You dont have javascript enabled! Please enable it! 1978.09.15 | বাংলাদেশের গ্রাম | আনু মুহাম্মদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের গ্রাম | আনু মুহাম্মদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮

বহু কথিত একটি বাক্য – “বাংলাদেশ একটি গ্রাম”। সত্যতাআছে এই কথাতে। বাংলাদেশে নগর এখনও দৃষ্টিগ্রাহ্য কিংবা উল্লেখযোগ্য নয়, নাগরিক আরও বেশী নয়। বাংলাদেশ জুড়েই গ্রাম, শহরেও তার ছায়া, শহরের মানুষের মধ্যেও তার ছাপ।

কিন্তু কোন গ্রাম, বাংলাদেশ কেমন গ্রাম? আকাশ থেকে দেখা সবুজ, পানির সুন্দর প্রবাহে সুন্দরতর, পাল তোলা নৌকায় ভরা ধান-পাট আর গাছপালায় চোখ ভুলানো? না কর্কশ ফাটা মাটির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখা মুমূর্ষু অপরিচ্ছন্ন আদিকালের মানুষের বসতি? কেমন গ্রাম বাংলাদেশ?  যেমনটি শেখানো হয়নআমাদের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা তেমন গ্রাম কি?  মানুষ এখানে হেসে হেসে ধান কাটে, আনন্দে গান গায়, রাতে তৃপ্তিতে ঘুমায়, এই কি এই গ্রামের চিত্র?

দুই

দৃষ্টির প্রশ্ন আছে এখানে। কোথ্বেকে দেখছি আমরা, কাকে দেখছি, কেন দেখছি, কিভাবে দেখছি? প্রকৃতি কি মুখ্য আমাদের দৃষ্টিতে, না মানুষ? প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার মত সময় আমাদের হাতে নেই, প্রকৃতির আগে মানুষকেই দেখতে হবে। আর সে দেখা আকাশ থেকে নয়, বিমান থেকে নয়, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হাত নেড়ে নেড়ে নয়; কর্কশ মাটিতে পা রেখে, মানুষের জাগতিক অনুসন্ধান করে।

মানুষের জন্যই প্রকৃতি, মানুষের জন্যই সবকিছু। কিন্তু মানুষই যদি আমাদের মূল লক্ষ্যের বিষয় হয় তবেই কি দেখা যাবে, বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের গ্রামের সব মানুষকে কি একইভাবে দেখা যায়? সব মানুষের জীবনযাপন, হাসি কান্না, দুঃখ কি একই রকম? একইভাবে জীবনকে হাতে নিতে পারে? যখন – দুজনের জীবনের ভিত্তি অর্থনৈতিক – সামাজিক অবস্থান একই রকম হয়। তেমন কি আছে বাংলাদেশে? বাংলাদেশের সকল মানুষের অর্থনৈতিক – সামাজিক অবস্থান একই রকম নয়৷ সে জন্যই গ্রাম অর্থাৎ গ্রামের মানুষকে দেখতে গেলে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থানকে ভিত্তি হিসেবে ধরতে হবে; বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার এড়ানোর জন্য।

তিন

মোগল আমল কিংবা আরও আগের গ্রাম এখন নেই – যখন গ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামের মানুষের জীবন। গ্রামের বাইরের জীবনের সাথে ছিল না তেমন সম্পর্ক। এখন রাস্তা হয়েছে, বাজার অর্থনীতি গ্রামে জেঁকে বসেছে, গ্রামের জিনিসপত্র শহরে চলে যাচ্ছে, শহরের জিনিসপত্র গ্রামে আসছে, শিক্ষা গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছে, জমি নিয়ে তহশীলদার, সাব-রেজিস্ট্রি  অফিসে খুব বেশী যেতে হচ্ছে, প্রশাসন, থানা-মহকুমা শহরের সঙ্গে গ্রামের মানুষের পরিচয় বাড়ছে। প্রশাসন গ্রাম পর্যন্ত আসছে, রেডিওতে উদাত্ত ঘোষণা আসছে সুদূর রাজধানী থেকে। থানা পুলিশ আসছে গ্রামে; মেশিনপত্র আসছে, শহুরে ব্যবসায়ীরা গ্রামে আসছে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে শহর, রাজধানী এবং আন্তর্জাতিক বাজারের যোগাযোগ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। যোগাযোগ বাড়ছে, সবাই স্বীকাে করবেন। কিন্তু কেমন সে যোগাযোগ – সে প্রশ্নে সবাই একমত হবেন না, উত্তর দেবেন নিজেদের যোগাযোগ অনুসারে৷

চার

গ্রামের মানুষকে,  তাদের সামাজিক – অর্থনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী,  কয়েকটি দলে ভাগ করা যায়।  এক দলে রয়েছেন  গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাদের হাতে কোন জমি নেই, উৎপাদনের উপকরণ নেই; যারা পুরোপুরি নিজেদের শ্রমের উপর নির্ভরশীল।  বিভিন্ন গ্রাম জরিপ, বিভিন্ন মহলের গবেষণা এবং সরকারী পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এদের সংখ্যা শতকরা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে৷ এই দলের মধ্যে আবার উল্লেখযোগ্য অংশের কোন ঘরবাড়ি নেই, অন্যের বাড়িতে থাকে, যাদের অনেকে বিভিন্ন মৌসুমে অন্যান্য গ্রামে গিয়ে কাজ করে। এদের অনেকে ইতিমধ্যে শহরে চলে এসেছে৷

দ্বিতীয় দলে রয়েছে যারা, তাদের স্বল্প উৎপাদন উপকরণ, জমি রয়েছে, যারা নিজেদের শ্রমের উপরই মোটামুটি নির্ভরশীল, কখনো কখনো এরা অন্যদের শ্রমও নিজেদের জমিতে খাটিয়ে থাকে; মাঝে মাঝে অন্যদের জমি বর্গা নিয়ে থাকে।

তৃতীয় দলে রয়েছে গ্রামের ‘উঁচু ব্যক্তিরা’ ; যাদের হাতে প্রচুর জমি রয়েছে, উৎপাদন উপকরণ রয়েছে যথেষ্ট। এরা অন্যদের শ্রম নিয়োগ করে নিজেদের জমিতে। তারা নিজেরাও কাজ করে, তবে তা করে পরিচালক, পরিদর্শক ও ব্যবস্থপক হিসেবে৷ এই দলভুক্ত ব্যক্তিরাই গ্রামীণ মাতব্বর,  যারা নিয়ন্ত্রণ করে গ্রামীণ জীবন; ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বও এদের হাতে।

উপরোক্ত তিনটি দল ছাড়াও গ্রামে আরও কিছু গ্রুপ ইদানীং বেশ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে চলে এসেছে৷ এরা হচ্ছে ব্যবসায়ী, স্থানীয় শিক্ষিত অংশ – শিক্ষক। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছে সার, রেশন ইত্যাদির ডিলার, ধান, চাল, পাট, রবিশস্য ইত্যাদির ফড়িয়া, পাইকার; গ্রামেই অবস্থানরত ঠিকাদার। পেশাজীবি কিছু কিছু গ্রপও কোন কোন গ্রামে রয়েছে। যেমন তাঁতী, জেলে, কামার, কুমোরদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ সমাজে এদের আলাদা একটি অবস্থান আছে। এরা মোটামুটি ভাবে নিজস্ব পেশার লোকদের নিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকে৷

এ ধরণের সাধারণ বর্ণনা ব্ংলাদেশের সব গ্রামের বেলাতেই মোটামুটি সত্য। কিন্তু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে অধিকতর অনগ্রসর কিছু এলাকায় ; যেমন পার্বত্য এলাকা, চর এলাকা – এসব অঞ্চলে জোতদারী প্রথার প্রাধান্য খুব বেশী৷ এই জোতদারী অবশ্য প্রাচীন জোতদারী তথা সামন্ত প্রথার সমার্থক নয়। এসব জোতদারী বর্তমানে প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামোর সাথে জড়িত। দেশের বাইরে প্রভাবের জন্য এই জোতদারী প্রথা কিছুটা মার্জিত হয়েছে। তবু এই প্রথা ব্যক্তি শাসন-শোষণকেই টিকিয়ে রেখেছে। এসব জায়গায় দেশীয় আইনের চাইতে স্থানীয় জোতদার প্রবর্তিত আইন অনেক বেশী শক্তিশালী।

পাঁচ

বাংলাদেশের গ্রাম লিখতে গিয়ে আমরা দেশের বেশ কয়েকটি গ্রামকে নমুনা হিসেবে নিয়েছি। যেগুলোতে ব্যক্তিগত তথ্যানুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ বর্তমান লেখার তথ্যসূত্র।

গ্রামের জীবন

গ্রামের জীবনে মানুষের সঙ্গে মানুষের বহুবিধ সংঘাত রয়েছে। রয়েছে বিরোধ। এই বিরোধ কোন পর্যায়ের কিংবা এই বিরোধ কোন চরিত্রের এটা খুঁজে পেতে হলে শ্রেণীওয়ালাকে সামনে রাখা প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা, স্বার্থের প্রশ্নও ভিন্ন। সে জন্যই গ্রামীণ উন্নয়ন বললেই সব মানুষের উন্নয়ন হয় না, গ্রামীণ প্রশাসন বললেই তা সব মানুষের প্রশাসন হয় না, গ্রামীণ প্রশাসন বললেই তা সব মানুষের প্রশাসন হয় না। গ্রামীণ মানুষের স্বার্থ দেখতে গেলে এক সঙ্গে সবার স্বার্থ দেখা হয় না, হয় শ্রেণী বিশেষের। সেই শ্রেণী, যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রামীণ জীবনকে। একটা অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতায় জড়িয়ে রেখেছে গ্রামীণ মানুষদেরকে। এ শ্রেণীর এই নিয়ন্ত্রণ শক্তির উৎস কখনো জমি, কখনো বা উর্ধ্বতন গণতন্ত্র, যতই বলা হোক না কেন, সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ তা সম্ভব হয় না। হয় না এই কাঠামোর জন্য, শ্রেণী বিন্যাসের জন্য। অথচ বলা হয় সেসব কথা, এই কাঠামোকে অস্বীকার করবার জন্য, নিয়ন্ত্রক শক্তির মূল প্রকৃতি চরিত্র টিকিয়ে রাখবার জন্য।

আমরা যদি গ্রামের জীবনের কিছু কিছু দিক সামনে রাখি, তবেই এই প্রতিবন্ধকতা, এই শ্রেণী বিন্যাস, এই কাঠামো সামনে চলে আসবে। এসব দিকের মধ্যে আছে – সালিশ বিচার, থানা পুলিশ, সিও-তহশীলদার, চিকিৎসা, শ্রেণীর সাথে শ্রেণীর সম্পর্ক, মজুর জমি, উন্নয়ন, শিক্ষা, নারী ইত্যাদি।

