You dont have javascript enabled! Please enable it! 1978.09.15 | ভাসানী ন্যাপ ও নয়া দল বি এন পি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ - সংগ্রামের নোটবুক

ভাসানী ন্যাপ ও নয়া দল বি এন পি | বিশেষ নিবন্ধকার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮

মঞ্চে তখন চেয়ারে হেলান দিয়ে রক্ষিত রয়েছে কাঁচে চিড় ধরা দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর একটি পেন্সিল স্কেচ।

ছবিটা ঝুলানোর কোন ব্যবস্থাও ছিল না। তাই একটা চেয়ারে রাখা হয়েছে। এর আগে শ্লোগান – পাল্টা শ্লোগানের মাঝে ৯ ই সেপ্টেম্বর বেলা ১২ টার দিকে অর্থাৎ দু’ ঘন্টা দেরী করে শুরু হয়েছে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন হোটেল ইডেনে।

সভা শুরু হল। দলের সম্পাদক এস, এ, বারী এ, টি বক্তৃতা করছেন। হঠাৎ একজন কাউন্সিলর উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন মওলানা ভাসানীর ছবি মঞ্চে নেই কেন? মারমুখো হয়ে তেড়ে গিয়ে কয়েকজন তাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন৷ কিছুক্ষণ উত্তেজনা। তারপর আধঘন্টা পর আনা হল মওলানার স্কেচ৷

এই পটভূমিকায় দলের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) পেশ করলেন কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ২১ বছরের অস্তিত্বকে আপাততঃ ‘সাসপেন্ড’ রেখে এক সপ্তাহ আগে গঠিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নতুন দল ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ‘ (বি এন পি) – তে ‘সংযুক্তিকরণ’ – এর প্রস্তাব। অপর একটি প্রস্তাবও এলো দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনোয়ার জাহিদের কাছ থেকেঃ দলের অস্তিত্ব রেখে বি এন পি র সাথে ফ্রন্ট করতে হবে।

দুটো প্রস্তাবেই ভোট দিলেন যাদু মিয়া। উল্লসিত হাত তুলে প্রস্তাব সমর্থন করলেন কাউন্সিলররা। কতজন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন তার হিসেব অবশ্য কেউ দিতে পারেননি৷ বিপক্ষের হাত গুলো গুণে গুণে তিনি জানালেন মাত্র ২৯ জন – এর বিরোধিতা করেছে।

ন্যাপ এর জন্মও হয়েছিলো ঠিক এমনি করে৷ তৎকালীন পিকচার প্যালেস (যা এখন শাবিস্তান) সিনেমা হলে ১৯৫৭ সালের মার্চ মাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ – এর কাউন্সিল সভা হচ্ছে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। স্বায়ত্তশাসন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি এবং সিয়াটো ও সেন্টো এ পাকিস্তানের অবস্থান প্রশ্নে ভোট হচ্ছে। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি ৯৮% স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে বলছেন এবং সামরিক চুক্তি সাক্ষর করে এসেছেন। ৩৩ জন কাউন্সিলরের এবং ১৩ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ায় বেরিয়ে আসেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে।

