You dont have javascript enabled! Please enable it! 1978.08.18 | আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি | বিশেষ নিবন্ধকার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ আগস্ট ১৯৭৮ - সংগ্রামের নোটবুক

আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি | বিশেষ নিবন্ধকার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ আগস্ট ১৯৭৮

বাইরের তখন রোদ। ভ্যাপসা আর গুমোট আবহাওয়া। এমনি গুমোট আবহাওয়ার মধ্যেই ১২ই আগস্ট শেখ মুজিবের মাল্যভূষিত প্রতিকৃতির সামনে নিজ বাস ভবনের খোলা ছাদে আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী ঘোষণা করলেন তাঁর ‘আসল’ আওয়ামী লীগের আবির্ভাব। এর সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ‘গুমোট ঐক্যের’। ভাঙ্গনের কাজ হয়েছে সাঙ্গ। ১৯৪৮ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলীম লীগ এবং পরে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ নিয়ে বিভক্ত হল ৭ বার মোট ৮ ভাগে।
মিজান চৌধুরীর ঘোষণা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের সাথে ‘কৃষক শ্রমিক’ জুড়ে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল গঠন এবং তার পতনের পর ১৯৭৬ সালে আবদুল মালেক উকিলের দরখাস্তে আবার আওয়ামী লীগের পুনরাবির্ভাব দলকে অনৈক্যের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। বিশেষ করে শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বের শূন্যতা মালেক উকিল পূরণ করতে পারেননি। এরই ফলশ্রুতিতে চরম কোন্দলের পর ১৯৭৬ এর ডিসেম্বরে জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়িকা করে নেতারা ভাবলেন ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগকে আপাততঃ এক রাখা হোক।
এর মাঝে অবশ্য শেখ মুজিবের একদা দক্ষিণ হস্ত খন্দকার মুশতাক আহমেদ, জেনারেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানী এবং মওলানা তর্কবাগীশ যথাক্রমে ডেমোক্রেটিক লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি ও গণ আজাদী লীগ প্রতিষ্ঠা করে টেনে নিয়ে যান দলের কিছু অংশ। ১৯৭৬ এর ডিসেম্বরে আহ্বায়ক কমিটি যদিও ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল নেতৃত্বের কোন্দল তা আবার প্রচন্ডভাবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৮ এর মার্চের ৩, ৪, ৫ তারিখে দলের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে।
ভাজনের হাত থেকে অবশ্য এ যাত্রাও রেহাই পায় আওয়ামী লীগ। মিজান চৌধুরী ও জোহরা তাজউদ্দিনকে দলের প্রবীণ নেতারা বাধ্য করেন আপোষ করে মালেক উকিলকে সভাপতি হিসেবে গ্রহণ করতে। কিন্তু কাউন্সিল প্রচণ্ড উত্তেজনার মাঝে কোন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করে শেষ হয়। অর্থাৎ অনৈক্যের বীজ সুপ্তই রয়ে যায়।

পরিণতিতে ৩ সপ্তাহ পর দুটো পাল্টা কমিটি গঠিত হয়। এরপর আবার আপোষ। আবার বিরোধ অনৈক্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। দলের নীতি নির্ধারণে ফের তীব্র হয় বিরোধ। বিরোধের কারণ বাকশালী ‘দ্বিতীয় বিপ্লবকে’ আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, না আওয়ামী লীগের চিরাচরিত চরিত্র পাশ্চাত্য ঘেষা সংসদীয় পথে বেঁচে থাকতে হবে। আপোষের ক্ষীণ বন্ধনী ছিড়ে যাবার উপক্রম হল এই বিতর্কে। শেষোক্ত দলের নেতৃত্বে একক ভাবে উঠে এলেন মিজান চৌধুরী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর দলের বর্ধিত সভায় ফের সংঘাত বাধে মিজান চৌধুরীর বাকশাল বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। মাঝে আরেকটি উপদলের আবির্ভাব ঘটে জোহরা তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে।
জোহরা তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন উপদল মনে করেন বাকশালপন্থী নেতৃত্ব বিশেষ করে মালেক উকিল, শেখ মুজিবের ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর’ দলপতি আবদুর রাজ্জাক এবং প্রাক্তন রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত তোফায়েল আহমেদ প্রমুখরা অত্যন্ত ‘দুর্বল’ ও ‘সুবিধাবাদী’। ত্রিধাবিভক্ত এই নেতৃত্বের কোন্দল তীব্রতর রূপ নেয় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায়। ভাঙ্গন অত্যাসন্ন হয়ে উঠে। ত্রিধাবিভক্ত ছাত্রলীগের ভাঙ্গন উপলক্ষ করে পারস্পরিক দোষারোপ এবং ঝগড়ার মধ্য দিয়ে কোন প্রস্তাব পাশ না করেই সভাকক্ষ ত্যাগ করেন তিন উপদলের নেতৃবৃন্দ। যাইহোক মিজান চৌধুরী অবশেষে “খাঁটি” আওয়ামী লীগের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন তাঁর দল হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম আওয়ামী লীগ।
তিনি বলেছেন, ‘৭০ সালের আওয়ামী লীগের চরিত্রই হবে তাঁর দলের চরিত্র। মোটের ওপর যারা আওয়ামী লীগের গোড়া থেকে দলের সঙ্গে আছেন এবং সংসদীয় নির্বাচনে দাঁড়ানোর সঙ্গতি রাখেন তাঁরা সবাই জড়ো হয়েছেন এ দলে।
১২ আগষ্টের সাংবাদিক সম্মেলনে এমন অনেক নেতাকেও দেখা গেছে যারা তাঁর বাকশাল বিরোধী রাজনীতির ছত্রছায়ায় নিজেদের পুনর্বাসিত করতে চান। মোটের ওপর দলের একটা বৃহৎ অংশ সমবেত হয়েছেন মিজান চৌধুরী সঙ্গে এবং তিনি আশা করছেন আরো অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা চূড়ান্ত পর্যায় বিশেষতঃ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই বাকশাল সংযোগ ত্যাগ করবেন। যোগ দেবেন তাঁর সঙ্গে।
উপদলীয় কোন্দল যেখানে ত্রিধাবিভক্ত সেখানে মিজান চৌধুরীরা বেরিয়ে যাওয়ার পরও কি বাকি অংশের কোন্দল মিটবে? খুব সম্ভবতঃ বাকশালপন্থী আওয়ামী লীগের আরো বিরোধ অনিবার্য। জোহরা তাজউদ্দীন-মহিউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মনি সিং-এর নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টির রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক— এরা চাইছেন ‘সুবিধাবাদীদের’ দল থেকে বের করে দিয়ে গঠন করবেন ‘বিপ্লবী’ আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে মালেক য়কিল, আবদুল মান্নান প্রমুখরা থাকতে চাইছেন না দলের ‘চরমপন্থী’দের সঙ্গে।
সমস্যা মালেক উকিলের। ব্যক্তিগত সংঘাতের প্রশ্নে মিজান চৌধুরীর নেতৃত্ব মেনে নেয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ যদি আবারো ভাঙ্গে তবে বিচিত্র হওয়ার কিছু থাকবেনা। কারণ আপাততঃ রাজ্জাক-তোফায়েল এবং জোহরা-মহিউদ্দিন উপদল এক থাকবে বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল বাকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে। তবে আপাততঃ বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে দু’দলই এখন আপোষ রক্ষা করে চলবেন। উদ্দেশ্য অস্তিত্ব রক্ষা ও মিজান চৌধুরীর চাপ সহ্য করা। এই হচ্ছে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। কিন্তু রাজনীতির চূড়ান্ত ধারায় এ ঐক্য অত্যন্ত ক্ষীণস্থায়ী হতে বাধ্য যার পরিণতিতে আরো বিভেদ অপেক্ষা করছে আওয়ামী লীগের জন্য।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.08.18-bichitra.pdf” title=”1978.08.18 bichitra”]