি লাভ করেছেন তাদের ৪৯.২% দুই বা তার অধিক বারের মতো ইউনিয়ন পরিষদে সদস্য / চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। যারা প্রথম বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন এবং জমি লাভ করেছেন তাদের পরিমাণ ৫০.৮%। জমি হস্তান্তর তথ্যে আবার আর একটি নতুন দিক রয়েছে৷ যাদের জমি পূর্ব থেকেই বেশী তারাই বেশী জমি লাভ করেছেন। যেমন যাদের জমি ২৫ একরের উর্ধ্বে এমন সদস্য / চেয়ারম্যানের ৫৩.৩৩% নতুন জমি লাভ করেছেন, ৭.৫১-১২.৫০ গ্রুপের সদস্য / চেয়ারম্যান দের ৫৩.১৩% নতুন জমি লাভ করেছেন, ২.৫১-৭.৫০ একরের গ্রুপের ৪২.৭২% এবং ০.১*২.৫০ গ্রুপের ২০% নতুন জমির মালিকানা পেয়েছেন। অর্থাৎ গ্রামীণ ক্ষমতাবান ধনিক শ্রেণীই বিভিন্ন উপায়ে নতুন জমির মালিক হচ্ছেন এবং একই সাথে স্থানীয় পরিষদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
৬, পেশাঃ পেশাগত দিক থেকে দেখা যায়, ৫১.৫২% মেম্বার/ চেয়ারম্যান কৃষিজীবী, ২৮.০৩% ব্যবসায়ী এবং ২০.৪৫% অন্যান্য (এর মধ্যে চাকরীজীবীরাও অন্তর্ভুক্ত)। জমির মালিকানার ধরণ হিসাব করলে ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান নেতৃত্বের পেশার বিস্তারিত বিবরণ দাড়ায় নিম্নরূপঃ
জমির মালিকানা ধরন (একর) | কৃষি কর্ম | ব্যবসায় | অন্যান্য* | মোট |
০০ | ২**
(৫০%) |
২
(৫০%) |
০
(০%) |
৪
(১০০%) |
০.১ – ২.৫০ | ২
(২০%) |
৫
(৫০%) |
৩
(৩০%) |
১০
(১০০%) |
২.৫১ – ৭.৫০ | ২১
(৫৩.৮৫%) |
১২
(৩০.৭৬%) |
৬
(১৫.৩৯%) |
৩৯
(১০০%) |
৭.৫১ – ২৫.০০ | ৩৪
(৫৩.১৪%) |
১৬
(২৫%) |
১৪
(২২.৮৬%) |
৬৪
(১০০%) |
২৫.০০ | ৯
(৬০%) |
২
(১৩.৩৩%) |
৪
(২৬.৬৭%) |
১৫
(১০০%) |
সব গ্রুপ মিলে | ৬৮
(৫১.৫১%) |
৩৭
(২৮.০৩%) |
২৭
(২০.৫৪%) |
১৩২
(১০০%) |
উত্স:পূর্বে উল্লেখিত জরিপ
* অন্যান্যের মধ্যে চাকরীও অন্তর্ভুক্ত
** ভূমিহীনরাও বর্গা নিয়ে জমি চাষ করে থাকে।
উপরের এই ছক থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে কৃষিকর্ম করেন এমন পেশার ব্যক্তিরাই এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্যবসা ক্ষেত্রে একটা প্রবণতা লক্ষণীয়, যাদের জমি কম তারাই এই পেশাতে অধিকসংখ্যক। অন্য পেশাতেও নিম্ন জমির মালিকরা ঝুঁকে পড়েছেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবীদের প্রাধান্য থাকায় চাকুরীজীবী দের (যেমন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক, ডাক্তার, কারিগর ইত্যাদি) ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য নয়৷ অথচ এই শ্রেণীর প্রাধান্য থাকলে ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে একটা গুণগত পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ছিল।
পূর্বপুরুষ ও শ্বশুরের পেশা
৭, জরিপকৃত মেম্বার/ চেয়ারম্যান দের পিতাদের ৮১% কৃষি কর্ম, ৬.০৬% এর ব্যবসায় এবং বাকী ১২.৮৮% অন্যান্য। পিতামহের ৮৬.৩৬% এর পেশা কৃষিকর্ম, ৫.৩০% এর ব্যবসায় এবং বাকী ৮.৩৪% এর অন্যান্য। তাদের শ্বশুরদের ৭৩.৬৪% এর পেশা কৃষিকর্ম, ১২.৪০% এর পেশা ব্যবসায় এবং বাকী ১৩.৯৬% এর অন্যান্য। এ থেকে একটা ঝোঁক স্পষ্ট, বর্তমান জেনারেশনের নেতৃত্ব অধিক হারে ব্যবসায়ে ও অন্যান্য পেশার দিকে যাচ্ছেন।
বাড়ীর গঠনঃ জরিপকৃত মেম্বার / চেয়ারম্যানদের বাড়ীর গঠনের যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যায় এরা বেশীর ভাগই ধনী ও সম্পদশালী শ্রেণীর আওতাভুক্ত। গ্রামে যাদের টিনের অথবা বিল্ডিং – এর বাড়িঘর রয়েছে, তাদেরকে কোনক্রমেই দরিদ্র পরিবার বলে গণ্য করা যায় না৷ অবশ্য দু একটি ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। আমাদের তথ্য মতে, ৪৩.১৮% সদস্য / চেয়ারম্যানদের টিনের বাড়ি, ১৯.৭০% এর বিল্ডিং, ১৯.৭০% এর টিন এবং ছন উভয় প্রকারের বাড়ি, ৬.৮১% এর টিন ও বিল্ডিং উভয় প্রকারের বাড়ি এবং মাত্র ১০.৬১% এর ছনের বাড়ি রয়েছে। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে আবার ৮০.৩০% সদস্য / চেয়ারম্যানের বাড়িতে বৈঠক খানা রয়েছে৷ অনেকের বাড়িতে মসজিদও রয়েছে৷ এসব কিছু প্রমাণ করে যে, এরা ঐতিহাসিক ভাবেই ধনিক শ্রেণীর সদস্য এবং ‘ঐতিহ্যবাহী ‘ নেতৃত্বের অংশীদার।
