You dont have javascript enabled! Please enable it!

৬-দফা প্রশ্নে কোন আপােষ নাই:
যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে দাবী আদায় করা হইবে
রাজশাহীর জনসভায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা

রাজশাহী, ১১ই এপ্রিল।–পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান আজ রাজশাহীতে এক বিপুল জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ঘােষণা করেন। যে, বিগত ১৮ বৎসর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সর্বক্ষেত্রে যে বঞ্চনামূলক আচরণ করা হইয়াছে, তার ফলে দেশবাসীর মনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছে। আওয়ামী লীগের ৬-দফার মাধ্যমে দেশবাসীর সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই অভিব্যক্তি ঘটিয়াছে। প্রদেশবাসী ৬-দফাকে তাদের মুক্তিসনদ বলিয়া আদৃত করিয়াছে। ৬-দফা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। তাই, ৬-দফা প্রশ্নে কোনরূপ আপােষ নাই। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে ৬দফাকে বাস্তবায়িত করাই আজ আওয়ামী লীগের সংগ্রাম। শেখ মুজিবর রহমান বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তার পাবনা সভার বক্তৃতার কথা উল্লেখ করিয়া রাজশাহীর জনসমাবেশে বলেন যে, কেন্দ্রীয় রাজধানী পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করিলে তিনি ৬-দফা প্রত্যাহার করিবেন বলিয়া যে সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা সঠিক নয়। তিনি বলেন যে, ৬-দফার যথার্থ প্রমান প্রসঙ্গে যুক্তি প্রদর্শন করিতে গিয়া আমি সেদিন বলিয়াছিলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তান, পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী করাচী, অন্তবর্তীকালীন রাজধানী রাওয়ালপিন্ডি এবং নির্মীয়মাণ। রাজধানী ইসলামাবাদ, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি সদর দফতর এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের সব কয়টি সদর দফতরের সুযােগ-সুবিধা লাভ করিয়াছে। এইসব সুযােগ-সুবিধা যদি গত ১৮ বৎসর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তান ভােগ করিত তবে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা ৬-দফার চাইতেও গুরুতর দফা লইয়া সংগ্রাম শুরু করিতেন। শেখ মুজিব বলেন যে, কোনকিছুর বিনিময়ে ৬-দফা। প্রত্যাহার করার প্রশ্ন উঠে না। কারণ, ৬-দফা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ৬দফা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অনুমােদন লাভ করিয়াছে, দেশবাসী ৬-দফাকেই তাদের মুক্তিসনদ বলিয়া আদৃত করিয়াছে ও স্বীকৃতি দিয়াছে। ৬-দফা আজ দেশবাসীর আশা-আকাংক্ষাকে, যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে ৬-দফা বাস্তবায়িত করাই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ৬-দফা বিনিময়যােগ্য বস্তু নহে। ৬দফা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। শেখ মুজিব আরও বলেন যে, ৬-দফা কর্মসূচী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ইহারই মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সর্বপ্রকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শােষণের বিরুদ্ধে জনগণের বিরামহীন সংগ্রামের দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত হইয়াছে।
শেখ মুজিব বলেন, ৬-দফা জাতির ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের সর্বময় কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দিয়া কায়েমী স্বার্থের চির অবসান এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির প্রতিশ্রুতি বহন করিতেছে। শেখ মুজিব ও তাহার সহকর্মীগণ দিনাজপুর হইতে সরাসরিভাবে এখানে আগমনের পরই ঈদগাহ ময়দানের জনসভায় উপস্থিত হন। তাঁহাদের বর্তমান উত্তরবঙ্গ সফরের প্রথম পর্যায়ের ইহাই ছিল সর্বশেষ জনসভা। কায়েদে মিল্লাতের নির্বাচনী সভার পর এইরূপ বৃহৎ জনসভা রাজশাহীতে আর অনুষ্ঠিত হয়। নাই। রাজশাহীর সকল শ্রেণীর মানুষ ৬-দফা কর্মসূচীর ব্যাখ্যা শ্রবণের জন্য এই বৃহৎ জনসভায় শরীক হইয়া ৬-দফার প্রতি তাঁহাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
৬-দফা কর্মসূচীর উদ্যোক্তাদের অন্তরঢালা অভিনন্দন ও স্বাগত জানাইবার উদ্দেশ্যে বিরাট জনতা ও তরুণদল প্রখর রৌদ্রের মধ্যে বেলা ১২টা হইতে বৈকাল… নেতৃবৃন্দের রাজশাহী পৌছিতে পাঁচ ঘণ্টা বিলম্ব হইলেও তাহাদের উৎসাহ বিন্দুমাত্র স্তিমিত হয় নাই। তাহাদের মােটরগাড়ী মিউনিসিপ্যাল হলের নিকটে পৌঁছিলে তরুণদল ও হর্ষোৎফুল্ল জনতা মুহুর্মুহু জিন্দাবাদ ধ্বনি সহকারে তাঁহাদিগকে এরূপ বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করে যে, ফুলের মালা রাখার জন্য মােটর গাড়ীগুলিতে স্থান সংকুলানও কষ্টকর হইয়া উঠে। বেলা পড়ার সাথে সাথে দলে দলে লােক সভাস্থলের দিকে যাইতে আরম্ভ করে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ময়দান ভর্তি হইয়া যায়। শেখ মুজিবর রহমান বক্তৃতামঞ্চে উপস্থিত হইলে উল্লসিত জনতা হর্ষধ্বনি ও পটকা ফুটাইয়া তাঁহাকে অভিনন্দিত করে।… কোন বিচ্যুতি বা আপোেষ চলিতে পারে না।

জনতা নেতৃবৃন্দকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। শ্রমিকদের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত মানপত্রে ছয়দফা বাস্তবায়নের মৃত্যুপণ সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মানপত্রের জবাবে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি শ্রমিকদের প্রতি ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানাইয়া বলেন যে, এই ত্যাগই তাহাদিগকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিবে।

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ এপ্রিল ১৯৬৬

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!