১. সালিশ গ্রামের বহু পুরানা প্রথা। ব্যক্তি মালিকানা যতদিন থেকে এসেছে, ততদিন থেকেই সম্ভবতঃ এই সালিশ প্রথা রয়েছে। সালিশ প্রতি সপ্তাহেই গ্রামে একটা-দুটি বসে। সালিশে যেসব বিচার আসে, সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব তুচ্ছ ঘটনা মনে হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ, ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, গাছের মালিকানা, ছেলে বাবা কিংবা মাকে খেতে দিচ্ছে না, মারপিট, ফসল দখল, চুরি, মেয়েঘটিত বিষয় ইত্যাদি নিয়েই সালিশ হয়। সালিশে যারা মাতব্বর থাকেন, তারা ‘খুব স্বাভাবিক ভাবেই’ গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধনী কৃষক অথবা মহাজন। গ্রামের ‘বাপ-মা’ হিসাবে তারা গ্রামের অন্যান্য মানুষদের বিচার-আচার করেন। গ্রামের এসব মাতব্বরদের অর্থাৎ ধনী কৃষকদের নিজেদের মধ্যেও বিরোধ থাকে। কিন্তু যদি কখনো কোন সালিশে কোন ধনী কৃষকদের নিজেদের মধ্যেও বিরোধ থাকে। কিন্তু যদি কখনো কোন সালিশে কোন ধনী কৃষক আসামী হিসেবে হাজির হন, সেক্ষেত্রে মাতব্বর ‘বন্ধুবান্ধব’ কখনোই তার প্রতি শত্রুতা দেখান না। শ্রেণী বন্ধুত্বের দাম দেয়া হয়। গ্রামের একজন ধনী কৃষক একই সঙ্গে একজন মাতব্বরের নিজের মুখে বলা একটি ঘটনা থেকে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ –

আমার ইচ্ছে ছিল না সালিশে যাওয়ার। কেননা আসামী মাতব্বরের সঙ্গে আমার এমনিতে গন্ডগোল থাকলেও তাকে আমি এভাবে অপদস্ত করতে পারি না। ঘটনাটি বলছি, পাশের পাড়ার এক লোক দিনমজুর, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওর বউ লেবু খুঁজে না পেয়ে এই মাতবরের গাছ থেকে লেবু ছিঁড়তে গিয়েছিল, মাতবর এটি দেখে মেয়েটির চুলের গোছা ধরে মাটিতে ফেলে মারতে থাকে, ওর সাথে আরও লোকজন ছিল। ঘটনাটা আরও বড় আকার নিতে পারত। কেননা বিবাহিতা মেয়ের গায়ে হাত দেয়া গ্রামে ভয়াবহ অপরাধ কিন্তু মান্যগণ্য লোক বলেই এটি সালিশ পর্যন্ত এসেছে, তাও হয়ত আসত না, যদি না মানুষজনের চাপ থাকত। বিচারে স্বাভাবিক ভাবেই রায় হওয়া উচিৎ ছিল জুতো মারা, উপস্থিত অনেক মানুষের তেমন ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু মাতবরেরা চেয়েছিল আসামীকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু উপস্থিত সব মানুষের চাপ এত বেশী ছিল যে, তেমনটি করতে গেলে অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী ছিল। সেজন্যে ১০০ টাকা জরিমানা অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে হয়েছে।”

আরেকটি গ্রামের আরেকটি ঘটনা৷ রাত দুপুরে হঠাৎ তুমুল হৈ চৈ। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তারাও উঠল। গ্রামের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তির নারিকেল গাছে চোর উঠেছিলো, তাকে ধরা হয়েছে। উল্লসিত অনেকেই চোরকে বেশ মারধর করার পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। চোর স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বরের বাড়ির কামলা। সে বলল, সে চুরি করতে যায়নি – মেম্বারের ছেলে তাকে চুরি করতে নিয়ে গেছে। ছেলে গাছের নীচে ছিল, লোকজনকে আসতে দেখে পালিয়েছে। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। রক্তাক্ত চোরকে মাঝখানে রেখে সালিশ বসলো, গ্রামের গণ্যমান্য মাতব্বরবৃন্দ এলেন। মেম্বরও এলো। মেম্বরের ছেলে পালিয়েছে। সালিশ শুরু হল। যার গাছে চুরি হয়েছে, তিনি বিব্রত হলেও পিছুতে পারছেন না। সালিশে উপস্থিত মাতবরদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, তারা ব্যাপারটা আপোষে মিটিয়ে ফেলতে চান৷ ঘন্টা দুয়েক চলে গেছে, সালিশে উপস্থিত লোকজন সুস্পষ্ট দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে গরীব মানুষ, তরুণ ছাত্ররা। অন্য দিকে মাতবরবৃন্দ। প্রথম দল দাবী করছে বিচার হোক মেম্বরের এবং সে বিচার হতে হবে গ্রামেই। চোরের বিচার করে লাভ নেই, মেম্বরের বিচার করতে হবে। কারণ সে নিজেই চোর, থানায় পাঠিয়েও লাভ নেই। অন্য দল বলছে, ব্যাপারটা আপোষে মিটিয়ে ফেলা হোক। তর্ক বিতর্কে একবার মেম্বরের পিটুনি খাবার উপক্রম হল। মেম্বর তার বাড়ির কামলা, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এর মধ্যেই দল পাকিয়ে ফেলেছিল। গন্ডগোলের রোল উঠতেই, মেম্বর চোর ভাগিয়ে দিয়ে উল্টো আক্রমণ করতে এলো। উল্টো কৈফিয়ত চাইলো তাকে অপমান করার। মাতবররা উঠে গেলো। সালিশ এখানেই শেষ। উল্লেখ্য, সেই মেম্বর এমনিতেই দূর্নীতিতে কুখ্যাত। “

আরেকটি সালিশ এক বিধবাকে নিয়ে। “বিধবার স্বামী ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষে নিজের মেয়েকে পানিতে ফেলে আত্মহত্যা করেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর এই বিধবা বহু জায়গায় কাজ খুঁজেছে, পায়নি। এরপর শুরু করে খড়ি বিক্রি৷ বিচারের বিষয় হল, ‘বিধবা গ্রামকে দূষিত করছে। তার ঘরে রাতে বহু ছেলে যাচ্ছে, এমন মেয়ে থাকলে গ্রাম নষ্ট হয়ে যাবে। ‘ ঘটনাটা সত্যি ছিল, কিন্তু আরও সত্যি ছিল বিচারে যারা বেশী উৎসাহ দেখাচ্ছিল তারা এবং তাদের ছেলেরাই ঐ বিধবাকে এই পখে নিয়ে এসেছে এবং তাদের মুখেই সব সময়  শোনা যেত এ মেয়েটি সম্পর্কে দুর্নাম। বিচারে মেয়েটিকে এক ঘরে করা হল।”

পরবর্তী ঘটনা হচ্ছে, মেয়েটি পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক লোককে বিয়ে করে, বিয়ের দু’ দিন পরই লোকটি পালিয়ে যায়। তত দিনে মেয়েটি সন্তান সম্ভবা। কিছুদিন আগে নিজের পাতা দিয়ে ছাওয়া খুপড়িতে মেয়েটি বাচ্চা প্রসব করে। গাঁয়ের কেউ তার ধারে কাছে যায়নি, অবৈধ বাচ্চা বলে। বৃষ্টি ছিল সে সময়। পর পর তিনদিন একটানা বৃষ্টিতে ভিজে, খেতে না পেয়ে, ওষুধ না পেয়ে মেয়েটি নিজের বাচ্চাসহ মারা যায়। মারা যাওয়ার পর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঐ মেয়ের দাফন-কাফন করতেও রাজী হয়নি। কেননা, ‘এমন মেয়ের দাফন-কাফন করাও পাপ।’ এরপর গ্রামের কিছু মানুষ জোর করেই তার দাফনের ব্যবস্থা করে।

অনেক সালিশ হতে পারে না, হয় না গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মান বাঁচানোর জন্য। একবার একজন ধনী কৃষকের সদয় নজর পড়েছিল একজন দিন মজুরের বউ-এর উপর, যার ফলশ্রুতিতে ঐ দিনমজুর বউকে তালাক দেয় ভুল বুঝে। পরবর্তীকালে সব জেনেও ঐ দিন মজুর কোন সালিশ ডাকতে পারেনি৷ গণ্যমান্য ব্যক্তির সদয় দান ৫০ টাকা প্রত্যাখ্যান করেই তার রাগ মেটাতে হয়েছিল৷

২. গ্রামের ভেতর খুন কিংবা জমি নিয়ে বড় কোন গন্ডগোল হলো থানা-পুলিশ কিংবা আদালত পর্যন্ত দৌড়াতে হয় মানুষকে। সেখানে মানুষ কেমন বিচার পায়, সে প্রশ্নও আছে। কিন্তু সে পর্যন্ত ক’জন পৌছতে পারে, সে প্রশ্ন আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

একজন সাধারণ অথচ প্রায় অপরিবর্তিত সত্য কথা হচ্ছে, শতকরা প্রায় ৮০ জন মানুষ নিরক্ষর। গ্রামে এই নিরক্ষরতা দরিদ্র অংশের মধ্যেই মূলত বিস্তৃত। সে কারণে যে কোন আপদে কিংবা যে কোন সমস্যায় এই দরিদ্র অংশের মানুষকে যখন থানা পুলিশ কিংবা আদালত পর্যন্ত পৌছবার প্রয়োজন হয় কিংবা থানা প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন তাদের আবেদন লিখে দেবার জন্য, কিংবা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছবার জন্য গ্রামের ধনী শিক্ষিত মানুষদের কাছেই যেতে হয়। জীর্ণ গাঁট  থেকে কিছু পয়সা দিতে হয় সিগারেটের জন্য। সে জন্যেই যখন এসব লোকের বিরুদ্ধেই তার অভিযোগ জানাতে হয়, তখন তার আর উপায় থাকে না, শক্তিহীন উপায়হীন দরিদ্র মানুষদের তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে ক্লান্ত হওয়া ছাড়া থাকে না আর কোন গতি।

একবার কিছুদিন আগে একটি গ্রামে টিউবওয়েল বরাদ্দ করতে গিয়ে টিউবওয়েল সংখ্যার চাইতে অনেক বেশী লোকের কাছ থেকে টাকা নেয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বর, চেয়ারম্যান। এতে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আরো অনেকবারের মত। কিন্তু সাহস করে এক ছাত্রকে দিয়ে আবেদনপত্র লিখিয়ে গ্রামের কিছু মানুষ এ ব্যাপারে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানালো মহকুমার প্রশাসকের অফিসে। কিছু দিন পর গ্রামের হাটে চেয়ারম্যানের হাতে দেখা গেল সেই আবেদনপত্র। একই সঙ্গে তার উচ্চস্বরও শোনা গেল, “কারা কারা নালিশ করেছিলে তারা দেখ, তোমাদের…। ” এরপর নিশ্চয়ই স্থানীয় মুরুব্বী দের বিরুদ্ধে নালিশ করবার মত ধৃষ্টতা সহজে এইসব মানুষ দেখাতে চাইতে পারে না।

একই গ্রামের আরেকটি ঘটনা। তার চাষের জমি নেই, শুধু ভিটে-বাটি আছে, ভিটে-বাটিতে প্রচুর ফলের গাছ, গাছের ফল বিক্রি করেই তার সংসার চালাতে হয়। তার বাড়ি থেকে সামান্য কিছু দূরে একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যানের বাড়ি। প্রাক্তন চেয়ারম্যান বহুদিন থেকেই এই ভিটে-বাটিটি কিনতে চাচ্ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই তার রাজী হবার কথা নয়৷ একবার সে স্ত্রী পুত্র নিয়ে কিছু দূরে আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গেলে ফিরে এসে দেখলো, তার ভিটে বাড়ীর ভাঙা ঘর মাটির সাথে মিশে আছে। বাড়ির উপর দিয়ে লাঙ্গল চালানো হয়েছে। সেসময় ফলের মৌসুম নয়, তার কাছে এমন অর্থ নেই যা দিয়ে সে ঘর আবার সে তুলতে পারে। এমনকি এতটুকু অর্থও নেই যা দিয়ে থানা পুলিশ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, আস্থাও নেই কোন। গ্রামের মাতবরদের কাছে সে অনেক দৌড়াদৌড়ি করল ব্যাপারটা নিয়ে। ‘স্বাভাবিক কারণেই’ এদের কারো সময় হলো না তার কথায় কান দেয়ার।

থানা পুলিশের উপর কিংবা থানা প্রশাসনের উপর মানুষের অনাস্থা তিক্ত অভিজ্ঞতার জের বেয়েই এসেছে। থানার দারোগা – পুলিশ যে কোন ঘটনাতেই গ্রামে আসতে হলে এসে উঠেন গ্রামের সবচাইতে ধনী কৃষকের বাড়িতেই। খানা ভাল, শুতে পারেন ভালমত, মর্যাদাও থাকে ভাল; থানা প্রশাসনের কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানে গ্রামের অন্যান্য মানুষরা তাদের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাবেন কেন? থানা পুলিশই হোন, কর্মকর্তাই হোন তারা সবাই তো সম্মানী ব্যক্তিদের সম্মান রাখায় বিশ্বাসী। সেখানে মুর্খ চাষাদের কথা তারা শুনবেন কেন, তারা অর্থহীন ভাবে কান্নাকাটিই তো বেশী করে।

মাঝে মাঝে স্থানীয় মুরুব্বীদের ব্যাপার থানা পুলিশ পর্যন্ত যায় বা যাবার উপক্রম হয়। যেমন একবার একজন গরীব  পরিবারের মেয়ে অপহৃতা হলো, মেয়ের মা দা-এর আঘাতে আহত হলেন, মেয়ের বাবা সাহস করে থানা পর্যন্ত গেলেন। সবাই জানে মেয়েকে কারা অপহরণ করেছে। সাক্ষী মিলল না, তিন-চার মাস পরেও মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেল না। থানা পুলিশ চাপ দিচ্ছে, আপোষ করে ফেল। গ্রামের মাতবররা চাপ দিচ্ছে, আপেষ করে ফেল। হুমকি আসছে শত্রু পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত আর কিছুই হয়নি৷

মাতবর, ধনী কৃষক, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা এবং পরিষদের বাইরের কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে রেষারেষির ফলে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি অনেক সময় বিপক্ষ দলকে ঘায়েল করার জন্য উল্লিখিত পরিস্থিতি ব্যবহার করে। কিন্তু আসল ভুক্তভোগীরা জানতেই পারে না, হঠাৎ করে রাতের অন্ধকারে বৈঠক বসে, ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় কিছু অর্থ, প্রভাবশালী ব্যক্তি সরে পড়ে পেছন থেকে। এমন ঘটনা প্রকাশ্যেও হয়। একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যানের মুখে এমন একটি ঘটনা শোনা, “অনেক দিন আগে থেকেই আমি রেগে ছিলাম, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান – মেম্বররা হাঁট ইজারার টাকা, রেশন, রিলিফ, ডিলারদের কাছ থেকে নেয়া টাকা, জুয়া খেলা লোকদের থেকে নেয়া টাকা নিজেরাই খাচ্ছিল, আমাকে দেয়া হচ্ছিল না৷ আমি পাব না, তারা একলাই নেবে এটা তো হয় না৷ একদিন ভরা হাটে চায়ের দোকানে বসে সবাইকে দেখিয়ে একটা আবেদনপত্র লিখলাম। এস ডি ও – কে সব জানিয়ে লিখলাম, ইউনিয়নের কর্মকর্তারা এই সব দূর্নীতি করছে, এগুলোর প্রতিকার হোক৷ তারপর সেটি চেয়ারম্যানের হাতে দিলাম ফরওয়ার্ড করে দেবার জন্য। তিনি দেখলেন, বাইরে গেলেন। রাত দশটার দিকে সবার সাথে আলোচনা করছি, এমন সময় টের পেলাম আমার পকেটে কিছু দেয়া হচ্ছে। এরপর আর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে দরখাস্ত ফেরত নেয়া হয় নি। আমার উদ্দেশ্য ছিল টাকা নয়, আমাকে উপেক্ষা করার মজা দেখানো…। “

বিভিন্ন সময় সেতু নির্মাণ, গভীর নলকূপ প্রকল্প, রিলিফ বিতরণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি কাজে গ্রামের নেতাদের মধ্যেকার গন্ডগোলের অভিযোগ যায় মহকুমার দফতরে, তারা আসেন, উচ্চ দামে মিটমাট হয়। এসব ঘটনাবলী গ্রামের মানুষ জানে। তবে ভান করতে হয় না জানার। কেননা ‘আদার ব্যাপারী তো আর জাহাজের খবর’ রাখতে পারে না।

৩. তহশিলদারদের সঙ্গে গ্রামের এইসব নেতাদের সম্পর্ক সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে যেমন তেমনই, বেশ উষ্ণ। তহশীলদার গ্রামের জমির হিসেব রাখেন, কর তোলেন। মাঝে মাঝেই তহশীলদার অফিস থেকে দরিদ্র কৃষকদের অনেকের দলিল হারিয়ে যায়, এমনকি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকেও জমির দখল নেয়া তো এমন কিছু নয়৷ তাছাড়া মামলা-মোকদ্দমা হলেও সে আর এমন কি। এছাড়া কর বসানোর ব্যাপারে তহশীলদার যা তোলেন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ যা তোলে, তাতে দেখা যায় কিছু কিছু মানুষের জমি প্রচুর থাকা সত্ত্বেও তাদের কর কম, জমি কম থাকা সত্ত্বেও অনেকের কর বেশী।

কিছু দিন আগে যখন খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের প্রশ্ন উঠেছিল তখন তহশীলদারের সাথে গ্রামের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ভূমিহীনদের যেভাবে বলা হয়েছিল, তারা সেভাবেই আবেদন করেছে, প্রতি আবেদনের পিছু টাকাও দিতে হয়েছে তাদের। কিন্তু খাসজমি এমনভাবে এমন সব লোকেদের হাতে চলে গেছে যাতে ভূমিহীনদের জন্য জমি আর পাওয়াই যায় নি। যারা পেল, এমন জমি পেল সেগুলো চাষের যোগ্য নয়, বাধ্য হয়ে সরে আসতে হল।

৪. চিকিৎসা-শিক্ষার ব্যাপারে গ্রামের মানুষদের কথা বেশী বলা বাহুল্য বই আর কিছু নয়৷ গ্রামের শতকরা ৯০ জন মানুষ যাদেরকে প্রতিদিন চরম অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়, অপুষ্টি যাদের অনিবার্য সঙ্গী, তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা বিলাসিতা হওয়াই স্বাভাবিক। চিকিৎসা তাদের খুব বেশী হলে মৌলবীর ফুঁ কিংবা কবিরাজের দু’আনা দামের বড়ি কিংবা হাটের উচ্চকণ্ঠ ক্যানভাসারদের বিষাক্ত দাওয়াই। শিক্ষার তো প্রশ্নই নেই৷ একবার এই গ্রামেরই এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে পড়বার ব্যাপারে জেদ ধরেছিল বাবার সাথে, যখন সংসারে অভাব চরম হয়ে এল বাৎসরিক নিয়মে, তেমনই একটি দিনে, ছেলেটি সবার সামনে, কাজে না গিয়ে পড়তে যাবার জন্য বাবার হাতে মার খেয়ে পুরোপুরি পড়াশোনা ছেড়ে দিলস স্বাভাবিক ঘটনা সন্দেহ নেই৷

৫. শ্রেণী বন্ধুত্ব রয়েছে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। শ্রেণীর সাথে শ্রেণীর বিরোধও রয়েছে৷ যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রামীণ সমাজ, সেই ধনী কৃষক শ্রেণী নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও, নিজেদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব কখনো নষ্ট করে না। এই শ্রেণী নিজেদের অস্তিত্বকে সংহত করবার জন্য, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তহশীলদার, ইউনিয়ন কৃষি কর্মী, দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার, থানা সার্কেল অফিসারসহ থানার বিভিন্ন বিষয়ক কর্মকর্তাবৃন্দ, ব্যাংক কর্মকর্তাবৃন্দ, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ, মহকুমা প্রশাসক, মহকুমা পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রমুখ অর্থাৎ আমলা শ্রেণীর সাথেও উষ্ণ সম্পর্ক রাখে। তাদের এ বন্ধুত্ব ভাঙ্গে না কখনো – মাঝে মাঝেই বিভিন্ন প্রকল্পে, বন্যা কিংবা অন্য দূর্যোগে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করে নেবার সুযোগ আসে৷

এছাড়া গ্রামের মাঝারী কৃষক শ্রেণী মোটামুটি ধনী কৃষকদের সাথেই থাকে সুখে-দুঃখে। গরীব কৃষক শ্রেণী আবার উপকার চাইতে ভূমিহীন কৃষি মজুর শ্রেণীরই বেশী কাছাকাছি। কেননা যেকোন সময়ই গরীব কৃষকদের নেমে আসার সম্ভাবনা থাকে দিন-মজুরদের পর্যায়ে। দিন-মজুরদের সাথে ধনী বা মাঝারী কৃষকদের সম্পর্ক অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। দিন মজুরদের সাধারণতঃ কাজ করতে হয় ভোর থেকে সন্ধা, কখনো গভীর রাত পর্যন্ত। আপত্তি নেই দিন মজুরের মনিবের সামনে, আপত্তি থাকে ভেতরে। প্রকাশিত হয় স্ব-শ্রেণীর লোকের কাছে। মুনীব যখন অন্য ধনী কৃষক বা মাতবর সম্পর্কে কুৎসা করে কিংবা নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী শোনায়, তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দিন মজুরদের শুনতে হয়, সাথে সাথে সায়ও দিতে হয়। যখন দিন-মজুরদের বউ-ঝি সম্পর্কে মুনিব কিংবা মুনিবের পুত্র কোন অশ্লীল ইঙ্গিত করে  তাও হেসে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে শুনতে হয়। যখন মজুরির ব্যাপারে মুনিব সিদ্ধান্ত নেয়, যখন মুনিব জমি বর্গা দিয়ে সে সুযোগে গালাগালি করা, ভাগ বেশি নেয়া, অন্যান্য কাজ করিয়ে নেয়া ইত্যাদি করে তখনও সহ্য করতে হয়। ভূমিহীনদের অসংগঠিত নিস্ফল ক্ষোভ নিজের শ্রেণী বন্ধুদের সাথে কথা বলাতে কিংবা গালাগালিতেই শেষ হয়। ঋণের সুদের টাকা বেশী হলেও উপায় নেই। কেউ যদি কখনো সামান্যতম ঔদ্ধত্য দেখায়, তবে তার কাজ পাওয়া, ঋণ পাওয়া, আবেদন পত্র লেখা, সালিশে সমর্থন পাওয়া ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। সে জন্য অনুগত থাকতে হয়। দরিদ্র কৃষকদের বেলায়ও একই কথা। 