৮, কৃষি সরঞ্জাম
কি ধরনের কৃষি সরঞ্জাম রয়েছে তার উপর নির্ভর করবে এরা কি পরিমাণ কৃষি কাজে নিজেদের শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকেন। সে জন্য নিম্নের ছকটি উল্লেখ্যঃ
জমির মালিকানা ধরণ (একর) | মেম্বার / চেয়ারম্যান (সংখ্যা) | হাল
(সংখ্যা) |
গবাদি পশু
(সংখ্যা) |
পাম্প
(সংখ্যা) |
০ – ২.৫০ | ১৪ | ৯
[০.৬৪] |
৩৬
[২.৫৭] |
০
[০] |
২.৫১ – ৭.৫০ | ৪৯ | ৪০
[১.০২] |
১৫০
[৩.৮৪] |
৩
[.০৭৬] |
৭.৫১ – ২৫.০০ | ৬৪ | ১২৪
[১.৯৩] |
৫৬০
[৮.৭৫] |
২
[.০৩১] |
২৫.০০ | ১৫ | ৪২
[২.৮০] |
১৭৪
[১১.৬০] |
০ |
সব গ্রুপ মিলে | ১৩২ | ২১৫
[১.৬২] |
৯২০
[৬.৯৬] |
৫
[.০৩] |
উত্স: পূর্ব উল্লেখিত জরিপ
*বন্ধনীর তথ্য প্রতি পরিবারে প্রাপ্ত সংখ্যা।
উপরের ছক থেকে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদে এমন সব ব্যক্তি বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যদের গড়পড়তা (পরিবার পিছু ১.৬২ টি হাল রয়েছে, ৬.৯৬ টি গবাদি পশু রয়েছে এবং. ০৩ টি জলের সেচের পাম্প রয়েছে৷ নিঃসন্দেহে এ সংখ্যা জাতীয় পর্যায়ের গড় হিসাবের চেয়ে অনেক গুণ বেশী।
৯, মেম্বার / চেয়ারম্যানদের আয়ঃ
উত্তরদাতারা তাদের মোট আয় প্রকাশে প্রায়ই দ্বিধা প্রকাশ করেছেন বলে সাক্ষৎকার গ্রহণকারী ফোরাম সদস্য গণ জানিয়েছেন।
যদিওবা বলেছেন, তাও সত্যিকার আয়ের চেয়ে অনেক কম হবে বলে ফোরাম সদস্যদের ধারণা। উত্তর দাতাদের হিসেবে দেখা যায়, বছরে ৫ হাজার টাকার নীচে যাদের আয় তারা হলেন ১৭.৪২%, ৬৮.৯৪% উত্তরদাতাদের আয় পাঁচ থেকে ত্রিশ হাজার টাকার মধ্যে। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার আয় সম্পন্ন মেম্বার / চেয়ারম্যান দের পরিমাণ ১১.৩৭%, পচাত্তর হাজার টাকার উর্ধ্বে বার্ষিক আয় সম্পন্ন উত্তরদাতার পরিমাণ ২.২৭%।
১০. বাজারজাত উদ্বৃত্ত
উত্তরদাতাদের অধিকাংশেরই বাজারে উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রি করার মতো সচ্ছল অবস্থা রয়েছে। আমরা শুধু ধান এবং পাটের বাজারজাতকরণের হিসাব চেয়েছিলাম। যাদের জমি মালিকানা নেই, তাদেরও ৫০% বাজারে ধান-পাট বিক্রি করে (এরা বর্গাচাষী) এবং এদের ধান পাট বিক্রয়লব্ধ অর্থের পরিমাণ ১০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
০.১–২.৫০ একর গ্রুপের জমি মালিকদের ৫০% বাজারে বিক্রয় করে এবং তা থেকে প্রতিজনের অর্থ আমদানীর পরিমাণ এক থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
২.৫১-৭.৫০ একর গ্রুপের উত্তরদাতাদের ৬৬.৬৭% বাজারে ধান-পাট বিক্রি করে। এদের এই বাজারজাত উদ্বৃত্ত ১০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে৷
৭.৫১-২৫.০০ একরের উত্তরদাতাদের ৬০.৯৪% বাজারে ধান-পাট বিক্রি করে এবং এই খাতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ চল্লিশ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
২৫ একরের উর্ধ্বে যারা, তাদের ৭৩.৩৩% অংশই বাজারে ধান-পাট বিক্রি করে এবং এদের বেশীর ভাগই এই খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ এক হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা এবং দু’ এক জনের এক লাখ টাকার অধিকও হয়ে থাকে৷ সব গ্রুপের ৬২.৮৭% অংশের বাজারে উঠানোর মতো উদ্বৃত্ত রয়েছে।
১১, জমির ব্যবহারঃ বর্গাচায় এবং আধুনিক চাষ
