You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.01.18 | আওয়ামী লীগের সকল ক্ষেত্রে বিজাতীয় মতবাদ বা কমিউনিস্ট পন্থীদের প্রভাব কাজ করছে - আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত এম আর সিদ্দিকী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ জানুয়ারি ১৯৮০ - সংগ্রামের নোটবুক

আওয়ামী লীগের সকল ক্ষেত্রে বিজাতীয় মতবাদ বা কমিউনিস্ট পন্থীদের প্রভাব কাজ করছে
সাক্ষাৎকারঃ আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত এম আর সিদ্দিকী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ জানুয়ারি ১৯৮০

আওয়ামীলীগ (মালেক)-এর সম্প্রতি বহিস্কৃত নেতা এম আর সিদ্দিকী। ‘৬২ সালে প্রথম তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। পরে’৬৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে।’৬৫ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।’৭০ ও ‘৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ‘৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি পরাজিত হন।
‘৬৪ সাল থেকে ‘৭২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। পাকিস্থানে আমলে ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। শেখ মুজিব মন্ত্রিসভায় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতাকে সম্প্রতি দল থেকে বহিষ্কার করা হয় ‘বাকশাল’ প্রশ্নে। দলে তিনি ‘কট্টর বাকশাল পন্থীদের’ বিরুদ্ধে ছিলেন।
——
প্রশ্ন –কয়েকদিন আগে আপনাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
উত্তর -এ ব্যাপারে আমি এখনও চিন্তাভাবনা করছি এবং শীঘ্রই পত্রিকায় বিবৃতি দেবো যাতে জনগণের কাছে আমার বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে যায় এবং কোন সংশয় না থাকে।
প্রশ্ন -আপনি কি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে বলে আজ করেছিলেন?
উত্তর -আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল মাঝখানে পূর্বে কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা আশা করিনি।
প্রশ্ন -পত্রিকায় দেখলাম আপনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেসব অভিযোগ এনেছে তার মধ্যে একটি হলো মার্কিন শান্তি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর -এ ব্যাপারে আমার ভূমিকা ছিল শুধু সরকারের নির্দেশ পালন করা। অর্থাৎ দুই সরকারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সেটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে স্বাক্ষর করা। এর চাইতে বেশি কিছু নয়।
প্রশ্ন -আপনি কি মনে করেন না শান্তি বাহিনীর লোক আসলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতো?
উত্তর -বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই এদের আসার কথা ছিল। আর এদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ জন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে যে ৪ ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকে তার ১ টি কারিগরি সাহায্য এবং এই কারিগরি সাহায্যের অধীনেই শান্তি বাহিনীর সদস্যদের এ দেশে আসার কথা ছিল। আমি মনে করি না এ কয়জন লোক দ্বারা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতো। কেননা আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে বিদেশি এজেন্টরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে এদের মধ্যে যেকোন এজেন্ট থাকতে পারেনা তা আমি বলছিনা।
প্রশ্ন -এই চুক্তির শেষ পরিণতি কি হলো?
উত্তর -আমি দেশে ফিরে এসে দেখলাম এর বিরুদ্ধে দেশে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগেরও অনেকে সমালোচনা করছে। এছাড়া ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক এর বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালাতে শুরু করে। যাইহোক এসব প্রত্যক্ষ করে আমি সরকারকে এ চুক্তি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই। এবং পরে তা বাতিল করা হয়।
প্রশ্ন -আপনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আরো একটি অভিযোগ আপনি অবাধ অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর -এ সম্পর্কে আমার স্পষ্ট বক্তব্য আমি বাংলাদেশের জন্য সবসময় পরিকল্পিত অর্থনীতির কথা বলে আসছি এবং ভবিষ্যতেও বলবো। কোন বিকল্প পন্থায় আমি বিশ্বাস করিনা।
প্রশ্ন -আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতি এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর -আমার ব্যক্তিগত ধারণা অন্তর দলীয় কোন্দল, রেষারেষি এবং সুবিধাবাদ আওয়ামী লীগকে অনেক দুর্বল করে ফেলেছে এবং দলের মধ্যে সাংগঠনিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
প্রশ্ন -কিছু দৃষ্টান্ত দিলে ভালো হয়.
উত্তর -শেখ মুজিবুরের সময় আমাদের সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু বর্তমানে পার্টির নেতারা তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন এবং সংগঠনে বিজাতীয় মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
প্রশ্ন -আপনি কি বাকশাল মতবাদে বিশ্বাস করেন?
উত্তর – ‘বাকশাল’ শব্দটা এখন দ্ব্যর্থবোধক হয়ে গেছে। তবে আমি একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করিনা। এমনকি এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বাকশালের সব কর্মসূচি বাদ দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক দিকটা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সম্প্রতি তারা আবার সম্পূর্ণভাবে বাকশালের মতবাদকে সামনে টেনে এনেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ যদি জিয়াউর রহমানের সরকার বাকশাল এর মত একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে ঐ আওয়ামী লীগ নেতারা তার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যাপারে অন্যের সমালোচনা পছন্দ করেনা। তাই আওয়ামীলীগের বর্তমান রাজনীতি একটা মস্ত বড় কনফিউশনের মধ্যে রয়েছে বলে আমি মনে করি।
দ্বিতীয়তঃ এছাড়া আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি রাখতে পারেনি। শুধু সরকারের বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করলে চলবে না। বাংলাদেশের যৌথ নৈতিক শংকর আমরা দেখতে পাচ্ছি তা থেকে মুক্তির পথকে তাও একটি সংগঠনকে দেখাতে হবে। শুধু নেগেটিভ বা নেতিবাচক রাজনীতি করে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যাবে না।
প্রশ্ন -আওয়ামী লীগের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উত্তর -আওয়ামী লীগের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি যে কি তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে সংগঠনের সকল ক্ষেত্রে বিজাতীয় মতবাদ বা ‘কমিউনিস্ট পন্থীদের’ প্রভাব কাজ করছে। কেননা আজকাল আওয়ামীলীগের বিভিন্ন সভায় বঙ্গবন্ধুকে কমরেড বলা হয়। তাছাড়া আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদার বাহিনী কবলিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক বলে আমি মনে করি। যেখানে সব দল এবং দেশের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ সেখানে আওয়ামী লীগ নীরব ভূমিকা পালন করছে তদুপরি নিন্দা না করে বরং যারা করছে তাদের সমালোচনা করে পরোক্ষভাবে সোভিয়েত হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
প্রশ্ন -শেখ মুজিবের শাসনামলে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য কি ছিল বলে আপনি মনে করেন।
উত্তর -বঙ্গবন্ধুর সময় আমাদের পররাষ্ট্র নীতি ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। আপনাদের নিশ্চয়ই শহর আছে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার স্বল্পকাল পরেই ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়। অপরদিকে রাশিয়ার একটি বিরাট সালভেজ টিম যারা চট্টগ্রামে কর্মরত ছিল তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করতে হয় এবং এ নিয়ে রীতিমতো কূটনীতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রশ্ন -আপনি কি মনে করেন মতিয়া চৌধুরীসহ প্রাক্তন মস্কোপন্থী নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগ দানের ফলে পার্টিতে সংকট সৃষ্টি হবে।
উত্তর -ব্যক্তিগতভাবে নামোল্লেখ করতে চায় না তবে আওয়ামী লীগে বিজাতীয় মতবাদের পুনঃপ্রবেশ ঘটেছে এবং এসব লোকদের মতবাদ আমাদের মতবাদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই এর ফলে পার্টিতে রাজনৈতিক ক্রাইসিস ও দ্বন্দ্ব শুরু হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আওয়ামী লীগের অধিকাংশ কর্মী আওয়ামী লীগের পুরনো নীতিতে বিশ্বাসী এবং আমি নিজেও কোন বিদেশী মতবাদে বিশ্বাসী নই। আমি কমিউনিজমে বিশ্বাস করিনা এবং কোনদিন করবো না।
প্রশ্ন -শেখ মুজিবের সময়ে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল। সেটা আপনি কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
উত্তর -সমাজতন্ত্র বলতে আমরা সমাজের বৈষম্য দূরীকরণ এবং সম্পদের সুষম বন্টন যতটুকু সম্ভব করা যায় সে ধরনের একটি কর্মসূচি কে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। আর কিছু নয়।
প্রশ্ন -আপনার বহিষ্কারের ব্যাপারে অনুপ্রবেশকারী কমিউনিস্টদের কোনো চাপ ছিল কিনা।
উত্তর – ঠিক বলতে পারি না।
প্রশ্ন -গত নির্বাচনে আপনার পরাজয়ের কারণ কি?
উত্তর -প্রথমত আমি প্রচারণার জন্য বিশেষ সময় পাইনি। যেহেতু আমার মনোনয়নের ব্যাপারে পার্টি অনেক দেরীতে সিদ্ধান্ত নেয়। তাছাড়া নির্বাচনে যথেষ্ট কারচুপি হয়েছে।
প্রশ্ন -আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর – এটি একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণবাদের আক্রমণ ও নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করি।
প্রশ্ন -এ বিচারে চীনের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর – চীনে এ ব্যাপারে অনেক সংযত এবং পরের স্বাধীনতার উপর শ্রদ্ধাশীল। বিশেষ করে তাইওয়ানের উপর তাদের যে ঐতিহাসিক দাবি সে ব্যাপারে তারা যে সংযম দেখাচ্ছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
প্রশ্ন -একটু আগে আপনি বলেছেন বাকশাল মতবাদে বিশ্বাস করেন না এ ব্যাপারে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও একই কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে আপনার একই প্লাটফর্মে কাজ করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা।
উত্তর -সেরকম কোনো কিছু এখনো চিন্তা করিনি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.01.18-.pdf” title=”1980.01.18″]