এরপর ২৫ শে জুলাই, ১৯৫৭, ৬ টি দল এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ – এর উপ- দলের সংযুক্তি করণের মাধ্যমে রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান এর পোষ্য গুন্ডাদের হামলার মুখে জন্ম নেয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। সেদিন বিকেলে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে পল্টনে ন্যাপ – এর সভা হতে দেননি। আর আওয়ামী লীগ – এর ভাড়াটে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী খান আবদুল গাফফার খান, ইফতেখারউদ্দিন, জি. এম সাঈদ, আবদুস সামাদ খান আচকজাই, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতাকে তাড়া করে। ২৫ শে জুলাইয়ের খন্ড খন্ড হামলায় গাফফার খানের মাথা ফেটে গিয়েছিল, মিয়া ইফতেখারউদ্দিনের হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। সেদিনে ছ’ টি দল – গাফফার খান – এর খোদাই খিদমতগার, জি. এম. সাঈদের আওয়ামী মাহাজ, আচকজাই – এর ভারোরে পাখতুন, গাউস বখস বেজেঞ্জোর উথমান গাল, মিয়া ইফতেখারউদ্দিনের আজাদ পাকিস্তান পার্টি, হাজী দানেশ মাহমুদ আলীর গণতন্ত্রী দল এবং মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগের অংশ সমবায়ে গড়া ন্যাপ তার ২২ বছরের ইতিহাসে অবশ্য এক থাকতে পারেনি। এর আগেও ভেঙ্গেছে। প্রথম চিড় ধরে ১৯৬৭ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ – এর নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে আসে। এরপর ১৯৭০ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন দল থেকে বেরিয়ে যান বর্তমান সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা, যার পরিবর্তে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এক কালের মুসলিম লীগ নেতা মশিউর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানে এ সময় আবদুস সামাদ খান আচকজাই এর নেতৃত্বে সৃষ্টি হয় পশতুন খাওয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির। আরো একটি উপদল বেরিয়ে যায় মেজর ইসহাকের নেতৃত্বে।

১৯৭৬ সালে আবার ভাঙ্গন ধরে ভাসানী ন্যাপ – এর। দলের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদ এ সময় প্রচার সম্পাদক রাশেদ খান মেননকে নিয়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি গঠন করেন। আর সহ-সভাপতি হাজী দানেশ গঠন করেন এ সময় জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)। জাগমুই গঠিত হয় আগে। ১৯৭৫ সালে ‘বাকশাল’ গঠনের পর অন্যান্য দলের সঙ্গে বিলুপ্ত হয় ভাসানী ন্যাপের অস্তিত্বও৷

এর পর ১৯৭৬ সালে পুনরুজ্জীবিত হবার পর দলের এককালীন অস্থায়ী চেয়ারম্যান ডঃ আলীম আল রাজী দাড় করান বাংলাদেশ পিপলস লীগ৷ ১৯৭৭ সালে মওলানা ভাসানীর পুত্র আবু নাসের খান এবং গাজী শহীদুল্লাহ্ দুজন মিলে গঠন করেন ন্যাপের একটি অংশ। ১৯৭৮ সালে আবার ভাঙ্গন ধরে। গাজী শহীদুল্লাহ্ নিজস্ব ন্যাপ খাড়া করেন। এ সময় মওলানা ভাসানীর একজন সহচর আলহাজ্ব বজলুস সাত্তার তার ন্যাপ গঠন করেন।

মোজাফফর আহমদ – এর নেতৃত্বাধীন অংশও ভাঙ্গন ধরে এ সময়। সৈয়দ আলতাফ হোসেন – এর নেতৃত্বে একটি অংশও ভাঙ্গন ধরে এ সময়। সৈয়দ আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি অংশ আরো একটি ন্যাপ-এর জন্ম দেয়৷ এবং এ প্রতিবেদন রচনার সময় আনোয়ার জাহিদের সমর্থকরা আরো একটি ন্যাপ গঠনের কথা চিন্তা করছেন।

যাই হোক, প্রস্তাব ভোটে দেওয়ার আগে মশিউর রহমান তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, ন্যাপ তার অবলুপ্তি ঘোষণা করছে না। কার্যক্রম স্থগিত রাখছে মাত্র৷ বিএনপি-এর সাথে সংযুক্তিকরণের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার৷ তাই, আমরা জাতীয়তাবাদী দলে ‘মার্জ’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ তিনি আরও বলেন যে, মওলানা ভাসানীর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যও এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মওলানা ভাসানীকে তিনি তার কীর্তির চাইতেও মহান বলে বর্ণনা করেন।