গড়ে একজন মেম্বার / চেয়ারম্যানের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হচ্ছে ১১.৩৫ একর। এত জমি তারা নিজ হাতে চাষ করতে পারেন না। এর একটি বৃহৎ অংশ তাই তারা বর্গা দিয়ে থাকেন। বর্গার মাধ্যমে এক দিকে যেমন বিনা পরিশ্রমে তাদের জমি থেকে শস্য উঠে আসছে, অন্য দিকে গ্রামীণ নেতৃত্বকে সক্রিয় রাখার জন্য এক উল্লেখযোগ্য আনুগত্য তারা বর্গাচাষীদের নিকট থেকে পেয়ে থাকেন। মোট উত্তরদাতার ৪৬.২১% এই জরিপ মতে জমি বর্গা দিয়ে থাকেন এবং বর্গা দেয়া জমির পরিমাণ মোট জমির প্রায় ৩০.৬১%। এর মধ্যে আবার যাদের জমি ২.৫০ একরের উর্ধ্বে এবং ২৫.০০ একরের নীচে তারাই বেশী পরিমাণ জমি বর্গা দিয়ে থাকেন। প্রথমোক্ত গ্রুপের ৪৮.৫৩% জমি এবং শেষোক্ত গ্রুপের ৩৯.৩৬% জমিই বর্গা দেয়া হয়। মধ্য কৃষক শ্রেণী (২.৫১-৭.৫০) বর্গা দেয় ২৫.৭৩% জমি এবং ধনী কৃষক শ্রেণী (৭.৫১-২৫.০০ একর) জমি বর্গা দেয় ৪৮.১০% জমি। এ তথ্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, গ্রামবাংলায় বর্তমানে খুব একটা জমি নেই, অথচ এক শ্রেণীর রাজনৈতিক ও সামাজিক টাউট শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে, যারা সার্বক্ষণিক ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকাণ্ড সালিশ দরবার ছোট খাটো ব্যবসা করে বেশ আয় করেছে, এরাই জমি বর্গা দিয়ে দিচ্ছে৷ জোতদার শ্রেণী তো পূর্ব থেকেই বর্গা দিয়ে আসছে। ধনী শ্রেণীর বর্গা দেয়ার পরিমাণও সামান্য নয়। মধ্য শ্রেণী যে বর্গা দেয় তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে থাকতে পারে। অন্য ভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক আনুগত্য কিনে নেয়ার একটি প্রকাশ হলো বর্গা দেয়া।
আধুনিক চাষের প্রশ্নেও ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমাদের হিসাব মতে দেখা যায়, ৬৩.৬৪% অংশ সদস্য / চেয়ারম্যানই ইরি চাষের সাথে জড়িত। এদের মধ্যে আবার ৪২.৮৬% প্রজেক্ট লিডার হিসেবে জড়িত। যতই জমি বাড়তে থাকে ততই প্রজেক্টে তাদের নেতৃত্বের পরিমাণও বাড়তে থাকে। নিম্নের ছকটি সে দিক দিয়ে বেশ অর্থবহঃ
জমির মালিকানা ধরণ (একর)
(১) |
উত্তরদাতা সংখ্যা
(২) |
ইরি চাষকারী
উত্তরদাতা সংখ্যা (৩) |
ইরি চাষকারী (%)
(৪) |
মোট আবাদী জমি (একর)
(৫) |
ইরি চাষে দেয়া জমির পরিমাণ (একর)
(৬) |
ইরি চাসে দেয়া জমি (%)
(৭) |
প্রজেক্ট লিডকর সংখ্যা
(৮) |
প্রজেক্ট লিডার (%) হিসেবে
(৯) |
০০ | ৪ | ০ | ১০০ | ১০০ | ১০০ | |||
০.১ – ২.৫০ | ১০ | ৫ | ৫০ | ১৭.০ | ৪.৫ | ২৬.৪৭ | ১ | ২০.০০ |
২.৫১ – ৭.৫০ | ৩৯ | ২৮ | ৭১.৭৯ | ২০৩.৩ | ৫৪.৯ | ২৭.০০ | ১০ | ৩৫.৭১ |
৭.৫১ – ২৫.০ | ৬৪ | ৪২ | ৬৫.৬২ | ৮২৩.০ | ১২২.০ | ১৪.৮২ | ২০ | ৪৭.৬২ |
২৫.০০ | ১৫ | ৯ | ৬০.০০ | ৪৫৬.০ | ৫৩.০ | ১১.৬২ | ৫ | ৫৫.৫৬ |
সব গ্রুপ মিলে | ১৩২ | ৮৪ | ৬৩.৬৪ | ১৪৯৯.৩ | ২৩৪.৪ | ১৫.৬৩ | ৩৬ | ৪২.৮৬ |
উত্স: পূর্বোক্ত।
উপরের ছক থেকে দেখা যায়, আবাদী জমির মাত্র ৫.৬৩% অংশ ইরি চাষ করে এই নেতৃত্ব। কিন্তু প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে যান প্রায় সবাই৷ বিশেষ করে বেশী জমির মালিকরা। পঁচিশ একরের উপরে জমির মালিকরাই ৫৫.৫৬% নেতৃত্ব দখল করে আছে। অথচ তাদের ১১ ৬২% জমিতে ইরি চাষ হয়৷ এর অর্থ পরিষ্কার। শোষণের একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে এসব সেচযন্ত্র এসেছে তাদের কাছে৷ জমি পতিত রাখবেন অথবা চড়া হারে বর্গা দেবেন তবু তারা নিজেরা চাষ করবেন না। অনেক সময় তাদের জমি দিয়ে সেচের খালও কাটতে দিতে চান না। অথচ ইরি প্রজেক্টের নেতা হিসেবে তার ভাগ্যে জোটে মোবিলের একাংশ, সার বা ঔষধের একাংশ। একই সাথে জোটে গরীব চাষীদের ওপর পানি বন্টনের নামে চরম খবরদারীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। সমতার বলয়ে সৃষ্টি হয় এক অসম দ্বন্দ্ব।
১২, শ্রমিক ব্যবহার
উত্তরদাতাদের বেশীরভাগই কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। এদের মধ্যে বছর বাঁধা কামলা এবং দিন মজুর উভয় শ্রেণীর শ্রমিকই রয়েছে। এদের শতকরা প্রায় ৮০ জন বছর বাঁধা কামলা এবং শতকরা ৯০ জন দিন মজুর নিয়োগ করে থাকে। জমির মালিকানার পরিমাণ যতই বাড়তে থাকে, উভয় প্রকারের শ্রমিক নিয়োগের পরিমাণও বাড়তে থাকে। যেমন সাড়ে সাত একরের উর্ধ্বে যাদের জমি এমন মেম্বর / চেয়ারম্যানদের শতকরা ৮৭ থেকে ৯১ ভাগই বছর বাঁধা কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করেন এবং ৯৪ থেকে ১০০ ভাগই দিনমজুর নিয়োগ করে থাকেন। অথচ আড়াই একরের নীচে যাদের জমি তাদের শতকরা ৫০ জন মাত্র বছর বাঁধা কামলা মজুর রাখেন এবং ৮০ জন দিন মজুর খাটিয়ে থাকেন।
