বাংলা বনাম ইংরেজি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ জানুয়ারি ১৯৮০
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অফিস-আদালত তথা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে স্বাধীনতার আট বছর পরে কথা বলার কথা নয়, কিন্তু বলতে হচ্ছে।
বাংলা ভাষার প্রচলন এর প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেছে ১৭ বছর আগে ,১৯৫২ সালে। এরপর ভাষার লড়াই জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই পর্যন্ত এগিয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার আট বছর পরও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে, উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে বাংলা ভাষা প্রচলন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। যারা ১৯৫২ সাল থেকেই স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, জাতীয় অস্তিত্বের সংগ্রামের শত্রুতা করে এসেছে -৭১ সালের যুদ্ধ ছিল তাদেরই বিরুদ্ধে। ৫২ সালেই নির্ধারিত হয়েছে দেশের শত্রু কারা।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার একটি লেখা ৭৪ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘একটি জাতির জন্ম।’লেখার শুরু ছিল এইরূপঃ পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্নাহ যে দিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা – আমার মতে ঠিক সেদিনই বাঙালি হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতির।’…………
৭১ সালে জনগণ পাকিস্তানি মতবাদকে পরাজিত করে যুদ্ধে। কিন্তু তারপরও রয়ে গেছে জনগণের উপর শোষণ – ভাষাগত শোষণ। বিদেশী ভাষা দিয়ে পদদলিত করা হয়েছে সে ভাষার অজ্ঞ জনগণকে।
মন্ত্রী ভালো বাংলা জানেন না বলে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিচিত্রার প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছিলেন। আর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাকে বলেছিলেন উচ্ছিষ্ট ভাষা। এ দুজনকে মন্ত্রী কিংবা অফিসার বললেই বক্তব্য সঠিক হবে না। এরা হচ্ছে অনেক মন্ত্রী রাজনীতিক কিংবা সরকারি সরকারি কর্মচারীর প্রতীক। এ দুটি চরিত্রের মধ্য দিয়েই বিশেষণ সম্ভব একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বাঙালি চরিত্র। এধরনের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কর্মচারীদের চরিত্র একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার বছরের বাঙালি চরিত্রের মধ্যে এর শিকড় প্রোথিত। দেশ প্রেমিক বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি – বাংলাদেশের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে দালাল শক্তি সবসময় ষড়যন্ত্র করে এসেছে। ১৯৫২ থেকে এর স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এরা সব সময় ছিল বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। কিন্তু বিরোধিতা, এই স্পষ্ট প্রতিক্রিয়াশীলতা সত্বেও তারা এখনো টিকে আছে, পারছে বর্তমান কাঠামোগত চরিত্রের জন্যই।
হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, রক্তপাত, সংঘর্ষের ইতিহাস । তারা বহু রক্ত ঢেলেছে কিন্তু সে পরিমাণে তার মূল্য পায়নি। কেন পায়নি? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা। জনগণ জানে বিদেশি দালালরা এ সাহস কোত্থেকে পায়! এদের ইন্ধন যোগায় কারা। বাঙালির ভেতরে সব সময় একশ্রেণীর বিশ্বাসঘাতকের জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে রাজ পরিতোষকের। আর এরাই বারবার নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিকিয়ে দিয়েছে জাতীয় স্বার্থ। নিজেদের মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে পরিণত হয়েছে দাসে। এরাই দাম সংস্কৃতির বাহক, চাকর সংস্কৃতির প্রচারক। বাঙালি জাতির যাত্রা থেকেই শুরু হয়েছে এদের বিশ্বাসঘাতকতা। এরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বাংলা ভাষার বিকাশের পথেও।
সেন রাজাদের আমলে রাজভাষা ছিল সংস্কৃতি ধর্মী ভাষা ও সংস্কৃতি। মুসলমান আমলের রাজভাষা ছিল পার্সি ধর্মীয় ভাষা আরবি। ইংরেজ আমলের রাজভাষা ছিল ইংরেজি। পাকিস্তান আমলের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আট বছর পর অফিস-আদালতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা হিসেবে সদর্পে বিরাজ করছে ইংরেজি। বাংলা ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও কয়েকবার নির্দেশ জারি করেছেন। রাষ্ট্রপতির নির্দেশও জারি হয়েছে। নির্দেশ – নির্দেশই রয়ে গেছে। কাজে রূপান্তরিত হয় নি। কিন্তু কেন ? এর জবাব প্রয়োজন। জনগণ এ প্রশ্নের জবাব জানতে চায় তাদের কাছে, যারা শাসক, আমলা কিংবা সংস্কৃতির বাহক। মীর জাফরকে বলা হতো ক্লাইভের বুড়ো গাধা। সেই ক্লাইভের বুড়ো গাধা কত ডজন বাচ্চা প্রসব করেছে এদেশে?