বছরের প্রায় ছয় মাস গ্রামে কাজের অভাব থাকে খুব বেশী। সে সময়টা, ফসলের পূর্বেকার সময় তখন মজুরী কমে যায়, ফসলের দাম বেড়ে যায়। আর যদি খরা কিংবা বন্যায় ফসল নষ্ট হয় তবে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে মজুরদের জন্য। এরকম একটি পরিস্থিতির কথা মনে আছে। মজুররা ঘুরছে, কাজ নেই। একজন ধনী কৃষক বললো দু’জন মজুরকে, আমার এখানে কাজ আছে, কাজ করলে কর। মজুর দূর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলো, কত দেবেন? কৃষক বললো – চার আনা পাবি। মজুর দু’ জনের বিনীত কন্ঠ – ‘না আট আনা দেন।’ ধনী কৃষক রাজি হলো না। মজুর দুজন চলে গেলো। কিছুদূর গিয়ে মজুর দু’ জন দাড়িয়ে পরামর্শ করলো। একজন ফিরে এলো চার আনা মজুরিতেই কাজ করতে, অন্য জন রাজি হতে পারলো না, চলে গেলো।

যে ধনী কৃষক যত বেশী জমি বর্গা দিতে পারে এবং একই সাথে যত বেশী কামলা নিয়মিত রাখতে পারে ততই তার শক্তি বেড়ে যাবে। আগে লাঠিয়াল বাহিনী রাখার নিয়ম ছিল, এখন এভাবেই অনুগত সমর্থন আদায় করা হয় বিভিন্ন কাজের – তা সে যেমন কাজেরই হোক।

৬. গ্রামের মেয়েদের অবস্থাএ শ্রেণী বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। ধনী পরিবার গুলোতে পর্দা অনেক বেশী। তাদের মেয়েরা স্কুলে যায়, কেউ কেউ কলেজেও যায়। তাদের সম্পর্কে কেউ কিছু বললে তা স্বাভাবিক বলে নেয়া হয় না। এই শ্রেণীর মেয়েরা যতটুকু  এবং যেভাবে অত্যাচারিত হয়, তা নিজেদের শ্রেণীর ভেতরে। নিজেদের বাবা, ভাই, স্বামীদের দ্বারা। কিন্তু গরীব শ্রেণীর মেয়েরা শুধু নিজেদের শ্রেণীর পুরুষদের দ্বারাই নয়, ধনী শ্রেণীর অত্যাচারেও তাদের পড়তে হয়। এই শ্রেণীর মেয়েদের তাদের শ্রেণীর পুরুষদের উপর যা কিছু অত্যাচার শোষণ হয়, তা তাদের উপরও পড়ে, কিন্তু তাদের উপর আরেকটি বাড়তি বোঝা আছে সেটি হচ্ছে নিজেদের শ্রেণীর পুরুষদের অত্যাচার ও শোষণ। নিশ্চয়তা নেই এদের, নিরাপত্তাও নেই – পুরুষদের চাইতেও বেশী এই অনিশ্চয়তা,  অনিরাপত্তা।

গ্রামের কোন গরীব মেয়ের পক্ষে গ্রামের ধনী ব্যক্তি,  তাদের সুযোগ্য পুত্রদের দৃষ্টি থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। এমনকি বিবাহিতা মেয়েদের পক্ষেও নয়৷ স্বামী সামাজিক ভাবেই দূর্বল, বছরের অধিকাংশ সময়ই খাবারের অনটন, সেক্ষেত্রে স্বামীকেও আত্মসমর্পণ করতে হয় কখনো ভয়ে, কখনো লোভে। বিধবা কিংবা পরিত্যক্তা মেয়েদের জন্য পরিস্থিতি আরও বেশী নাজুক।

৭. বর্তমান সময়ে একটি গ্রামের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এ দ্রব্যমূল্য জুলাই, ‘৭৮ – এ নেয়া। ধান (মণ) ৮০.০০ টাকা, চাল (মণ) ১২৫.০০ টাকা, দুধ (সের) ৫.০০ টাকা, সরিষার তেল (সের)  ৩০.০০ টাকা, কেরোসিন তেল (গ্যালন) ১০.০০ টাকা, মুরগীর ডিম  (হালি) ২.০০ টাকা, ডাল (সের) ৬.০০ টাকা, শাড়ি (সর্বনিম্ন) ৪০.০০ টাকা, লুঙ্গি (সর্বনিম্ন) ২০.০০ টাকা, পিঁয়াজ (সের) ১.৫০ টাকা, শুকনো মরিচ (সের) ২০.০০ টাকা।

বিদেশীদের চোখে

কিছুদিন আগে নেদারল্যান্ডের এক দম্পতি বাংলাদেশের একটি গ্রামে এক বছর থাকার পর নিজস্ব অভিজ্ঞতার উপর নিজস্ব উদ্যোগে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ঝগড়াপুর। এতে ঐ গ্রামের সামগ্রিক চিত্র আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী তারা সেই চেষ্টা করেছেন।

গ্রাম নির্বাচন করতে গিয়ে প্রথমে তিনি জনৈক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেন, যিনি একজন ধনী কৃষক। তার সাথে ছিলেন আরও দু’জন ধনী কৃষক। এদের সঙ্গে আলোচনা করে দম্পতি তাদের প্রতিক্রিয়া লিখেছেন, “গ্রামের গরীব কৃষকদের জন্য আমার অপরাধবোধ এত বেশী হচ্ছিলো যে, আমরা যতশীঘ্র সম্ভব এলাকা ত্যাগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। আমরা একটি গ্রাম চাইনি যেখানকার নেতারা রিলিফ মানসিকতায় পচে গেছে, যেখানকার নেতারা এমন স্ক্রাউন্ডেল, সে গ্রামে আমরা থাকতে চাইনি। যদিও আমরা জানতাম, বাংলাদেশের সব গ্রামের চেহারা মোটামুটি একই৷

গরীব একটি পরিবার সম্পর্কে লিখেছেনঃ ” পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। বাবা কৃষি মজুর, সে কাজের দিন এক সেরের কিছু কম চাল পায়। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময় সে কাজই করতে পারে না অসুস্থতা কিংবা কাজ না থাকার দরুণ। মা বছরের কোন কোন সময় কাজ পায়, কিংবা কাঁথা সেলাই করে বোনের সাথে। ছোট ছেলে রাখাল হিসেবে কাজ করে। এদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য পরিবারের চাইতে ভালো। কিন্তু তবুও কিছু দিন আগে তাদের সর্বশেষ সম্পদ দু’ বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। “

এরপর লেখক দম্পতি বলেছেনঃ ‘যখন গরীব কৃষক পরিবারগুলোকে বাজার থেকে পণ্য কিনতে হয় তখনই তাদের সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়। কেননা, কম দামের সময় পণ্য কিনে মজুত রাখা সম্ভব হয় না। তাদের প্রয়োজন কিংবা সঙ্গতির সময় পণ্যের দাম অনেক বেশী থাকে। খাদ্য ছাড়া অন্যান্য অত্যাবশকীয় পণ্য কেনা আরও মুশকিল। বছরের তিন থেকে চার মাস তাদেরকে ক্ষুধা মেটানোর পাতা খুঁজতে হয়৷ এমনিতে যা খাদ্য তারা জোটাতে পারে তাও পুষ্টিকর নয়, পরিমাণের দিক থেকেও নয়, স্বরূপের দিক থেকেও নয়৷ একজন মজুর যা আয় করে তা দিয়ে খাদ্য কিনে নিজের খাবার পর অবশিষ্ট অংশ পরিবারের অন্যান্য সদস্য খায়। স্ত্রী গর্ভবতী হোক, বা যাই হোক, এর অন্যথা হবার জো নেই।’

গ্রামের মজুরি সম্পর্কে বইতে এরপর একটি ছক দেয়া হয়েছে। এতে ১৯৬৯ সনে তুলনায় ১৯৭৫ সনে কিভাবে মজুরি কমেছে তা দেখানো হয়েছে চালের দামের সঙ্গে অনুপাত করে।

বছর মজুরি সের প্রতি চালের দাম চালের দাম অনুযায়ী মজুরী
১৯৬৯ ১.০০ ০.৫০ ২.০০
১৯৭০ ১.০০ ০.৭৫ ১.৩৩
১৯৭১ ১.০০ ০.৭৫ – ১.০০ ১.৩৩ – ১.০০
১৯৭২ ১.০০ ০.৭৫ – ১.০০ ১.৩৩ -১.০০
১৯৭৩ ১.৭৫ ২.০০ ০.৯০
১৯৭৪ (জুলাই) ২.৭৫ ৩.৫০ ০.৮০
১৯৭৪ (বাকী) ৪.০০ ৫.০০ ০.৮০
১৯৭৫ (এপ্রিল পর্যন্ত) ৫.০০ ৬.২৫ ০.৮০

বর্গাদারদের অবস্থা সম্পর্কে বইতে বলা হয়েছে, ঝগড়াপুরের শতকরা প্রায় ৪০ টি পরিবার জমি বর্গা দেয়৷ বর্গাদারদের মধ্যে কিছু কিছু মাঝারি কৃষকও রয়েছে। বিভিন্ন কারণে, গরীব কৃষকদের জন্য জমি বর্গা নেয়াও খুব কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমি বর্গা দেয়া হয় ভাগপ্রথার অধীনে৷ সে অনুযায়ী জমির মালিক পায় শতকরা ৫০ ভাগ এবং চাষী পায় গড়পড়তা শতকরা ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ, যেহেতু পুরো খরচ তাকেই দিতে হয়।

গ্রামের ঋণ পরিস্থিতি সম্পর্কে লেখক দম্পতি বেশ কিছু ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়েছেনঃ

“একজন ভেড়া ব্যবসায়ী নিয়মিত ৪ মাইল দূরে অবস্থানরত একজন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। সে বলছে, গত সপ্তাহে আমি মহাজনের কাছ থেকে চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। ঋণ নেবার পরের দিন ভোরে টাকা নিয়ে ১৫ মাইল দূরের সাপ্তাহিক হাট থেকে ভেড়া সে টাকায় কিনে পার্শ্ববর্তী গ্রামে তা বিক্রি করেছি ৪৬০০ টাকায়। লাভ ৬০০ টাকার মধ্যে মহাজনকেই আমার দিতে হয়েছে ৪০০ টাকা। গড়পড়তা বার্ষিক শতকরা ২৬০ ভাগ মুনাফা। “

“বছরের তিনটি সময়ে সাধারণতঃ ঋণ দেয়া হয়। মার্চ কিংবা এপ্রিলের শুরুতে, যখন বিবাহ জাতীয় উৎসব ইত্যাদি হয়, আগস্ট মাসে আউস ধান কাটবার আগে আগে, নভেম্বর-ডিসেম্বরের আমন ধান কাটবার আগে। কোন পরিবার যদি এক মণ ধান ঋণ নেয় তবে পরবর্তী মৌসুমে (দু-এক মাস পরেই) তাকে দেড় মণ ধান ফেরত দিতে হবে। বাৎসরিক সুদ দাড়ায় এতে শতকরা ৩০০ ভাগ। নগদ ঋণের ক্ষেত্রে সুদ শতকরা ৬০ থেকে ১৫০ পর্যন্ত উঠানামা করে। গ্রামের এই মহাজনদের মধ্যে রয়েছে ১৩ থেকে ৩৭ জন ধনী কৃষক, এদের মধ্যে ৪ জন তরুণ এবং শিক্ষিত।”