১৩, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক
উত্তরদাতাদের বেশীর ভাগই কোন না কোন গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠান গুলোতে ক্ষমতা ব্যবহার করেও অনেক সময় এসব নেতৃত্ব ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে থাকেন এবং পরবর্তী কালে এই ক্ষমতাকে আরো কুক্ষিগত করে থাকেন। আমাদের হিসাব মতে, জরিপকৃত সদস্য / চেয়ারম্যানদের ৮৭.১২% বর্তমানে স্কুল / মাদ্রাসা কমিটির প্রতিনিধি, ৭০.৪৫% মসজিদ কমিটিতে, ৩৬.৩৬% গভীর নলকূপ প্রকল্প কমিটিতে, ৬০.৬১% বিভিন্ন মুখী সমবায় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা ক্লাবের সাথে রয়েছেন ৫৭.৫৮%। এতে সুস্পষ্ট যে, কোন ধরণের গ্রামীণ সংগঠনই এসব নেতৃত্বের প্রাধান্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷
এসব কমিটি ছাড়াও এরা গ্রামীণ যে কোন বিচার বা সালিশে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এদের অনেকেই অনেক বছর যাবৎ গ্রামীণ পর্যায়ে মাতব্বরি করে আসছেন। আমাদের জরিপ অনুসারে দেখা যায়, মোট সদস্য / চেয়ারম্যানের ৯৭.৭২ % সালিশে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তন্মধ্যে ৭৫.৫৭% সমাজ পর্যায়ের সালিশে অংশগ্রহণ করে থাকেন, ৮৪.৮৪% গ্রাম পর্যায়ে এবং ৬২.৭৮% ইউনিয়ন পর্যায়ে সালিশ করে থাকেন।
এদের মধ্যে আবার ৩০.২৩% সদস্য /চেয়ারম্যান ১-৫ বছর যাবৎ সালিশে অংশগ্রহণ করে আসছেন, ৪৪.১৯% প্রায় ৬-১৫ বছর যাবৎ সালিশ-মাতব্বরি করে আসছেন এবং বাকী ২৫ ৫৮ % ২০ বছরের চেয়ে বেশী সময় নাগাদ সালিশ দরবার করে আসছেন।
এরা যে ঐতিহাসিক ভাবেই গ্রামীণ নেতৃত্ব দখল করে আছেন তা শুধু উপরের তথ্য থেকেই ধরা পড়ে। এ ছাড়াও তাদের পিতা এবং পিতামহসহ শ্বশুরের ক্ষমতার বিস্তৃতি লক্ষ্য করলে এ সত্যটি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ এদের পিতাদের ৬.০৬% অংশ স্থানীয় নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন, ৯.০৯% অংশ চেয়ারম্যান / ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন, ১৮.১৮% স্কুল/মাদ্রাসা কমিটিতে ছিলেন, ৬০.০৬% সালিশ-মাতব্বর ছিলেন, ১১.৩৬% স্কুল কমিটিতে ছিলেন। স্থানীয় পরিষদেও তাদের প্রতিনিধিত্ব ১০% এর কম নয়৷ তাদের শ্বশুর দের প্রায় ১৫.১৫% স্থানীয় প্রশাসনে ছিলেন এবং ৩৩.৩৩% বিভিন্ন কমিটিতে ছিলেন। মোটকথা, এদের অনেকেই কয়েক যুগ ধনে নেতৃত্বের শীর্ষ ভাগে রয়েছেন। আত্মীয়তার সুযোগেও এ ক্ষমতা আরো বলবান হয়েছে।
১৪, নির্বাচনী খরচ এ প্রচারে ব্যবহৃত জনবল
নির্বাচনে কে কত টাকা খরচ করলেন এবং নির্বাচনী প্রচারে কত জনবল ব্যবহার করলেন তার উপরে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি – তিনি কত বড় ‘ফ্যাকশন লিডার’ এবং কেমন সম্পদশালী। অন্য ভাবে দেখা যায়, এ খরচ তার আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং এ খরচ তিনি নির্বাচিত হয়ে জনগণের জন্য দেয়া সরকারী অর্থ থেকে ওসুল করবেন কি না। অবশ্য আমাদের ধারণা ছিল যে, সত্যি সত্যি একজন সদস্য / চেয়ারম্যান কত খরচ করেছেন তা তিনি বলবেন না। তবে আমরা এও ভেবেছিলাম যে, নিজেরটা না বললেও, অন্ততঃ নিকটস্থ প্রতিদ্বন্দ্বীর খরচের একটা মোটামুটি হিসেব তিনি বলবেন এবং একেক জন সদস্য / চেয়ারম্যানের নির্বাচনী খরচ এই দুইয়ের মাঝামাঝি অথবা প্রতিদ্বন্দ্বীর খরচের কাছাকাছি কোন অংকের হবে। সেই উপাত্ত মনে রেখেই আমরা উভয় পক্ষের খরচের হিসাব জানার চেষ্টা করেছি। তাদের হিসেব মতে, গড়পড়তা একজন বিজয়ী মেম্বার / চেয়ারম্যানের খরচ পড়েছে ১০,৯৬৯.১৭ টাকা এবং প্রতিপক্ষের গড়পড়তা খরচ পড়েছে ২২,২৭,০০ টাকা। আমাদের ধারণা, একজন বিজয়ী মেম্বার / চেয়ারম্যানের নির্বাচনী খরচ ও প্রতিপক্ষের খরচের কাছাকাছিই হবে৷ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যিনি জোগাতে পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে গ্রামীণ সমাজে সচ্ছল ব্যক্তি। যদি তা না হন, যদি ঋণ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে থাকেন, এ খরচের সুদ আসল নিশ্চয় তুলবেন তিনি জনগণের জন্য দেয়া সরকারী অর্থ থেকে।
