You dont have javascript enabled! Please enable it!

আগরতলা

আগরতলা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় রাজ্য। রাজন্য শাসিত ছিল স্বাধীন ত্রিপুরা কয়েক শতাব্দী ধরে। বঙ্গ ও বাঙ্গালীর সাথে ত্রিপুরার ছিল ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এমনকি বঙ্গেও যখন সরকারি ভাষা হিসেবে বাঙলার প্রচলন হয়নি তখনো ত্রিপুরার সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। এছাড়াও ত্রিপুরা ছিল স্বাধীন ভারতের স্মৃতিধন্য। ১৯৭৪ সালে বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা চলে যাবার পর ভারতের সাথে অঙ্গীভূত হয় ত্রিপুরা।
ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, ত্রিপুরাকেও ঠিক সেভাবে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজ্যের ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৮৩৯ কিলোমিটার বাংলাদেশের সঙ্গে। বাকি ৫৭ কিলমিটার আসাম ও ২১ কিলোমিটার মিজোরামের সঙ্গে।
আগরতলা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত সমর রাজধানী। ঢাকার খুব কাছে বলে এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ত মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ খবর। আগরতলা ছিল এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ‘ডেটলাইন’। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এই আগরতলাতেই পত্তন ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের। সেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।
২৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার বুকে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা নির্বিচারে বাঙালী নিধন শুরু করলে প্রথমত ঢাকা এবং পরে অন্যান্য শহর ও গ্রামগঞ্জ থেকে জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার ভয়ার্ত মানুষ দেশ ত্যাগ করে। পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যা থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিকতবর্তী ভারতীয় মাটিতে আশ্রয় নেয় মানুষ। বাঙালী শরণার্থীদের প্রথম ধাক্কা সামলাতে হয় আগরতলা তথা ত্রিপুরাকে।
এক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে, ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দহন কতটা ভোগ করেছিল। ১৯৭১ সালে এই ক্ষুদ্র রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৬ লক্ষ। কিন্তু অক্টোবর মাসেই ত্রিপুরায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৩.৪২ লক্ষ। পরের মাসগুলোতে এই সংখ্যা বেড়ে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সমান কিংবা তারও বেশি হয়। আগরতলা ও ত্রিপুরার প্রতিটি স্কুল-কলেজ মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধ ছিল। রাজ্যের প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজ, সরকারি অফিস-আদালত এবং ঘরবাড়িতে পর্যন্ত ঠাঁই করে নিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। বিপদের দিনে সত্যিকার বন্ধু-আত্মীয়ের মত ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষকে আগলে রেখেছিল সেদিন।
আগরতলা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এরপর তারা কলকাতাসহ অন্যান্য জায়গায় পাড়ি জমায়। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কর্মকান্ডেরও অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রাথমিক আশ্রয় পেয়েছিলেন আগরতলা তথা ত্রিপুরায়। ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ে পাহাড়ে গড়ে উঠেছিল শরণার্থী শিবির। মুক্তিবাহিনীর কয়েকডজন প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে উঠেছিল আগরতলা ও রাজ্যের পাহাড়গুলোতে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উদার সাহায্য সহযোগীতায় এই শিবির গুলো থেকেই বাঙালী গেরিলা যোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আগরতলা যুক্ত হয়েছিল আরেকটি প্রসঙ্গেও। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার প্রবল জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কিছু শীর্ষ বাঙালী সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে শুরু করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। পাকিস্তানীরা অভিযোগ আনে, গোপনে আগরতলাতে গিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন, স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু দেশের মানুষ তথাকথিত সেই ষড়যন্ত্র মামলাকে গ্রহন করেনি। বরং এরপর থেকেই পাকিস্তানবিরোধী গণ-আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।

[১৫১]     হারুন হাবীব

রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!