“গ্রামের কুখ্যাত জোতদার ঋণ চুক্তির বেলায় সবসময়ই একটি শর্ত উপস্থিত করে, যাতে ঋণগ্রহীতাকে সবসময়ই জমি বন্ধক দিতে হয়। জমির দখল করার উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়। সে তাদেরকেই ঋণ দিতে পছন্দ করে, যারা ঋণ এবং সুদের টাকা ফেরত দিতে সক্ষম নয়৷ এভাবে এই ব্যক্তি ১৫০ বিঘা জমি বানিয়েছে, দুটো পরিবারকে সম্পূর্ণ সর্বস্বান্ত করেছে৷ ইদানীং এই ব্যক্তি খুন কিংবা মার খাবার ভয়ে নিজের কর্মকান্ড কিছু কমিয়ে ধর্মকর্মে মন দিয়েছে।

একজন ক্ষুদ্র কৃষক যে তার জমি ধনী কৃষকের কাছে বন্ধক রেখেছে, সে বলছেঃ ” দু’ বিঘা জমি দু’ জন ধনী কৃষকের কাছে বন্ধক রেখেছি। একবার খাবারের খুব অভাবে, আরেকবার ঘর পুড়ে যাওয়ায় তা ঠিক করবার জন্য জমি বন্ধক দিতে হয়েছিল। প্রত্যেক মহাজন আমাকে একশ করে টাকা দিয়েছে। সে সময় সেই টাকা দিয়ে ৪ মণ ধান কিনতে পেরেছি, ১৯৭১ সন ছিল তখন। দু’ মহাজনই এ জন্যে জমি দশ বছরের জন্য আটকে রেখেছে। তারা পুরো জমির ফসল পাচ্ছে প্রতি বছর। এখন ৭০ টাকা হলেই আমি আইনত জমি ছাড়াতে পারি, কিন্তু সে টাকা আমার হাতে নেই। তাছাড়া এখন জমি ছাড়বার কেন ইচ্ছেও মহাজনদের নেই। গ্রামের আদালত তাদের পক্ষে। “

[সূত্রঃ ঝগড়াপুর ; জেনেকা এরেন্স, জস ড্যান বারডেন]

প্রশাসনঃ গ্রাম থেকে জেলা

বাংলাদেশের নিম্নতম প্রশাসনিক ইউনিট হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। গ্রাম পর্যায়ে প্রশাসন নেই, তবে প্রতিনিধি আছে প্রশাসনেন। ইদানীং চেষ্টা হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে প্রশাসন নিয়ে যাওয়ার৷

গ্রামীণ প্রশাসনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাই আমাদেরকে নিম্নতম প্রশাসনিক ইউনিট একটি জেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদকেই বেছে নিতে বলা হয়েছিল, যার পরবর্তী স্তর হিসেবে থানা প্রশাসন, মহকুমা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসন এসেছে ;  এখানে নাম উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কেননা, এই প্রশাসনিক কাঠামো বাংলাদেশে সকল এলাকার জন্যই সত্য। প্রশাসনের বর্তমান অবস্থায় যাবার আগের এর ঐতিহাসিক পটভূমি উল্লেখ করা প্রয়োজন।

ঐতিহাসিক পটভূমি

এদেশ ব্রিটিশদের অধীনে আসার অনেক আগে থেকে এদেশের গ্রাম প্রশাসনের সকল দায়িত্ব ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর। গ্রাম পঞ্চায়েত অর্থাৎ গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এই গোষ্ঠী ভূমি কর আদায় এবং গ্রামীণ জীবন নিয়ন্ত্রণ করতো। বৃটিশরা এ দেশ দখল করবার পর এ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়। বিশেষ করে ১৯৭৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্থাপনের পর বাংলাদেশের গ্রামে জমিদার হিসেবে নতুন এক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে৷ এই জমিদার শ্রেণী ভূমি কর আদায় ছাড়াও গ্রামের ‘শান্তি-শৃঙ্খলা ‘ রক্ষার দায়িত্বও বহন করতো। এজন্য ক্রমে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী আবির্ভূত হয়। পরে বৃটিশ শক্তির সুবিধার্থে আরো কিছু বিশেষ সংস্কার করা হয়। ১৮৭০ সালে ‘চৌকিদারী পঞ্চায়েত এ্যাকট’ গৃহীত হয়। যার মূল কথা ছিল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গ্রামের পাঁচজন সদস্য নিয়ে পঞ্চায়েত গঠন করবেন, যে পঞ্চায়েত চৌকিদার নিয়োগ করবে৷ পঞ্চায়েত এই চৌকিদারদের লালন-পালনের প্রয়োজনীয় খরচ নির্বাহের জন্য গ্রাম থেকেই কর আদায় করবেন৷ পঞ্চায়েতের জন্য নির্ধারিত কোন ব্যক্তি এর সদস্য হতে না চাইলে তাকে জরিমানা করা হতো এবং পঞ্চায়েত যদি নির্ধারিত কর তুলতে ব্যর্থ হতো তাহলে তাকে শাস্তি দেয়া হতো৷ চৌকিদারদের নিয়োগ পঞ্চায়েত করলেও তাদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা ছিল একমাত্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের। এই ব্যবস্থা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকলে লর্ড রিপন ১৮৮২ সালে এর কিছু সংস্কার করেন। এই সংস্কারের উপর ভিত্তি করেই ১৮৮৫ সালে ‘সেলফ-গভর্নমেন্ট এ্যাকট’ গৃহীত হয়।  এই এ্যাকটের অধীনে ব্যবস্থা করা হয়েছিল বাংলাদেশের তিন পর্যায়ের স্থানীয় প্রশাসন – জেলা বোর্ড, স্থানীয় বোর্ড এবং ইউনিয়ন কমিটি। সর্বনিম্ন পর্যায়েই ছিল ইউনিয়ন কমিটি। যার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় পুকুর, স্কুল এবং রাস্তা সংস্কার। পাশাপাশি চৌকিদারী পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও থাকে অব্যাহত।

প্রথম দিকে লর্ড রিপনের এ উদ্যোগকে ভারতীয় নেতারা স্বাগতঃ জানালেও ক্রমশঃ তারা বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯১২-১৩ সালে জেলা প্রশাসন কমিটিও এই ব্যবস্থার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে রিপোর্ট দেন। এর আগে ১৯০৭ সালে এসব বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট পেশ করবার জন্য সি, ই, এইচ হবহাউসের নেতৃত্বে ‘দ্য রয়্যাল কমিশন অন ডিসেন্ট্রালাইজেশন’ গঠিত হয়। ১৯০৯ সালে কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করেন। কিন্তু এই রিপোর্ট অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

১৯১৮ সালে মন্টেও-চেমসফোর্ড রিপোর্টে জোর দিয়ে স্থানীয় প্রশাসনে জনপ্রিয় মানুষদের নেয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এসব ঘটনা ঘটেছিল দেশে উদ্ভুত ক্রম বিষ্ফোরণন্মুখ অবস্থার কারণে। ১৯১১ সালে ‘ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট এ্যাকট’ পাশ করা হয়। এতে জেলা বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ড রাখা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আয়ূব খানের বুনিয়াদী গণতন্ত্র চালু করার পূর্ব পর্যন্ত মূলতঃ এই ব্যবস্থাই চালু ছিল। এর পূর্বে ছয় থেকে নয়জন সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন বোর্ড গঠিত হত। ১৯৫৬ সালে কিছু সংস্কার করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন বোর্ডে সদস্য সংখ্যা আরও দুজন বাড়ানো হয়। এবং বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ূব খান ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র আদেশ’ জারি করেন। এ ব্যবস্থায় ছিল কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়নের জন্য একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল, একটি থানার জন্য একটি থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল এবং বিভাগীয় কাউন্সিল। এ নিয়ম অনুযায়ী ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেম্বারদের ভোটে নির্বাচিত হতেন।

[তথ্যসূত্রঃ বেসিক ডেমোক্রেসিস এট দ্য গ্রাস বুটস – এটি রফিকুর রাহমান এবং পলিটিক্স এন্ড এডমিনিস্ট্রেশন ইন দ্য লোকাল কাউন্সিলস]

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চেয়ারম্যানের সরাসরি নির্বাচনের নিয়ম করা হয়। ১৯৭৪ সালে একবার পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা রদবদল করে ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করেন। ‘৭৫ এর ১৫ ই আগস্টের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক পূর্বে গৃহীত ব্যবস্থা বাতিল করে ইউনিয়ন পরিষদ পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমান ধারা

বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের যে কাঠামো, যে কর্মধারা, তা অতীতের চাইতে ভিন্নতর কিছু নয়। বর্তমানে একটি ইউনিয়ন পরিষদ যেসব কাজ করে থাকে সেগুলো হচ্ছেঃ (ক) কর সংগ্রহ, (চৌকিদারী কর ইত্যাদি),  (খ) কাজের বিনিময়ে খাদ্য,  (গ) রিলিফ বিতরণ (ঘ) রাস্তা, সেতু, কালভার্ট মেরামত,  (ঙ) জাতীয়তা, গরু- বাছুরসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের মালিকানার সার্টিফিকেট। এই কাজ নিয়েই ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্ব কাজ করছে। ইউনিয়ন পরিষদের অবশ্য আরো কিছু কাজ আছে। যেমন, সম্প্রতি প্রতি ইউনিয়নে বেশ কিছু কমিটি করা হয়েছে – ইউনিয়ন শিক্ষা কমিটি, ইউনিয়ন প্রতিরক্ষা কমিটি, ইউনিয়ন গ্রাম উৎপাদন কমিটি। গ্রাম পর্যায়েও রয়েছে গ্রাম শিক্ষা কমিটি, গ্রাম প্রতিরক্ষা কমিটি, গ্রাম খাদ্য উৎপাদন কমিটি। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলোর প্রধান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান  এবং গ্রাম পর্যায়ের কমিটি গুলোর প্রধান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। এসব কমিটি গুলের কার্যক্রম এখনও বৈঠক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা সন্দেহাতীত কারণেই মূলতঃ প্রতিনিধিত্ব করেন তাদেরই যারা এমনিতেও গ্রাম অঞ্চলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এরা হচ্ছে ধনী কৃষক শ্রেণীর প্রতিনিধি, কখনো ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রতিনিধি। গ্রাম পর্যায়ে  ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ধারা সুস্পষ্ট হবে আলোচ্য গ্রাম এবং ইউনিয়নের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য উল্লেখ করলেই।

১। আলোচ্য ইউনিয়নের আয়তন ১০.০২ বর্গমাইল, লোক সংখ্যা ২১,৫০০ জন, গ্রাম ২৮ টি, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সংখ্যা ১৩ জন (২ জন মহিলা),চৌকিদার ৯ জন, দফাদার ৯ জন, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ২০ টি, হাইস্কুল ১ টি, জুনিয়র হাইস্কুল ১ টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৯ টি, মসজিদ ৩৬ টি, দাতব্য চিকিৎসালয় ১ টি, তহবিল অফিস ১ টি, ডাকঘর ১ টি, মোট জমির পরিমাণ ৫,৮০৩ একর (এর মধ্যে আবাদী ৫,৩৯৫  একর), খাল ১০ মাইল, বিল ১৩ টি (সবগুলোই হাজামজা অবস্থায় রয়েছে), মোট পরিবার সংখ্যা ৩,৯১৮ টি, এর মধ্যে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ২,০০০ টি।

২। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের বেতন, চৌকিদার, দফাদারদের বেতন এবং কাগজপত্র, চা-সিগারেট বাবদ বার্ষিক খরচ হয় ৩০,০০০ টাকা। এর একটি অংশ চৌকিদারী কর, জমি এবং বসতবাড়ির বার্ষিক মূল্যের উপর কর ইত্যাদি থেকে ইউনিয়ন পরিষদকেই আদায় করবার কথা। তবে অধিকাংশ সময়ে তা উঠে না।

