অন্তিম শয্যায় মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার
ডাঃ নুরুল ইসলাম | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ জানুয়ারি ১৯৮০
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী শেষ জীবনে বেশ কিছুদিন পিজি হাসপাতালের ডাক্তার নুরুল ইসলামের চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ডাঃ নুরুল ইসলাম সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকারটি ডাঃ নুরুল ইসলাম আমাদের কাছে পাঠান।__
আমি ডাক্তার নুরুল ইসলাম পিজি হাসপাতাল থেকে বলছিঃ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী গত কয়েকদিন ধরে আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য এসে আমাদেরকে সুযোগ দিয়ে বাধিত করেছেন। জীবনে বেশ কয়েকবার উনাকে চিকিৎসা করার সুযোগ আমার হয়েছে। ১৯৫৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত। আজকে আমাদের সকলের ইচ্ছা ওনার কাছ থেকে আমরা কয়েকটি কথা শুনবো।
ভাসানীঃ আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি ডাক্তারদের দ্বারা বহুবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছি ও চিকিৎসা করিয়েছি। আমার মনে হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণ তাদের মধ্যে কোন ‘টেরিটোরিয়াল বেসিস’-এ অথবা ‘লিঙ্গুইস্টিক বেসিস -‘ এ পেশেন্টকে গ্রহণ করেনা বা চিকিৎসা করে না। চিকিৎসকদের প্রধান আদর্শ জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে বর্ণ, গোত্র কোন বিচার না করে দেশের কোন ভেদাভেদ না রেখে, পেশেন্টকে সর্বতোভাবে রোগ হতে মুক্ত করাই হলো তাদের জীবনের প্রধান আদর্শ। সেই সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। তারপর আমার দেশে বহুবার ডাক্তার নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে মিটফোর্ড এবং মেডিকেল হসপিটাল এবং অন্তরীণ অবস্থায় যখন ছিলাম তখন তার দ্বারা আমি বহুবার চিকিৎসা করিয়েছি এবং এখানেও পিজি হসপিটালে আমি কয়েকবার ভর্তি হয়েছি এবং তাঁর সান্নিধ্যে চিকিৎসা করেছি। এবং এই কয়েকটি হাসপাতালে অন্যান্য চিকিৎসকরাও তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে দেখাশোনা করেছেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন, তার জন্য আমি তাদের সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি এবং এখনো করছি এবং যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তাদের জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দোয়া করব।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় ‘পার্টিশন’ হওয়ার পর আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যা শুধু বাড়ে নাই, রোগীর সংখ্যা, খাদ্যের অভাব, বস্ত্রের অভাব, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, নানা কারণে রোগী এত বৃদ্ধি হয়েছে যে, যে কয়েকটি হাসপাতাল ডিস্ট্রিক্ট বা হেডকোয়ার্টার আছে তার দ্বারা চিকিৎসা করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত অন্যান্য শিক্ষা, রাস্তা-ঘাট, পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রতি তারা অবশ্যই দৃষ্টি দিবেন। কিন্তু বিশেষ করে, চিকিৎসার জন্য তাদের বাজেটের বৃহত্তম অংশ খরচ করা দরকার। অত্যধিক নার্সের প্রয়োজন, ডাক্তারের প্রয়োজন, আধুনিক যন্ত্রপাতির বা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন তা সরবরাহ করা প্রয়োজন এবং প্রত্যেক হসপিটালের যাতে ঔষধ প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ হয় তার ব্যবস্থা করবেন। সরকারকে এ সম্বন্ধে আমি বহুবার সজাগ করে দিয়েছি যে স্বাস্থ্যের মঙ্গল যদি না করতে পার, এদেশের মানুষকে রোগ হইতে মুক্ত করিতে না পারিলে তাদের সামাজিক উন্নতি, রাজনৈতিক জীবনের উন্নতি, অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি কিছুতেই সম্ভবপর নয়। স্বাস্থ্যই হইল উন্নতির মূল ভিত্তি এবং মূল সোপান। আমি আশা করি যে আমার দেশের ডাক্তাররা অন্যান্য রাজনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী যে যেখানে যেভাবে সম্ভব সমাজের খেদমত করে থাকেন তাদের চেয়ে এঁরা আরো বেশি খেদমত করতে পারবেন এঁদের দেশ প্রেম সম্বন্ধে কোনো রকম সন্দেহ প্রকাশ করার কোন কারন নাই। তবে রোগীরা এবং আমরা অনেক সময় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অনেক রকম ‘কমপ্লেইন’ করে থাকি অভিযোগ এনে থাকি। সে অভিযোগের মূলে হচ্ছে ডাক্তারের স্বল্পতা, নার্সের অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব -নানা কারণে তাদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্বেও রোগীকে ভালোভাবে চিকিৎসা করতে পারেনা। সরকারের নিকট দাবী জানায় যে পিজি হসপিটালে উন্নতির জন্য সর্বতোভাবে তারা চেষ্টা করে এবং সারাদেশে যে সমস্ত হাসপাতাল রয়েছে, সে হাসপাতালগুলি যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হয়। তার জন্য ঔষধ, নার্স, ডাক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। ডক্টর নুরুল ইসলাম এর সম্বন্ধে আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা আমার দেশে যারা একেবারেই সর্বহারা যারা পয়সা খরচ করে নিজের অথবা নিজের ছেলেপেলে, পরিবারবর্গের কোনরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে পারেনা। আমি যখন উত্তরবঙ্গে গিয়েছি রংপুর, দিনাজপুর যে কোন ডিস্টিক্ট হইতে বা পূর্ববঙ্গের যে কোন ডিস্টিক্ট হইতে যে কোনো রোগীকে একটা শ্লিপ লিখে ডাক্তার নুরুল ইসলামকে আমি পাঠিয়েছি এবং অনুরোধ করেছি যে এর পক্ষে চিকিৎসা করা নিজ ব্যয়ে মোটেই সম্ভব নয়, আপনি একে ভালোভাবে পরীক্ষা করে যাতে আপনার অধীনে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে তার ব্যবস্থা করবেন। আজ পর্যন্ত আমার মনে হয় না আমার কোনো রোগী যাদের আমি এইরকম স্লিপ দিয়ে পাঠিয়েছি তারা ফেরত যেয়ে আমার কাছে পুনরায় অভিযোগ করেছে যে আপনার চিঠি অনুযায়ী আমাকে ভর্তি করেন নাই বা চিকিৎসা করে নাই -এটাই আমার সবচেয়ে গর্ব যে আমাদের দেশে এখনো বহু চিকিৎসক বহু দেশ প্রেমিক আছে যারা মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শুধু পালন করেনা আন্তরিক দরদ দিয়ে তাদের রোগ হতে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে থাকেন। আমি আশা করি যে আমার দেশের সুযোগ্য ডাক্তাররা দেশকে সুখী এবং সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলবার পথে দেশের আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখে যাতে তারা স্বাস্থবান হয় এবং তারা দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করলে আমি সুখী হবো।
মৌঃভা -আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে ভারতের নর-নারীকে মুক্ত করা এবং স্বাধীনতা অর্জন করার ব্যাপারে আমরা যে সংগ্রাম করেছে সে সংগ্রামের সময় আমি (প্রত্যেক) ভারতের বিভিন্ন ‘প্রভিন্স’ ভ্রমণ করে যা দেখেছি তাতে আমাদের দেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার মে স্পৃহা, আকাঙ্ক্ষা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এরকম আর দুনিয়ার কোনো জাতির মধ্যে আমি কখনো লক্ষ্য করি নাই। আমি এই বাংলাদেশের মানুষ, কোন প্রকার লোভে জড়িত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে নাই। শত শত রকমের নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করেও তারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং আংশিক হইলেও আমরা তা সাফল্যমন্ডিত করেছি এইটাই আমার সর্বপ্রথম স্মরণীয় বিষয় যে, আমাদের দেশের মানুষ শুধু বাংলার স্বাধীনতার জন্য নয়, গোটা ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য, গোলামীর জিঞ্জির ভাঙ্গার জন্য যে সংগ্রাম করেছে সে সংগ্রামের তুলনায় পৃথিবীর ইতিহাসে নাই এবং সেটা সাফল্যমন্ডিত হয়েছে।
ডাঃ নূর ই – আমরা ডাক্তার এবং নাগরিক হিসাবে ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত সব সময় আপনাকে দেখেছি -জনসাধারণের পক্ষ হয়ে আমাকে যদি বলবার অনুমতি দেন বলবো বিরোধীদলের নেতৃত্ব দান করে এসেছেন। আপনি নিজে শাসনভার কোন সময় হাতে নেয় নি কেন?