বিভিন্ন মত
বাংলা চালু করবার চেষ্টা করে শিক্ষার মান নামিয়ে দেয়া হয়েছে এরকম একটি অভিযোগ ‘বিজ্ঞ’ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ করে থাকেন। এ ধরনের একটি যুক্তি কতটা অর্থহীন তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে তাদের কাছে স্পষ্ট। একটি জাতির সামগ্রিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। প্রতিভা বিকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। নিজস্ব ভাব প্রকাশে যখন ভিন্ন ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে আনা হয় তখন যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তার সামগ্রিক বিচারে একটি বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করে। বিদেশি প্রভুর ভাষা ইংরেজি সুতরাং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একমাত্র মাধ্যম ইংরেজি। তাদের সামনে জার্মান, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, ইতালি দেশের ইতিহাস তুচ্ছ। আরেকদিকে আছেন আমাদের দেশের প্রশাসনের খু’টি বৃহৎ আমলারা। যাদের হাত, পা, মাথা, জিব্বা বাংলার কথা শুনলেই ঘৃণায় গুটিয়ে যায় বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে এরা পরদেশী মুনিবের চাইতেও বেশি বিদেশি তাদের একটি পাবার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকেন।
এদের নিয়ন্ত্রণ জনগণের বিরুদ্ধতা, ভৃত্যসুলভ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সবসময়ই সংগ্রাম করে এসেছেনঃ কিন্তু এরা নিশ্চিহ্ন হয়নি।
বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর প্রশ্ন সমাধান না হবার কারণ হিসেবে ছদ্মবেশী এইসব মহল পরিভাষার সমস্যার কথা তোলেন, তোলেন বাংলা ভাষার দুর্বলতার কথা। পরিভাষা তখনই সমস্যা হিসেবে আসবে যখন তার প্রয়োজন খুব বেশি হবে, বাংলা ভাষার দূর্বলতার প্রশ্নও তাই। যারা এ সমস্যার কথা তোলেন তারা নিজেরাও জানেন সমস্যা এগুলো নয়, সমস্যা তারা নিজেরাই।
অফিস আদালতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয় তা থেকেই একথা প্রমাণিত।
আমাদের এখানে লোকজন লেখাপড়া করে চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাই চাকরি পাওয়া যাবে না বলে শিক্ষিত লোকেরা বাংলা শেখে না। অফিস-আদালতে এখন যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলা জানেনা বলে গর্ব বোধ করেন। তাদের অসুবিধায় পড়তে হবে অফিস-আদালতে বাংলা চালু হলে। অনেকে বলেন বাংলা ভাষা চালু করার বর্তমান সমস্যা প্রধানত তিনটি (১) বাংলা ভাষায় দখল না থাকা (২) বাংলা ভাষা চর্চায় সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ অনভ্যাস (৩) ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ বাংলা ভাষায় পাওয়া দুষ্কর। এই সমস্যার কথা বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। বাস্তবে এ সমস্যার উৎস একটিই উপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশের চাকর সাজবার মনোবৃত্তি। এদেশের শাসনকার্য চালানোর জন্য যেখানে বাংলা শিখতে বাধ্য হয়েছিল, সেখানে বাঙ্গালীদের ইংরেজি শেখার মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের দাসবৃত্তি করার চৈতন্য থেকেই। ব্রিটিশ আমলে এদেশে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধলেও প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধনি। এদেশের জনগণ কখনো ইংরেজি শিখেনি। শিখেছে মুষ্ঠিমেয় লোক। আর যারা ইংরেজি শিখেছে তাঁরাই চাকরি পেয়েছে। সেইসঙ্গে ইংরেজি শেখা বাঙ্গালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অফিস-আদালতে।
গোড়াতে ভাষা আন্দোলন ছিল শিক্ষিত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরে তা জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল । সে আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। ফলে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একমাত্র বাংলা ভাষারই স্বীকৃতি রয়েছে। তবুও অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই অ্যাকশনে শিক্ষিত মহল অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর দাবি তোলেন। আর কর্মকর্তারাও কোনরকম কার্পণ্য না করে প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু দাবিও পূরণ হয়না নির্দেশও মানা হয়না।
রাষ্ট্রভাষা চালু সম্পর্কে দুটি বিরোধী মন্তব্য রয়েছে। একটি দল মনে করছে সরকার ও আমলারা ইচ্ছে করলে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। আরেকটি দল মনে করছে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু সম্ভব নয়। প্রথম দলের যুক্তিঃ সরকার হয়েছে একটি দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক। অফিস-আদালতে বাংলা চালুর ব্যাপারে যেহেতু জনগণের সম্মতি রয়েছে সেহেতু অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে সরকারের পক্ষে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে আমলারা হয়তো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু সরাসরি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার সাহস পাবে না। যদি তারা সরাসরি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তবে তা জনগণই রুখবে।
দ্বিতীয় দলের যুক্তিঃ হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি অর্থনীতি। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামোরও পরিবর্তন হয়। অবকাঠামোর মধ্যে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে সমাজের অর্থনীতি, চিন্তা ও আদর্শের প্রতিক্রিয়াশীলদের আদর্শই রক্ষিত হয় সে সমাজে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে কোন ভাষা চালু রয়েছে এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে আগে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এলে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর জন্য আর স্লোগান তুলবার দরকার হবে না। যে দেশের শতকরা ৮০ জন লোক নিরক্ষর সেখানে অফিস-আদালতে কি ভাষা চালু আছে , এটা তারা জানেনা। জানার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। নিরক্ষর জনগণের সমস্যা এখানেই আনুষ্ঠানিক বাংলা প্রচলন নয়। প্রধান সমস্যা গন শিক্ষার অভাব।