এরা কেমন প্রভাবশালী ব্যক্তি তা তাদের নির্বাচনের প্রচার কাজে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বিচার করলেই ধরা পড়বে। গড়পড়তা একজন নেতার পেছনে ১৫৭.৫০ জন পড়সী, আত্মীয়, রাজনৈতিক সহযোগী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। এদের মধ্যে ২৯.২২% অংশের নির্বাচনী ২০০-২৫০০ ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছে ১৭.৭০, অংশের প্রচার ২৫-১০০ জন্য অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয়ী নেতৃত্বের ৫৩.০৮% অংশের প্রচারে ১-২৫ জনের মতো প্রচার কার্যে অংশগ্রহণ করেছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বের বহিঃসম্পর্ক (লিংকেজ)
১, রাজনৈতিক সম্পর্ক
রাজনীতির মতো নাজুক প্রশ্নে অনেক নেতৃবৃন্দই সরাসরি জবাব দিতে চাননি বলে আমাদের তথ্য সংগ্রহকারী গণ জানিয়েছেন। তবু প্রায় এদের ৪৮.৮৪% সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত বলে মত প্রকাশ করেছেন৷ ১৯৭১ সনের আগে নাগাদ এই ৪৮.৮৪% লর ৪৩.৭৫% আওয়ামী লীগ, ৪৩.৭৫% মুসলিম লীগ, ৪.৬৮% ভাসানী ন্যাপ, ১.৫৬% মোজাফফর ন্যাপ করতেন বলে জানিয়েছেন। পরবর্তী কালে এই তথ্যে অবশ্যই পরিবর্তন এসেছে। ১৯৭২-৭৫ সময়ে আওয়ামী লীগ করেন এমন নেতার সংখ্যা কমে ৩৯.০৬% এ দাড়ায়, মুসলিম লীগের পরিমাণ কমে ১৮.৭৫% এ দাড়ায়। ভাসানী ন্যাপের সংখ্যা কমে গিয়ে ১৮.৭৫% দাড়ায়। এ সময় রাজনীতি সচেতন অথচ দলগতভাবে নিরক্ষরের সংখ্যা দাড়ায় ২৯.৬৮%, জাসদ করেন এমন নেতার সংখ্যা তখন ছিল ৬.২৫%। পচাত্তরের পরে দ্রুতহারে নেতৃবৃন্দ দলীয় রাজনীতি ছেড়ে দেন এবং নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন। পচাত্তরোত্তরকালে আওয়ামী লীগ করেন এমন নেতার সংখ্যা দাড়িয়েছে ২৯.৬৮%, মুসলিম লীগ করেন ২০.৩১%, জাগদল ৪.৬৭%, ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপ করেন ১.৫৬%। নিরপেক্ষ ৪৮.৪৩%। রাজনৈতিক দিক থেকে বলা চলে এখনও গ্রামবাংলায় রক্ষণশীল রাজনীতির প্রাধান্য রয়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু হলেও মুসলিম লীগের প্রাধান্য ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বে বেড়েছে৷ বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব এসব প্রতিষ্ঠানে নেই বললেই চলে।
২, শহুরে আত্মীয়
নিকটস্থ থানা বা মহকুমা শহরে আত্মীয় আছেন এমন মেম্বার / চেয়ারম্যানদের পরিমাণ শতকরা ৫৪.৫৫% অংশ। দেশের যে কোন স্থানে উকিল / মেম্বার শ্রেণীর আত্মীয় রয়েছে ২১.২১% উত্তরদাতার, পুলিশ আত্মীয় রয়েছেন ২১.২১% উত্তরদাতার, সি ও আত্মীয় রয়েছেন ৬.০৬% উত্তরদাতার।
৩, স্থানীয় অফিসারদের সাথে সম্পর্ক
উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯৬.২১% স্থানীয় অফিসারদের (সি ও ; সি, এস, ডি, ও)নিকট গিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে আবার ১০% এর মতো প্রায়ই দেখা করেন অফিসারদের সাথে এবং বাকী ৯০% মাঝে মাঝে দেখা করেন।
৫৬.৮১% উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে, ও. সি, সি. ও সহ অন্যান্য অফিসারেরা মাঝে মধ্যে তাদের সাথে এসে দেখা করেন। ১৪.৩৯% জানিয়েছেন যে, স্থানীয় অফিসারদের অনেকেই তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন এবং তাদের বাড়ীতে রাত্রিও যাপন করেছেন।
স্থানীয় অফিসারদের সন্মন্ধে তাদের ধারণা কেমন তা জেনে নিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কি ধরণের সম্পর্ক তথা আতাত বিরাজ করছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তথ্য পেয়েছি যে, উত্তরদাতাদের ৯২.৪২% এর সাথে স্থানীয় সি. ও উন্নয়নের সম্পর্ক বেশ মধুর। ৮৬.৩৬% উত্তরদাতাই সি. ও উন্নয়ন সাহেবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন এবং বেশীর ভাগ সময়ে তাদের সাথে উক্ত কর্মকর্তার মতবিরোধ ঘটে না। মাত্র ২৮.৭৯% উত্তরদাতার সাথে সি, ও সাহেবের সামান্য মতাভেদ ঘটেছে বলে তারা জানিয়েছেন।