মৌঃ ভা -মানুষের জীবনে স্বাধীনতা বিভিন্ন প্রকারের (গ্রহণ করতে হয়)। রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। সামাজিক স্বাধীনতা ,ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক (মূলক) স্বাধীনতার দামও কোন অংশে কম নয়। তাই আমি দেখেছি, আমাদের দেশের জমিদার মহাজন’, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মিলে অসংখ্য কোটি কোটি মানুষের রক্ত শোষণ করে যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গেলে আগে জনগণের মধ্যে জাগরণ আনা দরকার। রাজনৈতিক চেতনা যদি আমরা জনগণের মধ্যে না আনতে পারে, জনগণকে যদি আমরা সংগঠিত করতে না পারি, আদর্শবাদী করে গড়ে তুলতে না পারি, জনগণের চরিত্র যদি গঠন করতে না পারি, জনগণের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করতে না পারি -শুধু শাসনক্ষমতার দ্বারা মানুষের মঙ্গল করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম হইতেই আজ পর্যন্ত আমি জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বরাবরই তাদের চেতনা জাগাবার চেষ্টা করে আসছি। এখনো আমার সে মিশন বা সে সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, দেশের সমাজতন্ত্র ঐদিন হইতে পারে যেদিন সমাজের সকল স্তরের মানুষ স্বেচ্ছাকৃতভাবে দেশকে শাসন করবে।
সমাজতন্ত্র মানেই যে রাষ্ট্রসমাজে চালায় তাকে বলে সমাজতন্ত্র। একমাত্র রাজার নির্দেশে যে রাষ্ট্রপরিচালনার শাসন ক্ষমতা পরিচালনা হয় তাকে বলে রাজতন্ত্র, জনগণের দারাজে রাষ্ট্রপরিচালনা হয় তাকে বলে গণতন্ত্র। অতএব, আজও জনগণের মধ্যে সেই জাগরণ আমি আনতে পারিনি, আমরা এখনো তাদের সচেতন করতে পারিনি। এখনো তাদের রাজনীতির প্রতি যতটা আকৃষ্ট হওয়া দরকার তার চেয়ে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা তার বিশেষ প্রয়োজন। এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই হল মানব জীবনের মূল লক্ষ্য । এবং কামনা। তাই আমি শাসনকামী, এ কথা বলি নাই যে শাসন ক্ষমতায় কখনো যাবনা। যেদিন জনগণকে আমি সংগঠিত করতে পারব জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চেতনা জাগাতে পারব, সমাজতন্ত্র আল্লাহর সঙ্গে তৌহিদে বিশ্বাস রেখে সমাজতন্ত্র হয়, যে সমাজতন্ত্রকে আমি মনেপ্রাণে কামনা করি। এ মিশন সাকসেসফুল করতে হলে, সাফল্যমন্ডিত করতে হলে জনগণের দ্বারা একমাত্র সম্ভবপর। তাই আমি এখনো সেই চেষ্টায় আছি -যদি আল্লাহ আমার জীবনের আশা -আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, জনগণকে আমি সংগঠিত করতে পারি, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চেতনা আনতে পারি, সমাজতন্ত্রের উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্বন্ধে তাদের শিক্ষা দিতে পারি সেই সময় আমি শাসনক্ষমতা অংশগ্রহণ করব।
ডাঃ নু ই -গত কয়েক বছর ধরে আপনি আপনার চেষ্টা করে আসছেন একটা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় সেটা প্রতিষ্ঠাও করেছেন (তার…..) যত শীঘ্র সম্ভব দেশীয় ও বৈদেশিক আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে এটা গড়ে তোলা -ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং আপনার যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দুটোর মধ্যে আপনি কি সামঞ্জস্য দেখতে পান?
মৌঃভাঃ – ইসলাম বিশ্বজনীন একটি আদর্শ। বিশ্বাস করি এটা শুধু কোন গোত্রের জন্য নয়, কোন বর্ণের লোকদের জন্য নয়, কোন সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য নয়, এটা ইউনিভার্সেল আদর্শ বিশ্বজনীন আদর্শ। এই আদর্শকে মানবজীবনে রূপায়িত করতে হলে সকল স্তরের মানুষের মন আকৃষ্ট করতে হবে -আদর্শের দ্বারা। দুনিয়ার যেকোন গোত্রের যে কোন বর্ণের যে কোন ধর্মের মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে ইসলাম সার্বজনীন আদর্শ এটা শুধু মুসলমানদের জন্য রাব্বুল আলামিন পাঠিয়ে দেন নাই। এটা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক, শিখ , পার্বত্য আদিম অধিবাসী পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারে, অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারে। সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে দিতে পারে, সামাজিক মুক্তি দান করতে পারে। তখন ইসলামের প্রতি সারা দুনিয়ার মানুষের মন আকৃষ্ট করা সম্ভবপর হবে। ইসলাম কোনদিন সাম্প্রদায়িক কোন আদর্শ নয়, ইসলাম কোন জাতির প্রতি, কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। ইসলাম কোন ভাষার ভিত্তিতে আদর্শ প্রচার করতে মোটেই রাজি নয়। ইসলাম কোন ভৌগোলিক সীমার মধ্যে ইসলামের আদর্শ নির্ধারিত হয় নাই। ইসলাম আল্লাহর আদর্শ। ইউনিভার্সাল গজ এবং ইসলাম ইউনিভার্সেল আদর্শ। অতএব আমি মনে করি, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমি এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি যে শিক্ষা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মঙ্গলের জন্য ব্যবহার হয়, যে শিক্ষায় মানুষকে সত্যিকারের মানুষরূপে গড়ে তুলবার ক্ষমতা অর্জন করে সে শিক্ষার জন্য আমি আপ্রান চেষ্টা করতেছি, আশা করি আমার এবং বিদেশের সমস্ত বিশ্বে মানুষ তারা স্বচক্ষে যখন দেখতে পারবেন যে সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মুসলমানদের জন্য করা হয়নি, শুধু বাঙ্গালীদের জন্য নয়, শুধু এশিয়ার জন্য নয় -ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা সমস্ত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, রাজনৈতিক মুক্তির জন্য এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বভাব, বিশ্বশান্তি, বিশ্বপ্রেম স্থাপনের জন্য করা হয়েছে। আমি আশা করি সেদিন আমার আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে এবং ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন অর্থের জন্য আমাকে কোন চিন্তাও করতে হবে না । আমার মৃত্যু যদি তার পূর্বেই এসে যায় তো আমি আশা করি এবং দেশবাসী যারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আকুল আবেদন জানায় যে আমার মৃত্যুর পরেও যেন ইসলামের আদর্শ সারা দুনিয়াব্যাপী এই আদর্শকে আমাদের আরবি ভাষায় বলি যে ‘রাব্বানী আদর্শ’ আল্লাহর গুনে গুণান্বিত হয়ে সকল মানুষকে সমানভাবে স্নেহ, মমতা, ভালবাসা দান করা।
ডাঃনূ ই – আমরা প্রত্যেকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যে আশাপোষণ করেন তা একদিন না একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই কারণ উদ্দেশ্য যেখানে আল্লাহর রহমতের সেখানে অভাব হয় না, এ বিশ্বাস আমরা দৃঢ়ভাবে করি। এবার আপনার কাছ থেকে জানতে চাইবো, হয়তো এমন কিছু আপনার জীবনের নাই বা না থাকার সম্ভাবনা বেশি তবু জানতে চাইবো, আপনার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা কোনটা?
মৌঃ ভা – সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আমার জীবনে, ভারতের ৪০ কোটি নরনারী আমরা সবাই মিলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছি -দীর্ঘদিন কারা যন্ত্রণা ভোগ করে নানাভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের মাধ্যমে আশা ছিল যদিও আমাদের ভৌগোলিক সীমা বিভাগ হয়েছে কিন্তু উভয় দেশের মানুষের মধ্যে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা সকলের মঙ্গল কামনা কিছুতেই ভেঙে পড়বে না। আমরা একসঙ্গেই ভারত এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন করে দুটো দেশকে সমানভাবে আমরা উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলের লোক তারা এই স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি মর্যাদা না দিয়ে কি করে আবার পুনরায় অখন্ড ভারত করা যায় সেই পথে তারা অগ্রসর হয়ে আমাদের যথেষ্ট, উভয় দেশের ক্ষতি করেছে। আমি আশা করি, এখনও আমাদের সময় আছে, যদি যে বিভাগ হয়ে গেছে সে বিভাগকে পুনরায় একত্রিত করে অহেতুক চেষ্টা বা কল্পনা -জল্পনা না করে ভারতের স্বাধীনতা যাতে অক্ষুন্ন থাকে, সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকে তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি এবং ভবিষ্যতেও করব। এবং ভারতের যে সমস্ত মনীষী যে স্বাধীনতার জন্য অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছে, কষ্ট ভোগ করেছে তাদের সেই ইতিহাসকে ম্লান করে, ধ্বংস না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সারা পৃথিবীতে অনেক উজ্জ্বল। বাংলার নর-নারী যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজের জীবনকে বলি দিয়েছে, কোরবান করেছে তার তুলনা পৃথিবীতে নেই। যদি আমাদের দেশ ভারতের তুলনায় জনসংখ্যায় অনেক কম, ভৌগোলিক সীমানা অনেক কম, ‘রিসোর্স’ অনেক কম, সামন্তবাদী পুঁজিবাদের সংখ্যাও কম এবং কল-কারখানা ইত্যাদি অনেক কম তবুও আমরা একটা আদর্শ জাতির পরিচয় আমরা বরাবর দিয়েছি ইনশাআল্লাহ যতদিন আমরা জীবিত থাকবো আমরা স্বাধীনতাকে মনে-প্রাণে শুধু বিশ্বাস করাই নয়, রক্ষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগের যেকোন কোরবানির বিনিময়ে আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল গোত্রের লোক একত্রে চেষ্টা করব। আমি আশা করি যে আমার এই কষ্ট আমার সবচেয়ে বেশি যে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করিয়াছি বরাবর আমরা যারা কংগ্রেস অংশগ্রহণ করেছিলাম খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম তাদের মধ্যে আমি এবং আরো কয়েকজন এখনো জীবিত আছে। আমাদের রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে অসম্প্রদায়িক। আমরা মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসি, বাসবো যতকাল জীবিত থাকবো। তাই আমি মনে করি এই যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের শৃংখল ভাঙার জন্য যে চেষ্টা হইতেছে সেটা আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টদায়ক।
ডাঃ নু ই – এবার রাজনীতি থেকে বহুদূরে জনগণের মাঝ থেকে চিকিৎসক হিসেবে আমাদের সবাইকে রেখে আপনাকে অনুরোধ করবো কয়েকটা উপদেশ দিতে।
মৌঃ বা – আমি আশা করি চিকিৎসক মন্ডলী আপনাদের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ সকল ব্যবসায়ী চেয়ে আপনাদের সবচেয়ে বেশি। কি গরীব, কি ধনী, কি কৃষক, কি মজুর, কি ভূমিহীন, কি মজুর, কি ফ্যাক্টরির মজুর, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত, পুঁজিপতি সব শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসার জন্য আপনাদের কাছে যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে শুধু তাদের রোগ চিকিৎসাতো করবেনই বটে তার সঙ্গে তাদের চরিত্র গঠন করবার তারা যাতে সত্যবাদী হয়, ন্যায় পরায়ণ হয়, তারা যেন মিতব্যয়ী হয় , দেশবাসীকে ভালোবাসতে শিখে, তারা যেন মানুষের প্রতি অবজ্ঞা না করে, তারা যেন মানুষের রক্ত পান করে নিজেদের ভোগবিলাস চরিতার্থ না করে এবং আপনারা নিজেও ওই পথের পথিক হবেন। ডক্টর আনসারীর মত ডক্টর, ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের ডাক্তার, হেকিম আফজাল খাঁর মতো চিকিৎসক, হারাণ বিশ্বাস কবিরাজের মতো কবিরাজ আমাদের দেশে শুধু অর্থের জন্যই তাদের ব্যবসা, চিকিৎসা ব্যবসা চালায় নাই। মানুষের অশেষ কল্যাণ করে গেছে। মৃত্যুর পরও এখনও তাদের মিশন তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যতকাল পৃথিবী থাকবে তাদের নাম দেশবাসী স্মরণ করবে। আমি আশা করি যে আপনারা দিবারাত্রি পরিশ্রম করেন, কর্তব্য পালন করেন তার সত্বেও সময় গেলে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এদের বাঁচাবার জন্য সুষ্ঠু কোন কর্মপন্থা -কর্মসূচি এবং চিকিৎসা হইতে পারে, আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থা যেমন খারাপ, চিকিৎসা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। শিক্ষার জন্য এবং চিকিৎসার জন্য ব্যয় করাই হলো সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব এবং কর্তব্য। মানুষ মরে গেলে তার জন্য আর শিক্ষার প্রয়োজন হয় না -তার জন্য কোন জিনিসের প্রয়োজন হয় না । মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। অতএব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজন এবং চিকিৎসার অভাবে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিবছর প্রাণ করে থাকে। শুধু ডায়রিয়া, পকা ব্যারামে যে পরিমাণ মানুষ পূর্বে মারা যেত যদি সময় উপযোগী চিকিৎসা করা যায় তাহলে অধিকাংশ আরোগ্য লাভ করতে পারত। বর্ধমান আমাদের আশার সঞ্চার হয়েছে ম্যালেরিয়া এবং কলেরা প্রভৃতি রোগে আর পূর্বের মত এত মারা যায় না। তাই আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করি সর্বদা যাতে এই পাঁচ হাজার ইউনিয়নে এমন কোন চিকিৎসালয় সরকার স্থাপন করতে পারে, যাতে কম ব্যয়ে প্রতিটি নারী এবং পুরুষ, শিশু, বালক-বালিকা তাতে চিকিৎসা লাভ করতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে যে সকল হাসপাতালের চিকিৎসক আছে এবং আমি বলব আপনারা চিকিৎসক সমিতির পক্ষ থেকে গভারমেন্ট এর কাছে দাবি জানান যাতে আমাদের দেশের এমবিএস ডাক্তাররা যাতে গ্রামাঞ্চলে যেয়ে চিকিৎসার ব্যবসা আরম্ভ করতে পারে। তা করতে হলে তাদের ফার্মেসি করার জন্য অর্থের প্রয়োজন তা আদৌ তাদের নাই। সরকার যদি প্রত্যেকটি ডাক্তারকে তার ফাইন্যান্স মীট করবার জন্য অর্থাৎ এফার্মেসি খোলার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ টাকা সাহায্য বা লোন দেয় তাহলে যথেষ্ট কল্যাণ হইতে পারে। পাঁচহাজার ইউনিয়নে যদি আজ পাঁচহাজার আপনাদের প্রোডাকশন এই সমস্ত ডাক্তার এই ডাক্তারকে যত দিন আপনারা কাজে লাগাইতে না পারেন প্রতি বৎসর প্রতিটি হসপিটালে যেসব ডিগ্রী আপনারা দিয়ে থাকেন পোস্টগ্রাজুয়েট শিক্ষা এই শিক্ষার বেনিফিট গ্ৰামের লোক আজ পর্যন্ত পাচ্ছে না -কেন পাইতেছে না? না পাওয়ার কারণ যে, যেখানে জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নাই, সেই অঞ্চলে কোন ডাক্তার-খানাও নাই। ফার্মেসি ও নাই। আমি আশা করি আপনাদের চিকিৎসক মন্ডলীর যেটি আছে সেটি থেকে আপনারা সরকারের নিকট দাবী জানান এবং আমিও সরকারের বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করব যে চিকিৎসার মঙ্গল করতে হলে শুধু কয়েকটা টাউনে বড় হাসপাতাল করলে চলবে না, পাঁচহাজার ইউনিয়নে যাতে গ্রাম্য হাসপাতাল সৃষ্টি করতে পারেন তার ব্যবস্থা এবং এই ডাক্তারদিগকে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ দিয়া ফার্মেসির ঔষধ পত্র, অন্যান্য যন্ত্রপাতি খরিদ করার জন্য সহায়তা করেন তাহলে আমাদের দেশে যথেষ্ট কল্যাণ হবে।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.01.18.pdf”]