৩। গত এক বছরে ইউনিয়নে রিলিফ এসেছে – ৮ বস্তা দুধ। এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে এসেছে ১০০ মণ গম।

৪। কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি কৃষি উন্নয়ন সংস্থাই গ্রাম, ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করে। এছাড়া কৃষি প্রসারণ ব্যবস্থাপনা – র পক্ষ থেকে ইউনিয়ন কৃষি কর্মী নিয়োগ করা হয়। জেলা বোর্ড দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা করে। স্কুলগুলো সরাসরি থানা শিক্ষা অফিসার পরিচালনা করে। এ সকল কাজে স্থানীয় কার্যক্রমের ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে আনুষ্ঠানিক কিছু যোগাযোগ রাখা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের এর উপর সরাসরি কর্তৃত্ব নেই, তবে সম্পর্ক আছে গ্রামীণ ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের।

৫। কৃষি উন্নয়ন সংস্থা ইউনিয়নে ৯ জন ডিলার নিয়োগ করেছে, যাদের দায়িত্বে রয়েছে বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ ইত্যাদি। গত মৌসুমে কীটনাশক ওষুধ পাউন্ড প্রতি ৭ টাকার স্থলে বিক্রি হয়েছে ১৬ টাকা পাউন্ড, ইউরিয়া সার মণ প্রতি ৬০ টাকার স্থলে বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা মণ, ফসফেট ৪৮ টাকা মণের স্থলে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা মণ।

৬। ইউনিয়ন কৃষি কর্মী রয়েছেন একজন। কৃষি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করতে হয়। তার কাজ হচ্ছে কৃষকদের উন্নত চাষাবাদের ব্যাপারে পরামর্শ দান। নির্বাচিত জমি চাষ, যথাসময়ে বীজ-সার সরবরাহের ব্যাপারে চেষ্টা করা ইত্যাদি। বেতনভুক এই কর্মচারী জানিয়েছেন, তার নিজের ক্ষমতা কিছু নেই, পরামর্শের সাথে উপাদান তিনি দিতে পারেন না। কৃষি উন্নয়ন সংস্থার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়। অধিকাংশ সময়ে, যথাসময়ে এবং যথাযথ দামে এসব দ্রব্যাদি পাওয়া যায় না।

৭। কৃষি ঋণ দেয়া হয়েছে ১,২৭,০০০ টাকা। আউশ, বোরোর জন্য নির্ধারিত ঋণ দেয়া হচ্ছে এ ফসল চাষ হবার পর। অভিযোগ রয়েছে ঋণের প্রতি হাজার টাকার জন্য ২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়৷ অবশ্য ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এ সম্পর্কে কিংবা উচ্চ মূল্যে বীজ সার কেনার ব্যাপারে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই, কেননা তিনি যথাদামেই সব পেয়েছেন।

৮। তহশীল অফিস উন্নয়ন কর, শিক্ষা কর, পথ কর, অতিরিক্ত উন্নয়ন কর এবং ২৫ বিঘার উপরে খাজনা তুলে থাকেন। এ বছর রাজস্ব আয় হয়েছে ২৮,০০০ টাকা। ২৫ বিঘার উপর জমি রয়েছে অফিসিয়ালি ২৩৮ টি পরিবারের।

৯। ইউনিয়নের বৃহত্তম হাট ইজারা দেয়া হয়েছে ৪৩,০০০ টাকায়, গো-হাট ১৮,০০০ টাকায়। ইজারাদার সম্পর্কে অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও অভিযোগ আছে।

১০। ইউনিয়নে কামার পরিবার রয়েছে ১৮ টি, তাঁতী পরিবার রয়েছে দেড়শ।

১১। ইউনিয়ন গভীর নলকূপ রয়েছে ৬ টি। যেগুলো প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। নেতৃত্বে আছেন ধনী কৃষকরা। গভীর নলকূপ সম্পর্কে কৃষকদের অভিযোগ – এগুলো নষ্ট হলে ঠিক করা মুশকিল, নলকূপ আনতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে, ঘুরতে হয়েছে দু মাস থেকে এক বছর৷

১২। ইউনিয়নে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য নয়। অকেজো দাতব্য চিকিৎসালয়, যেখানে ডাক্তার কখনোই থাকে না। এছাড়া ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আর কোন ব্যবস্থা নেই।

১৩। উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় উভয় ক্ষেত্রেই জরিপ নিয়ে দেখা গেছে, ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা কমছে। যদিও বাড়ছে লোক সংখ্যা।

১৪। ইউনিয়ন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি ব্যাপারে এবং  ঐগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের কাজের অসঙ্গতি প্রকট। ইউনিয়ন খাদ্য উৎপাদন কমিটি, কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, ইউনিয়ন কৃষি কর্মীর মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। খুঁজে পাওয়া মুশকিল ইউনিয়নের শিক্ষার সাথে ইউনিয়ন শিক্ষা কমিটির কাজের। স্বাস্থ্য সম্পর্কে তো প্রশ্নই নেই। সার, বীজ, নলকূপ, কালোবাজারী ইত্যাদি সম্পর্কিত দূর্নীতি, অনিয়মিত সরবরাহ, শিক্ষকদের বেতন নিয়ে কারচুপি, স্কুল ভেঙ্গে গেলে দায়িত্বের বিরাট ফর্মালিটি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ইত্যাদি ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের কিছুই করবার নেই। এছাড়া কৃষকদের পাটের ন্যায্য দাম পাওয়া, ধান-চালের ন্যায্য দাম পাওয়া, ফড়িয়া-পাইকারদের দৌরাত্ম কমানো, ভূমিহীন দের স্বার্থ সংরক্ষণ, জমি সম্পর্কিত ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তি, ক্ষুদ্র কৃষকদের ঋণ মুক্ত করা, ঋণসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামের সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদ আরো বেশী অথর্ব। ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃত্বের এসব কাজ করবার ইচ্ছে আছে বলেও মনে হয়নি৷ খালগুলো কেটে দিলে এলাকায় দ্বিগুণ উৎপাদন হওয়া সম্ভব, এটা জেনেও বর্তমান নেতৃত্ব এ ব্যাপারে এগুতে পারেনি৷ তাদের বক্তব্য – সি, ও কিছু বলছে না। ফান্ড দিচ্ছে না।

১৫। এসব ব্যাপারে চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বারবার জাতীয় পর্যায়ে বহুল উচ্চারিত কথাগুলোই পুনরুক্তি করেই বলেন, “মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। কৃষকদের অলসতা কমাতে হবে৷ কামলাদের আরও বেশী কাজ করতে হবে। ” কোন মানসিকতার পরিবর্তন, কার অলসতা কমাতে হবে ইত্যাদি প্রশ্নে তার কোন উত্তর ছিল না। এরপর তিনি বলেন, “থানা অফিস সব কাজে দেরী করলে, ঘোরালে, পয়সা চাইলে আমরা কি করবো? “

থানা-মহকুমা প্রশাসন

থানা পরিষদে চেয়ারম্যান থাকেন মহকুমা প্রশাসক। এতে থাকেন থানার অধীনস্থ সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, থানা পর্যায়ের সকল সরকারী কর্মকর্তা।

থানা প্রশাসনের প্রধান হচ্ছেন সার্কেল অফিসার। তার মাধ্যমেই ইউনিয়ন কিংবা গ্রাম পর্যায়ে সকল উন্নয়ন তৎপরতা চালানো হয়। ইউনিয়ন পরিষদের সরাসরি যোগাযোগ তার সাথেই৷

মহকুমা প্রশাসনের প্রধান হচ্ছেন মহকুমা প্রশাসক। তিনি সাধারণতঃ মহকুমা পর্যায়ে সকল সংস্থার, সকল বিভাগের কাজের প্রধান সমন্বয়কারী। তার মূল কাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়ন। তিনি যেসব কাজকর্ম দেখেন তার মধ্যে রয়েছে, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বেসরকারী স্কুল-কলেজ এবং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন, বিভাগীয় উন্নয়ন স্কীম অন্যান্য সংস্থার বিশেষ ধরণের উন্নয়ন কাজ। মহকুমা প্রশাসক একই সঙ্গে মহকুমার বিভিন্ন ক্রিমিনাল কেস দেখেন, তাকে সহযোগিতা করেন ম্যাজিস্ট্রেট বৃন্দ। মহকুমা প্রশাসকের অধীনে থাকেন সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন যার অধীনে থাকে ইউনিয়ন পরিষদ)। সার্কেল অফিসার (রাজস্ব যার অধীনে থানা রাজস্ব অফিসার এবং এর অধীনে থাকে তফসীল গুলো),

[Table]

মহকুমা প্রশাসক মহকুমা পরিচালনা সম্পর্কে বলেন, এতসব বিষয়ে একজনের পক্ষে কাজ করা দুরূহ ; সমন্বয় সাধন করা মুশকিল। আর যা কিছু আমরা কর্মসূচী নেই, তাও ফান্ডের অভাবে করা যায় না। সবচেয়ে বড় সমস্যা স্থানীয় প্রশাসন গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না৷ গ্রামের মাতবরদের অভ্যন্তরীণ কলহ, সিদ্ধান্ত নেয়ার অপারগতা, স্বতঃস্ফূর্ত কাজের অভাব, অশিক্ষা, আন্তরিকতার অভাব এগুলো উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ইউনিয়ন পরিষদের যে টাকা ইউনিয়ন থেকে তোলার কথা, তা কখনোই ঠিক মতো উঠে না৷

আলোচ্য থানায় উল্লেখযোগ্য হাসপাতাল নেই, যে গ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে তাতে ২৫ টি সিট আছে ; মহকুমায় আছে একটি টিবি ক্লিনিক। সরকারী কলেজ আছে ১ টি। থানা পর্যায়ে ধান মৌসুমের সময়ে খাদ্য ডিলারদের মাধ্যমে ধান কেনা হয়। পাট কেনে পাটের পাইকাররা সরাসরি। দু ক্ষেত্রেই পাইকার-ডিলারদের কারসাজিতে কৃষকরা কখনোই যথাযথ দাম পায় না। এখানে প্রশাসন অবশ্য পৌছেনি।

জেলা প্রশাসক

জেলা প্রশাসক জেলা পর্যায়ের সকল বিভাগের কাজের সমন্বয় সাধন করেন। জেলা প্রশাসক বর্তমান প্রশাসন প্রসঙ্গে বলেছেন, কিছু পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে। মাথাভারী প্রশাসন বললেই হয় না – এস, ডি, ও সি, ও কে হাজার রকম কাজের দায়িত্ব মোকাবেলা করতে হয়।…..  থানা উন্নয়ন কমিটি, থানা পরিষদকে আরো বেশী দায়িত্ব দিতে হবে। ক্ষমতা দিতে হবে৷ দিতে হবে ফান্ড। একটি প্রাথমিক স্কুল ভেঙ্গে গেলে গ্রাম থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরে সি, ও এস, ডি, ও হয়ে ডিসির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। ফান্ড এলে তারপর এতসব স্তর পেরিয়ে তা সেই স্কুল পর্যন্ত পৌছতে পারে৷ এজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে আরও বেশী ক্ষমতা, দায়িত্ব, ফান্ড দেয়া উচিৎ৷ স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগানো উচিৎ। অর্থহীন ফাইল ঘুরিয়ে লাভ নেই।….  অভিযোগ করা হয়, আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, জনগণের কাছে আমাদেরকে যাবার সুযোগ কিংবা সময় দেয়া হচ্ছে কই?