স্থানীয় তহশীলদার গ্রামীণ প্রশাসন কাঠামোতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অনেকেই বলে থাকেন যে, গ্রামীণ ক্ষমতাবান দের সাথে আঁতাত করে এই রাজস্ব কর্মচারী গরীব চাষীদের শোষণ করে থাকেন এবং ব্যপক দূর্নীতি করে থাকেন। সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃবৃন্দের সাথে তহশীলদার দের সম্পর্ক কেমন এবং তহশীলদার দূর্নীতি করছেন কি না তা আমরা জানতে চেয়েছিলাম। প্রাপ্ত তথ্য মতে, আমাদের পূর্বোক্ত ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। নেতৃত্বের ৮৭.১২% জানিয়েছেন যে, তাদের সাথে তহশীলদার দের সম্পর্ক বেশ ভালো। স্থানীয় তহশীলদার দূর্নীতি পরায়ন নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন এদের ৭২.৭৩%। এই উত্তরের মধ্যেই গ্রামীণ ক্ষমতার বলয়ে একটা সুস্পষ্ট ইংগিত আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানে শোষণের প্রয়োজনে শক্ত আঁতাত গড়ে উঠেছে।
৪, মামলা মোকদ্দমা
আমাদের একটা ধারণা ছিল যে, গ্রামীণ জনগণের অপেক্ষাকৃত চতুর অংশই ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে আসেন। সে জন্য গ্রাম বাংলায় যে মামলা-মোকদ্দমা রোজ ঘটছে তাতে এই নেতৃত্বের এ অংশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সে ধারণা একেবারে ভুল নয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১ থেকে ৪ বার বিবাদী হয়েছেন এদের ২২.৭২%, ৫ থেকে ৯ বার বিবাদী হয়েছেন ৩.০৩%। এক থেকে চার বার বাদী হয়েছেন ১৬.৬৬%, ৫ থেকে ১০ বার বাদী হয়েছেন ৩%। বিভিন্ন সময়ে মামলার সাক্ষী হয়েছেন ৩৪.০৯% অংশ।
এসব তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গ্রামীণ অনৈক্য এবং মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে জমি হস্তান্তর ও দারিদ্রায়ন প্রক্রিয়ায় এসব নেতাদের ভূমিকা খুব একটা গৌণ নয়।
ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বের মনোভাব
সরকার যেহেতু স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট এবং স্থানীয় ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের নীতি গ্রহণ করেছেন, সেজন্য এবারে নির্বাচিত ইউপি নেতৃত্বের সচেতনতার মান সরকারী নীতিমালা, সমাজ-সংস্কৃতি সম্মন্ধে তাদের ধারণা এবং বিশেষ করে কিছু কিছু সামাজিক – অর্থনৈতিক কর্মসূচীর প্রতি তাদের মনোভাব কি তা জানার জন্য কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। এসব প্রশ্ন সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং সন্তোষজনক জবাব নেতৃবৃন্দ দিয়েছেন বলা চলে।
১, সচেতনতার মান
উত্তরদাতা দের মধ্যে ৯৩.৯৮% ইউনিয়ন পরিষদ সংক্রান্ত সরকারী অরডিন্যান্সটি পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। এদের ৭১.২১% দৈনিক পত্রিকা পড়েন, ৬৯.৪২% রেডিও শোনেন ও নেতৃবৃন্দের ভাষণসহ উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানমালা নিয়মিত শ্রবণ করেন। ৪৬.৯৭% সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়েন। তন্মধ্যে ৪০.৩২% বিচিত্রা এবং ৫৯.৬৮% অন্যান্য সাপ্তাহিক পড়ে থাকেন।
২, কর্মসূচী ও প্রতিষ্ঠান সম্মন্ধে মনোভাব
উত্তরদাতাদের ৭৮.০৩ শতাংশ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর সাথে জড়িত রয়েছেন৷ ৭০.৪৫% উত্তরদাতা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ সমর্থন করেন, ৬৪.৩১% এ ধরণের কর্মসূচীতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের অংশগ্রহণে আপত্তি করবেন না এবং ৭০.৪৫% নারী এবং পুরুষের সমান মজুরী হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন। ৬৩.৬৪% নেতৃত্ব সহনশীলতায় বিশ্বাসী। বেশ কিছু নেতৃত্ব একেবারেই রক্ষণশীল। আমাদের একজন মহিলা তথ্য সংগ্রহকারী জানিয়েছেন যে, একজন ইউ. পি. সদস্য তার সাথে মুখোমুখি বসে উত্তর দানেও রাজি হতে পারেন নি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি মেয়েদের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচীতে পুরুষদের পাশাপাশি অংশ গ্রহণ সমর্থন করবেন না।
