You dont have javascript enabled! Please enable it!

পায়ে পায়ে কাঁটা ফোটে ফোটা ফোটা রক্ত ঝরে

ফুটে ওঠে ঝাকে ঝাকে রক্তগােলাপ

অস্ত্রসহ ৪৫ জন রাজাকারের আত্মসমর্পণ পুরনাে ঢাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে মুক্তিযােদ্ধারা গত কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় ঢাকা শহরের এক বিরাট অংশ মুক্ত করতে সক্ষম হয়। গত পক্ষকালের মধ্যে ঢাকা শহরে গেরিলারা বিরতিহীন আক্রমণ চালিয়ে পুলিশ ও মিলিটারীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এখন শহরের পুরাতন অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ী মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। বীর মুক্তিযােদ্ধারা খােদ ঢাকা শহর সহ ডেমরা শিল্প এলাকার বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা বিকল করে দিতে সক্ষম হয়। এছাড়া বহুস্থানে রেলসেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ প্রদেশের অন্যান্য শহরের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । 

মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রগতি ও সাফল্যের আরও চমকপ্রদ সংবাদ মুজিবনগরে এসে পৌচেছে। মুক্তিযােদ্ধারা খােদ ঢাকা শহরের প্রধান পাওয়ার ষ্টেশনের চারটির মধ্যে তিনটি জেনারেটর ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ অঞ্চলে নেমে এসেছে অন্ধকার, জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে এবং ঢাকা শহরের সমস্ত শিল্প-কারখানা অচল হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। ছাড়া অন্যান্য সমগ্র এলাকা মুক্তিফৌজ নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ১১ই নভেম্বর ঢাকার নিউ মার্কেটের মধ্যে এক বােমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়। বিস্ফোরণের ফলে একটি মােটর ধ্বংস হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম হাতিয়া এবং সন্দ্বীপ থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে এবং এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা তৎপরতা আরও জোরদার করা হয়েছে। গেরিলারা শহর ও শহরতলীর বিপুল সংখ্যক পাক দালালকে খতম করতে সমর্থ হয়। পাকসেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। খুলনা শ্যামনগর থানার কৈখালী নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের এক সংঘর্ষ ঘটলে ২ জন পাকসেনা সহ ৬ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা জখম হয়। মােল্লারহাট থানার চারকুলিয়া গ্রামের সন্নিকটে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালালে ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ১২জন হানাদার নিহত হয়। এছাড়া পাঞ্জাবী পুলিশ ও রেজাকার মিলিয়ে ৫৪ জন মারা যায়। বাকী সকল হানাদার পালিয়ে যায়। এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা বহুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। গত ২৫শে। অক্টোবর ঐ একই স্থানে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে ১৫৩ জন হানাদার পাকসেনা খতম করে এবং ৪৫ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

ফরিদপুর। ফরিদপুর জেলার ভাটিয়া পাড়া এলাকায় মুক্তিবাহিনী এক আক্রমণ চালিয়ে ১৭জন পাঞ্জাবী পুলিশ হত্যা করে। ভেদরগঞ্জ থানায় এক আক্রমণ চালিয়ে বীর মুক্তিযােদ্ধারা পাঞ্জাবী পুলিশ ও পাক দালালসহ ৮ ব্যক্তিকে হত্যা করে। ডুমুরিয়া-থানায় এক আক্রমণ চালিয়ে একজন মেজরও একজন ক্যাপটেন সহ ৭২ জন পাঞ্জাবী পুলিশ খতম করে। মােকসেদপুর থানার অপর এক আক্রমণে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৭২ জন পাক সেনা নিহত হয় এবং এ ছাড়া ১৭জন রাজাকার খতম হয়। গােপালগঞ্জ মহকুমার ফাকুরা নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী এক আক্রমণ চালিয়ে ৮৩ জন পাঞ্জাবীসেনা খতম করে এবং এ ছাড়া বহু পাঞ্জাবীসেনা জখম হয়। এই সংঘর্ষে ১৫ জন রাজাকারও নিহত হয়। রংপুর রণাঙ্গনের ডিমলা, নিলফামারী এবং ডুমার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছ। বন্দুরা এবং ফুলছড়ি ঘাটের মধ্যে মুক্তিবাহিনী একটি সামরিক ট্রেন উল্টে দিতে সমর্থ হয়, ফলে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়, ডিমলায় এক গেরিলা আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা এবং কিছু রাজাকার নিহত হয়েছে। টাঙ্গাইল আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল জেলা থেকে পাকসেনাদের হটিয়ে  দিয়েছে। পাবনা জেলার রায়গঞ্জ থানা পর্যন্ত টাঙ্গাইলের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারিত হয়েছে এবং দক্ষিণে সম্প্রসারিত হয়েছে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ থানা পর্যন্ত। ঢাকা ও টাঙ্গাইলের মধ্যে রেল সংযােগও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কুমিল্লা। সিমপুরের কাছে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ২ জন শত্রুসেনাকে খতম করে এবং আরও ১৪জনকে জখম করতে সমর্থ হয়। কোতয়ালী থানার কোটেশ্বর এলাকায় শক্র ছাউনির উপর মর্টার আক্রমণ চালিয়ে ২ জন পাকসেনাকে খতম করা হয় এবং আরও তিনজনকে আহত করা হয়। নয়টি থানা মুক্ত ময়মনসিংহ মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা কিশােরগঞ্জ মহকুমার ১২ থানার মধ্যে ৯টি থানা পাক হানাদারদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এই আক্রমণ চালিয়ে ১১৭টি রাইফেল ও বহু গােলাবারুদ দখল করতে সক্ষম হয়। সিলেট বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে সিলেট জেলার গােয়াইন এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে ২৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং বহু পাকসেনাকে জখম করে।

স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে বরিশাল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বীর মুক্তিযােদ্ধারা হিজলা থানা আক্রমণ করে ফলে ৭ জন পাঞ্জাবী পুলিশ। ও ৮জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা হিজলা থানা থেকে ৩০টি রাইফেল উদ্ধার করে। ঐ একই দিন মুলাদী থানা আক্রমণ করা হলে থানার কর্মচারীরা মুক্তিবাহিনীর কাছে ৪০টি রাইফেল এবং ২১শত রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করে। মুলাদী থানার ৩জন রাজাকারকে গ্রামবাসীগণ পিটিয়ে হত্যা করে। আমাদের রণাঙ্গণ প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে বরিশাল জেলার প্রতিটি মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উডডীন আছে। | অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে তুষখালী থানায় আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকারকে বন্দী করা হয়। থানা থেকে বেশ কিছু সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এখানকার সরকারী গুদাম থেকে খাদ্য শস্য উদ্ধার করে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ। করে দেয়। যশাের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী যশােরের সাচানাঙ্গা এলাকায় অতর্কিত আক্রমণ চালান। এই আক্রমনীকে পাকিস্তানী সৈন্যদল মর্টার আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। পরে হানাদার বাহিনী পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ৩ জন পশ্চিমা সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী এখানে গােলাবারুদসহ ৩টি চীনা রাইফেল হস্তগত করে। মুক্তিবাহিনী বাগডাঙ্গা এলাকায় টেলিফোন তার ও খুটি বিনস্ট করে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে।  চীনা রাইফেল উদ্ধার গত ৮ই নভেম্বর মাশালাতে মুক্তিযােদ্ধারা একটি সামরিক জিপ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে। ধলাইতে পাক | টহলদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ২৫ জন শত্রুসেনা নিহত এবং কিছু সংখ্যক | গুরুতররূপে আহত করে।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ( ১ : ১৩

৪ নভেম্বর ১৯৭১।

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!