গ্রাম থেকে জেলাঃ মানুষ

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে যে মাধ্যম গুলো হয়ে প্রশাসন গ্রাম পর্যন্ত গেছে, সেগুলোর সঙ্গে গ্রামের মানুষের সম্পর্ক কি? গ্রাম পর্যায়ে অর্থাৎ ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষ নিজেদের ‘অমূল্য’ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচন করেছে ইউনিয়ন পরিষদ। প্রশাসনের উপর গ্রামের মানুষের ক্ষমতা ঐ টুকুই, নির্বাচন এলে প্রচুর ঢাকঢোল, হৈ হট্টগোলের মধ্যে নিজের ভোট দিয়ে পরিষদের চেয়ারম্যান – মেম্বরদের নির্বাচন করা, এরপর গ্রামের মানুষের আর কিছু করার নেই৷ ইউনিয়ন পরিষদ – যাই ই করুক না কেন, সেখানে ‘মূর্খ অলস’ এসব মানুষের কোন ক্ষমতা নেই কিছু করার। ইউনিয়ন পর্যায়ে যে সব সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রয়েছে, তাদের কাজকর্মের ব্যাপারে গ্রামের মানুষের আরও ক্ষমতা নেই। তারা জানেও না এদের খবর, জানার সুযোগও হয় না। কেননা এসব কর্মকর্তা পরিষদের কর্মকর্তাবৃন্দ, গ্রামের সম্মানী ব্যক্তিদের বাইরে কোথাও যান না। তবে গ্রামের মানুষ কদাচিৎ সার্কেল অফিসার বা মহকুমা প্রশাসককে দেখে, কখনো তাদের বক্তৃতাও শুনতে হয় কাউকে কাউকে। সার, রিলিফ, রেশন, কীটনাশক ওষুধ এগুলো কিভাবে এসে কিভাবে শেষ হয় তাও গ্রামের মানুষদের জানবার সুযোগ নেই। থানা পুলিশের কার্যক্রমের সঙ্গে অবশ্য গ্রামের মানুষ পরিচিত, তবে পরিচিতিটা এমনই যে, গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা কখনো সর্বস্বান্ত কিংবা হেনস্তা হবার জন্য থানা-পুলিশের কাছে যেতে চায় না৷ যেতে না চাইলেও যেতে হয় অনেক সময় – থানায়, আদালতে৷ ৫ মাইল, ১০ মাইল, ২০ মাইল দূরের শহরে। অচেনা, অনাত্মীয় শহরে এসে গ্রামের ধূর্ত মানী ব্যক্তিদের উপরই ভরসা করতে হয়। আদালতের হাজারো ঝকমারি, বিচার – খুব সাধারণ বিচারও ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।

মানুষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করে, তাতে তাদের কি লাভ হয়? যাদের ক্ষুদ্র জমি আছে, তারা কি সময় মত বীজ সার ওষুধ পায়? জমি হস্তান্তরের কারচুপি কি কখনো কমানো যায়? শিক্ষার ব্যাপারেও কি কোন কাজ হয়? খাল কেটে গ্রামের বন্যা কমানোর সাথে সাথে কি পাশের জমির ফসল উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে? নিরাপত্তা এসেছে কি মানুষের? চিকিৎসার কোন উন্নতি হয়? দূর্নীতি কমে?  ফড়িয়া – পাইকারদের দৌরাত্ম কি কখনো কমে? থানা প্রশাসন থেকে প্রাপ্য বিভিন্ন জিনিস কি যথাসময়ে আসে? দুর্ভিক্ষের সময় কি বাঁচার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়? 

এগুলো খুবই সাধারণ প্রশ্ন। এরপর অধিকতর প্রয়োজনীয় প্রশ্ন আছে, উৎপাদনের মানুষেরা কি তাদের শ্রমের মূল্য পায়? সুবিচারের কি কোন নিশ্চয়তা আসে সমাজে? মানুষের ওপর মানুষের কদর্য শোষণের কি কমতি ঘটে কখনো? এসব প্রশ্ন তো নয়ই এমনকি উপরের সাধারণ বিষয় গুলোর ক্ষেত্রেও ইউনিয়ন পরিষদ কোন ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাদের সে ক্ষমতাও নেই। যতটুকু ক্ষমতা আছে, ততটুকু প্রয়োগ করে আরও উল্টো ঘটনা ঘটে৷

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করে সাধারণ জনগণ, কিন্তু তাতে প্রশাসনের ওপর সেই সব জনগণের কতটুকু অধিকার কায়েম হয়? থানা পুলিশ, থানা কর্মকর্তা, মহকুমা কর্মকর্তা, জেলা কর্মকর্তা – তারা ইউনিয়ন পরিষদকে চালায়,  ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃবৃন্দ তাদের অধীনেই বস্তুতঃ কাজ করে৷ তাহলে এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করার সার্থকতা কোথায়? শুধু কাজের বিনিময়ে খাদ্য, রিলিফ বিতরণ, করের টাকা তোলা, সার্টিফিকেট দেয়া আর বেতন নেয়ার জন্য?  একজন গ্রামের সাধারণ মানুষ এসব কাজকর্ম সম্পর্কে খুব সচ্ছ ধারণা রাখে, যেমন একজন বলেছিলেন – ‘শনির কান্ড।’

একজন মেম্বার, চেয়ারম্যান বা একজন এমপিকে নির্বাচন করে একজন মানুষ কি অধিকার পায় – যদি না সে একজন দারোগা, একজন সার্কেল অফিসার, মহকুমা প্রশাসককে নির্বাচন না করতে পারে? গণতন্ত্র বলতে কিংবা জনগণের অংশগ্রহণ বলতে তবে কি বোঝানো হচ্ছে? গ্রামের ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে যে তাদের এবং তাদের আমলা বস এবং বন্ধুদের গণতন্ত্র?

বর্তমান প্রশাসন যদি সম্পূর্ণ উঠে যায়, গ্রামে যদি কোন সরকারী প্রশাসন না থাকে, তারা যদি ফিরে যায় অতীতের কোন দিনে তবে সাধারণ দরিদ্র মানুষের কি ক্ষতি হবে?

সরকারী মডেল

প্রশাসনকে গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যাবার লক্ষ্যে সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই কয়েকটি গ্রামে বেশ কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা চালাচ্ছেন। এমন একটি গ্রামের কথাই বলছি। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এখানে স্বনির্ভর কর্মসূচী চালু হয়৷ ১৯৭৮ সালের জানুয়ারীতে এখানে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ইতিমধ্যে গ্রামটিকে স্বনির্ভর গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গ্রামে প্রয়োজন বার্ষিক ১৪ হাজার মণ খাদ্য শস্য, বর্তমানে উৎপাদিত হয় ১২ হাজার মণ। মোট জমির পরিমাণ ৩২৩ একর,  এর মধ্যে আবাদী জমি ২৪৯ একর। জনসংখ্যা ২০০১ জন। পরিবার ৩৪৭ টি। এর মধ্যে ৫ টি ধনী পরিবার, ২০ টি মাঝারি কৃষক পরিবার, ১১১ টি গরীব কৃষক পরিবার, ২১১ টি ভূমিহীন  পরিবার, ভূমিহীনদের মাঝে ৪৪ টি জেলে পরিবার, ৩ টি কামার পরিবার রয়েছে।  গ্রামে সমিতি আছে তিনটি৷ ভূমিহীন সমিতিতে আছে ৫০ জন ভূমিহীন, যাদেরকে ঢেঁকি, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি তৈরী ও পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সমিতিতে ৯ জন রয়েছে মহিলা সদস্যা। তিনটি সেলাই মেশিন দিয়ে এখানে সেলাই শিক্ষা দেয়া হয় তাদের। জমি আছে এমন ৭৫ জন কৃষককে নিয়ে কৃষক সমিতি।

থানা সদর দফতরের পাশে অবস্থিত এ গ্রামে ২ টি নলকূপ রয়েছে। গ্রাম সরকারের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এক বছর আগেই একটি নলকূপের জন্য টাকা ও আবেদনপত্র জমা দেয়া হয়েছে, প্রেসিডেন্টকেও বলা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন খোঁজ নেই। ব্যাঙ্ক ঋণ সময় মত পাওয়া যায় না, ঘুরতে হয় কর্তাদের পেছন পেছন, ঘুষ দিতে হয়৷ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যে পরিমাণ প্রচার হয়েছে, আমাদের গ্রামে সে তুলনায় কাজ তেমন হয়নি। গ্রামের অন্যান্য মানুষ বললেন, ‘৭৫ থেকে পুরো প্রশাসনকে কাজে লাগানো সত্ত্বেও তেমন কোন কাজ হয়নি। গ্রাম সরকার গঠিত হলেও প্রশাসন ক্ষেত্রে নতুন কিছু যোগ হয়নি। গ্রাম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন গ্রামের মেম্বর, ইউনিয়ন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। ইউনিয়ন পরিষদের হাতে যা ক্ষমতা তার বেশী ক্ষমতা ইউনিয়ন সরকারের হাতে নেই। অন্যান্য গ্রাম-ইউনিয়নের মত এখানেও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ব্যাপারের বিভিন্ন সংস্থার উপর নির্ভর করতে হয়, অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয়। এছাড়া গ্রাম সরকারের নেতৃত্ব তৈরী করা হয়েছে তাতে নতুন নেতৃত্ব আসেনি, যারা বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী হয়েছেন তারা এমনিতেই গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, প্রভাবশালী ধনী শ্রেণীর  অন্তর্ভুক্ত মানুষ।

স্বনির্ভর কর্মসূচী প্রসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তা জানিয়েছেন,  স্বনির্ভর কর্মসূচীর কাগজপত্র তৈরী করতেই আমাদের ফান্ড শেষ হয়ে গেছে, এমন কিছু লিখবেন যাতে আমরা কিছু ফান্ড পেতে পারি।

গ্রাম সরকারের সদস্যদের পরিচিতি এখানে উল্লেখযোগ্যঃ 

  পদ পেশা বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা
প্রধানমণ্ত্রী কৃষি, ১৪/১৫ বিঘা জমি ৬০ নাম দস্ত খত
ভূমিহীন ও সমবায় বিষয়ক মণ্ত্রী কুলি, সরদার ৩০/৩৫ নাম দস্ত খত
মত্স্য মণ্ত্রী শিক্ষকতা ৩০/৩৫ গ্রাজুয়েট
কৃষি মণ্ত্রী কৃষি , ২০ বিঘা জমি ৩০/৩৫ গ্রাজুয়েট
অর্থ ও রাজস্ব মণ্ত্রী কৃষি, ৫০ বিঘা জমি ৬০ নাম দস্ত খত
পশুপালন মন্ত্রী কৃষি, ১৬ বিঘা জমি ৩৫ নাম দস্ত খত
পরিবার পরিকল্পনা মণ্ত্রী মহিলা সমিতির সম্পাদিকা, ঠিকাদার স্বাস্থ্য মণ্ত্রীর স্ত্রী ২২ মেট্রিক
যোগাযোগ মণ্ত্রী ব্যবসা, শ্যালো টিউবওয়েলের ম্যানেজার ৩৫ নাম দস্ত খত
আইন মণ্ত্রী আই আর ডি পি – র সুপারভাইজার ৩৫ মেট্রিক
১০ শিক্ষা মণ্ত্রী কৃষি ও ঠিকাদারী, ৭৮ বিঘা জমি ৪০ গ্রাজুয়েট
১১ স্বাস্থ্য মণ্ত্রী ঠিকাদার ৪০ মেট্রিক
১২ সমাজ কল্যাণ মণ্ত্রী চাকুরী, সমাজ কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য মণ্ত্রীর স্ত্রী ৩০ মেট্রিক