৩, ধর্ম সম্মন্ধে মনোভাব
উত্তর দাতাদের ৭১.১২% পীর মানেন, ৬০.৬০ শতাংশ পীরের ওরসে অংশগ্রহণ করেছেন, ৮১.০৬ শতাংশ পীরের জন্য চাঁদা দেন এবং ৮৪.৮৪ শতাংশ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে নেতৃত্ব বা সাহায্য করেছেন।
৪, সরকারী নীতিমালা ও সংস্কার সম্পর্কে মনোভাব
(ক) ভূমিসংস্কারঃ উত্তরদাতাদের ৮৪.০৮% বর্তমান ভূমি ব্যবস্থা রদবদল করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। আমাদের ধারণা, এ প্রশ্নটি সম্পর্কে উত্তরদাতা দের বিভ্রান্তি ছিল। ভূমি ব্যবস্থা বদলানো বলতে হয়তো বা ভূমি উন্নয়ন কর্মসূচী তারা বুঝেছেন। যদি এমন প্রশ্ন করা হতো যে, “১০ একরের উপরে যাদের জমি, তাদের জমি জাতীয়করণ করে দরিদ্র বা ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করার মতো ভূমি সংস্কারে আপনারা বিশ্বাস করেন কি না” তাহলে হয়তো ভিন্নতর উত্তর আসতো। আর যদি তারা বুঝে শুনেই এমন উত্তর দিয়ে থাকেন, তবে সরকারের ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করা যায়।
(খ) ভূমিহীনদের সংগঠনঃ উত্তরদাতাদের ৯৪.৬৯ শতাংশ মত প্রকাশ করেছেন যে, ভূমিহীন দের নিজস্ব সংগঠন থাকা উচিৎ৷ সরকার ভূমিহীনদের সংগঠন গড়ে তোলার জন্য শিল্পাঞ্চলের অনুরূপ কৃষিখাতেও ট্রেড ইউনিয়ন আইন পাস ও বাস্তবায়ন করতে পারেন। যদি প্রাপ্ত উত্তর আন্তরিক হয় তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা মিলবে আশা করা যায়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় ভূমিহীনদের প্রতি এতটুকু সদয় সাধারণতঃ এসব নেতৃবৃন্দকে হতে দেখা যায় না৷
(গ) অনুপস্থিত ভূস্বামীঃ উত্তরদাতাদের অর্ধেক মত প্রকাশ করেছেন যে, যারা গ্রামে বসবাস করেন না, এমন অনুপস্থিত ভূস্বামীদের জমি থাকা উচিৎ নয়। বাকী অর্ধেক এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
(ঘ) বর্গাচাষঃ উত্তরদাতাদের ৭৬.৫১ শতাংশ মত প্রকাশ করেছেন যে, বর্গাচাষ উঠিয়ে দেয়া উচিৎ হবে না। বাকী ২৩.৪৯% অবশ্য বর্গাচাষ উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মত প্রকাশ করেছেন। নেতৃত্বের অধিকাংশই নিজেরা হাল চাষ করার সময় ব্যয় করতে পারেন না এবং স্থানীয় প্রভাব বলয় শক্তিশালী করার জন্য প্রচুর অনুগত সমর্থক প্রয়োজন বলে তাদের বৃহদাংশ যে বর্গাচাষ সমর্থন করবেন, সেটা অনস্বীকার্য।
(ঙ) সমবায়ঃ উত্তরদাতাদের ৯৫.৪৫ % সমবায় গড়ে তুলে চাষবাস করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রেও মনে হয় সমবায় সম্মন্ধে সনাতনি ধারণা তাদের মনে কাজ করে।
(চ) সেচ্ছা বন্ধাকরণঃ উত্তরদাতাদের ৮৭.৮৭% বন্ধাকরণ অভিযান সমর্থন করেন। ৬৬.৬৬% সদস্য / চেয়ারম্যান নিজেরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন। ডঃ রসিদুজ্জামান এ বছরের গোড়ার দিকে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পরিবার পরিকল্পনার প্রতি মনোভাব সংক্রান্ত এক জরিপে একই ধরণের সিদ্ধান্তে পৌছেছেন। (সূত্রঃ বাংলাদেশ টাইমস, ২২ ও ২৩ জানুয়ারী, ১৯৭৮)। তিনি পরিবার পরিকল্পনাকে স্বার্থক করার জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইউ পি নেতৃবৃন্দ জনগণকে এই প্রশ্নে সংগঠিত করতে পারেন বলে তিনি সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আমাদের ধারণা, কতিপয় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যত আশাবাদী মতামতই ব্যক্ত করুন না কেন, দারিদ্রের যে ভয়াবহ রূপ গ্রামীণ বেশীর ভাগ মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে পরিবার পরিকল্পনা বা অনুরূপ কর্মসূচীতে যথেষ্ট গণ সমর্থন মিলবে না।
(ছ) স্বনির্ভরতাঃ উত্তরদাতাদের ৮৩.৩৩ শতাংশ ‘স্বনির্ভর’ শব্দটির সরকারী তাৎপর্য বোঝেন এবং সেই মোতাবেক কর্মসূচী গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।
মন্তব্য