নতুন দল সংযুক্তিকরণের শর্তগুলো বর্ণনা করে তার প্রস্তাবে বলা হয়, বিএনপির গঠন পদ্ধতি, ঘোষণাপত্র এবং সংবিধানে কিছু বিচ্যুতি রয়েছে, এগুলোকে দূর করা দরকার। অন্য শর্ত গুলোতে প্রস্তাব করা হয় যে, নতুন দলে ন্যাপের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সাধারণ নির্বাচনে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। এ ছাড়াও বলা হয়, ৩ রা জুন নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানের সংশোধনী সহ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের বিভিন্ন ওয়াদা পূরণ করেন নি। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ শর্তগুলো মেনে নিলে ন্যাপ নতুন দলে নিজেকে সংযুক্তকরণ করবে৷

এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য দলের চেয়ারম্যান সেক্রেটারী সহ সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘নিগোসিয়েটিং’ কমিটিও গঠন করা হয়৷ অবশ্য মশিউর রহমান আশা প্রকাশ করেন বন্দী মুক্তিসহ বিভিন্ন ওয়াদা প্রেসিডেন্ট জিয়া পূরণ করবেন।

অপর দিকে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আনোয়ার জাহিদ বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যাপ – এর অস্তিত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। এছাড়াও বিএনপি এবং ন্যাপ এর লক্ষ্য ও কর্মসূচীতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি বলেন, ন্যাপের লক্ষ্য সংসদীয় গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিএনপি-র লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার৷ তিনি নতুন দলের সাথে ফ্রন্ট এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করার আহবান জানান। তিনি সারের দাম সহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামরিক আইন, রাজনৈতিক দলবিধি চতুর্থ সংশোধনী বহাল রাখার এবং মার্কিন শান্তি বাহিনী আনার তীব্র বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন ন্যাপ-এর জন্ম হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য।

ন্যাপের সংযুক্তিকরণের পর নতুন দল অবশ্যই শক্তিশালী হবে। এর আগে অবশ্য জাগদল নিজেদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে নতুন দলে যোগ দেবার কথা বলেছে৷

শাহ আজিজের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের অংশ এবং রসরাজ মন্ডলের তফশীলি ফেডারেশনও এ দলে যোগ দেবার ঘোষণা করেছে৷ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের এক শরীক দল মওলানা মতীনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি অবশ্য যোগ না দেবার কথা বলেছে৷ বাকী শরীক দল ইউপিপি অবশ্য ২রা নভেম্বর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে শক্তিশালীকরণে এবং নতুন দলের সাথে সহযোগিতার কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন৷

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বিএনপি যদিও দেশে দলের সংখ্যা কমিয়ে একটি শক্তিশালী দলে রূপ লাভ করবে কিন্তু বিভিন্ন মতের নেতৃবৃন্দের সমাবেশ প্রেসিডেন্ট জিয়া কি তার নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে একে সংহত করতে পারবেন? বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস থেকে দেখা যায় নির্বাচনে আসন বন্টনের প্রশ্নে দলত্যাগ ও পাল্টা দল গঠনের প্রবণতা খুব বেশী৷

সামনের সংসদীয় নির্বাচনে হয়ত এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি জনগণের বিশাল আস্থা এবং সামনের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাকশাল পন্থী আওয়ামী লীগ এবং দক্ষিণপন্থীদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনহীনতা অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কাজ করবে।

সবচাইতে বড় প্রশ্ন জাগদলের ৭ মাসের অস্তিত্ব এবং এর নেতাদের নিজস্ব কোন্দল ও আচরণ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি তার নতুন রাজনৈতিক সহকর্মীদের কতটুকু ‘রাজনৈতিক আন্তরিকতা রয়েছে। বিশেষ করে মন্ত্রী সভা গঠনের পর পর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের শরীকদলভুক্ত নেতাদের পারস্পরিক বিষেদাগার এবং রাস্তায় বেরিয়ে আসার হুমকি সত্যি ইংগীতবহ।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.09.15-.pdf” title=”1978.09.15″]