৬-দফা আদায়ের জন্য সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান
সাতকানিয়া কোর্ট প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবের বক্তৃতা
(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)
সাতকানিয়া(চট্টগ্রাম), ২৭ শে মার্চ।-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান ৬-দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে দেশবাসীকে সত্যাগ্রহের জন্য প্রস্তত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আজ স্থানীয় মুন্সেফ কোর্ট প্রাঙ্গণে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করিতেছিলেন।
শেখ মুজিবর রহমান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রফিকুল হােসেন, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব এম. আর. সিদ্দিকী, সম্পাদক জনাব এম. এ. আজিজ এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের অপরাপর কর্মীদের সঙ্গে নিয়া বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময়। সাতকানিয়ায় পৌঁছেন। অধিক রাত্র পর্যন্ত সভা চলে এবং রাত্রি দশটায় শেখ মুজিব দলবলসহ চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন করেন।
চট্টগ্রাম জেলায় সাতকানিয়া এ যাবৎ কনভেনশন লীগের একটি প্রধান আড্ডা বলিয়া বিবেচিত হইত। কিন্তু এখন ৬-দফার স্পর্শ এখানেও লাগিয়াছে।
এবং শেখ মুজিবের আগমনকে উপলক্ষ করিয়া এখানকার গণতান্ত্রিক শিবিরে অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী কাজী আনােয়ারুল হকের গতকাল সাতকানিয়া সফরের কথা ছিল। মন্ত্রী মহােদয়ের বিপুল সম্বর্ধনা আয়ােজন প্রায় সম্পন্ন হইয়াছিল। আশেপাশে এলাকায় মন্ত্রীর আগমন বার্তা পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য বহু টাকা ব্যয়ে দিনরাত প্রচারও করা হইয়াছে। কিন্তু আকস্মিকভাবে মন্ত্রীমহােদয়ের সাতকানিয়া সফর বাতিল করিয়া দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নেতা সাতকানিয়া আগমনের ঠিক পূর্বদিন মন্ত্রীমহােদয় তার। সফরসূচী বাতিল করায় কনভেনশন মুসলিম লীগ মহলে হতাশার সৃষ্টি হয়। অপরপক্ষে আওয়ামী লীগ মহলে অধিকতর তৎপরতা ও উৎসাহের সৃষ্টি হয়।
শেখ মুজিবর রহমান সভায় ঘােষণা করেন যে, যদি পূর্ব পাকিস্তানীরা ৬-দফা দাবী আদায় করিতে ব্যর্থ হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়া সম্পূর্ণ গােলামে পর্যবসিত হইবে। ৬-দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি দেশবাসীকে সত্যাগ্রহ করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, যদিও দেশের দায়িত্বশীল মহল হইতে “গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ডাক পাওয়া গিয়াছে, তথাপি আমরা গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে রাজী নই। আমাদের সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম। আমাদের উপর আঘাত হানিলে আমরা প্রত্যাঘাত করিব না, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আঘাত সহ্য করিব। আমরা আঘাত করিব না, আমরা সত্যাগ্রহ করিব।”
৬-দফা দাবী কেন উত্থাপন করা হইল, এই প্রশ্নের দীর্ঘ ব্যাখ্যাদান করিয়া তিনি বলেন যে, আজ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। হিন্দু মহাজনী আমলে এদেশের মুসলমানদের যে দূরবস্থা হইয়াছিল, আজকের অবস্থা ঠিক তদ্রুপ দাঁড়াইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান দেশের ৭০ ভাগ বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে; কিন্তু শতকরা ৩০ ভাগ বিদেশী মুদ্রা এখানে ব্যয় হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের কোন অধিকার নাই। এইখানে ব্যবসা করিয়া দিনের পর দিন এখান হইতে মূলধন পাচার করিয়া ক্ষমতাসীন দলের কাপুরুষােচিত ও অসহনশীল মনােভাবেরই পরিচায়।
তিনি বলেনঃ ইরান ও আফগানিস্তানের মত একান্ত রাজতন্ত্রী দেশেও সার্বজনীন ভােটাধিকার দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনসাধারণ আজিও সে অধিকার হইতে বঞ্চিত। পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশে দুই অর্থনীতি প্রবর্তন, দেশের জনসাধারণকে দেশদ্রোহী আখ্যাদান হইতে বিরত থাকা ও সর্বপ্রকার দমনমূলক নীতি পরিহারের জন্য জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরীর প্রতি জোর দাবী জানান।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ মার্চ ১৯৬৬