আমরা আমাদের জরিপ থেকে যে তথ্য পেয়েছি তা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান নেতৃত্ব যে শ্রেণীটি রয়েছে তারা মূলতঃ গ্রামীণ এলিট শ্রেণীরই প্রতিনিধি। উপরতলার ৮% গ্রামীণ ধনিক শ্রেণী (যাদের মালিকানায় রয়েছে ৪৫ শতাংশ জমি) থেকে আগত এই নেতৃত্ব ঐতিহাসিক ভাবেই বিকশিত এলিট নেতৃত্বেরই অংশবিশেষ। এদের পিতা, পিতামহ এবং নিকট আত্মীয় প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে গ্রামীণ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন বা এখনো আছেন। মানসিক দিক থেকে এদের অনেকেই সামন্ত সংস্কার ও অনুশাসনে বিশ্বাসী৷ প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিভূ তাও আবার বিচ্যুত বেশীর ভাগ এই নেতৃত্বের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার একাংশ। আমলা শ্রেণী আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত এই গ্রামীণ প্রভাবশালী শ্রেণী মূলতঃ উৎপাদন বিমুখ এবং যে কোন উৎপাদন মুখী কর্মকাণ্ডে তাদের তেমন উৎসাহ দেখানোর কথা নয়। প্রশাসনের সাথে আঁতাত করে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগিতায় এই শ্রেণী সরাসরি আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে ফেলতে পারে। সেজন্য দেশীয় উৎপাদনে খুব একটা তাদের নেতৃত্ব বাড়তে পারে না। ক্ষুদে কৃষক, ভূমিহীন কৃষক এমনকি মধ্য কৃষক, এ শ্রেণীর জন্য উৎপাদন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। এদের কোন আত্মীয় হয়তো সারের ডিলার সেজে বসে আছেন, এদের কেও হয়তো রেশন দোকানের মালিক। অতএব, এদের শ্রেণী ছাড়া অন্য কেউ সরকারী উপকরণ বা সাবসিডি ভিত্তিক সাহায্য পেতে পারেন না। যদিও বা পান, তাও দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করার পর। এতে আবার দল বা গোষ্ঠীর লোকজন বঞ্চিত হয়।
মোট কথা, এদের দিয়ে উৎপাদক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করার মতো গ্রামীণ সাংগঠনিক ক্রিয়াকান্ডের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। বরং তাদের উপস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠান গুলো সম্পদ অপব্যবহারের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের এসব সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে গ্রাম ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। ‘গ্রাম সরকার’ বা অন্য যে কোন নামেই তা ডাকা হোক না কেন, এসব প্রতিষ্ঠানেও ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বকেই বসানো হচ্ছে। জনগণের নিকট যাদের জবাবদিহি করতে হয় না, আমলাতন্ত্রের মুখাপেক্ষী এই সব নেতৃত্ব দিয়ে ‘গ্রামীণ সরকার’ এও কোন নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করা যাবে কি না সন্দেহ। আসলে খাঁটি উৎপাদক শ্রেণীগুলোকে শ্রেণী ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব না করতে দিয়ে এভাবে গ্রামীণ এলিট শ্রেণীর নেতৃত্বে সামগ্রিক ভাবে উন্নয়নে নতুন জোয়ার আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক ভাবে উৎপাদক শ্রেণীকে সংগঠিত না হতে দিয়ে কিছু কিছু অপরিহার্য আর্থ-সামাজিক সংস্কার করে সম্পদের অসম বন্টনকে প্রতিরোধ না করতে পারলে উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। এ সব পূর্বশর্ত অস্বীকার করে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে সীমিত করার উদ্দেশ্যে যদি এই গ্রামীণ নেতৃত্বকে জিইয়ে রাখার প্রয়াস অব্যাহত থাকে, তবে ইতিহাসের শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হবে। বিশেষ করে আয়ুব খানের ব্যর্থ প্রয়াসের পর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে নেতৃত্বের নতুনত্ব আসবে, কর্মসূচীর ভিন্নতা আসবে, আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য কমবে, এটাই দেশবাসী আশা করেছিলেন; কিন্তু মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই কাঙ্ক্ষিত নতুনত্ব আসেনি।
***
ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan