You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪)

তাঁকে বলা হত বাংলাদেশের জন্মবেদনা সহ্য করেছেন তিনি। আর এ বেদনা সহ্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকে বাদ দিয়ে কখনোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পন্ন হবেনা। একটি জাতির নতুন দেশের জন্মের সঙ্গে অপর একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর শুধু কূটনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে জড়িয়ে যাওয়া নয়, হৃদয় দিয়ে জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিরল। ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে সে ঘটনাই ঘটেছিল।
বিরল এ মানুষটি ভারতের এক মহান পরিবারের সন্তান। এ পরিবারটির নাম কাউল পরিবার। যার চমৎকারত্তবর্ণনা আছে পিতা জওয়াহেরলাল নেহরুর আত্মজিবনিতে। নেহেরু পরিবারটি রাজনৈতিকভাবে সামনে চলে আসে জওয়াহেরলাল নেহরুর পিতা মতিলাল নেহেরু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর থেকে। এই পরিবারের রাজনৈতিকভাবে তৃতীয় অধযায় শুরু হয়, ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে।

ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ১৯১৭ সালে অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের সময়। তেমনি তার রাজনৈতিক জীবনও জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় বিপ্লবের সঙ্গে। আর এ বিপ্লবে তিনি তাঁর পাশে পেয়েছিলেন রুশ জনতাকে। এ যেন ইতিহাসের কাকতালীয় এক মহা যোগাযোগ। নিজ দেশের রাজধানীতে ইন্দিরা গান্ধীর বিচরণ ও ব্যাপ্তি বিশাল এলাকাজুড়ে। কিন্তু সে ইতিহাস তাঁর ও তাঁর দেশের মানুষের। বাংলাদেশের প্রিয় মানুষ ইন্দিরার ইতিহাস ১৯৭১ এর ইতিহাস।
১৯৭১ ছিল ভারতের এ তরুন নেত্রীর জন্য এক কঠিনতম বছর। কারন এ বছর তাঁকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে হয়েছিল দেশের তরুনতম নেতা ও বামপন্থীদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে। সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের এই আদি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত তরুনদের নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর দলের এ সময়ের নির্বাচনে অন্তত সে দেশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একটি শ্লোগানের কথা মনে রাখতে হয়, সেখানে শ্লোগান উঠেছিল, ইন্দিরা-মুজিব যুগ যুগ জিও।
এ নির্বাচনে জিতে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা হন তিনি। বলা যেতে পারে তাঁর সেদিনের ওই নির্বাচনে জয়লাভ ও সংসদীয় দলের নেতা হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ঘটনা। কারন ওই নির্বাচনে ভারতে যদি আদি কংগ্রেস বা রক্ষণশীলরা জয়লাভ করত তাহলে হয়ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে সাহায্য পেয়েছিল সেটা পেত না। কারণ ওই রক্ষণশীলরা ছিল রাজনৈতিকভাবে আমেরিকার সমর্থক। তাই স্বাভাবিকভাবে তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াত না। আমেরিকার মত তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা না করলেও একটা সেক্যুলার দেশ গড়ায় নিঃস্বার্থ ত্যাগ স্বীকার করত না। এজনয বলা যায় ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন মিলে যেমন এক বিরাট ঐতিহাসিক দিন তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর সংসদীয় দলের নেতা হওয়াও একটা বড় ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৮ মার্চ মন্ত্রীসভা গঠন করার মাত্র ৯ দিন পর ইন্দিরা গান্ধী পালন করেন বাংলাদেশের সপক্ষে তার ঐতিহাসিক সেরা দ্বায়িত্ব। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার মাত্র ১ দিন পরে অর্থাৎ ২৭ মার্চ সে দেশের পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি সমর্থন করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। তাঁর এ সমর্থনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ওই মূহুর্তে পৃথিবীতে আর একা থাকেনা। মাত্র ২৪ ঘন্টার ভিতর ভারতের মত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ানোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নতুন প্রাণ পায়। এ দ্বশের নেতারা দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যার একটি ছিল প্রবাসে সরকারের জন্য একটা আশ্রয়। দেশের ভিতর থেকে যে এ সরকার টিকে থাকতে পারতনা তা নয়। কিন্তু তারপরেও এটা ঠিক, সীমান্তে আশ্রয় পেয়ে সেদিন অনেক সুবিধা হয়েছিল। আর এপ্রিলের ১০ তারিখে বাংলাদেশ সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতাকে অস্বীকার করার কোন পথ নেই।

সরকার গঠন করার পরে ওই সরকারের অধীনে প্রায় এক কোটি মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নেয়। এ বিপুল সংখ্যক শরনার্থীর বোঝা সেদিন ভারত সরকারকে বইতে হয়েছিল। জনসংখ্যার ভারে পীড়িত একটা দেশের জন্যে এ বিপুল শরনার্থীর বোঝা বহন করা সত্যিই কঠিন ছিল। এটা কেবল সম্ভব হয়েছিল ইন্দিরার আন্তরিকতা ও নেতৃত্বের কারণে। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ভারতের জনগণ সেদিন শরনার্থী ট্যাক্স দিতে রাজি হয়। এ ট্যাক্স তাঁদের ৫ বছরের বেশি সময় ধরে দিতে হয়। ভারতের মানুষের অন্য একটি দেশের জন্য এ আত্মত্যাগে রাজি করানো সম্ভব হয়েছিল কেবল ইন্দিরা গান্ধীর মানবদরদি আহবানের কারণে। এবং বাংলাদেশের সমস্যাকে তিনি ভারতের মানুষের একেবারে হৃদয়ের গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলে তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ এক ভাষণে বলতে পেরেছিলেন ‘পূর্ব বাংলার সমস্যা ভারতের মানুষের সমস্যা।’
ভারতের মানুষকে তিনি যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছিলেন, তেমনি তিনি একাত্ম করতে সমর্থ হয়েছিলেন সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে। আর এ কাজে তিনি আদৌ অগোছালোভাবে এগোননি। তৎকালীন দুই পরাশক্তির বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে। ইন্দিরা গান্ধী তাই আগস্টের ৯ তারিখ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করেন ২০ বছরের শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি। এ চুক্তির ফলে শুধু মানসিকভাবে নয় সামরিকভাবে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী অবস্থানে আসে। যার ফলে আমেরিকা-চীন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা কোরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, তারা অনেকটা হাত গোটাতে বাধ্য হয়।
ইন্দিরার এ কূটনীতির কাছে একের পর এক মার খেয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাএক পর্যায়ে এ মহীয়সী নারীকে ‘দ্যাট উম্যান’ বলে গালি দেয়। জওয়াহেরলাল নেহেরুর মেয়ে, রবীন্দ্রনাথ ও হ্যারল্ড ল্যাস্কির ছাত্রী ইন্দিরা এর উত্তরে বলেন, কারো সম্পর্কে ভাষা ব্যবহার তার শিক্ষা ও পারিবারিক কালচারের বিষয়। পরবর্তীকালে সৈয়দ মুজতবা আলী অবশ্য ইয়াহিয়া খানের পারিবারিক পরিচয় দিয়েছেন। ইয়াহিয়া খান বংশগতভাবে কিজিলবাস। কিজিলবাসরা হচ্ছে রাজদরবারের জল্লাদ। তাই জল্লাদ হিসেবে তার ভাষা ঠিকই ছিল।
বাংলাদেশে পরাজয় যখন ইয়াহিয়ার কাছে ক্রমে পরিষ্কার হতে চলেছে এ সময় ইয়াহিয়া তার বড় অস্ত্রটি হাতে নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপন বিচারে ফাঁসি দেয়ার উদ্যোগ নেন। এ ঘটনা জানতে পেরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম চিঠির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতা কামনা করেন বঙ্গবন্ধুর এ প্রহসনমূলক বিচার বন্ধের জন্য। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে ও তারবার্তা পাঠিয়ে ইয়াহিয়াকে বলেন এ বিচার বন্ধ করতে।
এরপর সময় যত এগিয়ে চলে ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পারেন তার জন্য একটা কঠিন সিদ্ধান ত নেবার সময় এগিয়ে আসছে। আর সেটা হচ্ছে সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এইজন্যে প্রথমেই যে দরকার বিশ্বজনমত সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়না দূরদর্শী ইন্দিরার। তাই তিনি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এই তিনমাসের একটা বড় সময় ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন।

এ সফরে তিনি ২৭ অক্টোবর প্রথমে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সফল সফরের পর গুরুত্বপূর্ণ সফর ছিল ইন্দিরার জন্য ২৪ অক্টোবর থেকে তিন সপ্তাহের ইউরোপ ও আমেরিকা সফর। ইন্দিরা গান্ধীর এ সফর বিশ্ব কূটনৈতিক ইতিহাসের এক মাইলফলক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলার নিপীড়িত মানুষের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার এক ঐতিহাসিক সফর। তাঁর এ সফরের ভেতর দিয়ে বিশ্ব জনমত বাংলার মানুষের পক্ষে একাট্টা হয়ে যায়। অসহায় অ প্রায় একঘরে হয়ে পড়ে পাকিস্তান। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ নেয়া তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক চীন ও মুসলিম বিশ্বের কিছু আমেরিকাপন্থী দেশ ছাড়া সেদিন আর কেউ পাকিস্তানের পক্ষে থাকেনা।
বিশ্ব জনমত হারিয়ে অসহায় পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত হিংসার পথ বেছে নেয়। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ৪ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পূর্বখন্ডে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে যুদ্ধ শুরু করেন।
৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশটির জন্য সেটাই ছিল প্রথম স্বীকৃতি। এরপরে মাত্র ১৪ দিনের যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
আর এ ১৬ ডিসেম্বর আমেরিকার গ্যালপ পোলের অভিমত অনুসারে বিশ্বের সর্বাধিক প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব হন ইন্দিরা গান্ধী।
এরপর গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে বহু টানাপোড়েন গেছে। তাঁর দেশে জেগে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। আর তারই ছোবলে নিজ দেহরক্ষীর হাতে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রাণ হারান।

[৭৩]                   স্বদেশ রায়

 

রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত