You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.26 | ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ - সংগ্রামের নোটবুক

উনিশ’শ একাত্তর (১৯৭১) সালের ২৬ মার্চ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ

আসসালামু আলাইকুম।
এ মাসের ৬ তারিখে আমি জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের নতুন তারিখ ২৫ মার্চ ঘোষণা করেছিলাম। আমার আশা ছিল নির্ধারিত তারিখে অধিবেশন বসার পরিবেশ অনুকূল হবে। কিন্তু ঘটনাবলী সে আশা পূর্ণ করেনি। জাতি গভীর সংকট মোকাবেলা করে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছে এবং পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ঘটনাবলী খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে এবং যত শীগগির সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অবশ্যই জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এ উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আমার অনেকবার সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৫ মার্চ আমি ঢাকা গমন করি। আপনারা সকলে জানেন যে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনার পর একইভাবে সেখানে আলোচনার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, যাতে সর্বজন গ্রহনযোগ্য বিষয় চিহ্নিত করে একটি সমঝোতায় পৌঁছা যায়।
আমার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনার কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তা সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার আলোচনে একটি পর্যায়ে পৌঁছালে আমি প্রয়োজন মনে করলাম যে, ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা করা উচিত।

জেড এ ভুট্টো ২১ মার্চ সেখানে পৌঁছালে তার সাথে আমাদের একাধিক আলোচনা হয়। আপনারা জানেন আওয়ামী লীগের নেতারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানায়। আমাদের আলোচনাকালে তিনি প্রস্তাব করেন যে, অন্তর্বর্তী ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে হবে এবং জাতীয় পরিষদে দুটি কমিটি হবে- একটি কমিটি গঠিত হবে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের দ্বারা ঈবং আর একটি গঠিত হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের নিয়ে।
এই পরিকল্পনায় আইনগত ও অন্যান্য বিষয়ে গুরুতর অনিয়ম থাকা সত্ত্বেও শামতিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থে আমি নীতিগতভাবে একটি শর্তে এ প্রস্তাব গ্রহনের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমি শর্তগুলো শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলাম যে, সকল রাজনৈতিক দলের আমার সাথে এ পরিকল্পনায় ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। তারপর আমি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে প্রস্তসবটি নিয়ে আলোচনা করলাম। ঘোষণার কোন আইনগত ভিত্তি থাকবেনা- এ ব্যাপারে তাদের একমত পোষণ করতে দেখলাম। তাতে সামরিক আইনের আবরণও থাকবে না, অন্যদিকে জনগনের ইচ্ছার ভিত্তিতে করা হয়েছে- তাও বলা যাবেনা। ফলে এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং নিশ্চিত একটি গোলযোগপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তারা আরো মনে করেন যে, ঘোষণার দ্বারা জাতীয় সংসদকে দুইভাগ করলে তা বিভক্তিকে উৎসাহিত করবে। সুতরাং তারা মরপ্রকাশ করেন যে, যদি অন্তরবর্তীকালে সামরিক আইন প্রতযাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয় তাহলে জাতীয় সংসদ অধিবেশন ডাকতে হবে। অন্তর্বতীকালের জন্য সঠিক শাসনতন্ত্র বিল পাশ করে আনার সম্মতির জন্য পেশ করতে হবে। আমি তাদের মতের সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করেছি এবং তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
আমি নেতাদের তাকে বোঝাতে বলেছি যে, একটি পরিকল্পনা দ্বারা একদিকে আপনি সকল ক্ষমতা- তথা সামরিক আইন তুলে নিতে বলছেন, অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে জনগনের ইচ্ছের দ্বারা তা পূরণে ব্যর্থতার ফলে গোলযোগ সৃষ্টি হবে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং জাতীয় সংসদ থেকে সৃষ্ট ক্ষমতার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থায় তার সম্মতি আদায় করার জন্য চেষ্টা করবেন।
শুরু থেকে শেখ মুজিবের জাতীয় সংসদ কে দুই ভাগ করার প্রস্তাবে রাজনৈতিক নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা উপলব্ধি করেন যে, এ পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে যাবে। আমার, ভূট্টো এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনাকালে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান তার নিকট একটি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সেখানে নেতারা শেখ মুজিবের নিকট আলোচনার জন্য গিয়েছিলেন। তারা ২৩ মার্চ বিকেলে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে সংবাদ দেন যা, তার (শেখ মুজিব) পরিকল্পনার কোন পরিবর্তন করতেব তিনি সম্মত নন। তিনি আমার নিকট যা চেয়েছেন তা হল আমি ঘোষণা (Proclamation) দিয়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করি।
শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন হল দেশদ্রোহিতা। তিনি ও তার দল বৈধ কর্তৃপক্ষকে তিন সপ্তাহব্যাপী উপেক্ষা করেছে। তারা পাকিস্তানের পতাকাকে তিরস্কার করেছে এবং ব্জাতির জনকের ছবি কলঙ্কিত করেছে। তারা বিকল্প সরকার পরিচালনার চেষ্টা করেছে। তারা গন্ডগোল, ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
আন্দোলনের ফলে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মিলিয়ন মিলিয়ন বাঙালী ভাই এবং যারা পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করেছে তারা জীবনের ভয়ে সে অঞ্চল ত্যাগ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সকল প্রকার তিরস্কার ও টিটকারির শিকার হয়েছে। প্রচন্ড উস্কানি সত্ত্বেও তারা অসম্ভব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে- এজন্য তাদের আমি প্রশংসা করছি। তাদের শৃঙ্খলাবোধ বাস্তবিক প্রশংসার দাবী রাখে। আমি তাদের জন্য গর্বিত।
কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু আমি পরিস্থিতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি যাতে আমার শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা রুদ্ধ হয়ে না যায়। এ লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে আমি অবৈধ কাজ একের পর এক সহ্য করেছি। একই সময় একটি যুক্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছার জন্য সকল সম্ভাবনাময় পথের সন্ধান করেছি। আমি যে সকল চেষ্টা করেছি তা রাজনৈতিক নেতারা- যেমন মুজিবুর রহমানকে যুক্তি দেখাবার জন্য যা করছে তার উল্লেখ করেছি। আমরা কোন চেষ্টা অবশিষ্ট রাখিনি। কিন্তু তিনি কোন গঠনমূলক কাজে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে তিনি এবং তার অনুসারীরা সসরকারের কর্তৃত্বকে এমনকি ঢাকায় আমার উপস্থিতকালে উপেক্ষা করে আসছেন। তিনি যে ঘোষণার প্রস্তাব করেছেন তা একটি ফাঁদ ছাড়া কিছুই নয়। তিনি জানতেন, যে দলিল লেখা হবে তার কোন মূল্য নেই। তিনি জানতেন যে, সামরিক আইন তুলে নিলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে সেখানে কোন প্রকার শাস্তি ছাড়া তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। তার একগুঁয়েমি, দুর্দমনীয়তা এবং যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব এবং তা হল, এই লোকটি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি এদেশের সংহতি ও অখন্ডতাকে আক্রমন করেছেন। তার অপ্রাধের জন্য অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে। ক্ষমতালোভী একদল এবং দেশপ্রেমহীন নেতাদের এদেশকে ধ্বংস করতে এবং ১২০ মিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে দেওয়া যায়না।

৬ মার্চ জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্তব্য হল পাকিস্তানের সংহতি, অখন্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমি তাদের দ্বায়িত্ব পালনের এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছি। দেশে বিরাজমান সংক্টময় পরিস্থিতির কারণে আজ আমি সারাদেশে রাজনৈতিক কাজকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হল রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দলকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হল। আমি সংবাদপত্র সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছি। এ সকল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই সামরিক বিধি জারি করা হবে।
সর্বশেষে আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে আমার উদ্দেশ্য একইরকম বহাল থাকবে। যখনই পরিবেশ অনুকূলে আসবে তখন এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নব উদ্যোগ গ্রহন করব। আমি আশা করি শীগগির পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এবং আমরা পুনরায় আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে যাত্রা করতে পারব।
আমি আমার দেশবাসিকে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য অনুরোধ করেছি। এ জন্য পাকিস্তান বিরোধীরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দোষী। দেশের দ্বায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাজ করার জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি। কারণ সেখানে নিরাপত্তা ও যুক্তি নিহিত আছে।
খোদা সহায় হোক, খোদার আশীর্বাদ আপনাদের জন্য-
পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ” [বাংলা অনুবাদ]

[১৩৬]                               সিরাজউদ্দীন আহমেদ

রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত