আওয়ামী লীগ কাউন্সিল শেষে পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিব : কোন হুমকিই জনসাধারণকে ৬-দফা দাবী হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিবে না
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
ছয়-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশবাসীকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে।’ গতকল্য (রবিবার) অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত অর্ধলক্ষাধিক লােকের একবিরাট সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান উপরােক্ত আহ্বান জানান। সমাবেশে ছয়দফা কর্মসূচী বিশ্লেষণ। প্রসঙ্গে জনাব শেখ মুজিব বলেন যে, কেবলমাত্র শক্তিশালী কেন্দ্র নহে, পাকিস্তানের উভয় অংশকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে দেশের ভিত্তি সুদৃঢ় হইতে পারে। মুজিব ঘােষণা করেন যে, কোন হুমকি, কোন ভীতিই জনসাধারণকে তাহাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন হইতে বিরত করিতে পারিবে না।
গতকল্য আওয়ামী লীগের আহ্বানে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতা করেন আওয়ামী সভাপতি জনাব শেখ মুজিবর রহমান ও প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহিরুদ্দীন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবের ছয়-দফা কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানানাে হয়। বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সভার কাজ সংক্ষিপ্ত করিতে হয়। জনসমাবেশে বক্তৃতাকালে শেখ মুজিবর রহমান একের পর এক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টের সমালােচনার জবাব প্রদান করেন এবং জনসাধারণকে ছয়-দফা কর্মসূচী অর্জনে যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইবার আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের উভয় অংশকে সমভাবে শক্তিশালী করার আহ্বান জানাইয়া জনাব শেখ মুজিব বলেন যে, কেবলমাত্র শক্তিশালী কেন্দ্র নয়, দেশের উভয় অংশকে শক্তিশালী করিতে হইবে। ইহার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব শেখ মুজিব বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসের যুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে, শক্তিশালী কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান “সম্পূর্ণরূপে বিছিন্ন এবং অসহায় হইয়া পড়িয়াছিল।
পাকিস্তানের উভয় অংশকে সমভাবে শক্তিশালী করার আহ্বান জনাব জানাইয়া জনাব শেখ মুজিব বলেন যে, কেবলমাত্র শক্তিশালী কেন্দ্র নয়, দেশের উভয় অংশকে শক্তিশালী করিতে হইবে। ইহার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব শেখ মুজিব বলেন বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে, শক্তিশালী কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন এবং অসহায়” হইয়া পড়িয়াছিল।
তিনি বারংবার প্রশ্ন তুলিয়া ধরেন, কেন তাহা হইলে পূর্ব পাকিস্তানকে এই জাতীয় সংকটের সময় সাহায্য করা যায় না, কেন তাহা হইলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় পরিষদে এই উক্তি করিয়াছিলেন যে, চীনের জন্যই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা পাইয়াছে। কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার কথা তাহা হইলে খাটে কি করিয়া? পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কখনও পশ্চিম পাকিস্তান কিম্বা বিদেশের উপর নির্ভরশীল হইতে পারে না বলিয়া তিনি দৃঢ়মত প্রকাশ করেন।
শেখ সাহেব দৃঢ়তার সহিত পুনরুল্লেখ করেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলকেই প্রতিরক্ষাসহ সকল দিক হইতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিতে হইবে।
তিনি বলেন, ৬-দফাতে একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও শক্তিশালী পাকিস্তানের পরিকল্পনা তুলিয়া ধরা হইয়াছে। ৬-দফা কর্মসূচী যাঁহারা তৈরী করিয়াছেন, তাহারা পাকিস্তানকে বিভক্ত করিতে চান বলিয়া যে অভিযােগ করা হইতেছে, তিনি তাহা নাকচ করিয়া দেন। তাঁহারা বৃহত্তর বাংলার পরিকল্পনা করিতেছেন বলিয়া যে অভিযােগ করা হইতেছে, তিনি তাহাও নাকচ করিয়া দেন। “আমি এই ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরুল্লেখ করিতে চাই যে, স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমরা যুক্ত বাংলা এবং আসামকে পাকিস্তানের অন্তভূক্ত করিতে চাহিয়াছিলাম” বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি দুঃখ করিয়া বলেন যে, অতীতে ইহার দরুন জনাব এ, কে ফজলুল হক, জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকের ন্যায় বরেণ্য নেতাদের বিশ্বাসঘাতক রুপে আখ্যায়িত করা হয়।
তিনি আরও বলেন, “জনসাধারণ যখনই তাহাদের অধিকার সম্পর্কে কিছু দাবী-দাওয়া উত্থাপন করিয়াছেন তখনই তাহাদের রাষ্ট্র বিরােধী ব্যক্তি নামে আখ্যায়িত করা হইয়াছে।
ইহা জনসাধারণকে তাহাদের দাবী-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম হইতে বিরত করিতে পারে নাই। অতীতের কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, বাংলাকে। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যখন দাবী জানানাে হইয়াছিল, তখনও অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছিল।
তিনি বলেন যে, ৬-দফা কর্মসূচীর উপর দেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নির্ভর করিতেছে। ইহাকে তিনি পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জনগণের ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলিয়া আখ্যায়িত করেন।
শেখ মুজিব বলেন, ৬-দফা কর্মসূচীতে জনগণের আশা ও আকাক্ষার সন্নিবেশ ঘটিয়াছে।
তিনি তাঁহার ৬-দফা কর্মসূচীর সমর্থনে রাশিয়া ও কানাডার শাসনতন্ত্র হইতে ঘন ঘন উদ্ধৃতি করেন।
তিনি বলেন, ফেডারেটিং ইউনিটের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর প্রস্তাব উত্থাপন আদৌ অস্বাভাবিক নয়। দেশে পূর্ব হইতেই এই ধরনের রেঞ্জার্স ইউনিট পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী রহিয়াছে। উপরন্তু ভৌগােলিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তা রক্ষাকল্পে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবীদার বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।
শেখ সাহেব বলেন, ফেডারেটিং ইউনিট যে বিদেশের সহিত বাণিজ্য করিয়া থাকে এবং এমনকি বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধিদলও প্রেরণ করেন, তাহার নজীর রহিয়াছে।
৬-দফাতে অন্যান্য যেসব প্রস্তাব রহিয়াছে সেগুলি হইতেছে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার এবং আইন পরিষদের সার্বভৌমত্ব বলিয়া তিনি জানান।
সংবাদ, ২১ মার্চ ১৯৬৬