আরেক ফারাক্কা | কাজী জাওয়াদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ আগস্ট ১৯৭৮
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ১৯৭৭ সালে ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর বাংলাদেশের জনগণ স্বভাবতই ভেবেছিলেন আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পাবে। ধারণা হয়েছিল সম্ভবতঃ বাংলাদেশের মতো ভারতও সৎ প্রতিবেশী হিসেবেই সবদিক থেকে সম্পর্ক রাখবে। কিন্তু এ আশাবাদ ভেঙে ভারত কয়েক মাসের মধ্যেই চুক্তি পালনে গড়িমসি করতে শুরু করে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর সমস্ত পানি গ্রাস করবার ইচ্ছায় তিস্তার উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। ফারাক্কা বাঁধের মতই এই তিস্তা প্রকল্পের উদ্দেশ্যও বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে তিস্তার পানি অন্যখাতে বইয়ে দেয়া। ভারতের এই পরিকল্পনা নতুন নয়। পরিকল্পনাটির সূচনা প্রায় ৪০ বছর আগে। গত ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান-ভারত এবং বাংলাদেশ ভারত এই পর্যায়ে এ নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনায় ভারত কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগোচরে ভারত বাঁধের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের পরিকল্পনা হচ্ছে তিস্তার পানি জলবিদ্যুৎ, সেচ এবং নৌ-চলাচলের কাজে লাগানো। এ জন্য ভারত তিস্তার শুষ্ক মৌসুমের প্রবাহ থেকে ৫ হাজার কিউসেক পানি তিস্তা থেকে অন্যখাতে বইয়ে দেয়ার জন্য তিস্তার উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। উল্লেখ্য যে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের এন্ডারসন সেতুর কাছে তিস্তার গড় প্রবাহের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কিউসেক এবং বাংলাদেশের গদ্দিমারিতে এই প্রবাহ কমেছে দাঁড়ায় মাত্র ৭ হাজার কিউসেক। ভারতীয় প্রকল্প অনুযায়ী তিস্তার ডান তীরে মহানন্দা নদীতে ৫ হাজার কিউসেক পানি বইয়ে দিলে গদ্দিমারিতে পানির পরিমাণ এসে দাঁড়াবে মাত্র ১ হাজার কিউসেক। এ প্রকল্প অনুসারে ভারতীয দেবীস্রামে একটি আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে সংযোগ খালে তুলে নেবে। সংযোগ খালের ও মহানন্দার প্রবাহ বুড়ি বালাসন দিয়ে বইয়ে আবার মহানন্দায়, সোনারপুরহাট সেতুর কাছে তুলে নেবে। তিস্তা- মহানন্দা সংযোগ খাল থেকে খাল কেটে জলপাইগুড়ি এবং কুচবিহারের হলদিবাড়িতে পানি নিয়ে যাওয়া হবে।
দেবীগ্রামের বাঁধের কাছ থেকে খাল কেটে দার্জিলিং এবং বিহার জেলায় পানি নিয়ে যাওয়া হবে। ভারত এই খালের জাল কেটে সমগ্র উত্তরবঙ্গকে পরিণত করতে চায় মরুভূমিতে। এবং সেই সাথে বন্ধ করতে চায় বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প। যে প্রকল্প উত্তরবঙ্গে কৃষি-অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করবে। এই প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের ব্যয় হবে ১২০.০০ মিলিয়ন টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সহ ৫২০.৬৬ মিলিয়ন টাকা। কিন্তু তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। তিস্তার গতিধারা থেকেই এটি প্রমাণিত হয়। তাই ভারতের অধিকার নেই এ নদীর স্রোতধারা পরিবর্তনের।
তিস্তার গতিপথ
উওর সিকিমের অন্তর্গত হিমালয়ের হিমবাহ তিস্তার উৎস। এবং তিস্তার অধিকাংশই সিকিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। লাচেন এবং লাচুং নামের দুই পর্বত স্রোতধারাই তিস্তার উৎস। এই দুই স্রোতধারা সিকিমের চুংথাং এ এসে মিলেছে। চুং থাং-এর ভাটিতে তিস্তা আস্তে আস্তে প্রশস্ত হতে থাকে। সিংতামে এর প্রস্থ্য প্রায় ১৪০ ফুট।
চুংথাং এবং সিংতামের মধ্যে বহু পর্বতস্রোত তিস্তাকে সমৃদ্ধ করেছে। এগুলোর মধ্যে রাংনিচু, ডিকচু, তালাচুং এবং চাকুংচু প্রধান। রাংনিচু একটি বড় উপনদী। তিস্তার সাথে এটি সিংতোমে মিলেছে। অন্য তিনটি মিলেফহে গ্যাংটকের কাছে। সিংতাম থেকে এটি দক্ষিণ- পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে থাকে এবং রাংপোচু নদীর সাথে মুক্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে এসে মেলি বাজারে রঙ্গিত নঅদীর সাথে মিলিত হয়। মেলি বাজার থেকে আবার দক্ষিণ পূর্বে প্রবাহিত হতে থাকে। সমভুমিতে সিবক শহরের কাছে এসে তিস্তা প্রায় ৩ মেইল প্রশস্ত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। সিবকে ভাটিতে লিশা, সিশ, চেল এবং নেওয়া পার্বত্য স্রোতধারা তিস্তার সাথে যুক্ত হয়।
মেলিবাজার পর্য়ন্ত তিস্তার দৈর্ঘ্য ৯২ মাইল। পশ্চিম বঙ্গে ৭৭ মাইল পথ অতিক্রম করবার পর তিস্তা জলপাইগুড়ির নীচে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ৭৭ মাইল প্রবাহের পর তিস্তা চিলমারিতে যমুনার সাথে যুক্ত হয়। বলা হয় ১৭৮৭ সালের আগে তিস্তা উওর আত্রাই, করতোয়া প্রভৃতি নদীর সাথে যুক্ত হয়ে গোয়ালন্দের কাছে জাফরগঞ্জে পদ্মায় পতিত হতো। ১৭৮৭ সালে বন্যায় তিস্তা গতি পরিবর্তন করে চিলমারিতে ছোট্ট নদী যমুনার সাথে যুক্ত হয়। যমুনা পরে ব্রহ্মপুত্রের মূলধারায় পরিণত হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহার করতে হলে ভারতকে নিম্নোক্ত আইনগুলো মেনে চলতে হবে।
আন্তর্জাতিক আইন
অধ্যাপক এম, আই, চৌধুরী ‘ফারাক্কা বাঁধ এবং বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে (বিচিত্রা ১৯ মার্চ ১৯৭৬) আন্তর্জাতিক আইন সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘হার্ভার্ড’ আইন স্কুলের অধ্যাপক বক্সটার গঙ্গা এবং সিন্ধু নদী সম্পর্কিত এক বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ব্যাপারে তিনটি মতবাদের উল্লেখ করেছেন।
প্রথমটি হচ্ছে তথাকথিত ‘হরম্যান ডাকষ্ট্রিন’ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূতপূর্ব এক এটর্নী জেনারেলে যিনি এ মতবাদের প্রবক্তা তার নামানুসারে)। তার মতে— কোন আন্তর্জাতিক নদীর উপরের রাষ্ট্রটি তার আঞ্চলিক সীমানায় এ নদীর উপর পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী। এ জন্যে ভাটির রাষ্ট্রটির কাছে আইনানুগভাবে কোন বাধ্যবাধকতায় আটকে থাকবে না। ‘হরম্যান ডকষ্ট্রিন’-এর অনেক রকম দোষ থাকার দরুন এ তথাকথিত মতবাদটি সর্বজন নিন্দনীয় (আসলে অধ্যাপক বক্সটার তাকে মূর্খ এটর্নি জেনারেল হিসাবে সমালোচনা করেছেন এবং এ লোকটি তার নির্বুদ্ধিতার জন্যই ইতিহাসে ধিকৃত ব্যক্তি)।
দ্বিতীয় মতবাদ হচ্ছে— নদীর তীরবর্তীর উপরের রাষ্ট্রটি কোন বিশেষ কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি নিতে পারে তবে এর পরিমাণ নিশ্চিত করে নিতে হবে। তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী যথার্থ দ্বিপক্ষীয় অংশ নির্ধারণ। এ মতানুসারে একটি আন্তর্জাতিক নদীতীরের উজান ও ভাটির রাষ্ট্রদুটির মধ্যে পানির অংশ নির্ধারিত হওয়া উচিত। এ ভাগাভাগিতেও রাজনৈতিক সীমানার উর্ধে নদীর পানির ব্যবহারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
১৯৬৩ সালে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অববাহিকা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে জাতিসংঘের একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে ‘হরম্যান ডকষ্ট্রিন’- এর কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং সেই সঙ্গে সেমিনারে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নীচের ভূমিকাটিকে সর্ব সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়— ‘আবহাওয়া বিদ্যা, পানিবিদ্যা ও প্রকৌশল শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার গুরুত্ব অপরিহার্য। ভূ এবং পানি ব্যবহারে উন্নতিসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকল্পে এর প্রয়োজনীয়তাও অসম্ভব রকমের। অতএব, সেমিনারে প্রত্যেকে রাষ্ট্রকেই তার কৃতকর্মের জন্য সমস্ত অববাহিকায় হাইড্রোলজিক্যাল ফলাফলের প্রতি নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
নদীর অববাহিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক বক্সটার হেলসিংকি আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞরা যথার্থ ভাগাভাগি আইনটি ব্যাপকভাবে অনুমোদন করেছেন। যথার্থ ভাগাভাগি আইনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৬৬ সালে হেলসিংকি আইনে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারে এর গ্রহণ। আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মতিক্রমে এ আইনগুলো বেশ কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় সর্বত্রই গ্রহণ করা হয়েছে। অধ্যাপক বক্সটার উল্লেখ করেন, একজন আইনজ্ঞের মতে এ যথার্থ ভাগাভাগির ব্যাপারে সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ চুক্তিতে আসা খুবই কষ্টসাধ্য।
কারণ বহুমুখী পানি সম্পদ প্রজেক্টের মতো একটি বহুধা বিভক্ত অসুবিধা রয়েছে। তিনি তবুও এই বলে জোর দিয়েছেন যে, নদী তীরবর্তী উপরের দেশটির অবশ্যই নীচের ভাটির দেশটির নিকট আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
উপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, ‘যথার্থ ভাগাভাগি’ মতবাদটিই সবচাইতে বেশি গ্রহণীয়। কারণ এতে করেই নদী অববাহিকার অর্থনৈতিক দিকটি সার্বিকভাবে ঠিক থাকে। এই মতবাদটিতে সমস্ত অববাহিকাকে একটি অর্থনৈতিক ইউনিট ধরা হয় এবং এর উপর ভিত্তি করেই পানি ভাগাভাগির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৬৮ সালে ‘হার্ভার্ড গ্রুপ’— পানি বিশেষজ্ঞ সিস্টেম প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ ও ভূগোল বিশারদেদের সমরায়ে একটি বিভিন্নমুখী জরিপ চালান। প্রাথমিক তদন্তের ফলশ্রুতিতে দেখা যায় উভয় দেশের জন্যই এটা আশাপ্রদ অর্থনৈতিক সফল দান করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক আইন মতে, নিজ জাতীয় সীমানার বাইরে কোন আন্তর্জাতিক নদীর কর্তৃত্ব নদী তীরবর্তী দেশের থাকে না।
আন্তর্জাতিক আইন মতে কোন দেশই প্রতিবেশী দেশের প্রাকৃতিক পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। এ কারণেই কোন রাষ্ট্র শুধুমাত্র কোন নদীর সাধারণ স্রোতকে পরিবর্তন অথবা থামাতেই পারে না, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি হতে পারে এমন ব্যবহার অথবা প্রতিবেশী দেশকে পানি থেকে বঞ্চিতও করতে পারে না। (আন্তর্জাতিক আইন, এল, ওপেন হার, পৃষ্ঠা ৪৭৪-৭৫)।’
যথার্থ ভাগাভাগির নীতিতে হেলসিংকি আইনই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। ‘ইন্টারন্যাশনাল ল এসোসিয়েশন ১৯৬৬ সালে তা গ্রহণ করেছে (রিপোর্ট অব দি ফিফটি সেকেন্ড কনফারেন্স হেল্ড এটা হেলসিংকি,আগষ্ট ১৪ থেকে আগষ্ট ২০, ১৯৬৬ (১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৪৮৪)।
হেলসিংকি আইনের চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে—
“Each basin State is entitled, within its territory, to a reasonable and equitable share in the beneficial uses of the waters of an international drainage basin.”
‘মানবিক প্রতিবেশ’ শীর্ষক জাতিসংঘের এক কনফারেন্সের ৫১ নং ঘোষণার এক অংশে বলা হয়েছে—
“The net benefits of hydrologic religons common to kore than one national jurisdiction are to be shared equitably vy the nations, affected;”
মানভিক প্রতিবেশে’র উপর ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত স্টকহোম কনফারেন্সের ঘোষণায় বলা হয়–
“States have, in accordance with the charter of the United Nations and the principles of the international law, the sovereign right to exploit their own resources pursuant to their own environmental policies, and the responsibility to ensure that activities within their jurisdiction or contral do not cause damage to the environment of other States or of areas beyondbthe limits of national jurisdiction, ( Principal 21, Declaration of on the Human Environment in Report of the United Nations Conference on the Human Environment, U.N.Dec. A/GONF. 48/14 and cow. (1972)
‘…..In the exploration, exploitation and development of.
সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবেও এই বক্তবেরই সমর্থন করা হয়েছে। their natural resources, States must not produce rignificant harmful effects in zones situated outside their natural jurisdiction, (General Assembly official Records, 27th Session, Supplement No 30, P. 42 U. N. Dec. A/8730 (1973).”
কিন্তু ভারত এসবের তোয়াক্কা না করে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করবার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের প্রতিবেশ বিনষ্ট করছে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে পড়বে ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। যমুনা নদীর প্রবাহ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে পদ্মার প্রবাহও। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নীচে নেমে যাবে। এতে বিনষ্ট হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
তিস্তা প্রকল্প
তিস্তার পানিসম্পদ ব্যবহারের পরিকল্পনা অবশ্য অনেক দিনের পুরনো। ৩০ দশকের মাঝামাঝি উত্তর ভারতে সেচ এবং নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার ধারণা বৃটিশ সরকারের মাথায় আসে। বৃটিশ সরকার জলপাইগুড়ির কাছাকাছি বাঁধ নির্মাণ এবং খাল কাটার পরিকল্পনা করছিলেন। এজন্য তিস্তা এবং কোসি অববাহিকা জরীপের আদেশও দেয়া হয়। পরে শুধু সেচ ও নৌ যোগাযোগে সীমিত না থেকে পরিকল্পনা করা হয় বিদ্যুৎ সৃষ্টিরও। এজন্য তিস্তা এবং নেপালের নিকোসি নদীতে দুটো বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনাও হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে বিভিন্ন প্রস্তাবে ভারতের করোনেশন সেতুর কাছে প্রায় ৭০০ ফুট উঁচু এক বাঁধ দিয়ে ৩.৫ থেকে ৩.৮ মিলিয়ন একর ফুট পানি ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়।
এতে প্রায় অর্ধমিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও করা হয়। জলপাইগুড়ির কাছে দামোহনি স্টেশনের বিপরীতে তিস্তার উপর বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনাও হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয় করতোয়া এবং সাওন নদীর সংগমে খাল কেটে পানি নিয়ে যাওয়া হবে এবং উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন নদীতে মোট প্রায় ১৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত করা হবে। এই নদীগুলো হলো মহানন্দা, তাঙ্গন, পুনউবা, করতোয়া, নাগরবুড়ি তিস্তা, ঘাগট এবং বাঙ্গালী।
দেশভাগ হয়ে যাওয়ায় এই পরিকল্পনার মূল বাঁধ এবং নিয়ন্ত্রণ এলাকা বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৩ সালে আবার জরীপ করে ১৯৫৫ সালে আর একটি প্রকল্প তৈরি করে। প্রকল্পে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত থেকে ৯ মাইল ভাটিতে গদ্দিমারিতে মূল বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এখানে বাঁধ দিয়ে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া এবং রাজশাহীর মোট ১.৮৯ মিলিয়ন একরের মধ্যে ১.৩৪ একর জমিতে খারিফ শস্য উৎপাদনের জন্যে জলসেচ করা যাবে। গদ্দিমারিতে এই বাঁধ দিয়ে ছোট বড় বিভিন্ন খাল দিয়ে সেচের জন্য প্রায় ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত করা যাবে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সরকার উত্তরবঙ্গের জলাল্পতার এই সমস্যার দিকে নজর না দেয়ায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৫৫ সালে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে পরে পাকিস্তান সরকার এ প্রকল্পের কোন বড় ধরনের কাজ হাতে নিতে বারণ করে এবং একজন উপদেষ্টা প্রকৌশলী নিয়োগের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু ততদিনে প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক কাজগুলো হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সেই পাকিস্তান লিমিটেডকে প্রকল্পের উপদেষ্টা প্রকৌশলী নিয়োগ করা হয়। এসিইর যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকায় প্রকল্পের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হেগ জিন এন্ড এসোসিয়েটসকে এসিইর এসোসিয়েট হিসাবে নিয়োগ করেন। এই দুই উপদেষ্টা ১৯৬০ সালে একটি প্রকল্প প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে ৩৯ দশমিক ২ কোটি টাকা খরচ হবে বলে হিসেব করা হয়েছিল পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা এর সাথে যোগ করে প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হয় ৪৪ দশমিক ২ কোটি টাকা।
১৯৬০ সালের বন্যায় মূল তিনটি স্রোতধারার একটি চওড়া হয়ে গেলে ঘোষণা করা হয় যে গদ্দিমারিতে বাঁধ দেয়া যাবে না। ইতিমধ্যে ১৯৫৯ সালে ইপিওয়াপদা গঠন করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সেচবিভাগের কাছ থেকে প্রকল্পটি নিয়ে নেয়। গদ্দিমারির প্রায় ৪০ মাইল দক্ষিণে কাউনিয়ায় বাঁধ নির্মাণ করা যাবে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে বলে এসিইকে। এসিই প্রকল্পের একটি নকশাও তৈরি করে। নয়া পরিকল্পনা পাকিস্তান সরকারকে দিলে সরকার ডি,কে, পাওয়ারের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী প্রকৌশলীদের এক বোর্ড সৃষ্টি করেন উভয় স্থানে বাঁধের সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য। বোর্ড তার প্রতিবেদনে জানায় যে গদ্দিমারি এবং কাউনিয়া এই দুই স্থানেই বাঁধ দেয়া যাবে এবং স্রোতধারা চওড়া হয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধ দেয়া যাবে না এ প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত নয়। ১৯৬৭ সালে আবার গদ্দিমারিতেই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আবার একটি বিশেষ মহল এসিইকে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু মঙ্গলা বাঁধের উপদেষ্টা বিন্নি এবং পার্টনারদের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়।
ভারতের সঙ্গে আলোচনার ইতিহাস
দেশে এসব চলতে থাকলেও ভারতের সাথে আলোচনা চলছে ১৯৫৫ সাল থেকেই। ভারতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের পত্রের জবাবে জানায় যে ভারত ও তিস্তার পানি ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। সেই সাথে ভারত পাকিস্তানের তিস্তা প্রকল্পের তথ্যাদি চায়। ১৯৫৭ সালের মে মাসে পাকিস্তান জানায় যে প্রাথমিক তথ্যাদির ভিত্তিতে তিস্তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জরীপ ও অনুসন্ধান শেষে পুরো প্রকল্পের নকশা ভারতকে দেয়া যাবে। পাকিস্তান ভারতের কাছে ভারতীয় পরিকল্পনার তথ্যাদি চেয়ে পাঠায়। জবাবে ১৯৫৮ সালের নবেম্বরে ভারত জানায় যে পাকিস্তানের তথ্যাদি না পাওয়া পর্যন্ত তিস্তা প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা হবে।
১৯৬৮ সালে মে মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞপর্যায়ের আলোচনায় পাকিস্তান তার প্রকল্পের দলিল দেয়। জুলাই মাসের ২০ তারিখে ভারত তিস্তার উপর বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে জানায়। অজুহাত হিসাবে ভারত বলে যে এতে ভারত প্লাবিত হয়ে যাবে এবং আরও অনেক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ডিসেম্বরে সেক্রেটারী পর্যায়ের আলোচনায় পাকিস্তান বলে যে ভারতের সেচ প্রকল্পের জন্য আরও অনেক নদী থেকে পানি পাওয়া যেতে পারে। ভারত তার প্রেক্ষিতে বলে যে বিষয়টি তাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ১৯৬৯ সালে ভারত সে সেক্রেটারী পর্যায়ের সভায় পরীক্ষা না করেই দু’দেশেরই তিস্তা প্রকল্প এক করে ফেলার উপর জোর দেয়।
১৯৭০ সালের ১৯শে জানুয়ারী ভারত জানায় যে ১৯৬৮ সালের বন্যায় তিস্তা বেড়ী বাঁধের যে সব অংশ ভেঙ্গে গেছে ভারত তা মেরামত করছে। তিস্তার পানি অন্যখাতে বইয়ে দেয়া হচ্ছে না।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়৷ কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় যে দু’দেশের দুজন প্রতিনিধি তিস্তার পানি ব্যবহারের ব্যাপারে করণীয় কাজের ব্যাপারে দু’দেশের সরকারকে কমিশন অনুরোধ করবে।
১৯৭৬ সালে জানা যায় যস ভারত পশিম বঙ্গের মহানন্দা নদীতে তিস্তার পানি বইয়ে দেয়ার জন্য মহানন্দার উপর কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের ২৪শে আগষ্ট এ ধরনের কাজে অগ্রসর না হবার জন্য ভারতের প্রতি অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশে বলে যে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারত আলোচনা করলে ভাল হবে। সে বছরই ৬ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মহানন্দা এবং তিস্তার উপর বাঁধ নির্মাণ করলে বাংলাদেশের উপর এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জানায় এবং পুনরায় তা বন্ধ করার অনুরোধ জানায়।
বাংলাদেশ পরে তার ২৪শে আগষ্ট এবং ৬ই সেপ্টেম্বরের পত্রের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চায়। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে কিছুই জানায়নি বরং বাংলাদেশের অনুরোধ উপেক্ষা করে তিস্তা এবং মহানন্দার উপর বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে তিস্তার পানি ব্যবহারের উপর উল্লেখিত আলোচনা ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আরও অনেক আলোচনা হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের প্রায় প্রত্যেকটি বৈঠকেই তিস্তা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভারত অবিলম্বে তিস্তার উপর বাঁধ নির্মাণ বন্ধ না করলে বাংলাদেশের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে ভারতকে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসতে রাজি করানো। এজন্যে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে হবে অবিলম্বে।