মূলতঃ দ্বিতীয় দলের মতামতই বেশি বস্তুনিষ্ঠ। তাদের মতামতের যুক্তিকতা স্বাধীনতার আট বছর অতিবাহিত হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। একটি শ্রেণী সবসময় উচ্চকণ্ঠে প্রচার করে থাকেন ভাষার সমস্যার কথা। কিন্তু এ সমস্যা কেবল বাংলা ভাষাতেই নয় পৃথিবীর যেকোন ভাষাকে কোন সমস্যা রয়েছে। ইংরেজি ভাষাতেও বানান -উচ্চারণের সমস্যা রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ পরিবর্তিত হয়। সেই সঙ্গে পরিবর্তন লাভ করে ভাষাও।
জনগণ যে ভাষা বোঝে, সে ভাষাই হওয়া উচিত অফিস-আদালতের ভাষা। তা ইংরেজিই হোক আর বাংলাই হোক। প্রত্যেক ভাষাতে প্রচুর বিদেশি ভাষার ব্যবহার রয়েছে। অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করা ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজিতেও এমন বহু শব্দ রয়েছে, যা ল্যাটিন, গ্ৰীস কিংবা জার্মান ভাষা থেকে ধার করা। অনেক ভাষাতাত্ত্বিকের অভিমত, গত ৫০ বছরে ইংরেজিতে অন্য ভাষা থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার শব্দ ঢুকে পড়েছে। অথচ চেয়ার এর বাংলা শব্দ কেদারা না অন্য কিছু হবে এ নিয়ে বিতর্ক চলে আমাদের সমাজে। এধরনের বিতর্কে একশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দ্বারাই সৃষ্টি। যেকোনো ভাষার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার মূলে রয়েছে, সে ভাষার গ্রহণ ক্ষমতাই। বাংলা ভাষা যে এত সমৃদ্ধ, এর মূলে রয়েছে সংস্কৃত ও বিদেশি শব্দকে এ ভাষা সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। ভাষার বিবর্তন ও বিকাশের মূলে রয়েছে একটি সমাজ, ব্যক্তি নয়। ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আমরা ভাষাকে যতই পরিবর্তন করতে চাই না কেন, তা সম্ভব নয়। স্কুলের বাংলা বিদ্যালয় না অন্য কিছু হবে এ নিয়ে সাধারন মানুষ কখনো মাথা ঘামায় না। এধরনের বিতর্কে সূত্রপাত করে একশ্রেণীর শিক্ষিত লোকই। তারা এই বিতর্ক সূত্রপাত করে বাংলা ভাষা প্রচলন সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। অফিস-আদালতে, শিক্ষালয়ে যে সমস্ত ইংরেজি শব্দ বা অন্য কোন শব্দ প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য, সে শব্দের পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা আমাদের সামাজিক সমস্যাকেই বাড়িয়ে তুলবে। পরিভাষার সমস্যার কথা পাকিস্তান আমলেও তোলা হয়েছে। এখনো তোলা হচ্ছে। কিন্তু তার কি সমস্যা হয়েছে? আমরা যে শব্দ, প্রতিদিন ব্যবহার করি তা-ই আমাদের পরিভাষা।
শিক্ষাক্ষেত্র বাংলা ভাষা প্রচলন করা এখনো সম্ভব হয়নি। অজুহাতে একটিই বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব। যারা এ ধরনের অজুহাত তোলেন, তাদের কাছে আমাদের একটি বক্তব্য, আগে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা শুরু হলেই বই পুস্তক রচনা অনুবাদ শুরু হবে। আর যারা অভিযোগ করেন তাদেরই তো দায়িত্ব এ সমস্যা সমাধানের। বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় পরিভাষা নেই, পুস্তক নেই – এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য বক্তব্যের অবসান হোক এটাই চায় সাধারণ মানুষ।
কিছুদিন আগে বিচিত্রায় গবেষণা ও গবেষক ৬৯ জন গবেষক-শিক্ষকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য – গবেষণা বাংলা ,না ইংরেজি ভাষায় হওয়া উচিত – এ সম্পর্কে মতামত সংগ্রহ করা। এর মধ্যে মাত্র আটজন বাংলা ভাষার পক্ষে সরাসরি মন্তব্য করেছেন। তাদের পাঁচজন আবার বাংলা ভাষার শিক্ষক। ইংরেজি গবেষণা হওয়া উচিত -এ মন্তব্যের স্বপক্ষে তাদের যুক্তি হলো জ্ঞান বিনিময়ের জন্য ইংরেজি ভাষাই ভালো মাধ্যম। কারণ ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এ ধরনের হাস্যকর মন্তব্যেরই জবাব রয়েছে আরেকজন গবেষকের উত্তরেই। বাংলা গবেষণা হওয়া উচিত। এর সপক্ষে তার মন্তব্য হলোঃ গবেষণা প্রকাশনা বাংলা ভাষায় হওয়া উচিত কি না এ ধরনের প্রশ্ন কে আমি অবান্তর মনে করি এবং সেইসঙ্গে দুঃখজনকও। বিদেশি পোনা মনোভাব আর কতদিন থাকবে আমাদের? আসলে আমরা দুর্বল বলে ধরনের প্রশ্ন তুলি। কোন সভ্য জাতি এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয় না । কথা হয়, বাঙালি চতুর জাতি, কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যন্ত পদানত থেকেছে কেন? আমার তো মনে হয়, বাঙ্গালী তার মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেখতে পায়নি বলে অন্যদের তুলনায় ইনফিরিয়র ভেবেছে এবং অপরের গোলামী করছে। যদি আত্মপ্রকাশের ভাষা পেত রাষ্ট্রীয় জীবন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তবে তার জাতীয় চরিত্রে হীনমন্যতাবোধ জাগতো না। আর্য, তুর্,ক মোঘল, ইংরেজদের কাছে বাঙালির পরাজয় কেবল শক্তির পরাজয় না ধর্ম সংস্কৃতিও পরাজয়। তারা এসেছে উন্নততর ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে । সেখানে বাঙালি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে পারেনি। পরের ভাষা রপ্ত করতে করতে বাঙালির জীবন গেছে। নিজের ভাষার কণ্ঠ চেপে রেখে বাঙালি তার আত্মাটাকে কর্মরত, শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছে। সেই হীনমন্যতাবোধ সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হোক শুধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এটাই আমার কাম্য। গবেষণা কেন সব কাজেই বাংলা হবে বাংলার সব শ্রেণীর মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্য। যদি আমাদের কাজে কর্মের মূল্য থাকে তবে যারা প্রয়োজন মনে করবে তারাই তাদের ভাষার অনুবাদ করে নেবে। আমাদের মাথা ব্যথার কারণ নেই।
শিক্ষার দুই বিরোধ্য মান
দৈনিক পত্রিকার যেকোনো দিন এর বিজ্ঞাপনের পাতার দিকে দৃষ্টি দিলে স্কুলের ব্যবসার ক্রমবর্ধমান পরিধি আজ করা যাবে। স্কুলের ব্যবসা করা হচ্ছে কিন্ডার গার্ডেন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কোন কোন স্কুলের বেতন মাসিক চারশো টাকা পর্যন্ত, এরও বেশি মাসিক বেতনের স্কুলও আছে বলে জানা গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব স্কুলের প্রধান ভাষা ইংরেজি অথবা আরবি। শাসকশ্রেণীর ভিন্নতা বজায় রাখার জন্যই ভাষা ক্ষেত্রেও এই ভিন্নতা রাখা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যাতে আরও সুযোগ তৈরি হয় সেজন্য বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন এর ছড়াছড়ি। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সেখানে অন্যান্যদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
দেশের জনগণকে বিদেশি মূল্যবোধের দাম বাড়ানোর জন্য শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে চালু
—————————————
রয়েছে দুই বিরোধী মানদন্ড। বর্তমানে দেশে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চালু রয়েছে কিন্ডারগার্টেন ও এই ধরণের কিছু স্কুল। এ ধরনের অধিকাংশ স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হয়। এসমস্ত স্কুলগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় শহরের কিছু বিত্তশালী লোক। এ ধরনের স্কুলে একজন ছাত্রের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য প্রতি মাসে যে টাকা ব্যয় হয়, তা কমপক্ষে একজন কেরানির বেতনের সমান। এখানে যেহেতু বিত্তশালী লোকদের ছেলেপেলেরা লেখাপড়া শিখছে, সে কারণেই তাদের সুযোগ সুবিধাও বেশি। এ সমস্ত স্কুলের গুরুত্বসহকারে ইংরেজি পড়ানো হয় । যে দেশের শতকরা ৬০ জনেরও বেশি কৃষক ভূমিহীন, বাকি ৪০ জনের সামান্য জমি রয়েছে, সে দেশে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখার অর্থ –নিতান্তই আপত্তিকর। মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের সুবিধার জন্য জাতীয় জীবনের সৃষ্টির করে রাখা হচ্ছে ইংরেজি-বাংলা সমস্যাকে। এদের ভাবখানা যেমন এ–রকম দেশের শতকরা ৮০ জন লোক নিরক্ষর থাকলে ক্ষতি নেই, শতকরা ৪-৫ জন শুদ্ধ ইংরেজি জানলেই হল। ব্রিটিশ মূল্যবোধের শিকড় কত গভীর পর্যন্ত আজও ছড়িয়ে রয়েছে এটা তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদ তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন ও এ ধরনের বিশেষ স্কুল উঠিয়ে দেয়ার সুপারিশ করলেও, এ ধরনের স্কুলের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে রেখেছে বিরাট প্রাচীর। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রচলিত রয়েছে বাংলা – ইংরেজিএ দুই মিডিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা। একশ্রেণীর লোক সব সময়ই এই দুই বিরোধী শিক্ষার মানদন্ডকেই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এ প্রতিক্রিয়াশীলরা নানা অজুহাত তুলে শিক্ষাব্যবস্থার বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে তুলে রেখেছেন বিরাট প্রাচীর। এ ধরনের দালাল গবেষক-শিক্ষকরাই এদেশের কৃষক শ্রমিকের ঘাম রক্তে অর্জিত সম্পদ ব্যয় করে শিক্ষা গ্রহণ করছে। আর এরা নিজেদের মেধা ও মনীষার সারবান অংশটুকু ব্যয় করছেন বিদেশিদের সেবায়। চাকরবৃত্তি করে । এটা তারা প্রকাশ্যে করছে। এবং তা নির্লজ্জ ভাবে প্রকাশ করছে জনসমক্ষে। এভাবে অনুৎপাদক পরিশ্রম জীবিরা আত্মসাৎ করছে শ্রমজীবীদের পরিশ্রম। এ অবস্থায় সমাজে যত দিন চলতে থাকবে ততদিন এ দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে না। হয়েও লাভ নেই। যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে উপনিবেশিক মূল্যবোধের শিকড়, বিদেশি চাকর সাজবার মনোবৃত্তি, সে সমাজকে প্রচলিত মূল্যবোধ থেকে মুক্ত না করতে পারলে, কি লাভ বাংলা প্রচলনে? আগে মূল কাঠামো বদলাতে হবে। তারপর প্রশ্ন আসে ওপর কাঠামো বদলানোর। সরকারের ইচ্ছে থাকা সত্বেও বাংলা প্রচলন কেন সম্ভব হচ্ছে না?–এ প্রশ্নের উত্তর এখানেই। ইংরেজি বানান ভুল করলে শিক্ষিত লোকদের আর লজ্জার সীমা থাকে না। অথচ বাংলা বানান ভুল করার পরও এক শ্রেণীর লোক গর্ব করে বলে থাকেন ভালো বাংলা জানিনা । ভণ্ডামিরও একটা সীমা থাকা উচিত।
দাসখত
ব্রিটিশ শাসনামলে ‘আইবেক’ বলে যে দরখাস্তের শুরু করা হতো শেষ করা হতো ‘অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ বলে। আজও আমাদের সমাজে দরখাস্ত লেখার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। জনগণ সরকারি কর্মচারীর কাছে দরখাস্ত লিখলে, শেষ করতে হয় ফেইথফুল সার্ভেন্ট বলে। কে চাকর, আর কাকে চাকর বানানোর চেষ্টা। অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গণজীবনের বিবর্তন ঘটে। যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণকে চাকর হতে শেখায়, সে শাসন ব্যবস্থা কি ধরনের শাসন ব্যবস্থার, যে কেউ বুঝতে পারে। তবু তাই চলছে। যে বিদেশীরা এদেশের জনগণকে দাস বানাতে চেয়েছিল তাদের দেশে এ ধরনের রীতি প্রচলিত নেই। অথচ আমাদের আমলারা, রাজকর্মচারীরা তাই চাচ্ছেন? এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশিদের সংস্কৃতির চাকর হিসেবে কাজ করা। কারণ জনগণকে চাকর না বানাতে পারলে তাদের ক্ষমতা থাকেনা । ক্ষমতা চলে যায় জনগণের হাতে।
অনুৎপাদক শ্রেণি যে দেশের শাসক, সে দেশে কখনো জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের শোষনের উপর যারা গড়ে তুলেছে শাসনের আসেন তারা সমাজের ভেতর থেকে নির্যাসটুকু ফোঁপরা করে দিয়েছে মূল্যবোধ। এ মূল্যবোধের ধারক, বাহক, রক্ষক, উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন এক শ্রেণীর দালাল, রাজনীতিক, আমলা, বুদ্ধিজীবী। এরা সংখ্যায় নগণ্য, তবু শক্তিশালী। কারণ তাদের শাসনের আসনটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। এরাই প্রচলিত সমাজ থেকে সুবিধা ভোগ করছে। প্রচলিত সমাজ থেকে যারা সুবিধা ভোগ করছে, তারাই টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে ঘুনে ধরা সমাজকে। সমাজের ভিতরে বিদেশি মূল্যবোধকে, দালাল বৃত্তিকে টিকিয়ে রাখবার জন্য প্রয়োজন বিদেশী ভাষা সংস্কৃতি। এক শ্রেণীর দালাল কাজ করছে এই সংস্কৃতির চাকর হিসেবে। তাদের জন্য এটা প্রয়োজন সমাজের বিভক্তি বজায় রাখার জন্যেই। এ চাকরদের জনগণ হাজারবছরধরে চিনে আসছে।
বিদেশী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বাহক এ চাকরেরা চায়না জনগণ সচেতন হোক। কারণ, জনগণ সচেতন হলে তাদের চাকরবৃত্তির মূল উৎস কোথায় ধরা পড়ে যাবে। এরা জনগণ থেকে চাকর বৃত্তি পরিচালনা করে যাচ্ছে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে। জনগণ তাদের সঙ্গে রয়েছে একটি বিরাট গ্যাপ। এই গ্যাপ তারা ইচ্ছে করেই রেখেছে। কারণ জনগণের কাছে এলেই তারা ধরা পড়ে যাবে। ধরা পড়ে যাবে এরা উৎপাদক শ্রেণী নন, তবু উৎপাদক শ্রেণীকেই শোষণ করে বেড়ে উঠছে পরজীবীর মত। জনগণের সঙ্গে তাদের ভাষার যে প্রভেদ এ কারণেই। এ ব্যবধানকে তারা সৃষ্টি করে চলেছে শিক্ষাব্যবস্থার শুরু থেকেই। এ ব্যবধানের স্বরূপ স্পষ্ট। গত এক যুগেরও বেশি সময় শতকরা গ্রামীণ শিক্ষার হার বেড়েছে শতকরা ১৫.১ থেকে হয়েছে ১৮.৫ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর একভাগও বাড়েনি। যে হারে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েছে, সে হারে সচেতনতা বাড়েনি। কারণ এ শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্ক নেই।
এদেশে ইংরেজরাও বাংলা শিক্ষার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কারণ তারা জানত এদেশের জনগণকে শাসন ও শোষণ করার জন্য, এদেশের শিক্ষা গ্রহণ করতেই হবে। ঔপনিবেশিক শাসন কার্য চালিয়ে যাবার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তারা শুধু ততটুকই শিখেছিল। কারণ বাঙালির ভেতরে তারা তৈরি করেছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একদল লোক যারা ব্রিটিশদের সাহায্য করত শাসন-শোষণ কার্য চালিয়ে যাবার জন্য। প্রায় ১ শত ৯০ বছর ধরে ব্রিটিশ সরকার যে স্তাবক দল তৈরি করেছিল তা সহজে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন। অর্থ সমাজের মূল ভিত্তি । অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন না হলে কখনো মূল্যবোধের পরিবর্তন সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক পরিবর্তনই সূচনা করে অবকাঠামো মূলক পরিবর্তনের। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন আসেনি সমাজ ও সামাজিক মুল্যবোধের। কেন আসেনি! এর পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
প্রাসঙ্গিক পটভূমি
সহস্রাধিক বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে চলেছে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও ইতিহাস। ঐতিহ্য ইতিহাস এর নির্মাতা যে সাধারণ মানুষ তারা যুগযুগ ধরে অবহেলা পেয়ে এসেছে। অবহেলা করেছে একশ্রেণীর উচু তলার মানুষ। প্রাচীনকালে বাঙালির আত্মপরিচয় ধরা পড়েছে অবলুপ্তপ্রায় বইয়ের পাতায় পাতায়। অবিশ্বাস্য অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাংলার মঠ-মন্দির; মূর্তি, রাজপ্রাসাদ। আর এরা এখন হয়েছে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার বিষয়। কিন্তু বাঙালির শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস চিরকালই রয়েছে অমর।
বাংলাদেশের জন্ম তত্ত্ব নিয়ে যারা গবেষণা করেন, যারা জনতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক কিংবা সমাজতাত্ত্বিক তাদের মতে বাঙালি সংকর জাতি। বাঙালি জাতির কেবল জৈব সমন্বয়ে নয় জীবিকার তাগিদেই বাঙালি জাতির ভেতর সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন পেশার লোক। মূলতঃ এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে প্রাচীন বাংলার শ্রেণিবিভক্তি। একদিকে বর্ণভেদ আর অন্যদিকে পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ বাঙালি জাতিকে করে রেখেছে বিভক্ত। উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীরা দ্রাবিড়ভাষী কৃষক ওশিকারীকে বলতো দস্যু । তাদের ভাষাকে বলা হতো অসুর ভাষা। আর এভাবেই সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায়কে আলাদা করে রেখেছো উপর তলার মানুষ। বাঙ্গলীর বর্ণ আর বৃত্তি চেতনা তাকে টেনে রেখেছে পেছনের দিকে । বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ভেতরে যে ভারতীয় আর্যভাষীরা দ্রাবিড়ভাষী কৃষকও শিকারীকে বলতো শ্রেণীবিভক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে এক বিদেশি শক্তি। তারা বারবার হানাদার হয়ে উঠছে বাংলাদেশে। বাঙালি জাতিকে পরিণত করতে চেয়েছে দাস কিংবা অনুগত চাকরে। বাঙালি জাতির প্রতি বিদেশিদের এ ঘৃণা একদিনে জন্ম লাভ করেনি। একশ্রেণীর লোকের মধ্যে চেতনা ও মূল্যবোধের বিদেশিদের দাস হবার বাসনা যেভাবে হাজার বছর ধরে শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে, তা আজও আমাদের পক্ষে উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। প্রাচীনকালের দাস আজ পরিণত হয়েছে আমলাতে। এদেশে যে আর্যরা বর্ণ চেতনার সৃষ্টি করেছিল, সে বর্ণ চেতনায় নতুন করে জন্ম দিয়েছিল আমলাতন্ত্রের। এদেশে আর্যরা এলে তাদের বংশধর কর্তৃক কপালে এঁকে দেয়া হয় কলঙ্কতিলক। আর ব্রিটিশরা বাঙালি কে বলতো কালো কুকুর। এ ঘৃণানা আত্মসচেতন বাঙালির মনে বিদ্রোহের জন্ম দিলেও এক শ্রেণীর ভৃত্য এঁকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রাজভাষা কিংবা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি । ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলেও তাকে কার্যে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। প্রাচীনকালে নানারকম শ্রেণীর সংঘাত, বিদ্রোহ ও যুদ্ধ বাংলাদেশের সীমানাকে বদলে দিলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সীমারেখা বদলায়নি। বাংলার সাধারণ মানুষ কখনো মুখের ভাষাকে বিসর্জন দেয় নি। স্বদেশের ঠাকুর ফেলে কেউ হয়তো বিদেশি কুকুরকে পূজা করেছে এটা হয়তো তাদের স্বভাবেরই অন্তর্গত। বাঙালি জাতি মূলতঃ আত্মসচেতন। তাদের আত্মসচেতনতার পরিচয় রয়েছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তাদের সংগ্রামে।
ক। রাজভাষা সংস্কৃতি
প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজ-রাজাদের রাজভাষা ছিল সংস্কৃতি। সংস্কৃত কখনো কথ্য ভাষা ছিল কিনা এ নিয়ে পন্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে প্রচুর। প্রাচীন বাঙালি সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য ছিল সর্বভারতীয় ধর্ম ও দর্শন। সংস্কৃতির উচ্চকোটি চিন্তায় আচারে নিয়মে বাঙালির অধিকার ছিল না। তবু বাংলার জনক শ্রেণীর ভাবে-কল্পনায় জীবনাচরণে- আদর্শে নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে ধরে রেখেছিল। এর বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে পরবর্তীকালে লোকসংস্কৃতির মধ্যে রূপকথায়, ব্রত কথায়, ছড়ায়, কাব্যে, প্রবাদে , বচনে। আর এগুলো ছিল অনার্য বাঙালির নিজস্ব জিনিস। আদিবাসী বাঙালিরা ছিল মূলতঃ কৃষক। আর কৃষি উৎপাদনের প্রধান অংশ ব্যয় হতো রাজপুরুষ, রাজসেবক ব্রাহ্মণ, বৌধৃ, জৈন, গুরুদের সেবায়।
এই বন্টন বৈষম্যকে কেন্দ্র করেই মাঝে মাঝে বেঁধেছিল সংঘর্ষ। এ সময় থেকে বাঙালি কৃষিজীবী মানুষের ভেতর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে একটি বণিক শ্রেণি। মঙ্গলকাব্যে তাদেরকেই বলা হয়েছে বেনে। আর মধ্যযুগের বাংলায় এরাই পরিচিত হলো সওদাগর হিসেবে। এভাবেই বাঙালিকে বারবার বঞ্চিত করা হয়েছে। বারবার তাদের উপরে হানাদার হয়ে উঠেছে একটি অনুৎপাদক শ্রেণি। হিন্দু সেন রাজাদের কাছে বাঙালি কৃষক শ্রেণী যেমন অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, তেমন অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল বেনেরাও। আর এ কারণেই বাঙালি বণিক শ্রেণি উৎপাদক শক্তিরূপে বিকাশ লাভ করতে পারেনি।
সে সময় সংস্কৃতি ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাহন, রাজভাষা। বাংলা ভাষা চর্চা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ভাষায় কথা বললে ব্রাহ্মণদের কাছে হয়ে যেত অস্পৃশ্য। সেন রাজাদের পরেই এদেশে তুর্কিদের প্রভাব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এ যুগে বাঙালিরা বৈদেশিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে,’ এই নতুন সংস্কৃতির বাহন ছিল পারসী’।
খ। রাজভাষা পারসী
প্রাচীনকালে পাল আর সেন রাজারা ছিল বাঙালির শাসক, সংস্কৃতির ধারক বাহক। মধ্যযুগের ধর্ম-বর্ণ চেতনার কারণে সমাজ ছিল সম্পূর্ণ শ্রেণীবিভক্ত। এরমধ্যে বাঙালিরা ছিল সবচেয়ে অস্পৃশ্য।এ সময়ে সংস্কৃতি ভাষার প্রভাব কাটিয়ে বাংলা ভাষা তেমনভাবে বিকাশের পথ খুঁজে পায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগ ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনির্ভর। ধর্মনির্ভর সামন্তযুগ পর্যন্ত রাজার ধর্ম ছিল প্রজার ধর্ম। সাধারণ মানুষের ভূমিতে নিজস্ব অধিকার ছিলনা। অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সেন রাজাদের বিরুদ্ধে। আল সেপথ ধরেই তুর্কিরা বাংলা আক্রমণ করে এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০১ সালে বাংলার তৎকালীন রাজধানী নবদ্বীপ দখল করে নেন। কিন্তু সমস্ত বাংলা মুসলমানদের অধিকারে আসতে আরো একশত বছর লেগে যায়। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সমস্ত বাংলা একছত্র অধিপতি হন। মুসলমান ধর্মে বর্ণ চেতনার প্রভাব না থাকায় দলে দলে সাধারণ মানুষ এ ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। সুফি, ফকির দরবেশ দলে দলে নব বিজিত ভূমিতে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। এসময়ই বাংলা ভাষার ভেতরে আরবি,ফারসি ও তুর্কি শব্দ ঢুকে পড়ে।
১২০১সাল থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত এদেশের মুসলমানরাই রাজত্ব করেন। যদিও এর মধ্যে একবার ১৪১৮ সালের দিকে কনস নামে একজন হিন্দু রাজা রাজ্য লাভ করেন। এই রাজার ছেলে যদু আবার মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে জালাল উদ্দিন নামে রাজত্ব করেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এর সময়কাল ছিল আনুমানিক ১৪১৮ থেকে ১৪৩১ পর্যন্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্রমশঃ ইলিয়াস শাহী বংশই বাঙালির রাজা হয়ে ওঠেন। এবার ক্রমশঃ ক্ষমতায় আসেন হুসেন শাহ, নুসরত শাহ। হুসেন শাহী রাজাদের সহযোগিতায় বাংলা ভাষা খুঁজে পেল একটি নতুন শক্তি। এই শক্তি আফগানী এবং মুঘল আমলেও অব্যাহত ছিল। মুঘল আমলের পরে এলো ইংরেজ আমল। হুসেন শাহের আমলেই পর্তুগিজরা প্রথম বাংলাদেশে এলো। একসময় পর্তুগিজ ভাষা ইংরেজি ভাষার মতোই এ দেশে প্রচলিত ছিল।
মুসলমান বাদশারা কখনোই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয় নি। আরবি ফারসি ভাষা ছিল রাজ কার্যের বাহন। বাংলা ভাষায় সাধারণ মানুষের কথা বলার অধিকার থাকলেও জীবিকা অর্জনের জন্য এ ভাষা কোন কাজে আসেনি। তাই শিক্ষিত লোকেরা বাংলা ভাষায় শিক্ষালাভ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। রাজকার্যে যে ভাষার প্রয়োজন নেই, সে ভাষায় শিক্ষা লাভ করে কি লাভ -এই ছিল সাধারণ শিক্ষিত যেকোনো লোকেরই ধারণা। বাংলা ভাষা রাজ ভাষার মর্যাদা পায়নি, কারণ বাংলাদেশের রাজা-বাদশা যারা ছিল, তারা কেউ কেউ নামে বাঙালি হলেও বাস্তবে ছিল না। এমনকি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলে যাকে ইতিহাসে চিহ্নিত করা হয়, সে সিরাজউদ্দৌলাও বাঙালি ছিলেন না। ছিলেন নবাব। এর এটাই ছিল বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী মনোভঙ্গি বিকাশের বড় বাধা। বাঙালি জাতির শাসক হয়নি, শাসিত হয়েছে। শোষক হয়নি, শোষিত হয়েছে। আর সেইসঙ্গে বিদেশী শাসক-শোষকরা সৃষ্টি করে গিয়েছে স্তাবক দল , চাকর সংস্কৃতি, প্রভুভক্ত কুকুরের মত কিছু অনুচর।
গ। রাজ ভাষা ইংরেজী
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা গদ্যের লিখিত কোনরূপ ছিলনা। কবিতা ছিল সাহিত্যের বাহক। আধুনিক যুগে সূচিত হলো বাংলা গদ্যের লিখিত রূপ। মধ্যযুগের সাহিত্য মাত্রই ছিল রাজ বন্দনা। আর রাজারাই ছিল শোষক ও শাসক। ১৭৫৭ সালে নবাবী শাসনের অবসান হলো। এলো ইংরেজরা। ১৭৫৭ সালের ২৯জুন ক্লাইভের নির্দেশে মীরজাফর বসলেন মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে। মীর জাফরকে সাধারণ লোক বলতো ক্লাইভের বুড়ো গাধা। একদিকে ইংরেজি বণিক আর অন্যদিকে নবাবী শাসনের লোভ-লালসা বিশ্বাসঘাতকতা বাংলার সাধারন মানুষকে জর্জরিত করে ফেললো। ১৭৬৫ সালে দিল্লির বাদশাহ এর কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করে ক্লাইভ বাংলার সাধারন মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় -এই দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলাদেশে নেমে এলো দুর্ভিক্ষের করার ছায়া। ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল চরম আকারে। তবু ইংরেজদের দেওয়ানী আদায় বন্ধ হল না, বরং এক ধাপ বাড়লো। সাধারণ কৃষক তো বটেই, দেশের বিত্তবান এবং জমিদারও এর শিকার হলো। প্রায় এক কোটি লোক মারা গেল এই দুর্ভিক্ষে। এ দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বাঙালির মনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬) নামে বেঁচে আছে।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার কৃষক সমাজ হয়ে পরলো সম্পুর্ন ছিন্নমূল। মধ্যবিত্ত সমাজেও লাগলো এর প্রচন্ড আঘাত। দিল্লিস্বরও মারাঠাদের আঘাতে পর্যুদস্ত।
ইংরেজ রাজত্বের ভিত্তি গড়ে উঠতে লেগেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। ইংরেজরা শুধু বাঙালিকে শোষণই করেনি, সেইসঙ্গে গ্রামীণ শিক্ষার উপরও হেনেছিল চরম আঘাত। সেসময় একশ্রেণীর জমিদার টোল-মকতব ইত্যাদি শিক্ষালয় চালু রেখেছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল।
বাংলা শিখে কোন চাকরি পাওয়া যেত না বলে কেউ বাংলা শিখত না। কিছু সংখ্যক লোক ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে কাজকারবার চালাবার জন্য চাকরি করার বাসনা নিয়ে ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ করলেন।
এসময় ইংরেজরাই হয়েছিল বাংলাদেশের শাসক। কাজেই ইংরেজি ভাষা শেখা বাঙ্গালীদের জন্য অনিবার্য হয়ে দেখা দিল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়, ফিরিঙ্গি, আরমানীয় ব্যক্তি নিজেদের আস্তানায় খুলে বসলেন শিক্ষালয় । অনেক বাঙালির কাছ থেকে আদায় করতে লাগলেন টাকা-পয়সা। কিছু সংখ্যক ইংরেজ মনোযোগ দিলেন বাংলা ইংরেজি ওয়ার্ড বুক রচনায়। মাতৃভাষা যখন জীবিকার প্রয়োজনে না লাগে, তখন বিদেশী ভাষা শেখা ছাড়া আর উপায় বা কোথায় বাঙালির। ফস্টাস সাহেবের খেলা ইংরেজি ওয়ার্ড বুক ‘ভোকাবুলারি’ বহুদিন বাংলা অভিধানের চাহিদা মিটিয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষার পদ্ধতি বাঙালির সুযোগ পেল আধুনিক দর্শন ও মূল্যবোধকে জানবার। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে পারেনি বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ। তা সাধারণ মানুষের কোন উপকারে আসেনি।
একশ্রেণীর পর্তুগিজ পন্ডিতেরা এদেশে এসে বাংলা চর্চা শুরু করেন। বাংলা শেখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার করা। অষ্টাদশ শতকে কয়েকজন ইংরেজি মিশনারিও বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের সচেষ্ট হন। সম্ভবতঃ এদের মধ্যে উইলিয়াম কেরি ও টমাস নামে দুজন ব্যক্তি এদেশে এ উদ্দেশ্যে প্রথম আসেন। এদের সঙ্গে পরে যোগ দিয়েছিলেন অন্যান্য মিশনারি। এদের মধ্যে ওয়ার্ড বার্ণডন্ মার্শম্যান প্রধান। এরাই প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীরামপুর মিশনারি (১৮০০)। এরা প্রথম বিদেশী ভাষায় লেখা বাইবেলকে দেশীয় ভাষায় অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং বাইবেল অনুবাদে হাত দেন। ভারতের নানা ভাষায় এর অনুবাদ বিনামূল্যে বিতরণ করেন ১৮০০ সালে ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পূর্ণ এবং নিউ টেস্টামেন্ট খানিকটা অনূদিত হয়ে ছাপা হয়। তারপর ১৮০৯ সালে সমগ্র বাইবেল ‘ধর্মপুস্তক’ নামে বাংলা ছাপা হয়। এভাবে খ্রিস্টান মিশনারীরাই মূলতঃ এদেশে গদ্য চর্চার সূত্রপাত করেন উদ্দেশ্য -ধর্মপ্রচার ও সাম্রাজ্য বিস্তার।
এদেশে ইংরেজরা বাংলা চর্চা শুরু করেন শোষণের কৌশল হিসেবে। লর্ড ওয়েলেসলি ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে এসে দেখলেন ইংরেজি সিভিলিয়ান কর্মচারীরা এদেশের জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে শাসনকার্য চালাতে পারছেন না। এজন্য প্রয়োজন বাংলা ভাষা শিক্ষা। ১৮০০ সালে তারা কলকাতা লাল বাজারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রতিষ্ঠিত করেন তরুণ ইংরেজ সিভিলিয়ান কর্মচারীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য। এসময়ে বাংলা বিভাগের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন কেরী সাহেব।আর ইংরেজ সিভিলিয়ান কর্মচারীরা যাতে সহজে বাংলা শিখতে পারে এ উদ্দেশ্যে রচিত হতে থাকে বাংলা বই। এসমস্ত গ্ৰন্হের বিষয়বস্তু গল্পকাহিনী মূলক ও খৃষ্টান ধর্ম প্রচারমূলক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের দেশী ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে ওয়েলেসলী সাহেব এক আইন পাশ করেন।১৭৯৯ সালে ৩রা জানুয়ারী তিনি এ মর্মে এক বিজ্ঞপ্তি জারী করেন, ১৮০১ সালের ১ জানুয়ারীর মধ্যে দেশীয় ভাষা, আইন ও আচরণ জ্ঞান লাভ না করবে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। অথচ বাঙালীদের বাংলা শেখার প্রতি কোন জোর দেয়া তো দূরের কথা ইংরেজী না জানলে তাদের কোন প্রকারেই চাকরি দেয়া হতোনা।
ঘ। পাক -বাংলা ভাষা
১৯৪৭ সালে পূর্ব -পাকিস্তানে রূপান্তরিত হলো। বাংলা ভাষাকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে পশ্চিম বাংলা থেকে পৃথক করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। বাংলা ভাষাকে সংস্কার করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। বাংলা ভাষাকে সংস্কার করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শুরু হলো সংস্কৃতির আওতা থেকে বাংলাকে মুক্ত করা। অকাতরে আরবী -উর্দু শব্দ বসিয়ে মুসলমানী ভাষা তৈরি করা। এ উদ্দেশ্যে এক শ্রেণীর উৎসাহী লেখক অভিনব বাংলায় সরকারী পত্রিকায়, রেডিওতে এ ধরনের বাংলায় বিভিন্ন লেখা লিখতে আরম্ভ করলেন। মাসিক ‘মাহেনও’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বাংলা ভাষার বিকাশ সম্পর্কে লেখা হলোঃ বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল সকলকে স্বীকার করতেই হবে যে, শৈশবে বাংলা ভাষা মুসলমান বাদশাহ এবং শাহী দরবারের শান-শাওকাত হাসিল করেছিল। …….. সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের তাহজীব তমুদ্দুনের তায়াল্লুক বর্জিত বাংলা ভাষা মাশরেকি পাকিস্তানের মাতৃভাষা নয় এবং হবেনা হতে পারে না।’ কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি সেবিরা সে আদর্শ কায়েম করতে পারেনি। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দান করতে পাকিস্তানীরা বাধ্য হলেও তা কার্যে রূপান্তরিত করা হয়নি। এরপরও পাকিস্তান ওয়ালাদের কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৫৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত একটি সাহিত্য সম্মেলনে তারই প্রতিফলন ঘটে। এ সম্মেলনে গোলাম মোস্তফা জানালেন ‘বাংলা ভাষা -ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নয় , মূলত দারিদ্র ও সেমিটিক ভাষা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আজরফ বললেন তমুদ্দীন পূণর্গঠনের জন্য বাংলা ভাষাকে ফার্সীর মতো একটি আরবী ভাষায় পরিণত করতে হবে। ‘এতসব সম্মেলন আন্দোলনও সরকারের সহযোগিতার পরও পাক -বাংলা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে তারা সক্ষম হয়নি। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে সামরিক আইন জারী করলেন আইয়ুব খান। রাজনীতিতে তেমনি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তিনি চাইলেন তার ফ্যাসীবাদ আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ভাষার ক্ষেত্রে চেষ্টা হলো উর্দু ও বাংলাতে মিশ্রিত রোমান হরফের মাধ্যমে পাকিস্তানী ভাষা উদ্ভাবন করার। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ শুরু হলো চতুর্দিকে। প্রবল উৎসাহ ভরে বাঙালিদের পক্ষ থেকে শুরু হলো পয়লা বৈশাখ, এগারই জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি পালনের। স্থান, দোকানপাট, সিনেমা হলের নামকরণ শুরু হলো বাংলায়। স্থানের নাম হল বনানী, শ্যামলী, হ’লের নাম হল জোনাকি হংসঃ বলাকা ও দোকানের নাম হল সাগরিকা ইত্যাদি। এ সময়ের একটি জনপ্রিয় গানের কলি ছিল আবার তোরা মানুষ হ/ অনুকরণ খোলস ভেদি কায়মনে বাঙালি হ…….।
আন্দোলনে বুর্জোয়া ও সাম্যবাদীদের মিলিত প্রবাহ কাজ করে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। এর প্রবল বিকাশ ঘটে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে। আর এই আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে । অবসান ঘটে পাকিস্তানের একচেটিয়া পু’জির শাসনের।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে বাংলা। তবুও বিতর্ক চলে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে সম্ভব কিনা এ নিয়ে? কিন্তু কেন এই বিতর্ক?
বছরের পর বছর একটি বিষয়কে বিতর্কের অধীনে রেখে কোনো সমাধানে না পৌঁছা ক্লীবত্বেরই লক্ষণ। আমাদের দেশে এ নিয়ে উপরমহলে বহু দৃষ্টান্ত আছে। বাংলা ভাষার প্রচলন প্রশ্ন তারই একটি দৃষ্টান্ত।
সমাধান হয়ে যাওয়া প্রশ্নটিকে বারবার বিতর্কের মধ্যে আনার অপচেষ্টার আমরা ঘোর বিরোধিতা করি। জনগণের আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই -বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলিত হতে হবে। প্রচলিত হওয়ার পর যদি কোন সমস্যা উদ্ভূত হয় তবে তা নিয়ে আলোচনা হবে, সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হবে । বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন দেশে, এটি কঠিন কিছু নয়।
প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, এগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ নেই, নেই এগুলোর উপর কোন নিয়ন্ত্রন। সেজন্য এখনো সম্ভব হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত পরদেশী ভৃত্যদের আস্ফালন। যদি শিক্ষা সার্বজনীন চরিত্র লাভ করতো, যদি প্রশাসন জনগণের প্রশাসনের চরিত্র লাভ করতো তবে প্রশ্নের সমাধান এত জটিল হতো না। আমাদের জনগণ ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে প্রমাণ করেছেন তাদের ধারাবাহিকতা, স্পষ্টতা, আপোষহীনতা। সুবিধাভোগী পরশ্রমজীবী শ্রেণিই এর বিরুদ্ধে সমাজের গতিময়তাকে ঠেকিয়ে রেখেছে বিভিন্নভাবে। বাংলা ভাষাকে তালাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা সেজন্যই। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু হলে শাসকশ্রেণীর, সমাজের উপর মহলের আপাতঃ ভিন্নতা থাকেনা, এসব ক্ষেত্রে জনগণের প্রবেশাধিকার আসে, সেজন্যেই একে ঠেকিয়ে রাখা ।
আন্তর্জাতিক গতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার জন্য বিদেশী ভাষা প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্যে অফিসের ফাইলে, শিক্ষাক্ষেত্রের সর্বত্র বিদেশি ভাষার উৎকট চর্চার প্রয়োজন হয় না।
যারা ভৃত্য, তারা মুনিবকে অনুসরণ করলেও মুনিব হতে পারে না, ভৃত্যই থেকে যায়। এটি আমাদের বিজ্ঞ কর্তাদের মাথায় আসেনা।
একটি ভাষা কখনোই সেই ভাষাভাষী মানুষদের সামগ্রিক অস্তিত্ব থেকে ভিন্ন নয়। বাংলা ভাষার উন্নয়ন বাংলা ভাষাভাষীদের উন্নয়নের সঙ্গেই যুক্ত। ভাষার উন্নয়ন ভাষা চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভাষা চর্চা সম্পর্কিত ভাষাভাষীদের শিক্ষার সঙ্গে, জীবনের গতিময়তার সঙ্গে।
প্রশাসন, শিক্ষা, সামাজিক রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে জনগণের মধ্যে থেকে পরিচালিত না করতে পারলে আমাদের এ (অস্পষ্ট) জনপদের মুক্তি নেই। সেজন্যে – বর্তমানে দূরত্ব দূর করবার প্রাথমিক করণীয় হচ্ছে -মুখের ভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলনের। তারপরেই প্রয়োজন সে ভাষাকে বিস্তৃত করবার জন্য – চেতনাকে উন্মুক্ত করার জন্য গণশিক্ষা।
বর্তমান সমাজ কাঠামোর, শাসন পদ্ধতির সুবিধায় -জনগণের যে বিরুদ্ধ শক্তি এখনো সদম্ভ অবস্থান প্রতি পদে পদে আমরা টের পাচ্ছি -তাদের চিহ্নিত করা এবং নিশ্চিহ্ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সেজন্যে ভাষার ভূমিকার সঠিক রূপায়ন করতেই হবে। একইকারণে বাংলাভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলনের কোনো বিকল্প নেই। এখানে কোন দ্বিধার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের অস্তিত্বে, মাতৃভাষা বাংলা প্রকাশে যারা গর্বিত হতে পারেনা তারাই শুধু এর বিরুদ্ধতা করতে পারে, আর কেউ নয়।