You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমরা জনগণেরই দালাল আর জনতার দরবারই শক্তিশালী আদালত
দিনাজপুরের বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা

(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)
দিনাজপুর, ১০ই এপ্রিল।আজ এখানে একবিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন যে, কাহারা দেশ ও জনগণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে, উহা বিচারের ভার জনগণের উপর। কেননা আদালতে তাহাদের বিচার হইতে পারে না। আপনাদেরও ভােটাধিকার নাই; আসুন, আমরা সবাই মিলিয়া ভােটাধিকার অর্জন করি।
শেখ মুজিব বলেনঃ আমি বিশ্বাস করি, জনসাধারণই প্রকৃত শক্তির উৎস এবং জনতার দরবারই আল্লার আদালতের পরে শক্তিশালী আদালত। তাই আপনাদের উপরই বিচারের ভার দিলাম, আপনাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।
শেখ মুজিবর রহমান ঘঘাষণা করেন যে, আমরা চীন বা আমেরিকা কাহারাে দালাল নই। আমরা আমাদের দেশবাসীরই দালাল। কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পােষণের প্রশ্নই আসে না। কারণ, আমরা জানি যে, নিজেদের শক্তি না থাকিলে কেহই আমাদের বন্ধু হইতে আসিবে না। এই দুনিয়া উপযুক্তেরই স্থান এবং আমরা কাহারও করুণার উপর নির্ভরশীল থাকিতে চাই না। আমাদের নিজেদেরই উপযুক্ত হইতে হইবে এবং নিজেদের শক্তিতেই বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। শেখ মুজিব বলেন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল শেরেবাংলা ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত দেশবরেণ্য নেতাকেও বিভেদ সৃষ্টিকারী বলিয়া আখ্যাদান করিয়াছিল। ইহা একটু অতি পুরাতন শ্লোগান। উহা আমরা পরােয়া করি না। তবে আমরা জানি, কিভাবে দাবী-দাওয়া স্বীকার করিয়া লইতে তাহাদের বাধ্য করা যায়। তুমুল করতালির মধ্যে শেখ মুজিব দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আমরা যে সংগ্রাম শুরু করিয়াছি, জীবনের বিনিময়ে হইলেও আমরা এই সংগ্রাম চালাইয়া যাইব। ৬-দফা দাবীর বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন, একদা লাহােরে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল। আর পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইবে, এই আশা লইয়া ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করার জন্য আমি লাহাের গিয়াছিলাম; কিন্তু আমার সেই আশা ব্যর্থ হইয়াছে।
শেখ মুজিবর রহমান দেশের শিল্প ব্যবস্থার সমালােচনা করিয়া দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছে। সুযােগ আসিলে আওয়ামী লীগ দেশের সকল শিল্প জাতীয়করণ করিবে।

রাত ৯টা পর্যন্ত জনসভা
সাধারণতঃ দিনাজপুরের জনসভা মগরেবের পর চালু থাকে না। কিন্তু আজিকার জনসভায় উল্লিখিত জনতা রাত নয়টা পর্যন্ত সভাস্থলে জমায়েত থাকে। অবশেষে সভার সমাপ্তি ঘােষণার পরও নারাজ, জনতা সভার কাজ চালু রাখার এবং আরও বক্তৃতা শ্রবণের দাবী জানাইতে থাকে। কিন্তু রাতেই নৃেতবৃন্দের সড়ক-পথে সােয়া দুইশত মাইল পাড়ি দিয়া রাজশাহী রওয়ানা হওয়ার কর্মসূচী থাকায় দিনাজপুরের উদ্দীপ্ত জনতার মুখর আগ্রহকে হতাশ করিতে হয়।

জনসভায় ভাষণদানকালে জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছয়দফার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন যে, ইহা বিগত ১৮ বৎসরের দুর্দশারই বহিঃপ্রকাশ।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী মাথাভারী শাসনব্যবস্থার সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, এই মাথাভারী শাসনের দরুন গােটা জাতীয় জীবনেই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করিয়াছে। জনাব চৌধুরী বলেন যে, দেশের উন্নয়ন খাতের ব্যয় কাহারাে ব্যক্তিগত আয় হইতে আসে না, জনগণের সম্পদ হইতেই ইহা সংগৃহীত হয়। জনাব খােন্দকার মােশতাক আহমদ বক্তৃতাকালে বলেন যে, পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ সবকিছুই উৎসর্গ করিয়াছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করে নাই।

রংপুর
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য নেতার আশু মুক্তির দাবীতে জেলা আওয়ামী লীগ দফতর সম্পাদক শেখ আমজাদ হােসেনের বাসভবনে সাতগাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ আমজাদ হােসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কারারুদ্ধ নেতাদের আশু মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা বলেন যে, জননেতাদের গ্রেফতার করিয়া দাবী-দাওয়া আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করা যায় না এবং যাইবে না। সভায় ৬-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন, খাদ্যদ্রেব্যের মূল্য হ্রাস, টেপাতা অর্ডিন্যান্স বাতিল ও জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের দাবী জানানাে হয়।

হাটহাজারী
সম্প্রতি হাটহাজারী থানার দক্ষিণ মার্দাশা সমিতির হাটে জনাব আবদুল লতিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এগার নম্বর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলনে ৬দফা আদায়ের শপথ গ্রহণ করিয়া অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয়, ৬-দফার সহিত পূর্ব পাকিস্তানীদের বাঁচা-মরার সম্পর্ক; সুতরাং এই দাবী আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম দাবী স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকিবে।

টাঙ্গাইল মােক্তার বার
টাঙ্গাইল মােক্তার বার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবর রহামনসহ দেশরক্ষা আইনে আটক সকল রাজনৈতিক নেতার আশু মুক্তির দাবী জানাইয়াছেন। বিবৃতিতে দেশরক্ষা আইনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করার নীতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানাে হয়।
তিনি তাহার বিবৃতিতে বলেন যে, নিজ কর্মসূচী জনসাধারণের নিকট পেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার সব কয়টি রাজনৈতিক দলেরই রহিয়াছে। শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার অন্যান্য সহকর্মীকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করায় আমরা। বিক্ষুদ্ধ। তাসখেন্দ ঘােষণার পর দেশে জরুরী অবস্থা অব্যাহত রাখার কোন প্রয়ােজনীয়তা নাই এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে দেশরক্ষা আইনের ব্যবহার একবারেই নিষ্প্রয়ােজন। বিবৃতিতে দেশে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখার খাতিরে সরকারকে আইনের অপব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানাইয়া অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী জনানাে হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ এপ্রিল ১৯৬৬

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!