এবং প্রধানমন্ত্রী – মন্ত্রীর সামাজিক – অর্থনৈতিক অবস্থানে মৌলিক কোন ভিন্নতা নেই। ব্যবসায়ী, কন্ট্রাকটর, ধনী-মাঝারী কৃষক, কুলি সর্দার – এদের সবার মধ্যে মৌলিক বিরোধের চেয়ে বন্ধুত্ব রয়েছে অনেক বেশী।

গ্রাম সরকার৷ ইউনিয়ন সরকার প্রতিষ্ঠা করায় প্রশাসন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসেনি।  কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রের বিভিন্ন সংস্থার অসমন্বিত কার্যক্রম এখনও একই অবস্থায় আছে। সমস্যা রয়েছে ফান্ডের। একই নিয়মে গ্রামের সমস্যায় থানা – জেলা পর্যন্ত দৌড়াতে হয়। এবং একইভাবে অন্যান্য গ্রামের মতোই অধিকাংশ মানুষ সব কাজের, সব ক্ষমতার বাইরে রয়েছে।

আরেকটি গ্রাম, যেখানে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে সে গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সে গ্রামে গিয়েও মৌলিক দিক থেকে অপরিবর্তিত চেহারাই দেখতে হয়েছে৷ পরিবর্তনের মধ্যে এতটুকুই যে, সেখানে রাস্তার ধারে কিছু কলা গাছ লাগানো হয়েছে। একজন বাচ্চা ছেলে,  বয়স কত হবে – পাঁচ কি ছয়, ঐ গ্রামেরই অধিবাসী।  মা আছে শুধু তার৷ কাজ নেই বলে জমি যতটুকু ছিল বিক্রি করে সংসার চলছে। এই টাকা শেষ হলে কি করে চলবে – প্রশ্নের উত্তরে ছেলের নির্বিকার জবাব, ‘না খাইয়া থাকুম, আগে কত থাকছি!’ একজন বৃদ্ধ যিনি কিছুদিন আগে জমি হারিয়েছেন তিনি কেমন আছেন প্রশ্নের জবাবে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ধনী কৃষকের বাড়ির দিকে হাত দিয়ে দেখালেন, ‘আমি কেমন আছি হ্যারে হৈচ করেন।’

উপসংহার

কোন মেজন অপারেশন প্রয়োজন হয় না, সামান্য কাঁটাছেড়া করলেই বেরিয়ে পড়ে আমাদের গ্রামের আসল চেহারা। বেরিয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে যে গ্রাম, তার সীমাবদ্ধতা।  বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিস্তৃত অংশ জুড়ে যে গ্রামের মানুষ তাদের অসহায়ত্বেন তীব্রতা, একই সঙ্গে গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী হয়ে বিদেশী রাজধানী পর্যন্ত একটি বন্ধু শ্রেণীর কিছু সংখ্যক লোকের নগ্ন বদমায়েশী।

গ্রাম এখন আগের গ্রাম নেই। গ্রামের যোগাযোগ এখন অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ছড়ানো জাল গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছে, কখনো মানবতা রক্ষায় সদা ব্যস্ত বিদেশী সংস্থা সমূহের মাধ্যমে, কখনো সাহায্য – ঋণের মাধ্যমে এবং সেসব কাজকর্মের জন্য গ্রাম পর্যন্ত প্রতিনিধি পেতে কষ্ট হয় না। গ্রামে যারা বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদেরকে নিজেদের শ্রেণীর স্বার্থেই  আন্তর্জাতিক এই সব সংস্থার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, নিজেদের প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রাখছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে।

জেলা থেকে মহকুমা, মহকুমা থেকে থানা, থানা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ক্ষমতার প্রশাসন সাজানো, তাতে স্বাভাবিকভাবে এই ব্যবস্থাকেই বিভিন্ন প্রকারে উৎসাহিত করা হয়৷ যার ফলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের প্রশাসনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয় না৷ প্রশাসনে বর্তমানে আইনের বৈধ সুযোগ নিয়ে জেলা, মহকুমা, থানা প্রশাসনের কর্মকর্তা, বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা, থানা পুলিশ, তহশীলদার এবং গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃবৃন্দ এরা সবাই মিলে এতটা ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত যে সে ফাঁক গলে ক্ষুদ্র কৃষক, ভূমিহীন কৃষক দাড়াতে পারে না৷ অনুগত চরিত্র, সেচ্ছাচারী শোষণের ধারার প্রতি অসহায় স্বীকৃতি ছাড়া, অসংগঠিত এই মানুষদের ভিন্ন কোন উপায় থাকে না।

এর উপর অশিক্ষা এই মানুষদের অর্থাৎ গ্রামের সত্যিকার উৎপাদকদের আরও বেশী অসহায় করে দিয়েছে৷ অনাস্থা থাকলেও তাদের টিপসই দিতে হয় নিজের প্রতিবাদ উপর পর্যন্ত পৌছানোর ক্ষমতা থাকে না৷

কিন্তু বর্তমান প্রশাসন ব্যবস্থা এরপরও যাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে, তাদের জন্যও দক্ষ নয়৷ গ্রাম পর্যন্ত প্রশাসনের কার্যক্রম বিভিন্ন শাখা প্রশাখার অসমর্থিত কার্যক্রমে গভীর নলকূপ এসে পৌছায় না, ঋণ আসে না, বীজ-সার আসে, বিনিয়োগের চাইতে চুরিতেই অধিক সম্পদ বিনষ্ট হয় – এই অদক্ষতায় ক্রুদ্ধ হয়েছে আন্তর্জাতিক মহাজন (দ্রষ্টব্য ঃ ইন্টারন্যাশনাল পলিসি রিপোর্ট – সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি, ওয়াশিংটন, মে, ১৯৭৮)। এই কারণও পরনির্ভর সকল নীতির ভেতর সুপ্ত। পরনির্ভর দালাল শক্তি কখনও দেশে দক্ষ হতে পারে না, দক্ষ হতে পারে মানুষের বিক্ষোভ প্রতিবাদকে স্তব্ধ করার কাজে। সে কাজে লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে সরকারী ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য বাহিনী একাত্মা। কিন্তু এ ব্যবস্থা মানুষের বিক্ষোভ, ‘বিশৃঙ্খলা’ ঠেকাতে পারে নি। সরকারী প্রচেষ্টায় তাই প্রশাসনকে ভিন্নভাবে সাজানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। কিন্তু সেখানকার চিত্র কি ভিন্ন কিছু?

বর্তমান ব্যবস্থায় গ্রামের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে ভূমি এবং সরকারী প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ। সে জন্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী কৃষক, মহাজন, বড় পাইকার-ফড়িয়া, ঠিকাদার এমনকি কুলি সর্দারদের আঁতাতবদ্ধ চক্রে। সকল কাজে সকল মানুষের অংশগ্রহণের মৌলিক শর্ত হচ্ছে, এই কাঠামো ভেঙে ফেলে মানুষের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে যাওয়া। সে ক্ষমতা তখনই যেতে পারে যখন ক্ষমতার উৎস যেতে পারে মানুষ পর্যন্ত। একজন গ্রামের মানুষের যদি থানার পুলিশ-দারোগা, থানা প্রশাসনের উপর আস্থা না থাকে তবে শুধু ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান মেম্বর নির্বাচিত করে ক্ষমতা প্রয়োগের প্রহসন হতে পারে, আর কিছু নয়।

গ্রামের একজন মানুষ যে নিজের পরিবারের কারোর জন্য, স্ত্রীর জন্যে, সন্তানের জন্যে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারে না, নিরাপত্তা দিতে পারে না, যে নিজেকেও দিতে পারে না কোন সাহস, নিরাপত্তা,  নিশ্চয়তা – যে বারবার ঋণ নিয়ে ঘর-জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, দুর্ভিক্ষে যে আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প দেখে না, জমিতে যখন পাকা ফসল, তখন তাকে না খেয়ে থাকতে হয়, যে গভীর নলকূপের শব্দে ঘুমোতে পারলেও সে পানি পায় না, যে হাজারো অত্যাচারে সালিশ ডাকবার ভিত্তি পায় না, থানা পর্যন্ত কোন কাজে যাওয়া যার স্বপ্নের বাইরে, তার কাছ থেকে ‘উন্নয়ন কাজে ‘ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আশা করা ধৃষ্টতা, অশিক্ষায় অন্ধ এই সব মানুষের কাছে মুখে গণতন্ত্র পৌছে দেয়া যায় না, মুখে ক্ষমতা পৌছে দেয়া যায় না। এই মানুষ একজন মানুষ নয়, এই মানুষ কোটি মানুষ। গ্রামের ক্ষমতার কাঠামোয় এরা সবার নীচে, সবার বোঝা বইতে গিয়ে ন্যুব্জ, অকালবৃদ্ধ, ল্যাবরেটরিতে রাখা কঙ্কালের প্রতিমূর্তি। উজ্জ্বল মানুষ হিসেবে তাকে কল্পনা করা আকাশে মাছ মারার মতো, আর এই কোটি মানুষকে উপেক্ষা করে গ্রামের প্রকৃতি দেখে সুন্দর বাংলাদেশের চেহারায় মুগ্ধ হওয়া বদমায়েশী৷

সচল গ্রামের সচল মানুষ, যারা সচল গ্রামের সকল কাজের নেতৃত্ব দেয়, একই সঙ্গে কর্ম দেয়, তেমন দৃশ্য দেখতে চাইলে ভাঙ্গা ঘর জোড়াতালি দিয়ে লাভ নেই। জাল গ্রাম থেকে হাজার মাইল দূর পর্যন্ত৷ এই জাল থেকে বের করে গ্রামের মানুষের জীবনের মুক্তির জন্য তাই ক্ষমতার মূল উৎসগুলো চেনা প্রয়োজন। প্রয়োজন মূল উৎপাদক আর পরগাছার মধ্যকার বিরোধের ইতিবাচক সমাধান। পরগাছা দিয়ে অগ্রসরতা কল্পনা করা যায়, কিন্তু তা অসততা, উৎপাদক মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে জীবন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ক্ষমতা দিতে হবে উৎপাদকদের। পরগাছাদের নয়, সেজন্যে ক্ষমতার উৎসের ব্যাপক রদবদল প্রয়োজন। সে জন্য প্রাথমিক কাজ উৎপাদক-অসংগঠিত মানুষের সংগঠিত হওয়া।

বাংলাদেশের একটি গ্রাম, তেমন গ্রাম যে গ্রামে মানুষের স্বাধীনতা নেই, যে গ্রামে উৎপাদন করে ক্ষুধায় মরতে হয়, যে গ্রামে ক্ষমতা অনুৎপাদকের হাতে।

সহস্র পরীক্ষা নিরিক্ষা এ অবস্থা কাটাতে পারবে না, যদি না এইসব একজন মানুষ, কোটি মানুষ সংগঠিত হয়ে ক্ষমতার উৎসগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না আনে।